স্বর্ণভূমির সন্ধানে ● সায়নদীপা পলমল


 

 

“কাপ্তান!”

এই রাতে দরজার কাছ থেকে আচমকা ফ্যাসফ্যাসে গলাটা শোনা যেতেই চমকে উঠলেন ‘ডানা’ জাহাজের ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ডি সিলভা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেই লোকটা― একমুখ কাঁচা পাকা দাড়ি, মরা মাছের মত ঘোলাটে চোখ, গায়ে বিশ্রী গন্ধ আর কপালে একটা লম্বাটে ক্ষত যাকে প্রত্যেক দিন দেখলে মনে হয় যেন টাটকা― লোকটার নাম রডরিক। মাত্র একমাস আগে পর্তুগালের প্রধান কারাগার থেকে বিশেষ শর্তের বিনিময়ে ছাড়া পেয়েছে; ডাকাতি ও খুন সহ আরও না জানি কী কী সব অভিযোগে জেল খাটছিল। এমন লোক যদি এই রাতের বেলায় একলা ক্যাপ্টেনের কেবিনে আসে তাহলে ক্যাপ্টেন যে প্রসন্ন হবেন না তা বলাই বাহুল্য।

রডরিক হয়তো স্বাগত সম্ভাষণের অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু ক্যাপ্টেন সেসবের ধার না ধরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শুধু তাকালেন লোকটার দিকে। লোকটা আগের মতই ফ্যাসফ্যাসে গলায় কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলে উঠল, “জাহাজ ফেরান, আমরা আর এগোবো না।”

“কী!” থতমত খেয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন।

“সামনে বিপদ ঘুমিয়ে, তাকে জাগিয়ে তুলে এতগুলো প্রাণ নষ্ট করবেন না।” ভাবলেশহীন গলায় কথাগুলো বলে যেমন আচমকা এসেছিল তেমনই আচমকা চলে গেল রডরিক, পেছনে ফেলে রেখে গেল হতভম্ব ক্যাপ্টেন আলফ্রেডকে। রাতের দিকে কোনো দায়িত্ব না থাকলে অনেক কর্মচারীই নিজ নিজ কক্ষে পান করে থাকে, রডরিকও হয়তো আজ... কিন্তু লোকটাকে দেখে তো নেশাগ্রস্থও মনে হল না!

“কাপ্তান?”

আবার ডাকে সম্বিৎ ফিরল আলফ্রেডের, দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে পেড্রো, জাহাজের সবচেয়ে বয়স্ক, সবচেয়ে অভিজ্ঞ নাবিক। আলফ্রেড তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে কক্ষের ভেতরে আহ্বান জানাল। পেড্রো ভেতরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন, তারপর ফিসফিস করে বললেন, “ওই রডরিককে আপনার কক্ষ থেকে যেতে দেখলাম, সে কি কিছু বলেছে আপনাকে?”

“হুমম…” গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন আলফ্রেড। পেড্রো সশব্দে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ভেবেছিলাম এই রাতে আর আপনাকে বিরক্ত করব না কিন্তু ওই দুষ্টটা যখন আপনাকে বলেই দিয়েছে তখন এখনই আলোচনা করা শ্রেয়।”

“কী ব্যাপার বলুন তো পেড্রো, হঠাৎ করে কী হল?”

“হঠাৎ করে হয়ত নয় কাপ্তান, আগুনটা লেগেছিল অনেক আগেই। আমরাই টের পাইনি শুধু। আর এই আগুন লাগিয়েছে ওই শয়তান রডরিক।”

“ওর উদ্দেশ্যটা কী?”

“ঠিক বুঝতে পারছি না, হয়তো আবার ছাড়া পেয়ে পুরোনো পেশাতে ফিরে যেতে চায়, আর শুরুটা করতে চায় ডানাকে দিয়েই।”

“সেকি! না না আমি থাকতে এ কিছুতেই হতে দেব না।”

“শান্ত হোন কাপ্তান, যা বললাম তা আমার অনুমান মাত্র।”

“শান্ত হওয়া সম্ভব নয় পেড্রো, আমারই পেছনে আমার জাহাজের কর্মচারীরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে আর আমি কাপ্তান হয়ে কিছুই জানতে পারছি না! এ তো আমার ব্যর্থতা।”

“একে আদৌ ষড়যন্ত্র বলা যায় কিনা সে নিয়ে আমার মন দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে আছে।”

“অর্থাৎ?”

“অর্থাৎ...”, গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে পেড্রো বললেন, “এই জাহাজের কর্মচারীদের একজন আমার কাছে বিশেষ কারণে কৃতজ্ঞ তাই তার মারফৎ জাহাজের কর্মচারীদের ভেতরের কিছু খবর আমি জেনেছি। সে আমাকে বলল রডরিক নাকি বলেছে আমরা যে দিশায় এগুচ্ছি সেদিকে আরও যদি এগিয়ে যাই তাহলে আমাদের জাহাজ এক মায়া পুরীর পরিধির মধ্যে প্রবেশ করবে, যে মায়া পুরীতে একবার প্রবেশ করলে আর ফিরে আসা মুশকিল, মায়া পুরীর মায়ায় আমরা হারিয়ে যাবো সকলেই, আর কেউ যদি ভাগ্য জোরে বেঁচেও যাই তাহলেও নাকি উন্মাদ হয়ে যাবো।”

“আপনি এসব গাঁজাখুরি গল্পে বিশ্বাস করেন পেড্রো?”

“বিশ্বাস অবিশ্বাস বড় বিচিত্র জিনিস। আমি জানি না মানেই তার অস্তিত্ব নেই একথা ভাবা অবান্তর। এই পথে এর আগে আমরা কেউ আসিনি কিন্তু রডরিক এসেছিল, আর এটাও সত্যি যে ওর ভাগ্য বিপর্যয়ও ঘটে সেই যাত্রার পরেই। কুখ্যাত দস্যু রডরিক বিধ্বস্ত অবস্থায় দেশে ফেরে, যাকে এতদিন ধরাতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল সেনারা, সেই রডরিকই কত সহজে ধরা পড়ে যায় এবার। দস্যুর অপরাধের সাথে নতুন আরেক অপরাধের তকমা লাগে। যাইহোক, আপনি ভাবনা চিন্তা করুন। কালকে এই নিয়ে আবার কথা বলা যাবে।”

প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে যান বৃদ্ধ পেড্রো। আলফ্রেড হতবুদ্ধি হয়ে বসে পড়েন তার বিছানায়।

 

আলফ্রেড ডি সিলভা, পর্তুগালের রাজার এক বাণিজ্যতরীর সুযোগ্য ক্যাপ্টেন। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়েসে অন্তর্দেশীয় বানিজ্যে ইতিমধ্যেই বেশ নাম করেছেন আলফ্রেড। শুধু তাই নয় বেশ কয়েকবার জলদস্যুর আক্রমণের সামনে বিচলিত না হয়ে বীর বিক্রমে লড়াই করে নিজের জাহাজকেও রক্ষা করেছেন তিনি। রাজাও এই কারণে বিশেষ ভরসা করেন তাঁকে। বিবাহ না হলেও মা বাবা ও তিন বোনকে নিয়ে সংসার আলফ্রেডের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। বাবা অসুস্থ আজ দীর্ঘদিন। কিশোর বয়েসে চরম দারিদ্রতার সাথে ডি সিলভা পরিবারকে যুঝতে হলেও আলফ্রেড বাণিজ্য তরীতে যাওয়ার পর থেকে অবস্থার উন্নতি ঘটে, তারপর রাজার খাস বাণিজ্য তরীর নাবিক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর তো পরিবারের আর্থিক চিত্রই পাল্টে যায়। কিন্তু কথায় বলে না প্রদীপের সামনে যত আলো তলায় ততই অন্ধকার। রাজা দ্বিতীয় জন এমনিতে ভালো হলেও কি হবে তাঁর খামখেয়ালীপনায় সবসময় তটস্থ থাকতে হয় সকলকে, বিশেষ করে রাজ কর্মচারীদের। রাজার অপছন্দের কিছু ঘটলেই কপালে দুর্ভোগের শেষ থাকে না। চোখের সামনে এমন হাজারও উদাহরণ দেখেছে আলফ্রেড, তাই তো সবসময় সতর্ক থাকার চেষ্টা করে সে।

মাস তিনেক আগের কথা, ইতালির জেনোয়া থেকে নাকি একটা লোক এসে রাজামশাইয়ের কাছে দরবার করে যে আতলান্তিক মহাসাগর ধরে পশ্চিম মুখে এগোতে থাকলেই এক স্বর্ণভূমির সন্ধান মিলবে। রাজামশাই যদি তাঁর অভিযানের ব্যয়ভার বহন করেন তাহলে সে পর্তুগালের হয়ে ওই দেশ অধিকার করে আসবে। অধিক ব্যয়বহুল বলে লোকটার প্রস্তাব মন্ত্রীসভায় নাকচ হয়ে যায়। কিন্তু লোকটার দিয়ে যাওয়া বর্ণনা, যাত্রা পথের বিবরণ সব কিছু রাজামশাইকে অনুসন্ধিৎসু করে তোলে। সত্যই যদি এরকম স্বর্ণভূমি থেকে থাকে তাহলে পর্তুগালের ভাগ্যই পাল্টে যাবে, পর্তুগালই হবে ওই দেশের প্রথম ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। আর এই সোনার দেশের কথা ইতালীয় লোকটাই যে প্রথম বলছে এমনটা কিন্তু নয়, ইউরোপের বণিকদের মুখে মুখে সেই দেশের গল্প আজ দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত। আলফ্রেড নিজেও কাজ করতে গিয়ে শুনেছিল সে দেশের কথা। যাইহোক, ইতালির লোকটাকে বিদেয় করলেও রাজা মশাই সিদ্ধান্ত নেন তুলনামূলক স্বল্প খরচে তিনি নিজের নৌবাহিনীকে লোকটার নির্দেশিত পথে পাঠাবেন। দেখা ই যাক না ভাগ্যে কী আছে! সেই মত ডাক পড়ে আলফ্রেডের, রাজা তার হাতে তুলে দেন এই অভিযানের দায়িত্ব। পেড্রোর মত কয়েকজন অভিজ্ঞ নাবিককে দেন সঙ্গে। রাজার শর্ত এই পুরো অভিযানটাই করতে হবে খুব গোপনে, এমনকি নিজের পরিবারের লোকেদেরও সত্যিটা জানানো যাবে, খানিক ধোঁয়াশায় থাকবে জাহাজের কর্মচারীরাও। রডরিকের এই জাহাজে আসার ব্যাপারটাও রাজামশাইয়ের নির্দেশে। যেহেতু রডরিক একমাত্র লোক যার আতলান্তিক মহাসাগরের এই দিকটা অনেকটাই চেনা তাই তাকে কারাবাস থেকে মুক্তির বিনিময়ে এই অভিযানে পাঠিয়েছেন রাজা। আলফ্রেডের ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও বাধা দিতে পারেনি সে। অবশ্য তার নিজেরও যে এই অভিযানে আসার যে খুব একটা ইচ্ছে ছিল তা নয়, মনে মনে সব সময় শঙ্কা কাজ করছিল যে তার কিছু হয়ে গেলে তার পরিবারের কী হবে! কিন্তু রাজার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস বা ক্ষমতা কোনোটাই তার ছিল না।

অবশেষে প্রায় মাস খানেক আগে এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে লিসবন বন্দর থেকে ডানা জাহাজে পঞ্চাশজন লোক নিয়ে যাত্রা শুরু করে আলফ্রেড। সেই থেকে যাত্রা চলছে তাদের। দেশের সীমা, বন্দর এসব বহু আগেই পেছনে ফেলে এসেছে তারা। আজ প্রায় তেরদিন হল তারা মাথার ওপরে নীলাকাশ আর সামনে অনন্ত বিস্তৃত জলরাশি ছাড়া কিছুই দেখেতে পায়নি। এই পরিস্থিতিতে কর্মচারীরা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তো সমূহ বিপদ, আবার বিদ্রোহের চাপে জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও রাজামশাই কাউকে ছেড়ে কথা বলবেন না।

***

চারিদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার... ডেকের ওপর একলা দাঁড়িয়ে আলফ্রেড। জাহাজটা স্থির হয়ে আছে জলে, বাতাসহীন শীতলটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপুনি ধরাচ্ছে। আলফ্রেড দিশাহীন। আচমকা একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে এসে লাগতেই পেছন ফিরে তাকালেন আলফ্রেড। রডরিক দাঁড়িয়ে, আজকে তার মরা মাছের মত চোখ দুটো জ্বলছে ভাঁটার মত। সাপের মত হিসহিস শব্দে নিঃশ্বাস সামনের কুয়াশায় দাগ কেটে যাচ্ছে।

“এই লোকটা... এই লোকটার জন্য আজকে আমাদের এই দুর্দশা। মারো একে মারো...” আচমকা চিৎকার করে উঠল রডরিক। কুয়াশার নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল বহু মানুষের কোলাহল, “মারো... একে মারো...”

ঊনপঞ্চাশটা হিংস্র শরীর ধেয়ে এলো আলফ্রেডের দিকে...

 

নাআআআ... প্রচণ্ড আর্তনাদ করে বিছানায় উঠে বসল আলফ্রেড। এতক্ষণ তবে পুরোটাই স্বপ্ন ছিল! উফফ শান্তি... কিন্তু বাইরে ও কীসের কোলাহল শোনা যাচ্ছে! বিছানা থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় কেউ করাঘাত করল। দুরুদুরু বুকে দরজাটা খুলতেই আলফ্রেড দেখল পেড্রো দাঁড়িয়ে, উদ্বিগ্নতা তাঁর ছকে মুখে। আলফ্রেড কিছু বলার আগেই পেড্রো বলে উঠলেন, “তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন, কথা বলতে হবে ওদের সঙ্গে।”

নিজেকে কয়েক মুহূর্ত সময় দিলেন আলফ্রেড, তাঁর স্বপ্নটা যাতে সত্যি না হয় তার জন্য এই কথা বলাটা ভীষণ জরুরি।

পেড্রোকে অনুসরণ করে বাইরে বেরিয়ে এলেন আলফ্রেড। ডেকের ওপর তখন জড়ো জাহাজের সব কর্মচারী― ওদের সামনে স্যান্তিয়াগো, কর্মচারীদের প্রধান, আর তার পাশেই রডরিক। আজকের এই জমায়েতের পেছনে যে মূল ইন্ধন যোগানকারী রডরিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সব কিছু জেনেও না জানার ভান করে আলফ্রেড বল্লেন, “কী ব্যাপার, সবাই এখানে কেন?”

এগিয়ে এলো স্যান্তিয়াগো, “কাপ্তান আমরা আর এগোবো না, জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিন।”

“হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ জানতে পারি?” আলফ্রেডের গলা আগের মতই শান্ত।

স্যান্তিয়াগো একটা ঢোক গিলে বলল, “এই পথে এগুলে আমারা সবাই বিপদে পড়ব, সামনে... সামনের রাস্তা ভালো নয়।”

“তুমি তো এই পথে প্রথম এলে, তাহলে কী করে জানলে সামনের পথ ভালো নয়?”

“আমি প্রথম এলেও যে আগেও এসেছে এই পথে সে সব জানে। কাপ্তান আপনি আমাদের কথা শুনুন, জাহাজ ফিরে যেতে নির্দেশ দিন, নয়তো আমরা সবাই মারা পড়ব।”

“আর ফিরে গেলে বেঁচে যাবে? রাজামশাই এত সহজে ছেড়ে দেবেন আমাদের? তোমরা জানো না দেশের এখন কী অবস্থা! এর মাঝেই এই অভিযানের আয়োজন করেছেন তিনি। ফিরে গেলে কেউ রক্ষা পাবো না।”

“কিন্তু...”

“অন্য কারুর কথায় প্ররোচিত হওয়া তোমার শোভা পায় না স্যান্তিয়াগো, নিজের বিবেচনা করে দেখো। আমরা আর কিছুটা এগিয়ে যাবো, যদি তখনও কোনো ডাঙার সন্ধান না পাই তাহলে ফিরে যাবো। এখন তোমরা যে যার কাজে ফিরে যাও।” আলফ্রেডের শান্ত কিন্তু গাম্ভীর্যপূর্ণ গলা শুনে কেন না জানি কর্মচারীরা আর কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। সবাই ফিরে গেল যে যার কাজে। কিন্তু আলফ্রেডের যেন মনে হল রডরিকের ঠোঁটের কোণে একটা ধূর্ত হাসি ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেল। তার মানে কি লোকটার মনে আরও কিছু পরিকল্পনা চলছে!

***

পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই মনটা ভালো হয়ে গেল আলফ্রেডের। এমন রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের সূচনা মানেই ভালো কিছুর ইঙ্গিত। আর হলও তাই। মধ্য প্রহরের আগেই আচমকা আকাশে একজোড়া নাম না জানা পাখি উড়ে গেল, উড়ে যাওয়ার সময় জাহাজের ডেকে ফেলে দিয়ে গেল কিছু। পেড্রো এগিয়ে গিয়ে জিনিসটা কুড়িয়েই চমকে উঠলেন। আনন্দে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো, “হো হো হো”। বৃদ্ধ পেড্রোর এহেন আচরণে চমকে উঠল সবাই, যে যার কাজ ফেলে ছুটে এলো তার কাছে। পেড্রো তাঁর হাতের জিনিসটা ওপরে তুলে ধরতেই সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখল একটা গাছের ডাল, যার গায়ে তখনও লেগে দুটি কচি পাতা। সমস্ত জাহাজে যেন আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল। দুই জোড়া উড়ন্ত পাখি আর এই গাছের ডাল প্রমাণ করছে সামনেই ডাঙ্গা। আলফ্রেড আনন্দে নির্দেশ দিলেন পাখি দুটো যে দিক থেকে এসেছিল সেই পথে এগোতে। এই নির্দেশে জাহাজের সব কর্মচারী আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করল। প্রফুল্ল চিত্তে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়ালেন আলফ্রেড। এখনও যতদূর চোখ যায় ততদূর বিস্তৃত জলরাশি কিন্তু খুব শীঘ্রই এই নীল পেরিয়ে দেখা মিলবে বাদামী মাটির। সেই নতুন দেশের মাটি স্পর্শ করে সেখানে পর্তুগালের রাজ পতাকা উড়িয়ে দিতে পারলেই আলফ্রেডের সাফল্যের মুকুটে আরেকটি নতুন পালক যুক্ত হবে। মনে মনে মা বাবার মুখটা একবার স্মরণ করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু তখনই কানের কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে বলে উঠল, “এখনও সময় আছে, মায়ার জালে পা দেবেন না।”

চমকে উঠে পাশে তাকাতেই আলফ্রেড দেখতে পেলেন রডরিক চলে যাচ্ছে ভাবলেশহীন মুখে। কথাটা নিশ্চয় ওই শয়তানটাই বলে গেল। দুষ্টটা আসলে চায় কী!

 

ডেক ছেড়ে কল ঘরে চলে এলেন আলফ্রেড। পেড্রো সেখানে কাজ করছিলেন। এই মুহূর্তে পেড্রো ছাড়া কেউ সঠিক পরামর্শ দিতে পারবে না।

“পেড্রো আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

পেড্রো একটু অবাক চোখে তাকালেন আলফ্রেডের দিকে। ইশারায় বুঝলেন আলফ্রেড একান্তে কথা বলতে চায়। আলফ্রেডের অকারণে কাজ ছেড়ে কথা বলার মানুষ নন, নিশ্চয় ব্যাপার খুব গুরুতর। অধস্তনকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন পেড্রো।

“কী ব্যাপার কাপ্তান?”

পেড্রোকে রডরিকের ব্যাপারটা বলে আলফ্রেড বললেন, “লোকটার উদ্দেশ্য কিছু বুঝতে পারছেন? ডাঙ্গার সন্ধান পাওয়ার পরেও লোকটা এসে আমাকে এরকম করে ভয় দেখাচ্ছে! কিন্তু কেন? ওর উদ্দেশ্য কী?”

“বুঝতে পারছি না। আমার শুরুর থেকেই মনটা কু গাইছিল, এরকম একটা লোককে রাজামশাই কেন যে আমাদের সঙ্গে দিলেন!”

“লোকটা মিস নিনাকে সত্যিই খুন করেছিল?”

“আমার সঠিক জানা নেই কাপ্তান। সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই আমার কাছে ধোঁয়াশা। তবুও বলার চেষ্টা করছি। আপনি হয়তো জানেন না রডরিক তার প্রথম জীবনে জাহাজে কাজ করত। চমৎকার গানের গলা ছিল তার। মিস নিনা, আমাদের মন্ত্রী সভার সদস্য মিগুয়েল পেরিয়ারের একমাত্র কন্যা, তখন কিশোরী। সমুদ্র যাত্রা কালে একাধিকবার রডরিকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়, তিনি রডরিকের গান শুনে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তার প্রতি। তারপর ভাগ্যের ফেরে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই রডরিক হয়ে ওঠে কুখ্যাত জলদস্যু। কিন্তু তার এই পরিবর্তনও নাকি মিস নিনাকে বিচলিত করতে পারেনি। তারপর তারা গোপনে বিবাহ করে এবং মিস নিনাও স্বামীর সঙ্গিনী হয়ে যাত্রা করেন কুখ্যাত সিগ্রেস জাহাজে।”

“এটা সত্যি?”

“রডরিক তার বিচার সভায় অন্তত তাই বলেছে। কিন্তু মহামান্য মিগুয়েল অভিযোগ করেন রডরিক তাঁর কন্যাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে।”

“এ বিষয়ে রডরিক কী বলেছে?”

“রডরিকের দাবি তারা এবার কিছু জাহাজকে লুঠপাটের উদ্দেশ্যে এগোতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে এক উত্তাল ঝড় এসে সব গোলমাল করে দেয়। উত্তাল সমুদ্র তাদের পশ্চিম দিশায় টেনে নিয়ে এমন এক মায়াপুরীতে গিয়ে ফেলে যেখানে নাকি এক ফোঁটা বাতাস নেই, চারিদিকে শুধু অন্ধকার কুয়াশার চাদর বিছানো। সেই মায়াপুরীতে দিন রাতের পার্থক্য বোঝার উপায় নেই।”

পেড্রোর বর্ণনা শুনে চমকে উঠলেন আলফ্রেড, মনে পড়ে গেল আজ সকালের স্বপ্নটা। কিন্তু আলফ্রেডের এই সাময়িক পরিবর্তন লক্ষ্য না করে বলে যেতে থাকলেন পেড্রো, “আর সেই অন্ধকারের সুযোগেই মায়া প্রাণীরা নাকি আক্রমণ করে ওদের। সিগ্রেস ভেঙ্গে যায়। রডরিক আর দু একজন সঙ্গীসাথী কোনো মতে প্রাণে বাঁচিয়ে পালাতে পারে ওই ভাঙ্গা সিগ্রেসকে নিয়ে কিন্তু মিস নিনা সহ বাকিরা ওই মায়াপুরীতেই আটকে রয়ে যায়।”

“গাঁজাখুরি গল্প।”

“মজার কথা কী জানেন কাপ্তান? রডরিকদের যখন উদ্ধার করে আফন্স গ্রামের বাসিন্দারা তখন সিগ্রেস প্রায় ভেঙ্গে চুরমার, কী করে তট অবধি পৌঁছাল সেটাই বিস্ময়ের। আর সিগ্রেসের যাত্রীরা কেউ অচৈতন্য তো কেউ উন্মাদ। কয়েকজন ওই গ্রামেই মারা যায় আর বাকিদের গ্রেপ্তার করে রাজধানীতে আনে সেনারা।”

“আর রডরিক?”

“সেও প্রায় উন্মাদই হয়ে গিয়েছিল বলা যায়, মিস নিনার নাম ধরে চিৎকার করত। আমিও দেখেছি বিচারসভায় তাকে চিৎকার করতে। কিন্তু মহামান্য মিগুয়েল বলেন এগুলি সবই নাকি তার অভিনয়। হয়তো তাই হবে। রডরিক আজীবন কারাবাসের সাজা পায়।”

“সবই তো বুঝলাম কিন্তু রাজামশাই হঠাৎ এই লোকটাকে জেল থেকে বের করে আমাদের সঙ্গে দিতে গেলেন কেন? ওই এই পথে আগেও এসেছে বলে? কিন্তু ওর আগমনে কোনো সুরাহা হওয়ার বদলে সমস্যাই তো বাড়ছে।”

“আমি আপনার সাথে সহমত কিন্তু রাজামশাইয়ের খেয়াল, আর তাঁর ইচ্ছের ওপর কে কথা বলবে!”

“হুমম। কিন্তু পেড্রো আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। ডাঙ্গায় না পৌঁছানো অবধি লোকটাকে নজরে নজরে রাখতে হবে।”

মাথা নেড়ে স্মমতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালেন পেড্রো। আলফ্রেডও ডেকে যাওয়ার জন্য উঠলেন কিন্তু তখনই প্রচণ্ড জোরে কেঁপে উঠল জাহাজটা; পেড্রো আলফ্রেডের ওপর উল্টে পড়লেন। আলফ্রেড কোনো মতে সামলালেন নিজেকে।

“কী হল বলুন তো পেড্রো?” বিস্ময়ে জানতে চাইলেন আলফ্রেড কিন্তু পেড্রো কোনো জাবাব দেওয়ার আগেই জাহাজটা আবার নড়ে উঠল অদ্ভুত ভাবে, সেই সঙ্গে বাইরে থেকে ভেসে এলো মানুষজনের কোলাহল। অবাক বিস্ময়ে আলফ্রেড আর পেড্রো ছুটলেন ডেকের দিকে। জাহাজ তখন প্রচণ্ড জোরে দুলছে।

 

এ কী অবস্থা ডেকের! সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ যেন এক বিচিত্র নৃত্যে মগ্ন, তারা নৃত্যের তালে লাফিয়ে উঠে ধুইয়ে দিচ্ছে ডেকের পাটাতন। মাথার ওপর আকাশে এক বিশাল কালো মেঘ দৈত্যের মত ধীরে ধীরে নেমে আসছে নীচে, এক্ষুনি যেন সব গিলে নিতে প্রস্তুত। সকলেই হতভম্ব, সকালের সেই সোনালি দিন এমন আচমকা রূপ পরিবর্তন করে ফেলল কেমন করে!

পাল তোলো শিগগির... দড়ি ছাড়... আলফ্রেড আর পেড্রো প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে লাগলেন। কিন্তু সব করেও কী শেষ রক্ষা হবে! প্রকৃতি যেন আজ অদ্ভুত এক ধ্বংসের খেলা শুরু করেছে... প্রচণ্ড ঝড়ের সঙ্গে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল... সেই সাথে মুহুর্মুহু বজ্রপাত। সমুদ্র যেন ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় গর্জন করছে আজ, বৃষ্টির ফোঁটা শলাকার মত এসে বিঁধছে শরীরে। হাওয়ার দাপটে আলো জ্বেলে কাজ করা মুশকিল, তবুও কোনোক্রমে সুরক্ষার সব ব্যবস্থা করা গেল। জাহাজের মানুষদের কোলাহল শান্ত হল খানিক কিন্তু প্রকৃতির উদ্দামতা যেন আরও বেড়েই চলল।

“আমার কথাটা শুনলে আজ এতগুলো মানুষকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হত না।”

নিজের কেবিনের দিকে সেই সবে পা বাড়িয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আলফ্রেড, আচমকা কথাগুলো যেন বিষাক্ত শেলের মত এসে বিঁধল কানে। ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে পাশে তাকালেন তিনি। মুহূর্তের বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখলেন ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে যাওয়া রডরিকের চোখ দুটো আজ যেন ভাঁটার মত জ্বলছে।

“শুনেছিলাম তুমি নাকি সমুদ্রের সম্রাট বলো নিজেকে, তা এই সামান্য ঝড়েই ঘাবড়ে গেলে!” কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না আলফ্রেড। ইচ্ছে হচ্ছিল লোকটার মুখের ওপর আঘাত করেন সরাসরি কিন্তু তা না করে নিজের কেবিনে ফিরে এলেন তিনি। গোটা শরীর থেকে জল ঝরছে,দ্রুত পোশাক পাল্টে ফেললেন আলফ্রেড। মুছে ফেললেন শরীরের সব জল, কিন্তু মনের দ্বন্দ্বটা কিছুতেই মুছে ফেলতে পারলেন না। রডরিককে বাইরে যাই বলে আসুন না কেন, তাঁর নিজেরই ভীষণ অচেনা লাগছে এই আকস্মিক দুর্যোগ। একটা রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন কেমন করে এভাবে বিনা সংকেতে তার রূপ পাল্টে ফেলতে পারে তা আলফ্রেডের অভিজ্ঞতায় অজানা। আচ্ছা রডরিক নাকি বিচার সভায় বলেছিল তারা এক অদ্ভুত দুর্যোগের মুখে পড়ে দিশা হারায়! তবে কি লোকটা এমনই ঝড়ের কথা বলেছিল! কথাটা মনে হতেই গা’টা শিরশির করে উঠল আলফ্রেডের, পা’দুটো আলগা হয়ে গেল। জাহাজটা প্রচণ্ড জোরে কাঁপছিল, টাল সামলাতে না পেরে আলফ্রেড এলিয়ে পড়লেন বিছানায়।

বাইরের গর্জন আর জাহাজের কাঁপুনি ক্রমে বেড়েই চলল, সেই সঙ্গে ভারি হয়ে এলো ক্যাপ্টেন আলফ্রেডের মাথা। আজ রাত্রেই কি তবে সব শেষ! ওই পাল আর কতক্ষণ যুঝবে এই ভয়ঙ্কর ঝড়ের সম্মুখে!

***

চোখ খুললেন আলফ্রেড। এক অদ্ভুত রকমের নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে চারিদিকে। সকাল কি হয়ে গিয়েছে! আর সেই ঝড়, সেই ভয়ঙ্কর ঝড় থেমে গেল! আশ্চর্য! উঠে বসলেন আলফ্রেড। কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন কে জানে! ভীষণ লজ্জা করছে তার, কাল রাতে জাহাজের সবাই নিশ্চয় উৎকণ্ঠায় বিনিদ্র রাত্রি যাপন করেছে, আর তিনি কিনা ক্যাপ্টেন হয়ে এমন ঘুমলেন যে টেরই পেলেন না কখন ঝড় থেমে সব কিছু শান্ত হয়ে গেল। আলফ্রেড তাড়াতাড়ি বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আর দাঁড়াতেই টের পেলেন জাহাজ চলছে না। কিন্তু কেন?

ডেকের ওপর এসেই হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি। ডেকের ওপর কয়েকজন কর্মচারী হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে, ভেজা মেঝের জল যে তাদের শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে সেদিকে কোনো হুঁশই নেই। কী হল ওদের! আর একী! চারিদিকটা কেমন অন্ধকার কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে, এতটাই গাঢ় সে কুয়াশা যে সমুদ্রের জল থেকে আকাশ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এক ফোঁটা বাতাস বইছে না এখানে, তাই জাহাজটা স্থির হয়ে আছে। বাতাস না দিলেও একটা শিরশিরে অনুভুতি হচ্ছে শরীরে।

“কাপ্তান!”

পেছন থেকে পেড্রোর গলা শুনে ঘুরে তাকালেন আলফ্রেড। পেড্রোর চোখ তখনও তন্দ্রালু। তিনি লজ্জিত কণ্ঠে বলল, “আপনি কি সারারাত জেগে ছিলেন কাপ্তান? দুর্যোগ কখন থামল? আমায় ক্ষমা করবেন, আমি...”

“পেড্রো”, হাত তুলে পেড্রোকে থামিয়ে দিয়ে আলফ্রেড বললেন, “আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ যে ক’বছর জাহাজে কাজ করছি এমন ভয়ঙ্কর ঘুম ঘুমিয়েছি বলে মনে পড়ে না। কখন ঝড় থেমেছে টেরই পাইনি।”

আলফ্রেডকে জবাব দেওয়ার আগেই পেড্রো চেঁচিয়ে উঠলেন, “এ কী এরা এভাবে কেন!” তাঁর নজর গিয়েছে ডেকের ওপর শুয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলফ্রেড বললেন, “কিচ্ছু বুঝতে পারছি না পেড্রো। কাল ঝড় আমাদের কোন দিশায় নিয়ে এসেছে বোঝার উপায় নেই। কী অদ্ভুত কুয়াশা। জায়গাটাও কেমন যেন আর আপনি আমি আমরা সবাই কালকের ওই দুর্যোগেও অমন ঘুমিয়ে পড়লাম কী করে!”

“কাপ্তান... কাপ্তান কী হয়েছে? এ আমরা কোথায়?” চিৎকার করতে করতে এগিয়ে এলো স্যান্তিয়াগো। তার পেছনে আরও কয়েকজন। সবার চোখে মুখে ঘুমের ভাব স্পষ্ট। আলফ্রেড জবাব দেওয়ার আগেই একজন বলে উঠল, “এ কেমন কুয়াশা! এমন তো কোনোদিনও দেখিনি! তাহলে কি এই কুয়াশার কথাই রডরিক বলছিল? আমরা কি সেই মায়ার দেশে পৌঁছে গেলাম!” লোকটার কথা শেষ হওয়া মাত্রই বাকিদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিল, সবাই চোখ মুখ মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে এলো। এমনকি আলফ্রেড আর পেড্রোও চমকে উঠে পরস্পরের মুখের দিকে চাইলেন। তারপর পেড্রো চোখের ইশারায় আলফ্রেডকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিয়ে লোকটাকে ধমকে উঠলেন, “চুপ করো, যত সব বাজে চিন্তা তোমাদের। বেলা হতে দাও, সূর্য উঠলেই কুয়াশা কেটে যাবে।” কথাগুলো পেড্রো বললেন বটে কিন্তু তাঁর নিজের গলাতে নিজেই যেন অবিশ্বাসের ছোঁয়া পেলেন। এই রকম কুয়াশার ঘন চাদর ভেদ করে সূর্যালোকও আদৌ পৌঁছাতে পারবে তাদের কাছে!

 

মুহূর্ত পেরোচ্ছে একটু একটু করে কিন্তু সময় মাপার উপায় নেই। জাহাজের ডেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে সব কর্মচারীরা, আজ আর তাদের কোথাও যাওয়ার নেই কোনো কাজ করার নেই। যেন এক আদি অনন্তকালের অপেক্ষায় বসে তারা। প্রত্যেকের চোখে মুখে আতঙ্ক, উদ্বিগ্নতা। সূর্য উঠছে না, কুয়াশা সরছে না। বাতাসও নেই এক ফোঁটাও।

“কাপ্তান এবার?” ভীতসন্ত্রস্ত গলায় প্রশ্ন করল স্যান্তিয়াগো। আলফ্রেড শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন তার দিকে, উত্তর দিতে পারলেন না।

“কাপ্তান আপনি কি খেয়াল করেছেন সকাল থেকে রডরিগকে দেখা যায়নি?” আলফ্রেডের কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বললেন পেড্রো, চমকে উঠলেন আলফ্রেড। সত্যিই তো, লোকটা গেল কোথায়! স্যান্তিয়াগোর দিকে ঘুরে প্রশ্নটা সবে করতে যাবেন আলফ্রেড এমন সময় কোথাও থেকে একটা পাখির সুরেলা কণ্ঠ ভেসে এলো। জাহাজের সবাই চঞ্চল হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। এই ঘন কুয়াশার মধ্যে পাখির ডাক কোথার থেকে আসছে! রিও নামের এক কর্মচারীর হঠাৎ নজর গেল জাহাজের পালের দিকে। দুটি পাখি পালের ওপর পিঠোপিঠি বসে। কিন্তু পাখিরা এমন ভাবে তো কখনও বসে না! ব্যাপারটা একটু অবাক করার মত কিন্তু তাও পাখিদুটির মিষ্টি গলার জ্ঞান অনেকক্ষণ পর যেন একটুকু ভালবাসার আবেশ নিয়ে এলো জাহাজে। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একফোঁটা হাসি ফুটে উঠল আলফ্রেডের। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে। কাল যে দুটি পাখি তাঁদের মনে আশার আলো এনেছিল, এরা কি তারাই! নিজের মনেই প্রশ্নটা করেছিলেন আলফ্রেড, আর তখনই পেড্রো তাকে ফিসফিস করে ডেকে উঠলেন, “কাপ্তান, রডরিগ...”

আলফ্রেড তাকিয়ে দেখলেন ডেকে এসেছে রডরিগ। তার চোখ ইতিউতি খুঁজছে কাউকে। খুঁজতে খুঁজতেই রডরিগ দেখতে পেল আলফ্রেড আর পেড্রোকে। সে দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে এলো তাদের দিকে, তারপর চাপা গলায় বলল, “ওদের গান শুনবেন না কাপ্তান, বাকিদেরও যে যার কাজে নির্দেশ দিন। যাদের গান শুনে মুগ্ধ হচ্ছে সবাই তারা আসলে... তারা আসলে... আপনি দয়া করে সবাইকে কাজে ফিরে যেতে বলুন, আপনারাও যান। শুনতে হবে না এই শয়তানদের গান।”

এই প্রথমবারের জন্য রডরিগের ওপর রাগতে পারলেন না আলফ্রেড। রডরিগের চোখমুখ, তার গলার স্বরে যেন সত্যিই এক আশঙ্কার ছাপ। কোনো উত্তর ভেবে ওঠার আগেই রডরিগ আবার বলে উঠল, “আর... আর আপনি সকলকে নির্দেশ দিন সমুদ্রের বুকে যা কিছু দেখতে পাক না কেন, যেই ওদের ডাকুক না কেন ওরা যেন সাড়া না দেয়।”

“এই সমুদ্রের বুকে কে কাকে ডাকবে রডরিগ? আর এই কুয়াশার মধ্যে সমুদ্রের বুকে কিইবা দেখা যাবে?” প্রশ্ন করলেন পেড্রো।

“আপনারা জানেন না, ওরা সব পারে... সব...”

এই মুহূর্তে কেন না জানি রডরিগের কথাগুলোর প্রতিবাদ করতে পারলেন না আলফ্রেড। যদিও সরাসরি রডরিগকে কিছু বললেন না তিনি কিন্তু কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন যে যার কাজে ফিরে যেতে।

***

সূর্য আসেনি কুয়াশা মুক্ত করতে। অন্ধকার এই চাদরে দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। তবুও মনে মনে কষা সময়ের হিসেব বলছে রাত নেমেছে। সারাদিনের উত্তেজনা, আশঙ্কা শেষে ক্লান্তিতে সবাই আশ্রয় নিয়েছে যে যার কক্ষে। আলফ্রেড শরীরটা শয্যায় এলিয়ে দিয়ে এক মনে চিন্তা করছিলেন কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় এই পরিস্থিতি থেকে। এমন পরিস্থিতি তাঁর জীবনে আগে কখনও আসেনি, এখন কি শুধু ভাগ্যের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে নাকি কিছু চেষ্টা করা যেতে পারে! সুস্থির মস্তিষ্কে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলেন না আলফ্রেড। এমন সময় আচমকা কক্ষের দরজায় করাঘাতের শব্দ হতেই সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি । শয্যা থেকে নেমে দরজা খুলতেই দেখলেন নজরদার ডিকো দাঁড়িয়ে, হাঁফাচ্ছে সে।

“কী হয়েছে ডিকো?” উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলেন অ্যালফ্রেড।

ডিকো হাঁফাতে হাঁফাতে জবাব দিল, “আমরা নিশ্চয় কোনো স্থলভাগের কাছে আটকে রয়েছি, আমি এই মাত্র সমুদ্রে এক নারীকে সাঁতার কাটতে দেখলাম।”

“কী বলছো কি ডিকো! তুমি ঠিক দেখেছো?”

“হাঁ কাপ্তান।”

আলফ্রেড ছুটে গেলেন ডেকে, জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়ালেন― সামনে শুধু কালচে জমাট বাঁধা কুয়াশা। কুয়াশায় ঢেকে আছে চারিদিক ঠিক আগের মতই কিন্তু তবুও কোথাও না কোথাও আলফ্রেডের মনে হল আগের সেই দুর্ভেদ্যতা একটু হলেও যেন হালকা হয়েছে। ডিকোর ডাকেই বোধহয় পেড্রোসহ আরও কয়েকজন ছুটে এলো ডেকে, রেলিং ধরে কুয়াশার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে সবাই সমুদ্রের বুকে খুঁজে পেতে চাইল মানুষের গন্ধ।

“কাপ্তান ওই দেখুন...” এক কর্মচারীর ডাকে তার দিকে ছুটে গেলেন আলফ্রেড সহ বাকি সকলে। তার আঙ্গুলের ইশারা লক্ষ্য করে সকলে সমুদ্রের দিকে তাকাল।

“এ তো কোনো শৈল মনে হচ্ছে!” বিড়বিড় করলেন আলফ্রেড।

“হাঁ কাপ্তান, আমার মনে হয় ডিকো এই শৈলের শিখর দেখেই বিভ্রান্ত হয়েছে।” বললেন পেড্রো। বাকিরাও তাঁর মতকে সমর্থন করল। ডিকো ঠিক যেন মানতে পারছিল না তার কোনো ভুল হয়েছে বলে, কিন্তু বাকিদের মতের বিরুদ্ধে আর কিছু বলতে সাহস করল না সে।

 

একরাশ চিন্তার মাঝেই কখন যেন ঘুম ধরে গিয়েছিল আলফ্রেডের। ঘুম ভাঙল সমবেত কোলাহলের শব্দে। ধড়ফড় করে উঠে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। দেখলেন ডেকে জাহাজের প্রায় সব কর্মচারী জড়ো হয়েছে― তারা উত্তেজিত ভাবে দাঁড়িয়ে সবাই, রডরিগ তাদেরকে কিছু বোঝাতে ব্যাস্ত। কিন্তু তারা শুনতে রাজি নয়।

“কী হচ্ছে এসব?” এগিয়ে গেলেন আলফ্রেড।

“কাপ্তান দেখুন সামনে চেয়ে।” বলল স্যান্তিয়াগো। আলফ্রেড সামনে তাকিয়েই অবাক হলেন, কুয়াশার জট যেন সহসাই আলগা হয়ে গেছে অনেকটা। সামনে দেখা যাচ্ছে ছোট বড় বেশ কয়েকটা ডুবো পাহাড়ের চূড়া, সেসব পেরিয়ে আরেকটু দৃষ্টি নিয়ে গেলেই সমুদ্রের জলে দাঁড়িয়ে আছে এক সুবিশাল পাথরের তোরণ― খানিক ক্ষয়ে গেছে, অনেকখানি জুড়ে শ্যাওলার প্রলেপ পড়েছে তবুও যেন মনে তোরণখানি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তাদের সম্ভাষণ করছে। আকাশ এখনও সমুদ্রের বুকে মিশে, সূর্যের দেখা নেই, তবুও চারিদিকে এক নরম মোহময়ী রুপালি আলো ছড়িয়ে আছে। নীল সাদার মাঝেই বাদামী পাহাড়গুলো যেন নতুন করে জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

“এই তোরণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি বলে ঠিক মনে হচ্ছে না, যদি কোনো মানুষের সৃষ্টি হয় তাহলে ওপারে নিশ্চয় কোনো দেশ আছে।” মন্তব্য করলেন আলফ্রেড। পেড্রো সম্মতি জানালেন। আলফ্রেড নির্দেশ দিলেন, “নৌকা প্রস্তুত করো, ওই তোরণ পেরিয়ে যাবো আমরা।”

দৌড়ে এলো রডরিগ, “এরা কেউ আমার কথা মানছে না, আপনি তো গোড়া থেকেই আমাকে বিশ্বাস করেননি কিন্তু একটিবার আমার কথা শুনুন। সেবার আমরা ঠিক একই রকম ঝড়ে পড়েছিলাম, একই রকম ভাবে আমাদের জাহাজ ঝড়ের টানে কোথায় গিয়ে আটকে পড়েছিল জানি না, স্পষ্ট করে সে কথা মনেও পড়ে না। শুধু মনে পড়ে সে ছিল এক মায়ার রাজ্য। অদ্ভুত এক ঘোরে আছন্ন হয়ে পড়েছিলাম আমরা সবাই। তারপর কী যেন একটা হল, কারা যেন এসে ডাক দিল। একের পর এক আমাদের সঙ্গীরা ঝাঁপ দিতে থাকল জলে, তারপর... তারপর...”

“এর কথা শুনে সময় নষ্ট করা উচিত হবে না কাপ্তান, হয় এর সত্যিকারের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে নয়তো স্ত্রীকে খুন করার পর এসব অভিনয় করছে।” দাঁতে দাঁত চিপে কথাগুলো বললেন পেড্রো। প্রতিবাদ করে উঠল রডরিগ, “মিথ্যে কথা। আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিনি, তাকে ওরা... ওরা নিয়ে চলে গিয়েছিল।”

“কারা?”

“আমার ঠিক মনে নেই কিন্তু ওরা... ওরা খুব ভয়ঙ্কর।”

“আমি জানি না কেন শুরুর থেকে অভিযানে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছ তুমি। তোমার যদি এতই আপত্তি ছিল তুমি এই অভিযানে নাই আসতে পারতে। তুমি যখন সব আগে থেকেই জানতে তখন এলে কেন?” রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করলেন আলফ্রেড।

“কে আসতে ছেয়েছিল? আমি চাইনি, আর তাছাড়া আমাকে বলেওনি যে তোমরা এই পথে আসবে। ওই রাজা... রাজা... আমার তো আর হারানোর কিছু নেই কিন্তু আপনাদের তো পরিবার আছে...”

রডরিগের কথায় আর আমল দিলো না কেউ, আলফ্রেডের নির্দেশে তিনটি নৌকা নামল জলে। জাহাজ ছেড়ে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতেও শুনতে পেলেন রডরিগের চিৎকার, “যাবেন না, যাবেন না ওই মায়াপুরীতে...”

***

ডানা জাহাজ ছেড়ে নৌকা তিনটে একটু একটু করে এগোতে লাগল। সমুদ্রের জল এখানে পুরোপুরি স্থির নয়, একটা খুব ক্ষীণ তরঙ্গ রয়েছে জলে। নৌকা অবশ্য দাঁড় টেনেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রথমের নৌকায় আছেন আলফ্রেড, স্যান্তিয়াগো সহ আরও দুইজন। পরের নৌকায় পেড্রো সহ আরও দুইজন এবং শেষ নৌকায় আরও তিনজন। ডুবো পাহাড়গুলোকে এড়িয়ে খুব সন্তর্পণে নৌকা নিয়ে এগোতে হচ্ছিল। জাহাজ থেকে তোরণটাকে যত কাছে মনে হচ্ছিল এগোতে গিয়ে দেখা গেল ততটাও কাছে নয়। এখানে প্রকৃতির কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। চারিদিকে সাদা কালো কুয়াশা ভেদ করে এগোতে হচ্ছিল ওদের।

আলফ্রেডের মাথায় তখন অনেক রকম চিন্তা― নতুন দেশ আবিষ্কারের উন্মাদনাকে ছাপিয়েও কেন না জানি কর্ণকুহরে বারবার বেজে উঠছিল উন্মাদ রডরিগের সাবধানবাণী। চিরকাল কুখ্যাত হিসাবে পরিচিত রডরিগের চোখমুখে আজ কোথাও না জানি আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠেছিল। কিন্তু কেন? সে কি সেবার সত্যিই কোনো রহস্যময় অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছিল!

“ওই তো... ওই তো...” আচমকা এক সঙ্গীর চিৎকারে চিন্তার জাল ছিন্ন হল আলফ্রেডের।

“কী হল?”

“আমি দেখলাম, আমি দেখতে পেলাম...”

“একটা মেয়ে... আমি দেখলাম, ওই ওইখানটায় ডুব দিয়ে সাঁতরে গেল।” এই বলে লোকটা আঙ্গুল দিয়ে একটা জায়গায় ইশারা করল। আলফ্রেডকে কিছুই বলতে হল না, যারা দাঁড় টানছিল তারা সহসাই গতি বাড়িয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই জাহাজগুলো তোরণ পেরিয়ে প্রবেশ করল এক নতুন দেশে।

“আশ্চর্য!” পেছনের নৌকা থেকে বলে উঠলেন পেড্রো। আলফ্রেডও বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে তাকাতে লাগলেন আশেপাশে। একটা মাত্র তোরণ পেরোতেই প্রকৃতির এমন আশ্চর্য রকমের রূপ পরিবর্তন! পেছন ফিরে একবার তাকালেন আলফ্রেড, তোরণের ওপার আবার গাঢ় কুয়াশায় ঢেকেছে কিন্তু এখানে... এখানে এক মায়াবী নীল আলোক ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। আকাশে গোল থালার মত রুপোলী চাঁদ, চাঁদকে ঘিরে পাক খেয়ে চলেছে তুলোর মত অগুনতি মেঘের রাশি কিন্তু তারা বেহিসেবি নয়। একটিবারের জন্যও চাঁদকে তারা আড়াল হতে দিচ্ছে না। সমুদ্রের বুকে মাথা তুলে রাখা ছোট ছোট পাহাড়গুলোর রূপও এখানে যেন অন্যরকম। তাদের গায়ে গজিয়ে উঠেছে ছোট বড় সামুদ্রিক লতা, লতার কোলে আবার কত রকমের রঙ বাহারি ফুল। নীলচে জ্যোৎস্না তাদের রূপ হয়েছে আরও দেখার মত।

“অপূর্ব!” আপনা থেকেই বলে উঠলেন আলফ্রেড, “কিন্তু স্যান্তিয়াগো আমরা কি সময়ের হিসেব রাখতে এত ভুল করেছিলাম?”

“হু!” স্যান্তিয়াগো মুগ্ধ হয়ে দেখছিল প্রকৃতির বিচিত্র রূপ, আলফ্রেডের প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরল তার, “আমিও সেটাই ভাবছি কাপ্তান। কিন্তু...”

স্যান্তিয়াগো তার কথা শেষ করার আগেই কোথা থেকে যেন একটা সুরেলা কণ্ঠের গান ভেসে এলো―

এমন মায়াবী চাঁদনী রাতে

ওগো প্রিয় আছি তোমার অপেক্ষাতে,

এসো গো এসো বাহুডোরে

মিলে যাবো মোরা এই চরাচরে।

...চমকে উঠল সবাই। এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগল সে গানের উৎস। স্যান্তিয়াগো আলফ্রেডের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এই মাত্র বলতে যাচ্ছিলাম যে তোরণ তো পেরিয়ে গেলাম তবু ডাঙ্গা তো দেখতে পাচ্ছিনা, কিন্তু এই গান শুনে মনে হচ্ছে ডাঙ্গার কাছে এসে গিয়েছি আমরা।”

“ওই দেখুন।” পেড্রোর জাহাজ থেকে চিৎকার করে উঠল একজন। তার ইশারা অনুসরণ করে দৃষ্টি ফেরাতেই বাকি সকলেই দেখতে পেল দৃশ্যটা। একটা তুলনামূলক উঁচু পাথরের চূড়ায় বসে এক নারীমূর্তি, পেছন ফিরে থাকায় তার মুখ দেখার অবকাশ নেই কিন্তু পিঠ ছাপানো বাদামী চুলে চাঁদের আলো পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে, অদ্ভুত লাস্যময়ী ভঙ্গিতে বসে আছে সে। এক মনে গান গেয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, আগন্তুকদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন।

“সাবধানে নৌকাগুলো ওই পাথরের কাছে নিয়ে চলো।” নির্দেশ দিলেন আলফ্রেড। যারা দাঁড় বাইছিল তারা দ্রুততার সঙ্গে নৌকার মুখ ঘোরালো।

তিনটে নৌকা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পাথরটার কাছে পৌঁছে গেল। মেয়েটা তখনও গান গেয়ে যাচ্ছে, সুরের মূর্ছনায় এতটাই বিভোর সে যে তার এত কাছে মানুষের অস্তিত্ব টেরই পাচ্ছে না। মেয়েটার মুখটা এখনও দেখা যাচ্ছে না। আলফ্রেড নির্দেশ দিলে নৌকা ঘুরিয়ে মেয়েটার সামনের দিকে যেতে। জলে আবার দাঁড় পড়ল ছপাৎ করে। নৌকা তিনটে পাক খেয়ে খানিকটা যেতেই আলফ্রেডের একজন সঙ্গী আঁক করে চিৎকার করে উঠল, তার হাত থেকে দাঁড় খসে পড়ল জলে। বাকিদের শরীরও কেঁপে উঠল...

আকাশের বুকে কত ফুটে আছে তারা

এসো এই জোছনায় ভেসে যাই মোরা।।

...শেষ হল গান। চাঁদের আলোয় নৌকার যাত্রীরা দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য― তাদের সামনে বসে এক বিচিত্র প্রাণী, যার নাম এতদিন গল্পকথাতেই শুনেছিল সেই অর্ধ মানবী অর্ধ মীন বসে তাদের সামনে। তার শরীরের সোনালী সবুজ আঁশ চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে। মৎস্যকন্যা ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল নৌকাগুলোর দিকে। তার নীল চোখের তারার দিকে দৃষ্টি পড়তে ক্ষণিকের জন্য যেন মোহিত হয়ে গেল সকলে, সে শুধুই দুটি চোখ নয় যেন আরও এক গভীর সমুদ্র যেখানে একবার ডুব দিতে পারলেই প্রশান্তি। ধীরে ধীরে তার রক্তিম ঠোঁটের কোণে এক বিচিত্র হাসি খেলে গেল। আলফ্রেডরা অনুভব করতে পারলেন কেউ বা কারা যেন ধীরে ধীরে চাপ দিচ্ছে তাদের নৌকায়। আরও একবার চমকে উঠে মৎস্যকন্যার থেকে চোখ ফিরিয়ে নৌকার দিকে তাকালেন আলফ্রেড, দেখলেন তাদের নৌকাগুলোকে ঘিরে ধীরে ধীরে পাক খাচ্ছে আরও বেশ কয়েকজন মৎস্যকন্যা। ওই পাথরের ওপরে যে বসে সে তাহলে একা নয়, ওরা সংখ্যায় আরও আছে!

“জোয়ানা...!” আচমকা চিৎকার করে উঠে পেছনের নৌকা থেকে সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিল একজন। চমকে উঠল সকলে।”

“একি ব্রুনোর কী হল?” চিৎকার করে জানতে চাইলেন আলফ্রেড।

“জা... জানি না। তবে জোয়ানা তো ওর স্ত্রী এর নাম, সেতো মারা গিয়েছে বছর তিনেক আগে।” উত্তর দিল ব্রুনোর নৌকার সঙ্গী জুকো। ব্রুনোর অদ্ভুত আচরণের বিস্ময় কাটতে না কাটতেই আরও এক আকস্মিক ঘটনা ঘটল।

“মোরা...! তুই বেঁচে আছিস? আমি আসছি তোর কাছে।” এই বলে জলে ঝাঁপ দিল আলফ্রেডের নৌকার সঙ্গী কার্লোস। ব্রুনোদের নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকা আলফ্রেড কিছু করার আগেই প্রচণ্ড দ্রুততার সঙ্গে ঝাঁপ দিল কার্লোস। আলফ্রেড আর্তনাদ করে উঠলেন, “এসব কী হচ্ছে পেড্রো!” জবাব দিলেন না পেড্রো, তাঁর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে জলের দিকে, বা বলা ভালো এক মৎস্যকন্যার দিকে। আলফ্রেডের বুকটা কেঁপে উঠল, পেড্রোও কী তবে...!

“পেড্রো...পেড্রো... আপনি শুনতে...” আলফ্রেডের কথা শেষ হওয়ার আগেই জড়ানো গলায় পেড্রো বলে উঠলেন, “এ কী করে সম্ভব আমি জানি না কাপ্তান কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার কিশোরবেলার প্রেমিকা মারিয়ানা আমাকে ডাকছে, ওই দেখুন...” আঙ্গুলটা সামনের দিকে তুলে কিছু দেখাতে দেখাতেই জলে পড়ে গেলেন পেড্রো। আর তারই সঙ্গে আলফ্রেডের নৌকার আরেক সঙ্গী ঝাঁপ দিল জলে।

“কা... কাপ্তান... এ... এসব কী হচ্ছে?” ভীত সন্ত্রস্ত গলায় প্রশ্ন করল স্যান্তিয়াগো। আলফ্রেডের কাছে উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। তিনিও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন স্যান্তিয়াগোর দিকে। আর তখনই তাদের নৌকাটা কেঁপে উঠল প্রচণ্ড জোরে। মনে হল যেন জলের তলা থেকে কেউ ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে নৌকার ওপর। কোনোমতে দাঁড় চেপে ধরে নৌকাটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে লাগলেন আলফ্রেড আর স্যান্তিয়াগো।

এমন মায়াবী চাঁদনী রাতে

ও প্রিয় আছি তোমার অপেক্ষাতে,

এসো গো এসো বাহুডোরে

মিলে যাবো মোরা এই চরাচরে।।

...আবার ভেসে এলো গান। পাথরের ওপরটা ফাঁকা, সেই মৎস্যকন্যা কখন যেন ঝাঁপ দিয়েছে জলে। গান এখন ভেসে আসছে চারিদিক থেকে, তার উৎস বোঝা দায়। গানের মূর্ছনা যেন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে সকলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আলফ্রেড স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তার হাত আলগা হয়ে আসছে। তবুও নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করে দাঁড়টা চেপে ধরতে চাহিলেন তিনি কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। স্যান্তিয়াগোর হাত থেকে দাঁড়টা খসে পড়ল জলে, উল্টে পড়ল নৌকাটাই। একাধিক মানুষের জলে পড়ার শব্দ ছাপিয়ে গেল মৎস্যকন্যার মোহময়ী সঙ্গীতকে। আলফ্রেড বুঝলেন বাকি নৌকাগুলোও একই ভাবে উল্টে পড়েছে। জলের মধ্যেই কেউ যেন এসে ধরল তার হাত। হাতের ওপর নরম স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকালেন আলফ্রেড। সমুদ্রের বুক চিরে আসা চাঁদনী আলোয় দেখতে পেলেন তার হাত ধরে এক অপরূপা মৎস্যকন্যা, তার বাদামী চুল রেশমের মত ছড়িয়ে পড়েছে জলে। তার সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে জীবনে প্রথমবার আলফ্রেডের পুরুষ হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠল। কারণ অকারণ, যুক্তি তর্কের সমস্ত হিসেব ভুলে আলফ্রেডের ইচ্ছে করল ওই কন্যার হাত ধরে ভেসে যায় এই অনন্ত নীলে...

***

একটা নেশার ঘোরে যেন এতটা পথ সাঁতরে এসেছিলেন আলফ্রেড। শক্ত জমিতে শরীর ঠেকতেই খানিকটা সম্বিৎ ফিরল তার। ভূমিখণ্ড! স্বর্ণভূমির সন্ধানে বেরিয়ে এ কোন ভূখণ্ডে এসে পৌঁছালেন তিনি! যতদূর চোখ যায় কিছু বুনো ঝোপ আর গুহা নজরে পড়ছে। কোনো মানুষজন নেই, কেউ নেই। গল্পের মৎস্যকন্যারা তবে কি এখানেই থাকে!

“কাপ্তান!” আচমকা পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠতেই ঘুরে তাকালেন আলফ্রেড। দেখলেন তারই এক সঙ্গী লিও দাঁড়িয়ে, “কাপ্তান এ আমরা কোথায় এলাম? আর সেই বা কোথায় গেল?”

“কে?” উত্তরটা জেনেও প্রশ্ন করলেন আলফ্রেড।

“যে আমাকে এখানে নিয়ে এলো।” লিওর গলায় আকুতি। আলফ্রেড বুঝতে পারছিলেন মুখে না প্রকাশ করলেও সেই মৎস্যকন্যাকে দেখার জন্য তার বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এখন হয়তো তার উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত, চিন্তান্বিত হওয়া উচিত কিন্তু এসব কিছুই যেন তার মাথায় আসছে না। একটা অন্যরকম অনুভূতি তাকে জড়িয়ে রেখেছে তার জালে—একটা ভয় মেশানো ভালো লাগা, সেই মৎস্যকন্যাকে পুনরায় দেখার আকুল ইচ্ছা।

এমন মায়াবী চাঁদনী রাতে

ও প্রিয় আছি তোমার অপেক্ষাতে,

এসো গো এসো বাহুডোরে

মিলে যাবো মোরা এই চরাচরে।।

আবার ভেসে এলো গান। চমকে উঠলেন আলফ্রেড। কোথায় সে... কোথা থেকে আসছে এই গান! লিওর কথা বিস্মৃত হয়ে গান শুনে এগোতে লাগলেন আলফ্রেড। ওই গুহার যত কাছে এগোচ্ছিলেন আলফ্রেড ততই গানের তীব্রতা বাড়ছিল। উন্মাদের মত ছুটে গুহার মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন আলফ্রেড। গুহার ভেতর অন্ধকার, তবুও গান ভেসে আসছে সেই আগের মতই। অন্ধকারের মধ্যেই ঠোক্কর খেতে খেতে প্রায় ছুটে চললেন তিনি... পায়ের তলায় কোনো চ্যাটচ্যাটে তরল এসে লাগল, ভ্রুক্ষেপ না করে এগোতে থাকলেন আলফ্রেড। অন্ধকার শেষ হল... আলফ্রেডের পা ধাক্কা খেলো কোনো কিছুতে। মাটির দিকে তাকিয়েই আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠলেন আলফ্রেড, “ব্রুনো!” ব্রুনোর ধড় বিহীন মুণ্ডুটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তার থেকে বেরিয়ে আসছে টাটকা রক্ত। নীচের মাটিটা রক্তে লাল, এ কোনো একজন মানুষের রক্ত হতে পারে না। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও অনেক মানুষের মাথার খুলি, কঙ্কাল... বিস্ময়ে আতঙ্কে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলেন আলফ্রেড। গুহার ভেতরেই এক বিস্তৃত জমিতে বসে আছে অদ্ভুত দর্শন কয়েকটা প্রাণী―সারা শরীর পাঁশুটে বর্ণের লোম দ্বারা আচ্ছাদিত, মাংসাশী পশুর ন্যায় তীক্ষ্ণ নখর । সেই নখর দিয়েই তারা ছিঁড়ে খাচ্ছে একটি মানুষকে। মানুষটিকে চিনতে ভুল হল না আলফ্রেডের, কিচ্ছুক্ষণ আগেও নৌকায় সঙ্গী ছিল তারা। আলফ্রেডের হাত পা কাঁপতে শুরু করল, পেছন ফিরে ছুটতে গিয়ে টের পেলেন পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে সেই মায়াবিনী যার হাত ধরে এই শয়তানের ভূমিতে এসে পড়েছেন তিনি। সেই মায়াবিনী এখন মানুষের মতই দুই পায়ে দাঁড়িয়ে। সে একটু একটু এগিয়ে আসছে আলফ্রেডের দিকে... আলফ্রেড আবার পেছাতে লাগলেন এক ...দুই পা... পেছতে পেছতে সহসাই ধাক্কা খেলেন কারুর সঙ্গে। ভয়ে ভয়ে ঘাড় ঘোরালেন তিনি। সেই অদ্ভুত দর্শন প্রাণীদের একজন দাঁড়িয়ে ঠিক তার পেছনেই। আলফ্রেডকে ঘুরতে দেখে হাঁ করল সে, ধরালো দাঁত গুলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। তরোয়ালের মত উন্মত্ত নখরযুক্ত হাত তুলে সে থাবা বসাতে গেল আলফ্রেডের মুখে কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে কেউ যেন আঘাত করল প্রাণীটাকে, একটা সবজেটে তরল ছড়িয়ে পড়ল তার শরীর থেকে। পেছন থেকে ভেসে এলো সেই মৎস্যকন্যার তীক্ষ্ণ স্বরের বিলাপ। কিন্তু পেছন ফিরতে পারলেন না আলফ্রেড, তার সামনে ওই দৈত্যের শরীর থেকে বের হওয়া তরলে মাখামাখি হয়ে দাঁড়িয়ে রডরিগ, উন্মত্ত তরবারি তার হাতে।

“রডরিগ!” অস্ফুটে কথাটা উচ্চারণ করেই আলফ্রেড দেখলেন একটা দৈত্য রডরিগকে আঘাত করতে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে আলফ্রেডের মনে পড়ে গেল তার নিজের কোমরবন্ধনীতে আটকে রাখা তরোয়ালটার কথা। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্র হাতে তরোয়ালটা খুলে নিয়েই আঘাত করলেন দৈত্যটাকে। সবুজ তরল বেরিয়ে এলো তার শরীর থেকে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। বাকি দৈত্যগুলো একজোটে ধেয়ে এলো তাদের দিকে। রডরিক আর আলফ্রেড পিঠেপিঠ ঠেকিয়ে প্রস্তুত হলেন লড়াই করার জন্য।

ক্ষিপ্র হাতে তরবারির আঘাতে একটার পর একটা দৈত্যকে আঘাত করতে লাগলেন তারা। ওদের নখের আঘাত এসে পড়তে লাগল দুজনের চোখে মুখে। তবুও লড়াই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে গুহার আরেকদিকের মুখের বাইরে থেকে অদ্ভুত রকমের দানবীয় গর্জন ভেসে এলো। আলফ্রেড চমকে উঠলেন। এতক্ষণে মুখ খুলল রডরিগ, “পালান কাপ্তান, পালান। ওই দক্ষিণ দিকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যান, সমুদ্রের বুকে নৌকাতে অপেক্ষা করছে ওরা। সবাইকে রক্ষা করতে পারলাম না।”

“কিন্তু তুমি...!” বিস্ময়ে জানতে চাইলেন আলফ্রেড।

“আপনারা বিপদে পড়বেন জানতাম বলেই আপনার বারণ সত্ত্বেও আপনাদের অনুসরণ করি। দূর থেকে দেখছিলাম সবটুকু, মনে পড়ে যাচ্ছিল কিছু পুরোনো স্মৃতি। কিন্তু জানতাম ওই সময় আপনাদের আটকানো সম্ভব না। তাই উল্টোদিকের পথে...” রডরিগের কথা শেষ হওয়ার আগেই আরও অনেক দৈত্য একসঙ্গে ঢুকে পড়ল হুড়মুড়িয়ে।

“পালান কাপ্তান, পালান...” চিৎকার করে উঠল রডরিক।

“নাহ তুমিও চলো আমার সঙ্গে।” প্রতিবাদ করলেন আলফ্রেড। একটা দৈত্য এসে ততক্ষণে থাবা বসিয়েছে রডরিগের কাঁধে। এই অবস্থাতেও সে চিৎকার করে বলে উঠল, “ওদের আটকে রাখার জন্য কাউকে চাই আর তাছাড়া আমার পিছুটান এই দ্বীপেই আটকে, আমার নিনা এখানে আছে যে। আপনি পালান কাপ্তান শুধু দেখবেন আর কেউ যেন ভুলেও এ পথে পাড়ি না দেয়...” রডরিকের শেষ কথাটা অস্পষ্ট রয়ে গেল, ধারালো নখের আঘাতে তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো রক্ত।

বুকের ভেতর একটা দলা পাকানো কষ্ট নিয়ে দক্ষিণ মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন আলফ্রেড। তীব্র জ্যোৎস্নার আলোকে দেখতে পেলেন সমুদ্রের বুকে একটা নৌকা দাঁড়িয়ে, কেউ তাকে হাত নেড়ে ডাকছে সেখান থেকে। টলোমলো পায়ে এগিয়ে গিয়ে নৌকায় চড়ে বসলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে জলে দাঁড় পড়ল ছলাৎ করে।

“কাপ্তান আপনি ঠিক আছেন? আপনার শরীর তো ভালই জখম হয়েছে। রডরিক যদি ঠিক সময়ে না আসতো...” পেড্রোর কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল; দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন আলফ্রেড।

***

ডানা জাহাজে চেপে পর্তুগিজ অভিযাত্রীর দল বিধ্বস্ত অবস্থায় শূন্য হাতে ফিরেছিল। কোনো স্বর্ণভূমির সন্ধান তারা পায়নি। ডানা জাহাজের ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ডি সিলভা রাজাকে জানিয়েছিলেন ওই পথে কিছু নেই, শুধু অনন্ত সমুদ্র আর বিপজ্জনক ঝড়ঝঞ্ঝা ছাড়া। সেই সাথে তাদের এক হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীর শেষ ইচ্ছে হিসেবে তিনি রাজাকে এও অনুরোধ করেছিলেন ওই বিপজ্জনক পথে আর যেন কোনদিনও কোনো অভিযাত্রী দলকে না পাঠানো হয়...