পুজোর জামা - রাজীবকুমার সাহা

অলংকরণ - মৈনাক দাশ

দরজায় বেলের আওয়াজ পেয়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে এসে বাঁহাতে ছিটকিনিটা খুলে গলা বাড়ালাম। ওমা, কেউ তো নেই, বেল বাজাল কে! উঠোনে চৈত্রের খা খা দুপুর। বাতাসে আগুনের হলকা। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাসটার নিচে একগোছা সরু সরু শুকনো পাতা দলা পাকিয়ে সরসর করে গড়াগড়ি খাওয়াচ্ছে এলোপাথাড়ি বাতাস। ভাবছি সামনে বর্ষার আগেই ডালপালা কিছু ছেঁটে দিতে হবে। এমন সময় কোত্থেকে এক আধপাগলা মানুষ নাকের ডগায় আচমকা উদয় হয়ে ভউ ভউ করে চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ চমকে গিয়েও পরক্ষণেই আমিও চিৎকার করে উঠলাম, “আরে, শৌনক! তুই কোত্থেকে! আয় আয়।”

এঁটো হাতটা মুঠো করেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে। ডানহাতের আঙুলে ঝুলে থাকা প্যাকেটটা উঁচু করে শৌনক তাড়াতাড়ি বলল, “চল তো, কিচেনে চল। ওটার একটা মজবুত ব্যবস্থা করতে হবে। হটপট একটা বের কর দিকি চটপট। বিরিয়ানি আছে অনেকটা। রাত্তিরে খাব।”

অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া থলেটা হটপটে বসিয়ে দিতে দিতে শৌনক বলল, “চটপট তৈরি হয়ে নে। বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছুতে পারলে বেস্ট। জায়গা পছন্দ না হলে আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। হাতে সময় থাকবে তখন।”

“সে কী, কোথায়! কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করে এলি নাকি?”

“হুম, কাঞ্চনমালা ফরেস্ট বাংলো। নে, তাড়াতাড়ি কর।”

“হুহ্‌, লাস্ট ট্রিপে যা এক গেস্ট-হাউসে নিয়ে তুলেছিলি, বাপের জম্মেও ভুলব না। শেষে দোকান থেকে তিন ড্রাম কেনা জলের দণ্ড দিয়ে তবেই স্নান সারা হল।” আমি মুখ বেঁকালাম।

“আরে ওরকম দুয়েকটা অভিজ্ঞতা থাকা ভালো।” শৌনক মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে আমার অভিযোগটা উড়িয়ে দিল নিমেষেই। মুচকি হেসে আশ্বাস দিল, “এবারে আর এমনটা হবে না। যা যা, তৈরি হয়ে নে শিগগিরি। বেলা ঢলে পড়ছে।”

দু’জনেই পৃথিবীটা ভালো করে চেনার আগেই মা-বাবাকে হারিয়েছি, মিশনের বোর্ডিংয়ে বড়ো হয়েছি। পিছুটান নেই কারও। সে থেকেই চিনি ওকে। আমি নিশ্চিত, আমার কোনোরকম ওজর-আপত্তি ধোপেই টিকবে না এখন। শৌনক অতটা দয়ালু ছেলে নয়। নীরস মুখে বললাম, “বেশ। একটা লেখা নিয়ে রগড়াচ্ছি তিনদিন ধরে। ব্যাটা বাগেই আসছে না। চল, ঘুরেই আসি একরাত।”

***

মালবাসা বাজার থেকে খানিকটা এগিয়ে একটা ফাঁড়ি রাস্তায় পড়েই লাফিয়ে উঠল আমার সিলভার-গ্রে রয়্যাল এনফিল্ডটা। ন্যাশনাল হাইওয়ের মুখেই রাস্তা যদি এমন তো বাকি আরও প্রায় পনেরো কিলোমিটারের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। খানিকটা বিরক্তি মিশিয়েই গলা তুললাম, “পই পই করে বললাম তখন, গাড়িটা নিয়ে বেরোই চল, কথা কানেও তুললি না। পৌঁছুতে পৌঁছুতে সবক’টা হাড়গোড় এখন আস্ত থাকলে হয়। তোর আর কী, দিব্যি পেছনে বসে মজা করছিস।”

কথার পিঠে শৌনকও গলা চড়াল, “আরে, মাস চারেক আগে খুঁজে পেয়েছিলাম স্পটটা। তখন এত খারাপ ছিল না রাস্তাটা। একটু ধৈর্য ধরে দেখেশুনে চালা না বাপু! এত বকবক করার কী আছে তো বুঝি না!”

বাঁদিকের রিয়ার ভিউ মিররটায় ওর ফিচেল হাসিটা চোখে পড়তেই মেজাজটা খচে গেল দ্বিগুণ। স্পীডোমিটারের কাঁটাটা ত্রিশ-বত্রিশে নামিয়ে গজগজ করতে লাগলাম, “বাইকটাও শুরুতেই স্টার্ট নিতে ঝামেলা করল। কেনার পর এই প্রথম। আগে কপালে কী আছে কে জানে।”

শৌনক মুখে পোরা চকোলেটটা কোঁত করে গিলেই বলল, “আরে কিচ্ছু হবে না। ভাবিস না তো! ট্রিপটা দারুণ জমবে দেখিস।”

শৌনকের এই একটা গুণকে আমি রীতিমতো হিংসে করি। ও সাংঘাতিকরকম অপ্টিমিস্টিক। আমার তো সন্দেহ জিনিসটাই সবচেয়ে প্রথমে আসে।

কিলোমিটার দুয়েক এগিয়ে যেতেই অবশ্য মনের গতিকটা আর আগের মতো রইল না। চার-পৌনে চার মিটার চওড়া খোয়া ওঠা রাস্তার দু’ধারে তখন কচি সবুজে মোড়া ঘন চা-বাগান শুরু হয়ে গেছে। ছায়া দেওয়া গাছগুলোর কোনওটা ন্যাড়া, কোনওটায় আবার থোক থোক কচিপাতা। এখানে বাতাসের গন্ধটাই অন্যরকম। শেষ বসন্তের বিকেলে নিঝুম হয়ে আছে চারপাশ। কোন গাছের মগডালে নতুন পাতার আড়ালে বসে কোকিল ডেকে চলেছে ব্যাকুল হয়ে। এখন তো এই পরিবেশে বাইকের চড়া ভটভট শব্দটাই বেশ লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে আমাকে। অনেকটা এগিয়ে ফরেস্ট ড্রপ-গেট পড়ল এবার। বাইক দাঁড় করিয়ে দু’জনে ছোট্টমতো একটা ঘরে ঢুকে পরিচয়পত্র দেখিয়ে একটা টোকেন নিয়ে এগোতে থাকলাম আবার। ইতিউতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু চা-গাছের ঝোপ শেষ হয়ে পাতলা জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে এখান থেকে। আস্তে আস্তে ঝিম ধরা ঘন জঙ্গলে ঢোকার মুখেই জরাজীর্ণ একটা বাংলোর দেখা মিলল শেষে। আমিও দম ফেলার ফুরসত পেলাম। নামে বাংলো, অবস্থা কটেজ থেকেও খারাপ। প্রায় সবক’টা দেওয়ালেই এদিক সেদিক খসে পড়ছে নোনাধরা পলেস্তরা, কোথাও কোথাও বেরিয়ে পড়েছে ইটের পাঁজর। মরা কাঠের নড়বড়ে একটা গেট পেরিয়ে উঠোনে ঢুকে বাইক থেকে নেমে যখন আড়মোড়া ভাঙলাম, গাছগাছড়ার ছায়াগুলো লম্বা হয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে ততক্ষণে। হর্ন বাজালাম কয়েকবার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম চারপাশটা ফুট পাঁচেক উঁচু কাঁটাতারে বেড় দেওয়া। কারও পাত্তা নেই। খানিকটা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, একজন চৌকিদার থাকে বললি না তখন? কোথায় গেল?”

শৌনক নির্বিকার। বলল, “আরে আসবে আসবে। ডাকাডাকি করতে হবে হয়তো একটু।”

বলে নিজেই গলা তুলে ডাকাডাকি শুরু করে দিল চৌকিদারকে। একটু পরেই পেছনদিক থেকে দৌড়ে এল চোখমুখ বসা খ্যাদা নাকের একটা রোগা শুঁটকোগোছের লোক। গায়ের জামাটা দেখেই চমকে গেলাম আমি। টোকেনটা হাতে ধরিয়ে দিতেই হন্তদন্ত হয়ে একটা ঘর খুলে দিল। ঢুকে দেখলাম, ভেতরটা তেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। চৌকিদারের দিকে চোখ ফেরাতেই ও তাড়াতাড়ি কোত্থেকে একটা ঝাড়ু নিয়ে এসে ঝাঁট দিতে শুরু করে দিল। মুখে কোনও কথা নেই। শৌনকের কানে মুখ রেখে ফিসফিস করে বললাম, “কী রে, বোবা নয়তো?”

শৌনক ভুরু কুঁচকে একমনে খানিকটা পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট উলটালো শেষে। বললাম, “একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? ওর গায়ের জামাটা অবিকল এবার পুজোয় তোকে আমার কিনে দেওয়া জামাটার মতো না?”

শৌনক কথাটা পাত্তাই দিল না। বরং চৌকিদারের ঝাড়াপোঁছার দিকে ওর সব মনোযোগ। মুখের ভাবখানা এইরকম যে একরকম জামা কি কোনও গারমেন্ট কোম্পানি একটাই তৈরি করে নাকি!

“অ্যাই অ্যাই, খাটের দিকের দেওয়ালের কোণটায় ভালো করে দাও। মেঝেতে এত মাটি কীসের?” শৌনকের হুকুম।

চৌকিদারের অবশ্য কোনও হেলদোল নেই এই হুকুমে। মুখটা তুলে একটু তাকাল না পর্যন্ত। শৌনক খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার কাঁধটা খামচে ধরে আঁতকে উঠল, “পিতু রে, এ যে বদ্ধ কালাও দেখছি ভাই! ভেবেছিলাম বাংলোটা মোটামুটি গোছের হলেও দুয়েকদিন কাটিয়ে ফিরব। এখন এই বোবাকালাকে নিয়ে ঘর করি কীভাবে!”

রাত আটটা নাগাদ চৌকিদারকে হাতছানি দিয়ে ডেকে এনে বিরিয়ানির প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় গরম করে আনতে বললাম। ওর ঘরটা উঠোনের ঠিক উলটোদিকেই। আমাদের ঘরটায় একটাই বড়সড় খাট। গুছিয়ে বসে গল্পে মজে গেলাম দু’বন্ধুতে। শৌনকের সাথে দেখা নেই প্রায় মাস চারেক। কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে মাঝেমাঝে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার বেলায় ওস্তাদ ও। অনেক কথা জমে ছিল। একটানা বকবক করতে করতে একটা ঝিমুনি মতো এসে কখন নিঃসাড় ঘুমে তলিয়ে গেলাম টেরই পেলাম না। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। চকিতে হাতঘড়ির দিকে চোখ ফেলে দেখলাম রাত প্রায় আড়াইটা। অস্বাভাবিক একটা নিস্তব্ধতায় থিতিয়ে আছে চারদিক। নিভু নিভু ঘোলাটে হলদে আলোটা সন্ধে থেকেই জ্বলছে। পাশ ফিরে শৌনককে জাগাতে যাব, দেখলাম ও নেই। বাথরুমে গেছে হয়তো। উঠে গিয়ে টেবিলে রাখা হটপটটার মুখটা খুলে দেখলাম অল্প কিছু বিরিয়ানি পড়ে আছে। ও, শৌনক তাহলে খেয়ে ফেলেছে আগেই! কিন্তু আমাকে ডাকল না কেন? প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা একা বাইক চালিয়ে এসে পরিশ্রান্ত শরীরে শুয়ে পড়েছি বলে? একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম ভেতরে ভেতরে। আমি আর এত রাতে কিছু খেলাম না। তন্দ্রালু শরীরে শুয়ে শুয়ে শৌনকের অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘুমের চটকটা হঠাৎ হঠাৎ ভেঙে যাচ্ছে, আবার জমাট হচ্ছে।

মিনিট কুড়ি পর খানিকটা সন্দেহ হল। আবার উঠে গিয়ে লাগোয়া বাথরুমটার দরজায় নক করলাম। আরে, দরজা তো খোলা! ভেতরেও আলো নেই। গেল কোথায় শৌনক? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজাটা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম টর্চটা হাতে করে। বাইরে একটা আলোর ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। খুবলে যাওয়া বারান্দার মেঝেয় হোঁচট খেয়ে এক লাফে নেমে এলাম উঠোনে। মনে হল পেছন থেকে কে যেন জোর ধাক্কা মারল একটা। চারদিকে টর্চের আলো ফেলে চাপা স্বরে কয়েকবার ডেকেও কোনও সাড়া পেলাম না শৌনকের। গাটা একবার ছমছম করে উঠেই আবার শীত শীত করে উঠল। জঙ্গল থেকে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়ার উপক্রম করছে। নাহ্‌, চৌকিদারকে একবার ডাকা দরকার। ওর ঘরের দিকে এক পা এগোতেই কোত্থেকে যমদূতের মতো একটা বাদুড় না প্যাঁচা কী যেন নাকে মুখে এসে ঝাপটা মারল। বিশ্রী একটা গন্ধে গাটা গুলিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। টর্চটা মেরে একবার দেখার কথাটাও মাথায় আসেনি। শরীরটা হঠাৎ ভার হয়ে আসতেই একদৌড়ে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়লাম চৌকিদারের দরজায়। উঠেই আবার ভেজানো নড়বড়ে দরজাটা সজোরে ঠেলে ধপাস করে পড়ে গেলাম মেঝেতে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে নিস্তব্ধ ঘরে। হৃৎপিণ্ডের অবস্থা আর গলাকাটা মুরগির মধ্যে তখন আর কোনও তফাত নেই। ভয়ে ভয়ে টর্চটা জ্বাললাম এবারে। কেউ নেই। চৌকিদারের গায়ের সেই জামাটা শুধু ঝুলছে শূন্যে, আর হাতাদুটো আমার দিকে উঠে আছে। যেন মুহূর্তের অপেক্ষা মাত্র, এখুনি এসে গলাটা পেঁচিয়ে ধরবে। হৃৎপিণ্ডটা লাফাতে লাফাতে ততক্ষণে গলায় এসে আটকে গেছে। উলটো পায়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতেই শৌনকের গলা কানে এল। জঙ্গলের দিক থেকে আসছে গলাটা, “এদিকে আয় পিতু, আমি এখানে।”

ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। সারাটা শরীর খানিকটা ঢিলে হয়ে আসতেই টের পেলাম কানদুটো সর্বোচ্চ মাত্রায় ঝাঁ ঝাঁ করছে। শুকিয়ে যাওয়া টাকরাটা একটা ঢোঁক গিলে ভেজানোর নিষ্ফল চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় তুই? অন্ধকারে তো কিছুই ঠাহর করতে পারছি না!”

“সোজা এগিয়ে আয় নাক বরাবর।”

“এত রাতে কী করছিস তুই ওখানে? না বলে চলে এলি যে বড়ো! কী করিস, না করিস! ওদিকে চৌকিদারের ঘরে কীসব... টর্চটার স্যুইচটাও খুঁজে পাচ্ছি না ছাই,” একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ল আমার গলায়।

“আরে এলেই না দেখতে পাবি! চলে আয় চটপট।”

এই শৌনকের সঙ্গে আমার শেষ কথা। তারপর গেট গলে আগাছা মাড়িয়ে ঝোপঝাড় পেরিয়ে ওই গভীর জঙ্গলে কী করে পৌঁছলাম তা আর স্পষ্ট মনে নেই। কে যেন আমার আগে আগে খানিকটা দূরত্ব রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমি যন্ত্রচালিতের মতো তার পিছু নিয়েছি এটুকুই কেবল আবছা মনে আছে। একটা ঘোরের মধ্যে পড়েছিলাম যেন। বোধশক্তি যেটুকু ছিল সেটা নিজেকে আটকানোর মতো যথেষ্ট নয়। মোটা সরু গাছপালার ফাঁকফোকর গলে আচ্ছন্নের মতো ঢুকে চলেছি আরও গভীর জঙ্গলে।

কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না। হঠাৎ বুনোলতায় না কীসে যেন একটা পা পেঁচিয়ে ছিটকে পড়লাম মাটিতে। হাতের টর্চটার কথা ভুলেই ছিলাম এতক্ষণ। বুকে পেটে তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভব করতে হাত গলিয়ে বের করে আনলাম ওটাকে। অনেকটাই সম্বিৎ ফিরে এসেছে ততক্ষণে। চারদিকে আলো ফেলে জায়গাটা একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতেই খানিকটা দূরে একটা মোটা গাছের গুঁড়ির পাশে আটকে গেল টর্চের আলোটা। কাপড়ের টুকরোমতো কী একটা গেঁথে আছে মাটিতে। এগোতে গিয়েও পিছিয়ে এলাম দু’পা। কীসের যেন পায়ের শব্দ পেলাম একসাথে বেশ কিছু। বনবাদাড় ভেঙে দুদ্দাড় করে পালিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করতেই চমকে উঠলাম। আরে, এ তো সেই জামাটা, পুজোর সময় শৌনককে যেটা দিয়েছিলাম! চৌকিদারের গায়ে আর ঘরেও একই জামা দেখলাম! কী ভেবে কোণটা ধরে বেশ জোরে টান দিতেই ঝুরঝুরে আলগা মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এল পচা গলা হাড় বের করা একখানা হাত। এই বীভৎস দৃশ্যে স্থির থাকতে পারলাম না আর। টাল খেয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। টর্চের আলোটা গড়াগড়ি খেতে লাগল মাটিতে পড়ে। আর কিছু মনে নেই। অসাড় জিভটা শুকনো টাকরায় আটকে গিয়ে আর মেরুদণ্ড বেয়ে কী একটা বরফঠাণ্ডা জিনিস নেমে যাচ্ছিল এটুকুই খেয়াল করেছিলাম শুধু। আচমকা দু’চোখ ঝাঁপিয়ে অন্ধকার নেমে এল রাশি রাশি।

জ্ঞান ফিরে পেলাম চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা খেয়ে। সূর্য তখন মাথার ওপর উঠে গেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিয়ে ছিবড়েটা যেন ফেলে রেখে গেছে কেউ এখানে। একটুও জোর পাচ্ছি না গায়ে। আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে আমায় ঘিরে। অস্পষ্ট কিছু কথাবার্তাও কানে আসছে। দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসতেই বুঝতে পারলাম এরা প্রত্যেকেই খাকি পোশাক পরে আছেন।

একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে বসতেই একজন জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিই থানায় ফোন করেছিলেন তো? আমি সাব-ইনস্পেক্টর অসীম দত্তরায়। আপনার বন্ধু না চৌকিদার, কে যেন মিসিং বললেন। কে?”

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম, “আমি? থানায় ফোন? কী বলছেন তো বুঝতে পারছি না! আমি কোথায় এখন?”

“আপনি তো প্রীতম মল্লিক। এই ফোন নম্বরটা আপনারই তো?” বলেই একটা মোবাইলের কল লিস্ট খুলে মেলে ধরলেন আমার চোখের সামনে অসীমবাবু।

“তা... হ্যাঁ, আমারই নম্বর। কিন্তু আমি তো আপনাকে বা থানা-টানায় কোনও ফোন-টোন... তাছাড়া আমার ফোন তো সেই ফরেস্ট বাংলোয়... প্লিজ বলুন না, আমি কোথায় আছি এখন। কাঞ্চনমালাতেই?” মরিয়া হয়ে উঠলাম আমি।

“হ্যাঁ, আপনি কাঞ্চনমালা রেঞ্জেই আছেন। তবে ফরেস্ট বাংলো থেকে প্রায় কিলোমিটার পাঁচেক দূরে বনের ভেতরে। এটা কোর এরিয়া। ফরেস্ট বাংলোতে না পেয়ে আপনার ফোন ট্র্যাক করে পৌঁছেছি আমরা। ফরেস্টের স্টাফও রয়েছেন সঙ্গে।”

“আমার ফোন ট্র্যাক মানে! আপনার নম্বরটা দেবেন?” বলেই কাপড়চোপড়ের এদিক ওদিক হাতড়াতে হাতড়াতে প্যান্টের পকেটে এসে হাতে ঠেকল মোবাইলটা। হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর করে ফোনটা বের করে কল লিস্টটা খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। গতকাল রাত আড়াইটা নাগাদ থানার ওই নম্বরে ফোন গেছে আমার মোবাইল থেকে। মিনিট দেড়েক কথাও হয়েছে।

এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে থানার জীপে করে প্রথমে হাসপাতাল তারপর থানায় এসে যখন নামলাম তখন রোদ মরে গেছে। শরীরটা আর সঙ্গ দিচ্ছে না। প্রাথমিক কিছু কথাবার্তার পর অসীমবাবু যখন শৌনকের কথা তুললেন ঠিক তখনই ওর কথা মনে এল আমার। আশ্চর্য, এর আগে অবধি একটিবারের জন্যেও মনে আসেনি ওর কথা!

“সময় নষ্ট না করে সত্যি করে বলে ফেলুন তো প্রীতমবাবু, চারমাস আগে বন্ধুকে খুন করে এতদিন পর আবার সেখানে গিয়ে হাজির হলেন কেন? কী খুঁজতে গিয়েছিলেন? দামি কিছু?” অসীমবাবুর হঠাৎ কড়া ধমকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।

আশ্চর্যের চরমতম সীমায় পৌঁছে পালটা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, “খুন! কী যা তা বলছেন আপনি?”

কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও কিছুতেই গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। শুধু গোঁ গোঁ করতে করতে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে লাগলাম।

ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কে যেন এক ধাক্কায় চেয়ার থেকে মাটিতে ফেলে দিল আমাকে। সারা শরীরের নার্ভগুলো যেন স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠল। মাথার ভেতরটা হঠাৎ চড়াৎ করে উঠতেই মুহূর্তের মধ্যে উঠে বসে চোখটোখ কচলে ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই একটা গলা কানে এল, “ত্রেতাযুগে আমরা থাকলে রাবণ কুম্ভকর্ণকে নির্ঘাত ত্যাজ্যভাই করে দিত, জানিস তো! সেই সন্ধেরাত্তির থেকে ঘুমুচ্ছিস ভোঁস ভোঁস করে। ওঠ ওঠ, রোদ চড়ে গেছে অনেকক্ষণ। ইস, বিরিয়ানিটার পেছনে ছ’শোটা টাকা জলে দিলাম। শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে উঠেছে পুরোটা। হ্যাঁ রে, স্বপ্ন দেখছিলি নাকি? গোঁ গোঁ করছিলি কেন ওর’ম?”

আমি সেই থেকে হাঁ করে আছি তো আছিই। শৌনক তাড়া দিল, “হাঁ করে আছিস কী! যা, শিগগির বাথরুম সেরে আয়। এখানে চা-টা কিচ্ছু পাবি না। বেরিয়ে গিয়ে খেয়ে আসতে হবে।”

অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমেও থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। শৌনক দেখলাম সেই পুজোর জামাটাই পরে আছে। সেই হলুদ, খয়েরি আর সবুজ ডোরাকাটা। শিরশিরে একটা অনুভূতি খেলে গেল সারা শরীরে। চোখের দৃষ্টিটা যথাসম্ভব লুকিয়ে মিনমিনে গলায় শুধু বললাম, “একবারেই বেরিয়ে যাব রে এখান থেকে। আর নয়।”

বলেই শৌনককে জাপটে ধরে বুকে টেনে নিলাম। আমার এই আচমকা ব্যবহারে এবারে ওর হাঁ করে থাকার পালা।