ঝড় - সলমা মিত্র

অলংকরণ - পিয়াল চক্রবর্তী

অতনু এক নামী বেসরকারি সংস্থার পাইলট। বাগডোগরা থেকে সে কলকাতায় ফ্লাইট নিয়ে আসবে আজ। গতকাল যখন ঘর থেকে বেরোচ্ছিল কলকাতা থেকে বাগডোগরা ফ্লাইটটাকে নিয়ে আসার সময় তখন অহনা যেন কতো প্রশ্ন নিয়ে তার দিকে চেয়েছিল, মুখে কিছু না বললেও অতনু খুব বুঝতে পেরেছিল অহনা কী বোঝাতে চাইছে। সে ফিরতে পারবে কি-না সেই নিয়ে সংশয়। তখন মনে মনে অতনু এই কথাই বলেছে যে এই পাঁচ বছর ধরে ও কোনোদিন কি মিস করেছে এই দিনটাতে? নাহ্! কোনোদিন না।

কিন্তু আজ অতনুর মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই পৌঁছতে হবে তাকে। কিন্তু আজ আবার কী হল!! হঠাৎ করে আকাশ এতো কেন গম্ভীর হল? এমনিতেই শীতের সময় ঘন কুয়াশা থাকার জন্য বেশির ভাগ সময় প্লেন সঠিক সময় ছাড়তে পারে না। আসামের বাগডোগরা এলে এই এক অসুবিধায় পড়তে হয় এসময়। কখন যে ঠিক ফ্লাইট ছাড়বে সেটা বলা ভারী মুশকিল।

এদিকে অহনা তো কোনো কথা শুনবেই না। বুঝবে ও না। সেই কারণে অতনুর এত টেনশন। আজ যদি সঠিক সময়ে না পৌঁছতে পারে তাহলে ও যে কী করে বসবে!! একথা ভাবতে ভাবতে আরও একবার আকাশের দিকে তাকাল অতনু। নাহ!!কোনো উন্নতি নেই ওয়েদারের। সেই একই রকম মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ওদিকে অহনা ও আবার দেরি করলে কী যে করে বসে!এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অতনু সোজা ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে গেল।

সামনেই ম্যানেজার বসে আছে। সেও অস্থির। বেশ কিছু গণ্যমান্য লোক এই ফ্লাইটের যাত্রী। কিন্তু এইরকম ওয়েদারে কী করে ফ্লাইট ছাড়বে এটাই বুঝতে পারছিল না। অতনুকে ঘরে ঢুকতে দেখেই সে উৎকণ্ঠার সাথে বলে উঠলো কী হবে বলোতো? কী করে ফ্লাইট নিয়ে যাবে? এমন সময় আবার খবর এলো এক বিষম ঝড় আসছে তাই আর কোনো ফ্লাইট যেন টেক অফ না করে। অতনু এবার আর ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে পারলো না। সে ম্যানেজার কে বলে দিল যে তাকে যেতেই হবে এবং আর কিছুক্ষণের মধ্যেই।

ম্যানেজার অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকাতেই বলল,

—“আপনি আমাকে প্লিজ টেক অফ এর পারমিশন দিন... প্লিজ। আমি ঠিক পারবো কলকাতা পৌঁছতে।”

ম্যানেজার ওর চোখের দৃঢ়তার কাছে আর কিছুই বলতে পারলো না। অতনু একটু মুচকি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরটার থেকে বেরিয়ে গেলো। বাইরে বেরিয়ে মাইক্রোফোনে একটা ঘোষণা করতে বলল যে ফ্লাইট নির্ধারিত সময়েই ছাড়বে!

***

শ্রেয়া ২২ বছরের যুবতী। ফর্সা গায়ের রং। চোখ মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সে রোমাঞ্চ প্রিয়।এইরকম একটা সুযোগের সে যে সদ্ব্যবহার করবে সেটা বলাই বাহুল্য। তাই সে সবার আগে ফ্লাইটের দিকে রওনা হলো। আরো কিছু লোক যারা ভাবলো এই সিচুয়েশন হলেও তাদের যাওয়া দরকার তারা মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করেই ফ্লাইটে চেপে বসলো।

যথা সময়ে ফ্লাইট রওনা হলো। ঠিকঠাকমতো ফ্লাইট টেক অফ্ করলো দেখে অতনু একটু নিশ্চিন্ত হলো। যাক বাবা এবার সব ঠিক থাকলে কলকাতায় পৌঁছতে বেশী দেরি হবে না। আর অহনাকেও ঠিক সামলানো যাবে।

বেশ খানিকক্ষণ যাওয়ার পর যখন অতনু সবে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতে যাবে হঠাৎ আকাশে ঘন মেঘের দেখা পেলো। সেই সঙ্গে প্রবল ঝড়ের আভাস। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সিট বেল্ট বেঁধে বসতে ঘোষণা করে দিল আর এও বলে দিলো যে তাদের প্লেন এক ভীষণ ঝড়ের মুখোমুখি হতে চলেছে। বলা মাত্রই যাত্রীরা নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য যে যার সিট বেল্ট তড়িঘড়ি বেঁধে নিয়ে যে যার মতো তাদের ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করতে লাগলো।

দেখতে দেখতেই সেই ঝড় এগিয়ে এলো। প্লেন কন্ট্রোল করতে গিয়ে অতনু হিমসিম খাচ্ছে। কারণ প্লেনটা দোলার মতো একবার এইদিক আর একবার ওইদিক করছে। ভেতরে সব যাত্রীরাও ভীষণ ভয়ে কাঁপছে। কেউ কেউ তো কান্নাকাটিও শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ঝড়ের দাপট কিছুতেই যেন কমছে না। বেড়েই চলেছে। আর অতনু কোনরকমে শুধু প্লেন যেন উল্টে না যায় সেটাই দেখে যাচ্ছে। মরণপণ লড়াই চলছে।

বেশ কিছুক্ষণ লড়াই চলার পর অবশেষে ঝড়ের দাপট কে হারিয়ে প্লেন সোজা হলো। সবাই কে আবার ঘোষণা করা হলো, “এখন আমরা বিপদের বাইরে বেরিয়ে এসেছি। আপনারা সবাই আমার সাথে ছিলেন তাই আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কলকাতা পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই। আমরা আর কিছুক্ষনের মধ্যেই কলকাতা পৌঁছব। ধন্যবাদ।”

এতক্ষণ ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে অতনু ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। এবার আর কোনো চিন্তা নেই। ঠিক সময় মতো পৌঁছে যাবে সে অহনার কাছে।

ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে জিতে যাওয়ার জন্য শ্রেয়া খুব আনন্দ পেলো আর ধন্যবাদ দিতে ককপিটে পাইলটের সঙ্গে দেখা করতে চাইল। সবাই তখন যুদ্ধ জয়ের আনন্দে আপ্লুত। প্লেনের ক্রুরাও খুশি হয়ে ওকে পাইলটের সাথে দেখা করবার পারমিশন দিয়ে দিলো।

অতনুর চেয়ারের পেছনে এসে শ্রেয়া দেখল অতনু বসে আছে। মাথাটা চেয়ারের ব্যাক সিটে হেলানো। শ্রেয়া খুব নীচু স্বরে হ‍্যালো বলতে গিয়ে খানিকটা ভাবলো কিন্তু ভদ্রলোক কী ভীষণ পরিস্থিতি থেকে ওদের বাঁচিয়ে দিয়েছে তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দেওয়া উচিৎই এই ভেবে বলেই ফেলো “ হ‍্যালো স‍্যার!"

অচেনা গলার আওয়াজ শুনে থতমত খেয়ে পেছন ফিরে সুন্দরী শ্রেয়ার দিকে চেয়ে স্মিত হেসে বলল, “ইয়েস! বলুন!”

শ্রেয়া তখন উচ্ছাসের সঙ্গে বলে উঠল, “ধন্যবাদ স‍্যার! আপনি আজ আমাদের সবাইকে বাঁচালেন। যতই ধন্যবাদ দিই না কেন আপনার ঋণ কখনো শোধ করা যাবে না।”

“ইটস ওকে মাই ডিয়ার! আপনারা সাথে ছিলেন বলেই আমার পক্ষে এই কাজটা সহজ হলো,” হাসিমুখে বলল অতনু।

শ্রেয়া আর কথা না বাড়িয়ে নিজের সিটে এসে বসে গেলো।

সবাইকে সিট বেল্ট বাঁধার অনুরোধ শুনে সবাই যে যার মতো সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে নিজের নিজের ঈশ্বরকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাতে লাগলো।

ফ্লাইট নির্দিষ্ট সময়েই মাটি ছুঁয়ে দাঁড়ালো। সবাই একে একে বাইরে বেরিয়ে এলো। কলকাতাতেও অসম্ভব ঝড় বৃষ্টি হয়েছে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এখনও বৃষ্টি অনবরত পড়েই যাচ্ছে।

***

শ্রেয়া এয়ারপোর্ট এর বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে এতো রাতে এই বৃষ্টিতে কী করে বাড়ি ফিরবে! একটা ট্যাক্সি বা ওলা উবের কারো দেখা নেই। পাশাপাশি গার্ডদের আলোচনা শুনে বুঝতে পারলো যে এখানে ও খুব বড়ো একটা ঝড় এখুনি হয়ে গেছে। এখন সেই ঝড়ের দাপট নেই কিন্তু বৃষ্টি এখনো পড়েই যাচ্ছে। যা হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না আর কিছুক্ষনের মধ্যেই কমবে। বিষন্ন মনে এদিক ওদিক দেখছে।

অতনু নিজের গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই দেখলো শ্রেয়া খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে এদিক সেদিক দেখছে। দেখে মনে হলো আরে এই তো সেই মেয়েটি যে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে গেলো। মনে হতেই গাড়িটা ওর সামনে দাঁড় করিয়ে কাঁচটা খুলে বলল, “যা ওয়েদার দেখছি এখনো বেশ কিছুক্ষণ এটা কাটবে না। আপনি কোন দিকে যাবেন? আমার দিকে যদি হয় কিছু যদি মনে না করেন আমি কিছুটা এগিয়ে দিতে পারি আপনাকে!”

শ্রেয়া অবাক আর খুশি মেশানো গলায় বলল, “থ্যাং ইউ সো মাচ!”

“আপনি যে আমার কী উপকার করলেন কী বলি,” বলতে বলতে গাড়ির দরজা খুলে সোজা ভেতরে ঢুকে সিটে বসে পড়লো। তারপর বলল, “চলুন!”

অতনু জিজ্ঞেস করলো, “আরে আগে বলুন তো আপনি কোনদিকে যাবেন? আমি সেদিকে যাই কিনা দেখে আপনাকে বলছি। আসলে আমার একটু তাড়া আছে। তাই আমার রাস্তায় যদি না হয় আপনার গন্তব্য তাহলে আমি সরি। আপনাকে লিফট দিতে পারবো না।”

শ্রেয়া মুখ শুকনো করে বলল, “আমি গড়িয়া যাবো। আপনি কোনদিকে যাবেন?”

অতনু ওকে আশ্বস্ত করে বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে। বসুন আমি ওদিকেই যাবো। তবে মিস আমার একটু কাজ আছে। সেটা পথে একটু মিটিয়ে নেবো।”

গাড়ি চলতে চলতে শ্রেয়া দেখলো অতনু খুব টেনশন করছে আর বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। পথে এতো জল জমে আছে যে ট্রাফিকের খুব অবস্থা খারাপ। অথচ অতনুকে পৌঁছতেই হবে।

শ্রেয়া ওর বিচলিত ভাব দেখে ওকে জিজ্ঞেস করলো, “কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে আপনার?”

অতনু ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। অহনা অপেক্ষা করে আছে। আমি তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর কাছে পৌঁছতে চাইছি।”

শ্রেয়া হঠাৎ অতনুর গাড়ির ব্রেক কষায় খুব জোরালো ধাক্কা খেলো‌। বোধ হয় খানিকটা মনেও। কিন্তু মুখে হাসি নিয়ে বললো, “ও আচ্ছা আচ্ছা! হ‍্যাপি অ‍্যানিভারসারি!”

অতনু ধন্যবাদ বলেই আবার গাড়ি চালানোতে মন দিলো।

কিছুক্ষণ পরে আবার শ্রেয়া প্রশ্ন করলো, “তো আপনি ওনার জন্য কিছু নেবেন না?”

অতনু আবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “নেবো তো! আমার অহনা বড়ো অর্কিড ভালোবাসে। রাস্তায় একটা অর্কিডের দোকান থেকে কিছু অর্কিড নেবো। জানেন অহনাকে আমি একটা খুব সুন্দর সেট দেবো বলে লুকিয়ে আলমারি তে রেখেছি। এখনও জানে না ও সেটা। সারপ্রাইজ দেবো যে। বলেই হা হা করে হেসে উঠলো। আর এখন কিছু ফুল নিয়ে যাবো। তারপর দুজনে মিলে সারারাত বসে গল্প করবো। এটাই এবার প্ল্যান আমার।”

—“বাহ বাহ তো আপনার অহনা কি কিছু করেন?”

—“না না আসলে আমি বাড়িতে থাকি না। বাড়িতে দু তিনজন চাকর বাকর বাবা মা এদের সামলাবে কে? ও কিছু করতে চাইলে হবে কী করে? বাড়ি সামলাতে হবে তো! আর তাছাড়া ও বড়লোক পিতার একমাত্র কন্যা। তাই একটু জেদিও বটে। ও না থাকলে সংসারটা সামলানো বড়ো মুশকিল তাই আর কাজ টাজ করা হয়ে ওঠেনি। আজকাল বন্ধু বান্ধব নিয়ে মেতে আছে। কিটি পার্টি করে আমি যখন না থাকি মনকে ভুলিয়ে রাখে।”

—“আপনাদের কতোদিন বিয়ে হলো?”

—“আজ আমাদের সাত বছরের বিবাহ বার্ষিকী।”

—“বাহ বাহ খুব ভালো তো। তাই আপনার এতো ছটফটানি।” বলেই হেসে উঠলো শ্রেয়া।

—“না না আসলে বললাম না বড়লোক পিতার একমাত্র জেদী মেয়ে। আমি না পৌঁছলে খুব রাগ করবে। অভিমান করে বাড়ি পালালে আমার আবার মাথায় বাজ পড়বে যে। কতো অনুনয় বিনয় করে মান ভাঙাতে হবে যে কী বলি!”

এসব কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা ফুলের দোকানের সামনে গাড়িটা পার্ক করে “একটু বসুন প্লিজ আমি ফুলটা নিয়ে আসি” বলে গাড়ি দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

শ্রেয়া মনে মনে ভাবছে যে কতো ভাগ্য করে অহনা এরম একজন মানুষ পেয়েছে। দেখতে শুনতে যেমন তেমন অমায়িক। সব দিক থেকেই সুপাত্র। ওর কপালে কে যে জুটবে কে জানে!

ভাবতে ভাবতেই দেখলো অতনু হাতে খুব সুন্দর কিছু হালকা বেগুনি অর্কিড নিয়ে গাড়িতে বসলো। পেছনের সিটে অর্কিড টা রাখতে রাখতে বলল, “আজ পাওয়া গেছে। ওর এই রঙের অর্কিড খুব পছন্দের। আজ এটাই পেলাম। খুব খুশি হবে।”

আবার গাড়ি গন্তব্যস্থানের দিকে ছুটে চললো। টুকটাক কথাবার্তা চলছে। হঠাৎ একটা মোড় থেকে গাড়ি টা ডানদিকে বেঁকে গেলো। অন্ধকার শুনশান রাস্তা। একটু আগে ঝড় হয়েছে। তাই আরো নিস্তব্ধ। গাড়ির হেডলাইটের আলো আর বৃষ্টি মিলিয়ে একটা অন‍্য রকমের ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। শ্রেয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি গাড়ি এদিকে বাঁকালেন কেন?”

অতনু ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “এদিক হয়েই যাবো যে। এখানে একজনের সঙ্গে দেখা না করে গেলে অহনা খুব রাগ করে যে। আপনি ভাবছেন কেন? আমি আপনাকে ঠিক পৌঁছে দেবো।”

—“কিন্তু এদিকটায় একটু ফাঁকা ফাঁকা। তাই বলছিলাম।”

—“ঠিক আছে আপনি গাড়িতেই বসবেন। আমি গিয়ে দেখা করেই চলে আসবো।”

গাড়ির গতির সাথে সাথেই শ্রেয়ার বুক ধুকপুক করছে। অজানা একটা লোকের সাথে এভাবে আসাটা ওর একদম উচিত হয়নি এটাই মনে মনে ভাবছে। ভয়ের মারে গলা শুকিয়ে কাঠ। জলের বোতল খুলে গলায় একটু জল ঢাললো।

হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গায় গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেলো। পেছনের থেকে ফুলটা নিয়ে অতনু নামলো। আবার ঘুরে এসে ওর দিকের দরজার কাছে আসতেই শ্রেয়া জলের বোতলটাকে শক্ত করে ধরলো আর মনে মনে ভাবলো কাছে এলে সজোরে জলের বোতল দিয়ে মাথায় মেরেই ছুটবে।

অতনু ওর পাশে এসে গাড়ির দরজাটা খুলে শ্রেয়াকে বললো, “আপনি এখানে এতো রাতে ভয় পাবেন। আমার সাথেই চলুন। নেমে আসুন।”

শ্রেয়া বলল, “না না ভয় পাবো না। আপনি তাড়াতাড়ি ঘুরে আসুন। আমি এখানেই ঠিক আছি।”

অতনু “আচ্ছা ঠিক আছে” বলে এগিয়ে গেলো। ওকে যেতে দেখে শ্রেয়া ভাবলো ভয়ের কারণে দেখাই হয়নি ওরা কোথায় আছে!

পাশাপাশি চোখ চালিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলো এটা একটা কবরস্থান। সাইন বোর্ডে কি যেন নাম লেখা কিন্তু পুরোনো হওয়ার জন্য ঠিক করে পড়া যায় না। মনে মনে ভাবলো আজ অতনুর বিবাহ বার্ষিকী, ঘরে অহনা বসে আছে অপেক্ষা করছে। তাহলে এখানে অতনু কার সাথে দেখা করতে এলো। আবার বললো এর সাথে দেখা না করে গেলে অহনা রাগ ও করবে।

সব কিছু কীরকম যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। আর অতনুও আসছে না। বেশ খানিকক্ষণ তো হলো। এবার একটু একটু ভয়ও লাগছে। এতো রাতে কবরস্থানে একা একটা গাড়িতে একলা মেয়ে বসে থাকাটাও সেফ না। অস্বস্তি হচ্ছে। ও তাই গাড়ি থেকে নেমে ভাবলো অতনু যেদিকে গেছে সেদিকে একটু এগিয়ে যাই।

ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে ও কবরস্থানের ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরের লাইট পোষ্টের ডিম আলোতে রাস্তা তো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পাশে তাকালেই সারি সারি কবর দেখে মনে একটা অজানা ভয়ও হচ্ছে।

কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে তাকাতেই দূরে কে একজন একটা কবরের পাশে বসে আছে মনে হলো। একটু পরিস্কার করে দেখবার জন্য একটু এগোতেই বুঝতে পারলো অতনুই একটা কবরের সামনে বসে আছে।

শ্রেয়া এগিয়ে গিয়ে দেখলো অতনু শুধু বসেই নেই। কারো সঙ্গে কিছু কথা বলছে। কী বলছে শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু এটুকু পরিষ্কার যে ও কাঁদছে। একটু একটু করে কাছে আসতে ও শুনতে পেলো অতনু বলে চলেছে, “সরি সরি! দেখো আমি তোমার কাছে এসে গেছি। আর দেরি করিনি।”

তখন শ্রেয়া এগিয়ে কাছে এসে দেখলো। কবরের ওপরে নাম লেখা অহনা স‍্যামুয়েল। ও অবাক হয়ে বসে পড়লো অতনুর পাশে। চোখের জল বাঁধ মানলো না।

অতনুর দিকে চাইতে ও বলতে শুরু করলো, “গত পাঁচ বছর আগে এমনই বিবাহ বার্ষিকীর দিন ছিলো। অনেক বন্ধু কে ডেকেছিল অহনা বাড়িতে। কিন্তু ওকে ওই দিনই একটা জরুরী কাজে বাগডোগরা যেতেই হয়। সেই দিনও এরকম ঝড় আসে আর ম‍্যানেজারকে ও কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি ফ্লাইট নিয়ে ওড়ার। আসতে পারেনি ঠিক সময়ে। অহনা খুব সুন্দর করে সেজেছিল সেদিন। লাল রঙের শাড়িটা ওকে দারুণ মানাতো। ও বারবার বলছিল তোমাকে আসতেই হবে। আমি ও খুব চেষ্টা করছিলাম আসার জন্য। কিন্তু ঝড় কিছুতেই থামছিল না। অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে সবাই খাইয়ে দাইয়ে ছেড়ে আসার পর ও আমাকে ফোন করেছিল। কিন্তু আমি তখন ফ্লাইটে। তাই পাইনি। বারবার ফোন করে যখন পায়নি তখন অভিমান করে মেসেজ করে ‘আমি চলে যাচ্ছি।’ বলে আর গাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাগে অভিমানে গাড়ি চালাতে গিয়ে ও গাড়ির কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। সজোরে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা মারে। আমি বাড়ি এসে ওকে খুঁজে না পাওয়ায় ছুটি ওদের বাড়ির দিকে। তখন ভোরের আলো ফুটতে আর একটু বাকি। হঠাৎ এক জায়গায় জটলা দেখে গিয়ে দেখি আমাদের গাড়ি আর ভেতরে অহনা। কাছে গিয়ে বুঝতে পারি আমার অহনা আমাকে ছেড়ে রাগ করে চলে গেছে।

“কিন্তু বিশ্বাস করো তারপর থেকে আর কোনদিন আমি দেরি করিনি। প্রত্যেক বার আমি ওর সময়ের মধ্যেই ওর কাছে আসি।”

শ্রেয়া মন্ত্র মুগ্ধের মত ওর কথা এতোক্ষণ শুনছিল। হঠাৎ পাখির ডাকের আওয়াজে বুঝতে পারে ভোর হয়ে আসছে। অতনুকে ধরে তখন শ্রেয়া বলল, “চলো আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু। আর এবার থেকে আমরা দুজন মিলে অহনার সাথে দেখা করতে আসবো। কিন্তু ওঠো এখন ভোর হয়ে আসছে। আমাকে বাড়িতে ছেড়ে দেবে না!”

আস্তে আস্তে দুজনে আবার গাড়ির দিকে পা বাড়ালো!