তিনতলার ঘর - দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

অলংকরণ - রুমেলা দাস

হোস্টেলে ঢুকেই জানতে পারলাম কেবলমাত্র তিনতলার ৩০৫ নম্বর ঘরটাই খালি আছে। হোস্টেল পাওয়ার প্রায় এক মাস বাদে এসেছি। আসলে এখানে যে থাকবো সেটা ঠিক করতে পারিনি আগে। বোটানি তে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি। দেরিতে আসার ফলে অনেক কথাই শুনতে হলো মেট্রনের কাছে। প্রথমে তো শুনেছিলাম ঘর খালি নেই। তারপর আমরা অনেকদূর থেকে এসেছি শুনে মেট্রন বললেন, বিভিন্ন কারণে ওই ঘরটায় কেউই থাকতে চায়না। ঘরটা তালা বন্ধ রাখা হয়েছে।

এতদূর থেকে এসে চলে যাবো? কারণ জানতে চাইলাম। মেট্রন একটু বিরক্ত হয়েই বললেন যে ঘরটার কন্ডিশন ভালো নয়। বহুদিন ওখানে কেউ থাকেনি। আর তাছাড়া যারা নতুন হোস্টেল-এ আসে তারা ডরমেটরি তে থাকে ২০ জন বা ১০ জন একসঙ্গে। কখনো কখনো ৫ জন একসঙ্গে। সিঙ্গেল রুম প্রথমেই দেওয়া যায়না। আমি অনেক জোরাজুরি করে ওই তিনতলার ঘরের চাবিটা চেয়ে নিলাম। রেসাল্ট মোটামুটি ভালোই ছিল তাই আমাদের ডিপার্টমেন্ট-এর হেড কে অনুরোধ করে ওই ঘরেই থাকার ব্যবস্থা করলাম।

চারতলা হোস্টেল। তিনতলায় ঘরটা। ঘরটা বেশ বড়। সামনে টানা বারান্দা। দুই প্রান্তে দুটো ডরমেটরি। আর বারান্দার ঠিক মাঝখানে ওই ঘরটা। এমনি দেখতে মন্দ নয়। বাগানের দিকে একটা জানলা খোলা। ঘরটার কন্ডিশন ভালো নয় সেটা সত্যি। দেওয়ালগুলোর রং উঠে গেছে। ঘর ভর্তি ঝুল, ইঁদুর, মাকড়শা, টিকটিকি। আগে ঘরটা লছমী দিদিকে ভালো করে পরিষ্কার করতে বললাম।

ঘর পরিষ্কার করতে করতে লছমী দিদি বলছিলো, “ই ঘর বহত খারাব আছে দিদি। এ ঘর বন্ধ ছিল তিন সাল।”

“সেজন্যই একটা ভ্যাপসা গন্ধ,” আমি বললাম।

লছমী দিদি চলে যাওয়ার পরে রুম ফ্রেশনার কিনে আনলাম একটা। ভালো করে চারদিকে স্প্রে করলাম। ভ্যাপসা গন্ধটা যদিও যায়নি। কিন্তু কিছুদিন রোদ হাওয়া পেলেই ঘরটা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নিজের মনকে আশ্বস্ত করলাম।

সেইদিন সন্ধ্যে বেলা কিছু সিনিয়র দিদিরা দেখা করতে এলো।

—“এই যে নতুন মেয়ে। সামনে শনিবার সন্ধ্যেয় বড় হল ঘরে চলে আসবে। তোমার পরীক্ষা আছে।”

—“কীসের পরীক্ষা?”

—“সব নতুন মেয়েরা যে পরীক্ষা দেয় এখানে সেই পরীক্ষা।”

বুঝলাম এরা খুব একটা সুবিধের নয়। সামনে শনিবার আমার বাড়ি ফেরার আছে। ওদের সেকথা খুলে বললাম না।

বাড়ি থেকে ফিরে এলাম রবিবার রাতে। সোমবার থেকে আবার কলেজ। ফিরে এসে শুনলাম সিনিয়ররা নাকি দারুণ রেগে আছে আমার ওপরে। পাশের ডর্মেটরির সোমলতা, পিয়াসী এরা সবাই একই কথা বললো। যাই হোক আমি এখানে পড়াশোনা করতে এসেছি। সিনিয়রদের হুকুম তামিল করার জন্য নয়।

তারপর দু’দিন কেটে গেলো। এই দু’দিন ঘর সাজাতে গোছাতেই আমার সময় কেটেছে। গড়িয়াহাট মোড় থেকে একটা বড় আয়না কিনেছি। দু’তিনটে বিছানার চাদর কিনেছি দরদাম করে। এখানে রাত আটটায় খাবারের ঘন্টা বাজে। থালা আর ঘি, আচারের শিশি সঙ্গে করে নিয়ে যাই। মাঝে মাঝে ফ্লাস্কটাও। নিচের থেকে গরম জল ভরে আনি। রাত্রে মাঝে মাঝে কফি করে খাই। নতুন জায়গা। অনেক রাত অব্দি ঘুম আসেনা। পড়াশোনা করি। অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমার ভালো আলাপ নেই। আমি আসলে চট করে কারোর সঙ্গে মিশতে পারিনা। একা একাই চলাফেরা করি। আমার কোনো ভাই বোন নেই। বাড়িতেও একা একাই বড় হয়েছি আসলে।

লছমী দিদি রোজ আমার ঘরে ঝাঁট দিতে আসে। একদিন ঘর মুছতে মুছতে বললো, “বহত বুড়া ঘর হ্যায় ইয়ে।”

প্রশ্ন করলাম, “কেন?”

“সে সব আমার শুনা কথা। আমি তো কাজে লেগেছি এক সাল হলো। আগে এ ঘরে কুছু বহত খারাব চিজ হয়েছে, এ ঘর মে আগ লগা থা বহত সাল পহেলে। দিবার কালা পড় গেয়া ইসলিয়ে। এ ঘরে আপনি থাকবেন না দিদি।”

এখানে আসার পর থেকে কেমন যেন মনে হচ্ছে এই ঘর, সামনের বারান্দায় আরও কেউ থাকে।

সেদিনটা ছিল কোনো একটা সোমবার। আমার কলেজের ক্লাসরুম থেকে আমার হোস্টেলের ঘরের জানলাটা দেখা যায়। ক্লাসের মাঝে হঠাৎ দেখলাম আমার ঘরের জানলা দিয়ে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। আমি প্রথমে খেয়াল করিনি। আমার ব্যাচের দিশাই দেখালো। চরম আতঙ্কে পড়ি কি মরি করে ছুটলাম। তিনতলায় ঘর। দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি গুলো বেয়ে উঠতে লাগলাম। ঘর তালা বন্ধ। ব্যাগ থেকে চাবি বের করে তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম সব কিছু যেমন কে তেমনই আছে। কোনো আগুন নেই। তাহলে কি আমার মনের ভুল? কিন্তু একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। ঘরের বাতাস এরকম গরম কেন? শুধু তাই নয়, বাতাসে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।

সেদিন কলেজ-এ ফিরিনি। বিকেলের টিফিন খেয়ে আবার ঘরে ফিরে এসেছিলাম। পোড়া গন্ধটা আর ছিলোনা। ঘরের বাতাসও স্বাভাবিক।

তারপর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। প্রায়ই রাতে আমার ঘরের দরজায় কে নক করে। দরজাটা খুলে আর কাউকে দেখতে পাইনা। একদিন দেখেছিলাম এক সিনিয়রকে করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে। আরেকটা ঘটনা কিছুদিন পরেই ঘটলো। দিনটা রবিবার, কলেজ ছিলো না। স্নান সেরে ঘরে ঢুকতেই দেখি পুরো ঘরময় হেনার গন্ধ। যেন কেউ হেনা শ্যাম্পু ব্যবহার করেছে। আমি তো এই গন্ধের শ্যাম্পু ব্যবহার করিনা। গন্ধটা এলো কোথা থেকে এমন ভাবছি। হঠাৎ চোখ পড়লো আয়নার সামনে একটা চিরুনি রাখা। সেটা আমার চিরুনি নয়। বেশ পুরোনো কাঠের চিরুনি। কয়েকটা চুল আটকে আছে তাতে। মাথা নিচু করে ভালো করে চিরুনিটা হাতে নিয়ে দেখছি যেন মনে হলো পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ঘাড়ে তার নিশ্বাস পড়ছে। সামনে রাখা আয়নায় কার ছায়া। পেছনে ফিরতেই কাউকে দেখতে পেলাম না। দরজা দিয়ে একটা দমকা হাওয়া এলো পেছনের জানলাটা হঠাৎ দুম করে বন্ধ হয়ে গেলো। আমার শরীরে একটা শিরশিরে কাঁপন ধরানো অনুভূতি হতে শুরু করলো। আমি মনে মনে যুক্তি খাড়া করলাম সবই আমার মনের ভুল। সিনিয়র-দের ই কারচুপি এইসব আমাকে ভয় দেখানোর জন্য। মনের ভয়টাকে রাগে পরিবর্তন করে তখনই হোস্টেল সুপার-এর কাছে অভিযোগ করবো মনস্থ করলাম। হোস্টেলের নতুন সুপার ম্যাম কয়েক মাস হলো এসেছেন। তিনি কমবয়সী হলেও তাকে এমনিতে সকলেই ভয় পায়। আমার সব কথা শোনার পর ওঁকে একটু বিচলিত দেখালো। সিনিয়র দিদিদের উনি কমন রুমে ডেকে পাঠালেন। সবাই সেখানে জড়ো হলে, উনি বললেন, যে বা যারা আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে তারা যেন আজকের মধ্যে ওঁর ঘরে এসে সেটা স্বীকার করে। নইলে উনি অভিভাবকদের কল করতে বাধ্য হবেন। আর প্রিন্সিপালকেও জানাবেন। এই হোস্টেল-এ এই রকম ব্যবহার একেবারেই চলবেনা।

সুপারের ধমকে কাজ হয়েছিল। তনিমাদি আর শ্রীতমাদি নিজের দোষ স্বীকার করে। লছমী দিদিকে কিছু টাকা দিয়ে ওরাই আমাকে ভয় দেখানোর জন্য গল্প বলতে বলে। ওই ঘরে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো ঠিকই আর তা নিয়ে অনেকের ভয়, কুসংস্কার আছে। সেটারই সুযোগ নিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা। ঘরের যে তালা আমাকে দেওয়া হয়েছিল তার একটা ডুপ্লিকেট চাবি মেট্রনের কাছে থাকে। সেটা ওরা কোনোভাবে সরিয়েছিলো। সেদিন ওরা আমার ঘরে কাগজ পুড়িয়েছিল আর আমার ক্লাসের দিশাকে বলেছিলো বিশেষ সময়ে আমাকে জানলা দিয়ে ধোঁয়ার দৃশ্যটা দেখাতে। এছাড়া ওই চিরুনি রেখে আসা দরজায় ধাক্কা দেওয়া সব ওদেরই কাজ। কিন্তু একটা খটকা মন থেকে গেলো না। সেটার কথা ম্যামকে বলিনি। একটা ডাইরি পেয়েছি খাটের তলায়। তাতে পাতার পর পাতা একজনের মনখারাপের দিনলিপি। এটাও কি মিথ্যে? সাজানো?

ডাইরিটা আমি কয়েকটা পাতা পড়েছি। আবার রাত্রিবেলা ওটার অমোঘ আকর্ষণ আমাকে পেয়ে বসলো।

প্রত্যেক পাতায় তারিখ দিয়ে লেখা

“৬ নভেম্বর ১৯৯০

আমার কিছু ভালো লাগছে না। বাড়িতে ফোন করলেই সেই এক কথা শুনতে হয়। দিদি স্কলারশিপ পেয়েছে। দারুণ রেসাল্ট করেছে। আর তুই? এবার মিডটার্ম-এ এতো কম নম্বর । আমাদের মান সম্মান সব ডুববে তোর জন্য। এতো খরচ করে হোস্টেল -এ রেখে পড়ানো হচ্ছে তোকে। আমার খুব কান্না পাচ্ছে, খুব কান্না পাচ্ছে। আমাকে কেউ ভালোবাসে না”

পাতার পর পাতা সেই এক মন খারাপের কথা। পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেলো। দেখি ঘরের লাইট অফ হয়ে গেছে। তবে কি লোডশেডিং? কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো দেখা যাচ্ছে। গা টা ছম ছম করে উঠলো। ক’টা বাজে এখন? মোবাইল-টা হাতে নিয়ে দেখলাম রাত ১২ টা। দরজাটা বন্ধ ছিল। দরজায় একটা মৃদু ঠকঠক করে টোকা দেওয়ার আওয়াজ হলো। ঘরের লাইটটা জ্বালানোর চেষ্টা করলাম। জ্বললো না। হতবুদ্ধির মতো মোবাইলটা হাতে নিয়ে দরজাটা খুলে দেখলাম সেই কয়েকদিন আগে দেখা সিনিয়ারটিকে। ফর্সা গায়ে কালো নাইটি। করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি পেছন পেছন এগোলাম। সব কিছুর একটা সীমা আছে। সে এগিয়ে গেলো বাথরুমের দিকে আমিও তার পিছু পিছু এগোলাম। বাথরুমের বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বললাম, “তোমরা আবার এইসব উৎপাত শুরু করেছো। আমি এবার ডাইরেক্ট প্রিন্সিপালের কাছে যাবো।”

সে আমার দিকে না তাকিয়েই আস্তে আস্তে বললো, “অন্যের ডাইরি পড়তে নেই।”

আর আমাকে চমকে দিয়ে তার মাথা আমার দিকে ঘুরে গেলো শরীরটা স্থির রেখেই। আমি চিৎকার করে উঠতেই দেখি আমি আমার ঘরেই বসে আছি কোলের ওপর সেই ডাইরিটা।

পরের দিনই আমি অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করি। সেই ডাইরিটা আমি যেখান থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম সেখানেই রেখে দিয়েছিলাম। পরে শুনেছিলাম ওই তিনতলার ঘরে কী করে যেন আগুন লেগে গিয়ে একজন ছাত্রী মারা যায় অনেকদিন আগে। সেই দুর্ঘটনা ইচ্ছাকৃত কি-না তা অবশ্য জানা যায়নি। ওই তিনতলার ঘরে থাকার সময় যেন প্রতি মুহূর্তে মনে হতো কোনো অদৃশ্য মনখারাপের চিহ্ন লেগে আছে ঘরটায়। এখানে যেন অন্য কেউ থাকে। আমি ভুল করেই ঢুকে পড়েছি তার জায়গায় যে কিনা খুব একা, পৃথিবীতে যাকে কেউ ভালোবাসেনা। এর পর আর কারোর ডাইরি কোনোদিন পড়িনি।