রানি হওয়ার গল্প ● সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়


 

 

ষোলোশো ছয়ের লন্ডন। বসন্ত বিদায় নিচ্ছে, কিন্তু ইংল্যান্ডের বাতাসে এখনও দিব্যি উষ্ণতার স্পর্শ পাওয়া যায় দিনের বেলাটুকুতে। রাতের দিকে অবশ্য হিমের দাঁত ভালই কামড় বসায় শরীরের খোলা অংশগুলোয়। তখন চাই মদ। শহরের এল-হাউসগুলোয় ভিড় জমায় অভিজাত রাজপুরুষ থেকে অভিনেতা, মাতাল, জুয়াড়ি, গাঁটকাটা সবাই।

উইলিয়াম অবশ্য শুঁড়িখানায় ছিলেন না। তাঁর বাড়ির নিভৃত ঘরটিতে মোমের আলোয় একখানা মস্ত বইতে বুঁদ হয়ে ছিলেন তিনি। হলিনশেডস ক্রনিকলস। বাইরে রাস্তায় একদল মাতাল হইহল্লা করতে করতে যাচ্ছে। ওদের চিৎকারে একটু বিরক্ত বোধ করলেন তিনি।

কয়েকদিন হল স্কটল্যান্ডের অতীত নিয়ে একটা নাটক লেখার কথা বারবার ভাবছেন তিনি। মুখ্য চরিত্রটাও তাঁর ভাবা হয়ে গেছে— এক সেনাপতি, যে রাজা হওয়ার মারাত্মক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশে খুন করে বসে তার অন্নদাতা রাজাকেই। কিন্তু কী যেন একটা কম পড়ছে; চরিত্রটাকে বড় একা লাগছে তাঁর।

মাতালগুলোর অসংলগ্ন কথার মধ্যেও বন্ধু বেনের নামটা শুনতে পেলেন তিনি। বেন জনসন। ওদের একজন দেখতে গিয়েছিল ‘ভলপোনে’। মুগ্ধকন্ঠে লোকটা প্রশংসা করছে জনসনের। উইলিয়াম একটু হাসলেন। না, নাট্যকার বন্ধুর জনপ্রিয়তায় তাঁর গা জ্বলে না। যদিও বেনের মত শহুরে কমেডি লিখতে তিনি কোনোদিনই আগ্রহ পান না।

মানুষের জীবনের বিপুল, অতলস্পর্শ গভীরতা তাঁকে বড় টানে এখন। আর মঞ্চে তাঁর সৃষ্টিতে প্রাণ দেন রিচার্ড বারবেজ। মারাত্মক প্রতিভাধর অভিনেতা— গ্লোব থিয়েটারের প্রাণ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার হলিনশেডের পাতায় চোখ রাখলেন তিনি। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠলেন।

একটা ছায়া এসে পড়েছে বইটার পাতার উপর। একটা মানুষের ছায়া!

“দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল!” বিস্মিত হয়ে আগন্তুকের দিকে তাকানোর আগেই ভাবা হয়ে গেল তাঁর।

যে মহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে, হঠাৎ করে তাঁকে দেখলে গা-শিরশির করে ওঠা বিচিত্র নয়। দীর্ঘদেহিনী ভদ্রমহিলার পরনে অভিজাত রাজবংশীয় (উইলিয়াম অনুমান করলেন, স্কটল্যান্ডিয়) পোষাক, চোখের দৃষ্টি একই সঙ্গে তীক্ষ্ণ এবং যন্ত্রণাপূর্ণ, আর দু’হাতে…

তাঁর হাতের দিকে চেয়ে চমকে গেলেন উইলিয়াম। ভদ্রমহিলার দু’হাত রক্তে মাখামাখি।

“আপনার… আপনার হাতে…!”

মলিন হাসি হাসলেন মহিলা।

“কে ভেবেছিল, ঐ বুড়োটার শরীরে এত রক্ত ছিল!”

উইলিয়ামের চোখ নিজের অজান্তেই চলে গেল পাশে রাখা আরেকটা বইয়ের দিকে। রাজা জেমসের ‘ডেমনোলজি’। বিশ্বের যতরকমের ভূত-পেত্নী-ডাকিনী আর কালোজাদু আছে, সবকিছুকে নিয়ে রাজা বইটা লিখেছেন। এ এক মারাত্মক বই; বিশেষতঃ যেখানে ঐ পদ্ধতিগুলো…

উইলিয়াম প্রশ্ন করলেন, “কে আপনি?”

মহিলা আবার হাসলেন।

“অনেকে আমাকে ডাইনি ভাবে, কিন্তু আমি তা নই। আমি রানি— স্কটল্যান্ডের রানি। আমার স্বামীর নাম তো শুনেছ তুমি। ম্যাকবেথ। ওঁকে নিয়ে নাটক লিখবে বলেই তো এত পড়াশুনা করছ।”

উইলিয়াম সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন, এ তিনি স্বপ্ন দেখছেন। গত ক’দিন টানা হলিনশেড পড়ার ফল।

রানি বললেন, “না উইলিয়াম, এ স্বপ্ন নয়। ঐ ক্রনিকলসে ‘আমাকে’ পুরোপুরি পাবে না তুমি। অথচ আমি না থাকলে স্কটল্যান্ডের ইতিহাসটাই বদলে যেত, জানো? আমি তাই এলাম তোমাকে আমার কথা বলতে। আজ থেকে চার-পাঁচশো বছর পরে হলিনশেড পড়বে আর ক’জন? কিন্তু তোমার লেখা পড়ে লোকে জানবে, লেডি ম্যাকবেথ কী করে গেছে।”

উইলিয়াম সোজা হয়ে বসলেন। গল্প আসছে বুঝতে পেরে মনে মনে একটু খুশিই হলেন। সেই সঙ্গে একটু আশ্চর্যও হলেন যে, ভূতের সামনে বসেও তাঁর একটুও ভয় করছে না।

উইলিয়াম বললেন, “হলিনশেডের লেখায় ডাইনিদের উল্লেখ পেলাম। আপনার স্বামীর সঙ্গে সত্যি সত্যি দেখা হয়েছিল ওদের? লর্ড ম্যাকবেথকে ওরাই নাকি সিংহাসনের লোভ দেখিয়েছিল?”

“আমার স্বামী বাচ্চা ছেলে নয়, উইলিয়াম, যে ওরা লোভ দেখাল আর তিনিও ওদের ফাঁদে পা দিলেন। এত দুর্বল মনের মানুষ ছিলেন না লর্ড ম্যাকবেথ, আর ডাইনিদেরও এত ক্ষমতা ছিল না যে ওঁকে এত সহজে প্রলুব্ধ করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বস্তুটা অবশ্য তাঁর বরাবরই ছিল।"

উইলিয়াম বললেন, “ডাইনিদের প্রতি আপনার এত সহানুভূতির কথা হিজ হাইনেস জানলে কিন্তু ভালভাবে নেবেন না। ডাইনি সন্দেহে মেয়েমানুষ মারায় ইংল্যান্ড এখন ইউরোপ জুড়ে বেশ নাম করেছে, জানেন তো?”

লেডি ম্যাকবেথ হাসলেন। বললেন, “জানি। রাজা জেমস এতদিন স্কটল্যান্ডে ডাইনি-নিধন যজ্ঞ চালিয়ে এখন ইংল্যান্ডকে সাফসুতরো করায় মন দিয়েছেন। কিন্তু তোমাকে যে ঘটনাটা বলব সেটা হলিনশেডের বইতে পাবে না। ডাইনিরা আমার স্বামীর কাছে যাওয়ার আগে কার কাছে গিয়েছিল জানো?”

নড়েচড়ে বসলেন উইলিয়াম।

“কার কাছে?”

লেডি ম্যাকবেথ বললেন, “আমার কাছে।”

বিস্মিত হয়ে তাকালেন উইলিয়াম। লেডি ম্যাকবেথ বললেন, “বলি তাহলে, শোনো।”

উইলিয়াম মাথা নাড়লেন। লেডি ম্যাকবেথ শুরু করলেন—

ক্ষমতার লোভ বড় সাংঘাতিক লোভ, জানো তো? রাজবংশগুলোর ইতিহাস দেখলেই বুঝবে— নিকট আত্মীয়দের মধ্যে খুনোখুনি লেগেই আছে। মানুষ ভাবে বুঝি সিংহাসনে বসলেই জীবনের সব ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পাওয়া যাবে। কিন্তু রাজা ক’দিনই বা সিংহাসনে থাকেন, উইলিয়াম? যত ক্ষমতাধরই হন না তিনি, মৃত্যুর চেয়ে তো বড় হতে পারেন না। তাই রাজা মরে যায়, রাজত্ব শেষ হয়ে যায়, অন্য কোনো সামান্য মানুষ আবার সিংহাসনের উপর বসে নিজেকে সর্বশক্তিমান ‘রাজা’ ভাবতে থাকে, আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসে মৃত্যু। ক্ষমতার আয়ু বড় কম, জানো তো?

আমার স্বামী তখনও রাজা হননি, কিন্তু রাজসভায় একটা উচ্চ পদে আছেন। গ্লামিসের থেন তিনি, এবং এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা— স্কটল্যান্ড জুড়ে তাঁর বিরাট সম্মান। রাজা ডানকানের নিকটাত্মীয়ও বটে, কিন্তু রাজার দুই ছেলে ম্যালকম আর ডোনালবেন থাকতে সিংহাসন পাওয়ার আশা নেই বললেই চলে।

যে সময়ের কথা বলছি, তখন স্কটল্যান্ডে যুদ্ধ চলছে। বিদ্রোহী ম্যাকডনওয়াল্ডের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছে বিশ্বাসঘাতক কডরের থেন, আর তাদের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করছে নরওয়ের রাজা সোয়েনো। আমার স্বামী সেনাপতি ম্যাকবেথ গেছেন যুদ্ধে— স্কটল্যান্ডের রাজার প্রধান আশা-ভরসা তিনিই— তিনি এবং ব্যাংকো।

বিকেলবেলা আমার প্রাসাদের ছাদে একলাটি বেড়াচ্ছিলাম আমি। দাসী দু’জন আসতে চেয়েছিল, আমি নিষেধ করে দিয়েছি। কিছুটা সময় একলা কাটাতে ভাল লাগে আমার সূর্য ডোবার সময়ে।

পশ্চিম আকাশটা টকটকে লাল, যেন একটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে ওখানে। দূরের বার্ণাম বনের গাছের ডগাগুলো হাওয়ায় দুলছে জ্যান্ত মানুষের মাথার মত। ডানসিনেন পাহাড়ের মাথায় সূর্যাস্তের বিষণ্ণ আভা। একটা মার্টলেট পাখি ফুড়ুৎ করে ছাদ থেকে উড়ে গেল আমাকে আসতে দেখে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম আমার স্বামীর কথা, আমার কথা— আমাদের কথা। যুদ্ধে জিতেই উনি ফিরবেন, এ দৃঢ় বিশ্বাস আমার ছিল। সম্মুখ যুদ্ধে ওঁকে হারাতে পারে, এমন মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়নি বলেই আমার নিশ্চিত ধারণা। কিন্তু এই যে যুদ্ধজয় করে উনি ফিরবেন, এতে আমাদের কী লাভ হবে? রাজা বাহবা দেবেন, কিছু পুরস্কার দেবেন— ব্যস, তারপর সবাই ভুলে যাবে ম্যাকবেথ কত বড়মাপের যোদ্ধা ছিল। ইতিহাসের পাতায় সেনাপতির নাম ক’জন মনে রাখে? ইতিহাস বলবে, ‘রাজা ডানকান এই যুদ্ধে জয়লাভ করেন’। রাজা ডানকান! অসমসাহসী সেনাপতি ম্যাকবেথকে ইতিহাস ভুলে যাবে! আর মনে রাখবে ভাল করে তলোয়ারটাও ধরতে না জানা ডানকানকে। কারণ, সে যে রাজা!

মৃত্যুর কাছে সবাই এক— কী রাজা, কী প্রজা! কিন্তু মৃত্যুকে জয় করার কি কোনো উপায় নেই, উইলিয়াম? সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, সিংহাসনে বসাটাই এর একমাত্র সমাধান। লোকে রাজার নাম মনে রাখে, ইতিহাস বইগুলোতে থাকে রাজবংশের ইতিহাস। তাই আমার স্বামী যদি রাজা হতে পারেন, আর আমি রানি, তাহলেই আমরা ‘ইতিহাস’ হওয়ার যোগ্য হতে পারি, এমনটাই ভাবছিলাম আমি।

আর তক্ষুণি আমার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা তিনজন।

পরে আমার স্বামীও দেখেছিলেন ওদের। ওরা এই পৃথিবীর জীব নয়, উইলিয়াম। ওদের শরীরগুলো শুকনো, দড়িপাকানো; হাতের চামড়াগুলো কোঁচকানো, মুখে অজস্র ভাঁজ আর ঠোঁটের উপর শুকনো আঁশের মত ছাল-ওঠা পরত। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য, জানো, ওদের চোখগুলো! সে চোখে যেন সারা বিশ্বের ক্ষুধা একসঙ্গে এসে জুটেছে— এমন চোখ কোনো জ্যান্ত প্রাণীর মধ্যে আমি আগে কখনও দেখিনি।

প্রথম ডাইনিটা বলল, “রানি হবে তুমি।”

বাকি দু’জনও বলে উঠল, “রানি হবে তুমি। রানি হবে তুমি।”

খেয়াল করে দেখলাম, ওদের চোখগুলো যেন জ্বলছে অদ্ভুত উন্মাদনায়। ওদের চিবুক থেকে নেমে এসেছে দাড়ির মত একগোছা চুল, ওদের শুকনো আঙুলগুলো ঘুরছে আমার চোখের সামনে— লোভ দেখাচ্ছে ইতিহাস হওয়ার।

“কীভাবে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

খসখসে স্বরে হেসে উঠল ওরা।

“জানো না তুমি?”

খপ করে আমার হাতটা ধরে নাচতে লাগল ডাইনিগুলো। কী ভয়ংকর শীতল সে স্পর্শ— মনে হল আমার অন্তরে যেটুকু উষ্ণতা ছিল, সব শুষে নিচ্ছে ওদের চামড়া। ওরা বলতে লাগল, “রাজা আসবে তোমার ঘরে। রাজা ফিরবে না তার ঘরে।”

কী ছোঁয়াচে সেই উন্মাদনা, কী বলব তোমাকে! অদ্ভুত এক পাগলামি পেয়ে বসল আমাকেও। আমরা নাচতে লাগলাম। সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য, একটা তারাও উঠল না। মনে হল, আমাদের দেখে নক্ষত্রেরা মুখ লুকিয়েছে ভয়ে, লজ্জায়। অন্ধকার আকাশের নিচে খোলা ছাদের উপর চারটে ক্ষুধার্ত ডাইনির মত আমরা নাচতে লাগলাম, আর আমাদের চোখের সামনে বাতাসে ভাসতে থাকল একটা ছোরা— তার ফলায় ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।

কিন্তু ধীরে ধীরে আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে এল। হ্যাঁচকা টানে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম আমি।

এ নাচ আমার জন্য নয়। এ আমি চাই না। ছোরাটা অদৃশ্য হয়ে গেল আমার সামনে থেকে।

একটু অবাক হয়ে ডাইনি তিনটে তাকাল আমার দিকে। একজন বলল, “আমাদের দলে এসো, বোন। হেকেট তোমার সব ইচ্ছা পূর্ণ করবেন।”

আরেকজন বলল, “তোমার স্বামীকে বোঝাও, রাজা ডানকান অতিথি হয়ে আসছে এই প্রাসাদে। তাঁকে যদি আর ফিরে যেতে না দেওয়া যায়...”

তৃতীয়জন বলল, “ম্যালকম, ডোনালবেন— দুটোই পালাবে। সিংহাসন তোমাদের, ইতিহাস তোমাদের। তুমি তো ইতিহাসে অমরত্ব চাও, তাই না?”

খিকখিক করে হেসে উঠল ওরা তিনজন। তোমাকে সত্যি কথা বলব, উইলিয়াম, প্রচণ্ড এক পাপচিন্তা যে আমার মনে আসেনি, তা নয়। আর কাজ করছিল ভীষণ লজ্জাবোধ। মনে হচ্ছিল, পৃথিবী ঢেকে যাক কালো রাত্রির আঁধারে, নরকের ঘন ধোঁয়া এসে ঢেকে দিক সবকিছু, আর তার আড়ালে আমি চুপিচুপি চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিই আমাদের অন্নদাতা রাজা ডানকানকে। বাতাসে ঝুলন্ত রক্তমাখা ছোরাটা আবার এগিয়ে এল আমার দিকে, তার হাতলটা যেন এসে ঢুকতে চাইছে আমার মুঠোয়।

কিন্তু তারপর একটা ঘটনা ঘটল।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল রাজা ডানকানের মুখটা। বৃদ্ধ মানুষটি— চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে— কী অদ্ভুত এক প্রশান্তি সারা মুখে— ঠিক যেন... ঠিক যেন আমার বাবার মত! ভালবাসায় মাথা নত হয়ে এল আমার।

সঙ্গে সঙ্গে ছোরাটা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল আমার সামনে থেকে। আকাশে ফুটে উঠল সন্ধ্যাতারা। পিছিয়ে গেল ডাইনিগুলো, যেন ওরা ভয় পেয়েছে।

আর তখনই স্বপ্নের মত আমার স্বামীকে দেখতে পেলাম ভবিষ্যতের রাজসিংহাসনে, তাঁর পাশে রানির বেশে বসে আছি আমি, আর আমাদের পেছনে...

আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কালো কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা এক মূর্তি, তার হাতে উদ্যত খড়্গ।

সত্যি বলছি উইলিয়াম, জীবনের একটা বিরাট সত্য মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের সামনে খুলে গেল। জীবনটা কী জানো? জীবন এক মূর্খের বলা গল্পের মত— তার কোনো অর্থ নেই। আগামীকালগুলো একটার পর একটা আসছে, আর আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই আমাদের। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, দেখতে পেলাম কৃষ্ণমৃত্যুর খড়্গ নেমে আসছে বীর ম্যাকবেথের উপর, সে তরবারিতে লেগে আছে বার্ণাম বনের পাতা। আর আমার মৃত্যুর মুহূর্তটাও দেখতে পেলাম স্বচক্ষে— আমার সামনে তখনও জ্বলছে ছোট্ট, ক্ষয়াটে মোমবাতি...

ডাইনিগুলো বুঝতে পেরেছিল, ওরা হেরে গেছে, ওরা পারেনি আমাকে প্রলুব্ধ করতে; জীবনের আসল সত্যকে আমি দেখে ফেলেছি। হিসহিস করে উঠল ওরা— “হেকেটের ইচ্ছা পূর্ণ হবেই। আমরা যাচ্ছি তোমার স্বামীর কাছে; সে শুনবে আমাদের কথা। আর তুমি... তোমার ‘ইতিহাস’ হওয়ার খুব সাধ, না? কোনো ইতিহাস-লেখক লিখবে না তোমার পরিপূর্ণ ইতিহাস; কোনো ইতিহাস বইতে তুমি পাবে না তোমার প্রাপ্য স্থান। এই আমাদের অভিশাপ, এই হেকেটের অভিশাপ।”

অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের জীবগুলো। তারারা ফুটে উঠল কালো আকাশের গায়ে। সেদিকে তাকিয়ে একটা উপলব্ধি হল আমার।

নিয়তির গতিরোধ করার সাধ্য আমার নেই। আমার স্বামীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, আমি জানি। তাতে ঘৃতাহুতি পড়লে তিনি কী করতে পারেন, তাও অজানা নয় আমার। আমার কাজ এখন ওঁর পাশে থাকা; ধ্বংসের পথে চলেছে যে জাহাজ, তার ক্যাপ্টেনের পাশে থাকা, তাকে বুঝতে দেওয়া যে এই শেষ মুহূর্তেও সে একা নয়।

তারপরের দিন যুদ্ধ জিতে বাড়ি ফিরলেন আমার স্বামী; রাজা ডানকান তাঁর সামন্তবর্গ নিয়ে এলেন আমার প্রাসাদে। আর সেই রাতে রাজার প্রহরীদের মদে অজ্ঞান করে ছোরা নিয়ে তাঁর কক্ষে ঢুকলাম আমি।

আমার স্বামী নিজেই চেয়েছিলেন কাজটা করতে, কিন্তু আমি করতে দিইনি। অতিথি-হত্যার যা পাপ, তা আমারই হোক। ঐ মানুষটাকে আর জড়াতে চাইনি তাতে।

প্রায়ান্ধকার কক্ষে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলেন রাজা ডানকান— ঠিক আমার বুড়ো বাবার মত। ডাইনিরা চায়, লোভে পড়ে ওঁকে হত্যা করি আমি— রানি হওয়ার লোভে।

ঘরের মধ্যে অঘোরে ঘুমোচ্ছে দুই মাতাল দেহরক্ষী। ছোরার শীতল ফলায় চুম্বন করলাম আমি, মাখিয়ে দিলাম আমার সব ভালবাসা, সব ক্ষমাপ্রার্থনা। তারপর তাকে পাঠিয়ে দিলাম ঘুমন্ত বৃদ্ধের হৃৎপিণ্ডের ঠিকানায়।

কে ভেবেছিল, ঐ বুড়োটার শরীরে এত রক্ত ছিল!

এ ঘটনার কথা তোমার নাটকে লিখো না, উইলিয়াম; কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি কিন্তু রানি হওয়ার লোভে ওঁকে মারিনি, বিশ্বাস করো। যখন ডানকান প্রথম এলেন আমার প্রাসাদে, ওঁর পেছনে কালো কাপড় পরা খড়্গহস্ত মৃত্যুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম আমি। তখনই জানতাম, ফিরে যাওয়া আর হবে না রাজার। কিন্তু রাজহত্যার পাপ লর্ড ম্যাকবেথের হাতে লাগতে দেব না, এই ছিল আমার পণ। যদিও তোমার হলিনশেডস ক্রনিকলস সম্পূর্ণ অন্য কথা বলে।

মৃত্যুই সত্য, জীবনটা মঞ্চের অভিনয়ের বেশি কিছু নয়। তুমি নাটক লেখো, তুমি বুঝবে।

ডাইনিরা হারাতে পারেনি আমাকে, কারণ লোভে নয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষায় নয়, রাজা ডানকানের বুকে ছুরি বসিয়েছিল যে মেয়েটা, সে জানত জীবনের একমাত্র সত্য— মৃত্যু। সেই শেষ পরিণতির আগে তার স্বামীকে ক্ষমতার ক্ষণিক আস্বাদ দিতে চেয়েছিল সে। ব্যস, এইটুকুই আমার গল্প।

 

লেডি ম্যাকবেথ থামলেন। উইলিয়াম তাকিয়ে রইলেন তাঁর টেবিলের উপর ছোট হয়ে আসা গলন্ত মোমবাতিটার দিকে। তারপর বললেন, “এ ইতিহাস তো কোথাও পাইনি।”

“পাবেও না। ডাইনিদের অভিশাপ, হেকেটের অভিশাপ। কোনো ইতিহাস মনে রাখবে না আমাকে।”

রাতের লন্ডনের রাস্তায় মাতালদের অসংলগ্ন হল্লা ভেসে বেড়াচ্ছে এখনও। এক মূর্খের বলা গল্প যেন— অর্থহীন, অনাবশ্যক!

লেডি ম্যাকবেথ আবার বললেন, “কিন্তু উইলিয়াম, সেদিন এক জায়গায় আমি ভুল করেছিলাম, জানো!”

চকিত হয়ে উইলিয়াম বললেন, “কোথায়?”

“মৃত্যুতেই সব শেষ নয়। মৃত্যুকে জয় করার উপায় আছে।”

“কীভাবে, বলুন আমাকে।”

“তুমি জানো না? তুমিই তো বলেছ—

‘Nor Mars his sword nor war’s quick fire shall burn

The living record of your memory.’

কবিতায় যে অমরত্ব পায়, মৃত্যু তাকে মারবে কী করে?”

ভীষণভাবে চমকে উঠলেন উইলিয়াম।

“এ কবিতা আপনি পড়লেন কোথায়? খুব চেনা ক’জনের বাইরে আমি তো এখনও কাউকে দেখাইনি!”

লেডি ম্যাকবেথ হাসলেন।

“এই যা কিছু দেখছ, শুনছ, এসব কোথায় হচ্ছে বলো তো?”

“কোথায় আবার? আমার ঘরে!”

মাথা নাড়লেন লেডি ম্যাকবেথ।

“না উইলিয়াম। এসব তোমার মনের সৃষ্টি; তোমার মস্তিষ্কের ঘরে চলছে এই কথাবার্তা। তোমার লেখা আমার কাছে কিছুই অজানা নেই। কিন্তু তার আগে বলি আমার ভুল ভাঙার কথা। কীসে আমার ভুল ভাঙল জানো? তোমার কবিতা পড়ে।”

স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন উইলিয়াম। লেডি ম্যাকবেথ আবার বললেন, “তোমার কবিতা আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে, মৃত্যুকে জয় যদি কেউ করতে পারে, সে ইতিহাস নয়, সে সাহিত্য। তোমার কবিতায় যেমন তোমার বন্ধুকে অমর করেছ তুমি, তেমনই তোমার নাটকে অমর হয়ে থাকবে লেডি ম্যাকবেথ। ইতিহাস তাকে নিয়ে যদি না-ই লেখে, তাতে তার আর কিচ্ছু যায় আসে না। পাঁচশো বছর পরেও লোকে তাকে দেখে মুগ্ধ হবে, উইলিয়াম; তোমার সৃষ্টি দেখে বিস্মিত হবে।”

উইলিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

“পাঁচশো বছর! অতটাও আশা করি না।”

“আমি করি। আমি তোমার ভবিষ্যৎ দেখেছি।”

“কিন্তু একটা কথা...” কিন্তু-কিন্তু করে উইলিয়াম বলেই ফেললেন শেষ পর্যন্ত। “কোনো ইতিহাসেই তো আপনাকে নিয়ে বিশেষ কিছু তথ্য পাচ্ছি না। অথচ লর্ড ম্যাকবেথের পাশে আপনার মত চরিত্র থাকলে নাটক পূর্ণতা পায়, একথাও সত্যি...”

লেডি ম্যাকবেথ উঠে দাঁড়ালেন।

“তোমার নাটকের প্রয়োজনেই তো আমার এখানে আসা, উইলিয়াম। কিন্তু এবার আমাকে যেতে হবে।”

“কিন্তু আপনি... আপনি আসলে কী, মাই লেডি? কীরকম স্পিরিট আপনি?” ‘ডেমনোলজি’র দিকে আবার চোখ গেল তাঁর। এরকম কোনো ভূতের উল্লেখ তো ওখানে পাননি তিনি।

“আমি ভূত নই, উইলিয়াম,” লেডি ম্যাকবেথ হাসলেন। “আমি ভবিষ্যৎ। তোমার সৃষ্টির অপেক্ষায়।”

ছায়া হয়ে মিলিয়ে গেলেন রাজকীয় বেশধারী দীর্ঘাঙ্গী ভদ্রমহিলা। উইলিয়াম নিষ্পলকে চেয়ে রইলেন ফুরিয়ে আসা মোমবাতিটার দিকে। তাঁর ছায়া কাঁপছে ঘরের দেওয়ালে; রাত্রি ফুরিয়ে আসছে।

নাটকের চরিত্র পেয়ে গেছেন তিনি; মাথার মধ্যে গুণগুণ করছে ক’টা লাইন। তবে রানি নয়, এগুলো বসাতে হবে রাজা ম্যাকবেথের মুখেঃ

“Out, out, brief candle!

Life’s but a walking shadow…”