বজ্রের তিন যোদ্ধা ● স্ট্যানিস্লাভ লেম ● অনুবাদ: দীপ ঘোষ


 

 

জ তোমাদের এক অনেক দূরের আকাশের গল্প বলি। সেই জগতে বহু বছর আগে এক নামকরা বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তিনি সারাদিন যত অদ্ভুত সব যন্ত্র বানাতেন। তাঁর সাথি ছিল একটা ছোট্ট যন্ত্র যে সুরেলা গলায় গান শোনাতো তাঁকে। তিনি সেই যন্ত্রটার নাম দিয়েছিলেন ‘পাখি’। বৈজ্ঞানিকের চিহ্ন ছিল একটা হরতনের টেক্কা, আর তাঁর তৈরি ছোট বড় সব যন্ত্রতেই থাকত এই প্রতীক। অনেক বছর পরে অন্যরা যখন অণু পরমাণুর দুনিয়ায় পা রাখল, অবাক হয়ে দেখল তারা সেখানেও ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন প্রাজ্ঞ তপস্বী। অনেক অদ্ভুত কল কবজা তৈরি করলেও তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা কাজটি ছিল জীবন ও মৃত্যুকে এক সুতোয় বাঁধা। তিনি জল থেকে তৈরি করলেন এক বুদ্ধিমান জাতিকে। না না, তোমরা যেমন ভাবছ সেরকম জলের দৈত্য তিনি বানাননি, স্যাঁতস্যাঁতে-ভিজে জিনিসপত্রকে তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন। সেই জন্যে তাঁর তৈরি সেই বুদ্ধিমান ও সুন্দর জীবরা ছিল ক্রিস্টালের তৈরি। তিনি বাছলেন সূর্য থেকে অনেক দূরের একটি গ্রহ, আর তার বরফ হয়ে যাওয়া সমুদ্র থেকে তুলে আনলেন হিমের পাহাড় এবং সেগুলি কেটে তৈরি করলেন হিমজীবীদের। এই জীবেরা চিররাত্রির জগতে অত্যন্ত ঠান্ডা ছাড়া বাঁচতে পারত না। তারা সেই গ্রহে তৈরি করল অনেক বরফের শহর, ঝলমলে ক্রিস্টালের প্রাসাদ। কোনোরকম তাপই তাদের সহ্য হত না, তাই তারা মেরুজ্যোতিকে বন্দি করল ক্রিস্টালের বাতিদানে। তাদের শহরের রাস্তায়, ঘরে ঘরে থাকত সেই আলো। সমাজে যার অবস্থান যতটা উঁচু, তার কাছে থাকত তত বেশি আলো— রূপালী অথবা লেবু হলুদ আলোয় সেজে উঠত তার প্রাসাদ। এইভাবে তারা বহুকাল সুখে শান্তিতে বসবাস করছিল। তবে শুধু আলো নয়, হিমজীবীরা বিখ্যাত ছিল তাদের অমূল্য সব রত্নের জন্যে। দুষ্প্রাপ্য সব খনিজ, তারা খুঁড়ে বের করত জমে যাওয়া গ্যাসেদের হৃদয় চিড়ে। আর সেই রত্নগুলি রঙিন করে তুলত তাদের চির তুষারের রাত্রিকে, যেন ক্রিস্টালের মধ্যে বন্দী কতকালের অতৃপ্ত আত্মা, যেন মহাজাগতিক ছায়াপথ মিশে গেছে শীতল মেরুজ্যোতির সঙ্গে।

একাধিকবার মহাশূন্যের বিজয়ীরা ভবেছে ওই রত্নগুলো ছিনিয়ে নেবার কথা, আর ভাববে নাই বা কেন? মহাকাশ থেকে হিমগ্রহকে অনেক অনেক দূর থেকেও দেখতে পাওয়া যেত, কালো ক্যানভাসের মাঝে একটি উজ্জ্বল হীরের টুকরোর মতো। সুতরাং অভিযাত্রীরাও হাজির হলো একদিন হিমগ্রহের সম্পদ লুঠ করার জন্যে। প্রথমে এলো বজ্রের যোদ্ধা পিতল। সে একেকবার পা ফেললে মনে হত যেন কোনো বিশাল ঘণ্টা বাজছে কোথাও। অথচ সে যে মুহূর্তে হিমগ্রহের বরফে পা রাখল, তার শরীরের তাপে গলে গেল বরফ। সীমাহীন অন্ধকার সমুদ্রে তলিয়ে গেল পিতল। মাথার উপর পুরু বরফের আস্তরণের নিচে আটকে গেল সে, ঠিক যেন রজনের স্ফটিকে আটকে থাকা অসহায় কীট। শোনা যায় আজও নাকি হিমসাগরের নিচে বরফের পাহাড়ের মধ্যে আটকে আছে পিতল।

তা বলে কি মহাবিশ্বের দুর্দম বীর যোদ্ধারা থমকে গেল? এরপরে হিমগ্রহের সম্পদের লোভে এল বজ্রযোদ্ধা লৌহ। পিতলের দশা থেকে আগেই শিক্ষা নিয়েছিল সে। তাই গলা পর্যন্ত টইটম্বুর করে তরল হিলিয়াম খেয়ে নিয়েছিল লৌহ। তার সারা গায়ে এমনভাবে বরফ জমে গেল যে দূর থেকে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক তুষার দানব। কিন্তু গ্রহের পিঠে নামার সময় বাতাসের ঘর্ষণে তার পেটের সব হিলিয়াম নিমেষে বাষ্প হয়ে গেল তীব্র শব্দে। ওদিকে লৌহের সারা শরীর আগুনের মতো গরম হয়ে গেছিল ততক্ষণে। বরফের একটা উঁচু পাহাড়ের উপর স্বশব্দে আছড়ে পড়ল সে। বরফের ফাটল থেকে নিজেকে যখন বের করে আনল লৌহ, তখন তার শরীর থেকে বয়লারের মতো শোঁ শোঁ শব্দ বের হচ্ছিল। সে যা ছুঁতে যাচ্ছিল তাই নিমেষে সাদা মেঘে পরিণত হচ্ছিল, আর সেই মেঘ সঙ্গে সঙ্গে বরফ হয়ে ঝরে পড়ছিল তার পায়ের কাছে। লৌহ অপেক্ষা করতে লাগল, কখন তার শরীর ঠান্ডা হয়। যখন তার বর্ম থেকে বরফ গলে পড়া বন্ধ হল, তখন সে উঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হল। কিন্তু হায়, ততক্ষণে তার শরীরের জোড়ের সমস্ত তেল জমে প্রায় বরফ হয়ে পড়েছে। সে বেচারা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আর পারল না। সে সেখানেই একইভাবে বসে রইল আর তার শরীরের উপর জমতে লাগল বরফের পাহাড়। আজও তারা ওই জায়গাটাকে বলে লৌহ পাহাড়, সেখানে বজ্রের দ্বিতীয় যোদ্ধা লৌহের বরফ ঠান্ডা চোখে নিস্পলকে তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে।

দুই যোদ্ধার অন্তিম দশার কথা পৌঁছল তৃতীয় যোদ্ধা স্ফটিকের কানে। স্ফটিকের শরীর দিনের বেলায় কাচের মতো স্বচ্ছ দেখাত, আবার রাত্রে সেই শরীরেই প্রতিফলিত হত অন্ধকার মহাকাশের ঝিকমিকে তারাগুলি। লৌহের মতো তার শরীরের জোড়ে কোনো তেল দরকার হত না, তাই ঠান্ডায় জমে যাবারও ভয় ছিল না। আবার পিতলের মতো বরফ গলে তলিয়ে যাবারও কোনো সম্ভাবনা তার ছিল না, কারণ স্ফটিক ইচ্ছে মতো নিজের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। শুধু একটাই ভয় ছিল তার, খুব বেশি মাথা খাটালেই তার স্ফটিকের তৈরি মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠত। তাই সে প্রতিজ্ঞা করল হিমগ্রহে লড়াইয়ের সময় সে একদম চিন্তা ভাবনা করবে না। অনন্ত রাত্রির মহাকাশের মধ্যে দিয়ে সে শুরু করল তার যাত্রা। এই দীর্ঘ যাত্রায় তার শরীর এতই ঠান্ডা আর কঠিন হয়ে গেছিল যে মহাশূন্যের উল্কাখন্ডগুলো তার শরীরে লেগে সঙ্গে সঙ্গে টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। হিমগ্রহের বরফের মধ্যে সে যখন নামল, তাকে দেখে একটি উজ্জ্বল কাচের টুকরো বলে মনে হচ্ছিল। কালো আকাশের নিচে বসে সে ভাবছিল এবার কী করবে। হঠাৎ তার খেয়াল হল চারপাশের বরফ গলে বাষ্প তৈরি হতে শুরু হয়েছে।

“ওহ! ভাবনা চিন্তা করলে হবে না। শুধু রত্নগুলো থলিতে পুরলেই হবে।” স্ফটিক নিজের মনে বার বার বলতে লাগল।

সে ঠিক করল যাই হোক না কেন এই একটাই কথা সে মনে মনে আওড়াবে। কিছু না ভাবলেই তার শরীর ঠান্ডা থাকবে আর তাহলেই তার কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না। এলোমেলো পায়ে সে হাঁটতে শুরু করল হিমজীবীদের শহরের খোঁজে। অনেকক্ষণ অনেকটা পথ চলার পরে সামনে এসে পড়ল এক দিগন্তবিস্তৃত বরফের প্রাচীর। হিমজীবীদের রাজধানী শৈত্যস্তান সেই পাঁচিলের অন্যদিকে। ছুটে গিয়ে সে মাথার শিরস্ত্রাণ দিয়ে ধাক্কা দিল সেই পাঁচিলের গায়ে। প্রবল সংঘাতে আগুনের ফুলকি ছুটল, কিন্তু বরফের পাঁচিলে একটা দাগও সে ফেলতে পারল না।

“আচ্ছা, এইভাবে হবে না!” সে মনে মনে দুইকে দুই দিয়ে গুণ করল। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথাটা একটু গরম হয়ে উঠল। আবার সে আবার ছুটে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা দিল। বরফের একটা ছোট টুকরো খসে পড়ল দেওয়াল থেকে এবার।

“হুম, যথেষ্ট গরম হয়নি”। চোখ বন্ধ করে স্ফটিক ভাবতে লাগল। “আরো কঠিন চিন্তা করতে হবে আমায়। তিন গুণ পাঁচ কত হয়?”

এত কঠিন হিসেব কষতে গিয়ে স্ফটিকের মাথার চারপাশ থেকে ধোঁয়া উঠতে লাগল, তার মাথা আর ঘাড়ের সব বরফ নিমেষে বাষ্প হয়ে গেল। এইবার সে কয়েক পা পিছিয়ে আবার ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিল বরফের পাঁচিলটায়। সঙ্গে সঙ্গে স্ফটিক সোজা পাঁচিল ভেদ করে অন্যদিকে পোঁছে গেল। কিন্তু এত জোরে সে দৌড়েছিল যে এরপরেও দুটো প্রাসাদ আর তিনটে বড় বাড়ি ভেঙে সে একটা বিশাল সিঁড়ির উপর আছাড় খেয়ে পড়ল। অনেক কষ্টে সিঁড়ির পাশের স্ট্যালাকটাইটের হাতল ধরে ওঠার চেষ্টা করল সে, ততক্ষণে তার চারপাশের সবকিছু গলতে শুরু করেছে মাথার গরমে। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জায়গা হবে শহরের নিচে বরফের মধ্যে, পিতলের মতোই অনন্তকাল আটকে থাকবে সে ওখানে।

“কোনো চিন্তা নেই, রত্নগুলো হাতের মুঠোয়!” বিড়বিড় করতে থাকল সে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মাথা ঠান্ডা হয়ে গেল।

বরফের মধ্যে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে সে পৌঁছে গেল শহরের মাঝখানে চার মাথার মোড়ে। চারপাশের ক্রিস্টালের তৈরি স্তম্ভগুলোর মাথায় পান্না রঙের মেরুজ্যোতি খেলা করছিল।

বরফের রাস্তায় হিমজীবীদের প্রধান সেনাপতি মেরুরাজের সঙ্গে তার দেখা হল। মেরুরাজের সর্বাঙ্গ কাচের মতো ঝকঝকে আর তাতে বসানো বিভিন্ন রত্ন রাত্রের তারাদের মতো ঝিকমিক করছে। মেরুরাজ কাছে আসতেই স্ফটিক তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, মনে হল মহাসাগরের মধ্যে দুটো ভাসমান হিমবাহে যেন ঠোকাঠুকি লেগেছে। মেরুরাজের ডান হাতটা সেই আঘাতের চোটে গ্রন্থি থেকে খুলে পড়ে গেল। তাতে একটু না দমে সে স্ফটিকের দিকে তার হিমবাহের মতো (সত্যিই হিমবাহই ছিল আসলে) বুকটা বাড়িয়ে দিল, যাতে পরের আঘাতটা সে সামলাতে পারে। কিন্তু স্ফটিক যে বরফের থেকে অনেক বেশি শক্ত আর ঘন, স্ফটিকের পরের আঘাতে মেরুরাজ বিকট শব্দ করে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সবাই বলে অনেক দূর থেকেও পাহাড়ের ধস নামার মতো সেই তীব্র শব্দ শোনা গেছিল।

“এইতো, রত্নগুলো হাতের মুঠোয়, আরেকটু সময় চাই, ভাবলে চলবে না”। বলতে বলতে স্ফটিক মেরুরাজের গা থেকে সব দূর্মূল্য রঙিন পাথরগুলো খুলে নিতে শুরু করল। জমাট হাইড্রোজেনের তৈরি আংটি, আর্গন, ক্রিপ্টন আর জেনন গ্যাসের তৈরি মেডেল আর মালা— হীরের মতোই চকমক করছিল। স্ফটিক সেগুলোকে হাতে নিয়ে তারিফ করছিল। হঠাৎ তার আবেগের উষ্ণতায় সেগুলি গলে যেতে লাগল, হিরে চুনি পান্না রঙের মণিগুলি হিসহিসিয়ে উবে গেল তার হাতের ছোঁয়ায়। হাতের মুঠোয় পড়ে ছিল শুধু কয়েক ফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতো জল, তাও দেখতে দেখতে উবে গেল।

“আরে! এতো দেখছি তারিফও করা যাবে না! ঠিক আছে পরের বার আর ভাবব না এসব নিয়ে!” স্ফটিক এগিয়ে চলল শহরের মাঝের প্রাসাদের দিকে। দূর থেকে সে দেখতে পেল বিশালাকার এক যোদ্ধা তার দিকে আসছে। খনিজদের সেনাপতি শ্বেতসঙ্করের বুকের উপর আড়াআড়িভাবে ঝলমল করছিল তুহিনকণার তারা আর বরফের কাঁটার কারুকাজ, সে ছিল হিমজীবীদের রাজকীয় সম্পদাগারের রক্ষী। শ্বেতসঙ্করের স্ফটিকের রাস্তা আটকে দাঁড়াল। স্ফটিক ঝড়ের মতো আক্রমণ করলো তাকে, দুজনের লড়াইয়ে যেন আকাশ থেকে বজ্র নেমে এল বরফের বুকে। দুজনের লড়াইটা সমানে সমানে হত, যদি না কৃষ্ণ শিলাবৃষ্টির শাসক, রাজপুত্র নক্ষত্রজ্যোতি এসে যোগ দিত শ্বেতসঙ্করের দিকে। রাজপুত্রের তরল হিলিয়াম দিয়ে বাঁধানো নাইট্রোজেনের বর্মের সামনে স্ফটিকের লড়াইয়ের উদ্যম যেন ঝিমিয়ে পড়ল, তার হাত পা শিথিল হয়ে এলো, এমনকি চোখের সামনে থেকে মেরুজ্যোতির আলোও যেন নিভে আসতে লাগল, এতটাই শীতল ছিল সেই বর্মের চরম শূন্য তাপমাত্রা।

“হচ্ছেটা কী আমার চারপাশে?” অবাক হয়ে ভাবতে লাগল স্ফটিক, আর এই আকস্মিক বিস্ময়ে তেতে উঠল তার মাথাটা। দেখতে দেখতে চরম শূন্য তাপমাত্রা পরিবর্তিত হল গ্রীষ্মের গরমে। স্ফটিকের চোখের সামনে নক্ষত্রজ্যোতি আর শ্বেতসঙ্করের প্রথমে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো বরফখন্ড থেকে পরাজিতের অশ্রুর মতো ঝরতে থাকা তরল ছাড়া কিছুই পড়ে রইল না যুদ্ধক্ষেত্রে।

“সব সম্পদ আমার হাতের মুঠোয়!” নিজের মনে আবার বলল স্ফটিক। “ভাবলে চলবে না, যতক্ষণ না ভাবার প্রয়োজন পড়ছে। আবার ভাবলেও দেখি আমিই জিতি!” শৈত্যস্তানের রাস্তা দিয়ে সে মহানন্দে এগিয়ে চলল আবার। তার প্রতি পদক্ষেপ বরফের উপরে গম্ভীর জলতরঙ্গের শব্দ তুলছিল, কিন্তু ছোট ছোট সাদা বরফের বাড়ির মধ্যে থেকে হিমজীবীদের হৃদয়ে তা হতাশার অনুরণন হয়ে বাজছিল। আকাশগঙ্গার মাঝে অপ্রতিরোধ্য ধূমকেতুর মতো সে এগিয়ে চলেছিল। হঠাৎ রাস্তার মাঝে সে একটি ছোটখাটো হিমজীবীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। এই ছোট্ট জীবটি ছিল ব্যারিয়ন, শীতালির প্রধান পুরোহিত, হিমজীবীদের মধ্যে সবথেকে জ্ঞানী। স্ফটিক দৌড়ে গেল তার দিকে, ইচ্ছে ছিল পিষে দেবার এক ধাক্কায়, কিন্তু ছোট্ট জীবটা শেষ মুহূর্তে একটু সরে দাঁড়ালো আর দুটো আঙ্গুল তুলে দেখাল তার দিকে। স্ফটিক এই সংকেতের অর্থ কিছু বুঝল না, কিন্তু সে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ধেয়ে গেল তার প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। আবার শেষ মুহূর্তে ব্যারিয়ন তার সামনে থেকে সরে গিয়ে এক আঙুল তুলে দেখাল। স্ফটিক এবার তাড়াহুড়ো না করে আস্তে আস্তে ব্যারিয়নের দিকে এগোতে লাগল, তার মাথায় জমা হয়েছিল একরাশ জিজ্ঞাশা। তার চারপাশের বাড়িগুলি থেকে বরফ জল হয়ে ঝরে পড়তে লাগল, কিন্তু সেসবের দিকে স্ফটিকের কোনো নজর ছিল না। তখন ব্যারিয়ন আঙুল দিয়ে একটি বৃত্ত তৈরি করেছে, আর বার বার বুড়ো আঙুলটা সেই বৃত্তের মধ্যে ঢোকাচ্ছে আর বের করছে। স্ফটিক আনমনা হয়ে ভাবতে লাগল এইসব সঙ্কেতের অর্থ কী, সে বুঝতেও পারল না তার পায়ের নিচের বরফ গলতে গলতে সে নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার কালো সমুদ্রের জগতে তলিয়ে যাচ্ছে। “ভাবলে চলবে না”, এই কথাটা ভাবার আগেই সে মারা গেল, আর তার দেহটা এক টুকরো ভারি পাথরের মতো ডুবে গেল সমুদ্রের মধ্যে।

পরে সমস্ত হিমজীবীরা জিজ্ঞাসা করেছিল ব্যারিয়নকে, এইসব সঙ্কেতের মাধ্যমে সে কী বলতে চেয়েছিল ওই ভয়ঙ্কর বজ্রের যোদ্ধাকে।

“খুবই সহজ কথা,” ব্যারিয়ন বলল, “দুই আঙ্গুলের আমি বুঝিয়েছিলাম, এখন আমরা দুজন আছি, আমি আর স্ফটিক। এক আঙুলে বুঝিয়েছি একটু পরেই শুধু আমিই থাকবো। আর বৃত্ত ও বুড়ো আঙুলে বুঝিয়েছি ওর পায়ের নিচের বরফ ভেঙে ও তলিয়ে যাবে কৃষ্ণ সমুদ্রের অতলে। ও বেচারা প্রথম সংকেতটাই বুঝতে পারেনি, দ্বিতীয় বা তৃতীয়টার কথা তো অবশ্যই নয়”।

“ও জ্ঞানী বৃদ্ধ ব্যারিয়ন, আপনি জানলেন কী করে যে ওই দুর্ধর্ষ লুঠেরা আপনার এই ইঙ্গিত বুঝবে না? যদি ও বুঝতে পারত তাহলে কী হত ভাবুন তো একবার! ও এত চিন্তাই করত না, আর বরফও গলত না…”

“ধুস, আমি জানতাম ও কিছু বুঝবেই না,” ব্যারিয়ন, শীতালির পুরোহিতের ঠোঁটে ঠান্ডা হাসি খেলে গেল। “আরে ওর মধ্যে যদি একটুও বোধ বুদ্ধি থাকত, তাহলে কি ও গরম সূর্যের দেশ থেকে এখানে এসে জমাট বাঁধা গ্যাসের মণি আর বরফের জহরত লুঠ করতে চাইত?”

সব হিমজীবীরা জ্ঞানী ব্যারিয়নের জয়গান করতে করতে ফিরে গেল তাদের হিমেল ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। এরপর আর কেউ হিমগ্রহ আক্রমণের সাহস দেখায়নি। কিছু হিমজীবী বলে সারা মহাবিশ্বে এরকম নির্বোধ যোদ্ধা আর নেই, তবে অন্যেরা বলে, নিশ্চই আছে, তারা শুধু এখনো হিমগ্রহের রাস্তা খুঁজে পায়নি।