নীলগিরির বাঘ - মিলন গাঙ্গুলী

মোটা টিনের একটা তোরঙ্গের মধ্যে বেশ কিছু বই ছিল।

পারিবারিক সম্পত্তি। ওখানেই পেয়েছিলাম বইটা। নাম – ‘বাঘের আত্নহত্যা’। লেখক রামেন্দ্র দেশমুখ্য। ১৯৬৪ সালের ছাপা। কোলকাতার কোন এক প্রকাশনী থেকে। ঠিক মনে পড়ছে না কোন প্রকাশনী। ভেতরে কাঠের ব্লকে ছাপা দারুণ কিছু ছবিও ছিল। পাতাগুলো ধূসর হয়ে তেজপাতার মত হয়ে গেছে।

অলস দুপুরে বইটা নিয়ে বসলাম।

এবং হারিয়ে গেলাম দফলার জঙ্গলে। ডুয়ারসের বনে। কী মনমাতানো বর্ণনা। শীতের রাতে জঙ্গলের জোছনায় ভেসে যায় চারিদিক। জলের পিপাসায় বাঘ চলে আসে বাড়ির উঠানের কুয়ার কাছে। শাল বনের ভেতর থেকে নেমে আসে পাগলা হাতি।

বন-জঙ্গল আর বুনো জীবজন্তু নিয়ে লেখা কোন বই এই প্রথম পড়লাম। বাইরে তখন হলুদ রঙের গাঢ় রোদ। দূরের বন পাহাড়ে হারিয়ে গেছে আমার মন। সব ছেড়েছুড়ে আমারও চলে যেতে ইচ্ছা করছিল দফলার জঙ্গলে।

যেখানে পথের ধারে এমনিতেই হয়ে থাকে গাব গাছ। কোন এক মৌসুমে রক্ত চুনির মত লাল আর পান্নার মত সবুজ কাঁচা পাকা গাব ধরে থাকে। সাপের মাথার মণির খোঁজে চলে আসে সাপুড়ে। কুট্টি মামা শীতের সন্ধ্যায় বসে লেখককে আফ্রিকার গল্প শোনায়।

ক্লাস সিক্সের লাস্ট বেঞ্চির ছাত্র আমি। এই সব বই পড়ে বুকের ভেতরে কেমন এক উসকো খুশকো অনুভূতি জন্মায়।

কিছু বই আমার ভেতরে দাগ কেটে যায়। বদলে দেয় চিন্তা চেতনা আর পছন্দ। বাঘের আত্নহত্যা বইটা তেমন একটা বই। তারপর আগাড়ে বাগাড়ে যত শিকার কাহিনি আর জঙ্গলের জার্নাল টাইপের বই পেয়েছি সব পড়েছি। বিভূতিভূষণের আরণ্যক পড়ে ভাল লাগায় মন আছন্ন হয়ে গেছে। পড়েছি ‘বাঘের মন্তর’ বইটা।

জিম করবেট আর কেনেথ অ্যান্ডারসনের সবগুলো শিকার কাহিনি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অথচ আরও অনেক শিকার কাহিনি রয়ে গেছে ক্লাসিক সাহিত্য হিসাবে। যেগুলোর বেশির ভাগই আজ কাল আর বাজারে পাওয়া যায় না।

আমার অনেক পছন্দের গল্পটা বিখ্যাত শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসনের। আজ সেটাই বলি-

নীলগিরি পাহাড়ের নিচেই ছিল ইয়া বড় এক কলা বাগান। বাগানটা কত বড় সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না।

জায়গাটার নাম উটাকামণ্ড। এখানে একটা কলা বাগানের মালিকের নাম কান্ত। সন্ধ্যা বেলায় বাগানে বসে হাওয়া খাচ্ছিল বেচারা।

সেই দিনের আবহাওয়াটা বেশ দারুণ।

তখনই তার সামনে এসে দাঁড়ালো এক সাধু বাবা। নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায় সাধু। এই কলাবাগানে তিন দিন থাকতে চায় সে। বাগানের সাথে যে ঘাসের তৈরি কুঁড়ে ঘরটা আছে। সেখানেই থাকবে। তিন দিন পর নীলগিরির ওখানে চলে যাবে। কোন গুহা পেলে ওখানেই বসে ধ্যান করবে সে।

সাধু বাবাকে দেখে খুশি হল কান্ত। মাখন কলা আর শরবত দিল সাধুর সেবায়। সাধু রয়ে গেল।

সাধু ওখান থেকে চলে যাবার কোন নামই করে না। বেশ আয়েশেই আছে সে। বিপদ যে শুরু হতে যাচ্ছে কেউ জানে না।

সাধু একদিন কান্তকে ডেকে বলল, এই কলা বাগান জায়গাটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। আরও কিছুদিন এখানেই থাকতে চায়। কান্ত যদি সাধুকে সেবা করে তবে সাধু খুশি হয়ে তাকে ইচ্ছাপূরণ বর দেবে।

কান্ত খুশি হয়ে আরও লোকজন ডেকে সাধুর জন্য একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে দিল।

চারিদিকে সুন্দর কলা গাছের বাগান। মাঝে সাধুর কুটির।

একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল সন্ধ্যা থেকে সারা রাত কুটিরের ভেতরে একটা প্রদীপ জ্বলে। সারা রাত প্রদীপ জ্বেলে সাধু কী করে? একদিন এক লোক চুপি চুপি গিয়ে উঁকি দিল কুটিরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে। কি কাণ্ড! ভেতরে সাধু নেই। কই গেল সে?

লোকটা অপেক্ষা করতে লাগল।

অনেকক্ষণ পর খুব কাছেই বিকট শব্দে বাঘের গর্জন শোনা গেল। ভয়ে লোকটার পিলে চমকে গেল।

উথাল পাথাল হয়ে পালাতে যাবে ঠিক তখনই দেখতে পেল কুটিরের পিছন থেকে পা টিপে টিপে সাধু বাবাজি আসছে।

পরদিন সারা গ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়লো। যে সাধু রাতের বেলা বাঘের কাছে গিয়ে দেখা করে আসে সে নিশ্চয়ই ভয়াল ক্ষমতাধর কোন সাধুই হবে।

আর সেই রাতেই পর থেকে রোজ রাতেই বাঘের গর্জন শোনা যেতে লাগল। পুরুষ বাঘের গর্জন। অন্ধকার রাতগুলোতে পাগলের মত ডাকে বাঘটা।

আরও অবাক কাণ্ড। সাধুর কুঁড়ের আশেপাশের নরম মাটিতে রোজই বাঘটার পায়ের ছাপ পাওয়া যেতে লাগল। পরিষ্কার ছাপ। তবে কেউ কোন দিন বাঘটাকে দেখেনি।

সেই কলা বাগানের আশেপাশে নানা রকম আদিবাসীরা থাকতো। তাদের মধ্যে ইরিলা নামের আদিবাসিরাই বেশি। ওরা গরু চরাতো, মোষ পালত, ঘন ঘাসের দঙ্গল পার হয়ে জঙ্গলে গিয়ে বাঁশ, কাঠ আর বুনো তেঁতুল সংগ্রহ করে আনত। কিছু জমিদার ছিল। তারাও গরু পালত।

তাদের রাখালরা ঘাসের বনে গরু চরাতে গিয়ে রোজই বাঘের ছাপ দেখত। সাবধানে থাকতো সবাই। সত্যি যদি বাঘ থাকে তবে দিনের বেলাতেই আক্রমণ করে বসবে গবাদি পশুর উপর। আদিবাসী একজনের নাম বুদিয়া। বেশ কয়েকটা গরু আছে ওর। একদিন খেয়াল করলো বাদামী রঙের গরুটা খুঁজে পাচ্ছে না। গেল কোথায়? ভাল মত খোঁয়াড়টা খোঁজ নিল। আদিবাসীদের খোঁয়াড়গুলো পাঁচ ফুট উঁচু মোটা কাঠের গুড়ি দিয়ে বানানো। বাইরে আবার ঘন কাটা গাছের লতানো ঝোপ দিয়ে ঘেরা। বুদিয়ার খোঁয়াড়ের কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু চারিদিকের নরম মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গেল কয়েক জায়গায়।

অনেক বার চক্কর দেয়ার পর বুদিয়া বুঝতে পারলো, খোঁয়াড়ের যেই দিকের বেড়া সবচেয়ে নিচু সেখান দিয়েই টপকে ভেতরে ঢুকেছে বাঘটা।

খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই নতুন করে তক্তা দিয়ে খোঁয়াড়ের দেয়াল উঁচু করতে লাগল।

তবে এরই মধ্যে আরও কয়েকটা গরু চুরি গেল। আদিবাসীরা ভয় পেয়ে গেল। বাঘটার আচরণ কেমন যেন। দিনের বেলায় কখনও কেউ বাঘটাকে দেখেনি। অতীতেও এই এলাকায় বাঘ বা চিতা এসে আক্রমণ করেছে কিন্তু এই বাঘটার মত রহস্যময় আচরণ করেনি। এতগুলো গরু হারিয়ে গেল কিন্তু বাঘটার পায়ের ছাপ ছাড়া আর কিছুই কখনই দেখেনি কলাবাগানের আদিবাসীরা।

আর এর মাঝে মস্ত এক ঘটনা ঘটে গেল।

এই বাগানগুলোতে একটা হাতি এসে কলা গাছ ভেঙ্গে নষ্ট করে যেত। কিন্তু হাতি মারা বেআইনি। তাই সবাই সহ্য করতো হাতির যন্ত্রণা। এইবার কান্ত ওর পুরানো আমলের বন্দুক নিয়ে রাত জেগে বসে রইল হাতি মারার জন্য। বাগানের এক কোণে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইল কান্ত। আকাশে অর্ধেক চাঁদ। খেয়ে ফেলা ময়দার বিস্কুটের মত। চারিদিকে কলা গাছের ঝাড়। দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।

কান্ত বসে আছে। পাজি হাতিটা এলেই গুলি করে মারবে। এমন সময় বাঘের গর্জনে চারিদিক কেঁপে উঠলো। হায় হায় করে উঠল কান্ত। এ আবার কী বিপদ।

হঠাৎ করেই কান্ত দেখতে পেল আবছা অন্ধকারে বাঘটা গুঁটি গুঁটি করে এগিয়ে আসছে বাগানের দিকেই। পুরানো বন্দুকটা তুলে গুলি করে বসলো কান্ত। গুলি লাগলো কি না কে জানে। কিন্তু বিকট শব্দ করে বাঘটা লেজ তুলে পালাল। কান্তও বন্দুক বগলে তুলে দৌড়ে নিজের কুঁড়ে ঘরে চলে এলো।

এমন ভয়াল রাতে কলা বাগানে বসে থাকার কোন মানেই হয় না।

কান্তর এক ছেলে ছিল। নাম জানি না। কেনেথ অ্যান্ডারসন সাহেব ছেলের নাম বলেননি। সেই ছেলেটা প্রতেকদিন সকালে সাধু বাবাকে জল খাবার দিত। রোজ সকালের মত আজও কান্তর ছেলে সাধু বাবার জন্য জল খাবার নিয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কা দিল ছেলে। সাধু দরজা খোলে না। এমন সময় নজরে পড়লো দরজার সামনে কালো কীসের যেন দাগ দেখা যাচ্ছে। একটু পরীক্ষা করেই ছেলে বুঝতে পারলো, শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ এটা।

দরজার সামনে রক্তের দাগ দেখে কান্তর ছেলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হয়েছে সাধুর। আরও কয়েকবার ডাকল সাধুকে। কুঁড়ে ঘরের ভেতর থেকে সাধু বকা ঝকা করতে লাগল ছেলেকে। ছুটতে ছুটতে ছেলে হাজির হল বাবার কাছে।

সব শুনে কান্ত অবাক। কেন যেন গত রাতের কথা মনে পড়ে গেল।

নিজেই চলে এলো সাধুর কুঁড়ে ঘরের সামনে। সত্যি তাই। কুঁড়ে ঘরের দরজার সামনে মেরুন রঙা আপেলের খোসার মত রক্তের শুকনো দাগ দেখা যাচ্ছে। কয়েকবার দরজায় নক করলো কান্ত।

সাধু বাবা দরজা খোলে না। বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতে যাবে ঠিক তখনই দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো সাধু। ভয়ঙ্কর রেগে আছে।

সাধুর বা হাতে একটা পুরানো কাপড় প্যাঁচানো। রক্তের দাগ লেগে আছে তাতে।

দেখেই কান্তর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। আর সাধু কেমন চোখে যেন চেয়ে আছে কান্তর দিকে।

খেঁকিয়ে উঠলো সাধু, ‘উঁকি দিয়ে দেখতে চেয়েছিলি আমি কী করছি? যা ভাগ এখান থেকে।’

ভয়ে দৌড় দিল কান্ত।

কয়েকদিন পর মস্ত এক ঘটনা ঘটে গেল।

এক রাখাল মোষ চড়াছিল। বেশ বুনো আর নিঝুম পরিবেশ। চারিদিকে তকতকে সবুজ ঘাসের বন।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। সূর্যটার রঙ হয়ে গেছে মসুরি ডালের মত। পশ্চিম আকাশে চলে গেছে ওটা। রাখাল ছেলেটা বাড়ির পথ ধরল। চারিদিকে লম্বা লম্বা ঘাসের স্তূপ। ওর ভেতর থেকে হঠাৎ করেই বের হয়ে এলো বাঘটা। ঝাঁপ দিয়ে পড়লো রাখাল ছেলেটার উপর। কীভাবে যেন নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ছেলেটা। দৌড়ে ঢুকে পড়লো মোষগুলোর ঠিক মাঝখানে। আর মোষগুলো এক কাণ্ড করল। ছেলেটাকে গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লো। মোষগুলোর সবার বিশাল সব শিঙ আছে। সবাই মিলে তেড়ে আক্রমণ করলো বাঘটাকে। অবস্থা ভাল না দেখে চম্পট দিল বাঘটা।

মাঠে পড়ে রইলো রাখাল ছেলে। সারারাত। আর মোষগুলো গোল হয়ে ঘিরে সারা রাত পাহারা দিল ওদের রাখাল বন্ধুকে।

পরদিন কয়েকজন রাখাল ছেলেটার খোঁজে গেল।

সারারাত বাড়ি ফেরেনি। চিন্তার কথা। মাঠের মধ্যেই পেল ওকে। হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতাল মেলা দূর। ওখানেই রওনা হল সবাই। পথের মধ্যেই মারা গেল ছেলেটা। দুঃখজনক। সারারাত খোলা মাঠে বাঘের ভয়ে কেটেছে ওর। মরার আগে না জানি কত কষ্ট পেয়েছে বেচারা।

দিন কয়েক সব চুপচাপ।

এক সন্ধ্যে বেলা মাথায় ঘাসের বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরছিল এক ইরিলা। মানে আদিবাসী। হঠাৎ দেখতে পেল পথের এক কোণায় ঝোপের আড়াল থেকে দৌড়ে ভাগছে এক ময়ূর। নিশ্চয়ই ময়ূরের বাসা আছে ওখানে। ময়ূরের বাসায় খুঁজলে ডিম পাওয়া যেতে পারে। ভেবে ঘাসের বোঝা রেখে সামনে এগিয়ে গেল সে।

মাত্র কয়েক কদম গিয়েই দেখে ঝোপের মধ্যে বসে আছে মস্ত এক বাঘ। চেয়ে আছে ওর দিকেই।

পাই করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিল লোকটা।

বাঘের সাথে দৌড়ে পারবে কেন? মাত্র কয়েক গজ দৌড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বাঘটা ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর।

মারা গেল লোকটা। ওর শরীরের সামান্য মাংস খেয়ে চলে গেল বাঘটা।

গ্রামের লোকজন পরদিন সকালে লাশটা খুঁজে পেল।

ভয়ে সবার গলা শুকিয়ে গেল।

এতদিন গরু মেরে খাচ্ছিল। এইবার মানুষ মারা শুরু হয়েছে। বিপদ আর কাকে বলে।

গোপনে সবাই আলোচনায় বসলো। কী করা যায়। আলোচনার মধ্যে কে যেন ফস করে বলে বসলো, ‘এই বাঘটা আসলে বাঘ না। সেই সাধু বাবাজি। সারাদিন সাধু থাকে। আর রাতের বেলা বাঘ হয়ে ঘুরে বেড়ায়।’

সবাই কিন্তু বিশ্বাস করলো কথাটা।

আরও কাণ্ড দেখ, যে লোকটা মারা গেছে, সে সব সময় সুযোগ পেলেই সাধুর কুঁড়ে ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিত।

সব আদিবাসীরা এক সাথে জড়ো হলো।

ভয়ে ভয়ে গিয়ে হাজির হল সাধু বাবার কাছে।

হাউ মাউ করে কেঁদে কেঁদে সবাই বলল, দয়া করে আমাদের ক্ষমা করে দিন। আর নিতান্ত মাংস যদি খেতেই হয় তবে অন্য কোথাও চলে যান। দূরে একটা গ্রাম আছে কারুম্বা। ওখানে প্রচুর গরু আছে। ইচ্ছা মত খেতে পারে সাধু।

সাধু দয়ালু একটা ভঙ্গিতে সবার কথা শুনল। শেষে বলল, যদি তাকে তিন বেলা খাবার আর মাসে একশো রুপী করে দেয়া হয় তবে মানুষ বা গরু খাওয়া বন্ধ করতে পারে।

আদিবাসীরা গরিব। টাকা পয়সা ওদের হাতে থাকে না তেমন। তবু সবাই মিলে রাজি হল মাসে একশো রুপী করে সাধু বাবার হাতে তুলে দেবে।

এছাড়া উপায় কী?

কিন্তু প্রথম কিস্তির টাকা দিতে ব্যর্থ হল।

আদিবাসীরা কিছু দিতে পারলো। কিন্তু পুরোপুরি একশো রুপী না। আগেই বলেছি ওদের অবস্থা খুব খারাপ।

টাকা দিতে না পারায় ভীষণ রেগে গেল সাধু। আর কী কাণ্ড! ঠিক চারদিন পর একজন লোক মারা গেল বাঘের হাতে।

ভাবতে অবাক লাগে সেই লোকটা সাধুকে টাকা দেবে বলেও দেয়নি।

আতঙ্ক নেমে এলো কলাবাগানে।

মারটিন ম্যাটসেল নামে এক ভদ্রলোক এই অদ্ভুত ঘটনার কথা কীভাবে যেন শুনেছিলেন।

তিনি আবার শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসনের বন্ধু। তক্ষুনি চিঠি লিখে দিলেন শিকারি বন্ধুকে।

আর চিঠি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কলাবাগানে চলে এলেন শিকারি কেনেথ।

 

গ্রামের কাছাকাছি যখন পৌঁছলেন তখন সূর্য গড়িয়ে রাত নেমে গেছে। কলাবাগানে পৌঁছা মাত্র এক গাইড পেয়ে গেলেন কেনেথ অ্যান্ডারসন। নাম - বুরা। লোকটা বেশ মুরুব্বী। শিকারিকে নিয়ে সেই রাতে জঙ্গলের ভেতরেই বিরাট এক আমগাছের তলায় আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে বসলো দুইজন। সাধু বাবার সব গল্প কেনেথকে খুলে বলল বুরা।

চারিদিকে ঘন জঙ্গল। বেশ শীত পড়েছে। বহু দূরে হাতি বাঁশ ঝাড় ভাঙছে। বুরা সাধুর গল্প বলছে আর মাঝে মাঝেই চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

কারণ কী জানতে চাইলেন কেনেথ।

বুরা বলল, সাধু নাকি সব শুনতে পায়। তার বেশ ক্ষমতা আছে। যেখানেই থাকুক এই মুহূর্তে কেনেথ আর বুরার কথা সব শুনতে পাচ্ছে।

ঠিক তখনই দূরে একটা বাঘ গর্জন করে উঠল।

বাঘের গর্জন শুনে বুরা ভয়ে প্রায় মারাই যায়।

কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘সাহেব ঐ তো। সাধু সব শুনে ফেলেছে। দেখলেন কেন তর্জন করে বুঝিয়ে দিল!’

বাঘের ডাক আরও শুনেছেন কেনেথ। কিন্তু এই প্রথমবার গা ছমছম করে উঠলো। সারা শরীর ঘেমে উঠল।

নিজেকেই তিরস্কার করলেন। এইভাবে গভীর মনোযোগ দিয়ে বুরার গল্প শোনা ঠিক হয়নি।

মানুষ কখনও বাঘ হতে পারে না।

পয়েন্ট ৪০৫ রাইফেলটা তুলে নিলেন। বাম হাতে তিন ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে চারিদিক ভাল করে দেখে নিলেন।

কোথাও কোন রকম নড়াচড়ার চিহ্ন নেই।

আরও কতগুলো শুকনো ডাল পালা ফেলে দিলেন আগুনের মধ্যে।

লক লক করে লাফিয়ে উঠলো আগুনের শিখা। যে পরিমাণ শুকনো কাঠ আছে তা দিয়ে বেশিক্ষণ চলবে না।

কিন্তু রাত শেষ হতে এখনও অনেক অনেক দেরি।

আরও একবার ডেকে উঠল বাঘটা। ঠিক তাদের পিছনে।

এত জলদি কীভাবে পিছনে চলে গেল বাঘটা ভেবে দিশেহারা হয়ে গেলেন কেনেথ।

আগুনের আরও কাছ ঘিরে বসে রইল কেনেথ আর বুরা।

চারিদিক নিঝুম। কোন শব্দ নেই। আগুনের কুণ্ডটা কোন মতে জ্বলছে। গাছের পাতার শব্দ শুনলেও ভয়ে চমকে উঠছেন কেনেথ। মনে হচ্ছে খুব কাছেই বোধ হয় এসে পড়েছে বাঘটা। আচমকা লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে। বুরার অবস্থা আরও খারাপ। ভয়ে শ্বাসও নিচ্ছে না। যেন যত চুপচাপ থাকা যায় ততই ভাল।

বহু দূর থেকে শম্বরের ডাক শোনা গেল। তারপর হাতি দৌড়ে পালাল আরেক দিক থেকে।

তার মানে, বাঘটা শিকারি আর তার সঙ্গীকে ঘিরে চক্কর খাচ্ছে।

মাঝরাতের পর আকাশে ময়লা মত চাঁদটা উঠলো। সেই আলোতে জঙ্গল কেমন রহস্যময় আর ভৌতিক মনে হতে লাগল।

রাত কখনই এত লম্বা মনে হয়নি কেনেথের কাছে।

হঠাৎ ময়ূরের ডাক শোনা গেল। সকাল হয়ে আসছে।

গোলাপি রঙের হয়ে গেল পুবের আকাশ। জঙ্গলের ভেতরে জেগে উঠলো বনমোরগ আর পাখ-পাখালি।

সারারাত না ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন কেনেথ। ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে নিলেন। সাথে স্যান্ডউইচ।

বুরার ঘুম ভাঙতেই পিটপিট করে শিকারির দিকে তাকাল।

‘তোমরা অনেক বোকা,’ বললেন কেনেথ। ‘সাধু বাবা তোমাদের মিথ্যা ভয় দেখায়।’

হেঁটে গিয়ে হাজির হলেন সাধু বাবার কুঁড়ে ঘরে। দরজায় ধাক্কা দেয়ার সাথে সাথেই ভেতর থেকে বের হয়ে এলো সাধু।

হাসি মুখে কেনেথকে বলল, ‘কাল রাতে আগুনের পাশে বসেছিলে দুই জনে। একজনকে ধরে রাতের খাওয়া শেষ করতে পারতাম। কিন্তু মত বদলে একটা সম্বর দিয়েই খাওয়া শেষ করতে হল।’

সাধু বাবার কথা শুনে কেমন যেন তম্বা হয়ে গেলেন কেনেথ।

বুঝতে পারলেন কাল রাতে এই ভণ্ড সাধু দূর থেকে তাদের দেখেছে।

‘তুমি আসলে একটা ফালতু ধরনের মানুষ,’ বললেন কেনেথ। ‘গ্রামের সহজ সরল মানুষদের খামোখাই ভয় দেখাও। অত সহজে আমাকে ভয় দেখাতে পরবে না।’

‘একটু সাবধানে থেকো শিকারি সাহেব।’ খ্যাঁকরে গলায় বলল সাধু।

‘তুমিও সাবধানে থেক,’ বিরক্ত হয়ে বললেন কেনেথ। ‘তোমাকে রাইফেলের সামনে পেলেই গুলি করে বসব।’

‘সে রকম কিছু ঘটার আগেই বাঘের হাতে মারা পড়বে তুমি।’ বলেই ঝুপ করে দরজা বন্ধ করে দিল সাধু।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে চলে এলেন শিকারি। মনে মনে ভাবছেন, এক চড় দিয়ে সাধুর সবগুলো দাঁত ফেলে দিতে পারলে ভাল হত।

সেটা সম্ভব না। তবে শিকারি কেনেথের জায়গায় আমি হলে তাই করতাম।

 

সাধুর কুঁড়ের পাশেই বাঘের পায়ের ছাপ পেলেন তিনি।

ফিরে এলেন সেই আম গাছের তলায়। বিছানা করে ঘুমানোর আয়োজন করলেন। ঘুমের মধ্যে বার বার স্বপ্ন দেখলেন একটা বাঘ হাসতে হাসতে তার দিয়ে গুঁটি গুঁটি পায়ে এগিয়ে আসছে।

বাঘের মাথাটার জায়গায় সাধুর মুখ। কী বিচ্ছিরি স্বপ্ন !

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছেন কেনেথ।

একটা মানুষ কিছুতেই রাতের বেলায় বাঘে রূপান্তর হতে পারে না।

কিন্তু সাধুর কথা শুনে মনে হচ্ছে সারা রাত জঙ্গলের আশে পাশে থেকে দূর থেকে ওদের উপর নজর রেখেছিল। যদি তাই হয় ব্যাপারটা বিপদজনক। বিরাট সাহস ঐ সাধু ব্যাটার। একটা মানুষখেকো বাঘ আছে জানার পরও রাতের বেলা ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে! শুধু তাই না। ভীষণ রকম ধূর্ত। মানুষদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই আসলে বাঘ।

কায়দা করে ঘটনার সুযোগ নিচ্ছে।

কেনেথ ঠিক করলেন যেই করেই হোক মানুষখেকো বাঘটাকে মারবেন।

আর তাতেই সাধু বাবার ভণ্ডামি ধরা পড়ে যাবে। গ্রামের লোক কিলিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেবে সাধুকে।

তবে হ্যাঁ, সাবধানে থাকতে হবে। কারণ সাধু প্রথমেই চেষ্টা করবে কেনেথের ক্ষতি করতে।

শিকারিই এখন সাধুর সবচেয়ে বড় শত্রু। অনেক চিন্তা করে কেনেথ অ্যান্ডারসন বুঝতে পারলেন এই মুহূর্তে তার শত্রু দুইটা। মানুষখেকো বাঘ আর ভণ্ড সাধু। খুব সাবধানে থাকতে হবে।

 

বাঘ মারার জন্য টোপ দরকার। তাই বুরাকে নিয়ে দুটো বাচ্চা মোষ কিনতে চলে গেলেন এক আদিবাসী মোষ পালকের কাছে। এই দিকে সমস্যা হল সাধু বাবা সবাইকে বলে দিয়েছে কেনেথের কাছে কেউ যেন মোষ বিক্রি না করে। আদিবাসীরা সবাই হাত পা মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তির সাথে জানালো মোষ বিক্রি করতে পারবে না। তাতে সাধু বাবা রেগে যাবে। আর বাঘ হয়ে এসে পরিশোধ নেবে।

গ্রামের মানুষদের বোঝাতে বোঝাতে গলা ব্যথা হয়ে গেল কেনেথের। নাহ। কেউ রাজি না।

পর পর তিনটে গ্রাম ঘুরে হতাশ হয়ে গেলেন শিকারি।

শেষে গ্রামের এক মুরুব্বী বুড়ো বলল, ‘মাইল পাঁচেক দূরে একটা গ্রাম আছে ওখানে গেলেই মোষ কিনতে পারবে।’

কিন্তু এখন যদি সেই পাঁচ মাইল দূরের গ্রামে যায় কেনেথ তবে মোষের বাচ্চা কিনে হেঁটে ফিরতে ফিরতে পথের মধ্যেই রাত নামবে। সেটা বিপদজনক।

মানে আরও একরাত এবং দিন এই সাধু আর বাঘের মধ্যেই থাকতে হবে।

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। সঙ্গী বুরা আর কেনেথ মিলে প্রচুর শুকনো কাঠের টুকরো আর লাকড়ি যোগার করলেন।

যাতে সারা রাত বড় করে আগুন জ্বেলে রাখা যায়।

চারিদিকে কাকের পালকের মত অন্ধকার নেমে আসছে।

সন্ধ্যা হবার আগেই পুরানো সেই আম গাছের তলায় বসে পড়লেন কেনেথ। সাথে বুরা। বড় করে আগুনের কুণ্ড জ্বেলে রেখেছে।

সামনে আম আর তেঁতুল গাছের ঘন জঙ্গল। কে জানে হয়তো আড়াল থেকে বাঘটা ওদের উপর নজর রাখছে। হাসছে ওদের অবস্থা দেখে।

সাধু বাবার উপর রাগে মেজাজ খিচড়ে গেল কেনেথের।

ঐ ব্যাটার জন্যই আজ রাতটা মোষের টোপ রাখা গেল না।

ফালতু একটা রাত নষ্ট হবে আম গাছের তলায়।

রাত নেমে গেল।

রাত মানেই জঙ্গল একদম থমথমে না কিন্তু। দূর থেকে রাত জাগা পাখিদের ডাক ভেসে আসছে হঠাৎ হঠাৎ। আর সেই সাথে ঝিঝি পোকার লাগাতার ডাক।

কানে তালা লেগে যাবে যেন।

এবং কোন কারণ ছাড়াই একদম শুনশান হয়ে গেল পুরা জঙ্গল।

কারণ বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হল না। দক্ষিণ দিকের নদীর কাছ থেকে ভেসে এলো বাঘের গর্জন।

চলে এসেছে ওটা!

মাত্র তিন বার ডেকেই থেমে গেল বাঘটা।

কয়েক সেকেন্ড রাস্তার পশ্চিম দিকে ডেকে উঠলো আবার।

চমকে গেলেন কেনেথ। এত খানি পথ মাত্র কয়েক মুহূর্তেই চলে এসেছে বাঘটা?

অসম্ভব আর অবিশ্বাস্য!

বুরাকে ওখানেই রেখে টর্চের আলোতে দৌড়ে সাধু বাবাজির কুঁড়ের দিকে দৌড় দিলেন কেনেথ।

কুঁড়েঘর অন্ধকার। সব সময় প্রদীপ জ্বলে। আজ জ্বলছে না।

দরজা ধাক্কা দিতেই দেখা গেল দরজার সামনে সাধু দাঁড়িয়ে আছে।

টর্চের আলোতে ঝিলিমিলি করে উঠলো সাধুর চোখ।

‘বাহ, বয়সের তুলনায় ভাল দৌড়াতে পারেন সাহেব।’ পিশাচের মত হেসে বলল সাধু।

‘তুমিও ভাল দৌড়াতে পার,’ রাগি গলায় বললেন কেনেথ। ‘রোজ অমন কর না? একদিন বাঘের পেটে চলে যাবে।’

ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েই ধাক্কা খেলেন বুরার সাথে। গাছ তলায় একা বসে থাকার সাহস ছিল না বুরার। সাহেবের পিছন পিছন চলে এসেছে। ঠক ঠক করে কাঁপছে ভয়ে।

আরও একটা রাত আম গাছের তলায় জেগে কাটিয়ে দিল দুইজনে।

বিরক্তকর একটা রাত।

পরদিন খুব ভোরেই পাশের গ্রামে চলে গেলেন কেনেথ আর বুরা।

দুটো মোষের বাচ্চা আর একটা ষাঁড় কিনে টলতে টলতে ফিরে এলেন। পর পর দুই রাত না ঘুমানোর জন্য চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন।

আম গাছ তলায় ষাঁড় আর মোষের বাচ্চা দুটো বেঁধে রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন কেনেথ।

বিকেল চারটার সময় তড়াৎ করে উঠে দাঁড়ালেন।

বেশি সময় নেই। অন্ধকার হয়ে আসবে দুই ঘণ্টা পর। কাজ গুছিয়ে নিতে হবে।

কিন্তু কোথায় টোপ রাখবেন? কোন পথে আসবে বাঘটা? কোথায় আস্তানা গেড়েছে ওটা? আর মাচা বাঁধার সময়ই বা কোথায়?

মানুষখেকো প্রাণী রোজ একই পথে চলাচল করে না। শিকার পাওয়া যায় না তাতে। মোষের বাচ্চা দুটো বুরার বাড়িতে রেখে ষাঁড়টা নিয়ে চললেন কেনেথ।

পশ্চিম দিকের পাহাড়ের দিকে হেঁটে যেতেই শুকনো মত একটা শাখা নদী পেলেন।

একদম সরু। পানি নেই প্রায়। দুই পাশের নরম বালিতে বাঘের পায়ের ছাপ ভর্তি।

দেখেই বোঝা যায় এই পথে বাঘটা প্রায়ই আসা যাওয়া করে।

বড়সড় একটা গাছ দেখে মাচাও বেঁধে ফেললেন।

সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। মাচায় উঠে বুরাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন কেনেথ। যে কোন সময় বাঘটা বের হতে পারে।

বেশ খানিক দূরে টোপটা মানে ষাঁড়টা বেঁধে রেখে তিন বার ওটাকে প্রণাম করে খিঁচে বাড়ির দিকে দৌড় দিল বুরা।

ছয়টার পর অন্ধকার হতে লাগল। সামনেই পাহাড়। ঐ দিকেই মুখ করে বসে আছেন কেনেথ। কেন যেন মনে হচ্ছে, ওখান থেকেই বাঘটা নেমে আসবে। নিশ্চয়ই কোন গুহার মধ্যে আস্তানা গেড়েছে ওটা।

সামনে একগাদা ময়ূর আর বনমোরগ ডাকাডাকি করেছে। সেই সাথে দুষ্ট বাচ্চার মত একদল বানর হৈ চৈ করছে।

আহা। বানরদের জীবন কত ভাল। ভাবলেন কেনেথ।

সব বানর হৈ চৈ করলেও একটা বানর চুপচাপ মুখ তম্বা করে বসে থাকে। ওটা দলের সর্দার। বিপদ দেখলে সঙ্কেত দেয় সে।

তাই হল। আচমকা চেঁচিয়ে উঠল সর্দার। সঙ্গে সঙ্গে খেলা বন্ধ করে দৌড়ে গায়েব হয়ে গেল বানরের দল।

বানরের দল পালিয়ে যেতেই পুরো পুরো নিঝুম হয়ে গেল জঙ্গল। মানে বাঘটা আসছে।

সারদিন যতই গরম থাকুক। পাহাড়ি এলাকা। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই ঝুপ করে নেমে এলো বরফের মত ঠাণ্ডা বাতাস।

শীতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো কেনেথের।

ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন। আগের দুই রাত আগুনের কুণ্ডের পাশে কাটিয়েছিলেন। শীত বুঝতে পারেননি।

এদিকে ঘন অন্ধকার হয়ে গেছে চারিদিক। আকাশ ভর্তি অনেক তারা। কালচে নিল আকাশে জ্বলছে।

হিম হিম বাতাসে গাছের পাতা ঝরে পড়ছে।

ঠিক তখনই বাঘের গর্জন শোনা গেল। কেনেথের ঠিক পিছনে। তারপর সেই ডাক ধীরে ধীরে চলে গেল দূরে। এখন সাধু বাবার কুঁড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকছে বাঘটা।

মনে হল বুরা আর কলা বাগানের লোক যা বলে সত্য।

সাধুই আসলে বাঘ হয় রাতের বেলা।

গাছ থেকে নেমে দৌড় দিলেন কেনেথ। ভয়ে না। কৌতূহলে।

সাধু বাবার কুঁড়ে ঘরের বাইরে চলে এলেন। কুঁড়ে ঘর অন্ধকার। ভেতরে কেউ নেই।

তখনই সামনে কলাবাগানের ভেতর থেকে বাঘটা ডেকে উঠলো আবার।

খুব কাছেই আছে ওটা।

আচমকা মাথায় বুদ্ধি এলো কেনেথের।

জোরে শ্বাস নিয়ে দুই হাত মুখের সামনে গোল করে তুলে বাঘের মত ডাক দিলেন কেনেথ। হুবহু বাঘের গর্জন করতে পারেন তিনি।

তারপর ঝুপ করে মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে রাইফেলটা তুলে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

ডাক শুনে বাঘ এইদিকে আসবেই।

অপেক্ষায় রইলেন।

একদম শুনশান চারিদিক।

আর একদম আচমকা কলা গাছের ভেতর থেকে হুড়মুড় করে বের হয়ে এলো একটা মানুষ। নেঙটি পরা। খালি গা। ছুটে আসছে সাধু বাবার কুঁড়ে ঘরের দিকে।

লোকটাকে চিনতে পেরে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল কেনেথের। লোকটা সাধু বাবা। খানিক আগে ঐ দিক থেকেই বাঘের গর্জন শুনেছিলেন কেনেথ।

তার মানে, সাধু সত্যি সত্যি রাতের বেলা বাঘ হয়ে যায়। মানুষ আর গরু-মোষ মেরে খায়।

জীবনে এমন ভয় আগে পেয়েছেন কি না কেনেথ নিজেও জানেন না।

কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ভয়ঙ্কর সেই রহস্যের সমাধান হয়ে গেল কয়েক

সেকেন্ড পরই।

কলাবাগানের ভেতর থেকে হুঙ্কার দিয়ে বের হয়ে এলো একটা বাঘ। কয়েকটা লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সাধুর উপর।

ব্যথা আর ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সাধু।

দৌড়ে সামনে চলে গেলেন কেনেথ। সাধু যতই খারাপ মানুষ হোক না কেন বাঘের হাতে মরতে দেয়া ঠিক হবে না।

বাঘটার মনোযোগ নষ্ট করার জন্য দূর থেকেই চিৎকার করে উঠলেন কেনেথ। যাতে সাধুর উপর থেকে সরে দাঁড়ায়।

রাইফেলের সাথেই টর্চ ফিট করা ছিল। চাপতেই আলো জ্বলে উঠলো।

সেই আলোতে ঝিকিমিকি করে উঠলো বাঘের দুই চোখ। গুলি করলেন কেনেথ। বাঘের দুই চোখের মাঝখানে লাগলো।

সাধু বাবার শরীরের উপর থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইলো বাঘটা।

আরও দুই গুলিতে ওটাকে ফেলে দিলেন। সাধু বাবার শরীর আড়াল করে শুয়ে আছে বাঘটা।

ভয় পেয়ে গেলেন কেনেথ। গুলি সাধুর গায়ে লাগেনি তো।

অনেক কষ্টে বাঘের বিশাল শরীরটা সরিয়ে সাধুকে বের করে আনলেন কেনেথ। নাহ বেচারার গায়ে কোন গুলি লাগেনি।

টর্চের আলো চোখে পড়তেই চোখ মেলে তাকাল সাধু। পিশাচের মত চেয়ে আছে কেনেথের দিকে।

ফিস ফিস করে বলল, ‘আমার ভাগ্য খারাপ। তাই। কিন্তু আজ, কাল বা পরশু অন্য বাঘের হাতে মারা যাবে তুমি।’

অভিশাপ দেয়া শেষ করেই মারা গেল সাধু।

সাধুবাবা ছিল আসলে ধূর্ত এক মানুষ।

আজকে বাঘটা ডাকতেই চুপিচুপি কুঁড়ে থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল আমগাছের কাছাকাছি গিয়ে কেনেথকে ভয় দেখাবে।

কিন্তু সাধু বুঝতে পারেনি মাচা থেকে নেমে কেনেথ চলে আসবে কুঁড়ের কাছে। আর কেনেথ যখন বাঘের ডাক নকল করেছে সাধু বাবা ভয় পেয়ে গেছে। দুই দিকে দুই বাঘ এলো কী করে?

ভয়ে দৌড়ে চলে আসতে চেয়েছিল নিজের কুঁড়ের ভেতরে।

আর নিয়তির মত তার পিছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষখেকো বাঘটা।

ক্লান্ত ভাবে হেঁটে বুরার বাড়ি চলে এলেন কেনেথ। ডাক শুনেই বাইরে চলে এলো বুরা।

‘বাঘটা মারা গেছে।’ বললেন কেনেথ।

‘আর সাধু বাবা?’ জানতে চাইলো বুরা।

‘সেও মারা গেছে।’

‘এই বার প্রমাণ হল তো?’

‘আরে না। সাধুকে আগে বাঘ মেরেছে। পরে বাঘটাকে আমি মেরেছি।’

‘তারমানে ওরা দুইজন আলাদা?’ অবাক হয়ে বলল বুরা।

‘নিশ্চয়ই।’ হাসলেন কেনেথ।

বুরা আরও লোকজনদের ডাকতে চলে গেল। খানিক পর একগাদা লোক জমে গেল। সবার চেহারায় ভয়ের ছাপ।

‘আমার সাহেব বাঘ আর সাধু দুইটাকেই মেরে ফেলেছে।’ বুক চিতিয়ে বলল বুরা।

‘আরে বেকুব বাঘে সাধুকে মেরেছে। আমি বাঘটাকে মেরেছি।’ বিরক্ত হয়ে বললেন কেনেথ।

এক দঙ্গল মানুষ হাজির হল সেই জায়গায়। যেখানে বাঘ আর সাধুর মৃতদেহ রয়েছে।

সবাই খুশি।

দুই ভয়ংকর আতঙ্ক চলে গেছে তাদের জীবন থেকে। মানুষখেকো বাঘ আর তারচেয়ে ভয়ঙ্কর সাধু।

(কেনেথ অ্যান্ডারসন-এর ‘The Swami of Valaithothu’ অবলম্বনে)