আলোকবৃত্তে - অনিন্দ্য রাউৎ

অলংকরণ - পিয়াল চক্রবর্তী

“দাদা, চল না একবার।”

এই নিয়ে চারবার বললো ভাই। আমার বিরক্ত লাগলো। বইটা বন্ধ করে ঘুরে ওকে কিছু বলতে যাবো দেখি ও হাতে বেশ কিছু ঘুড়ি আর দুটো লাটাই ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

“চল না দাদা, একবার চল। ছাদে উঠে দেখে এলাম কত ঘুড়ি উড়ছে আর তুই ওড়াচ্ছিস না! চল না।”

আমার ভাই পিকুন। আমার থেকে অনেকটাই ছোট ও। বারো বছর বয়স। খুব রোগা, ছোট্ট, ফর্সা টুকটুকে একটা ছেলে ও। নিজের বয়সের ছেলেদের থেকেও ওকে বেশ কিছুটা ছোট দেখায়। ওর নানা কাজে আমার বিরক্ত লাগলেও ওর মুখের দিকে যেই তাকাই আর কিছু বলতে পারি না, এতটাই মায়ায় মাখা একটা মুখ। না, ও কোনো দুষ্টুমি করে না, বায়নাও করে না তেমন। পড়াশোনায়ও খুব ভালো আর সবার কথা শোনে ও। তবুও কেন জানি ও কিছু চাইলেই এক বিরক্তি চলে আসে আমাদের। আসলে কারণটা জানি আমরা, তাই খুব চেষ্টা করি লুকিয়ে রাখতে, নিজের মনেই ঐ কারণকে বারবার অস্বীকার করি। কিন্তু হয়তো এড়িয়ে যেতে পারি না। তাই মাঝেমাঝেই এমন ব্যবহার করে ফেলি যা উচিৎ নয়।

কোনো এক কারণে ও বাইরে তেমন মিশতেও পারে না। পাড়ার মাঠে ওর বয়সী ছেলেরা খেললেও ও ঐ সময়গুলো বাড়ির মধ্যেই কাটায়। কেউ যেন ওকে বলে রেখেছে নিজে থেকে কিছু চাইতে নেই, কিছু করতে নেই। নিঃশব্দে যেন ও আমাদের পারমিশন দেওয়ার অপেক্ষা করে। এইটুকু ছেলের এত কিছু না চাওয়ার মধ্যেও কিছু জিনিস ও খুঁজে নিয়েছে যা ওকে খুশি রাখে। পড়াশোনা করা, সাইকেল চালানো, বাগানে গাছেদের সঙ্গে সময় কাটানো আর আমার এই ঘুড়ি ওড়ানো দেখা।

 

“কী মাঞ্জা এনেছিস?”

“ডিম মাঞ্জা আর কাঁচের মাঞ্জা।”

“তুই টাকা পেলি কোত্থেকে?”

“টিফিনের টাকা জমিয়ে এনেছি দাদা।” মুখটা একইসঙ্গে উৎসাহী আর কাঁচুমাচু করে বললো পিকুন।

আমার হাসি পেয়ে গেল। আমি ফোনটা হাতে তুললাম অকারণেই অভ্যাসবশত।

“চল না এবার দাদা।” পিকুন বলেই জিভ কাটলো।

আমিও একটু অবাক হলাম। ও এরকম বায়না করে না। কিন্তু আজ একটু আলাদা যেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আজ কী হয়েছে তোর?”

“সরি দাদা। আর হবে না।” মুখটা নামিয়ে বললো।

আমার খারাপ লাগলো।

“না পিকুন, তুই চাইতেই পারিস। আসলে হঠাৎ এরকম বারবার জোর করছিস, তাই?”

পিকুন একটু হেসে বললো, “রনিদা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে অনেকক্ষণ, আর তুই যাচ্ছিস না। তাই।”

রনি... তারমানে তুলিও ছাদে। আর এইজন্যই কি পিকুন! একলাফে বিছানা থেকে নেমে ওকে বললাম, “চল।”

তুলিকে আমি দেখি, যেভাবে সূর্যমুখী সূর্যকে দেখে অনেকটা সেইরকম, সমস্ত দিনের প্রত্যাশা দিয়ে একটু সুযোগ খোঁজা, কখন দেখতে পাবো, কাউকে দেখেই যে মন ভালো হয়ে যেতে পারে সেটা বুঝতে পারি। ভালো থাকার, বেঁচে থাকার রসদ জোগায় ও, ওর দর্শন দিয়ে। আমায় রোজ একবার ওকে দেখতে হয়ই, নাহলে ঐ অক্সিজেনের অভাব পড়ে বেশ। তবে একটা সময় ব্যাপারগুলো অন্যরকম ছিল। শুধু এই চোখের দেখার ওপর নির্ভর করে থাকতে হতো না। হাতের স্পর্শ, চুলের ঘ্রাণ, হাসির শব্দ, শরীরের ওম, চোখের আলো নিয়ে থাকতাম আমি আমার সবটুকু সময়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর বাড়ি যাওয়া, কলেজ থেকে বেরিয়ে ওর কলেজের সামনে দাঁড়ানো, সময় বুঝে ঠিক রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা, ওকে বারবার দেখার জন্য আমার কারণের দরকার পড়তো না। আর তুলিও হাসতো সব দেখে, হাসতো, বলতো, “যত পাগলামি তোর! এতবার করে দেখার কী আছে? বাড়িতে তো প্রায়ই আসিস।”

আসলে একই পাড়ায় থাকার সুবাদে আমার-তুলির জন্মের অনেক আগে থেকেই দুই বাড়ির সম্পর্ক খুব ভালো, তুলিদের যৌথ পরিবার, সেখানে আমরা ছিলাম তিনজন। বাবা-মা চাকরিতে চলে গেলে আমি বেশিরভাগ দিন থেকে যেতাম তুলির বাড়িতে, তুলির সঙ্গে ওর পরিবারের অনেকের মাঝে। ওদের বাড়িতে কত্তজন, দাদাই-দিদুন, জ্যেঠু, জেঠিমা, কাকু, কাকিমা, নন্তু পিসি, পিসে আরো অনেকে। আর সবাই কেন জানি না খুব আদর করতো আমায়, এই সবাইই খুব ভালোবাসতো আমায়। খুব ভালোবাসতো দেড়বছর আগের সেই দিনটা আসা অব্দিও।

 

“দাদা, আমি ধরবো এবার সুতো?”

কথাটা কানে আসতেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুড়ির দিকে তাকালাম। অনেকটা ওপরে এখন ঘুড়ি। শান্ত, অবিচল, স্থির হয়ে উড়ছে, মানিয়ে নিয়েছে যেন হাওয়ার প্রতিকূলতায়।

পিকুন আবার জিজ্ঞেস করলো, “ধরবো দাদা?”

আমার মন ঠিক ঘুড়ির দিকে ছিল না। অল্প মাথা নেড়ে সুতোটা ওর হাতে দিলাম। কিছুটা পেছনে গিয়ে কোনাকুনি থাকা দোতলা বাড়িটার ছাদের দিকে তাকালাম। রনি খুব উৎসাহে প্যাঁচ খেলছে। ওর হাতের মুভমেন্ট দেখেই বোঝা যায়। আর ওরই পেছনে আকাশী রঙের সুতির চুড়িদার পরে লাটাই হাতে দাঁড়িয়ে তুলি। যেন ভাইয়ের সঙ্গে ও যুদ্ধে নেমে পড়েছে। মাঝে মাঝে অভ্যাসবশে হাতের পিঠ দিয়ে মুখটা মুছছে, মাঝে মাঝে বাম হাত দিয়ে মুখের সামনে এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। চিনচিনে একটা ব্যথা হলো বুকে। কেন দিনগুলো পাল্টে গেল? ঐ ওদের ছাদেই পাঁচিলের ওপর উঠে পা ঝুলিয়ে দুজনে বসে থাকতাম। তেমন বিশেষ কিছু না বলেও কত ভালো সময় কেটে যেত, হয়তো মাঝে মাঝে ওর অনর্গল বকবক বা মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান ধরতো ও, কত যেন না বলা কথা হয়ে হতো, বেশিরভাগটাই ও বলতো সামনের রং পাল্টানো আকাশের দিকে তাকিয়ে, মৃদু হাওয়ায় ওর ওড়না, একটা দুটো অবাধ্য চুল আমার মুখ ছুঁয়ে যেত আর আমি প্রাণভরে শ্বাস নিতাম। চিলেকোঠার ওপরের ছাদের ঐ হাওয়া, গোধূলির আকাশ, সূর্যের টুপ করে খসে পড়া, শহরের বুকে একটুকরো নিস্তব্ধতা; ভালোবাসা আমাদের চারপাশের আবহে ছিল, আমরা দুজন শুধু চরিত্র মাত্র।

 

সেই তুলির কাছে আমি এখন উপেক্ষিত। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই যেন ওর। চোখ স্থির ঘুড়ি বা ওর ভাইয়ের দিকে। কিন্তু আমি জানি ও টের পেয়েছে যে আমি ওকে দেখছি, তবু একবারও তাকাচ্ছে না। অভিমানী প্রেমিকার মতো নীরবে শাস্তি দিয়ে চলেছে আমায়। কিন্তু সত্যিই আমার খুব দোষ? কেউ কখনো তার নিজের জন্মের জন্য শাস্তি পেতে পারে? আমার কী মনে হলো, আমি ভীষণ জোরে ডাকলাম, “তুলি... তুলিইই।”

ডাকটা এক বাড়ি পেরিয়ে ওদের ছাদে যে পৌঁছেছে বুঝলাম। রনি আমার দিকে তাকালো, কিছু বললোও যেন তুলিকে, কিন্তু তুলি একবারও ঘুরে দেখলো না। আমার সমস্ত শরীর জ্বলতে লাগলো। যেন একরাশ পাথর গড়িয়ে পড়লো পাহাড়ের চূড়া থেকে, আটকাতে পারলাম না অবশ্যম্ভাবী আঘাতকে। আমি ভীষণ গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম। পেছন থেকে ‘দাদা’ ডাকটাও আমায় ছুঁতে পারলো না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুট লাগালাম ওদের বাড়ির দিকে। সদর দরজা খোলাই থাকে ওদের। ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে একলাফে দু তিন সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে লাগলাম। দোতলায় তুলির জেঠিমা আমায় দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “ইতর, তোর লজ্জা করলো না এই বাড়িতে আসতে, কেন মেয়েটার জীবন শেষ করতে চাইছিস? কোথায় যাচ্ছিস? বেরিয়ে যা।” কিন্তু সত্যিই আমার কাছে বাকি সব কিছু ফিকে লাগছে এই মুহূর্তে। আমি দৌড়ে ছাদে গেলাম। শব্দ শুনে তুলি একবার আমার দিকে তাকালেও আবার আকাশের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।

“কী দোষ বল, তুই কেন এতটা শাস্তি দিচ্ছিস?”

তুলি কোনো উত্তর দিলো না। আমি রনিকে বললাম, “রনি, লাটাইটা একটু তুই ধর। আমি দিদির সঙ্গে কথা বলবো।”

তুলি এবার কেটে কেটে বললো, “আমার কোনো কথা নেই তোর সঙ্গে অমু।”

“তুলি একবারটি বল, কেন এরকম করছিস? ফোন কেটে দিস, মেসেজের রিপ্লাই দিস না। চিঠি পাঠালে উত্তর নেই, দেখা করিস না। তোর বাড়ির বাকি সবার কাছে যে কারণে আমি খারাপ, তোর কাছে কি...”

“তোর তাই মনে হয়? তোকে বলিনি আমি কী দরকার আমাদের? আমি বাড়ির বাকিদের মতো নই। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমি লড়বো কীভাবে? চার বছর হলো অমু, তুই এখনো চাকরি পেলি না। জানি সময় লাগে, কিন্তু সময় কোথায় আমার কাছে? বাড়ির লোকেরা ইতিমধ্যে ছয় সাতটা ছেলের পরিবারের সামনে আমায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তোর কি মনে হয়, ব্যাপারটা এতটাই সহজ? যাদের বিয়ে করতে চাই না তাদের সামনে দাঁড়ানো? তাদের সবার চোখের সামনে বারবার এসে হাজার অর্থহীন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া? কিন্তু তুই? পারলি না এখনো। পারলে আমি আমার স্কুলের চাকরিটা তোকে দিয়ে দিতাম। আমার বাড়ির লোকের সামনে তো তুই কাকুর প্রসঙ্গ সরিয়ে কিছু বলতে পারতি!” আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তুলি একনিঃশ্বাসে পুরোটা বলে থামলো।

আমার গলাটা বুজে এলো। “আমি চেষ্টা কি করছি না বল, তুলি?”

“চেষ্টা যথেষ্ট নয় এখন অমু। ফল দরকার। আমার সামনে আর আসিস না। আমি জানিনা কতদিন আর… কতদিন আর আমি আটকাতে পারবো। এখন যা।” তুলির চোখের কোণ চিকচিক করে উঠলো।

তুলি মুখটা ঘুরিয়ে নিতেই আমি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। জেঠিমা দাঁড়িয়ে। জেঠিমার মুখে শান্তির ছাপ। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলাম, জেঠিমা বলছেন, “কিচ্ছু পারবে না রে তুলি, এরা শুধু ক্ষতি করতে পারে, সংসার উজাড় করতে পারে। রক্ত কেন মিথ্যে কথা বলবে?”

আমাদের সমাজে মেয়েদের যেমন সারাজীবন স্ট্রাগল করতে হয়, ছেলেদেরও কিছু কম না। চাকরি না পাওয়া একটি ছেলে সংসারের সবার কাছে দুচোখের বিষ, উপহাস, বিদ্রুপের পাত্র। আর এমনটাই রোজ আমার মনে হয়, চারপাশে থাকা তাদের চাহনি, কথা, নীরবতা দিয়ে যেন সেটাই বোঝায়। কলেজ শেষ হওয়ার পর থেকেই আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে একটা ভালো চাকরি পাই। কিছু চাকরির ইন্টারভিউয়ের পরও জানি না কেমন করে চাকরিটা বাতিল হয়ে যেত। বাবা বলতো চেষ্টা করে যেতে, হাল না ছাড়তে। কিন্তু নিজে আশা হারাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে গিয়ে কী করে সব ভেস্তে যায়! বুঝতে পারতাম না ব্যাপারটা।

একদিন দেখলাম, বিল্টু বাড়িতে মিষ্টিমুখ করাতে এসেছে। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করায় ও বললো, “সেচ দপ্তরে হয়ে গেছে চাকরি।”

আমি অবাক হলাম। বিল্টু? যে সারাদিন পাড়ার রকে বসে থাকে বা ক্লাবে বা পার্টি অফিসে সে কী করে সরকারি চাকরি পায়! আমি যথাসম্ভব নিজের মনের ভাব লুকিয়ে বললাম, “কী পরীক্ষা দিলি?”

ও একচোট হেসে নিয়ে বললো, “পরীক্ষা দিতে হয় না। এতদিন এত কাজ করলাম এই এলাকায়, আবার পরীক্ষা!”

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমিও বুঝলাম, সব কষ্টেরই ফল থাকে না। আমার না পাওয়া চাকরি ঠিক এইভাবেই কেউ পেয়ে যায়।

সেদিন বিল্টুর খবরটা পাওয়ার পর পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। ছাদে উঠে পিলারে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। চোখের জল ধীরে ধীরে মনের উত্তাপগুলো শুষে নিচ্ছিল। অপমানের দলা গলায় আটকে ছিল, নামছিল না কিছুতেই।

গোধূলির আকাশ, নানা রঙের খেলা চলে ঠিক এইসময়, তাকিয়ে ছিলাম, চুপ করে এই বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে বাকি সব কিছু ভোলা যায় যেন। মনে হয়, যত ক্ষুদ্রতা হয়তো এই নীচে, আমাদের এই সমাজে। আকাশের দিকে তাকালে তো আর টের পাওয়া যায় না। নিজেকেও যদি ঐ শূন্যতায় ভাসিয়ে দুহাত মেলে সঁপে দিতে পারতাম আকাশের বুকে তাহলে এতটা কষ্ট থাকতো না,..

খেয়াল করিনি কখন বাবা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছতে গেলাম। বাবা দেখে মৃদু হেসে আমার পিঠে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকালো।

হঠাৎই কী খেয়ালে যেন বলেছিল, “আচ্ছা, তোর বয়স কত? ছাব্বিশ? আমার প্রথম চাকরি হয় যখন আমার বয়স একত্রিশ। এই প্রাইভেট স্কুলের চাকরি হওয়ার আগে আমি জীবনের অনেককিছুই হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু ছেড়ে দিইনি লড়াইটা। বারবার মনে হতো আমার জীবনে আর কিছুই ভালো হওয়ার নেই, জীবন কেন এতটা কঠিন। কিন্তু চাকরি হলো। একদিন তোর মা এলো, তারপর তুই এলি আর পুরানো অনেককিছুই ফিরে পেলাম। বুঝতে পারলাম জীবন কিন্তু সুন্দর, শুধু একটু অপেক্ষা করতে হয়। যতদিন না ভালোটা হয়, ততদিন চেষ্টা করে যেতে হয়। বাকি সবাই শুধু ঐ সাফল্য বা ফলের আশায় বসে থাকবে, কিন্তু ঐ সাফল্য পাওয়ার আগে বছরের পর বছর পরিশ্রমটা তোর, এই লড়াইটাই শুধু তোর নিজস্ব, কেউ এটা অনুভব করবে না তোর মতো। নিজেকে চিনিয়ে দেয় এই লড়াইটুকু। এখন তুই ঠিক কর তুই কী করবি, হাল ছেড়ে দিবি না যা চাস তার জন্য লড়বি। তবে মনে রাখিস, যাই করিস, আমরা তোর সঙ্গে থাকবো।”

 

বাবার বলা কথাগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল। মনখারাপটা প্রায় আর ছিল না। সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিনই হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবিনি আমি, কিন্তু আজ হয়তো এইটুকু যথেষ্ট নয়, এইটুকুতে আমার জীবন ভালো হয়ে যাবে না, যেমন তুলি বললো, আমায় পারতে হবে, ফলটা চাই এবার।

“পিকুন কোথায়?” রাগে মায়ের চোখ লাল হয়ে গেছে, অল্প অল্প কাঁপছে। মায়ের এরকম রূপ দেখে নিজেরই মন কেমন আশঙ্কায় ভরে উঠল। এই দেড় বছর মা তেমন কথা বলেনি কারোর সঙ্গে, কাজে যায়, ফেরে, বাড়ির কাজ করে, খেতে দেয় আমাদের, তারপর শুয়ে পড়ে। আমার বা পিকুন কারোর সঙ্গেই ঠিক কথা বলে না। তাই মায়ের সামান্য পরিবর্তন দেখলেই ভয় লাগে।

আমি বললাম, “জানিনা ঠিক, ছাদে বা বাগানে হবে।”

“না নেই ও। আর এই দুদিন…”

মা কথা শেষ করার আগেই থেমে গেলো। পিকুন ঘরে ঢুকেছে।

“কোথায় ছিলিস তুই?” মা জিজ্ঞেস করলো।

“ঐ রাজাদের বাড়ি। ওদের বাড়িতে নতুন একোয়ারিয়াম এনেছে, দেখছিলাম।”

“এই দুইদিন স্কুল না গিয়ে কোথায় গেছিলিস?” মায়ের কথা শুনে এবার আমিও অবাক। পিকুন স্কুল বাঙ্ক করছে?

পিকুন চুপ করে আছে। মা আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“স্কুল থেকে ফোন করেছিল। এত কষ্ট করে পড়ানো হচ্ছে আর তোর নামে এসব শুনতে হবে? কোথায় গেছিলিস?”

পিকুন কোনো উত্তর দেয় না। মা এগিয়ে যায় ওর দিকে।

ভয়ে পিকুন পিছিয়ে যায়। আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলেও আটকে যায়। মা আর থামে না।

“সব তো শেষ করেছিস আর এখন আমাদেরও শেষ করবি?” মা রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে পিকুনকে চড় মারতে থাকে। আমি গিয়ে কোনোমতে মাকে আটকাই। মায়ের চোখ লাল, কাঁদছে।

“যেদিন থেকে এসেছিস শুধু খারাপটাই করে যাচ্ছিস। আমাদের একটু রেহাই দে। স্কুল যখন যাবি না, তোকে আর স্কুল যেতেই হবে না।”

এই প্রথম মাকে এতটা রাগতে, ভেঙে যেতে দেখি। মা উঠে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। পিকুন একভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে। আমার রাগ হয় ওকে দেখে। এত জেদ কেন ওর? কেন চুপ করে আছে?

 

সেইদিনও এই একভাবে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকেছিলো পিকুন। আমি আর মা অপেক্ষা করছিলাম বাবার জন্য। বাবা স্কুল থেকে এক্সকার্শনে দার্জিলিং গিয়েছিল। সেদিন ফেরার কথা। কিন্তু বাবা আসেনি। এসেছিল ফুটফুটে একটি বাচ্চা ছেলে আর দুই পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠেন, “আপনিই রিমাদেবী?”

মা ভয়ে, আশঙ্কায় উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, আমি। বলুন। কী হয়েছে?”

পুলিশটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন,

“আপনার স্বামী ল্যান্ডস্লাইডে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। সঙ্গে এই ছেলেটির মা’ও।”

আমরা কিচ্ছু বুঝতে পারি না। মা মুখে আঁচল নিয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে পুলিশের দিকে। যেন প্রতিটা কথা বুঝে নিতে চাইছে। অনেক অনেক প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে আমার মনেও।

পুলিশটি বলতে থাকেন, “গাড়িটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। ড্রাইভারসহ ট্যুরিস্ট গ্রুপের যতজন ছিল সবাই মারা গেছে। শুধু এই ছেলেটি মিরাকুলাসলি বেঁচে গেছে।”

ফুটফুটে চেহারার বাচ্চা ছেলেটি আমাদের দিকে তাকায় আবার।

আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শশব্যস্ত হয়ে বলি, “আপনারা ভুল করছেন। আমার বাবা স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে এক্সকার্শনে গিয়েছিল। অন্য কারোর কথা বলছেন।”

“ভুল জানেন তাহলে। এই ছেলেটি তার মাকে এবং বাবা হিসাবে অতুলবাবুকে শনাক্ত করেছেন। অতুলবাবুর ডিটেইলস পেয়েই আমরা আজ এখানে এসেছি। আপনারা চলুন এখন, শনাক্ত করবেন।”

পুরো পৃথিবীটা এক নিমেষে উল্টে যায় আমাদের চোখের সামনে। বাবার অপেক্ষা করছিলাম আমরা। আমার ইন্টারভিউয়ের খবর দেব বলে বসেছিলাম। ভালো হয়েছিল। বাবা শুনে খুশি হতো। মা মুড়িঘন্ট তৈরি করেছিল। বাবা ফিরে খাবে বলে। খুব ভালোবাসে। কিন্তু কী বলছে এই পুলিশরা তার বদলে? বাবা কোথায়? ‘এই ছেলেটি তার বাবা হিসাবে…’ ‘বাবা আর নেই…’ যে এতটা অপরিহার্য সে হঠাৎ কী করে নেই হয়ে যায়! বিশ্বাস করছিলাম না, কিচ্ছু বিশ্বাস করছিলাম না।

কিন্তু আমি ঐ ঘরে বসে প্রথমবার শ্মশানের গন্ধ পেয়েছিলাম। আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার গন্ধ।

আমি আর মা কীভাবে হসপিটালে পৌঁছেছিলাম নিজেরাও জানি না। শুধু মর্গের শীত ভাবটা মনে আছে। মেরুদণ্ডের ভেতরে হানা দেওয়া শীতলতা। বাবার দেহটা দেখেছিলাম আমরা। মুখমণ্ডল জুড়ে শান্তির ছাপ, মুখের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, তবে হাত ও পা, বুকের এক অংশ থেঁতলে গেছিলো। আমি ভীষণভাবে কাঁদছিলাম, বাবা আর নেই, এই অনুভূতিটুকু নিতে পারছিলাম না, ঐ ঠান্ডা ঘরেও চোখ জ্বলে যাচ্ছিল, ভেতরে এক অসহনীয় কষ্ট। শরীরের প্রতিটি অংশে উত্তপ্ত লোহার রড দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলে কি এর থেকে বেশি যন্ত্রণা হয়? চোখের সামনে অনেককিছু দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার ছোটবেলা থেকে স্তরে স্তরে সাজানো মুহূর্তগুলো বারবার ভেসে উঠছিল চোখের সামনে।

আশ্চর্যজনক ভাবে মা চুপ করেই দাঁড়িয়েছিল। কোনো কান্না না, বিলাপ না, কোনো কথা না। মা মর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছিল আমার আগেই। এরপর থেকে কিছুদিন একের পর এক কাজ করে যাই, বুঝেছিলাম বাবার মৃত্যুতে শোকের জায়গা নেই, অনেক বেশি যান্ত্রিক করে দেয় মৃত্যুর স্পর্শ। আমরা পাড়ার কিছু লোকের সাহায্য নিয়ে পরদিন থেকে নানা কাজে করতে থাকি, কিন্তু মা চুপ করেই থাকে। কোনো আত্মীয়কে জানায়নি, কাউকে কিছু বলেনি, সবটা আমিই করছিলাম। নিজের সিঁদুর নিজে মুছে ঐ তেরো চোদ্দ দিন শুধু কালো শাড়ি পরে থাকতো।

সৎকার হয়ে গেলে সবার নজর যায় বাচ্চা ছেলেটির ওপর। ওর পরিচয় জিজ্ঞেস করাতে, আশ্চর্যজনক ভাবে মা’ই এগিয়ে এসে সবটা বলে দেয় সবাইকে। পিকুন আমার সৎ ভাই, এমন এক সত্যি যা দুদিন আগে অব্দিও আমরা জানতাম না। সব শুনে কিছু মানুষ সহানুভূতি দেখালেও সবাই সরে যেতে থাকে। মৃত মানুষটির চরিত্রের বিশ্লেষণ হতে থাকে, শোক ভুলে গিয়ে। ‘একজন শিক্ষক কীভাবে এরকম করতে পারে? কত বড় লম্পট! এত দিন বিশ্বাসঘাতকতা, শিক্ষকের নামে কলঙ্ক, এইজন্য সমাজ উচ্ছন্নে যাচ্ছে, পরিবারটিকে পুরো ডুবিয়ে দিয়ে গেল, মালের রস কম ছিল না, বাড়িতে একটা, বাইরে একটা’ এইসব কথা লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে শুনে মনে হত, বাবা শিক্ষক না হয়ে অন্য কোনো পেশায় নিযুক্ত থাকলে সবাই মেনে নিতো ব্যাপারটা।

শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে গুটিকয়েক লোক এলেও বেশিরভাগ লোকই এড়িয়ে যায়। যে কয়জন এসেছিলেন তাদেরও মা পিকুনের পরিচয় নিজে যেচে জানায়, আমি চেয়েও মাকে বাধা দিতে পারিনি। এই বিশ্বাসঘাতকতা, জমে থাকা হাজার প্রশ্নের উত্তর কিছুই না দিয়ে বাবা শুধু এক অসহায়তা মায়ের জন্য রেখে গিয়েছিলো। তাই মা নিজের মতো করে শান্তির পথ খুঁজতে থাকে। বাবার আসল রূপ সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়তো তারই অঙ্গ ছিল।

মায়ের রোষ থাকলেও মা পিকুনকে আমাদের সঙ্গেই এনে রাখে। মাকে আর আমি কোনোদিন আগের মতো হতে দেখিনি। বুঝতে পারি, পিকুনের অস্তিত্ব মাকে বাবার বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করায়। আর মা হয়তো বাবার ব্যাপারে সেটুকুই মনে রাখতে চায়।

পিকুন আজ স্কুলে যায়নি। একবার স্কুলের জামা পরতে গিয়ে মায়ের চোখের সামনে পড়ে যায় ও। মা ওর দিকে রেগে তাকায়। ও সব খুলে বসে থাকে নিজের ঘরে। পিকুন মাঝে মাঝে একটা ডায়েরি বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রাখে। খুলে উল্টে পাল্টে দেখে। আমার অনেকবার ইচ্ছে হয়েছিল, ডায়েরিটা দেখতে, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে চাইতে পারিনি। এখনো ঘরের মধ্যে বসে ও ডায়েরিটা জড়িয়ে ধরে জানালার বাইরে চেয়ে আছে ও। কী দেখে? এই বয়স থেকেই এতটা একা হয়ে গেল ও। ওর কী দোষ? যে কারণে ওর ওপরে আমরা রেগে থাকি সেই একই কারণে ওরও কি আমাদের ওপর রেগে থাকা উচিত নয়? কিন্তু কই ও তো কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করে না। উল্টে ভীষণভাবে জুড়তে চায় এই ভাঙা পরিবারে। আমরাই জোর করে এক গণ্ডির বাইরে রেখেছি, বুঝিয়ে দিয়েছি এর ভেতরে তোমার জায়গা নেই।

এইসময় কলিংবেলটা বেজে ওঠে। আমি উঠে দরজা খুলি। তুলি। চোখে একরাশ প্রশ্ন। অবাক হয়ে আমিও দাঁড়িয়ে। ও আমাকে সরিয়ে আমার পাশ কাটিয়ে মায়ের কাছে যায়। মা খাবার টেবিল থেকে এক এক করে সব গুছিয়ে রাখছিল। মা থমকে যায়। তুলি হঠাৎই মাকে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে ওঠে। মা হতভম্ব হয়েও সামলে নেয়। তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। অস্ফুটে বলে, “কী হয়েছে মা?”

তুলি কান্নার বেগে কিছুই বলতে পারে না। নিজেকে হঠাৎ অপরাধী লাগে। আমি কি কিছুই ভালো করতে পারি না? তুলি সামলে বলে ওঠে, “বাবা মা আর মানছে না কাকিমা। আমি রিজেক্ট করলেও নিজেরা সব ফাইনাল করে দিয়েছে। আমায় জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। কেন এমন করবে?”

মা কিছু বলতে চেয়েও কিছু বলে না। তুলিকে সোফায় বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আমি কিছুই পারিনি। পার্টি ধরবো? কালকের মধ্যে চাকরি দিতে পারবে? একটা পরীক্ষার ফলাফল বেরোবে এই মাসে। কিন্তু আর একদিনও কি সময় আছে আমার হাতে? কী করবো আমি? তুলি, আমার তুলি আমার সামনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার থেকে বিদায় নেবে চিরকালের মতো? আর ওকে দেখতে পাবো না? অন্য কেউ ওর ভালোবাসার ভাগ পাবে? অন্য কেউ বুঝি ওর শরীরের ওম মাখবে? অন্য কেউ ওকে আদর করবে? মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। হতে পারে না। আমি বিল্টুর কাছে যাবো। এক সপ্তাহের মধ্যে আমার চাকরি চাই। এক সপ্তাহের মধ্যে। বিল্টুর পায়ে পড়ে যাবো, সবার পায়ে পড়ে যাবো।

হাতের বইটা বিছানায় রেখে আমি ঘরে গিয়ে জামা পাল্টাই। তুলির কথা অস্পষ্ট ভাবে ভেসে আমার কানে আসে। “কাকিমা, পিকুন আজ কেন আমায় ডেকেছে,..?” ‘পিকুন তুলিকে ডেকেছে? পিকুনের কী দরকার?’ আমি কিছু বুঝতে পারি না। তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরে আসি। আবার কলিংবেল বেজে ওঠে। মা দরজা খুলে দিলে একজন ধোপদুরস্ত জামা, প্যান্ট পরিহিত লোককে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দেখেই মনে হয় কোনো অফিস থেকে আসছেন।

“নমস্কার। আমি দীপ্তেশ চৌধুরী। ভবানী ভবন থেকে আসছি। ভেতরে আসতে পারি?”

ভদ্রলোক ভেতরে এলেন। তুলি আর মা দুজনেই নিজেদের সামলে নিয়েছে।

“আপনিই রিমাদেবী তো?” মা একটু চমকে উঠলো। মায়ের কি কিছু মনে পড়ে গেলো?

“হ্যাঁ, আমিই।”

“আরে এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? মিষ্টি নিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি। আপনার তো এবার ভালো সময়।”

আমরা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি।

হো হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “আরে, আপনার ছেলে চাকরি পেয়েছে। তাও ভবানী ভবনেই, সরকারি চাকরি।”

সবাই শুনলেও কারোর বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি এগিয়ে গেলাম। “কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট আর ইন্টারভিউ তো…”

“রেজাল্ট তোমার ভালো হয়েছে। ফর্মাল ইন্টারভিউ একটা হবে। তবে চাকরিটা পাকা।”

“কিন্তু কীভাবে?”

“বসো। তোমাদের পরিবারের পুরো অবস্থাটাই আমি জানি। যদিও সবটা তোমার বাবার মৃত্যুর পরেই জানতে পেরেছি। মনামি রায়চৌধুরী একজন সরকারি চাকুরে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর চাকরিটি পাওয়ার কথা তাঁর ছেলে অনিমেষ রায়ের, অনিমেষের আঠারো বছর বয়স হলে। কিন্তু অনিমেষ চায়, চাকরিটা তুমি পাও। তবে ভেবো না যে সম্পূর্ণ ওর সুপারিশে তুমি চাকরিটা পাচ্ছ। যোগ্য তুমি, তাই পাচ্ছ। পরীক্ষার ফল ভালোই তোমার।

তবে একটা কথা আপনাদের জানিয়ে রাখা ভালো। হয়তো আপনারা জানেন না যে ঐ বাচ্চা ছেলেটা একা একা চিনে একাধিকবার আমাদের অফিসে এসেছে শুধু অমিতেশের চাকরি যেন হয়ে যায় সেইজন্য। ওর চেষ্টাটাকে বিফল আপনারা কেউ বিফল করবেন না। ও আমায় বলতে না করেছিল কিছু, আপনারা নাকি খুব বকবেন, কিন্তু ভালো কাজ কখনো লুকাতে নেই। ছেলেটা সব হারিয়েছে, ওর আর খারাপ থাকা উচিত নয়।”

“কাল, পরশুও কি পিকুন…?”

“হ্যাঁ অমিতেশ, পিকুন আমাদের কাছেই এসেছিল এই দুইদিন।”

তুলির মুখের সমস্ত কালো মেঘ সরে রোদ উঠেছে যেন। তুলি হাসছে। নিঃশব্দে মায়ের চোখ থেকে জল ঝরছে। আমি পিছনে ফিরলাম, দেখি ভেতরের ঘরের দরজা ধরে পিকুন দাঁড়িয়ে। মুখে কীসের যেন ভয়! হাত দুটো মুঠো করে দাঁড়িয়ে। মা সোফা থেকে উঠে দৌড়ে গেল পিকুনের কাছে। পিকুন ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যেতে মা ওকে ধরে নিলো। জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো ওর দুই গাল, কপাল। যেন কালকের মারের মলম লাগাচ্ছে মা। আমি বুঝি চাকরি পেয়ে গেছি? তুলি আর কোথাও যাবে না, তাই না? মা এবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে? পিকুন কি আমাদের সঙ্গে ভালো থাকবে এবার?

আসলে ভাবলেই কিছু হয়ে যায় না। সময় লাগে, সময় লাগে জীবনের সত্যিগুলোকে মেনে নিতে। আমার চাকরি হয়ে যাওয়ার পরও তুলির পরিবারের কিছুজন অনেক আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু তুলির বাবা মা আমায় আর তুলিকে আমার বাবার কারণে শাস্তি দিতে চায়নি। অনেক দোলাচলের মধ্যেও আমার আর তুলির বিয়ে ঠিক হয়। মা আর পিকুন খুব খুশি হয়েছিল ঐদিন। আমাদের পরিবার যে চিরকাল অভিশপ্ত হয়ে থাকবে না, সেই আশ্বাস হয়তো আমরা সবাই পেয়েছিলাম।

তবু যখনই বাবার কথা ভাবতাম, সব কেমন জানি গুলিয়ে যেত। যে বাবাকে আমি এত বছর ধরে চিনেছি সেই বাবা যে ভুল তা আমি কোনোদিনই মানতে পারিনি। মনের মধ্যে বাবার প্রসঙ্গ এলেই তা সরিয়ে দিই। কিন্তু এই দ্বিধার উত্তরও যেন পিকুনের কাছে ছিল।

এক ছুটির দিন বিকেলবেলায় যখন নিজের ঘরে বসে তুলির সঙ্গে টেক্সট করছি বিয়ের আয়োজন নিয়ে, কখন যে পিকুন নিঃশব্দে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি।

“দাদা।” অস্ফুটে ডাক দিয়ে পিকুন এক ডায়েরি এগিয়ে দেয় আমার কাছে। এটা সেই ডায়েরি, যা পিকুন মাঝে মাঝে নিয়ে বসে থাকে।

আমি মোবাইলটা রেখে ডায়েরিটা খুলি। পিকুন আমার পাশে বসে। মাথাটা সামান্য নিচু করে। অনেক পুরানো এক ডায়েরি। পাতাগুলো হলদেটে হয়ে গেছে। ডায়েরির প্রথম কিছু পাতা জুড়ে কীসব ছোট্ট ছোট্ট ছড়া লেখা। আমি হাত বুলিয়ে বুলিয়ে পড়তে লাগলাম এক এক করে। এক কিশোর মনের অপটু হাতে লেখা। কিছু কিছু ছড়ায় হাসি পেয়ে গেল। কিছু সাদা পাতার পর ডায়েরি জুড়ে একের পর এক ছবি দেখতে পেলাম। বাবার কিশোর বয়সের ছবি, সঙ্গে এক কিশোরী। ছবিগুলো দেখে মনে হলো কয়েক দশক বছর আগে কোনো এক ফুলের বাগানে, কোনো এক ছাদে, কোনো এক মাঠে, কোনো এক স্টেজে আমিই যেন দাঁড়িয়ে। বাবার কিশোর বয়সের ছবি আমি এই প্রথম দেখলাম। হারমোনিয়াম হাতে বাবাকে দেখে আশ্চর্য হলাম। বাবা বুঝি গানও গাইতো? আরো কিছু পাতা ওল্টাতে থমকে গেলাম। আমার ছবি, ছোট্ট বয়সের ছবি। আমার নাম লেখা। আমি, মা, বাবা। কলকাতা বইমেলার ছবি। এই ছবি তোলার সময়টা আমার মনে আছে। এক বেলুনওয়ালাকে বাবা নিজের পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরা দিয়ে আমাদের এই ছবি তুলতে দিয়েছিল। সেই ছবি আমি এতদিন পর দেখছি। আরো কিছু পাতা পর হঠাৎই অনেক পাতা ফাঁকা। তবে দেখে বোঝা যায় কোনো ছবি আটকানো ছিল, কিন্তু জোর করে তুলে দেওয়া হয়েছে।

পিকুনকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ছিল এখানে?”

পিকুন একবার দেখে নিয়ে মাথা নিচু করেই উত্তর দিলো, “মায়ের আর আমার ছবি।”

“কোথায় ছবিগুলো?”

“আমার কাছেই আছে, আমিই তুলে দিয়েছি তুই পড়বি বলে।”

আমি আর কিছু বলি না। কিছু পাতা উল্টে আবার হঠাৎ নিজের নাম দেখলাম, তবে এবার কোনো ছবি না, আমায় সম্বোধন করে চিঠি লেখা।

প্রিয় অমু,

যদি তুমি এই চিঠিটা পড়ছো, তার মানে আমি বেঁচে নেই বা আমার এই ডায়েরি হারিয়েছে। শুরু থেকে শেষ দেখলে বুঝতে পারবে আমার ছোট বয়স থেকে এখনকার জীবনের কিছু কিছু অংশ সাজিয়ে রাখা। এই চিঠি পেয়েছো মানে তুমি ‘মন’ আর পিকুনের কথা জানতে পেরেছো, হয়তো আমায় পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে মানুষ ভাবছো, হয়তো তোমায় আর রিমাকে সমাজের অনেক তিরস্কার, টিপ্পনী শুনতে হচ্ছে। হয়তো আমায় সবাই পিশাচ, লম্পট ভাবছে। কিন্তু সত্যি জানো অমু, কে কী ভাবলো আমার কিছু যায় আসে না। জীবনে এই একটা জিনিসই আমি সবচেয়ে কম ভেবেছি। তবে তুমি, রিমা, মন আর পিকুন কী ভাবলে সেটায় আমার খুব যায় আসে। তাই এই চিঠি লেখা, জানিনা কোনোদিন নিজের হাতে দেওয়ার সাহস হবে কি-না, নিজের মুখে বলতে পারবো কি-না, তাই এই আড়াল।

আমি আর মন অনেক ছোটবেলা থেকে একে অপরকে চিনি। হ্যাঁ, ঠিক তোমার আর তুলির মতো। একে অপরকে কখন ভালোবেসেছি একসঙ্গে গান করতে করতে, স্টেজে দাঁড়িয়ে নাটকের রিহার্সাল করতে করতে বুঝতেও পারিনি। শুধু বুঝতাম, একে অপরকে ছেড়ে ঠিকভাবে বাঁচবো না। কিন্তু তুমি তো জানোই জীবনকে আমরা যেভাবে পেতে চাই, সেই হিসেব জীবনে সবসময় মেলে না। আমি চাকরি পাইনি, তার ওপর অব্রাহ্মণ, মন এর বাড়ি থেকে কেউই মেনে নেয়নি আমাদের সম্পর্ক। আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা একটি পরিবারের মত তাই কেউ জানতেও চায়নি। মন এর বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর থেকে ওর বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল, ছিন্ন হয়ে গেল যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যমও। আমার যখন ২৬ বছর তখন হঠাৎই একদিন শুনলাম মনরা এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অমু তুমি বুঝবে, কেমন লেগেছিল আমার। প্রাণপনে ছুটেছিলাম স্টেশনে। কিন্তু ওরা হয়তো এরকম কিছু আঁচ করেছিল যে আমি আসতে পারি। পাড়ার কিছু হতাশাগ্রস্ত ছেলে যাদের নিজেদের জীবনে বিশেষ কিছু করার থাকে না, কিন্তু অন্যের ভালো দেখতে পারে না কোনোমতে, তারা আমার পথ আটকে আমায় রাস্তায় ফেলে খুব মেরেছিলো। অপমান, বুঝলে অপমান, নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় ছিল না। অসহায়ভাবে শুধু মার খেয়েছি। মন জানতে পারছে কি আমি কোথায়? কেন আমি মার খাচ্ছি? ওদের যখন হাতের সুখ হয়ে যায় ওরা আমায় ফেলে চলে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকা ব্যর্থ প্রেমিক, যার খবর এই শহরে আর কেউ জানতে চায়নি, সিনেমাতে দেখালে হয়তো হাততালি, সমবেদনা পাওয়া যায়, বাস্তবে শুধুই টিপ্পনি জোটে। চেষ্টা করেও মনকে দেখতেই পেলাম না, শুধু বিয়ের কার্ড জুটেছিল ঐ ছেলেগুলোর কাছ থেকে। সেইদিন মামার বাড়ি ফিরে আসার পর নিজের ঘরে যখন একা কুঁকড়ে শুয়ে ছিলাম, বুঝছিলাম নিজের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। ছোটবেলায় বাবা মাকে হারানোর পর নিজের সবচেয়ে কাছের জনকেও হারিয়ে ফেলেছিলাম, তারপরও অদ্ভুতভাবে আমি বেঁচে ছিলাম। বুঝেছিলাম কিছুর জন্যই, কারোর জন্যই জীবন থেমে থাকে না, জীবনের একটাই শর্ত - বেঁচে থাকা।

অমু, আমি পাশে কাউকে পাইনি। কিন্তু বাঁচতে আমায় হতো, আমি যে শুধুই ব্যর্থ নই, তা যেন নিজেকেও বোঝানোর দরকার ছিল। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর চাকরি, তারপর তোমার মা আসেন। নিজে থেকে বিয়ে করার আগ্রহ আমার ছিল না। কিন্তু আমারও বিয়ে হলো জীবনের নিজস্ব গতিতেই। আর ভাগ্যিস বিয়ে হয়েছিল। আমিও যে কোনোদিন ভালোভাবে থাকতে পারি তা তোমার মা না এলে বুঝতাম না অমু। আমিও যে দিনের শেষে কারোর হাতে বানানো ভাত তরকারি খেতে পারবো, জ্বরের সময় কেউ খেয়াল রাখবে, আমার ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোকেও কেউ গুরুত্ব দেবে তা রিমা না এলে জানতেই পারতাম না। ভালোবাসার তীব্রতার মতোই মায়ায় মাখানো থাকে ভরসার স্পর্শ। দুটোর স্পর্শ একইরকম না হলেও গুরুত্ব প্রায় সমান। সেটুকু আমি রিমার থেকে পেয়েছি। রিমা প্রথম একজন যে বুঝিয়েছে আমি মানুষটা কোনোভাবেই ফেলনা নই।

অমু রোজ ডাল ভাত খাওয়ানোর মতো ভালোবাসা আর কিছুতে নেই। আমি আজও প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারি তোমার মা কী অসাধারণ মানুষ, তবু দেখো আমি তোমাদের হারানোর ভয়ে রিমাকে কিছু বলতেই পারলাম না।

বিয়ের ১৫ বছর পর এই শহর থেকে দূরে পাহাড়ি রাস্তার এক বাঁকে যে আমার জীবনও যে নতুন বাঁক নেবে আমি ভাবতে পারিনি। স্কুলের বাচ্চাদের ঘুরিয়ে আনার পর বিকেলে ম্যালে বসেছিলাম। সন্ধ্যার মুখে আমি উঠি হোটেলে ফেরার জন্য। ম্যাল থেকে নামতে নামতে দোকানগুলো পেরিয়ে এক বাঁক আসে, আমাদের হোটেলে যাওয়ার রাস্তা। চলতে চলতে আমি কিছুই লক্ষ করিনি বিশেষভাবে। কিন্তু হঠাৎই চমকে উঠে অনুভব করেছিলাম দুই ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। এত ঠান্ডা হাত তো একজনেরই হতে পারে। আমি ভয়ে তাকিয়ে উঠতে পারিনি কিছুক্ষণ। সত্যিই কি সে? এও বুঝি হতে পারে? কুড়ি বছর, কুড়ি বছর, তারপর, তারপর গিয়ে… সত্যি এরকম হয় নাকি! নিজের হার্টবিট নিজে শুনতে পেয়েছিলাম সেদিন। আমি তাও নিজে থেকে তাকাতে পারিনি। মন দুই হাত দিয়ে আমার মুখটা তুলে ধরে। বুঝলি অমু, ঐ মুখটা যা দেখে আমার প্রতিটা দিন কাটতো একটুও পাল্টায়নি। মন একইরকম ছিল। একইরকম। যে মনকে আমি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার সময় পাশে পেতাম সেই মন তার দুই হাতের মধ্যে আমার মুখ ধরে দাঁড়িয়ে আমার সামনে, কুড়ি বছর পর। কুড়ি বছর, পুরো পৃথিবী পাল্টে গিয়েছিল, শুধু মন পাল্টায়নি। আমার ছোট্টবেলার খেলার সাথী, কিশোর বয়সের পার্টনার্স ইন ক্রাইম, যৌবনের ভালোবাসা একইরকম রয়ে গিয়েছিল।

মন বিয়ে করেনি। ওর বাড়ির লোক শত অত্যাচার করেও ওর বিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু ওকে বাড়ি থেকে বেরোতেও দেয়নি। বাড়িতে বসে ও পড়াশুনো করে গেছে। পরীক্ষা দিয়েছে। বুঝলি যে সময়টা আমি দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, সেই সময়টা ও চেষ্টা করছিল। আমরা দুজনে প্রায় একই সময়ে চাকরি পাই। তবে ওর পোস্টিং হয় উত্তরবঙ্গে। ওর বাবা ওর সঙ্গে যায়, ভয় ছিল কোথায় আবার পালিয়ে আমার কাছে না চলে আসে। অদ্ভুত না! দুটো জীবন কীভাবে পাল্টে গেল! চাকরি পাওয়ার ৪-৫ বছর পর ওর বাবা মারা যান। ওর পরিবারের আর কেউ ওর কোনোদিন খোঁজ নেয়নি। ও তিন চারবার আমার খোঁজ করতে এসেছিল, কিন্তু ততদিনে আমি চলে গিয়েছি অন্য জায়গায়। একা হয়ে গিয়েছিল মন, সম্পূর্ণ একা। এই পাহাড়ের কোলে একা এক অন্য জীবন কাটাচ্ছিলো।

সেদিন আমি মনের বাড়ি যাই। মন আমার পাশে বসে সবটা শুনেছিলো। কেঁদেছিল খুব। কিন্তু কিছু ছিনিয়ে নিতে চায়নি। ও ছিনিয়ে নিতে চাইলে আমার বাধা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল কি? জানি না। তবে ও একটা আর্জি রেখেছিল, ওকে বিয়ে করতে, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে না পারলেও প্রতি বছরে যেন একবার ওর সঙ্গে দুটো দিন কাটাই। যার আমার পুরো অস্তিত্বের ওপরই অধিকার সে শুধু এইটুকু চাইলে আমি কীভাবে অস্বীকার করে দিতে পারতাম অমু? যাকে জীবনের প্রতিটি দিন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলাম, সে শুধু এটুকু চেয়েছিল আমার কাছে, ফিরিয়ে দিতাম আমি? কীভাবে? পারিনি আমি। জানি, হয়তো তুই আমায় এখন ঘেন্না করছিস, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি তো শুধু আমার ভালোবাসাটুকুকে আবার হারাতে চাইনি। কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি। খুব খারাপ আমি অমু? তোর, রিমার মুখের দিকে আর ভালোভাবে চাইতে পারি না আমি। তোদের মুখের আড়ালে কে যেন বলে ওঠে, “বিশ্বাসঘাতক। মরে কেন যাও না তুমি?”

ভয়ে কেঁপে উঠি। মনে হয় সত্যিই একদিন মৃত্যু এলে সব ঠিক হবে, হবে কি? প্রতিদিন এক আশঙ্কায় দিন কাটতো। নিজের মনের মধ্যে হাজারবার শক্তি সঞ্চয় করে বলবো ভাবতাম, আর হাজারবার ব্যর্থ হতাম। কাউকে যে হারাতে চাই না। কাঙাল আমি। সব হারিয়ে বুঝেছিলাম হারানোর কষ্ট কী। রিমা যখন বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকতো, কতবার ওকে ঘুরিয়ে বলতে চেয়েও বলতে পারিনি, মনে হতো যদি ঐ মুহূর্তে রিমা তোকে নিয়ে বেরিয়ে যায়? যদি নিজের কোনো ক্ষতি করে? যদি তুই আমার গায়ে থুতু দিস? বুঝতে পেরেছিলাম তোদের চোখে নামলে আমার পক্ষে আত্মহত্যা ছাড়া আর পথ থাকবে না। তাই বারবার চেয়েও কিছু বলতে পারিনি। কেন এমনটা হলো আমার জীবনটা? কারোর তো কিছু খারাপ চাইনি, তাও কেন?

তোর খুব অচেনা লাগছে আমায়? এতটা পাগলামি দেখিসনি, না? ভিতর থেকে আমি তোর মতোই। বারবার তোকে অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করতো। জানিস, তুই যখন তোর বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতিস, মনে হতো আমিও নেমে যাই তোর সঙ্গে, তোর সবচেয়ে বেশি রানের পার্টনারশিপটা আমার সঙ্গেই হোক। যখন মাঠে কেউ ল্যাং মারত তোকে অন্যায়ভাবে তখন মনে হতো আমি গিয়ে ভালো করে মারি ওকে। কিন্তু বাবা হয়েছি, তোকে যে ঠিক জিনিসটা শেখাতে হবে, বড় করতে হবে। তাই আমি তোকে বুঝিয়েছি কী করতে হয়, কী করতে নেই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি যে ভীষণভাবেই তুই ছিলাম অমু।

অমু আমি তোমায় আর পিকুনকে কোনোদিন আলাদা ভাবিনি। তুমি যদি আমার দামাল যৌবন হও, পিকুন আমার শৈশব। আমি তোমাদের দুজনের জীবনটা বিষিয়ে দিতে চাই না। তাই সময় এলেই তোমরা সবটা জানবে, তার আগে না। আর সেই সময় আসা অব্দি এটুকু মনে রেখো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আমি তোমাদের দুজনকেই ভালোবাসি, কারণ তোমরা সেই দুজন মানুষের অংশ যাদের এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি।

অমু, যদি কোনোদিন তুমি পিকুনের ব্যাপারে জেনে যাও, আমায় ক্ষমা করতে পারো না পারো, ওকে কোনো শাস্তি দিও না, এই একার জীবনগুলোতে ওর হয়তো তোমায় খুব দরকার হবে। আমি যেমন কাউকে পাইনি, ওর বা তোমার সেই দিন না আসুক। শুধু এটুকুই মনে রেখো আমি মানুষটা তোমাদের কোনো ক্ষতি হোক চাইনি। সবরকম ভাবে তোমাদের আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। জানি আমি হেরে গেছি, তোমাদের অলক্ষ্যে, ভালোবাসার কাছে, তোমাদের সততার কাছে, তোমাদের পরিশ্রমের কাছে, তাই তোমাদের অজান্তে তোমাদের কাছে বারবার হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছি। আশা করি আমি মানুষটাকে কোনো একদিন বুঝতে পেরে তোমরা আমায় ক্ষমা করবে।

ইতি,

তোমার বাবা

কখন যে মা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। নিঃশব্দে তার চোখের জল বাষ্প হয়ে যাচ্ছিল অনুতাপে। মানুষটা যে সত্যিই নেই তার অনুভূতি ছড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের সমস্ত চেতনায়। মা আমায় জড়িয়ে ধরলে আমার চোখ আর বাঁধ মানেনি। তীব্র খরস্রোতা নদী পাহাড়ের বুক চিরে নেমে যাচ্ছিল। ঘাত প্রতিঘাতে জন্ম নিচ্ছিল নতুন পথ, নতুনভাবে বয়ে যাওয়ার রাস্তা।

“পিকুন, আর একটু, আর একটু ঢিলে দে। হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে, ঠিক আছে, এই তো। তুলি সুতো ছাড়ো, সুতো ছাড়ো, নে পিকুন নে, এবার তোর পালা, টান, টান দুই হাত দিয়ে যেমন দেখিয়েছি, জোরসে টান, হ্যাঁ, একদম, টান টান টান, আরো তাড়াতাড়ি, আরে আরে আরে দারুণ… ভোকাট্টা।”

পিকুনের মুখে একগাল হাসি ভরে গেল। ঘুড়ির প্যাঁচ খেলে প্রথমবার জিতেছে, আলাদাই আনন্দ। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম আমার ভাইটাকে। এইটুকুতে কী খুশিই না হয়ে যায়। পিছনে তুলিও হাসছে। মা গাছে জল দেওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে দেখছিল, মায়ের মুখটাও হাসিখুশি।

হ্যাঁ, আমার মায়ের প্রকাশ কম। তবে ঐটুকু যে অপার ভালোবাসার হিমশৈলর মুখটুকু, বাকিটা দেখা যায় না, তবে ভীষণভাবে বর্তমান। মা পিকুনকেও খুব ভালোবাসে, আমি এখন বুঝতে পারি। যে পিকুনকে দেখে মা বাবার বিশ্বাসঘাতকতা মনে রাখতে চাইতো, সেই পিকুনকে দেখে এখন মা তার স্বামীকে, আমার বাবাকে খোঁজে। মা বলে, পিকুন আমার থেকেও অনেক বেশি বাবার মতো, হবে হয়তো। আমি শুনে হেসে ফেলি।

পিকুনকে নিয়ে আমি এখন মাঠে যাই, ওর ওখানে নতুন বন্ধুও হয়েছে, পাড়ার মানুষরাও আমার চাকরি পাওয়ার পর, আমার আর তুলির বিয়ের পর পিকুনকে নিয়ে তেমন কিছু আর বলার চেষ্টা করে না। নিজেদের মনেই আমি আর তুলি প্রতিজ্ঞা করেছি যে পিকুনকে খুব ভালো একটা জীবন উপহার দেব। প্রতিটা পদক্ষেপে ওর সঙ্গে থাকবো। তাহলেই হয়তো বাবা আর মনামি মা খুব ভালো থাকবেন। তাই আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। বাবা বুঝিয়েছিল পৃথিবীতে আর সব কিছুই বড় গৌণ; ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সততার কাছে। এগুলোই শুধু থাকুক, বাকি কিছুই মনে রাখতে নেই।