ওল্ড এজ হোম - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

অলংকরণ - কৃষ্ণেন্দু মন্ডল

গল্পের শুরু প্রায় কুড়ি বছর আগে। যখন গল্পের নায়ক কুশল খাল কেটে একটা কুমির এনেছিল।

কুশলের তখন পঞ্চাশের ওপর বয়েস। বাহান্ন বছর বয়েস হলেও তার মুখে বলিরেখা ফুটে ওঠার চেষ্টা করেনি বা চামড়ায় পড়েনি কোনও কোঁচ। একেবারে তরতাজা যুবকের মতই ছিল সুন্দর গড়ন। স্বাস্থ্য আর রূপ দুই দিক দিয়েই সে ছিল সুদর্শন। এখন তো ধরতে গেলে চল্লিশ থেকে শুরু হয় যৌবনের। আর চলে প্রায় অন্ততঃ সত্তর পর্যন্ত হেসেখেলে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সেই কুড়ি বছর আগে কুশল একটু ব্যতিক্রম ছিল বলতেই হবে।

অফিসের এক কলিগ একদিন আনল মেয়েটিকে। বছর পঁচিশের মত বয়েস। দেহ যৌবনভারে পরিপুষ্ট। দেখলে চোখ ফেরানোর যো নেই।

বিহারে কিছুদিন আগে একটা ভয়ঙ্কর ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছিল। কাগজে পড়েছিল কুশল। সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলো দিনের পর দিন টেলিকাস্ট করেছে। তারপর মানুষের যা স্বভাব অর্থাৎ ভুলে যাওয়া।

রমেন মনে করিয়ে দিল আবার সেই ট্রেন দুর্ঘটনার কথা।

—এর বাড়ি পাটনায়। মানে সেখানের একটা গণ্ডগ্রামে আর কী। শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, মেয়ে মিলে সমস্ত পরিবার পাটনায় বাড়ী ফিরছিল ভাই। একজন আত্মীয়ের বিয়ে ছিল। মাত্র দু তিনটে স্টেশন। রিজার্ভেশন হয় না। সাধারণ কামরায় ফিরছিল। আর কী বলব—

বলার আর কী আছে ! সেই বীভৎস দৃশ্য তো এখনও যেন চোখের সামনে ভাসছে কুশলের। একটা এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের। প্রচণ্ড গতিতে আসা এক্সপ্রেস ট্রেন প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কয়েকটা কামরার ওপর উঠে পড়েছিল। পাসেঞ্জার ট্রেনের সামনের কামরাগুলো সব দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। তার বেশির ভাগ যাত্রী হয় সঙ্গে সঙ্গে মারা গিয়েছিল আর নয় সাংঘাতিক ভাবে জখম হয়েছিল।

রমেন বলল, দুর্ঘটনায় শুধু মা আর বাচ্চা মেয়েটা বেঁচেছে কুশল। আর সব – শ্বশুর, শাশুড়ি এমন কী বেচারির বরটা পর্যন্ত চলে গেছে।

মেয়েটির এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় রমেনের বাড়িতে কাজ করে। সেই নিয়ে এসেছে মেয়েটিকে কলকাতায়। মেয়েটিই একদিন উপায় না পেয়ে ফোন করেছিল রমেনের কাজের লোককে। জানিয়েছিল তার বিপদের কথা। দেশে এমন কেউ নেই মেয়েটিকে সাহায্য করার।

কাজের লোক তার মালিক মানে রমেনকে বলেছিল ব্যাপারটা। আসলে টাকা পয়সাই তো বড় কথা নয়, নিরাপত্তাটাই আসল। তাই বন্ধুর কাছে আসা।

—আমি? প্রায় আঁতকে উঠল কুশল, আমি কী করতে পারি?

—ওর দেশের যা অবস্থা খাঁ খাঁ করছে। পরিবেশ তেমন ভাল নয়। সোমত্ত বয়েসের একটা বাচ্চা মেয়ে নিয়ে একা বাস করবে সে সাহস ওদের নেই। ওর তেমন কোনও কাছের আত্মীয় বা আপনজন নেই যে দেখবে। আর যারা আছে তারা এসব ঝঞ্ঝাট নিতে চায় না। আর গ্রামের কথা তো ভাই বুঝতেই পারছিস।

সব কথা এখনও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি কুশল। এত লোক থাকতে রমেন তার কাছে আনল কেন এটা এখনও মাথায় ঢোকেনি। মুখ কুঁচকে বলল, বুঝতে তো পারছি। কিন্তু—

—কিচ্ছু বুঝতে পারছিস না। রমেন বলল, আজকালও গ্রামগুলো কী রকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন তা যদি জানতিস। ওরা ভাবছে যে মেয়ে একসঙ্গে এতগুলো মানুষকে হারায় সে নিশ্চয় অপয়া। তাই তাকে কেউ আশ্রয় দিতে চায় না।

—কিন্তু আমি—মানে বাড়ির আর সবাই—

—সে আমি বৌদিকে ম্যানেজ করে দেব। রমেন বলল, এখন তুই রাজি হলেই হয়। ওরা ভাল পরিবারের মেয়ে। ওর বর মোটামুটি ভাল চাকরি করত। না হয় বাড়ির কাজের লোক করে রাখ। ভাগ্যের ফেরে দ্রৌপদীকেও তো দাসী হতে হয়েছিল?

কঙ্কনাকে রাজী করা কি এত সোজা নাকি? বার বার শুধু এক কথা বলে, ওরে বাবা ওর যা রাক্ষুসে যৌবন। স্বামীটাকে খেয়েছে এখন তোমাকে না খায়।

রেগে উঠল কুশল, কী যা তা বলছ? তুমি কি সেই গত শতকের মেয়ে হয়ে গেলে নাকি?

সে ভেবে পেল না এটাও কি বিহারের একটা গ্রাম হয়ে গেল? এত কুসংস্কার নিয়ে এ যুগে চলা যায়?

না রেগে উপায় নেই। এ তো তার ওপর অপমানের একটা কালি ছেটানোর মত হয়ে যাচ্ছে। বয়সে মেয়েটা তো তার অর্ধেক। আর একটা পুরুষ আর মেয়ে এক জায়গায় থাকলেই একটা নোংরা সম্পর্ক গড়ে উঠবে তার মানে কী?

অনেক বুঝিয়ে বলল রমেন বৌদিকে। অবশেষে রাজি হতেই হল। বিন্দিয়ার ঠাঁই হল সিঁড়ির নীচের ঘুপচি ঘরে। কিছু জিনিস পত্তর সরিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে তার রাত্রিবাস। আর সারাদিন তো কাজের মধ্যেই থাকতে হবে। তাই খাট-পালঙ্ক আর কী দরকার? কুশলের একটু কষ্ট হল। এরা আর যাই হোক ঠিক কাজের লোক শ্রেণীভুক্ত তো নয়। পরিস্থিতির চাপে এমনভাবে একটা মানুষের গোত্র বদলে যাবে?

বিন্দিয়ার সারা দিনটা কেটে যায় কঙ্কনার নানা ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে। মনে মনে বলে, এই ভাল। নাহলে বেশী বিশ্রাম পেলেই তো মনে পড়ে যাবে ট্রেন দুর্ঘটনার সেই বীভৎস দিনগুলোকে। রক্তাক্ত কতগুলো ছিন্নভিন্ন পড়ে থাকা মানুষের জঙ্গলের ভেতর থেকে নিজের লোকগুলোকে খুঁজে নেওয়া। সে কি খুব সহজ কাজ নাকি? কারোর হাত নেই, কারোর পা চলে গেছে। কারোর বা সারা শরীর রক্তে ভেজা। কেউ চীৎকার করছে, কেউ গোঙাচ্ছে আবার কেউ মড়ার মত চুপ। কোনও আহত শিশু কেঁদে কেঁদে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার আপন জনদের আবার কোনও মা পাগলের মত আহত মৃত মানুষের জঙ্গল থেকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে তার কোলের বাচ্চাটাকে পাবার আশায়।

দলা দলা মাংসপিণ্ডের ভেতর থেকে নিজের চেনা লোকগুলোকে আবার একদফা চিনে নিয়ে ফেরত পাবার আশায় আহত মানুষগুলো হন্যে হয়ে ফিরছে। সেই আহত মানুষগুলোর মধ্যে একটা ছিল আহত রক্তাক্ত মেয়েটাকে কোলে নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে আলা হয়ে যাওয়া বিন্দিয়া। শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে শুকিয়ে কালো হয়ে যাওয়া রক্ত আর দু’চোখে শুকিয়ে যাওয়া জলের ওপর একরাশ উদ্বেগ নিয়ে খুঁজে যাচ্ছে মেয়েটি।

অনেক খোঁজা, অনেক ছোটাছুটি, অনেক কিছুর পরে দেহগুলোর সন্ধানই পাওয়া গেল না। অনেক খুঁজে পেতে শাশুড়ির মত একটা কাকে যেন পাওয়া গেল কিন্তু চেনার তেমন উপায় ছিল না। বরের ছেঁড়া জামাকাপড়ের কিছু টুকরোর সন্ধান পাওয়া গেলেও দেহ নয়। শ্বশুরের তো কোনও কিছুরই পাত্তা নেই। একজনের হাত এসে ছিটকে পড়েছে অন্যের পায়ের কাছে তো আর একজনের পায়ের একটা অংশ অন্য একজনের মাথার কাছে। খুঁজে খুঁজে মাথা কুটে মরার ফল শুধু মাত্র একরাশ ব্যর্থতা।

তার গ্রামের এক আত্মীয় কোলকাতায় কাজ করে। বিন্দিয়ার অবস্থা ভাল হলেও তার নয়। তাই ভাগ্যের সন্ধানে কোলকাতায় যাওয়া। মংলু হল রমেনের সেই কাজের লোক যে আবার বিন্দিয়ার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এতবড় ট্রেন দুর্ঘটনার কথা তখন তো লোকের মুখে মুখে। কাগজে আর টিভি চ্যানেলগুলোয় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু তাতেই যে পরিবার সমেত মেয়েটি সফর করছিল সেটা জানত না মংলু। জানা সম্ভবও ছিল না। কিন্তু মেয়েটি তার বাচ্চা নিয়ে এমনি ব্যতিব্যস্ত যে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। শেষে ফোন করেছিল মংলুকে একটা পরামর্শের আশায়। ভাগ্যিস ফোন নম্বরটা জানত মংলুর।

খবরটা পেয়েই সে দৌড়ল গ্রামে। রমেন তাকে বলল, দেখে আয় বাবা। আর যদি কিছু সাহায্য করতে হয় না হয় বলিস।

মংলু লোকটা নেহাত খারাপ লোক নয়। গ্রামে দেখতে গিয়েছিল বিন্দিয়াকে। গিয়ে বুঝল জায়গাটা আপাতত বিন্দিয়ার পক্ষে নিরাপদ নয়। রমেনকে ফোন করে বলল সে কথা। রমেন বলল, যদি তেমন বুঝিস তো সঙ্গে নিয়ে আসিস। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করিস।

রমেন আবার একা মানুষ ব্যাচেলর। সে বুঝল বিন্দিয়াকে তার কাছে রাখা ঠিক হবে না। তাছাড়া ছোট্ট একটা বাড়ী এখানে রাখাও সম্ভব নয়। তাই কুশলের কাছে আসা। ছেলেবেলার বন্ধু। ওর মনটাও ভাল। তাছাড়া সে সংসারী। যে ভয় তার আছে সেটা কুশলের না থাকাই স্বাভাবিক।

***

সারাদিন হাড়ভাঙ্গা কাজের মধ্যে দিয়ে থেকে বিন্দিয়া শুধু ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে যেন তিনি তার স্মৃতিটাকে তাড়াতাড়ি মুছে দেন। এখন শুধু কাজই পারে তাকে একটু বিশ্রাম দিতে। না হলে সে হয়ত পাগল হয়ে যাবে। একদিন যে ছিল মালকিন আজ সে হয়েছে চাকরানি। সে যদি তার ভাগ্যে থাকে তো আর কী করবে। কিন্তু মনে মনে কুশলের ওপর খুব কৃতজ্ঞ সে। সত্যি তো উনি না আশ্রয় দিলে কী হত আজ ভাবতেই তার কান্না আসে। স্বামীর কোনও খোঁজ নেই। সম্পত্তি সব দেশের জ্ঞাতিদের দখলে। ওরা যে ভাবে অত্যাচার শুরু করেছিল তাতে মংলু তাকে কোলকাতায় না আনলে বাঁচত কিনা সন্দেহ। মংলু তাকে এনেছে, রমেন গেছে কুশলের কাছে তার আশ্রয়ের আশায় আর কুশল তাকে শুধু আশ্রয়ই দেয়নি দিয়েছে একটা কাজ। আবার মেয়েটাকে ভর্তি পর্যন্ত করে দিয়েছে ইস্কুলে। এদের সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ সে।

সরকার থেকে কিছু সাহায্য অবশ্য এসেছে। অবশ্য এমনি এমনি নয়। কুশল আর রমেন মিলেমিশে অনেক মেহনত করে এনেছে। রিজার্ভ কামরা তো আর নয় যে নামের লিস্ট থাকবে। দূরত্ব এমন কিছু বেশি ছিল না যে তার জন্যে রিজার্ভেশন করতে হবে। ওরা সাধারণ কম্পার্টমেন্টেই যাচ্ছিল। বেচারি বরের ডেথ সার্টিফিকেটখানাও এখনও পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ লোকের ডেথ সার্টিফিকেট কিভাবে পাওয়া যায় সে জানে না। আর সেটা না পাওয়া গেলে ব্যাংকের কাগজগুলোর ক্লেম করার জন্যে সাকসেশন সারটিফিকেট বার করা যাচ্ছে না। তাই সে আশায় জল ঢেলেই বসে আছে বিন্দিয়া।

নিখোঁজ নয় মৃতই বটে। বিন্দিয়ার নিজের মনের স্থির বিশ্বাস। জুতো সমেত একটা কাটা পা দেখে শনাক্ত করে সে হাতে পায়ে ধরেছিল রেলবাবুদের। ওই জুতো পরেই তার বর ট্রেনে রওনা হয়েছিল সেদিন। জুতোটা যে এখনও পায়ে আটকান আছে দিব্বি। সেদিন বেরোবার মুখে জুতোটা পরে একটু খোঁড়াচ্ছিল রামবিলাস। খুঁত খুঁত করে বলেছিল, জুতোটা একটু মাপে ছোট হয়ে গেছে বোধহয় বিন্দি। অতটা খেয়াল করা হয় নি কেনার সময়। এ হে এ যে দেখছি পা থেকে খুলবেই না।

খল খল করে হেসে উঠে বিন্দিয়া বলেছিল, তবে তো বেশ ভালই হল। সর্বদা পরেই থাকো খুলতে আর হবে না। খোলা পরার সময় বেঁচে যাবে।

পা আছে, সে পায়ে এঁটে বসা জুতোটাও আছে। গোটা মানুষটা নেই। কিন্তু একটা জুতো আর একটা কাটা পা দেখে গোটা দেহটার সার্টিফিকেট দিতে কিছুতেই রাজি নয় বাবুরা। ট্রেনে যাচ্ছিল পাঁচজন। অবশিষ্ট এখন সে আর তার বাচ্চাটা। আইন কানুন এসব বুঝতে শিক্ষিত লোকদেরই মাথা ছরকুটে যায় তো বিন্দিয়ার মত অশিক্ষিত গৃহবধূ। তাও আবার আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থাই আর কী এমন ভাল ছিল। অগত্যা গ্রামেই ফিরে এসেছিল সে। আর তারপর জ্ঞাতিরা তার ওপর এমন ব্যবহার শুরু করেছিল যেন সেই তার স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়িকে খুন করে একা ফিরে এসেছে গ্রামে।

লাখ খানেক টাকা বিন্দিয়ার নামে ফিক্সড করে দিয়েছে কুশল। কঙ্কনা আপত্তি করেছিল, আমাদের বাড়িতে থাকবে খাবে আর টাকাটা হবে ওর? এ আবার কেমন কথা?

—ওই রকম কথা। মনে রেখ টাকাটা সরকার থেকে দেওয়া ওর নামে ক্ষতিপূরণ বাবদ। তাও ওর স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ নয়। কারণ ওদের কারোর ডেথ সার্টিফিকেট এখনও পাওয়া যায়নি। এটা কেবল বিন্দিয়া আর ওর মেয়ের আহত হওয়ার ক্ষতিপূরণ। ওতে আমাদের কোনও হাত নেই। কোনও অধিকারও নেই।

যে কথাটা ভাঙ্গেনি সেটা হল দুজনের জন্যে মাত্র দশ হাজার করে কুড়ি হাজার টাকা ক্ষতি পূরণ পেয়েছিল। বাকি আশি হাজার কুশল নিজে দিয়েছিল মেয়েটির ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কি জানি মানুষের জীবন তো এই আছে তো এই নেই। ভগবান না করুন সে নিজে যদি মারা যায় তো এদের কঙ্কনা তাড়িয়েও দিতে পারে। তখন ওই বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় যাবে বেচারি? রূপে মুগ্ধ হয়ে নয়, কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল এদের ওপর। তা ছাড়াও আরও একটা বিষয় ছিল। যতই ভাগ্যের ফেরের কথা বলা হোক না কেন, এমন একটা স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েকে আজ চাকরানির কাজ করতে দিতে হবে এটা যেন সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।

বিন্দিয়াকে কুশলের কাছ একেবারে ঘেঁষতে দেয় না কঙ্কনা। মনে সর্বদা শঙ্কা কি জানি কী হয়। মেয়েটার তো কাঁচা বয়েস। তাতে রূপ যৌবনের তেমন ঘাটতি নেই। আবার এ যুগে নাকি পুরুষের পদস্খলনটা খুব বেশী হচ্ছে। কাগজ তো পড়ে সে। আর টিভিও দেখে। শুধু খবর নয়। সিনেমা সিরিয়ালেই কি কম কেচ্ছা এসব পুরুষকে নিয়ে?

বিন্দিয়া কিন্তু এসব পাত্তাই দেয় না। কঙ্কনার সন্দেহভরা চোখ দেখে তার বেশ হাসি পায়। কুশলকে ডাকে বাবা বলে। কঙ্কনার হাত থেকে চায়ের কাপটা কেড়ে নিয়ে কুশলের কাছে পৌঁছে দিয়ে বলে, আমাকে কি মেয়ে বলে ভাবতে পার না বাবা?

কেন পারবে না কুশল? যদিও সে ভাবলে আর কী। কঙ্কনা কী ভাবে আর কী ভাবায় সেটাই তো আসল। তার চোখে যে ঘন এক ছায়া দেখেছে সন্দেহের। দিন দিন সে ছায়া গাঢ় হচ্ছে। একটা কথাই বলে বারবার। আর তা হল, ঘিকে কখনই আগুনের পাশে বেশীক্ষণ রাখা ঠিক নয়।

মাত্র মাস তিনেক না যেতে যেতেই সেই বিশ্রী কাণ্ডটা ঘটল। একটা মেয়ের কাছে তো সবার আগে ধরা পড়বেই পড়বে। একদিন কঙ্কনা এসে প্রায় বিড়বিড় করে বলল, একটা কথা জান কি?

—না বললে আর জানব কী করে? কুশল খুব হালকা চালে রসিকতার সুরে বলল কথাটা।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল কঙ্কনা। তার চোখেমুখে বেশ আশঙ্কার ছায়া। ফিসফিস করে বলল, মেয়েটার বাচ্চা হবে।

—কোন মেয়েটা?

—আমাদের বাড়ি কটা মেয়ে আছে শুনি?

বিন্দিয়ার বাচ্চা হবে? খবরটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল কুশলের। কিন্তু বৌয়ের চোখেমুখে এত দুশ্চিন্তা কেন সে বুঝতে পারল না। অবশ্য একটা বিধবার বাচ্চা হওয়াটায় অনেকে অনেক রসের সন্ধান পায় এটা ঠিক। কিন্তু বিধবা হলেও সদ্য বিধবা তো। মানে মাত্র মাস তিনেক হল গত হয়েছে ওর স্বামী।

—চিন্তার কী আছে? কুশল ভ্রু কুঁচকে বলল, বেচারির স্বামী তো সবে মারা গেছে। এরকম তো কত হয়। স্বামী মারা যাবার সময়ই মেয়েটা গর্ভবতী ছিল।

—ঘেন্না ঘেন্না। বলতে বলতে উঠে গেল কঙ্কনা।

দায়িত্ব তো কুশলের। যদিও শোভন নয়, তবু কঙ্কনার কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া গেল না যখন তখন কুশলকেই করতে হল দরকারি সে কাজটা। তাই সে নিয়ে চলল একজন গায়নোকোলোজিস্টের কাছে। রমেনও একাজে তেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এল না। আসলে সে যে ব্যাচেলর আর তার কাছে কিছুদিন আবার বিন্দিয়া ছিল। তাই সে একেবারে খুব সিঁটিয়ে ছিল বলতে গেলে। যদি কেউ তাকেই সন্দেহ করে?

জানা গেল কুশলের ধারণাই ঠিক মানে যখন বিন্দিয়ার স্বামী বেঁচেছিল তখনই সে গর্ভবতী হয়। তার মানে যখন ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টটা হয় তখন সে প্রেগন্যান্ট ছিল কিন্তু বোঝা যায়নি।

কিন্তু কঙ্কনাকে বিশ্বাস করায় কার সাধ্য ! বার বার কুশলকে জিজ্ঞাসা করে, এটা ওর স্বামী করেছে কি বল? অন্য কিছু নয়?

ইঙ্গিতটা বেশ স্পষ্ট। অপমানিত কুশল কোনও উত্তর দিল না।

বিন্দিয়া এখন বাড়ীর পরিচারিকা হিসেবে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। কুশল জিজ্ঞেস করে জেনেছিল বিন্দিয়াদের বাড়িতেও কিন্তু কাজের লোক ছিল। বিন্দিয়া ছিল সুন্দর গৃহের এক গৃহকর্ত্রী। বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ি, স্বামী আর মেয়ের বড় আদরের। সকলের প্রতি তার লক্ষ ছিল দেখভাল করার। আর আজ সে নিজেই কাজের লোক হয়ে সিঁড়ির নিচের গুমটি ঘরে নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যের লাথি খাওয়া একেই বলে।

অফিস থেকে ফিরলে এখন আর কঙ্কনা তেমন করে এগিয়ে যায় না কুশলের দিকে। কয়েকদিন ব্যাপারটা লক্ষ করেছে বিন্দিয়া। রান্নাঘরে উঁকিঝুকি মেরেও কঙ্কনার হাতের চা পায়নি কুশল।

মনে মনে খুব কষ্ট হয় তাই বেশ একটু ইতস্তত করে চা নিয়ে ঢোকে বিন্দিয়াই।

—বাবা তোমার চা। এই টেবিলে রাখছি।

পরিশ্রান্ত কুশলের কাছে কঙ্কনার চেয়ে বড় কেউ নয়। তার মনটা তাকেই চায়। সেটা বুঝেই বিন্দিয়া প্রথমটা এগোয় না। যখন দেখে মা মানে কঙ্কনা কিছুতেই এমুখো হবার নয় তখন নিজের উদ্যোগেই এক কাপ চা করে নিয়ে আসে। যত যাই হোক লোকটাকে এ ক’দিনে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। তার রূপ-যৌবন নিয়ে দেশের বাড়িতে স্বামীর আড়ালে কত লোকই তো খেলতে চাইত। কিন্তু খুব শক্ত হাতে সামাল দিতে হত বিন্দিয়াকে। একটু অসাবধান হলেই বিপদ। শুধু বদনাম রটে যাওয়া তো বটেই, তাছাড়া রয়েছে পঞ্চায়েতের শক্ত বিচার।

এই তো বছর খানেক আগের কথা। এক রাতে চন্দার সোয়ামি সুখন ঘরে ছিল না। গিয়েছিল এক আত্মীয়র বাড়ি তাকে দেখতে। অবস্থা নাকি খুব বাড়াবাড়ি। ছোট ছেলেটাকে নিয়ে একাই ছিল চন্দা। পাড়ার লম্পট ছেলে কিষেণ ঢুকে পড়ে বেইজ্জত করতে চাইল বৌটাকে। চন্দা কম যায় না। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করল। মাচা থেকে বঁটি নিয়ে তাড়া করল।

কিষেণ তো পালিয়ে বাঁচল। কিন্তু চন্দা বাঁচল না। পঞ্চায়েত সভা বসাল। চন্দা ব্যাভিচারিনী। কিষেণের বদনাম দিয়ে তাকে খুন করতে চেয়েছিল। তাই ওর সাজা ওর চুল কেটে সারা পাড়া ঘোরান হবে। তা তো হবেই। কিষেণ যে মোড়লের একেবারে নিজের ভাইপো।

সুখন ছুটে এসে পায়ে পড়ল মোড়লের, অমন সাজা দেবেন না। দয়া করুন।

অনেক হাতেপায়ে পড়ার পর মোড়লের দয়া হয়েছিল। কিষেণের পা ধরে মাপ চাইতে হবে চন্দাকে কিষেণের শুধু শুধু বদনাম করার জন্যে। আর সুখনের জন্যে রইল পঁচিশ হাজার টাকার জরিমানা। আবার হাতে পায়ে ধরা। জরিমানার অঙ্ক দশ হাজারের নিচে নামলই না।

সেই তুলনায় কুশল তো সাক্ষাৎ ভগবান। সে তো কোনোদিন তাকে বাঁকা চোখে চাইলই না। বরং বেশ একটু জড়সড় যেন। বেশ ভক্তি আসে লোকটার প্রতি। বয়স ধরে আন্দাজ করে তাই তাকে বাবা বলেই ডাকে। তখন কঙ্কনা যেন কেমন চোখে তাকায় তার দিকে। হিংসেটা লক্ষ পড়ে বেশ। যেন সে দৃষ্টি বলছে বাবা বলে ডেকে তুমি পার পাবে না।

জড়তা একটু কেটে গিয়ে স্বাভাবিক হয়েছে কুশল। বিন্দিয়াকে এখন সে বিন্দু বলে ডাকে। মেয়ের মতই ভাবে। এদিকে তার শরীরে গর্ভচিহ্ন প্রকট হয়ে উঠছে দিনের পর দিন। লোককে বোঝাতে বোঝাতে হয়রান হচ্ছে সবাই। বেশীর ভাগ ঝাপ্টাটা অবশ্য খেতে হচ্ছে কঙ্কনাকেই। প্রতিবেশীদের বাঁকাদৃষ্টি, বাঁকাহাসি, বাঁকা বাক্যবাণ। ফিসফিস, গুজগুজ, ফুসফুস।

একদিন অতিষ্ঠ হয়ে বলে উঠল, আর পারি না। মাঝে মাঝে তো মনে হয়—

—কী? অবাক হল কুশল।

—বাচ্চাটা—সবাই তো ইঙ্গিত দিচ্ছে—

কুশলের অপমানের তো আর অবশিষ্ট কিছুই ছিল না। বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার এত সন্দেহ? নিজের স্বামীকে বিশ্বাস কর না?

চুপ করে রইল কঙ্কনা।

—বেশ, বাচ্চাটা হলে নয় ডিএনএ টেস্টটা করিয়ে নিও দুজনের। মানে বাচ্চাটার আর আমার তবে সন্দেহটা কাটবে। আমাকে এতটা অপমান করতে একটুও বাধল না তোমার?

কুশল বেশ রেগে গেছে। কঙ্কনা গজগজ করতে করতে ওদিকে চলে গেল।

গায়নোকোলজিস্ট ভদ্রমহিলা বার বার বলে দিয়েছে, গর্ভবতীর কিন্তু ভাল খাবার আর যথেষ্ট বিশ্রাম দরকার। কিন্তু সেটা জেনেই বোধহয় কঙ্কনা তাকে বেশি করে খাটায়। অসহায় কুশল খুব বিড়ম্বিত হয়। তার ম্রিয়মান অবস্থাটা বেশ যেন মনে মনে উপভোগ করে কঙ্কনা।

এটা দ্বিতীয় বাচ্চা বিন্দুর। প্রথম তো মেয়ে। বছর পাঁচেক বয়েস। সেও তো মায়ের সঙ্গে কম্পিটিশন করে দিব্বি কুশলকে দাদু দাদু বলে। কুশল তাকে নাতনির মত আদর করে আবার কত খেলনা কিনে দেয়। স্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছে। রমেন মাঝে মাঝে আসে। বলল, বাঃ এত অল্প বয়সেই বেশ একটা নাতনি পেয়ে গেলে। আমার তো বেশ হিংসে হচ্ছে। মেয়ের বিয়ে হতে এখনও অন্তত বছর পাঁচ সাত। তারপর কত বছর পরে নাতি নাতনি হবে কে জানে।

মেয়ে মানে হল এক পাতানো মেয়ে। এই পাড়ারই। স্কুলের ইতিহাসের টিচার মোহনের ভাইঝি আদ্রিজা। একদিন কী এক দরকারে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল রমেন। মেয়েটি চা নিয়ে এসে বেশ ভক্তিভরে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, আপনাকে খানিকটা আমার বাবার মত দেখতে। আমি আপনাকে বাবা বললে আপনি কি বিরক্ত হবেন?

মোহন বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা, আদ্রিজার বাবা ওর ছোটবেলায় মারা গেছে। খুব ভালবাসত তাকে। সেই থেকে বেচারি বড় মনকষ্টে আছে।

প্রথমটা একটু সংকোচ থাকলেও এটা শোনার পর তাকে মেয়ে পাতালো রমেন। ভাবল বিয়ে না করেও মেয়ে পাওয়া বেশ একটা মজার। অবশ্য সে দেখেছে নিজের থেকেও পাতানো সম্পর্কের দৃঢ়তা অনেক।

কুশলের চব্বিশ বছরের ছেলেটা কদিন ধরে বেশ একটু ঘুর ঘুর করছে বিন্দুর চারপাশে। এ বয়েসে একটু কৌতূহল তো থাকবেই। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু কঙ্কনার স্বভাব সমস্যাকে সব সময়েই একটু বাড়িয়ে ধরার। বলল, রথীন কেমন ঘুরঘুর করছে বিন্দিয়ার পেছনে সেটা নজরে এল? বিদেয় কর মেয়েটাকে। বাইরে একটা ঘরভাড়া করে তোমরা যা খুশি কর আমি কিছু বলব না। কিন্তু এরপর ছেলেটা বিগড়ে গেলে—

ঘেন্নায় নাক কুঁচকে এল কুশলের। নিজের ছেলে তাকেও বিশ্বাস নেই? রথীন অবশ্য স্বাভাবিক নিয়মেই একটু কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল। এটা যৌবনের একটা ধর্ম। একটা নিছক কৌতূহল মাত্র। আড়ালে একদিন শুনে ফেলল মা বাবার আলোচনা। প্রথমটা বুঝতে না পারলেও পরে বুঝল। নিজের মাকে সে খুব ভালবাসত। তবু নিজের সম্পর্কে মায়ের কথাটা ঠিক পছন্দ করতে পারল না।

একদিন ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বাঙ্গালোর চলল। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটা ভাল চাকরি পেয়েছে। আগে জানায়নি। ভেবেছিল একটা স্টান্ট দেবে। কিন্তু মায়ের মনোভাব দেখে সে এমনিতেই এ বাড়ি থেকে পালাই পালাই করেছিল। ভগবান তাকে সুযোগ করে দিল।

কঙ্কনার খুব ক্ষোভ। বলল, তোমার জন্যেই ছেলেটা চলে গেল দেশ ছেড়ে।

—আমার জন্যে? কুশল তো অবাক।

—তা নয় তো কী? বাবার এমন কীর্তি দেখে বেচারা রাতদিন গুমরে গুমরে থাকত। এখন পালিয়ে বাঁচল।

এই ছেলেকেই কিন্তু সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল কঙ্কনা। বলল, অত করে বললুম মেয়েটাকে এ বাড়িতে রেখো না। কোনও বস্তির বাড়ি কি আর ভাড়া পাওয়া যেত না?

পাওয়া হয়ত যেত। কিন্তু পাওয়া গেলেই কি দেওয়া যায়? ভাগ্য আজ যদি মালকিনকে ঝি বানিয়ে দেয় তো কুশলের কি কিছুই করার থাকবে না? বিশেষ মেয়েটা তো সত্যি তাকে বাবার দৃষ্টিতেই দেখে।

রথীন চলে যেতে খুব একটা খারাপ লাগেনি কুশলের। কারণ আর কিছুদিন এ বাড়িতে থাকলে মায়ের কাছে সে কী জ্বালাময় হয়ে উঠত ভেবেই পাচ্ছে। যাক ছেলেটা রেহাই পেল। অন্তত ক’টা বছরের জন্যে। তারপর যদি আবার ট্রান্সফার হয়ে কলকাতায় আসে তো সে অন্য কথা।

খুব সুন্দর একটা ছেলে হয়েছে বিন্দুর। ভারি গর্ব তার। কুশলেরও বেশ ভাল লাগছে। একটা নাতনি ছিল আবার হল একটা নাতি। আড়ালে আবডালে সে অবশ্য একটু হাসির পাত্র হয়েছে অনেকের। তারা বলে, নাতি না ছেলে কে জানে !

বাচ্চা ছেলেটাকে দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে কুশলের সামনেও বলে ফেলে কথাটা। সোজাসুজি না হলেও আকারে ইঙ্গিতে। হয়ত চা দিতে এসেছে কঙ্কনা। তার দিকে তাকায় সে। ভাবে হয়ত তার দৃষ্টিতে দেখবে একটা রাগের চিহ্ন। কিন্তু না। বরং তার ঠোঁটের কোণে ঝুলছে একটা বাঁকা বিদ্রুপ। লোকগুলোর প্রতি প্রচ্ছন্ন একটা সমর্থন যেন।

বেশ লাজুক হেসে কঙ্কনা বলে, এসব ঠাট্টা রাখুন তো দেখি। চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।

***

রিটায়ার করে আরও পাঁচ বছর কেটে গেছে কুশলের। বছর দশেক আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছে কঙ্কনা। চলে গেছে বাঙ্গালোরে ছেলের কাছে। তখনও রিটায়ার করতে পাঁচ বছর বাকি কুশলের। অর্থাৎ বিন্দিয়া আসার মাত্র তিন বছর পরে।

ছেলে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। তারপর ভয়ও পেয়েছিল। মাকে নিয়ে না জানি আবার এক ঝামেলায় জড়াবে। কিন্তু কঙ্কনা সব ম্যানেজ করে নিয়েছে। বিন্দিয়াকে নাকি বিন্দু বলে ডাকে তোর বাবা। বুঝলি তো ব্যাপারখানা। সাবালক ছেলে আর দুদিন পরেই তো বিয়ে দিতে হবে। ওর কাছে তো সব বলা যায়। সব মানে বাবার সব কীর্তি আর কি।

ছেলের বিয়ে ওখানেই মানে বাঙ্গালোরেই দিয়েছে সে। ছেলেও আসতে চায়নি। তবে পাত্রীপক্ষ সৌজন্য সাক্ষাৎকার করে অনুমতি নিয়ে গেছে কুশলের। এইটুকুই। এরপর দীর্ঘ নীরবতা।

এখন কুশলের বেশ বয়েস হয়েছে। রিটায়ারমেন্টের পর সব টাকাকড়ি নিয়ে গেছে কঙ্কনা আর রথীন। ওরা ঠিক খবর পেয়ে ছুটে চলে এসেছে। না জোর করতে হয়নি। কঙ্কনা বলতেই দিয়ে দিয়েছে কুশল। তার এসব ভাল লাগে না। একেই তো বিন্দিয়াকে নিয়ে শুধু কাদা ঘাঁটতেই ভালবাসে কঙ্কনা। এখন আবার এইসব টাকাকড়ি না দিতে চাইলে তাকে আর বিন্দিয়াকে নিয়ে আবার একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটাবে। অর্থ নিয়ে এই অর্থহীন টানাপোড়েন পছন্দ হয় না তার।

শুধু পেনশনটা রয়েছে নিজের। এত অল্প টাকায় চারজনের সংসার টানা। শুধু খাওয়া পরা নয় বিন্দুর দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ। এরা ভাল পরিবারের ছিল। মনটা খচখচ করে কুশলের। তাই এদের লেখাপড়া শেখাতেই হবে।

এর মধ্যে আবার দু’ দুবার শক্ত রোগে পড়ল কুশল। হাসপাতাল থেকে আসার পর ডাক্তার বলল, তোমাকে এখন খুব সাবধানে থাকতে হবে ভাই। বিছানা থেকে ওঠা চলবে না।

ডাক্তার বন্ধু লোক। একটু চাপা ক্ষোভের সঙ্গে বলল, কী আর বলি। নিজের তো কেউ থেকেও নেই। একটা ভাল দেখে আয়া রেখ। আর আমি একটা নার্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

নার্সে কোনও আপত্তি করল না বিন্দু। ও ওষুধ টশুধের ব্যাপার অত বোঝে না সে। কিন্তু আয়াতে তার ঘোর আপত্তি। বলল, মেয়ের থেকে কি ভাল আয়া আর হয় বাবা?

বেডপ্যান, ইউরিনাল সব একা হাতে সামলাল। অবশ্য মুক্তো আর সূর্য মায়ের সঙ্গে হাত লাগাত দাদুর কাজে।

—আমার জন্যে তোমাদের কষ্ট। কুশলের এই কথায় রেগে উঠল ওরা তিনজন। সূর্য বলল, আমরা কি তোমার পর দাদু? আসলে মায়ের কাছ থেকে সে সব শুনেছে। এই দাদু না থাকলে তারা হয়ত কোথায় ভেসে যেত।

কিন্তু আর্থিক অবস্থার কথাটা তো বলতেই হয়। বলেই ফেলল কুশল, তোমাদের বড় কষ্ট হবে। আমার তো এখন পেনশন ছাড়া আর কিছুই নেই।

—বাবার সংসারে মেয়ের কি কষ্ট হয় বাবা? মিষ্টি হেসে বলল বিন্দু। সে এখনও দারুণ সুন্দরী। তাছাড়া তোমার নাতিটাও তো হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করল বাবা। আর ক'টা বছর পর গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরোলে কি কিছু একটা হবে না সুরাহা? না হয় একটা দোকান টোকানই খুলে দিয়ো তখন?

বিন্দুর মেয়ে মোতিয়া। বিন্দু এই নাম রেখেছিল। কুশল নিজে এফিডেভিট করে নাম পালটে করে দিয়েছে মুক্তো। পনের বছর আগের বিন্দুর নামে রাখা সেই ক্ষতিপূরণের এক লাখ টাকা এখন দু’আড়াই-এর মত হয়েছে। তার সঙ্গে নিজের কিছু জমানো দিয়ে মুক্তোর বিয়েটা দিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা পড়াশোনায় তেমন আগ্রহ নেই। মাধ্যমিকের পরে আর পড়লই না। বিয়েটা তবে খুব একটা মন্দ হয়নি। একটা মাঝারি ব্যবসায়ী। অন্তত খেয়েপরে বেঁচে থাকবে।

আরও পাঁচবছর পরে একটা ভাল চাকরি পেল বিন্দুর ছেলে সূর্য। প্রাইভেট ফার্ম হলেও বেশ ভাল চাকরি। চাকুরে হয়েই মায়ের দাসত্ব ঘোচাতে বদ্ধ পরিকর হল সে। দাদুকে বেশ বিনীতভাবে বলল, দাদু তুমি তো আমাদের এতদিন দেখলে। মায়ের দাসত্ব ঘোচাও এবার। ভাবছি তোমার পেনশন আর আমার মাইনে মিলিয়ে যা হবে তাতে একটা কাজের লোক অনায়াসেই রাখা যায়। কী বল?

বিন্দু কিছুতেই তা হতে দেবে না। এসে ঝগড়া করে ছেলের সঙ্গে, আমি বাবার কাজের লোক? কোনোদিন ছিলাম? বল না গো বাবা?

কোনোদিন যা করেনি আজ তাই করল কুশল। বাহাত্তর বছরের লোকটা বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় হাত রেখে বলল, মেয়ে কি কখনও বাবার কাজের লোক হয় রে পাগলী?

কিছুদিন পরেই ছেলে রথীনের কাছ থেকে একটা পেল্লায় চিঠি পেল কুশল। আজকাল দেখতে একটু অসুবিধে হয় তার। বিন্দু পড়ে দিল চিঠিটা। সে লিখেছে, মাকে নিয়ে তো আর পেরে উঠছি না বাবা। আমার দু’ দুটো ছেলেমেয়ে সামলে আবার মায়ের এই বায়না সামলান। সারাদিন বড় খিট খিট করে। বুড়ো লোকেরা যে এত ঝামেলার হয় তা আগে জানলে আগেই ব্যবস্থা করতাম। আর তোমার কাছেও যাবে না। তাই আর কী করব একটা ওল্ড এজ হোম দেখে দিয়ে আসব ভাবছি। বেশ ভালই থাকবে বাবা কিছু চিন্তা কর না।

এরপর আরও অনেক কথা। মায়ের সম্পর্কে অনেক কথা। সব অভিযোগের। শেষে লিখেছে, এখনও তো পেনশনটা তুমি পাও বাবা। মাসে মাসে তাই থেকে মায়ের জন্যে কিছু পাঠাতে তো পারো নাকি? আমার একটু সাশ্রয় হয় আর কি। দু’ দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার কী অবস্থা একবার ভাবতে পার?

এই চিঠিতে মনে মনে হেসেছে কুশল। সে নিজেও তো এখন আছে একটা ওল্ড এজ হোমে। তবে নিজের বাড়িতে। আত্মীয়রা যেখানে পর আর অনাত্মীয়রা যেখানে আপন।