সেবারও আগুন জ্বলেছিল ● সহস্রাংশু গুহ


 

টিল, বড়ই জটিল মানুষের চিন্তাধারা। শৃঙ্খলার নাগপাশে নিষ্পেষিত হয়েও বারংবার সে ছুটে যেতে চায় মুক্তির সন্ধানে। আক্রমণাত্মক শ্বাপদের সম্মুখে স্থাণুবৎ মার্জার থেকেও মানুষের চিন্তাধারায় প্রবাহিত হয় ভয়কে জয় করবার বাণী। যে কাহিনী আজ ব্যক্ত করতে বসেছি তারও উত্থান এমনই এক চিন্তাধারা থেকে। যে নায়কের মস্তিষ্কে সেই চিন্তাধারার উন্মেষ হয়েছিল, ইতিহাস সেই নায়ককে ঠেলে দিয়েছে বিস্মৃতির অন্ধকারে। এই এক বড় দোষ ইতিহাসের। উজ্জ্বল নক্ষত্র নিকটবর্তী হলে তা যেমন ম্লান করে দেয় উজ্জ্বলতর কিন্তু দূরবর্তী নক্ষত্রকে ঠিক তেমনি বিবিধ নায়কের কাহিনী মনে রাখতে গিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেছে একদা দেব জ্ঞানে পূজিত আমাদের কাহিনীর নায়ক।

 

৩০ শে অক্টোবর, রাত্রি প্রথম প্রহর, ১৮২৪, সাহেব বাংলো, ব্যারাকপুর

ঘনান্ধকার নিশুতি রাত আষ্টেপৃষ্ঠে আলিঙ্গন করেছে দুচোখের পরিসরে বাঁধা চেনা দুনিয়াটাকে। নিস্তব্ধতা হয়ে উঠেছে শ্বাসরোধকারী। প্রখর গরমে শ্রান্ত হয়ে বৃক্ষ সকলও যেন বিস্মৃত হয়েছে বাতাসের হিল্লোল তুলতে। প্রাগপূর্ণিমার চাঁদও ক্ষণে ক্ষণে অন্তর্হিত হচ্ছে ঘন কালো মেঘের অন্তরালে। অদূরে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী গঙ্গা আজ হারিয়ে গেছে অন্ধকারের করাল গ্রাসে। নিস্তব্ধ রাত্রে কেবল সচল রয়েছে আকাশগামী মেঘপুঞ্জ। যেন কোনো আসন্ন দুর্যোগের খবর নিয়ে তারা ভেসে আসছে আর পুঞ্জীভূত হচ্ছে চাণকের দিকচক্রবাল জুড়ে। নিঃশব্দে সচল এক মানুষের চিন্তাধারার কিন্তু মুক্তি নেই এই শ্মশানসম নীরবতায়। আলোকসম বেগে প্রায় বে-লাগাম হয়ে চিন্তা তার জাল বিস্তার করে চলেছে সূচিভেদ্য এই অন্ধকারে।

চিন্তায় চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে উঠল কর্নেল কার্টরাইটের। মশারি অপসৃত করে নেমে পড়লেন পালঙ্ক থেকে। মাথার উপরে টানা পাখা এখন স্থির। তার থেকে রশি বেরিয়ে ঘুলঘুলি দিয়ে চলে গেছে বাইরে। নিঃশব্দে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। পরনের রাত্রি পোশাক আলগা করে রেখেছিলেন গরমের কারণে। এবার কোমরের কোষবন্ধ শক্ত করতে করতে দরজার পাল্লা ঈষৎ ফাঁকা করে উঁকি দিলেন বাইরে।

সুবিশাল ঝাড়বাতিটার অল্পসংখ্যক বাতি এখনো অসম লড়াই করে চলেছে অন্ধকারের সঙ্গে। আলো আঁধারি মাখা আঙ্গিনায় অজস্র মশার গুঞ্জনের মধ্যে দুই জানুর মধ্যে মাথা গুঁজে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে খালি গায়ে ধুতি জড়ানো পাঙ্খাপুলার। মাথার পাগড়ি খুলে পড়েছে কখন সেদিকে তার হুঁশ নেই। মনস্থির করেও তাকে জাগাতে গিয়ে বিরত হলেন কর্নেল। বৃদ্ধ লোকটির উপর মায়া হল বোধহয়।

দরজা ভেজিয়ে ঘরে ফিরে এলেন। ঘুলঘুলি দিয়ে মেঘের আড়াল থেকে স্বল্প জ্যোৎস্না এসে লুটিয়েছে ঘরের মধ্যে। সেই আলো আধাঁরিতেই ধীরে ধীরে পশ্চিমের বন্ধ জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। গঙ্গার দিক থেকে আজ এতটুকু হাওয়াও আসছে না জানলার খড়খড়ি ভেদ করে। হাত উঠিয়ে অর্গল তুলে খুলে দিলেন জানলাটা। বাইরের অসীম অন্ধকারে মিলে মিশে একাত্ম হয়ে গেল বাংলো বাড়ির ঘরটা।

বাংলো থেকে বাগান চৌহাদি পেরিয়ে অদূরেই রাজপথ। পথ পার হলে মাটি সমান্তরাল ভাবে কিছুদূর গিয়ে তারপর ঢালু হয়ে গিয়ে মিশেছে গঙ্গার সঙ্গে। ঢালু প্রান্ত ঘেঁষে ইতি উতি ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় খান সত্তর ছাউনি। কোনোটি তার মাটির দেওয়াল ওপরে খড়ের ছাদ, কোনোটি আবার কেবলই তাঁবু। গভীর রাত্রে ছাউনির সব মশাল নিভিয়ে সিপাহীরাও নিদ্রা মগ্ন। তথাপি কর্নেলের অবচেতন মন যেন বার বার বলে যায়, কিছু এক দুর্যোগ যেন আকাশের মেঘের ন্যায় ঘনিয়ে আসছে সিপাহীদের মধ্যে।

‘মিঁয়াও!’

সহসা চাপা শব্দে সচকিত হন কর্নেল। জানলার ধারের কার্নিশে বসে তার পরিচারিকার পোষ্য। নিষ্পলক নয়নে তার সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ সিপাহী ছাউনির দিকে। মুখ ফেরাতেই ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় কর্নেলের শরীর বরাবর। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের ভিতর ক্ষুদ্র সচল আলোকবিন্দুর উপর শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। আলোর আকার বলে যে উৎস মশাল নয়, প্রদীপ মাত্র। কিন্তু এত রাত্রে সিপাহী ছাউনিতে কে যায় প্রদীপ হাতে। কিছুদূর গিয়ে সেই আলোকবিন্দু অন্তর্হিত হয় অন্ধকারে। কিন্তু মুহূর্ত মাত্র, তার পরেই একটার জায়গায় দুটি আলোকবিন্দু দৃশ্যমান হয়। সমান্তরালে কিছুদূর একসঙ্গে সচল থাকার পর উভয় আলোকবিন্দুই অন্তর্হিত হয়। একমুহূর্ত আগের উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে আসে অন্ধকারে।

‘মিঁয়াওওও!’

একইরকম চাপা শব্দ তুলে গাত্রোত্থান করে মার্জার। শরীর ঝেড়ে নিয়ে অলস ভঙ্গিতে পা ফেলে অন্তর্হিত হয় কার্নিশ বেয়ে।

‘চৌখিদার।’ অন্ধকারে ডুবে থাকা বাংলো বাড়ির মধ্যে প্রতিধ্বনি তোলে কর্নেলের স্বর।

‘জি হুজুররর।’ প্রতিধ্বনির রেশ মেলানোর আগেই উত্তর ভেসে আসে অদূর থেকে।

‘মাখখন কাঁহা।’

‘নিঁদ গেছে হুজুর।’

‘বুলাও অব।’

কর্নেলের আদেশের রেশ মিলিয়ে যেতেই আবার নীরবতা ঝাঁপিয়ে পড়ে রাতের অন্ধকারে। জেগে উঠে পাঙ্খাপুলার টান লাগায় হাতের রশিতে। ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ তুলে টানা পাখা ঘরের মধ্যের গুমোট গরম বাতাস কেটে সচল হয়।

 

২৯ শে অক্টোবর বেলা দ্বিপ্রহর শেষলগ্নে, গঙ্গার তীরে অশ্বত্থ তলা

রৌদ্রোজ্জ্বল স্তব্ধ দুপুরের সঙ্গে বিষাদী মনের সম্পর্কটি অতি প্রাচীন। চাণকের সেনানিবাস সংলগ্ন গঙ্গার ঘাটে অবস্থিত সুপ্রাচীন এবং সুবৃহৎ অশ্বত্থ গাছটিও এরকম বহু বিষাদী মনের নীরব সাক্ষী। আজও যেমন সেই গাছের তলায় বসে এক যুবক নিষ্পলক নয়নে চেয়ে রয়েছে বিশালাকায় স্রোতস্বিনীর দিকে। প্রখর রৌদ্রের আলোকে ঝিলিমিলি তোলা গঙ্গার জলের ওপর দিয়ে তার দৃষ্টি হারিয়ে গেছে যেন কোন সুদূরে। সুঠাম চেহারা বলে দিচ্ছে এ ব্যক্তি সিপাহী না হয়ে যায় না। মুণ্ডিত মস্তক, পরিপুষ্ট গুম্ফ এবং কপালের তিলক যদিও বাঙালিদের মধ্যেও বিরল নয়, তবে মুখের আদলে এ ব্যক্তিকে স্থানীয় মনে হয় না। যতদূর মনে হয় পশ্চিমের কোনো প্রদেশে এর আদি নিবাস। অন্তিম শরতের স্পর্শে হিল্লোল তুলে শুকিয়ে আসা কাশ ফুলগুচ্ছ নীরবে সঙ্গ দিয়ে চলেছে আজকের অতিথিকে। সহসা নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল।

‘তিয়ারী জী?’

আগন্তুকের ডাকে মুখ তুলে তাকান যুবক। যদিও মুখের ভাব তাতে একটুও বদলায় না। আগন্তুক ছোকরাকে বিলক্ষণ চেনেন যুবক। নিকটেই পান-সুপারি-ভাঙ-তামাকের পসরা নিয়ে ঠেকে বসে এই ছোকরা। সিপাহীদের মুখে মুখে ‘মাখনা’ নামে পরিচিত। সপ্তাহান্তে এ ছোকরার দোকানে প্রায় সকল সিপাহীই ভিড় জমায় ঠান্ডাই-ভাঙ প্রভৃতি সেবন করে খুচরো আমোদের জন্য।

‘এক্ষনে হেথা?’

তিয়ারীর উদাসী মন দেখে দ্বিতীয় প্রশ্ন হাঁকে মাখনা, যদিও উত্তর দেবার বদলে মুখ ঘুরিয়ে ফের নিজের মনে হারিয়ে যায় তিয়ারী। কিছু মানুষ আছেন যারা অপরের বার্তালাপে অনীহা দেখলে বেশি ঔৎসুক্য বোধ করেন। তিয়ারীর দুর্ভাগ্যবশত মাখনা এই দলেই পড়ে। কাজেই মাখনা তার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তিয়ারীর চোখ স্থির দৃষ্টি নিয়ে আবদ্ধ হয় তীরের অদূরে কর্দমাক্ত পঙ্কিলে ভাসমান কগাছা চুড়ি ও সিঁদুর মাখা শাঁখার দিকে। কোন অভাগীর কপাল পুড়েছে কে জানে।

‘বিধবার ঠিক, কিন্তু সতীমাতার নয় ওগুলি।’

‘কাহে?’ এতক্ষণে কথা বেরোয় তিয়ারীর মুখ থেকে।

‘এ জী, নেহি জানতে ক্যা? কোম্পানি এখানে সতী করা মানা করে দিয়েছে। পাতা হ্যায়, ওরা বলছে সতী তুলে দেবে নাকি আইন করে। আওর পাতা হ্যায় কি ওই কোম্পানির গোরা সাহেবরা মিলকে আমাদের চাণকের নাম বদলে বিরাকপুর কর ডালা।’

‘হুঁ, শালে গোরে, হার চিজ কো ছেরতে হ্যায়। জাত ধরম কুছু আর থাকবে না।’

‘হ্যাঁ, এসব কী বলছ তিয়ারী জী? জাত ধরম সব?’

‘ঔর নেহি তো ক্যায়া, আয়েথে ব্যাপার করনে কেলিয়ে, অব দেখো, সব কুছ বদল ডালা। ব্যাপার করনেকে নামপে বন্দুক বাজী।’

অব্যক্ত রাগে মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে তিয়ারীর।

‘অব বোল রাহে হ্যায় হামলগোকো দরিয়া পর করকে বার্মা ভেজেঙ্গে। তু হি বোল, ইসকে বাদ হামলোগ গাউমে মু ক্যাইসে দিখায়েঙ্গে।’

‘হ্যাঁ? সত্যি না কি?’

‘তো কেয়া ম্যায় ব্রাহ্মণ হোকে ঝুট বোল রাহা হু?’

‘না না। তা বলিনি। হঠাৎ বার্মা মুলুক ভাইয়া? উ তো বহত দূর, অজনাবি দেশ, ওখানে নাকি পুরুষের মান কুছু থাকেনা, মাগীদের ইজ্জত আব্রু কিছু থাকে না? একদম মগের মুলুক!’

‘ম্যায় নেহি জানেওয়ালা। আজই বোল দুঙ্গা ম্যায়।’ অব্যক্ত রাগ কপালের পাশের শিরা ফুলিয়ে দেয় তিয়ারীর।

হু হু হু হু

বিউগলের আর ড্রামের মিলিত শব্দ সহসা ছেদ ঘটে কথোপকথনে। বিকেলের এই সময় সূর্যাস্তের আগেই রোল কল হয় সিপাহীদের। তারপর সবার স্যালুট নিয়ে নমিত করা হয় সারাদিনব্যাপী গঙ্গার তীরে উড়তে থাকা ব্রিটিশ দম্ভের প্রতীক সম্বলিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিশান।

‘আরে তিয়ারী জী, যাও, তোমার ডাক পড়েছে।’ পতাকার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাড়া লাগায় মাখন।

চিক করে এক দলা থুতু মাটিতে ফেলে উঠে দাঁড়ায় তিয়ারী।

‘ম্যায় নেহি জানেওয়ালা, সালে গোরে!’ একরাশ বিরক্তি নিয়ে পা বাড়ায় তিয়ারী। ছাউনির দিকে নয়। অন্যদিকে। বিন্দার গমন পথের দিকে বক্র দৃষ্টি হেনে চেয়ে থাকে মাখনা, বোধহয় তার মনের কোণে খেলা করে যায় কোনো দুরভিসন্ধি।

 

একই দিন, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ

ঘোড়দৌড়ের মাঠ পেরিয়ে আপনমনে হেঁটে চলেছে তিয়ারী। সপ্তাহান্তে এই দৌড়ের মাঠে বেশ লোক সমাগম হয়। কলকাতা থেকে প্রভূত বড় বড় সাহেব হস্তি সওয়ার হয়ে ঘোড়দৌড়ে বাজী ধরতে আসেন। তার সঙ্গে দেশীয় জমিদার শ্রেণীর বাবুদেরও সমাগম ঘটে। সাধারণ কালা সিপাহীর এহেন স্থানে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও প্রতিরক্ষার খাতিরে সিপাহীদের ওপরই এস্থান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয়। সেই সুবাদে তিয়ারীও বেশ কয়েক বার এসেছে এখানে। যদিও হাতে মাস্কেট নিয়ে দণ্ডায়মান হয়ে স্বল্প বসনের ব্রিটিশ মহিলার দিকে দৃষ্টি দেওয়া ব্যতিরেকে আর কিছুই করা হয়নি। দুপুর পর থেকে সন্ধ্যার মশাল জ্বলা অবধি সুবিশাল এই মাঠ মুখরিত হয়ে থাকে হাজার লোকের কোলাহলে।

সপ্তাহের অন্যান্য দিন অবশ্য এই মাঠের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ। সন্ধ্যার পর এই স্থানে শৃগাল কুকুর ব্যতীত জীব সমাগম হয় না। আরও পূর্বে মাইল খানেক গেলেই এসে পড়বে আজব গজব চিড়িয়াখানা।

তবে তিয়ারীর উদ্দেশ্য এসব কিছুই নয়। মাথায় হাজার চিন্তার বোঝা বইতে হলে পদক্ষেপ উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে অনেক সময়। ঠিক সেই ভাবেই গভীর অন্ধকারে পথ দিয়ে একাকী প্রেতের ন্যায়, নৈঃশব্দকে সঙ্গী করে হেঁটে চলেছে বিন্দা।

এই সময় দরকার ছিল জগন্নাথের। সেনা ছাউনিতে বিন্দার সবথেকে কাছের দোস্ত জগন্নাথ। জাতে সেও ব্রাহ্মণ তবে পাণ্ডে। ছাউনিতে পাঁড়ে নামে সবাই চেনে তাকে। পরিবার,পরিজন, ঔরত, বাচ্চা সব দেশে ফেলে সেও বিন্দার মত এসে জুটেছে ৪৭ নম্বর নেটিভ ইনফ্রানটিতে। দৈনিক ডিউটির পর দেশোয়ালি ভাই জগন্নাথের সঙ্গে মাখনার ঠেকে ভাঙ সেবন তাদের অভ্যাস। একের পর এক পাত্র ভর্তি ভাঙের সঙ্গে প্রতিদিনের মজলিশের শুরুটা জুড়ে থাকে দেশের কথা, শস্য শ্যামলা জমিনের কথা, ঔরত, বাচ্চার কথা তবে অবশ্যম্ভাবী ভাবে নেশার পরত চড়তেই শুরু হয় কদর্য বিশেষণ প্রয়োগে গোরা অফিসারদের মুণ্ডু নিপাত।

তবে সেসব নেশার কথা। তারপর আহারান্তে নিদ্রা এবং পরের দিন সূর্যের প্রথম পরশ গগন চুম্বন করা মাত্র বিউগলের আওয়াজ দিয়ে সেই গোরাদের সঙ্গেই দিন শুরু। এই ভাবেই কেটে গেছে প্রায় বছর পাঁচেক। মাস গেলে ৬ টাকা মাসহারা পেয়ে তার অর্ধেক বিন্দা নিয়ম করে পাঠিয়ে দেয় দেশে। খেদ ছিল না তার। বাপ ঠাকুরদার জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার বদলে এই লাল সাদা পোশাকে সেজে হাতে মাস্কেট নিয়ে, কোমরের বেল্টে বেয়নেট ঝুলিয়ে সিপাহীর জীবন বেশ আপন করে নিয়েছিল সে। আর নেবে নাই বা কেন, তার বংশে রয়েছে সিপাহীর রক্ত। তার বাপ দাদারাও যে জোয়ান বয়েসে নবাবের সিপাহী গিরি করেছে। সে করছে গোরাদের, এইটুকু শুধুই পার্থক্য।

অসন্তোষ যে একেবারে ছিল না তা নয়। ছিল। অন্তত সন্ধ্যের মজলিশে ভাঙের টানে মনের অন্তরগুলো যখন কর্ষিত হত তখন কিছু কিছু অসন্তোষের কারণ বেরিয়ে আসতো। যেমন দেশোয়ালি সিপাহীরা কখনোই উচ্চপদ পেত না সিপাহী দলে। বছরের পর বছর সিপাহীর চাকরি করে বর্ষীয়ান হয়ে পড়লেও পদোন্নতি হত না তাদের। সমপদে আসীন গোরা বাবুর তুলনায় সিপাহীর বেতন ছিল অর্ধেকেরও কম।

এই তো সেদিন সুবাদার রতন শেঠ বলছিল আরেক সুবাদার গুতেন সাহেব বেতন পায় ৪০ টাকা মাস গেলে, সেখানে রতন সাহেবের বেতন ১০ টাকা। ড্রাম বাজিয়ে গোরা ছেলেটির এখনও গোঁফ গজানোর উমর হয়নি এদিকে তার বেতন ২৫ টাকা যেখানে বিউগল নিয়ে যে চাচা দিনে আটবার নিয়ম করে বাজিয়ে আসছে আজ কতকাল ধরে তার বেতন ৮ টাকা। সিপাহীদের পোশাকের ২ টাকা প্রতিবছর বেতন থেকে কাটা হয়।

তবে এই সব কিছুর মধ্যেও পেটের খিদে গায়ের পোশাক আর মাথা গুঁজবার ছাউনির অভাব না থাকার দরুন দিন গুজরান হয়ে যাচ্ছিল নির্বিবাদেই। এর মধ্যেই বাঁধল যুদ্ধ। সুদূর বার্মা মুলুকে গোরাদের সঙ্গে যুদ্ধ। গুজব সেখানে নাকি এবার সবাইকে পাঠানো হবে। বাপ দাদার জমিন ছেড়ে এত দূর দেশে সে চাকরির নামে পড়ে আছে। এবার যদি নদী পেরিয়ে বার্মা মুলুক যেতে হয় তবে তো ব্রামহিনের জাত বলে আর কিছু থাকবে না। গাঁয়ে ছিছিক্কার পড়ে যাবে তাদের বংশের নামে। একঘরে করে ছাড়বে সবাই তাদের সাজানো সংসারটাকে। বিধর্মী গোরাদের তো জাত ধর্মের বালাই নেই কোনো, ওরা কি বুঝবে ব্রামহিনের বংশ মর্যাদা!

‘কে যায়?’

সহসা আঁধারের মধ্যে দিয়ে তীরের মতো মনুষ্য কণ্ঠ এসে আঘাত হানে বিন্দার কানে। সিপাহীর প্রশিক্ষণে পরিপক্ব চেতনা মুহূর্তে সচকিত হয়ে ওঠে। ক্ষণিক আগের ভারাক্রান্ত মনবাহী শরীর টানটান হয়ে ওঠে। সন্ধানী চোখ উৎস খুঁজতে ব্রতী হয় সূচিভেদ্য অন্ধকারে। অতর্কিত শব্দে সচকিত হয়েই বোধহয় কোনো রাত জাগা পাখি তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে উড়ে যায় মাথার উপর দিয়ে। কিয়োৎক্ষণ আঁধারে ইতি উতি চোখ চালিয়ে অবশেষে নিকটেই এক ম্রিয়মাণ ধুনির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।

‘একটু আগুনটা উস্কে দিবি বাপ?’

ধুনির ওপাশে জটাজুট ধারী সাধুবাবার অবয়ব এবার কিঞ্চিৎ স্পষ্ট হয় বিন্দার কাছে। বিপদের আশঙ্কা দূর করে এগিয়ে যায় সে। তার নিজের দেশেও বিস্তর সাধুর দেখা পেত সে। সুদূর বাঙ্গাল হলেও দেশ তো সেই একই। কাজেই নির্ভয়ে বাঙ্গালী বাবার দিকে এগিয়ে যায় সে।

‘পরণাম বাবা’ ধুনির এদিকে সাধুর মুখোমুখি বসে কোচর থেকে চকমকি বের করে আগুন উসকাতে লেগে পড়ে সে।

‘সুখী হও বাবা।’

সাধুর আশীর্বাদেও বিন্দার মৌখিক ভাবের অপরিবর্তন দেখে আবার সাধুই প্রশ্ন করেন।

‘কী হয়েছে বেটা তোর? অস্থির মতি মনে হচ্ছে যে বড়।’

হাতের চকমকি ঘষে আগুনের ফুলকি তৈরির মধ্যেও বিন্দার অন্যমনস্কতা সাধুর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এড়ায় না। কাজ শেষে মুখ তুলে তাকায় বৃন্দা। বাঙ্গালী এই সাধুবাবার গলায় এমন এক আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল যে বৃন্দার মনও নরম হয়। ধুনির এপাশে মাটির উপর বসে পড়ে বলে।

‘ইহ্যা মুঝে কুছ আচ্ছা নেহি লাগ্ রাহা হ্যায় বাবা।’

‘বেশ দেখে তো সিপাহী মনে হচ্ছে, এদিকে চেহারা তো বাঙালীর নয়, তোর দেশ কোথায় বাপ্?’

‘বহুত দূর বাবা, পশ্চিম কি তরফ। গাঁও ছোড়কার আয়ে হয়ে আজ ১০ বরস হো গেয়ে। ইধার নৌকরি মিলা থা। গাঁও মে জমিন হ্যায় লেকিন ক্যায়ি সাল বারিশ নেহি হুই তো ভুখকে মারে ইঁহা আ গ্যায়া। সোচা থা গোরে লোগ হ্যায়, দূর দেশ সে আয়ে হ্যায়, আচ্ছেহি হোঙ্গে। লেকিন অবতো ইয়ে নৌকরি মেরে ধরমকে খিলাফ যা রাহে হে বাবা।’ হতাশায় অধোবদন হয় বিন্দা।

তারপর স্বগতোক্তির মতো বলে, ‘ইয়ে গোরে লগোকো ক্যায়সে সমঝ আয়েগা হমারে লিয়ে ধরম কেয়া হোতা হ্যায়, দিন দো পাহের মে তো ইয়ে লোগ গোমাংস খাতে হ্যায়।’

‘তাতে তোর কি বেটা, যার যার ধরম তার তার কাছে। তোর ধরম পালন করে তুই থাক না।’ একহাত দিয়ে ধুনির আগুন ঠিক করতে করতে জবাব দেন বাবা। যদিও দৃষ্টি সরে না বিন্দার থেকে।

‘ওহি তো, হম সিপাহী লোগ সব কুছ বরদাস্ত কর লিয়ে। আপকো পাতাহে বাবা হম সিপাহী লোগোকা কভি পরমসন নেহি হোতা হ্যায় ইধার। গোরা সিপাহীও সে আধা তনখা মিলতা হ্যায় হমলোগোকো। রাশন ভি কম মিলতা হ্যায়। গোরা লোগ খুন করে তবভী মাফ হমলোগ আগার থোরি দের সে ভি প্যারেড মে জায়ে তবভী তনখা কাটা জাতা হ্যায়। ইতোয়ার কো সব গোরো কো ছুটটি মিলতি হ্যায় সিবায়ে হমলোগ। পূজাকে দিন উপবাস করনেকে বাদ ভি পুরা আধা দিন ধুপ মে খারে হোকে ডিউটি করনা পারতা হ্যায়। হমারা ইস্তেমাল করকে ইয়ে লোগ সদর বাজার সে দারু ঔর আফিম মাঙ্গাতে হ্যায়।’

‘গোরাদের নৌকরি করছিস যখন, তখন তাই তো করতে হবে বেটা। চাকরি করার মানে তো তাই রে। পয়সা পাচ্ছিস ব্যস— মুখ বন্ধ করে কাজ করো।’

‘ঔর নেহি সাহা যাতা হ্যায় বাবা। অব ইয়ে বোল রাহে হ্যায় কে হমলোগোকো বার্মা ভেজনে বালে হ্যায়, আপ হি বোলিয়ে বাবা, নদী পার করকে উতনা দূর জানেকে বাদ হমারা ধরম রহেগা কুছ? অধর্মী ইয়ে গোরে আদমি লোগ তো ব্রাহ্মণ কোভি ছেড়তে হ্যায়, পতা হ্যায় আপকো উসদিন এক গোরা লাড়কে নে সুবেদার রতন সাবকো বেরাহমি সে পিটা ঔর ওয়াজা সিরফ ইয়ে থি কে রতন সাবনে শরাব পিনে সে ইনকার কর দিয়া। তো ফির ক্যায়া অব গোরে লোগোকে বলনে সে ম্যায় শরাব পিয়ুঙ্গা? হুঁ মন করতা হ্যায় জুতা সে পিটু ইন শালে গোরে লোগোকো!’ একনাগাড়ে রাগের কথা বলে উত্তেজনায় হাঁপিয়ে ওঠে বিন্দা। কপালের শিরা স্ফীত হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। ধুনির আগুনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কপালে জমা শিশির বিন্দুর ন্যায় ঘাম।

‘যদি তোর মন না চায় কিছু করতে তবে তা করিস না বেটা। সেটাই তো আমাদের স্বাধীনতা রে। নাহলে মানুষ হয়েছি কেন। ভগবান তার সব জীবদেরকে বানিয়েছেন স্বাধীন করে। এই ধরিত্রীতে সবার সমান অধিকার রে বেটা।’

‘লেকিন উও লোগ জুলুম করেগা বাবা, তনখা নেহি দেগা, মারেগা পিটেগা, জবরদস্তি সে ওহি করায়েঙ্গে জো উনহোনে সোচা হ্যায়।’

‘কেন রে বেটা। মরদ নস তুই? চাপাটি খেতে পাস না? খেতে যদি পাস, লাঠিও ধরবি। মর্জি মাফিক তোকে দিয়ে কেউ কাজ করাতে চাইলেই তুই করবি?’

‘লেকিন বাবা?’

‘ব্যস বেটা ব্যস। তোর এই চিন্তাই তোর কাল। দাঁড়া তোকে একটা জিনিস দেখাই।’ ইতি উতি খুঁজে নিজের ঝোলার ভিতর থেকে এক গোছা কাচের চুড়ি বের করেন বাবা। এককালে হয়তো কোনো সৌখিন সধবার পেলব অঙ্গে শোভা পেত, বাবা বোধহয় সংগ্রহ করেছেন বিসর্জনের পর গঙ্গা মাইয়ার তীর থেকে।

‘এই দেখ বেটা, তোর যত চিন্তা ভাবনা ওই যাকে তোরা বলিস ‘সোচ’ সব হচ্ছে সেই কাচের চুড়ির মতো। যতক্ষণ এটা তোর হাতে রয়েছে তুই ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে কিছু করতে পারছিস না আর এই দেখ এই আমি যদি এটা এইভাবে ভেঙ্গে ফেলি—’ ধুনির পাশের মাটিতে পড়ে চুড়ি চূর্ণ হয়। ‘তাহলেই আমার সব চিন্তা শেষ, এবার আর আমার কোনো ভয় নেই এটা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ এটা তো ভেঙ্গেই গেছে এবার আমি হাত দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। কেমন তাই না?’

কত কী আত্মস্থ হয় বিন্দার তা জানা নেই তবে সে নিশ্চুপে চিন্তামগ্ন হয়। কিয়ৎক্ষণ পরে সাধুবাবাই আবার কথা বলেন। ‘ঘর যা বেটা, রাত হচ্ছে। মনে রাখিস যা কিছু তোকে বাধা দিচ্ছে ঠিক কাজ করতে, তা সবই তোর মনে। মন থেকে আগে সব বাধা বিদেয় কর, তারপর শুধু সেটাই কর, যা তোর মন থেকে ঠিক বলে মনে হয়।’

গাত্রোত্থান করে প্রণাম জানিয়ে পিছনে ফিরতেই আবার বাবা ডাক পাড়েন।

‘এটা নিয়ে যা বেটা।’ উৎসুক চোখে বিন্দা পিছন ফেরে, তার হাতে একটি শুকনো পদ্ম ফুল তুলে দেন বাবা। ‘এটা পদ্ম ফুল, শুভ শক্তির প্রতীক। অশুভের প্রতিবাদ করতে শুভ শক্তিকে জাগতেই হয় রে বেটা। দ্বাপর যুগে যেমন কৃষ্ণ জেগেছিলেন, কলি যুগে যেমন বুদ্ধ জেগেছিলেন, তাদেরই আশীর্বাদ এই পদ্ম ফুল। আর কিছুর ভয় পাস না বেটা, যা কিছু খারাপ তার প্রতিবাদ তুই করবি, তবেই না তুই মানুষ, তবেই না তুই জীব শ্রেষ্ঠ। আর হ্যাঁ বেটা সবসময় মনকে পবিত্র রাখবি, খুন জখম মার দাঙ্গা করে কিন্তু ভালো কোনো কাজ হয় না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবি, কিন্তু মনে রাখবি শত্রু নিপাত করলে সমাধান হয় না, কারণ এক শত্রু বিনাশে শত শত্রু জাগে। তাই শত্রুর মন পরিবর্তন করাতে হয়, সেটাই হয় ভগবানের আশীর্বাদে সব থেকে বড় কাজ।’

করজোড়ে প্রণাম জানিয়ে ফিরতি পথ ধরে বিন্দা। বাঙ্গালী বাবা আবার মেতে ওঠেন তার ধুনির আগুন নিয়ে। নিস্তব্ধতা আবার আষ্টেপৃষ্ঠে জাঁকিয়ে ধরে রাতের অন্ধকারকে। কিছুক্ষণ আগেও দুজন মনুষ্য সন্তানের কথোপকথনে যে নিস্তব্ধ ভূমি প্রাণ পেয়েছিল তা আবার প্রেত-ভূমিতে পরিণত হয়। ধুনির জ্বলন্ত কাঠ ফাটার আওয়াজ সংগত দিতে থাকে সেই প্রেত-ভূমির। নিশ্চুপে বিন্দা ফিরে চলে তার ছাউনির দিকে।

 

৩০ শে অক্টোবর, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ, স্থান সেনা ছাউনি সন্নিকটস্থ ভাঙের আড্ডা

চিন্তামগ্ন হয়ে একাকী এক পার্শে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রয়েছে বিন্দা। ভাঙসেবীদের কোলাহল আজ যেন অস্বাভাবিক রকম কম। তার কারণ বোধ করি আজ সকালের প্যারেড গ্রাউন্ডের ঘটনাটি। ঘটনাটি বর্ণনা করা এক্ষণে আবশ্যক।

আজ সকালে ব্রাহ্ম মুহূর্তে যখন নিত্যাভাস মতো বিন্দা গঙ্গা স্নান আহ্নিক সেরে ছাউনিতে প্রত্যাবর্তন করছে তখনই সে প্রত্যক্ষ করে তাদের ৪৭ নম্বর নেটিভ রেজিমেন্টের যে ক্ষুদ্র এক দলকে মথুরা পাঠানো হয়েছিল সেই সিপাহী-গণের পুনরাগমন হয়েছে। দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্রিটিশ অফিসাররা ফিরেছে দিন দুই পূর্বেই কারণ তাদের জন্য ঘোড়া এবং গরুর গাড়ির বন্দোবস্ত ছিল। দেশীয় সিপাহীদের জন্য গাড়ির বন্দোবস্ত করা গোরাদের মতে অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা মাত্র। তাই নিজ নিজ সরঞ্জাম পিঠের পিঠঠু তে বেঁধে দেশীয় সিপাহীদের পায়ে হেঁটেই ফিরতে হয়েছে মথুরা থেকে চাণক। প্রাণাধিক পরিশ্রমে সকল সদ্য আগত সিপাহীরই কলিজা কণ্ঠাগত। তবুও নিদ্রা গেলে চলবে না, কারণ প্রত্যুষের প্রথম প্যারেডের সময় সমাগত প্রায়।

সদ্য ফেরত সিপাহীদের দলে ছিলেন বর্ষীয়ান বিউগল বাদক রহমত চাচা। পিতৃসম এই বর্ষীয়ান সিপাহীকে দলের সবাই সমীহ করে। তার কারণ শুধুই তাঁর বয়স নয়। শিক্ষা, আচরণ, ধর্মপরায়ণতা এবং সর্বোপরি সৎ মানুষ হিসেবেও রহমত চাচা নমস্য। প্রায় এক-পক্ষকাল নামমাত্র বিশ্রামে পদব্রজে চাণক ফেরার পর বর্ষীয়ান এই সিপাহীর শারীরিক অবস্থা কেমন হবে তা সকলেরই অনুমেয়।

প্যারেড শুরুর ঠিক আগে চাচা যদিও ঠিকই এসে উপস্থিত হয় গ্রাউন্ডে। পথশ্রমে মলিন সিপাহীর বেশ পরিবর্তনের সময়ও তাঁর জোটেনি। তবু বিউগলে ফুঁ দিতে ভুল করেনি সে। তবে সে সুর আজ ক্ষীণ, বাদকের ক্লান্ত পাঁজর থেকে বেরোনো সুর আজ ব্যর্থ ধ্বনিত হতে। সঙ্গে ড্রাম বাদক ছোকরা ব্রিটিশ কার্ল সাহেব। ড্রামের তালে সঙ্গত রাখতে বার দুয়েক ব্যর্থ হতেই কার্লের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। যার পরিণাম গড়ায় কার্ল কর্তৃক রহমত চাচার বেধড়ক প্রহারে।

বর্ষীয়ান বিউগল বাদককে ভূলুণ্ঠিত করে প্রহারের মত ন্যক্কার জনক ঘটনা দেখেও প্রথমে কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থাকেন কর্নেল কার্টরাইট। ক্লান্ত শরীরের উপর বেশ কয়েকটি পদাঘাত পড়ার পর কর্নেল সাহেবের সম্বিৎ ফেরে। নামমাত্র তিরস্কার করে কার্লকে ক্ষান্ত দেন আর তার সঙ্গে দয়ার ভাব দেখিয়ে দুই সিপাহীকে নির্দেশ দেন রহমতকে ছাউনিতে পৌঁছে দেবার জন্য। যদিও মুখে রক্ত উঠে যাওয়া মানুষটার তখন দরকার ছিল চিকিৎসার। দুই সিপাহীর কাঁধে করে প্রায় চলৎশক্তিহীন রহমত চাচা ছাউনিতে ফিরে আসেন এবং কার্লের ড্রামের তালে প্যারেড শুরু হয়ে যায়।

প্যারেড প্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান সহস্রাধিক সিপাহীর মধ্যে এই ঘটনা প্রচণ্ড মানসিক উদ্বেগের সৃষ্টি করলেও তাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, এবং বলাই বাহুল্য কর্নেল কার্টরাইটও এই প্রসঙ্গে সহানুভূতি দূরে থাক একটি বাক্য উচ্চারণ থেকেও বিরত থাকেন। তবে উপস্থিত সব সিপাহীর মধ্যে এই ঘটনা যে কীরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণ আজকের এই আড্ডাখানার অস্বাভাবিক নীরবতা। সকলের মধ্যেই যেন চাপা রয়েছে প্রচণ্ড এক ক্ষোভ। জাল নিবদ্ধ ব্যাঘ্র সম ক্রোধ নির্গত হচ্ছে কেবল চাপা দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে দিয়ে।

‘বিন্দা?’

পরিচিত কণ্ঠস্বর এবং স্কন্ধে পরিচিত হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ তোলে বিন্দা। নীরবে জগন্নাথ এসে বসে তার পাশে। বাকিদের ন্যায় তার মুখেও বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে রয়েছে।

‘সুবে প্যারেডকে বাদ কাহা চলা গ্যায়া তু? দিনভর নেহি দেখা।’ বন্ধুকে শুধোয় জগন্নাথ।

‘ঘর মে থা।’

‘তবিয়ত ঠিক?’

‘হা।’

‘তব?’

এবারের উত্তর দিতে বিলম্ব হয় বিন্দার। গতকালের সেই বাঙ্গালি বাবার কথাগুলো যে সমানে তার মনকে অস্থির করে দিচ্ছে, পারবে না সে গোরাদের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে?

‘কবতক, ঔর কবতক পাণ্ডে?’ মনের কথা মনেই চেপে অবশেষে হতাশার সূরে প্রশ্ন করে বিন্দা।

‘কবতক ক্যায়া?’

‘কবতক এইসে চুপ চাপ বইঠে রেহানা হ্যায় বোল তো? ১০ বরস তো পার হো গয়ে লেকিন আচ্ছা তো কুছ নেহি দেখরাহ হু ম্যায়। মু বন্ধ করকে কাম কর যাও তো কুছ নেহি, আগার যারা সা ভি কুছ গলত হুয়া তো হমলোগ কেলিয়ে সাজা, ঔর গোরে লোগোকে লিয়ে সাত খুন মাফ। বাপ দাদা কা জমিন ছোরকে আয়ে থে ইতনি দূর অব তো লাগতা হ্যায় মান তো জায়গাহি, জান ভি যা সকতি হ্যায় ইধার। ইতনে সারে সিপাহী হ্যায়, সব তো হমারে হি লোগ হ্যায়, লেকিন ফিরভি ডর কে মারে কই কুছ নেহি বোলতা। আজ জো রহমত চাচাকে সাথ হুয়া তু হি বোল কই মা কা দুধ পিনে বালা কর সকতে হ্যায় এইসা কাম?’

এক নিঃশ্বাসে কথা বলে অবশেষে নীরব হয় বিন্দা, অব্যক্ত হাজারও চিন্তার রাশ মুখে ফুটিয়ে চেয়ে থাকে বন্ধুর দিকে।

‘ইয়ে যো ইতনে আদমি দেখ রাহে হো না ইধার, পাতা হ্যায় ইয়ে সব তেরা জাইসে হি সোচতে হ্যায়।’

‘সোচ নে সে কাম বনেগা ক্যায়া ভাইয়া? ইয়ে অব সোচনেকা বক্ত নেহি হ্যায়। কুছ তো করনা পারেগা।’

‘কৌন করেগা? করভি কেয়া সকতে হ্যায় হম?’

‘হম নাহি তো কৌন ভাইয়া? মুসিবত তো হমহি ঝেল রহে হ্যায় না, জমিন হমারা, দেশ হমারা, আদমি হমারে ঔর কাম করনা পারেগা সালে গোরোকে লিয়ে।’

‘ধীরে বোল, দিওয়ারওকে ভি কান হোতে হ্যায়।’

‘আরে এহি তো সমস্যা হ্যায় মেরি ভাই, ইতনা ডরেগা তো আদমি কো খরগোশ বনকে কয়েদ রহনা চাহিয়ে।’

‘সব লোক তুজ জায়সা হি সোচতে হ্যায়।’

‘তো ফির ইন্তেজার কিসকা?’

‘সায়েদ এক মসিহ কা, জো হামলগ কো---’

ওদের বাক্যালাপ অমীমাংসিত রয়ে যায় কারণ অদূরে আড্ডা খানার বাইরে থেকে কিছু গোলমালের আভাস পাওয়া যায়।

‘কাম অন, কাম অন, সুইট ইন্ডিয়ান ডগি, চু চু, কাম অন,’

‘লুক হিয়ার বেবি, ইংলিশ দারু, কাম অন, কাম অন ডগি হ্যাভ এ সিপ।’

নিত্য নৈমিত্তিক না হলেও মাতাল বাবুদের এহেন অভব্যতা বিরল নয়। প্রায়শই রাত্রে সদর বাজার পানশালা থেকে ফেরার পথে কিছু ছোকরা ব্রিটিশ ঢুঁ মারতে আসে দেশীয়দের এই ভাঙের আড্ডায়। না ভাঙ বা ঠান্ডাই সেবন যে তাদের উদ্দেশ্য নয় তা বলাই বাহুল্য। তাদের আসল উদ্দেশ্য মাতাল হয়ে নেটিভ সিপাহীদের উপর মশকরার নামে অল্প বিস্তর হাতের চাবুক, ব্যাটন চালিয়ে আমোদ লাভ। সাদা চামড়ার তথাকথিত উন্নত মনুষ্য শ্রেণীর এই জানোয়ারদের আরও সহস্রাধিক অভব্যতার ন্যায় এই ঘটনাও দেশীয় সিপাহীদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। যতক্ষণ সাহেবরা মশকরা চালান ততক্ষণ তারা নিশ্চুপে মাথা নিচু করে কাঠ পুত্তলিকার ন্যায় দাঁড়িয়ে অত্যাচার প্রত্যক্ষ করবে এবং অবশেষে বাবুদের চিত্ত পরিতুষ্ট হলে তাঁদের প্রস্থানের পর দুপাত্তর অতিরিক্ত ভাঙ নিয়ে পুনর্মূষিক ভব হবে। ইহাই যেন স্বাভাবিক।

আজও ঘটনার শুরু এরকম ভাবেই হয়েছিল। ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে চড়ে আকণ্ঠ মদ্যপান করে একদল ব্রিটিশ ছোকরা ছাউনিতে ফিরছিল গঙ্গার পাশের এই রাস্তা ধরে। ছাউনির কাছেই সিপাহীদের ভাঙের ঠেক। এই অবধি এসে বাবুদের মনে হয় এখনো একটু আমোদ করার বাকি আছে। অতএব গাড়ি ঘুরিয়ে এনে উপস্থিত হয় আড্ডার সামনে। আড্ডাখানার ঘরটি ছোট, সামনের প্রাঙ্গণ বেশ বড়। ঘরের মধ্যে মাখনা বসে হিসেব মেলায় আর ভাঙ, ঠান্ডাইয়ের পাত্র প্রস্তুত করে। তার বউ মাখন আর নাবালক ছেলে কালু মিলে সেই পাত্র পৌঁছে দেয় প্রাঙ্গণে ইতি উতি ছড়িয়ে বসে থাকা সিপাহীদের কাছে। প্রায় খান বিশেক মশাল এদিকে ওদিকে বাঁশের খুঁটিতে গোঁজা রয়েছে প্রাঙ্গণের অন্ধকার দূর করার জন্যে। গুটিকয়েক দড়ির খাটিয়াও পাতা রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একটু আয়েশি সিপাহীরা তাতে হেলান দিয়ে ভাঙ এবং হুঁকো সেবনে তৃপ্তি লাভ করে।

আজ যখন বাবুদের উপস্থিতি ঘটে তখন বাকি সিপাহীরা উঠে দাঁড়ালেও কালু তখন ব্যস্ত ছিল মাটিতে হামা দিয়ে খালি পাত্র সংগ্রহে। তাই বাবুদের নজর প্রথম ওর দিকেই পড়ে। এবং তখনই বোধ করি সাদা চামড়ার সভ্য মানসিকতা ওই বাচ্চা ছেলেটিকে কুকুর ভ্রমে মনে করে এবার একে একটু ইংরাজি মদ খায়ানো যাক। অতএব এক ছোকরা ব্যস্ত হয় বাচ্চাটিকে ধরে হাঁ করাতে এবং আরেকজন বাচ্চার কান্নায় আমোদ পেয়ে তাকে কুকুরের মতো আদুরে গলায় সম্বোধন করে মদ খাওয়াতে। বাচ্চার চিল চিৎকার কান্নার সামনেও যখন সিপাহীরা কেবল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সেই সময় কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে প্রথম সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে মাখন। হাজার হোক, মা তো।

‘উসে ছোড় দিজিয়ে বাবুজি, বাচ্চা হ্যায়, ছোড় দিজিয়ে, প্যায়ের পরু আপকে।’

ব্রিটিশ বাবুর মনে হয় আরেক কুকুর এসেছে তার ফাঁদে পা দিতে, অতএব একে নিয়েও একটু রগড় করা যাক। এই ভেবে যেভাবে সে হাত বাড়িয়ে মাখনকে আলাদা করতে যায় সেভাবে আর যাই হোক ভদ্র লোকে কুকুর আদর করে না।

‘আবে আবে তু কাহা যা রাহে হ্যায়—’ জগন্নাথের মুখের কথা শেষ হবার আগেই বিন্দা ঘটনাস্থল অভিমুখে অগ্রসর হয়। জগন্নাথের বোধহয় ধারণা হয়েছিল ভাঙের নেশা চাড়া দিয়ে উঠেছে বিন্দার, কিন্তু তা ভ্রম মাত্র, এদিন এখনও পর্যন্ত বিন্দা ভাঙ পান করেনি, এগিয়ে যেতে যেতে বিন্দা অস্ফুটে যা বলে তা উদ্বিগ্ন জগন্নাথের কর্ণগোচর হয় না।

‘মসিহ বননে!’

কেউ কোনোরকম বাধা দেবার আগেই বিন্দা পৌঁছে যায় ঘটনাস্থলে যেখানে তখনও দুই সাহেব এবং মাখন ও তার ছেলেকে নিয়ে প্রহসন চলছে। প্রায় খান শয়েক দেশীয় তরুণ যেখানে মূর্তিবত দণ্ডায়মান সেখানে একাকী বৃন্দা সাহেবদের কাছে গিয়ে সজোরে হুঙ্কার ছাড়ে।

‘আয়াইইই’

ঘটনার আকস্মিকতায় কিয়ৎ হতভম্ব হয়েই দুই সাহেব এবার খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। সাদা হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বাচ্চা মাটিতে বসে কাঁদতে থাকে এবং মাখন তড়িঘড়ি কাপড়ের অঞ্চল দিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে।

‘মত কিজিয়ে ইয়ে সব। হামভি ইনসান হ্যায়।’

সাহেবরা যা বলবে কালা আদমিরা তাই মেনে নেবে মাথা নত করে ইহাই যেখানে স্বাভাবিক সেখানে এক কালা আদমির এহেন প্রতিক্রিয়ায় সাময়িক হতচকিত হলেও পরক্ষণেই দুই সাহেবের হাতে ব্যাটন উঠে আসে।

‘হোয়াট ডিড ইউ সে, ব্লাডি নিগার!’

দ্বিতীয় সাহেব যে মাখনের স্পর্শ সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে বোধহয় একটু বেশিই রাগ প্রকাশ করে উদ্যত ব্যাটন নিয়ে বিন্দাকে প্রহারের বাসনায় অগ্রসর হয়। তবে আজ সাহেবদের কপালে মৌতাতের সুখ ছিল না। রক্ত চক্ষু সাহেবের মোকাবিলার তরে উপস্থিত প্রায় অর্ধেক সিপাহী তখন বিন্দার পাশে এসে দাঁড়ায়। বলাই বাহুল্য তাদের সর্বাগ্রে তখন বিন্দা এবং তার পাশেই দণ্ডায়মান জগন্নাথ। এত জোড়া রক্তচক্ষুর সামনে বিপদ বুঝে সাহেবের ব্যাটন সম্বলিত ডান হস্ত উদ্যত হয়েই থমকে যায়, বিন্দার শরীর স্পর্শ করার সাহস তখন মদের নেশার মতোই উবে গেছে।

ওদিকে গাড়ি থেকে ততক্ষণে আরেক সাহেবও নেমে পড়েছে, তার বোধহয় একটু বেশি নেশা হওয়ার দরুন আজ গাড়ি থেকে নিচে পা পড়েনি এতক্ষণ। ক্রুদ্ধ সিপাহীদের এতদিন রজ্জু ভ্রমে বেদম লাঠিপেটা করা যাদের নিত্যাভাস ছিল আজ সেই ভ্রম ভেঙে যায় সর্পের ফণা প্রত্যক্ষ করে।

‘হেই জো, হেই কার্ল, কাম অন ম্যান,’ নেশার ঘরে বাক্য জড়িয়ে গেলেও গাড়ির চাকায় হেলান দিয়ে বাক্য সম্পূর্ণ করেন সাহেব। ‘দ্যাট লেডি ওয়ার্কস ফর কর্নেল, সি ইজ হিজ মেড ম্যান, কাম অন। ইটস নট আওয়ার টাইম। ‘

সেটা বোধহয় বাকিদেরও মনে হয়েছিল কিন্তু হতভম্বতার রেশ কাটতে তখনও কিছু পল বাকি ছিল, সেটুকু কেটে যায় আরেক মাতাল জাত ভাইয়ের কথায়। অতএব চুপচাপ গাড়িতে উঠে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করাই সমীচীন বোধ করেন লাল মুখো সাহেব দল। গাড়ি চলতে শুরু করলে ঘৃণায় বিন্দা সহ অনেকেই থুতু ছেটায় মাটিতে। গঙ্গার ধার থেকে ঠান্ডা হওয়ার এক পরশ এসে ইতি উতি বাঁশের ডগায় খাটানো মশাল গুলোকে নিভু নিভু করে তোলে। মাখন অশ্রু ভেজা বদনে বাচ্চা কোলে উঠে যায়। ঠিক সেই সময় সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে দূরাগত এক চিৎকার।

‘শুনো হো, শুনো হো ও ও ও ও’

দৌড়াতে দৌড়াতে এক সিপাহী ছাউনি থেকে আড্ডা খানায় উপস্থিত হয়, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘রহমত চাচা গুজৱ গ্যয়ে। জলদি চলো সব।’

 

দিন: ওই, সময় রাত্রি প্রথম প্রহর, স্থান কর্নেল কার্টরাইটের বাংলো বাড়ি

সারাদিন বাড়ির কাজ, সন্ধ্যায় বরের সঙ্গে ভাঙের ঠেক সামলে, তারপর রাত্রে মাখন আসে সাহেব বাংলোয়। কর্নেল কার্টরাইটের ব্যবহৃত জামা কাপড়, খাবার, বাসন-পত্র প্রভৃতি পরিষ্কার করা তখন তার কাজ। ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়ে তবে সে আসে এখানে। কোনো কোনো দিন কাজ শেষ করতে করতে গভীর রাত হয়ে যায়। কাজও নেহাত কম নয়, সাহেব পুরুষ মানুষ হলেও তাঁর পোশাক ও প্রসাধনীর শখ এদেশের নারীদের লজ্জা দেবে এমন বোধ হয় মাখনের। সব রকম কাজের জন্য আলাদা পোশাক। বাইরে তো বটেই, ঘরের মধ্যেও সকালের পোশাক, খাবার খাওয়ার সময়ের পোশাক, সকালে হাঁটতে যাওয়ার পোশাক, বই ঘরে যাওয়ার পোশাক, বাগানে বেড়ানোর পোশাক এমনকি স্নান ঘরে যাওয়ারও পোশাক আলাদা। এগুলি সবই আবার প্রতিদিন ব্যবহারের পর ঠিক ভাবে পরিষ্কার করে রাখা চাই পরের দিনের জন্য।

জামা কাপড়ের পর্ব শেষ হলে আসে খাবারের বাসন ধোয়ার পর্ব। নিজের মরদকে মাখন বরাবর একথালা ভাত আর তাতে ঢেলে ডাল বা সব্জি খেতেই দেখেছে, তার জন্য বরাদ্দ একটি মাত্র কাঠের থালা। এদিকে এই সাহেবের বাসনের বহর দেখে মাখনের মনে হয় সাহেব বোধহয় যজ্ঞির আহার খান। প্লেট থাকে খান কম করে খান দশেক, তারপর বাটি, কাপ, গ্লাস, চামচ, ছুরি, চিমটের মতো এক ধরনের কী যেন, এত কিছু বাসন যে তাও আবার শুধু দুপুরের। রাত্রি বেলা সাহেব নাকি স্বল্পাহার করেন।

মাখনের খুব ইচ্ছে একদিন সাহেবি খাবার চেখে দেখার যদিও তা এখন অবধি পূরণ হয়নি আর অবস্থা যা হয়েছে তাতে পূরণ হবার সম্ভাবনা অবধি কম। আজ সাহেবের চাপরাশির থেকে তার মাইনে নেবার কথা তাই সে এসেছে। আর তার বর তাকে বলে দিয়েছে যে সে যেন জানিয়ে আসে যে আর সে সাহেব বাড়িতে কাজ করতে যাবে না। দুটো পয়সা আসছিল ঠিকই। তবে মান বাঁচলে তবে জানের পরোয়া। দুই গোরা সাহেব আগের দিন যা করেছে তারপর আর সাহেবদের মুখ দেখার বাসনা নেই তার। আজই শেষ দিন সাহেব বাড়িতে।

সহসা চৌকিদারের হাঁক ডাক শোনা গেল। সাহেব নাকি তাকে ডাকছেন। এসময় আবার কি দরকার কে জানে। রাতের প্রথম প্রহর শেষ দিকে, দেশীয়দের কাছে তেমন রাত্রি না হলেও সাহেব সুবো মানুষেরা ঘুমাতে যান অনেক আগে। আজ আবার কী হল কে জানে। সাহেবদের মতিগতি দেখে ওই জাতটার ওপরেই ভয় ভাব এসে গেছে মাখনের। আজ তার মরদ বাড়িতে নেই তাই ফেরার তাড়াও নেই, ছেলে অবশ্য ঘুমোচ্ছে বাড়িতে। তাই ধীরে সুস্থেই হাতের কাজ সারছিল মাখন শেষ বারের মতো। কাজ হয়ে যাওয়ার পর ঠান্ডা পাথরের বারান্দায় বসে একটু চক্ষু মুদে এসেছিল। শীত শুরুর মুখে এই সময়টায় গঙ্গার দিক থেকে ঠান্ডা হওয়া দেয় রাতের দিকে। সারাদিন পরিশ্রমের পর ঠান্ডা হওয়ায় বেশ আমেজ এসে পড়েছিল ঠিক সেই সময় এসে উপস্থিত হল পাগড়ি বাঁধা চকিদার রতনলাল।

‘এ মাখন, সাহেব বুলা রহে হ্যায় তুঝে, অবভি জা’

ধড়মড় করে উঠে বসে পড়ে মাখন। নিয়মসিদ্ধ তৎপরতায় ঘোমটা ঠিক করে শুধোয়,

‘আজ সাহেব ঘুমায়নি?’

‘মুঝে ক্যায়া পাতা, সাহেব লোগ কেলিয়ে অব তো আধিরাত্ হো চুকি হ্যায়, যাকে দেখ, সায়েদ ভূখ লগ গয়ি হো তেরে সাহেব কো, ফিরসে ডিনার করনে বালে হ্যায়।’ হাস্য মুখে প্রস্থান করে চৌকিদার। সাহেব বাড়ির কোনায় কোনায় পিদিম জ্বলে। অন্ধকার এই বাড়িতে প্রবেশ করে না। মাখন জানে সাহেবের ঘর কোথায়, চৌকিদার চলে যেতেই সেও উঠে পড়ে দুরুদুরু বুকে। আজ সে চুপচাপ কাজ করে টাকা নিয়ে চলে যাবে ভেবেছিল, এবার কী হবে কে জানে।

‘সাব...’

‘ইয়েস মাখন, হোয়ার ওয়ার ইউ? কাহা থে?’

‘এখানেই হুজুর, বাসন মাজছিলাম’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই হাতের অঙ্গুলি নির্দেশে বাইরের ঘর দেখায় মাখন।

‘হোয়ার ইজ ইওর হাসবেন্ড টু নাইট?’

‘জি সায়েব?’ সাহেবের কথা না বুঝলেও গলার স্বরে উষ্মার রেশ ঠিকই অনুভব করতে পারে মাখন। কথা জড়িয়ে আসে তার। উত্তর যোগায় না।

‘আই মিন, পতি কাহা হ্যায়?’

‘ও, জানি না, জানি না সায়েব, সন্ধ্যের পর বেড়িয়েছে, আমি যখন এলাম তখনও ফেরেনি সাব। এতক্ষণে হয়ত বাড়ি ফিরে গেছে সায়েব’

‘অবভী বুলাও, বলো আর্জেন্ট, আর্জেন্ট, আন্ডারস্ট্যান্ড?’

‘জি, জি সায়েব’

‘যাও যাও, জল্দি যাও।’

 

দিন: ওই, কাল গভীর রাত, স্থান রহমত চাচার ছাউনি

ধর্মপ্রাণ রহমত চাচার ছোট এই হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া বেড়ার ঘর ছিল চাচার জগৎ। ঘরেরই মধ্যে এক দিকে পরিছন্ন নামাজ পড়ার জায়গা, মাটির ছোট্ট গম্বুজাকৃতি ঢিপির উপর সযত্নে রক্ষিত কোরান। এক পাশে পড়ে থাকা মটকা কুঁজো, মাটির গ্লাস। চাচার সিপাহী বেশ, অন্যান্য পরিধেয় সব যত্ন করে সাজানো। ঘরের মানুষটি যেন মথুরা থেকে ফিরেই এখুনি আসবে নিজের ঘরে তারপর দেশোয়ালি ভাইদের নিয়ে শুরু করবে মজলিশি আড্ডা।

সবই রয়ে গেল শুধু মানুষটা ছাড়া। গোরা সিপাহীর পরলোক প্রাপ্তি হলে শোক সভা থেকে একদিনের কর্মবিরতি অন্তত ঘটে থাকে। কিন্তু দেশীয়দের ক্ষেত্রে সেসবের বালাই নেই। বকেয়া বেতনটিও পাওয়া যায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কাল রাত্রেই কর্নেলকে জানানো হয়েছিল রহমতের অবস্থা সম্পর্কে, শুধু একবার ‘আই সি’ বলে ক্ষান্ত দিয়েছেন সাহেব। সিপাহীরাই চাচাকে গোর দিয়েছে। আর সেই অমানুষ কার্ল? তার তো কিছুই যায় আসে না। দেশীয় সিপাহী, সে আবার মানুষ নাকি। কাল রাত্রেই সে আকণ্ঠ মদ্যপান করে যা কাণ্ড ঘটিয়েছে মাখনের আড্ডায় তার পর সিপাহীরা একলা পেলে তাকে শৃগাল কুকুরের মতোই পিটিয়ে মারবে। অসম্ভব ঘৃণা স্তূপীকৃত হয়ে জমেছে ছাউনির সকল সিপাহীদের মধ্যে। কিন্তু সহসা কেউই কিছু করে বসার সাহস করছে না। আজ রাত্রে বিন্দা তাদের কয়েক জনকে ডেকে পাঠিয়েছে রহমত চাচার এই শূন্য ছাউনিতে গভীর রাতে গোপন সমাবেশে।

‘জগন্নাথ?’ অন্ধকারে চোখ চলে না। ঘরের মধ্যে কেবল একটি প্রদীপ জ্বলছে মিট মিট করে। চারিপাশের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কাছে সেই প্রদীপ কেবল সমুদ্রের তুলনায় গোষ্পদ। বিন্দা বসেছে প্রদীপের একদম কাছে। তার মুখের রেখায় কেবল কাঁপছে প্রদীপের ম্লান আলো।

‘এহি হু ভাই’ অদূরে ঘরের কোন থেকে বিন্দার ডাকে সারা দেয় জগন্নাথ।

‘সব আ গয়ে?’

‘হা, কুল মিলাকে গ্যারা আদমি, জাইসা তুনে বোলা থা।’

‘সব ভরসেমন্দ হ্যায় না?’

‘হা, তু বেফিকার রহে, হম সব একসাথ হ্যায়’

‘জয় লাল হো?’

‘হা ভাই!’ ঘরের ওপর কোন থেকে জয়লাল সারা দেয়।

‘ভাই লোগ, ম্যায়নে এক খত লিখা হ্যায়, হিন্দি মে, লেকিন হমলোগকে সাথ বহুত বাঙালি ভাই ভি হ্যায় ইসলিয়ে জয়লাল ও খত তুমলোগোকো অনুবাদ করকে সুনায়েগা। আগার কিসি কো কুছ ক্যাহনা হ্যায় তো উসকে বাদ বোল সকতা হ্যায়। জয়লাল, শুরু করো।’

বিন্দার চিঠিতে যা কহতব্য ছিল তা ভবিষ্যতদ্রষ্টা ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দলিল। দুর্ভাগ্য ইতিহাসের যে সেই অপূর্ব লেখনী আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সামান্য সিপাহী হয়েও প্রতিবাদের যে ভাষা যেভাবে ব্যক্ত করার কথা সেখানে লেখা হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে নাক উঁচু ব্রিটিশ জাতির সর্বোত্তম দার্শনিককেও ভাবনার জগতে তলিয়ে যেতে বাধ্য করবে। ইতিহাস শুধু মনে রেখেছে পরবর্তী দিনগুলির স্বল্প কিছু কথা নীরবে যা সাক্ষর বহন করে চলেছে বিন্দার পরিকল্পিত কর্মসূচি বর্ণিত সেই চিঠির।

চিঠি পাঠ সমাপন হলে আবার নিস্তব্ধতা গ্রাস করল ছাউনিকে। বিপক্ষে কাউকে কিছু বলতে শোনা না গেলেও বিন্দার প্রতিবাদের ধরন যে সবার মনঃপূত হয়নি তা হয়তো বলার অপেক্ষা রাখে না। নিস্তব্ধ কুঠুরিতে ১৩ সিপাহীর মধ্যে শুরু হল আলাপ আলোচনা। সপক্ষে বিপক্ষে যুক্তির খই ফুটিয়ে অবশেষে সহমত পোষণ করল সবাই। মুখ বুজে সহন করার দিন শেষ। নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে নতুন ভাবে বাঁচার শপথ নিল সবাই।

ছাউনির সিপাহী সংখ্যা প্রায় আঠারো শতাধিক। কাল সকালে প্যারেড শুরুর পূর্বেই সকল সিপাহীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে এই বার্তা। একার পক্ষে তা অসম্ভব বুঝেই বিন্দা সেই দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছে ১২ জন সতীর্থের মধ্যে। রাত্রের প্রথম প্রহরের শেষ লগ্ন জানান দিয়ে যখন গঙ্গার তীর থেকে শৃগালের দল তীক্ষ্ণ রব তুলল তখন ভাঙল গোপন আড্ডা। অবশ্যম্ভাবী ভাবে যে প্রশ্ন ওঠার কথা ছিল অবশেষে জয়লাল শেষ লগ্নে তা করল ছাউনি ছেড়ে বেরোবার আগে।

‘একটা ব্যাপার বুঝলাম না বিন্দি ভাইয়া। জগন্নাথ তোমার সব চেয়ে কাছের দোস্ত, অথচ ওকে তুমি কিছু দায়িত্ব দিচ্ছ না কেন?’

সামান্য হাসি যেন খেলে যায় বিন্দার মুখে। যেন সে জানত যে এই প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী।

‘জগন্নাথ কো ম্যায়নে সবসে বড়া কাম দিয়া হ্যায়। হাম জো করনে যা রাহে হ্যায় উসকা পরিণাম কেয়া হোগা ইয়ে মুঝে নেহি পাতা। ভগবান না করে আগার হামলোগোকে সাথ কুছ বুড়া হুয়া তো ভি ইয়ে আন্দোলন জারি রাহনা চাহিয়ে, হামলোগ আগার নাকামিয়াব হুয়ে তো জগন্নাথ ইসে আগে লে কার জায়গা। হামারি বাত, অওর হামারা আদর্শ, সবকে সামনে লানেকে লিয়ে উসকো লড়তে রাহনা পরেগা। ইসিলিয়ে উসে অভি কুছ কাম নাহি দে রাহা হু।’

জবাব শুনে হাসি খেলে যায় জয়লালের মুখে। ‘ইয়ে হুই না বাত।’

‘ও হ্যাঁ, এক চিজ ম্যায় ভুল রাহা হু—’

বিন্দা উঠে গিয়ে ঘরের কোন থেকে তার পিঠঠু উঠিয়ে নিয়ে আসে। অন্ধকারে তাতে হাত চালিয়ে কী যে তুলে আনে তা বুঝতে চোখ চলে না।

‘ইয়ে হ্যায় কমল কি পানখুড়ি।’

‘ইসসে কেয়া হোগা ভাইয়া?’ হাত পেতে কিছু শুকনো পদ্মের পাপড়ি নেয় জয়লাল। তাকে অনুসরণ করে বাকিরাও একে একে এগিয়ে আসে বিন্দার দিকে।

‘ইয়ে ফুল শুভশক্তি কা প্রতীক হ্যায়। হাম সব ইস পানখুরি কো আপনে হাতও মে লেকে শপথ লেঙ্গে কি হামারে দেশ কি মিটটি পে খাড়া হোকে হাম ওহী করেঙ্গে জো হামারে লিয়ে সাহি হো। কিসিকে ক্যাহনা পর হাম হামারে ধরমকে খিলাফ কুছ নেহি করেঙ্গে। একসাথ হোকে হামলোগ কাল আন্দোলন মে শামিল হোঙ্গে প্যারেড গ্রাউন্ড মে আংরেজও কি খিলাফ। একসাথ বলো ভাই লোগ, খাও চাপাঠি লও লাঠি।’

চাপা গুঞ্জনে অমনি উপস্থিত সকলে বিন্দার কথায় কথা মেলায় ‘খাও চাপাঠি লও লাঠি’।

সকলে বিদায় নিলে জগন্নাথ এগিয়ে যায় বিন্দার দিকে। সুহৃদয় বন্ধু সঙ্গই যে বিপ্লবের অন্যতম পাথেয় তা জানে বিন্দা। তাই নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে দিয়েছে সবচেয়ে গুরু দায়িত্ব। তাকে শুধু এখন অনুসরণ করে যেতে হবে সকল কর্মসূচি তারপর সঠিক সময়ে মশাল তুলে দিতে হবে অন্যের হাতে। হাস্য মুখে করমর্দন করে সংকল্পে দৃঢ় দুই হৃদয়। তারপর বিদায় নেবার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে জগন্নাথ।

‘কৌন হ্যায় উধার?’

চাচার ঘর সংলগ্ন মাটি বাঁধানো কূপের কাছে অস্পষ্ট অবয়ব মতো যেন দেখতে পায় সে, তবে পলক মাত্র। যেন কোনো মানুষ নিশ্চুপে দণ্ডায়মান ছিল সেখানে আর মুহূর্তে অন্ধকারে মিশে গেল। দুই বন্ধু স্থির দৃষ্টিতে অন্ধকার কূপের দিকে চেয়ে থেকেও আর কিছুই দেখতে পায় না। ইতিমধ্যে বিন্দা লক্ষ করে আরেক দৃশ্য। জগন্নাথের কাঁধে হাত দিয়ে তার দৃষ্টি নির্দেশ করায় ছাউনির প্রবেশ পথের দিকে। চোখে পড়ে মাটির পথ দিয়ে লণ্ঠন হাতে কে হেঁটে আসছে ছাউনির দিকে।

‘ঔরত’ চাপা গলায় বলে জগন্নাথ। লুণ্ঠনের স্বল্প আলোয় সে আবছায়া অবয়ব দেখে এটুকু বুঝতে পারে যে কোনো মহিলা আসছে এদিকে। এত রাত্রে সেনা ছাউনিতে কোনো মহিলার আগমন তো সাধারণ নয়। বারবনিতা নিয়ে ফুর্তি দেশীয় সিপাহীদের ছাউনিতে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে সেই কোন কালে।

আলোক হাতে ছায়া মূর্তি সামনে এলে তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দুই বন্ধু।

‘আমার সোয়ামিকে দেখেছ?’ উৎকণ্ঠার সুরে শুধোয় মাখন।

‘নেহি তো? কেয়া হুয়া, সব সাহি হ্যায়?’

‘সাহেব তলব করেছেন আমার পতিকে, এখুনি। কিন্তু বাড়িতে তো নেই সে তাই ভাবলাম এদিকে যদি এসে থাকে। তোমরা আজ এত রাত্রে জেগে?’

‘জগন্নাথ কা খত আয়া হ্যায়, ঘর মে দাদাজি কো বুখার আয়া হ্যায়, উসে জানা পারেগা, ইসলিয়ে বাত হো রাহি হ্যায়।’ মাখন যে সাহেব বাড়িতে কাজ করে তা বিন্দার অবগত আছে। তাই মিথ্যে বলার সময় ঠোঁট কাঁপে না তার। বিপ্লবের অন্যতম শর্ত যে গোপনীয়তা তা রক্ষিত হয় সযত্নে।

 

৩০ শে অক্টোবর, গভীর রাত, সাহেব বাংলো

‘সাহেব ডেঞ্জার সাহেব, ডেঞ্জার, ধামাকা হতে চলেছে সাহেব। ডেঞ্জার ডেঞ্জার, ভেরি ডেঞ্জার।’ একরকম ছুটতে ছুটতে সাহেব বাড়ীতে এসে উপস্থিত হয়েই সামনে সাহেবকে পেয়ে যাওয়ায় উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে থাকে মাখনা।

‘ধীরে, ধীরে বোল।’

‘খুব ডেঞ্জার সাহেব।’

‘কেয়া ডেঞ্জার?’

‘সবাই বলছে সাহেব। আমি এই মাত্র শুনে এলাম। রহমত চাচা মারা যাওয়াতে সবাই ক্ষেপে গেছে সাহেব। সবাই বলছে আপনাদের কাউকে আর মান্নি করবে না।’

‘ঔর কেয়া শুনা?’

‘ওরা বলছে বার্মা যাবে না সাহেব। অত দূর দেশে কেউ যাবে না। আরও বলছে এবার থেকে ওদের দুগনা মাইনে দিতে হবে নাহলে ওরা সিপাহী থাকবে না সাহেব। বলছে বিদ্রোহ করবে। কারোর কোনো কথা শুনবে না।’

‘বিদরো? হোয়াট?’

‘ইয়ে মানে খুন খারাপি সাহেব। কোনো কথা শুনবে না বলেছে ওরা। আর বলছে এটা ওদের দেশ ওরা এখানে স্বাধীন ভাবে ইচ্ছেমত চাকরি করবে।’

‘আই সি। হাউ মেনি ওয়ার দেয়ার?’

‘আজ্ঞে?’

‘আদমি, আদমি, কিতনা?’

‘জনা দশেক হবে সাহেব, অন্ধকারে বুঝিনি।’

‘হুঁ হুঁ, ঠিক হ্যায়। যাও। গো, অ্যান্ড ডোন্ট টেল এনিওয়ান এনিথিং।’

‘ইয়ে মানে সাহেব, ইতনা রাত হয়ে গেছে, এরকম খবর...’

‘আই সি, দো রূপেয়া মিলেগা, লেকিন কাল। নাও গো।’

হাতে হাতে আমদানি না হওয়াতে একটু বিমর্ষ মুখেই মাখনা বিদেয় হয়। সাহেব কিয়ৎক্ষণ চিন্তা মগ্ন থেকেই কর্তব্য স্থির করে হাঁক পাড়েন।

‘চৌখীদার?’

‘জি হুজুর র র’

‘কোচয়ান কো বুলাও ঔর হরকরা বুলাও, খত ভেজনা হ্যায়, আর্জেন্ট, অভি জানা হ্যায়!’

 

১ লা নভেম্বর, প্রত্যুষে চাণক প্যারেড গ্রাউন্ড।

আজ বিউগল বাজানোর জন্য এসেছে আরেক ইংরেজ ছোকরা। সম্ভবত এই ব্যক্তিই আগের দিন মাখনার ঠেকে কার্লের কীর্তিকলাপের সঙ্গী ছিল। এতদিন একে কোথাও দেখা যায়নি। বোধহয় নতুন এসেছে কোলকাতা থেকে। সাদা চামড়ার কাজের অভাব হয় না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। কার্লের ড্রামের তালে নতুন বাদকের সুরে বিউগল বাজতেই সার বেঁধে লাইনে দাঁড়াতে শুরু করল দেশী রেজিমেন্ট।

নতুন মাসের পয়লা দিন। আজ স্বয়ং কর্নেল উপস্থিত থাকবেন মর্নিং প্যারেডে। সিপাহীদের ভালো মন্দ উপদেশ দেবেন। এক গোছা ফিরিস্তি শোনাবেন কোম্পানি দেশের উন্নতি করতে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। তারপর আসবে বড়লাট এবং মহারানির গুণ কীর্তন। সাহেব বলে যাবেন আর দোভাষী তা বাংলা ও হিন্দিতে অনুবাদ করে শোনাবেন। মাসের প্রথম প্যারেডে উপস্থিত থাকেন এই অঞ্চলের প্রধান সংবাদপত্র দৈনিক হরকরার জনৈক সাংবাদিক। সব শেষে আসবে সিপাহীদের মাইনে দেবার পালা।

একের পর এক নাম ধরে ডাকা হবে সিপাহীকে আর শেষ মাসে তার কী কী খাতে টাকা বাদ গেছে সেই ফিরিস্তি শোনানোর পর বাকি টাকা তার হাতে দেওয়া হবে। হাতে গোনা যে কয়জন উচ্চপদস্থ গোরা সিপাহী আছেন তাঁদের জন্য অবশ্য আলাদা বন্দোবস্ত তাঁদের বেতন নিতে হয় স্ব স্ব পদের প্রধানের হাত থেকে দিনের পরের অর্ধাংশে। এই সব করতে সকালের প্যারেড যখন শেষ হয় তখন সূর্য মধ্যগগনে পৌঁছে যায়। অন্যান্য পাঁচটা দিনের মতো পয়লা তারিখের শুরুটা একঘেয়ে ভাবে হলেও হাতে পয়সা পাবার আনন্দে এই দিনে দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে একটু অধিক উত্তেজনা লক্ষণীয় হয়।

আজ সকালটাও শুরু হল অন্যান্য পাঁচটা দিনের মতোই। নভেম্বর মাস পড়েছে। প্রত্যুষের আকাশে আবছা কুয়াশার চাদর আসন্ন শীতকালের পূর্বাভাস দিচ্ছে। এই সময় করেই সদর বাজার এলাকায় দৈনিক বাজার শুরুর সময় পিছিয়ে যায়, ফলত রাস্তায় গরু ও ঘোড়ার গাড়ির দেখা মেলে একটু বেলা বাড়ার পর। সিপাহীদের নিয়মে অবশ্য নড়চড় হয় না কিছু। বিউগলের সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক সিপাহী লাল সাদা পরিধান পরে মাথায় ৪৭ নম্বর এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শীল মোহর সম্বলিত টুপি পরে আরমারি থেকে মাস্কেট বন্দুক এবং বেয়নেট নিয়ে মাঠে সার বেঁধে দাঁড়াতে শুরু করল। প্রত্যেকের কাঁধে বেয়নেট সম্বলিত মাস্কেট। যদিও প্যারেড গ্রাউন্ডে গুলি বারুদ আনার হুকুম নেই তবু বন্দুক সঙ্গে থাকে সিপাহীর সাক্ষর বহন করে।

সাধারণত পয়লা তারিখের প্যারেডে কোনো সিপাহী অনুপস্থিত থাকে না। বেশ খানিকক্ষণ ধরে ছন্দ মিলিয়ে বাজাবার পর থেমে গেল বিউগল আর ড্রামের আওয়াজ। প্রত্যুষে মাঠে প্যারেড চলাকালীন এই একটু নিস্তব্ধতা বেশ লাগে বিন্দার। সিপাহী সমাবেশ শেষ হবার পর পতাকা উত্তোলনের শুরু পর্যন্ত বন্ধ থাকে বিউগল। এত বিশাল এই প্রাঙ্গণে প্রায় দুই সহস্রাধিক লোক সমাগম হয়েও বিচার করে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা। গঙ্গার উপর থেকে বয়ে আসা ভোরের হওয়া হাল্কা শব্দ তুলে ছুঁয়ে যায় সকল উপস্থিত মানুষকে। সারারাত ঘুমের পর সদ্য জেগে ওঠা পাখির কলতানে মুখরিত হতে শুরু করে চাণকের আকাশ। অনেক দূরের সেই চিড়িয়াখানা থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসে হস্তীকুলের বৃংহণ। এখন যে তাদের স্নানের সময়। নিকটস্থ অশ্বশালা থেকে শোনা যায় হ্রেষাধ্বনি। শুধু মনুষ্য শব্দ হীন হয়ে এই কয়েকটি মুহূর্তের জন্য যেন চাণক হয়ে ওঠে এক স্বপ্ন-পুরী। নতুন সূর্যকে স্বাগত জানিয়ে সূচনা হয় নতুন দিনের।

কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতার পর যথা সময়ে আবার বিউগল আর ড্রামের শব্দ শুরু হল। এবারের সুর অনেক খাদে এবং গতিও মন্থর। সকল সিপাহীর স্যালুট ভঙ্গির মধ্যে প্যারেড গ্রাউন্ডের সম্মুখস্থিত নিচু বাঁধানো মঞ্চে নিজস্ব শ্বেত অশ্ব চ্যাম্পের পিঠে করে এলেন কর্নেল কার্টরাইট পূর্ণ সামরিক বেশে। কোমরে ঝুলছে বহুমূল্য তরবারি। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশীয় কর্মচারী একটি ত্রিপলের কাপড় নির্মিত বস্তা এনে নামিয়ে রাখে। এতে রয়েছে জরুরি খবর সম্বলিত চিঠি ও কাগজ যেগুলি পাঠ হবে একটু পরে। ধীরে সুস্থে মাঠের কোনার দিকে দেখা মেলে বলদে টানা একটি গাড়ি এগিয়ে আসছে। যাতে গাড়োয়ান ছাড়াও রয়েছে দুই সশস্ত্র সিপাহী এবং একটি বড়সড় কাঠের সিন্দুক। ওই সিন্দুক থেকেই সিপাহীদের মাহিনা বিতরণ করবেন সুবাদার মনিলাল। এবার শুরু হল পতাকা উত্তোলন, কার্টরাইটের তরবারি এখন কশিমুক্ত এবং সোজাসুজি ভাবে দক্ষিণ হস্তে শোভা পাচ্ছে। সমস্ত সিপাহীদের মাস্কেট উদ্ধত। পতাকা উত্তোলন এবং সম্মান প্রদর্শনে র পর থেমে গেল সমস্ত বাদ্য। এবার ভাষণ শুরু করবেন কর্নেল।

আজ কর্নেলের ভাষণ সীমিত। স্বল্প বয়ানের পরেই শুরু করলেন আসল প্রসঙ্গ। বাংলা ও হিন্দিতে তর্জমা করে তার ভাষণ শোনাতে লাগলেন অনুবাদক।

‘—বার্মা মুলুকে যুদ্ধের ব্যাপারে তোমরা সবাই স্বল্প বিস্তর অবগত আছ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বার্মার বন্দর একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কেন্দ্র। অতএব তার দখল নিতে কোম্পানি তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে চলেছে। অন্যান্য রেজিমেন্টের সঙ্গে দেশীয় ৪৭ তম রেজিমেন্ট কেউ যেতে হবে বার্মা ফ্রন্টে। ইতিপূর্বে সমুদ্র পথে জাহাজ করে যেতে অনেক সিপাহী আপত্তি প্রকাশ করেছিল। তাই কোম্পানির সিদ্ধান্ত সিপাহীদের জাহাজে যাওয়ার জন্য কোনোরকম ভাবেই প্রলোভিত করা হবে না। তবে এত অল্প সময়ে সিপাহীদের জন্য অন্য কোনো রকম পরিবহন ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সেই হেতু কোম্পানি তার অধীনস্থ ৪৭ তম বাহিনীর সমস্ত সিপাহীদের আদেশ জানাচ্ছে তারা যেন আজকের মধ্যেই তাদের সমস্ত যুদ্ধোপকরণ নিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে পদব্রজে যাত্রা শুরু করে। চট্টগ্রাম থেকে বার্মা যাবার জন্য বলদ গাড়ি বা নৌকার ব্যবস্থা করার কথা কোম্পানি বিবেচনা করে দেখবে।

আজকের প্যারেড যত শীঘ্র সম্ভব শেষ করা হবে যাতে বেলা দ্বিপ্রহরের আগেই সমস্ত সিপাহীগণ সুসজ্জিত হয়ে যাত্রা শুরু করতে পারে। সিপাহীদের নিজ নিজ অস্ত্র এবং বারুদ পরিবহন করার জন্য ত্রিপলের থলে বিতরণ করা হবে যার মূল্য বাবদ সিপাহীদের মাহিনা থেকে ২ টাকা করে কেটে নেওয়া হবে। ভারতবর্ষের সর্বাধিপত্যই এবং মহামান্য রানির প্রতিনিধি স্বয়ং বড়লাটের প্রতিনিধি হিসেবে আমি কার্টরাইট আদেশ জারি করছি যে সমস্ত সিপাহী যত শীঘ্র সম্ভব তাদের মাহিনা সংগ্রহ করে যাত্রার আয়োজন করতে ব্রতী হও। আমি—’

চাপা গুঞ্জনের শব্দে অনুবাদক চুপ করে যেতে বাধ্য হন। কর্নেল অবশ্য তার আগেই পরিস্থিতি কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কারণ ইশারা মাত্রই তাঁর দুই পাশের বন্দুকধারী গোরা সিপাহীকে দেখা গেল হাতের রাইফেল উঁচু করতে। মঞ্চের সম্মুখে প্রায় কুড়ি গজ মতো জায়গা ফাঁকা। তারপর শুরু হয়েছে দেশীয় সিপাহীদের সমাবেশ। হাতে মাস্কেট নিয়ে যারা এতক্ষণ স্থাণুবৎ দণ্ডায়মান ছিল তাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের ভাব স্পষ্ট। সহস্রাধিক মানুষের গুঞ্জন মাঠের পরিবেশ গম্ভীর করে তুলেছে ততক্ষণে।

‘সুবাদার, সুবাদার।’

‘জি সাহেব!’

‘হোয়াটস দ্য ম্যাটার? ইয়ে কেয়া হো রাহা হ্যায়?’

‘নেহি পতা সাহেব। উও লোগ কুছ ক্যাহনা চাতে হ্যায়!’

‘হোয়াট, হোয়াট আর দে স্যেইং?’

‘নেহি পতা সাহেব!’

‘ওয়েল আস্ক দেম! ড্যাম ইট!’

সাহেবের কপালে এই শীতের প্রত্যুষেও ঘামের ফোঁটা দৃশ্যমান। সুবাদার, ব্যান্ড বাদক এবং বাকি গোরা সিপাহী যারা মঞ্চের নিকটে দণ্ডায়মান তাদেরও চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। দেশীয় সুবাদার রতন লাল এবার গলা উঁচু করেন সিপাহীদের উদ্দেশে।

‘শোনো, শোনো সবাই। শোনো শোনো’ ব্যর্থ হয় তার গলার স্বর গুঞ্জন ছাপিয়ে সিপাহীদের স্তব্ধ করতে। উচ্চ শব্দ করে হঠাৎ গর্জন করে ওঠে মঞ্চে দণ্ডায়মান এক গোরা সিপাহীর মাস্কেট। গঙ্গার তীর বেয়ে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সুদূর প্রান্তে। তবে বন্দুকের নল ঊর্ধপানে। বোঝা যায় কর্নেলের নির্দেশেই ওই গোরা সিপাহী শূন্যে বন্দুক দেগেছে। অশান্তকে শান্ত করতে শক্তি প্রদর্শন মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। গুলির শব্দে সিপাহীরা স্তব্ধ হলে কর্নেল ইশারা করেন সুবাদারকে। সুবাদার আবার গলা ওঠান।

‘শোনো শোনো, তোমাদের যা বলার আছে শান্ত ভাবে বলো। একজন এগিয়ে এস মঞ্চের দিকে। শুধু মাত্র একজন। বাকিদের আদেশ দেওয়া হচ্ছে তারা যেন পুনর্বার তাদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ যেন তাদের শ্রেণী-সজ্জা ত্যাগ না করে। তোমাদের কর্নেল সাহেব একজনের সঙ্গে কথা বলতে চান। তোমাদের কোনো একজন এগিয়ে এস।’

‘আমরা যুদ্ধে যেতে চাই না সাহেব!’

একজন নয় একসঙ্গে শত-ধ্বনি প্যারেড গ্রাউন্ড কাঁপিয়ে তুলল। সাহেবের তা বোধগম্য হল কিনা জানা যায় না তবে সুবাদার সাহেব নিঃসন্দেহে বুঝলেন। সিপাহীদের গুঞ্জন তখন গগনভেদী স্লোগানে পরিণত হয়েছে। প্রত্যুষের সিন্ধগ্ধতাকে শত খণ্ড করে ধ্বনি উঠছে।

‘আমরা বার্মা যাব না, সমুদ্র পার করব না। আমরা যুদ্ধে যাব না। আমরা মার্চ করব না।’

সিপাহীরা যদিও নিজেদের স্থান থেকে একটুও অগ্রসর হয়নি তবুও তাদের আস্ফালন ও হুঙ্কারের বহরে ব্রিটিশ সিংহেরও বুঝি কম্প আসে।

‘কোম্পানিইই ফল ইননননন।’ নাঃ, সিংহের হুঙ্কার চাপা পড়ে যায় সহস্র সিপাহীর ক্রোধান্বিত গর্জনে।

‘আমরা যাব না বার্মা। আমরা মানবনা কোম্পানির আদেশ। আমরা সাগর পার করব না। আমরা যুদ্ধে যাব না।’

‘সাহেব উও লোগ বার্মা নেহি জায়েঙ্গে সাহেব।’ ভীত স্বরে সুবাদার এবার সাহেবের দিকে এগিয়ে আসে।

উন্নাসিকতার একটা দিক বোধহয় এই যে তারা ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না। তাই অন্তরে দ্বিধায় ভুগলেও সাহেবের মুখে তার ছাপ অন্তত সুবাদারের নজরে পড়ে না।

‘নো সুবাদার, দে আর জাস্ট সেইং। উই উইল মেক দেম মার্চ বিফোর ইভনিং।’

ওদিকে সিপাহীদের বন্দুক শূন্যে তুলে মুহুর্মুহু গর্জন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। ড্রামবাদক কার্ল এবার এগিয়ে আসে কার্টরাইটের দিকে।

‘স্যার দে আর ফিউরিয়াস স্যার।’

‘হম বার্মা নেহি জায়েঙ্গে। কোম্পানি কা রাজ নেহি চলেগা। হম সাগরপার নেহি করেঙ্গে।’

‘স্যার দে মে সারাউন্ড আস!’ কার্লের গলার স্বরে ভয়ের সুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

‘ডে উইল নট ডেয়ার টু ডু দ্যাট!’ কর্নেল তখন অটুট ভাব বজায় রেখে চলেছেন।

‘ফর গড সেক স্যার, লুক আট দেম। দে আর ম্যাড, ফিউরিয়াস। ডিসমিস দ্য প্যারেড স্যার।’

‘হম লোগ এহি রহেঙ্গে। হম কাহি নাহি জায়েঙ্গে। সাগর পার নেহি জায়েঙ্গে। ‘

‘স্যার ডু ইট স্যার, ডিসমিস ইট বিফোর ইটস টু লেট। ফর গড সেক—’

‘ড্যাম ইট! ডু ইট সুবাদার, ডু ইট! ডিসমিস দ্য প্যারেড!’ অবশেষে কর্নেল পিছু হটতে বাধ্য হন। নিকটেই দণ্ডায়মান তার শ্বেত অশ্বে চড়ে বসেন ত্রস্ত ভাব নিয়ে। ওদিকে তখন বিউগল আর ড্রামের শব্দ বৃথাই আস্ফালনের চেষ্টা করছে সিপাহীদের উচ্ছ্বসিত চিৎকারের সামনে। গলা তুলে সুবাদার হেঁকে ওঠে

‘প্যারেএএড ডিসমিস!’

 

১ লা নভেম্বর বেলা প্রথম প্রহর কর্নেলের বাংলো, ব্যারাকপুর

‘ইজ দিজ সাম কাইন্ড অব জোক মিস্টার কার্টরাইট?’ জেনারেল প্যাগেট আজ প্রত্যুষেই অবগত হয়েছেন চাণকের খবরে। এক লাইনের ছোট্ট এক চিঠিই যথেষ্ট স্যার উপাধি প্রাপ্ত এই পোড় খাওয়া জেনারেলের পক্ষে অবস্থা অনুধাবনের জন্য। তাই রাত থাকতেই তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে রওনা দিয়ে ছিলেন ব্যারাকপুরের উদ্দেশে।

‘সাসপেক্টেড আর্মড রিভোল্ট। এলার্ট আর্মি।’ রাত থাকতেই ঘুম থেকে তুলে ঘোর সওয়ারী ডাক হরকরা তাঁকে এনে দিয়েছিল কার্টরাইটের বার্তা। গুরুত্ব উপলব্ধি করে কিছু সময়ের মধ্যেই দুই ব্যাটালিয়ন রাজশাহী বাহিনীকে এলার্ট জানিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন ব্যারাকপুরের উদ্দেশ্যে। সকালের ব্রেকফাস্ট অবধি করা হয়নি তার। এখন কার্টরাইটের বাংলোতে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে রাগটা উগরে ফেললেন।

‘দে কান্ট টার্ন দেমসেলভস ইন জাস্ট ওয়ান নাইট। ইট মাস্ট বি প্ল্যানড। অ্যান্ড ইউ নো নাথিং? ইউ হ্যাভ নো ক্লু? ফর গডস সেক স্পিক আপ কার্টরাইট।’

‘আই—আই সিরিয়াসলি হ্যাড নো ক্লু স্যার, হ্যাড ফিউ ডাউটস বাট নো ক্লু বিফোর ইয়েস্টারডে নাইট স্যার। আই হ্যাভ মাই ঔন ইনফর্মার অ্যামঙ্গ দেম, এ লোকাল ল্যাড, বাট হি অলসো হ্যাড নো ক্লু।’

‘বাট দ্যাটস অ্যাবসার্ড, টুডে মর্নিং উইথ 47, 62 অ্যান্ড 26 দেয়ার ওয়ার অলমোস্ট থ্রি-থাউসেন্ড শিপয়স। ইন জাস্ট ওয়ান নাইট দে ক্যান্ট টার্ন দেমসেলভস এজ রিভল্টি। ইট হ্যাজ টু বি প্ল্যানড, দেয়ার মাস্ট বি ওয়ান ওর মোর দ্যান ওয়ান লিডার, অ্যান্ড দেয়ার আর মাল্টিপল রিজনস অবভিয়াসলি। ইউ কান্ট জাস্ট সে ইউ নো নাথিং অ্যান্ড রিলাক্স। ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া হোয়াট হ্যাপেনড ফিউ ইয়ার্স আর্লিয়ার ইন আর্মি ক্যান্টনমেন্ট অব ভেলোর।’

‘নো স্যার।’

‘ইন 1806 দ্য নেটিভ শিপয়স অব ভেলোর ক্যাম্প গট ফিউরিয়াস অ্যান্ড উইদিন ফিউ আওয়ার দে কিলড 130 ইউরোপিয়ানস। ইউ আন্ডারস্টান্ড। ওয়ান থারটি। 15 অ্যামঙ্গ দেম বিলং টু এলিট ক্লাস। ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনি আইডিয়া হোয়াট দিস নেটিভ শিপয়স ক্যান ডু।’

‘ইয়া, টুডে দে লুকড ফিউরিয়াস স্যার। ইভেন আই ওয়াস স্কেয়ার্ড ফর সামটাইম।’

‘হোয়াট দে ওয়ান্ট?’

‘অ্যাম নট টোটালি শিওর স্যার বাট আই গেস দে ডোন্ট ওয়ান্ট টু গো টু বার্মা।’

‘বাট দ্যাটস অ্যাবসার্ড। উই নিড দেম ইন বার্মা।’

‘ক্যানট উই ম্যানেজ সামথিং এলস স্যার?’

‘আর ইউ কিডিং মি কার্ট? ডোন্ট ইউ নো কোম্পানিস কন্ডিশন ইন দ্য ব্লাডি বার্মা ওয়ার? ইন রেঙ্গুন অনলি উই লস্ট এইটটি পার্সেন্ট অব আওয়ার শিপয়স। ম্যাক্স অব দেম ইন দ্যাট ব্লাডি প্লেগ প্যান্ডেমিক। উই হ্যাভ টু ফোর্স দেম টু বার্মা।’

‘স্যার স্যার, নিউজ স্যার নিউজ। ‘

ওনাদের কথোপকথনের মধ্যেই দৌড়ে বাংলোয় প্রবেশ করে রতনলাল। উত্তেজিত ভঙ্গিতে কী বলে তা বোধগম্য হয় না প্যাগেট সাহেবের।

‘হু ইজ হি?’

‘আওয়ার নেটিভ সুবাদার স্যার। লুকস লাইক হি গট সাম নিউজ’।

 

১ লা নভেম্বর, সময় ঐ, স্থান প্যারেড গ্রাউন্ড, চাণক

সূর্য এখন পুব দিগন্ত ছাড়িয়ে উঠে এসেছে অনেকখানি। তবে অসময়ে মেঘ জমছে পশ্চিম কোণে। শীতের শুরুর সময়ে বৃষ্টিপাত বিরল না হলেও অনভিপ্রেত। জমায়েত হওয়া সিপাহীরা সেই প্রত্যুষ কাল থেকেই মাঠে রয়েছে। তাদের কেউ ছাউনিতে ফিরে যায়নি। এই সময়ে সূর্যের তেজ কমে আসে তাই রোদ বাড়লেও মাঠের মধ্যে তাদের জমায়েত নড়চড় হয়নি একটুও। আজ মাঠে সিপাহীর সংখ্যা প্রায় তিন সহস্রাধিক। তার কারণ এই যে ৪৭ নম্বর বাহিনীর সঙ্গে সেখানে জমায়েত হয়েছে কাল অনেক রাত্রে ব্যারাকপুর আসা আরও দুই বাহিনী ২৬ এবং ৬২ তম রেজিমেন্টের সিপাহী। তারা আজকের প্রতিবাদের ঘটনার পূর্বপরিকল্পনা সম্বন্ধে কিছু মাত্র অবগত না থাকলেও এখন তাদের মধ্যে অনেকেই অন্যান্যদের মুখে শুনে সমর্থন জানিয়েছে এই প্রতিবাদের।

মাঠেরই মধ্যে মাটিতে বসে বিন্দা শুনছিল ২৬ তম বাহিনীর এক তরুণ বাঙ্গালী সিপাহী হরিলালের কথা। এই বছর মার্চ মাসে প্রথম এই ব্যারাকপুর থেকেই ১৩০০ সিপাহীর এক রেজিমেন্টকে পাঠানো হয় বার্মা। এই তরুণ সেই বাহিনীর এক সদস্য ছিল। সেবারও তাদেরকে বঙ্গ দেশের কক্স বাজার অবধি নিজেদের সামগ্রী নিজেদের বইতে বাধ্য করা হয়।

‘—মার্চের প্রথম হপ্তায় তো আমরা পা দিলাম বার্মা দেশে। সে যে কি দেশ বললে পেত্তায় যাবেন তিয়ারী জী। শুধু পাহাড় আর জঙ্গল, পাহাড় আর জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট পাহাড়ি গাঁ। প্রথম প্রথম পথের কষ্ট ছাড়া সমস্যা কিছু ছিল নাকো। সারাদিন পিঠে বোঁচকা নিয়ে পাহাড় জঙ্গল খেদিয়ে হাঁটা। আর সুজ্জি ডুবলে কোনো একটা সমতল মত জায়গা দেখে রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া। দিনের শেষে পেট ভরা খাবার পেলে সবারই মন খুশ থাকে। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন থাকল না কো। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই কী এক রোগ শুরু হল, যার হত তাকে একদম শ্যাষ না করে ছাড়ত না। সব মিলিয়ে মাস দুয়েক ছিলাম বার্মা দেশে। যুদ্ধ হয়েছে শেষের দিকে কয়দিন কিন্তু ততদিনে আমাদের সব গেছে, যত সিপাহী গেছিলাম রোগে ভোগে তখন আমরা অধধেক হয়ে গেছি। বেশিরভাগই মরেছে রোগে। তারপর শুরু হল খাবার সমস্যা। যুদ্ধের জায়গা, সৈন্যরা খাবার না পেলে চলে বল? প্রথমে শুরু হল আধ পেটা খাওয়া। তারপর তাও বন্ধ। জঙ্গলের মধ্যে ফল পাকুড় কিছু পেলে পেটে দিতাম। তাও সে মা জননীর দয়া হলে তবে। আমার শরীর ভেঙ্গে গেল। অবশেষে মে মাসে আমাদের ক্যাপ্টেন পিছু হটার আদেশ দিলেন। সে যেন সাক্ষাৎ দেবদূত। ক্যাপ্টেন নোটন নাম তাঁর। সেই নাকি আরেক ক্যাপ্টেন ডাভন না কী যেন নাম তার সঙ্গে কথা বলে আমাদের দেশে ফিরিয়ে দেয়। কতজন ফিরেছিলাম জান বাবুরা? মাত্র ২০০। বাকি সব মায়ের ভোগে—’

হরিলালের কথা শুনতে সেখানে বেশ ভিড় জমে গেছিল। একে একে টুকরো টুকরো নানা কথা উঠে আসছিল সিপাহীদের মধ্যে। যেমন জানা গেল মাদ্রাজি সিপাহীদের নাকি বেতন দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে বার্মা পাঠানোর আগে। তাদের নাকি সকল মাল পরিবহনের জন্য গরু আর ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই পোড়া বঙ্গদেশেই যেন লাল মুখো সাহেবদের দেওয়ার কিছুই নাই। শুধুই নেওয়ার আছে।

এত কথার মধ্যে এবার এ কথাও উঠল যে বিন্দার পরিকল্পনা মাফিক এরকম প্রতিবাদ জমায়েতে আদৌ কোনো কাজ হবে কিনা। গোরা সিপাহীরা তো গণ্ডগোলের শুরুতেই প্যারেড প্রাঙ্গণ থেকে ভেগে গেছে, ‘আমাদের উচিত এবার দল বেঁধে গিয়ে অস্ত্রাগারের দখল নেওয়া।’ জমায়েতের মধ্যে এক সিপাহী বলে উঠল গলা উঁচিয়ে।

‘কভি নেহি।’ উঠে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলে উঠল বিন্দা। ‘কই সিপাহী এইসা নেহি করেগা।’

‘তা না করলে গোরাগুলো যদি আমাদের উপর গুলি চালিয়ে হামলা করে?’

‘নেহি, হমলগ খুন খারাপা নেহি চাতে। আগর হামলগ আরমারী লুঠেঙ্গে তো উনে ভি হামপর সশস্ত্র আক্রমণ করনেকা এক বাহনা মিল জায়গা।’

‘লেকিন এই ভাবে হাত গুটিয়ে বসে থেকে কী লাভ হচ্ছে বলো তিয়ারী জী। প্রতিবাদ করতে অস্ত্র লাগে, রক্ত ঝরাতে হয়। এতজন রয়েছি আমরা। সবাই মিলে ওই কয়টা গোরাকে---’

‘নেহি, ইয়ে সোচ হি গলত হ্যায়। হমলোগ কুছ খুন খারাপা নেহি করেনঙ্গে। হমলোগোকো জো ভি কুছ ক্যাহনা হ্যায়, ইয়া হামারি জো মাঙ্গে হ্যায় উও হামলগ অহিংসাকে মাধ্যম সে পেশ করেনঙ্গে। হামলোগ এহি প্যারেড গ্রাউন্ড মে রহেঙ্গে, মার্চ নাহি করেঙ্গে, ছাউনি পে ভি নেহি লোটেনগে জবতক হামলগ কি বাত নাহি মান জায়গা।’

‘আমি বলছি গুলি বন্দুক নিয়ে হামলা না করলে কিছু হবে না তিয়ারী জী। তুমি চেন না গোরাদের।’

‘মুঝে পতা হ্যায়, বহুত আচ্ছা তারাসে পাহেচানতে হ্যায় হম উনে। আগার হামলগ আজ গোলা বারি করেঙ্গে তো কাল উও লোগ কলকাক্তা সে ঔর গোরা সিপাহী বুলা লেঙ্গে ঔর হামারে উপর টুট পড়েঙ্গে কামান লেকে। বহুত খুন খারাপা হোগা।’

‘তিয়ারী জী, তিয়ারী জী’। দুই সিপাহীর বাকবিতণ্ডার মধ্যেই আরেক সিপাহী ছুটতে ছুটতে প্রবেশ করে।

‘বোল ভোলা, কুছ খবর হ্যায় ক্যয়া?’

‘হা ভাইয়া, উও জো জেনারেল প্যাগেট সাহাব হ্যায় না? উও ইহা আ গ্যয়ে হেয়। ম্যায়নে খুদ দেখা।’

‘বহুত আচ্ছা, অব হামলোগোকো এক খৎ লিখনা হ্যায় জেনারেলকে লিয়ে, ওহিপে হাম হামারি সারি মাঙ্গে লিখেঙ্গে। জগন্নাথ, জগন্নাথ কাহা হ্যায়?’

‘উও তো ছাউনি পে লট গ্যয়ে কব। পুছনে সে বাতায়া কি ইন সব সে উনকা কোই লেনা দেনা নাহি। শালা গদ্দার, ব্যক্ত পে ছোর গ্যয়া ভাইলোগ কো?’ কথা শেষ করে একদলা থুতু ছিটায় মাটিতে ভোলানাথ।

বিন্দার ঠোঁটের কোণে কিন্তু হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে। জগন্নাথ সেটাই করছে যেটা তাদের পরিকল্পনা। অহিংসার পথে দাবী দাওয়া জানালেও গোরা পল্টন ওদের উপর যা ইচ্ছে তাই করতে পারে সেটা ভালো মতো জানে বৃন্দা। ওদের কিছু হয়ে গেলে জগন্নাথকেই আসরে নামতে হবে। ওদের সব কথা জানাতে হবে সবাইকে, ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে এই প্রতিবাদের বীজ। নিজের দেশের মাটিতে কোনো বিদেশী যেন আর মর্জি মতো রাজত্ব চালাতে না পারে কোনো দেশীয় সিপাহীর ওপর। সেই বার্তা দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য জগন্নাথকে আলাদা থাকতেই হবে। তার জন্য এখন এটাই সবার জানা ভালো যে জগন্নাথ এই আন্দোলনে সামিল নয়। ব্রিটিশরা যদি এখানকার কোনো সিপাহীকে গ্রেপ্তার করে কথা উগলানোর চেষ্টাও করে তাহলেও তারা জানবে যে জগন্নাথ এই আন্দোলনে নেই। মনের ভাব মনে রেখেই তাই মুখ খোলে বিন্দা।

‘ঔর বাকি গ্যরা সাথী লোগকো বুলাও, খৎ লিখনা হ্যায়, ঔর হামারে সুবাদার সাহেব কোভি বুলাও। ওহি জেনারেলকে পাস খৎ লেকে জায়েঙ্গে।’

অহিংসার পথেও যে আন্দোলন, প্রতিবাদ চলতে পারে এমন ধারনা বিন্দার মস্তিষ্কে কীভাবে প্রণীত হয়েছিল বলা শক্ত। তবে যে দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে সে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় অন্য। একদিকে ১১ জন সঙ্গী সহযোগে তাদের দাবি দাওয়া লিপিবদ্ধ করতে ব্যস্ত তখন অত্যুৎসাহ কিছু সিপাহী উত্তেজনার বসে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্যারেড গ্রাউন্ড সংলগ্ন মঞ্চের সন্নিকটস্থ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকার উপর। নিমেষে তা ভূলুণ্ঠিত হল। তারপর উন্মত্তের মতো সেই সিপাহীর পাল চলল অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বাসনায়।

 

১ লা নভেম্বর, সময় বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর, স্থান সাহেব বাংলো, ব্যারাকপুর

‘সো, হোয়াটস দ্য মোরাল অফ দেয়ার লেটার কার্ট?’

গভর্নর জেনারেল প্যাগেট সাহেব স্থানীয় ভাষা বুঝতে অপরোগ তাই সুবাদারের চিঠি পড়ার শেষে তিনি প্রশ্ন করলেন কার্টরাইটকে। দেশীয় সিপাহীরা যে এরকম লিখিত ভাবে নিজেদের দাবি দাওয়া ইউরোপীয় কায়দায় পেশ করতে পারে তা প্যাগেট সাহেবের কাছে নিতান্তই অপ্রত্যাশিত।

‘ওয়েল স্যার মেইনলি দে আর আস্কিং ফর ফোর থিংস। ফার্স্ট, দ্যে উইল নট গো টু বার্মা।—

‘হুইচ ইজ অ্যাবসোলুটলি রিডিকিউলাস, দ্যে আর বাউন্ড টু লিসন আওয়ার অর্ডার। নেক্সট—’

‘সেকেন্ডলি দ্যে ওয়ান্ট ডাবল স্যালারি অজ শিপয়স, অ্যান্ড প্রমোশন আজ পার এক্স পেরিয়েন্স।’

‘অ্যাষ্টনিশিং ব্ল্যাসফেমি, দেন?’

‘দে নিড অল দ্য ফেসিলিটি ইকুয়াল টু অ্যান ইউরোপিয়ান শিপয় ওর অ্যাট লিস্ট ডবল স্যালারি। অ্যান্ড ফাইনালি দ্যে সেইড ইফ অনলি উই গেরেন্টি অল অফ দেয়ার ডিমান্ডস অ্যান্ড অরেঞ্জ বুল কার্ট ফর অল অফ দেয়ার বিলনগিংস দেন অনলি দ্যে উইল থিংক এবাউট গোয়িং টু বার্মা।’

‘ব্লাডি নিগার্স, হোয়াট ডিড দ্যে থিংক অ্যাবাউট দেমসেলভস? ডোজ ব্লাডি শিপয়স আর অ্যাজ ব্ল্যাক অ্যাজ মাই হ্যাট অ্যান্ড দ্যে ওয়ান্ট সেম ফেসিলিটি লাইক আস? রিয়ালি? ডোন্ট দ্যে নো হোয়ার দ্যে বিলং?’

‘বাট স্যার দ্য ফ্যাক্টস আর ট্রু। আওয়ার ড্রামার কার্ল গেট মোর স্যালারি দ্যান দেয়ার সুবাদার। মোরওভার ফ্রম দেয়ার 6 রুপি পার মান্থ স্যালারি উই কাট 2 রূপি দিস মান্থ ফর দেয়ার ব্যাগ টু ক্যারি লাগেজ টু বার্মা।’

‘মে বি, বাট হোয়াট ইজ রং হেয়ার? ইন এনি কেস দ্যে ক্যান্ট বি কম্পেয়ার্ড উইথ ইউরোপিয়ান্স?’

‘বাট স্যার অ্যাট প্রেজেন্ট কন্ডিশন উই হ্যাভ টু কনসিডার সাম অফ দেয়ার ডিমান্ডস?’

‘আই সে উই মাস্ট নট। ইফ টুডে উই কনসিডার মে বি টুমরো দ্যে উইল ডিমান্ড মোর। ডিজ হ্যাভ টু বি সাস্পেরসড।’

‘বাট স্যার—’

পুনর্বার বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে যায় দুই সাহেবের কথোপকথন। এবার ঘোড়ার পিঠে ক্ষিপ্র ভাবে বাংলোয় প্রবেশ করে কার্ল।

‘স্যার ইউ হ্যাভ টু কাম স্যার।’

‘হোয়াট ইজ ইট কার্ল?’

‘দ্যে আর ট্রাইং টু লুঠ দ্য আরমারী স্যার।’

‘মাই গড কার্টার, কান্ট ইউ ডু সামথিং। ইটজ গোয়িং আউট অব হ্যান্ড। আই নিড টু মেসেজ ফোর্ট উইলিয়াম।’

ক্ষিপ্র হস্তে কোমরে তলোয়ার এবং রিভলবার গুঁজে নেন কার্টার। ঘোড়ার পিঠে চেপে সেই দণ্ডেই ছুটে বেরিয়ে পরেন আরমারী র দিকে। শীতের শুষ্ক ধুলোর চাদর অনুসরণ করে কার্ল।

 

১ লা নভেম্বর, সময় বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর, স্থান প্যারেড গ্রাউন্ড, চাণক

‘বিন্দা, বিন্দা, ভাই সত্যনাশ হো গ্যয়া, জো বাঙ্গালী তেরে সাথ বাহেস কর রহা থা উও কুছ লেরকা লেকে আরমারী লুঠনে চলা গ্যয়া।’

‘কেয়া বাত কর রাহে?’

‘সচ, তু অভি চল। উস্কো রোকনা পারেগা।’

বিধাতার আশীর্বাদে মানুষ চেতনা লাভ করে ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তে কিন্তু সেই চেতনার প্রয়োগ রপ্ত করতে অনেকাংশেই এক জীবনকাল অপর্যাপ্ত পর্যবেশীত হয়। ক্ষণিকের উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে চেতনাহীন ভাবে কর্মে বা বলা ভাল দুষ্কর্মে লিপ্ত হওয়ার ঘটনাও ইতিহাসে বিরল নয়। বিন্দার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ফলাফল নিয়ে সন্দিহান হয়ে সেই সিপাহী তো পৌঁছে যায় অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করতে কিন্তু তার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে সে বিষয়ে ভাবার অবকাশ বা যোগ্যতা কোনোটাই তার ছিল না। তাই তার লুণ্ঠনের প্রয়াসের সঙ্গে দাঙ্গাবাজের লুণ্ঠন লিপ্সার কোনো ফারাক ছিল কিনা তা বলা কঠিন।

চাণক ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত অস্ত্রাগারগুলির মধ্যে অন্যতম বৃহৎ। এবং প্রত্যাশা মতন তার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ইউরোপিয়ান দুর্গের থেকে কম নয় কিছু। হস্তী বাহিনী বা কামানের গোলাবর্ষণ অবধি যে অস্ত্রাগার যথেষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতিরোধ করতে সক্ষম, যার প্রবেশদ্বারে অষ্ট প্রহর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গোরা সিপাহী টহল দেয় তাকে লুঠ করা আর যাই হোক উন্মত্ত একদল সিপাহীর পক্ষে নেহাতই বাতুলতা।

বাঙ্গালী সিপাহীর নেতৃত্বে উন্মত্তের মতো কোলাহল করতে করতে কোম্পানির পতাকা ছিন্ন করে একদল সিপাহী উপস্থিত হয় অস্ত্রাগারের সামনে। নিকটে দণ্ডায়মান গোরা সিপাহী উন্মত্ত সিপাহীদের দেখেই পলায়ন করে এবং পথিমধ্যে কার্লকে দেখে তার মারফতই কর্নেলের নিকট সংবাদ পাঠায়। এদিকে তাদের পলায়ন দেখেই সোৎসাহে সেই সিপাহীরা ব্রতী হয় বীর বিক্রমে হাতের মাস্কেটের গুঁতো মেরে অস্ত্রাগারের প্রবেশদ্বার ভাঙতে। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হন কর্নেল কার্টরাইট। এবং তাকে অনুসরণ করে মুষ্টিমেয় একদল ঘোর সওয়ারী গোরা সিপাহী-দল।

বলাই বাহুল্য গলদঘর্ম হয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চেষ্টায় ব্রতী থাকলেও উন্মত্ত সিপাহীরা ব্যর্থ হয় প্রবেশদ্বারের সামান্যতম কোনো অনিষ্ট সাধনে। ইতিমধ্যে গোরা সিপাহী-দল এসে পড়লে বেশ একটা হুড়োহুড়ি অবস্থা উপস্থিত হয়। সশস্ত্র কর্নেল সাহেবকে আক্রমণ করতে শত উন্মত্ততার মধ্যেও কারোর সাহসে কুলায় না, বরং বিচ্ছিন্ন ধস্তাধস্তিতে কিছু গোরা সিপাহী ঘোড়া থেকে ভূলুণ্ঠিত হয়। তাদের সিপাহীর বেশও যারপরনাই ছিন্ন হয় এবং শারীরিক কোনো ক্ষতি হবার আগেই তারা যেমন দল বেঁধে এসেছিল তেমনই দল বেঁধে পলায়ন করে।

কর্নেল সাহেব এই অবস্থার মধ্যে এক অতি উত্তেজিত সিপাহী কর্তৃক সামান্য আহত হন। সেই সিপাহী কর্নেলের ঘোড়ায় সংযুক্ত কোম্পানির পতাকা ছিন্ন করে এবং মাস্কেটের সঙ্গে সংযুক্ত বেয়নেটের খোঁচায় কর্নেলের হাত রক্তাত্ব হওয়ায় কর্নেল তার উদ্যত তরবারি ফেলেই প্রস্থান করেন। শেষমেশ অবশ্য সিপাহীরাও অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে ব্যর্থ হয়ে অস্ত্রাগারের সামনেই অবরোধ করে বসে। বিন্দা যখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় তখন যা হবার তা হয়ে গেছে। উন্মত্ত সিপাহীরাও এতক্ষণে তাদের কর্মফল সম্বন্ধে ভাবিত হয়ে শান্ত হয়েছে।

হায়, তখন যদি তারা বুঝত যে তাদের এই হঠকারিতা শতগুণ স্ফীত হয়ে বর্ণিত হবে জেনারেল সাহেবের কাছে এবং তিনিও বাধ্য হবেন চরমতম সিদ্ধান্ত নিতে। মানুষ সত্যি ভাবে এক আর বিধাতা মুচকি হাসেন শুধু।

 

১ লা নভেম্বর, বেলা তৃতীয় প্রহর, প্যারেড গ্রাউন্ড, চাণক

বিন্দা সহ জমায়েত সহস্রাধিক সিপাহীর মধ্যেই এখন ভয় ঢুকেছে যে অস্ত্রাগারের ঘটনাকে অজুহাত করে এবার গোরা সিপাহী তাদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ চালাতে পারে। সিপাহীদের অস্ত্র বলতে মাস্কেট বন্দুকের অগ্রে বসানো বেয়নেট। গুলি নিয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে আসা বা নিজের কাছে বারুদ ও গুলি রাখা কোনোটাই কোম্পানির আইন সিদ্ধ নয়। তাই আত্মরক্ষার অস্ত্র বলতে সিপাহীদের ভরসা কেবল বেয়নেট। আশার কথা এই যে চাণক ক্যান্টনমেন্টে গোরা সিপাহীর সংখ্যা নগণ্য। এখন অবধি এরূপ কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি যে জেনারেল বা কর্নেল সাহেব কেউ কলকাতা থেকে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে। তবু দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে রয়েছে বিন্দার মন জুড়ে। ওদিকে চাণকের আকাশেও মেঘের ঘনঘটা। সময়ের হিসেব বলছে সূর্য মধ্যগগন অতিক্রম করে গেছেন কিন্তু আকাশের রং বলে চলেছে অন্য কথা। পরিবেশ ক্রমেই হয়ে উঠছে ভ্যাপসা আর্দ্র।

অস্ত্রাগারের ঘটনা একেবারেই অনভিপ্রেত হলেও এখন আর এ নিয়ে করার কিছু নেই। বরং একটি ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া গেছে যে অস্ত্রাগার সম্পূর্ণ অবরোধ করে রাখা হবে। প্রায় দুই শতাধিক সিপাহী সেখানে অস্ত্র এবং মশাল নিয়ে প্রস্তুত আছে যাতে রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গোরা সিপাহী যেন সেখান থেকে গুলি বারুদ না নিয়ে যেতে পারে। যদিও গোরা সিপাহীদের আইন অনুযায়ী তারা সীমিত পরিমাণে আগ্নেয়াস্ত্র গুলি বারুদ সমেত নিজেদের কাছে রাখতে পারে তবে তা মোটেও যথেষ্ট নয়।

এদিকে প্যারেড প্রাঙ্গণেও অবরোধে সামিল দুই সহস্রাধিক সিপাহী। বিন্দা সহ দ্বাদশ নেতার নেতৃত্বে তারা সবাই পবিত্র গঙ্গাজল ও তুলসী স্পর্শ করে শপথ করেছে যে এই বিক্ষোভ যতটা শান্তিপূর্ণ ভাবে করা সম্ভব ততটাই করা হবে। কেউই সমস্ত দাবি পূর্ণ না হলে প্যারেড প্রাঙ্গণের অবস্থান বিক্ষোভ ছেড়ে ছাউনিতে প্রত্যাবর্তন করবে না। সুবাদার রামতিয়ার জী তাদের এবং গোরাদের মধ্যে সংবাদ আদান প্রদানে ব্রতী গেছেন। মৌখিক ভাবে তিনিও এই আন্দোলনের সপক্ষে মত পোষণ করেন। এবার অপেক্ষা কেবল কোম্পানির মতামত শোনার।

‘বিন্দা?’ সুবাদারের কণ্ঠস্বরে মুখ তুলে তাকায় বিন্দা। এতক্ষণ এক দৃষ্টে সে তাকিয়ে ছিল স্রোতস্বিনী গঙ্গার দিকে। বিচ্ছন্ন কিছু কচুরি পানার ঝাঁক নিয়ে নির্মল জল বয়ে চলেছে সমানে। তার তীরেই যে এত কিছু হয়ে চলেছে আজ সকাল থেকে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন গঙ্গা মাইয়া।

‘বলিয়ে, কুছ বো লে উনলোগ?’

‘কর্নেল সাহেব আহত, গুরুতর না হলেও অবস্থা খুব ভালো নয়। জেনারেল প্যাগেট সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন সমস্ত অস্ত্র ত্যাগ করে ছাউনিতে ফিরে না গেলে আমাদের সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতা করতে আগ্রহী নয়।’

‘জো হো গ্যয়া ও তো ম্যায় রোক নেহি পায়া, পর অভি হামলগ এইসে হি রহেঙ্গে জবতক হামলগ কা সারি বাত মান না লে।’

‘আমার মনে হয় না কাল সকালের আগে কোম্পানির কেউই কোনোরকম আলোচনা করবে আমাদের সঙ্গে। কর্নেলের ব্যাপারে সবাই এবার চরম পন্থা নেওয়ার কথা ভাবছে। কলকাতায় চিঠি পাঠানো হয়েছে?’

‘সচ? কেয়া থা উও খৎ মে?’ বিন্দা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এই ভেবে যে ইংরেজরা আরও গোরা সিপাহী তলব করার জন্য কলকাতায় দূত পাঠাবে।

‘সবটা আমি জানি না কিন্তু কর্নেল সাহেব বলেছেন আমাদের দাবি দাওয়া বড়লাটকে জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এরা বড়লাটের সিদ্ধান্ত জানতে চায় এই প্রসঙ্গে।’

কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে পায় বিন্দা।

 

১লা নভেম্বর, সন্ধ্যে আগত প্রায়, সাহেব বাংলো ব্যারাকপুর

‘ফর মেরিস সেক কার্টার, ইওর উন্ডস আর স্টিল ফ্রেশ অ্যান্ড স্টিল ইউ আর থিঙ্কিং দ্যাট দিস ম্যাটার ক্যান বি সলভড বাই টকিং? হোয়েন ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট ম্যাটার ইজ অলরেডি আউট অফ হ্যান্ড?’

কর্নেল কার্টার এই সুজলা সুফলা উপনিবেশের মোহাচ্ছন্ন না হলেও বিদ্রোহের ব্যাপারে নরম পন্থা অনুসরণ করারই পক্ষপাতী কিন্তু অপরদিকে জেনারেল স্যার প্যাগেট সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। বিদ্রোহ দমনে তার মতে অগ্নিবর্ষণই একমদ্বিতীয়ম ঔষধ। আজ সকাল অবধি যদিও বা তিনি সিপাহীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালাতে নিমরাজী ছিলেন, অস্ত্রাগারের ঘটনার পর তিনি দৃষ্টান্তমূলক ভাবে চরম পন্থা ব্যাবহারের দিকে ঝুঁকেছেন।

‘আই স্টিল বিলিভ স্যার দ্য ইনসিডেন্ট অব আরমারী ওয়াস এন একসিডেন্ট। ম্যাক্স অফ দেম ইজ মেন্টাইনিং পিসফুল প্রটেস্ট এগেন্সট আওয়ার বার্মা ক্যাম্পেন।’

‘নো, নো ননসেন্স। দে আর অবসলুট ননসেন্স। অজ পার লাস্ট নিউজ অলমোস্ট ২০০ অব দেম আর গ্যাদার্ড ইন আরমারী এরিয়া। রেস্ট অব দেম ক্যান ডু এনিথিং এনিটাইম। ডোন্ট নো এবাউট ইউ বাট আই বিলিভ ব্যারাকপুর ইজ গোয়িং টু বি সেকেন্ড ভেলোর। ডোজ নেটিভ শিপয়স আর জাস্ট ব্লাডি ডগস অ্যান্ড দে ক্যান অ্যাটাক এনিটাইম।’

‘দে আর স্টিল আওয়ার সোলজার স্যার।’

‘নট এনি মোর, অ্যান্ড ফর ইওর ইনফো দে আর আওয়ার সার্ভেন্টস টু হুম উই পে মানি।’ প্যাগেট সাহেবের ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙ্গে যায়। ‘লিসেন আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি অফ ইওর আরগুমেন্টস। আই অলরেডি সেন্ড মেসেঞ্জার টু ক্যালকাটা ফর ফরটি সেভেন্থ ল্যাঙ্কাশায়ার রেজিমেন্ট এন্ড ফার্স্ট রয়্যাল রেজিমেন্ট। অ্যান্ড আস্কড দেম টু কাম শার্প ভায়া গ্যাঞ্জেস। দে উইল বি হেয়ার টু-নাইট অর ম্যাক্স টুমরো ডন।’

হতাশ ভাবে মাথা নত করেন কর্নেল। জেনারেলের মতবাদের প্রতিবাদ তাঁর বিরুদ্ধ। তাঁর সকল অনুনয় স্তিমিত করার জন্য যথেষ্ট তাঁরই হাতের সুগভীর ক্ষত।

‘অ্যান্ড বাই দ্য ওয়ে, ডিড ইউ ফাইন্ড হুইচ বাস্টার্ডস আর দেয়ার লিডার্স?’

‘নট ডিফিনেটলি সিওর টিল নাও। নিড টু আস্ক মাখন অ্যাবাউট দ্যাট স্যার।’

‘অ্যান্ড হু অন অর্থ ইজ হি?’

‘আওয়ার এজেন্ট স্যার।’

‘গুড অ্যারেস্ট হিম অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল।’

 

২রা নভেম্বর, রাত্রি শেষ প্রায়, সাহেব বাংলো ব্যারাকপুর

‘স্যার অ্যাম স্টিল সেয়িং দে আর আওয়ার ঔন সোলজারস। দ্য ম্যাটার কুড বি—’

‘রিয়ালি কার্ট??? রিয়ালি? ফ্রম হোয়েন ডিড ইউ স্টার্ট লাভিং দেম? আর ইউ ফোর্গেটিং হু উই আর কার্ট?’

‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট ওয়ার উইথ দেম স্যার, উই নিড দিস কান্ট্রি অ্যান্ড ওয়ার--’

‘এনাফ কার্ট। আই অর্ডার টু সারাউন্ড প্যারেড গ্রাউন্ড। ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু ইনটারাপ্ট!’

ফোর্ট উইলিয়াম থেকে জলপথে রাজশাহী সিপাহী দল এসে যখন ব্যারাকপুরে পদার্পণ করে তখনও রাত শেষ হতে বহু সময় বাকি। ক্ষয়াটে চাঁদ তখনও দৃশ্যমান আকাশের এক কিনারায়। সমগ্র ব্যারাকপুর তখন ঘিরে রয়েছে মায়াবিনী কুয়াশার চাদর। আকাশেও মেঘের ঘনঘটা। শুধু মাত্র কোন মন্ত্রবলে অন্ধকার রেহাই দিয়েছে এক ফালি চাঁদকে। গঙ্গা তীরবর্তী জঙ্গল থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে শৃগালের ডাক। দৈত্যাকৃতি তিন বজরা করে এসেছে দুই কোম্পানি রাজশাহী গোরা সিপাহী দল। তাদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র তো বটেই রয়েছে বেশ কিছু ছোট ও মাঝারি আকৃতির কামান। এই কামান শুধু আনা হয়েছে বিদ্রোহী সিপাহী নিধনের কাজে অতএব বিশালাকৃতির দূর পাল্লার কামান নিষ্প্রয়োজন। আর তা ব্যতীত ও প্যাগেটের হুকুম অনুযায়ী বর্জন করা হয়েছে সেই সমস্ত কিছু যা পরিবহন করা সময় ও পশুবল সাপেক্ষ। নিঃশব্দে ঘিরে ধরে শত্রু দমনে সিদ্ধ হস্ত প্যাগেট, তবেই না তাঁর জুটেছে স্যার উপাধি।

প্রথমেই বজরা থেকে কিছু সংখ্যক সৈন্য নেমে চলে গেল সাহেব বাংলোয়। এদের কাজ মূলত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং কর্মসূচী নির্ধারণ। এরপর এদের সংকেত মতো নেমে আসবে বাকি সিপাহী দল। যুদ্ধ শাস্ত্রে অজ্ঞ ৪৭ নং রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সিপাহীদের বোধের বাইরে চোরাগোপ্তা আক্রমণের কৌশল। তারা নিশ্চিন্তে প্যারেড গ্রাউন্ডে মশালের আলোয় অস্থায়ী শিবির বানিয়ে অবস্থান রত। স্রোতস্বিনী পুণ্য গঙ্গার বুক চিরেই যে তাদের মৃত্যু-দূত সমাগত সে সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

অল্প কিছু সশস্ত্র সৈন্য নিঃশব্দে কিনারা বরাবর প্যারেড গ্রাউন্ড অতিক্রম করে এসে উপস্থিত হল সাহেব বাংলোর সামনে।

‘উই নিড অ্যাটলিস্ট 100 মেন অ্যান্ড 3 হ্যান্ড হেল্ড ক্যাননস টু লিকুইডেট দ্য বাস্টার্ডস অ্যাট আরমারী। টেক দেম অ্যান্ড কভার দ্য আরমারী গেট। কিপ ইন মাইন্ড দ্যাট উই ডোন্ট নিড সারভাইভর্স। রেস্ট অফ ইউ সারাউন্ড দ্য প্যারেড গ্রাউন্ড বিফোর সান রাইজ। এভরি কর্নার শুড হ্যাভ ২ ক্যাননস এটলিস্ট। আই ওয়ান্ট টু ডু দ্য জব অ্যাজ সাইলেন্টলি অ্যাজ পসিবল। অ্যান্ড কার্ট? হোয়ার ইজ আওয়ার সুবাদার?’

‘আই সেন্ড হিম টু ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অফিস টু চেক হোয়দার উই কুড ম্যানেজ সাম বুলক কার্ট ফর ট্রান্সপোর্টেশন।’

‘স্টিল ইউ আর থিঙ্কিং দ্যাট ম্যাটার কুড বি সলভড বাই নেগোশিয়েটিং? আই পিটি ইউ।’

‘উইথ অল রেসপেক্ট স্যার আই আম ডুইং মাই ডিউটি। আফটার অল ডিজ উই হ্যাভ টু সেন্ড 47 টু বার্মা।’

‘অ্যাজ পার মাই প্ল্যান দেয়ার উইল বি নো 47 নেটিভ রেজিমেন্ট টুমরো কার্টার। উই আর গোয়িং ফর ফুল ফ্লেজড অ্যাট্যাক অ্যাট ডন। অ্যান্ড আই নিড ইউ বিসাইড মি।’

‘ইয়েস স্যার।’

‘আই ডিড নট হিয়ার ইউ কর্নেল!’

‘ইয়েসসস স্যার!’

‘গুড দেন। ইউ উইল লিড দ্য সোলজারস টু আরমারী। আই উইল টেক কেয়ার অ্যাবাউট প্যারেড গ্রাউন্ড।’

‘আর ইউ রিয়ালি গোয়িং টু ওপেন ফায়ার স্যার? ক্যান ইউ ডু দ্যাট ইন কোম্পানিস ল?’

‘ডোন্ট ইউ ডেয়ার ইন্টারফেয়ার মি কর্নেল।’ রাগে মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে জেনারেলের। ‘ফর ইওর ইনফো উইথ ১৭৮৭ ল আই ক্যান ডু এনিথিং হুইচ ইস নেসেসারি। সো ইদার ইউ ফলো মি ওর এম গোয়িং টু সু ইউ।’

এরপর আর কথা যোগায় না কর্নেলের। স্যালুট করে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হন।

‘ডোন্ট কমেন্স অ্যাট্যাক আনটিল ইউ হিয়ার সিগনাল ফ্রম প্যারেড গ্রাউন্ড।’

‘ইয়েসসস স্যার!’

একজন সিপাহী কেবল ঘোড়া নিয়ে চলল বজরার বাকি সিপাহীদের খবর দিতে। নিঃশব্দে প্যারেড গ্রাউন্ড অতিক্রম করেই সবেগে ঘোড়া ছুটল জাহাজ ঘাটের দিকে।

 

২রা নভেম্বর, প্রত্যুষ, প্যারেড গ্রাউন্ড চাণক

‘বিন্দা?’

মশালের আলোর পাশে গঙ্গার দিকে মুখ করে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে বিন্দা। বাকি সহস্রাধিক সিপাহীর অধিকাংশই বিচ্ছিন্ন ভাবে জমায়েত হয়ে গুজবে মত্ত তাদের মধ্যে কেউ আবার খোলা প্রাঙ্গণে ঘাসের উপর শুয়েই নিদ্রামগ্ন। শীতের প্রারম্ভের হিম জমছে সবারই শরীরে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন অবশ্য ফিরে গেছে তাদের ছাউনিতে। তাদের কেউ কেউ নিজের ছাউনিতে হাত চাপাটি বানিয়ে দিয়ে গেছে সতীর্থদের জন্য। কেউ আবার ব্যবস্থা করেছে পরিস্রুত পানীয় জলের।

গতকাল সন্ধ্যের পর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি গোরা সিপাহীদের। আসেনি গভর্নর বা কর্নেল সাহেবের থেকে কোনো খবর। বাকিদের সঙ্গে বিন্দার ও ধারণা কলকাতা থেকে বড়লাটের জবাব না আসা পর্যন্ত আর কিছুই ঘটবে না চাণকে। তবে তার জন্য হতোদ্যম হয়ে ছাউনিতে ফিরে গেলে চলবে না। নিজেদের দাবিতে অটুট থেকে অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে হবে এই প্যারেড গ্রাউন্ডে। সুবিশাল এই প্যারেড গ্রাউন্ডের কেন্দ্রস্থলে মূল জমায়েত করে রয়েছে সিপাহীরা। পরিধি মাপলে প্রত্যেক দিকে এই প্রাঙ্গণের বিস্তার কম করেও মাইল খানেক হবে। অস্ত্রাগারের অনভিপ্রেত ঘটনার পর অস্বাভাবিক রকম শান্ত রয়েছে সবকিছু।

এই অবস্থাই আরও বেশি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিন্দার। কাল সে ধরেই নিয়েছিল অস্ত্রাগারের ঘটনার পর গোরা রা সশস্ত্র আক্রমণ করবে, কিন্তু ঘটেনি সেরকম কিছু। চাণক ক্যান্টনমেন্টে গোরা সিপাহী অবশ্য হাতে গোনা তথাপি ব্রিটিশরা কেউ কোনোরকম আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেয়নি বরং কলকাতায় হরকরা পাঠিয়েছে বড়লাটকে তাদের দাবি সম্বন্ধে অবগত করার জন্য। সবটাই কি নির্বিঘ্নে হবে? হে ঈশ্বর তাই যেন হয়। চিন্তায় যখন মাথা ভারী হয়ে উঠেছে তখনি চেনা স্বরের ডাক শুনে মুখ তুলল বিন্দা। মুখের উপর বিন্দু বিন্দু হিম জমে রয়েছে।

‘সুবাদার জী। বলিয়ে, কাহা থে অব?’

‘ডি এম সাহেবের কাছে গেছিলাম কর্নেলের বার্তা নিয়ে।’

‘কেয়া বার্তা?’

‘আমাদের জন্য বলদ গাড়ির ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ডি এম সাহাব বলে দিয়েছেন এখন ব্যবস্থা করা যাবে না।’

‘ঔর কুছ?’

‘নাঃ, আমার কিছু সন্দেহ হচ্ছে বিন্দা, গোরাদের শয়তানি তো কম দেখিনি এত দিনে। ওরা ঠিক কিছু বড় মতলব বানাচ্ছে।’

‘জো ভি হো, ইধার সব মিলকে বিশ তিশ গোরে লোগ হ্যায়, ফির ডর কিস চিজ কা?’

‘আহা তুমি বুঝছো না ভাই, আমি তো ছিলাম ওদের সঙ্গে সন্ধ্যে থেকে। বন্ধ ঘরের মধ্যে ওরা বড় কিছু করার কথা বলছিল, গভর্নর জেনারেল সাহেব খুব চিৎকার করছিলেন।’

‘আপ নেহি থে ঘরকে অন্দর?’

‘পাগল, আমাকে বাড়িতেই ঢুকতে দেয় না কখনও, আমি তো অলিন্দ থেকে শুনছিলাম। ইংরেজিতে কথা হচ্ছিল, বুঝিনি সবটা কিন্তু মন বলছে আজ সকালেই খারাপ একটা কিছু হবে। আচ্চা ওই হরকরা যে খবর আনতে কলকাতা গেল ও যদি অন্য কোনো খবর দিতে যায়? কলকাতা থেকে যদি অনেক গোরা পল্টন চলে আসে?’

‘আহ, জ্যাদা সচিয়ে মত সুবাদার জি। পল্টন আয়েঙ্গে তো রাস্তা সে হি আয়েঙ্গে না? হামলগ তো জাগে হ্যায় সারা রাত। এইস কুছ নেহি হোগা।’

বড় বেশিই বিন্দা ভরসা করেছিল কোম্পানির আইনকে, ভরসা ছিল শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভের মধ্যে দিয়েই সমস্ত দাবী দাওয়ার অঙ্গীকার করিয়ে নেবে। ওদের কথোপকথনের মধ্যেই সাহেব বাংলোর দিক থেকে ভেসে এলো মৃদু ড্রাম বাজানোর আওয়াজ।

‘ও ক্যায়া সুবাদার জি? ইয়ে তো ব্যক্ত নাহি ড্রাম বাজানে কা?’ এক মুহূর্ত আগেও যে বিন্দা সুবাদারের কথাকে উড়িয়ে দিতে চাইছিল সহসা তার মনেও আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে আসে। তবে কি সত্যি গোরারা সিপাহী আনিয়েছে? বড় ভাবে আক্রমণের কথা ভাবছে? কিন্তু... কিন্তু তা কী করে সম্ভব? এত জলদি কলকাতা থেকে? তবে কি গঙ্গার পথেই? হাজারো প্রশ্ন ধেয়ে আসে বিন্দার মাথায়। প্রাঙ্গণের বাকি সিপাহীরাও শুনেছে ড্রামের আওয়াজ। মাঠের যেখানে যারা ছিল হুড়মুড়িয়ে সবাই আসতে থাকে কেন্দ্রের দিকে।

‘বাত কেয়া হ্যায় তিয়ারী জী? ইতনা সুবে ড্রাম?’

‘গোরে সিপাহী আ রাহা হ্যায় ক্যা?’

‘তিয়ারী জী দেখিয়ে দেখিয়ে!’

মাঠের চতুর্দিকে সহসা প্রজ্বলিত হতে থাকে শয়ে শয়ে মশাল।নিঃশব্দে চক্রাকারে ঘিরে ধরে এবার নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে ব্রিটিশ রেজিমেন্ট। প্রাঙ্গণের সিপাহীদের গুঞ্জনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ব্রিটিশ সিপাহীদের সমবেত পদধ্বনি। ড্রামের আওয়াজ চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে প্যারেড প্রাঙ্গণ। স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে কামানের চাকার ঘর্ঘর-ধ্বনি। সহস্রাধিক সিপাহীর বিস্ফারিত চোখের সম্মুখে ব্রিটিশ গোলন্দাজ বাহিনী প্রাঙ্গণের চতুর্দিক বেষ্টন করে ক্রমে কোণঠাসা করতে থাকে দেশীয় সিপাহীদের।

‘রেজিমেন্টটটট, হল্ট!’

ভোরের স্তব্ধতা খান খান করে প্যাগেট সাহেবের আদেশ ধ্বনিত হয় প্রাঙ্গণে। হাতের গুলি-শূন্য মাস্কেট সবলে আঁকড়ে ধরে ভীত সন্ত্রস্ত দেশীয় সিপাহী-দল। সমস্ত প্রাঙ্গণের চতুর্দিকে তখন গোরা সিপাহী দল, পদাতিক বাহিনী ও মুষ্টিমেয় অশ্বারোহী। শুধুমাত্র এক দিকে ফাঁকা দৃশ্যমান কারণ সেদিকেই স্রোতস্বিনী গঙ্গা বয়ে চলেছে। প্রত্যুষের এই রক্তক্ষয়ী নাটকের অন্তিম লগ্ন প্রত্যক্ষ করার বাসনায় যেন স্তব্ধ হয়েছে তার স্রোত। শীত কালীন প্রত্যুষের কুয়াশা কেটে গিয়ে দমবন্ধ স্তব্ধতা নেমে আসছে চাণক প্যারেড প্রাঙ্গণে।

‘অল শিপয়স অব 47 আর অর্ডারড টু সারেন্ডার নাও, দি স ইজ ইওর লাস্ট চান্স। পুট ডাউন দ্য গানস অ্যান্ড সারেন্ডার।’ আবার প্রাঙ্গণে ধ্বনিত হল প্যাগেটের কণ্ঠস্বর।

‘ইউ আর গিভেন 10 সেকেন্ড, সারেন্ডার নাও ওর উই উইল ওপেন ফায়ার।’

‘হাম খুন খারাপা নেহি চাতে হ্যায় সরকার।’ ততোধিক উচ্চ স্বরে এবার ধ্বনিত হল বিন্দার কণ্ঠস্বর। প্রাঙ্গণের দেশীয় সিপাহীরা ততক্ষণে কেন্দ্রস্থলে জমায়েত হয়েছে। সর্বাগ্রে বিন্দা।

‘ওয়ান!’

‘হামারে পাস গোলি নাহি হ্যায় সাহাব।’

‘টু!’

‘হামলগ মুকাবলা নেহি কর পায়েঙ্গে।’

‘থ্রি!’

‘হমলোগোকি মাঙ্গে মান লিজিয়ে হাম ওয়াপস—’

‘ফোর!’

‘সাঁথিও, বেয়নেট লাগাও!’ মুখে রক্ত তুলে প্রতি জবাব দেয় বিন্দা এবার। শত্রুর সঙ্গে কথা বলতে অস্ত্রের ভাষাই ভরসা।

‘ফাইভ!’

‘হমারে দেশ মে গোরে কি রাজ নাহি চলেগি!’

‘সিক্স!’

‘হাম সিপাহী লোগ সংখ্যা মে জায়দা হ্যায়, কুছ নাহি কর পায়েঙ্গে গোরে!’

‘সেভেন!’

‘ডরো মত সাঁথিও সব একঠ্ঠা হো যাও!’

‘এইট!’

‘যান কবুল, হাম লোগ অটুট রহেঙ্গে!’

‘নাইন!’

‘হাম এক সাথ, যান কবুল, লরেঙ্গে চলো ভাইও!’

‘ফায়ার!’

‘আক্রমণ!’

শুরু হল এক অসম লড়াই। বেয়নেট বসানো গুলি-শূন্য রাইফেল এবং প্রাঙ্গণের পাথর ও লাঠি সম্বল করে গর্জে উঠল দেশীয় সিপাহী দল। ওদিকে প্রাঙ্গণের কিনারা থেকে গর্জন করে উঠল কামান। আগ্নেয়াস্ত্রহীন সিপাহীদের ভিড়ের উপর মুহুর্মুহু আছড়ে পড়তে লাগল অনলবর্ষী কামানের গোলা আর ব্রিটিশ সিপাহীদের গুলি। মুহূর্ত মাত্র। কালান্তক কামানের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে প্রচণ্ড সন্ত্রস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল দেশীয় সিপাহী দল। রক্তাক্ত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সিপাহীদের দেহ রাঙ্গিয়ে তুলল প্রাঙ্গণের শুকনো মাটি। কিন্তু কামান তখনো থামল না। ছত্রভঙ্গ সিপাহীদের লক্ষ করেই সমানে বর্ষিত হয়ে চলল গোরা সিপাহীর গুলি। ভোরের আকাশ বাতাস দূষিত হয়ে উঠল মরণমুখ সিপাহীদের আর্তনাদ ও ব্রিটিশ সিপাহীদের পৈশাচিক কোলাহলে। ভোরের পাখিরা আজ ভুলেছে তাদের কলতান তার জায়গা নিয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের নারকীয় শব্দ।

প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে একদল দেশীয় সিপাহী দৌড়ে গেল গঙ্গার দিকে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই হিমশীতল জলে। তবুও থামল না বন্দুক। ঘোর সওয়ারী গোরা সিপাহীরা এবার অবস্থান বদলে চলে এলো গঙ্গার তীরের দিকে। শীতের প্রত্যুষে পূব আকাশ যখন রক্তিম হয়ে উঠেছে তখন মরণ ভয়ে গঙ্গার জলে প্রাণপণ সাঁতরে চলেছে শতাধিক সিপাহী। এবার বন্দুকের লক্ষ্য মুখ হল তারা। প্রতিবাদ শুধু বোঝে বন্দুকের ভাষা। পবিত্র গঙ্গার জল রক্তে রাঙ্গিয়ে বন্দুক যখন থামল তখন স্রোতস্বিনীও বুঝি স্তম্ভিত হয়ে স্রোত হারিয়েছেন। প্যারেড প্রাঙ্গণে ও গঙ্গার জলে শত শত লাশ তখন নীরবে নিথর শরীরে অভিসম্পাত দিচ্ছে নিয়তিকে। মহাকাল জানেন তারা শুধু নিজের দেশের মাটিতে জন্মে নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছিল।

‘সোলজারস, টার্ন টু দ্য বুশেস, ডোন্ট লেট এনি বাস্টার্ডস ফ্লি, হিট দেম হার্ড, সাচ হার্ড দ্যাট দে রিমেম্বার ফর এভার’। শত্রু দুর্বল, অক্ষম, পরাজিত এবং পলায়ন রত, তবু তাদের উপর নির্বিচারে চলতে লাগলো গুলি। যখন সারিবদ্ধ ভাবে আক্রমণের প্রয়োজনীয়তা ফুরল তখন ব্রিটিশ সিপাহীরা ছড়িয়ে গেল প্রাঙ্গণময়। ভূলুণ্ঠিত যাদের শরীরে সামান্যতম প্রাণের আভাস বিদ্যমান তাদের উপর পৈশাচিক আনন্দে পরীক্ষা চলতে লাগলো বেয়নেটের। প্রাণভয়ে কিছু সিপাহী আশ্রয় নিয়েছিল প্রাঙ্গণের কিনারা বরাবর গুল্ম লতার জঙ্গলে। ব্রিটিশ বীর পুঙ্গবেরা সেখানেও রেহাই দিল না তাদের। জঙ্গলের কিনারা বরাবর দাঁড়িয়ে অবিশ্রান্ত গুলি বর্ষণ চালিয়ে গেল।

রক্ত খেলা যখন শেষ হল তখন প্রাঙ্গণে দেশীয় সিপাহী সংখ্যা শূন্য প্রায়। শয়ে শয়ে পড়ে রয়েছে গোলার আঘাতে সনাক্তকরণের অযোগ্য মৃতদেহ। রক্তিম গঙ্গার জলে ভেসে গেছে কত সিপাহীর দেহ। নিকটবর্তী জঙ্গলে আর খোঁজ চালানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না জেনারেল প্যাগেট। নারকীয়তায় অদ্বিতীয় বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন প্যারেড গ্রাউন্ডে সমবেত হওয়ার জন্য। আর ঠিক সেই ক্ষণে আকাশ ভেঙ্গে নামলো বৃষ্টি। ব্রিটিশ বর্বরতার চিহ্ন মুছিয়ে দিতে লাগল অঝোর বারিধারা। প্যাগেট সাহেব মৌখিক হিসেব কষলেন নিজের মনে। আক্রমণ প্রতি আক্রমণের খেলায় 180 জন দেশীয় বিদ্রোহী সিপাহী নিহত।

তবে এখনও কর্ম সমাপন হয়নি তাঁর। চিহ্নিত করতে হবে এই বিদ্রোহীদের নায়ক কে। সে যদি মারা গিয়ে থাকে তাহলে একরকম নাহলে তাকে খুঁজে বার করে এমন দৃষ্টান্তমূলক ভাবে শাস্তি প্রদান করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কোনো কালো চামড়ার বেতনভুক মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে জাত-শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশদের সামনে।

মুষ্টিমেয় কিছু সৈন্য নিয়ে তিনি চললেন অস্ত্রাগারের দিকে। যদিও কার্টরাইটের যুদ্ধ পারদর্শিতা নিয়ে তাঁর সন্দেহ নেই কোনো তবু কার্ট নরম মনের মানুষ। আগ্রাসী সিদ্ধান্তের বিরোধী তাই শত্রুর শেষ নিশ্চিত করতে তাঁকেই যেতে হবে।

 

২রা নভেম্বর বেলা দ্বিপ্রহর সাহেব বাংলো ব্যারাকপুর

‘সি, দিজ ইজ হাও রেবেলস শুড বি সাপ্রেসড। মেক এ টোস্ট ফর দ্যাট জেন্টেলম্যানস।’

দ্বিপ্রহরে ভোজন কক্ষে বিজয়ী জেনারেল প্যাগেট সাহেবের আস্ফালন দেখবার মত। বৃষ্টি স্নাত প্যারেড প্রাঙ্গণে ভর দ্বিপ্রহরেও শৃগাল কুকুরের উৎসব লেগেছে তখন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যারাকপুরের আকাশে শকুনের ঘনঘটা। এদিকে প্যাগেট সাহেব তখন কলকাতা থেকে আগত বাকি ব্রিটিশ অফিসারদের সঙ্গে পানাহারে মত্ত। সরকারি ভাবে কোম্পানির কাছে পাঠানোর জন্য ইতিমধ্যেই সবিস্তারে রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়ে গেছে বলাই বাহুল্য তাতে মৃতের সংখ্যা সাহেবের মৌখিক হিসেবেরই অনুরূপ। গঙ্গায় ভেসে যাওয়া বা জঙ্গলের মধ্যে মৃত্যু হওয়া সিপাহীদের গণনা করা নিষ্প্রয়োজন। অতএব নারকীয় হত্যা-লীলাকে যুদ্ধ বিজয় এবং বিদ্রোহ দমনের তকমা দিয়ে চলছে উল্লাস।

‘বাই দ্য ওয়ে কার্ট, হাউ মেনি ক্যাজুয়ালিটিস ইন আরমারী?’

‘নান স্যার।’ সর্বসাকুল্যে অস্ত্রাগারের সামনে ছিল শত খানেক সিপাহী। যাদের মধ্যে বলাই বাহুল্য শেষ রাতের দিকে বেশ কিছু সিপাহী ছিল নিদ্রামগ্ন। ব্রিটিশ বাহিনী নিঃশব্দে তাদের ঘিরে ধরে। তারপর প্যারেড প্রাঙ্গণের দিক থেকে ভেসে আসা প্রাণ জল করা কামান গর্জনে যখন সেই সিপাহী দল সচকিত হয় তখনই তাদের অবস্থা হয় জালবন্ধ মূষিকের ন্যায়। চোখের সম্মুখে কামান বন্দুকধারী গোরা সিপাহী দেখে এবং পলায়নের পথ বন্ধ বুঝে তারা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। তাদের সকলেই আপাতত সাহেব বাংলোর ভূগর্ভস্থ কক্ষে বন্দি।

‘ইম্প্রেসিভ কার্ট, কংগ্রাচুলেশনস, ইউ হ্যাভ সেভড এ লট অব বুলেটস।’ শ্লেষ মিশ্রিত বচনে উত্তর যোগায় না কার্টের মুখে। ‘ও ও, বাই দ্য ওয়ে ডিড ইউ অ্যারেস্ট দ্যাট নিগার? ইওর স্পাই?’

‘ইয়েস, হি ইজ ইন অ্যানাদর রুম ডাউন স্টেয়ার্স।’

‘গুড, নাও মেক হিম স্পিক, অ্যারেস্ট হিস ফ্যামিলি ওর ডু হোয়াট এভার ইউ লাইক। বাট ফাইন্ড মি দ্যাট ব্লাডি লিডার অব দোজ নিগারস।’

মাখনাকে জেরা করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। সাময়িক ভাবে প্রত্যুষের ঘটনায় হতভম্ব এবং ব্রাহ্মণ সিপাহীদের মরণোত্তর ব্রহ্মশাপের ভয়ে চুপ থাকলেও পরিবারকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়াতেই অনেক খবর সে ফাঁস করে বসে। অপরদিকে অস্ত্রাগারের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া সিপাহীদের জবান বন্দি থেকে উঠে আসে বিন্দা এবং তার 11 জন সাথীর নাম। এরপর শুরু হয় অন্বেষণ। কিন্তু সনাক্তকরণ যোগ্য মৃতদেহ খুঁজেও মেলেনা মূল চক্রী বিন্দার খোঁজ। যদিও বাকি 11 জনের হদিশ মিলতে সময় লাগে না এবং বিদ্রোহের অপরাধে প্রহসন সুলভ বিচারে তাদের প্রাণদণ্ড ধার্য হয়ে যায় সূর্যাস্তের আগেই। খোঁজ চলতে থাকে বিন্দার।

‘আর ইউ অ্যাবসোলুটলি শিওর কার্ট দ্যাট দ্য নিগার ইজ নট ডেড অলরেডি।’

‘নো বডি রিয়ালি স্য হিম স্যার আফটার দ্য ফায়ারিং বিগান। অ্যাজ পার সেইয়ংস অফ অর্রেস্টেড শিপয়স হি প্রবাবলি রান আওয়ে। ‘

‘দেন? এনি লিড অন হিম? হি জাস্ট ক্যান্ট ভ্যানিশড!’

‘ওয়েল মাখনা টোল্ড এবাউট হিজ ফ্রেন্ড জগনাথ?’

‘হোয়ার ইজ হি নাও?’

‘হি ডিড নট জয়েন দ্য রেবেলস, হি ইজ উন্ডেড অ্যান্ড নাও ইন শিপয়স হসপিটাল’

‘ওয়েল ইফ হি ডিড নট পার্টিসিপেটেড দেন হাও অন আর্থ হি ইজ উন্ডেড?’

‘ইট লুকস লাইক আফটার কমেন্স ফায়ারিং হি ওয়েন্ট টু প্যারেড গ্রাউন্ড।’

‘হাও ইজ হি নাও?’

‘নাথিং সিরিয়াস, আই হ্যাভ টক উইথ ডক্টরস। জাস্ট 2-3 ফ্লেশ উন্ডস।’

‘গুড, ভেরি গুড। গ্রেট, দেন ইটজ সর্টেড। ইউজ হিম আজ বেট ফর বিন্দা।’

 

৯ই নভেম্বর সকাল, চাণক জাহাজ ঘাটা সংলগ্ন বস্তি

জাহাজ ঘাটার সঙ্গে মাখনার কিছু বিশেষ যোগ রয়েছে। কলকাতা থেকে আফিমের গুলি এই জাহাজঘাটা হয়েই চাণকে আসে। তাছাড়া ভাঙ তৈরির বেশ কিছু উপাদান এবং অন্যান্য স্বর্গলাভের সামগ্রী আমদানির এই একটি মাত্র পথ কেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনসিদ্ধ। পরনের জামাকাপড় থেকে মাথার টুপি, নেশার বস্তু থেকে অস্ত্রশস্ত্র সব কিছুর ব্যবসাই এখন চলে কোম্পানির অঙ্গুলিহেলনের সঙ্গে। আজকেও মাখনা জাহাজ ঘাটা এসেছে কিছু মাল নিয়ে যাওয়ার বাসনায়। তবে অন্য একটি উদ্দেশ্য অবধি রয়েছে তার। মাল কেনার আগে আপাতত সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই ব্যস্ত সে।

এই সকালেও জাহাজঘাটে বিস্তর মানুষের মেলা। জাহাজি মানুষ তো বটেই তার সঙ্গে ফেরি-ওলা, ভিখারি, ব্যবসাদার, সিপাহী, বরকন্দাজ সব মিলিয়ে জমজমাট সকালের জাহাজ ঘাটা। মাখনার চোখ সন্ধানী দৃষ্টিতে ঘুরতে থাকে এদিক সেদিক। এ মাসের দুই তারিখের কালান্তক ঘটনার পর আজকেই প্রথম জাহাজ আসছে চাণকে। কলকাতা থেকে হরেক সামগ্রী এখানে নামিয়ে দিয়ে আবার প্রহর পেরোতেই রওনা দেবে জাহাজ ফিরতি পথে কলকাতা অভিমুখে। নিয়মিত এই ঘাটে আগমন হেতু জাহাজঘাটার কুলি মজুর ভিখারি থেকে মহাজন জমিদার সিপাহী সবাইকে অন্তত মুখ দেখে চেনার ক্ষমতা রাখে সে। উচ্চবিত্ত মানুষ জন বাদ দিলে বাকি প্রায় সকলের সঙ্গে মৌখিক আলাপও আছে তার।

সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে মাখনা খুঁজে চলেছে এমন এক মুখ যা জাহাজ ঘাটে নিত্ত পরিচিত নয়। সেই দিন সেই গভীর রাতে সেনা ছাউনির রহমত চাচার ঘরে বিন্দা এবং তার সঙ্গীদের কথা আড়াল থেকে শুনে মাখনার মনে আছে যে পালানোর হলে বিন্দা পালাবে এই জাহাজ ঘাটা দিয়েই জলপথে। চাণক থেকে কলকাতা বা উত্তরে যাবার সমস্ত পথে যেভাবে গোরা সিপাহীর পাহারা বসেছে সেদিক দিয়ে মক্ষী পালানো দুঃসাধ্য। বরং এই জাহাজ ঘাটে একবার পাহারাদারদের নজর এড়িয়ে জাহাজে চড়ে বসলেই ব্যস। মূলত মালবাহী এখানকার ছোট জাহাজগুলোতে কুলির ছদ্মবেশে লুকিয়ে পড়া অনেক সহজ। যেহেতু সেই দিনের ঘটনার পর আজই প্রথম জাহাজ ছাড়বে তাই বিন্দা যদি বেঁচে থাকে তবে আজই সে পালানোর চেষ্টা করবে আর তা করবে এখান দিয়েই।

প্রথম দৃষ্টিতে জড় বুদ্ধি মনে হলেও এইসব ছলে মাখনার মাথা খোলে ভালো। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না তাকে। অল্প অনুসন্ধানের পরেই চোখে পড়ে খাটো ধুতি পড়ে নগ্ন গাত্রে এক ব্যক্তি মুখ ও মাথা সুতির গামছায় জড়িয়ে নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে রয়েছে গঙ্গা বক্ষে ভাসমান জাহাজের দিকে। চোখের দৃষ্টি হারিয়ে গেছে তার কোন সুদূরে। গায়ের পোশাক অনুরূপ হলেও সুঠাম স্বাস্থ্য জানান দিচ্ছে এ ব্যক্তি আফিম খোর বস্তিবাসী কুলি মজুর নয়, এ ব্যক্তি সিপাহী না হয়ে যায় না। পায়ে জড়ানো কাপড়ের রাশি ক্ষতের চিহ্ন বহন করছে। মুচকি হাসি ঠোঁটের কোণে এনে এগিয়ে যায় মাখনা। সাহেবের মুখের কথা। বিন্দার মাথার দাম পাক্কা ১০ টাকা নগদ। মাখনার এক মাসের লাভের অঙ্ক তার থেকে মাত্র হাতের দূরত্বে। পূর্ব পরিকল্পিত হাতের ইশারা করতে করতে সহসা ব্যক্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মাখনা। প্রচণ্ড চমকে উঠেও বিন্দা মাখনাকে চিনতে পেরে কিছুটা আশ্বস্ত হয়। মাখনা তাকে হাতের ইশারায় বোঝায় নিকটেই গাছের ছায়ায় ঢাকা এক স্থানে যাওয়ার জন্য।

‘তিয়ারী জি তুমি এখানে? তুমি বেঁচে আছো বলেই তো ভাবিনি। সৌভাগ্য আমার।’

হাল্কা হাসি মুখে আনার চেষ্টা করে গাছের ছায়ায় দাঁড়ায় বিন্দা। হাঁটতে গেলে এখনও তার পায়ের ক্ষত দিয়ে রক্ত আসে। মুখ বিকৃতি করে জবাব দেয়।

‘উধার হাল কেয়া রে মাখনা?’

‘আরে উধার তো সব গ্যায়া, তুমি কী করে পালালে বলো আগে, কোথায় ছিলে এতদিন? খাবার খাবে কিছু আগে?’ বলতে বলতেই কোচর থেকে মুড়ি বাতাসা ভর্তি পুটুলি বের করে মাখনা। বাস্তবিক এই কয়দিনে বিন্দার দিনে একবেলা করেও খাবার জুটেছিল না। জাহাজ ঘাটের আসে পাশে বস্তির এদিক সেদিক, খামার ঘর প্রভৃতিতে লুকিয়ে এবং রাত্রি কালে সংলগ্ন বাজারে উচ্ছিষ্ট সব্জী-ফল খেয়েই এই কয়টা দিন কাটাতে হয়েছে তাকে। অতএব মাখনার মুড়ি বাতাসা পেয়ে খুশিই হয় বিন্দা।

‘সব গ্যায়া মতলব?’

‘মতলব, সব গ্যায়া’ হাত উল্টে বোঝায় মাখনা। ‘তোমাদের রেজিমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আর তোমার বন্ধু জগন্নাথের হালত জানো?’

বন্ধুর কথা শুনেই সচকিত হয়ে বিন্দা। পরিকল্পনা মাফিক ওর পালানোর কথা সেদিনই। উত্তেজনায় খাওয়া থামিয়ে মাখনার মুখের দিকে চেয়ে বলে, ‘কেয়া হুয়া উস্কা?’

‘পাকড়ে গ্যায়ে, আবার কি। গোরা সিপাহী যা মেরেছে না, কী বলবো তোমায়, চোখের ডিম বের করে দিয়েছে একদম, হাতে পায়ের আঙ্গুল ভেঙ্গে ছিঁড়ে দিয়েছে, মাথা বেঁকে গেছে একদিকে এমন মার দিয়েছে।’

‘কাহা, কাহা হ্যায় ও আভি?’ গলার স্বর অব্যক্ত দুঃখে স্তব্ধ হয়ে আসে বিন্দার। এতটাই সে বন্ধুর কথা ভেবে আবিষ্ট হয়ে পড়ে যে আরও চারজন কুলি যে সেখানেই গাছের ছায়ায় বসে তামাক টানার ছলে তাদের উপর নজর রেখে চলেছে তা চোখ এড়িয়ে যায় ওর।

‘হ্যায় তো ছাউনিতেই, এই তো সকালে গরম পানি দিয়ে এলাম, উঠতে বসতে তো পারছে না। কথা বলতেও পারে না এতো ফুলে গেছে মুখ। তুমি দেখতে যাবা নাকি একবার।’

আজ জাহাজ ঘাটায় কলকাতা থেকে বেশ কিছু ইউরোপিয়ান পরিবার আসছে চাণকে। সকলেই বড়লাটের আত্মীয় বিশেষ তাই কর্নেলের হুকুম মতো জাহাজ ঘাটে কোনোরকম ধরপাকড় চলবে না। পলাতক সিপাহীকে যদি দেখা যায় তবে মাখনার দায়িত্ব তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘাটের সীমানার বাইরে নিয়ে আসা। ওই চার কুলি আদপে ছদ্মবেশী গোরা সিপাহী মাত্র।

বন্ধুর শোচনীয় অবস্থা শুনে প্রায় বাহ্য জ্ঞান শূন্য বিন্দা তক্ষুনি মনস্থির করে ছাউনি যাবার। অর্থলাভের আশায় নেচে ওঠে মাখনার মন। বাস্তবিকই জগন্নাথের উপর অকথ্য মধ্যযুগীয় নির্যাতন চালিয়েছে গোরা সিপাহী। তবে প্রাণে মারেনি। বিচক্ষণ প্যাগেট সাহেব জানেন আহত বন্ধুর টোপেই ধরা যেতে পারে বিন্দাকে। অতএব মাখনাকে অর্থলোভী দেখিয়ে হাত করে আজকের এই অভিযান। স্বল্প তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে যে বিচক্ষণ প্যাগেট সাহেব নিঃসন্দেহে অবগত ছিলেন যে জগন্নাথ সম্পর্কে কোনো কু-সংবাদ তা সে মিথ্যে হলেও সই, বিন্দার কাছে পৌঁছানোই যথেষ্ট ছিল বিন্দাকে ফাঁদে ফেলার জন্য। তবু নিষ্প্রয়োজনে যে অকথ্য অত্যাচার জগন্নাথের উপর চালানো হয়েছিল, ইতিহাস তাকে যাই বলুক না কেন, তা এক বিকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত নারকীয় কার্যকলাপ ভিন্ন কিছু বলতে মুখে বাঁধে।

পায়ের ক্ষতর যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বিন্দা জাহাজঘাটার বাইরে আসতেই তাকে ঘিরে ধরে গোরা সিপাহীর দল। আহত অভুক্ত শরীরে প্রতিরোধের জন্য বল কিছু অবশিষ্ট ছিল না। একরকম বিনা বাঁধাতেই শত্রু গ্রেপ্তার করে শিকলবদ্ধ করে ফেলে গোরা সিপাহীরা। তারপর বিজয় উল্লাসে পশুর ন্যায় টানতে টানতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সাহেব বাংলোর দিকে। ওদিকে মাখনা তখন জাহাজ ঘাটার দেশী সূরার দোকানে পান পাত্র হাতে বাজারে মেয়ের সঙ্গে দিন যাপনের দর কষাকষি শুরু করেছে। পকেটের থলেতে রয়েছে দশটি নতুন মুদ্রা।

 

১০ই নভেম্বর সকাল, সাহেব বাংলো ব্যারাকপুর

শীতের প্রারম্ভে গঙ্গা তীরের নিকটবর্তী সাহেব বাংলোর বাগানে প্রাতরাশ সারছেন জেনারেল এবং কর্নেল।

‘হোয়াটস দ্য নিউজ পেপার সেয়িং কার্ট?’

গতকাল জাহাজঘাটার সাফল্যের পর বিদ্রোহ দমনের অন্তিম চালটি দেওয়ার আগে বেশ আমুদে মেজাজে রয়েছেন প্যাগেট সাহেব। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাসে বিদ্রোহ এবং তার দমন নতুন কিছু না হলেও এতদিনে অন্তত বেশ দৃষ্টান্তমূলক ভাবে কার্য সমাধা হয়েছে। যেরকম আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে আক্রমণাত্মক ভাবে সমস্ত বিদ্রোহী সিপাহী নিকেশ করা হয়েছে তাতে প্যাগেট সাহেবের বদ্ধমূল ধারণা যে আগামী অন্তত কয়েক দশক, দেশীয় সিপাহীদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস হবে না। ভারতভূমিতে কোম্পানির শাসন আরও বেশ কিছু কালের জন্য নিষ্কণ্টক, নিরুপদ্রব করতে পারার অনাবিল আনন্দ শরীরের প্রত্যেকটি ধমনী দিয়ে অনুভব করতে করতে প্রশ্ন করলেন প্যাগেট। কর্নেল কার্টরাইটের হাতে দৈনিক হরকরা। এই সময়ের অত্যন্ত অগ্রণী দেশীয় ভাষার সংবাদ পত্রিকা। স্থানীয় ভাষা প্যাগেট সাহেবের আয়ত্তে নেই সেদিকে কর্নেলই তাঁর ভরসা।

‘ওয়েল অল নিউজ আর আজ পার ইওর রিপোর্ট স্যার। 180 ডেড, 250 প্লাস ইনজিওর্ড অ্যান্ড অ্যান্ড, এন্ড অফ 47 নেটিভ রেজিমেন্ট’

‘গুড, অ্যান্ড এনিথিং অ্যাবাউট বিন্দা?’

‘অ্যারেস্টেড অ্যান্ড এক্সপেক্টেড টু বি পানিশড সুন।’

‘অফ কোর্স। অফ কোর্স।’ কৌতুকের হাসি খেলে যায় প্যাগেট সাহেবের মুখে।

‘শুড উই এক্সেকিউট হিম টুডে স্যার?’

‘অফ কোর্স টুডে, বাট উই হ্যাভ টু মেক ইট এন এক্সাম্পল টু এভরি নেটিভস।’

মানুষের মনে ভয় জাগাতে নৃশংসতার ব্যবহারে ব্রিটিশ জাতি নিঃসন্দেহে অগ্রণী। রক্তক্ষয়ী একতরফা যুদ্ধে অগণিত নরহত্যা করলেও প্যাগেট সাহেবের রক্ত-তৃষ্ণা যেন মেটেনি। বিদ্রোহের সকল নায়ককে গতানুগতিক ফাঁসি কাঠে প্রাণদণ্ডের বিধান দিলেও প্রধান নেতা বিন্দার ক্ষেত্রে তার পরিকল্পনা অন্য ধরনের। তাঁর ক্রূর মনের কুটিল ভাবনা আন্দাজ পেয়েই বোধহয় কর্নেল সাহেব চুপ করে যান। কোম্পানিতে পদমর্যাদায় জেনারেল প্যাগেট অনেক উচ্চাসীন, কর্নেল বাধ্য তাঁর আদেশ পালন করতে কিন্তু তিনি বেশ বুঝতে পারেন যে আদেশ এবার তাঁর উপর আসতে চলেছে তা পালন করতে গেলে নিজের সবটুকু মানবতা বিসর্জন দিয়েই করতে হবে। তাই নির্বাক শ্রোতা হয়ে হাতের সংবাদ পত্র নামিয়ে রাখেন কর্নেল। দৈনিক হরকরায় শুধু সেটাই মুদ্রিত হবে যা জেনারেল সাহেব অনুমোদন করবেন। সত্য ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে যাবে শুধু স্রোতস্বিনী গঙ্গা।

‘দ্য নিউজ শুড ওনলি সে বিন্দা ইজ হাংড টিল ডেথ অ্যান্ড হিজ কর্পস ইজ কেপ্ট অ্যাজ অ্যান এমব্লেম ফর মেভারিক্স—’

এর পরবর্তীতে প্যাগেট সাহেব বিন্দার প্রাণদণ্ড সম্পর্কে যে নির্দেশনামা পেশ করলেন তার নৃশংসতা ভাষায় প্রকাশ অযোগ্য। কর্নেল সাহেবের প্রাতরাশ করা আর হয় না সে সব শোনার পর। নীরবে স্যালুট জানিয়ে চলে আসেন বাগান থেকে।

‘অ্যান্ড ওয়ান থিং মোর কার্ট—’ পিছুডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়েন কার্ট। ‘মেক শিওর টু কিপ হিজ বডি রট ফর অ্যাটলিস্ট ওয়ান মান্থ।’

 

১০ই নভেম্বর, গভীর রাত চাণক প্যারেড গ্রাউন্ড

কুয়াশার চাদরে প্রেত-ভূমির মতো ঢাকা রয়েছে সুবিশাল চাণক প্যারেড প্রাঙ্গণ। বিগত কিছু দিনের ন্যায় আজও সন্ধ্যের পর থেকেই প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে রয়েছে নিশাচর রক্তলোলুপ শৃগাল কুকুরের কোলাহলে। নিহত সিপাহীদের মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও সারা প্রাঙ্গণে এখনো ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহাংশ। পচন-রত সেই সব মাংস পিণ্ড এবং রক্তে ভেজা মাটির বমন্দ্রেককারী কটু গন্ধ এই সুবিশাল প্রাঙ্গণকে নরক-ভূমিতে পরিণত করেছে। দিনের বেলাতেই এদিকে এখন জনমানুষের দেখা পাওয়া দুষ্কর।

কিন্তু আজ এই গভীর রাতেও নক্ষত্রের আলোয় কুয়াশার চাদর ভেদ করে দেখা গেল এক মনুষ্য মূর্তিকে এগিয়ে আসতে। গমনভঙ্গি বলছে পথিক আহত। কোনোরকমে কষ্ট করে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ করে একজন এগিয়ে আসছে প্যারেড প্রাঙ্গণের প্রান্তে অশ্বত্থ গাছের দিকে। অবাঞ্ছিত আগন্তুক এই মনুষ্য সন্তানের উপস্থিতিতে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে শৃগাল কুকুরের দল সগর্জনে প্রতিবাদে মুখর করে তুলল প্রাঙ্গণ। কিন্তু আগন্তুকের ভ্রূক্ষেপ নেই সেইদিকে। তার লক্ষ্য স্থির। ধীর, বিচলিত কিন্তু বিরামহীন পদক্ষেপে সে এগিয়ে আসছে প্রান্তবর্তী অশ্বত্থ গাছের দিকে।

এই গাছের বেদিতে আজ শায়িত এক শিকলবদ্ধ মৃতদেহ। ক্ষুধার্ত নিশাচরের দল আজ তাই বেশি মাত্রায় সমবেত এই গাছের তলে। ইতস্তত কোলাহলের মধ্যে তারা ছিঁড়ে খাচ্ছে সেই শবদেহের টাটকা মাংস। এত রাত্রেও সেই গাছের শাখায় শাখায় কাক শকুনের ভিড়। ভোজন উৎসবে নিশাচরের সঙ্গে তারাও আজ মত্ত নরমাংস ভক্ষণে। আগন্তুক ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে আসতে থাকে সেই গাছের দিকে। তার পায়ের শব্দে হুঙ্কার তোলে কিছু শৃগাল কিন্তু পরক্ষণেই তারা আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই মৃতদেহের উপর। নক্ষত্রের সামান্য আলোতেও দৃশ্যমান হয় শবদেহের উন্মুক্ত পাঁজর। পেট বুকের মাংস ইতিমধ্যেই নিশাচরের উদরস্থ হয়েছে।

নিবিষ্ট ভাবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে যে আগন্তুকের অন্তর বিদীর্ণ করে উঠে আসছে হাহাকারের চাপা শব্দ। অবিশ্রান্ত ধারায় তার দুগাল দিয়ে নামছে অশ্রু ধারা। বন্ধু হারানোর শোকে সে পাথর। সাক্ষাৎ নররূপী এই অশ্বত্থ গাছ দিনের বেলাতেও আগামীতে মনুষ্য বর্জিত হবে, আজকের এই অভিশপ্ত রাতে সেখানে বিরাজমান শতাধিক মাংস লোলুপ নিশাচরের ভয়েও আগন্তুক মোটেও বিচলিত নয়। অজস্র শৃগালের হুঙ্কার, শকুনের কান্না উপেক্ষা করে সে জড়িয়ে ধরে শবদেহেটিকে। এতক্ষণ ধরে অন্তরে জমে থাকা হাহাকার এবার সশব্দে প্রকাশিত হয়। চাণকের আকাশ বাতাস চিড়ে সেই বিলাপধ্বনি যেন ছুঁয়ে যেতে চায় বিধাতাকে। বহুক্ষণ ধরে চলতে থাকে বিলাপধ্বনি। অবশেষে আগন্তুক তার গায়ের চাদর খুলে যত্ন করে জড়িয়ে দেয় মৃত দেহটিকে। তারপর নিঃশব্দে একটি শুকনো পদ্মফুল সমর্পণ করে শবদেহের চরণে। তারপর অত্যাচার ক্লিষ্ট শরীরটাকে টানতে টানতে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায় প্যারেড প্রাঙ্গণ থেকে। জগন্নাথকে এরপর আর কেউ কোনোদিন দেখেনি চাণকে।

 

১৯ই জুলাই, ১৮২৭ নাগওয়া গ্রাম বালিয়া প্রদেশ

‘এ পাণ্ডে ভাইয়া, ঘর চল তো সহি, তেরে বিবিনে লেরকা জনম দিয়া।’

সিপাহী জীবন পিছনে ফেলে জগন্নাথ চলে আসে তার নিজের গ্রামে। ৪৭ নম্বর নেটিভ রেজিমেন্ট কোম্পানি সরকার বন্ধ করে দেবার পর চাণকে আর কিছুই ছিল না জগন্নাথের। অত্যাচারে ভগ্ন স্বাস্থ্য ও প্রিয় বন্ধুর মর্মান্তিক হত্যা কাণ্ড দর্শনে উন্মাদ-প্রায় মন নিয়ে সর্বস্বান্ত ভবঘুরের ন্যায় সে একদিন এসে উপস্থিত হয় বালিয়া প্রদেশে তার নিজের বসত ভিটায়। তারপর কেটে গেছে তিনটি বছর। সিপাহীর চাকরি করার মতো স্বাস্থ্য এবং মন কোনটাই অবশিষ্ট ছিল না তার, অতএব বাপ ঠাকুরদার জমিতে শস্য শ্যামলা ফসল চাষের কাজেই নিজেকে সঁপে দেয় সে। ফেলে আসা অতীত তার কাছে অভিশাপ।

চাণকে শেষ রাত্রে বিন্দার পিশাচসম মৃত দেহের সামনে সেদিন সে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল যে বিদ্রোহের বীজ সে ছড়িয়ে দিয়ে যাবে সকল হিন্দুস্থানের সন্তানের কাছে কিন্তু শরীর ও মন তাকে শুধুই দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে তার লক্ষের থেকে। যে পৈশাচিক নরহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সে, তাই তাকে তাড়া করে ফিরছে নিত্য। আজও অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে সে বিভোর হয়ে গেছিল পিছনে ফেলে আসা সেই দিনগুলির চিন্তায়। হয়তো তার মনের কোণে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল সেই স্রোতস্বিনী গঙ্গার তীরে রক্তিম পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্ত, হয়তো তার মানস পটে অভিনীত হচ্ছিল সেই নির্বিচারে নরহত্যার দৃশ্য, হয়তবা তার শুকনো ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দিচ্ছিল প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে করা কোনো সস্তা আমোদের স্মৃতি।

গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের মধ্যে যখন তার কর্দমাক্ত শরীরে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল বেলা শেষের শুষ্ক বাতাস সেই সময় প্রতিবেশীর ডাকে চেতনা ফিরল জগন্নাথের। খেতের সুদূর কিনারে তখন রক্তিম আকাশে তখন সূর্যদেব অস্তগামী। শুষ্ক জমিতে সারাদিন ব্যাপী লাঙ্গল চালিয়ে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে জগন্নাথ ফিরে আসে তাদের মাটির কুটিরে। প্রাঙ্গণে তখন সংসারের নতুন অতিথিকে স্বাগত জানাতে সমবেত হয়েছে সকল প্রতিবেশীরা।

সদ্যজাত পুত্র সন্তানের মুখদর্শন করে সহসা এক তৃপ্তির হাসি খেলে যায় জগন্নাথের মুখে। যে নারকীয় দুঃস্বপ্ন অহরহ তাকে তারা করে একরকম নির্বাক করে তুলেছে বিগত কয়েক বছরে, একরত্তি সন্তানের মুখদর্শন মাত্র যেন সেই দুঃস্বপ্নের আঁধার কেটে যায়। মনে মনে প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু বিন্দাকে স্মরণ করে জগন্নাথ। পেয়ে গেছে সে তার উত্তরসূরি। এই সন্তানের মধ্যেই তাকে বপন করতে হবে স্বাধীনচেতা মানসিকতার বীজ। দুঃস্বপ্নকে হেলায় হারিয়ে খুশির আলোকে যে সন্তান তার জীবন মঙ্গলময় করে তুলবে তার জন্য একটি উপযোগী নামও তৎক্ষণাৎ জগন্নাথের মনে ধরে যায়।

মঙ্গলময় এই সন্তানকে পরিচিতি দেওয়া হোক মঙ্গল নামে। মঙ্গল পাণ্ডে। খুশির অশ্রু বয়ে যায় জগন্নাথের মুখে।