মধ্যযুগীয় রান্নার পুঁথি—নিমত্‌নামা ● অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

মধ্যযুগীয় রান্নার পুঁথি—নিমত্‌নামা
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

কটি বিশেষ গুণের জন্য বহুপরিচিত একজন মানুষ যদি সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে পারদর্শী হন, তবে অবাক হতেই হয়। আর যদি সেই মানুষটা দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা হন, তাহলে তো কথাই নেই। শাসকের কাজ শুধু শাসন ত্রাসন। তিনি যদি বিপরীত দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য কাজে মন দিয়ে ফেলেন, যে কাজটা আদৌ তাকে সাজে না, তবে যেটা হয়, তার প্রমাণ হলেন মহম্মদ ঘিয়াসুদ্দিন শাহ, যাকে ইতিহাস ঘিয়াত শাহ্‌ বলে চেনে।

চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে দিল্লিতে সুলতানি শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। মালব্য অঞ্চল (বর্তমানের মধ্যপ্রদেশ) ছিল সুলতানদের দখলে। দিল্লির সুলতানি শাসনের দুর্বলতার সুযোগে সেখানকার রাজ্যপালক নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে দিল্লি শাহি দরবারের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন। তারপর মালব্য দেশের পরিধি বাড়তে থাকে। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সুলতান মহম্মদের মৃত্যুর পর মালব্যের ক্ষমতায় আসেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র ঘিয়াসুদ্দিন। মালব্যের রাজধানী ছিল মান্ডুতে। পিতার জীবদ্দশাতেই ঘিয়াসুদ্দিনের সমর কুশলতার কারণেই মালব্যের সম্প্রসারণ সম্ভবপর হয়। যুদ্ধে পারদর্শিতা ছাড়াও তাঁর আর একটি গুণ ছিল— তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক।

মসনদে বসেই তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র নাসির শাহ্‌কে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করে ঘোষণা করেন— পঁয়ত্রিশ বছর পিতার রাজ্য সুরক্ষিত রাখতে তিনি অনেক ঘাম ঝরিয়েছেন, কাজেই তাঁর বিশ্রাম দরকার। রাজ্যপাট অনেক বিস্তৃত হয়েছে। যুদ্ধ টুদ্ধ করবার আর প্রয়োজন নেই। রাজ্যের প্রজাদের মনে ও জীবনে শান্তি কায়েম রাখাই তাঁর রাজ দরবারের প্রধান উদ্দেশ্য।

রাজপাট থেকে নজর ঘুরিয়ে সুলতান ঘিয়াত শাহ্‌, শাহি রান্নাঘরের তদারকিতে মন দিলেন। তিনি নিজেও অত্যন্ত ভোজন রসিক ছিলেন। নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তিনি বিভিন্ন পদ বানানোর নির্দেশ দিতে শুরু করলেন নিয়মিত। অসাধারণ সেই সব পদ যাতে কালের গ্রাসে হারিয়ে না যায়, সেইজন্য তিনি হাতে লেখা রান্নার প্রক্রিয়ার একটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল লেখান, নাম দেন— “নিমত্‌নামা”। আরবি ভাষায় নিমত্‌ শব্দের অর্থ হল— সুস্বাদু খাবার। পাণ্ডুলিপি লেখা হয় আরবি লিপিতে, চমৎকার হস্তাক্ষরে। যদিও বইটির ভাষা ছিল উর্দু ও ফার্সির সংমিশ্রণ। শাহি দরবারের তাবড় তাবড় অঙ্কন শিল্পীদের দিয়ে সুন্দর ছবি এঁকে বইটিকে অলংকৃত করা হয়। সব ছবিতেই সুলতানের সক্রিয় ভূমিকার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। তবে সুলতান নিজে হাতে যে রাঁধতেন না, বিশেষজ্ঞরা তেমনই মনে করেন। সুলতান বলে কথা, তাঁর কি আর হাতা খুন্তি ধরা মানায়! এই বইটি আরও বর্ধিত ও সংশোধিত করেন তার পুত্র নাসির শাহ্‌।

 

 

সুলতান ঘিয়াত শাহ্‌ প্রয়াত হলে শাহ্‌ রাজবংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর মালব্যের রাজপাটে অনেক হাতবদল হয়। মোগল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন সম্রাট আকবর। খুব সম্ভব সম্রাট আকবরের সেনারা মালব্য বিজয়ের সময় কেল্লা থেকে অন্যান্য মূল্যবান জিনিস লুট করবার সময় বইটি হস্তগত করে। হাতে লেখা সেই পাণ্ডুলিপি আবার মোগল দরবার লুঠ করবার সময় ইংরেজদের হাতে আসে। তারা বইটিকে সযত্নে ব্রিটিশ লাইব্রেরির সংগ্রহশালায় রেখে দেয়। সুদীর্ঘকাল বইটির হদিস পর্যন্ত কেউ জানত না। অজ্ঞাত হয়েই ব্রিটিশ লাইব্রেরীর এক কোণায় পড়েছিল এই বহু মূল্যবান বইটি। ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে যোগ দেন একজন ব্রিটিশ পণ্ডিত— নোরা টিটিলে। তিনি বইটিকে খুঁজে পান। ভদ্রমহিলা ছিলেন আরবি ও ফার্সি ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ। ১৯৮৩ সালে ব্রিটিশ লাইব্রেরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বইটি অনুবাদ করেন ইংরেজিতে। প্রচারমাধ্যমের নজর পড়ে নোরার অনুবাদ করা বই— The Nimatnama Manuscript of Sultans of Mandu।

 

 

এবার বইটিতে উঁকি দিয়ে দেখা যাক, সেখানে কী রহস্য লুকিয়ে। নিমত্‌নামা বইটিতে পঞ্চাশটি রান্না কেন্দ্রিক ছবি পাওয়া যায়। এর প্রতিটিতে সুলতানের প্রতিকৃতি সহ খাদ্যপ্রস্তুতির প্রণালী লেখা আছে আরবি লিপিতে। বইটি আরবি ও ফার্সি ভাষার মিশ্রণে লেখা হয়। এই বইতে উল্লেখিত হয়েছে বড়া, শিঙারা, খান্ডবি, বিভিন্ন ধরনের খিচুড়ি, নান এবং রুটির প্রস্তুতি পদ্ধতি। যদিও পরোটার কথা উল্লিখিত হয়নি। শিঙাড়ায় আমরা আজ যেমন আলু দেখে থাকি, নিমত্‌নামায় শিঙাড়ার ভিতরে পুর হিসাবে হরিণের মাংসের উল্লেখ আছে। শোরবা, শিক কাবাব, বিরিয়ান এবং য়াখানির (মাংসের স্টু) উল্লেখ আছে। বিরিয়ান কথাটির অর্থ হল — ধীর গতিতে রান্না করা ভাত। সম্ভবত বিরিয়ান থেকেই পরবর্তীকালে বিরিয়ানির জন্ম হয়। তবে প্রায় বারো রকমের ভাত রান্নার পদ্ধতি দেখা গেলেও পোলাও-এর কথা এই বইটিতে উল্লেখিত হয়নি। এই সব উপাদেয় খাদ্য ছাড়াও রায়তা, লস্যি এবং হালুয়া প্রস্তুতির বিবরণ পাওয়া যায় এখানে। হাতে লেখা এই বইতে সুলতান খাদ্যের গুণবত্তা সম্পর্কে ফুটনোটে নিজস্ব মন্তব্য লিখে গেছেন, যাতে তিনি নিজেই নিজের রন্ধনপ্রণালীর সুখ্যাতি করে গেছেন।

 

 

বইটির কোথাও সুলতান ঘিয়াত শাহ্‌কে হাত লাগিয়ে রান্না করতে দেখা যায় না। প্রতিটি ছবিতে তিনি নারী ও পুরুষ পরিচারকদের রন্ধনের নির্দেশ দিচ্ছেন, এমনটাই দেখা যায়। মহাপরাক্রমশালী সুলতান নিজে রান্না করবেন না, এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। আধুনিক রান্নার বইতে যেমন রন্ধনপ্রণালী লেখা হয়, এই বইটিতে সেরকম নির্দেশ না থাকলেও বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক রান্নার উপাদান নথিবদ্ধ করে এবং প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়ে সুলতান ঘিয়াত শাহ্‌ খুব সম্ভব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে চেয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক দলিল।

 

বইটিতে বিভিন্ন সুগন্ধির প্রস্তুতির বিবরণ আছে। যেহেতু মান্ডুর সুলতানদের সরাসরি যোগাযোগ পারস্য দেশের সঙ্গে ছিল, তাই তারা গন্ধদ্রব্যের প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল ছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ এবং বলবর্ধক অনুপানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় নিমত্‌নামায়। কোন অসুখে ওষুধ বানাতে কী ধরণের গাছের ছাল, ফলের বীজ, ফুলের মধু, গাছের শিকড় ব্যবহার করা যায় সেই বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের দলিল নিমত্‌নামা। বইটির একটি বড় অংশ পান বানানোর বিভিন্ন উপায় এবং অনুপান নিয়ে লেখা। পানের মধ্যে কোন উপকরণ দেওয়া উচিত আর কী নয়, তারও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে গেছেন ঘিয়াত শাহ্‌। কোন অসুখের সময় পান খাওয়া অনুচিত তাও জানিয়েছেন তিনি।

 

 

নিমত্‌নামার অনেকটা জুড়েই আছে মাংসের বিভিন্ন পদ বানানোর উপায়। আর মাংস হতে হবে একেবারে উত্তম, টাটকা। উত্তম মাংসের জন্য শিকারে বেরোতে হবে। মধ্যযুগে শিকার করা একটা বিশেষ ক্রীড়া বলেও মনে করতেন শাসকেরা। শিকারের জন্য প্রাথমিক উপাদান— সাহস। সাহসের অভাব দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজদের কারো মধ্যে ছিল না। শিকারে লাগত লোকলস্কর, হাতি-ঘোড়া, আর লাগত অস্ত্র। এসবেরও অভাব ছিল না, থাকলে আর শাসন কী করে করতেন তাঁরা? তবে একটি বিশেষ গুণ সুলতান ঘিয়াত শাহ্‌-এর ছিল, সেটি হল শিকারের আগে সুষ্ঠু পরিকল্পনা। নিমত্‌নামায় তিনি লিখে রেখে গেছেন শিকার করার আগে কী কী প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, অভিজ্ঞতালব্ধ বিধিনিষেধের কথাও জানিয়ে গেছেন সুলতান। শুধু কি তাই? কথায় আছে— ‘পথে নারী বিবর্জিতা’। এই প্রবাদের রচনা হয়েছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতার ঘেরাটোপে। কিন্তু মধ্যযুগেও সুলতান মনে করতেন— বর্মাচ্ছাদিত, শক্তিশালী নারীদের সঙ্গে রাখা উচিত শিকারের সময়। কাজেই তিনি যে একজন সময়ের আগে এগিয়ে থাকা মানুষ ছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

 

ছবি ও বইটির তথ্যসূত্র - The Nimatnama Manuscript of Sultans of Mandu, Norah M Titley, Routledge (Taylor & Francis Group), London and USA, 2005.