অ্যাডভাইসস্কোপ ● শিমুল মন্ডল


 

 

১।।

ক্টোবর মাসের মধ্য দুপুর, একটা বাজে রকমের ভ্যাপসা গরম পড়েছে চারিদিকে। এই দুপুর রোদে প্রফেসর সদবুদ্ধি অ্যাডভাইসস্কোপ নামক তাঁর আবিষ্কৃত নতুন যন্ত্রটা পকেটে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রফেসর সদবুদ্ধি নামটা একটু অদ্ভুত হলেও এটাই তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম। ছোটবেলায় তাঁর বাবা আশা করেছিলেন এই ছেলে বড় হয়ে দেশের ও দশের অশেষ উপকার সাধন করবে, মানুষকে সদবুদ্ধি দান করবে, তা বাবার সেই আশা কিছুটা অবশ্য তিনি পূরণ করেছেন। 

যৌবনে তিনি মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন, ছিলেন বলাটা অবশ্য ঠিক হচ্ছে না, বরং বলা উচিত আছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চমকপ্রদ আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এতকাল বিজ্ঞান চর্চা করতে করতে বাবার ইচ্ছে পূরণের ব্যাপারটা অনেকটা চাপা পড়ে গিয়েছিল এখন এই ষাট বছর বয়সে এসে তাঁর মনে সাধ জেগেছে মানুষকে সদবুদ্ধি দানের। আজকে এই দুপুর রোদে ঘোরার পিছনে সেটাই কারণ, তবে কোনো মানুষকে সদবুদ্ধি দানের ইচ্ছে তাঁর আপাতত নেই।

ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করে বলা যাক। আসলে মানুষকে সদবুদ্ধি দানের চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন সেটার কোনো দরকার নেই। কমবেশি সকলেরই বুদ্ধিসুদ্ধি তাঁর চেয়ে বেশি। প্রথমটায় খানিকটা হতাশ হয়েছিলেন বটে, তবে এরপরই তাঁর মাথায় দারুণ এক আইডিয়া এসে যায়।

তাজমহল রোডের এই মাঠটায় একদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছিলেন, সেদিন মাঠের এক কোণে একটা বেশ বড় মোটাতাজা নধরকান্তি কুকুর শুয়ে থাকতে দেখে তিনি ভাবলেন, মানুষ যখন পেলাম না, তখন এটাকেই খানিক সদবুদ্ধি দিই। সেই ভাবনা থেকে তিনি কুকুরটার কাছে গিয়ে কুকুরটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

―কী রে, কী খবর তোর?

জবাবে কুকুরটা বলল,

―ঘেউ ঘেউ ঘেউ।

প্রফেসর দেখলেন, এ তো ভারি ঝামেলার ব্যাপার। এ ব্যাটাতো তাঁর ভাষা বোঝে না, বা সে বুঝলেও তিনি এর ভাষা বোঝেন না। সেদিনই তাঁর মাথায় এমন এক যন্ত্র বানানোর আইডিয়া আসে যেটা কুকুরের গলায় ঝুলিয়ে দিলে কুকুর তাঁর ভাষা বুঝতে পারবে আর তিনিও কুকুরের ভাষা বুঝতে পারবেন। 

আজ মাসদুয়েক ধরে রাতদিন পরিশ্রমের পর তাঁর যন্ত্র তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। যন্ত্রের নাম তিনি দিয়েছেন অ্যাডভাইসস্কোপ, যেটা দিয়ে অবুঝ প্রাণীকেও অ্যাডভাইস বা সদবুদ্ধি দেয়া যাবে। সেই যন্ত্র হাতে এই দুপুর বেলার রোদে তিনি বেরিয়েছেন কুকুরটাকে খুঁজতে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল সেই কুকুরটাকে ঠিক খুঁজে পাচ্ছেন না।

 

২।।

আরো আধঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর প্রফেসর সদবুদ্ধি কুকুরটাকে খুঁজে পেলেন মাঠের এক কোণে একটা ঝোপের নিচে। কুকুরটা তখন ঝোপের নিচের মাটিতে একটা ছোট গর্ত খুঁড়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছিল। তিনি গিয়ে ডাকলেন,

―ওঠ, উঠে পড়। দেখ তোর জন্য কী এনেছি।

কুকুরটা সেদিনের মতই একবার মুখ তুলে চাইল শুধু, কিন্তু খুব একটা ভাবান্তর তার মাঝে দেখা গেল না। প্রফেসর সঙ্গে করে দুটো বিস্কুট এনেছিলেন, সে দুটো দিলেন কুকুরটাকে। কুকুরটা নাক বাড়িয়ে বিস্কুটদুটো একবার শুঁকল, তারপর আবার শুয়ে পড়ল। 

সদবুদ্ধি মনে মনে ভাবলেন―এ তো ভারি বিপদ, এর তো দেখি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নেই। নিজের যন্ত্রটাকে একটা বেল্টের সঙ্গে আটকে এনেছিলেন। সেই বেল্টটা নিয়ে একটু সাহস করে কাছে গিয়ে কুকুরটাকে বললেন,

―মাথাটা একটু তোল বাবা, বিকেলে তোকে আমি চিকেন গ্রিল খাওয়াব।

কুকুরটা তাঁর কথা বুঝল কিনা, কে জানে? কিন্তু প্রফেসর দেখলেন কুকুরটা মাথা একটু উঁচু করল। আর অমনি সুযোগ বুঝে তার গলায় বেল্টটা পরিয়ে দিয়ে যন্ত্রের বোতাম টিপে চালু করে দিলেন প্রফেসর। যন্ত্রটা চালু হতেই কুকুরটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে হঠাৎ কেমন ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে রইল। সদবুদ্ধি বুঝলেন যন্ত্র ঠিকমতই চালু হয়েছে। এবারে নিজের কাছে থাকা যন্ত্রের অন্য অংশটা চালু করলেন তিনি। অতপর তাদের দুজনের মধ্যে নিম্নরূপ কথা হল। সদবুদ্ধি বললেন,

―কী রে ব্যাটা, তোর নাম কী?

কুকুর বলল,

―জ্বি স্যার, আমার নাম লালু।

―ভালো ভালো, তোর নামটা বেশ সুন্দর, তা আছিস কেমন?

―বেশ আছি স্যার।

―এই দুপুর রোদে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস কেন?

―হাতে কোনো কাম কাজ নাই, তাই ঘুমাইতাছি।

―সে কী কথা কাম কাজ নাই মানে কী?

―নাই মানে নাই স্যার, আমার মূল কাজই হইল খাওন খোঁজা। আইজকা সকাল বেলা ডাষ্টবিনে চার টুকরা চিকেন ফ্রাই পাইছিলাম, সেইখান থেকে এক পিস চিকেন খাইছি।

প্রফেসর সদবুদ্ধি মনের মাঝে বেশ একটা কৌতুহল বোধ করলেন, চার পিস চিকেন পেয়েও কুকুরটা কেন এক পিস খেল সেটা তাঁর বোধগম্য হল না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন

―কেন? এক পিস খেলি কেন? বাকি তিন পিস কী হল?

―আর বইলেন না স্যার। কই থেইকা দুই টোকাই আইসা হাজির, মনে হয় সারারাত না খায়া আছিল। হেরা তো আমার সামনে গপগপ করে তিন পিস খাইয়া দিল। আমার পিসটাও কাইড়া খাইতে চাইছিল। আমি মুখে নিয়া দৌড় দিছি।

লালুর কথা শুনে আঁতকে উঠলেন সদবুদ্ধি,

―অ্যা, কী বলিস! এই একবিংশ শতাব্দীতে খাবার নিয়ে মানুষ কুকুরের কাড়াকাড়ি হয় নাকি?

লালু এবারে একটু গম্ভীর স্বরে বলল,

―হইব না স্যার? আপনাগো মত বড়লোকের খাই খাই যেই হারে বাড়ছে!

সদবুদ্ধি দেখলেন এর সঙ্গে বেশি কথা বলা বিপদজ্জনক। কুকুর হলেও এর বেশ বুদ্ধি আছে। তিনি ভাবলেন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করাই এখন ভাল হবে। তাই খানিক ভেবে লালুকে জিজ্ঞেস করলেন,

―তা ব্যাটা এই বেলা নাহয় খেয়েছিস। পরের বেলায় কী খাবি সেটা কিছু ভেবেছিস?

একটু হেসে লালু বলল,

―আপনে না চিকেন গ্রিল খাওয়াইবেন কইলেন?

সদবুদ্ধি বুঝলেন এ ব্যাটা মহাচালু, তবে চালু হওয়া ভালো, সদবুদ্ধি দিলে বুঝতে পারবে। তাই সদবুদ্ধি দেবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,

― সে না হয় আজকে খাওয়ালাম, কাল খাবি কী?

―সে স্যার আপনাগো দয়ায় ডাস্টবিন থেইকা কিছু না কিছু জুইটা যাইব।

―হুম, আর যদি কিছু না পাস?

―তাইলে আর কী, অন্য ডাস্টবিনে যামুগা।

―সেখানেও যদি না পাস? তোর আগেই যদি অন্যরা খেয়ে ফেলে?  সিটি কর্পোরেশন যদি ডাস্টবিন তুলে দেয়? তখন কী হবে তোর?

শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে সদবুদ্ধির গলাটা আবেগে ধরে আসল। যেন লালু কুকুর তাঁর কত দিনের চেনা আপনজন। প্রফেসরের কথাগুলো একটু চিন্তা করতে গিয়ে লালু কুকুরেরও মনে হল, ঠিকই তো। ধরা গলায় সে বলল,

―এইডা কী কন স্যার? ডাস্টবিন তুইলা দিলে তো না খায়া মরুম!

সদবুদ্ধি বুঝলেন এতক্ষণে ব্যাটা লাইনে এসেছে। একে এখন সদবুদ্ধি দেওয়া চলে। তিনি বললেন,

―কী আর করবি, দেখ কোন বাড়ি বা দোকানে একটা পাহারাদারের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারিস কিনা। সব সময় মাথায় একটাই চিন্তা রাখবি―

“এবেলা নাহয় খেলুম, পরের বেলায় খাব কী?”

এই বলে তিনি নিজের পথে হাঁটা ধরলেন। তাঁর আগে অবশ্য লালুর গলার বেল্টে লাগানো যন্ত্রাংশটুকু খুলে নিলেন। তবে বেল্টটা আর খুললেন না, বেল্টটা থাকাই বরং ভালো, ওটা গলায় পরানো থাকলে পরে প্রয়োজন মত আবার যন্ত্র জুড়ে দিয়ে কুকুরটার সঙ্গে কথা বলা যাবে। 

 

৩।।

এর প্রায় এক বছর পরের কথা, প্রফেসর সদবুদ্ধি বহুদিন পর দেশে ফিরেছেন। সেদিন সেই লালু কুকুরের সঙ্গে কথা বলার পরদিনই একটা জরুরি কাজে তাকে লন্ডন যেতে হয়েছিল। সেখান থেকে গিয়েছিলেন নিউইয়র্ককে, একটা সম্মেলনে, সেখানেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউইয়র্ক-এ তাঁর বড় মেয়ে থাকে, অগত্যা তাঁর কাছেই ছিলেন ছয়মাস। সেখান থেকে চলে যান অস্ট্রেলিয়াতে মেজ ছেলের কাছে, সেখানে দুই মাস, তারপর জাপানে বড় ছেলের কাছে। সেখানে আরো মাস পাঁচেক থেকে এই সবে দিন দুই হল দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরেই তাঁর মনে হল লালু কুকুরের কথা, ভাবলেন একটা খবর নেয়া দরকার। 

যাবার আগে লালুকে চিকেন গ্রিল খাওয়াবেন বলেছিলেন, সেটা আর খাওয়ানো হয়নি। তাই আজ সঙ্গে করে চিকেন গ্রিল নিয়ে গেলেন। ভেবেছিলেন সেই পুরোনো তাজমহল মাঠেই লালুকে পাবেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হতে হল তাকে, লালু সেখানে নেই।

মাঠের পাশেই একটা তেহারির দোকান, সেই দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে দোকানদার লালুর বর্ণনা শুনে চিনতে পারল। বলল এমন দেখতে একটা কুকুর মাঝে মাঝে তার দোকানের সামনে আসত, অযথা ঘেউ ঘেউ করত, তাই সে তাড়িয়ে দিয়েছে। 

শুনে একটু মন খারাপ হলেও, প্রফেসর কিছুটা খুশিও হলেন। খুশির কারণ এই যে তিনি ভাবলেন লালু নিশ্চয়ই তাঁর কথা মত দোকানে কাজ নিতে চেয়েছিল। তিনি ঠিক করলেন আশেপাশে আরেকটু খুঁজে দেখবেন। 

একা মানুষ তিনি, স্ত্রী গত হয়েছেন অনেক আগেই। আর বাড়িতেও কেউ নেই যে তাঁর জন্য চিন্তা করবে। তাই রাত আটটা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে একা একাই পুরো এলাকায় লালুর খোঁজ করলেন, কিন্তু লালুকে পাওয়া গেল না।

পরদিন সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠলেন প্রফেসর। তারপর হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে আসতেই কেমন একটা পচা গন্ধ পেলেন নাকে। পচা গন্ধের কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝলেন লালুর জন্য কেনা চিকেন গ্রিলটা কাল রাতে ফ্রিজে তুলে রাখা হয়নি, এখন পচে গিয়ে সেটা থেকেই গন্ধ বেরোচ্ছে। বাড়িতে থাকলে সকাল বেলার নাস্তাটা তিনি বাড়ির পাশে মনিরের হোটেলে করেন। আজ বেরোবার সময় সঙ্গে করে পচা গ্রিলটা নিয়ে নিলেন, ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন বলে।

মনিরের হোটেলের একটু সামনেই রাস্তার পাশে ময়লা ফেলার ডাস্টবিন, সেখানে ময়লা ফেলতে গিয়ে একটা লাল রঙের কুকুর দেখে চমকে গেলেন সদবুদ্ধি। তাঁর হাতের পলিথিন থেকে পচা চিকেনের গন্ধ পেয়েই সম্ভবত কুকুরটা একটু এগিয়ে এল, আর তখনই কুকুরটার গলার বেল্টটা দেখে সদবুদ্ধি বুঝলেন এই সেই লালু, এই বেল্টটা এক বছর আগে তিনি নিজেই পরিয়ে দিয়েছিলেন। চিনতে কষ্ট হবার অবশ্য কারণ আছে, সেই লালু কুকুরের সঙ্গে এই লালু কুকুরের বিস্তর তফাৎ। 

কুকুরদের বয়স মানুষের চেয়ে দ্রুত বাড়ে সেটা সদবুদ্ধি জানতেন, কিন্তু তাই বলে এক বছরে একি অবস্থা হয়েছে লালুর। তাঁর সেই নধরকান্তি শরীরের কিছুই যে আর অবশিষ্ট নেই, শরীরের চামড়ার নিচে বুকের হাড় গোনা যাচ্ছে। ভাগ্যিস অ্যাডভাইসস্কোপ যন্ত্রটা প্রফেসরের পকেটেই ছিল, রাস্তার একটু পাশে গিয়ে সেই যন্ত্র লাগিয়ে দিলেন  লালুর গলার বেল্টে, তারপর জিজ্ঞেস করলেন,

―একী লালু!! তোর এই অবস্থা কেন?

জবাবে লালু প্রথমেই খানিকটা ভেউ ভেউ করে কেঁদে কেটে একাকার করল, তারপর কান্নার দমক একটু কমে আসতে ধরা গলায় পাল্টা প্রশ্ন করল,

―আপনি কই আছিলেন স্যার? আপনেরে কত খুঁজলাম, পাইলাম না।

―কেন রে? কী হয়েছে?

―হইছে তো অনেক কিছু, স্যার।

―আমার হাতে অনেক সময় আছে, সবকিছু খুলে বল, কীভাবে তোর এই অবস্থা হল?

―তার আগে আপনের হাতের ওই পচা মুরগিটা দেন, কাল রাইত থেইকা না খাইয়া আছি।

প্রফেসর অবশ্য সেই পচা মুরগি লালুকে দিলেন না, তাঁর বদলে হোটেলের থেকে গরম পরোটা এনে দিলেন। লালু হাভাতের মত সেই পরোটা খেয়ে শেষ করলে প্রফেসর বললেন,

―এবারে বল।

তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লালু শুরু করল তার জীবন কাহিনী,

―স্যার আপনে তো আমারে সদবুদ্ধি দিয়া চইলা গেলেন, আমি ভাবলাম স্যারে ঠিক কথাই কইছে। তারপর দুইদিন অনেক ভাবনা চিন্তা করলাম, ভাবছিলাম আপনি গ্রিল নিয়া আসবেন, কিন্তু আপনে আর আইলেন না। তখন আমি গেলাম মাঠের পাশে এক দোকানদারের কাছে। গিয়া কইলাম আমি আপনার দোকান পাহারা দিমু, আপনি আমারে দুই বেলা খাইতে দিবেন? কিন্তু সে আমার কথা বুঝল না, দূর দূর করে খেদায়ে দিল। অবশ্য আরও কয়েকদিন গেছিলাম, কিন্তু কিছুই হইল না। 

ফেরার সময় আরেক কুত্তার লগে দেখা, তারে খুইলা কইলাম সব। সব শুইনা সে কইল ওই দোকানদার ব্যাটা নাকি পাজি। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে কাজ কাম দেয় না। কী আর করুম কন স্যার, সারা জীবন নিজের মনমত থাকছি, কাজ কামের অভিজ্ঞতা কই পামু। তবে আপনের কথাডা মাথায় আছিল, তাই দইমা গেলাম না। এদিক ওদিক আরো এক মাস ঘুরলাম। আজকে এই দোকান, তো কাল ওই দোকান। 

শেষে অনেক ঘুরাঘুরির পর এক হোটেলে জায়গা পাইলাম। হোটেলের সিঁড়িতেই থাকতাম, রাতে পাহারা দিতাম, তিন বেলা ভালমন্দ খাইতাম। বেশ ভালই আছিলাম স্যার। কিন্তু একদিন আবার আপনের কথা মনে হইল। আপনে বলছিলেন চিন্তা রাখতে “এই বেলা নাহয় খেলুম, পরের বেলা খাব কী?” চিন্তা কইরা বুঝলাম এই তাগড়া শরীর একদিন থাকব না। তখন খাওয়াইব কেডা? চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হারাম হইয়া গেল স্যার। তখন চিন্তা করলাম বিয়া শাদি করুম, বাচ্চা কাচ্চা হইলে তারাই শেষ বয়সে খাওয়াইব।

লালুর গল্পের এই পর্যায়ে এসে সদবুদ্ধি খানিকটা উসখুস করে উঠলেন। লালু কুকুরের গল্পটা তাঁর ভারি চেনা চেনা মনে হল, তিনি বললেন,

―ইসস, তখন যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতিস!

জবাবে ভ্রু কুঁচকে লালু বলল,

―আপনেতো আর আছিলেন না তখন। আপনেরে পাইলে অবশ্যই জিগাইতাম। যাইহোক সময় বুইঝা সুযোগ মত পাশের এলাকার জুলিরে বিয়া করলাম। সেই দিনগুলার কথা কী কমু স্যার, খুব সুখে আছিলাম দুজন। তারপর যখন বাচ্চাকাচ্চা হইল তখন পড়লাম বিপদে। বাচ্চা দেইখা হোটেল থেইকা আমাগো দুইজনরে খেদায়া দিল। আমি আর জুলি পড়লাম মহা বিপদে। থাকনের জায়গা নাই, খাওন নাই। 

এই পর্যায়ে এসে লালু কুকুর নিজের আবেগ সামলাতে পারল না। খানিকক্ষণ হাপুস নয়নে কান্নাকাটি করল। প্রফেসর সদবুদ্ধি তখন লালুকে হালকা ধমক দিয়ে বললেন,

―আরে কান্নাকাটি থামা। এরপর কী হল বল।

লালুর তো হাত নেই, তাই ল্যাজ দিয়ে চোখ মুছে লালু আবার বলতে শুরু করল,

―এরপরের কাহিনী স্যার কঠিন হইলেও খুবই নিরস। আমি আর জুলি কষ্ট কইরা এই ডাস্টবিন ওই ডাস্টবিন থেইকা খাবার কুড়াইয়া বাচ্চাগুলারে বড় করলাম। কিন্তু এইভাবে খাটতে খাটতে আমার শরীর ভাইঙ্গা গেল, গায়ের লোম পইড়া গেল। তারপর বাচ্চাগুলান একটু বড় হইলে ওগোরে আপনের বাণী শুনাইলাম―কইলাম,

―“এবেলা নাহয় খেলি? পরের বেলা খাবি কী?”

লালুর কথায় প্রফেসর সদবুদ্ধি আবার উৎসাহ ফিরে পেলেন। এত কিছুর পরেও যে লালু তাঁর বাণী মনে রেখেছে, সেটা তিনি একদমই আশা করেননি। খুশি হয়ে তিনি বললেন,

―বহুত আচ্ছা। কিন্তু তোর তাহলে এই অবস্থা হল কী করে? বাচ্চারা কোথায় তোর?

―হ্যারা স্যার তাগড়া জোয়ান হইয়া আমারে কইল বাবা এবেলা নাহয় খেলুম, পরের বেলা খাব কী? তুমি তো আর সারাজীবন থাকবা না। আমি তাগো কথা মাইনা নিলাম। এরপর হেরা নিজের মত কইরা গেছে গা। 

―আর তোর বউ জুলি?

―হ্যায় স্যার অসুস্থ আছিল, মইরা গেছে আগের শীতে।

মুখ দিয়ে একটু আক্ষেপসূচক চুকচুক শব্দ করে সদবুদ্ধি জিজ্ঞেস করলেন,

―তোর পোলাপাইন আসে না তোর কাছে?

―কী যে কন স্যার। হ্যাগো কি আর সেই সময় আছে! তারা এখন তাগড়া হইছে, ভালো ভালো হোটেলে বাড়িতে পাহারা দেওনের কাম করে। তয় আমি যাই মাঝে মধ্যে। বুইড়া বাপ, গেলে বেশ খাতির করে, ভাল মন্দ খাইতে টাইতে দেয়।

―আর বাকি সময় কী করিস?

―কী করুম স্যার, শরীরে তো আর জোর নাই। তাই ডাস্টবিন থেইকা যা পারি কুড়ায়ে খাই আর সুযোগ পাইলে অন্য কুকুরগো সদবুদ্ধি দেই।

শেষ কথাগুলো বলতে বলতে লালু কুকুরের গলা ধরে এল। প্রফেসর সদবুদ্ধি বুঝলেন তাঁর চোখও ভিজে উঠেছে, কীসের যেন একটা কষ্টে বুকের ভেতরটা চিনচিন করছে। জীবনের এতগুলো বসন্ত পার করে এসে, তিনি আর লালু কুকুর যে আজ একই ভাগ্য বরণ করেছেন সেটা তিনি বেশ বুঝতে পারলেন। পরম মমতায় তিনি লালুর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলেন। তাঁর ভেজা চোখ দেখে লালু জিজ্ঞেস করল,

―স্যার, আপনে কান্দেন ক্যান?

প্রফেসর সদবুদ্ধি নিজের কান্নার কারণটা লালুকে বলতে পারলেন না, মানুষ হিসেবে একটা কুকুরের কাছে একথা বলতে তাঁর লজ্জা লাগল। তার বদলে লালুর পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললেন,

―শুনিস, বলব তোকে কোনো একদিন। আপাতত তুই চল আমার সঙ্গে। 

লালু উৎসুক চোখে জিজ্ঞেস করল,

―কই যামু স্যার?

প্রফেসর সদবুদ্ধি বললেন,

―আমার বাসায়, আজ থেকে আমরা দুই বুড়ো নাহয় এক সঙ্গেই থাকলাম।

সদবুদ্ধি বাসার দিকে হাঁটা দিলেন, তাঁর পিছনে লেজ নাড়তে নাড়তে লালুও হাঁটতে লাগল, তাদের দুজনের চোখেই তখন অশ্রুর ফোঁটা চিকচিক করছে।