উড়ান - অনিমেষ ভট্টাচার্য্য

অলংকরণ - পিয়াল চক্রবর্তী

দুমদাম চ্যানেল পাল্টে ক্রিকেটে যাওয়ার সময়ই রিমোট হাতে থমকে দাঁড়াল ইন্দ্র। একটা নিউজে চোখ আটকে গেছে তার। সাউন্ড বাড়িয়ে শুনল, বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু হিউম্যান ট্রাফিকিং ব্যাপারটা ঠিক কী সে বিষয়ে খুব একটা আইডিয়া না থাকায় একটু দমে গেল।

তবে, জায়গাটা ওর খুব চেনা। আদিবাসী মাঠের ইটভাঁটা। সব চেয়ে বড় ব্যাপার যে সময়ের নিউজ রিল দেখাচ্ছে ঠিক তার একটু বাদেই ইন্দ্র ওখানে গেছিল। এই তো সোমবারের কথা। পিছনের দিকে ইঁটের পাঁজার মধ্যেই পেটকাটি ঘুড়িটা উড়াচ্ছে, যেটা এখন ওর চিলেকোঠায়। আশ্চর্য সেই সময় তো ওখানে কোনো নিউজ রিপোর্টার বা ক্যামেরাম্যানকে বেরোতে দেখেনি ও। প্রেসের কোনো গাড়িও চোখে পড়েনি। ইশ! আরেকটু আগে গেলে ওকেও টিভিতে দেখাত।

কিন্তু, এই হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর কেসটা কী জানতে হবে! আচ্ছা আজ তো শনিবার। ভাস্করদা বাড়ি থাকবে। ইন্দ্র পুরো খবরটা শুনে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল।

***

ভাস্কর একটা আইটি ফার্মে কাজ করে। বাড়িতেই ছিল। ইন্দ্রকে জানলার বাইরে সাইকেল তালা মেরে ঘরে ঢুকতে দেখে একটু অবাকই হল।

“ভাস্করদা, ফ্রি আছো?”

“বাপরে! ভালোই হাঁপাচ্ছিস। জল খা আগে। ...ফ্রিই আছি। বল—”, বলে ইন্দ্রকে জলের বোতলটা এগিয়ে দিল।

ঢকঢক করে কিছুটা জল খেয়ে ইন্দ্র বলল, “আদিবাসী ইটভাঁটা আছে না, ওটা আজ টিভিতে দেখাচ্ছিল। এই একটু আগেই!”

ভাস্কর একটা ইয়াবড়ো পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপ খুলে বসেছিল। সেটা গোটাতে গোটাতে বলল, “কেন? কারোর কোনো ইনজুরি?”

“না। না। কী যেন বলছিল, ও হ্যাঁ, হিউম্যান ট্রাফিকিং! ইংলিশ নিউজ গো... হাইফাই ব্যাপার মনে হল। তাই ছুট্টে এলাম।”

“একটা নিউজ জানতে দৌড়ে চলে এলি?” ভাস্কর চোখ পাকিয়ে বলল।

“না। মানে পেটকাটিটাকেও দেখালো। কিন্তু ঘুড়িটা দেখতে পেয়ে আমিও গেছিলাম ওখানে, তারপরেই। আমাকে টিভিতে দেখায় নি!” করুণ স্বরে বলল ইন্দ্র, এ বছর ফাইভে উঠল।

“হা হা হা! যা তাহলে কী হবে!” হেসেই ফেলল ভাস্কর।

“ধুর! বলো না কেসটা কী! আমি তো কোনো রিপোর্টার বা ক্যামেরাম্যানকে দেখিনি!”

এবার ভাস্কর একটু সিরিয়াস চোখে তাকাল। ভ্রু কুঞ্চিত হল। কপালে আরামসে ভাঁজ খেলে গেল। একটা ক্লোরোমিন্টের প্যাকেট ছিঁড়ে ইন্দ্রকে একটা দিল, নিজে একটা মুখে দিল। তারপর ইন্দ্রকে জিগ্যেস করল, “আচ্ছা, তুই যখন ওখানে গেলি, ঘুড়িটা আনতে, কী কী দেখতে পেয়েছিলি?”

“ওই যেমন হয়। গরম ইটভাঁটা। লোকজন মাথায় করে ইট নিয়ে যাচ্ছে। মাটির ইট নিয়ে আসছে। কেউ জায়গাটা পরিষ্কার করছে। এইসব।”

“আর কিছু? মানে এই ধর কোনো জমায়েত বা তোর মতো বাচ্চা কাউকে কাজ করতে দেখলি?”

“বাচ্চা? হ্যাঁ, সে ছিল বৈকি। আমার মতই বা আমার থেকে বড় হবে। ওদের সঙ্গে কাজ করছিল। ইট বানাচ্ছিল, সাজাচ্ছিল। আর জমায়েত, মানে ভিড় তো?”

“হ্যাঁ ওইরকমই। অল্প জায়গা জুড়ে—”

“আমি যখন ঘুড়িটার জন্য বাঁ দিককার ইটগুলোর দিকে যাচ্ছিলাম দুটো লোক জিগ্যেস করল, ‘কী চাই?’ ঐখানে কয়েকটা গরিব লোক দাঁড়িয়ে ছিল।”

“হুম... বুঝলাম। তোকে আর কিছু বলেনি ওরা?”

“নাঃ। ঘুড়ি নিয়ে চলে এলাম। আরেকটু আগে গেলেই হত! ক্যামেরাম্যানগুলো ততক্ষণে চলে গেছিল নিশ্চয়! …এই তুমি কী বুঝলে বলো না! বলো না!”

ভাস্কর ততক্ষণে ইন্টারনেটে কীসব সার্ফ করছিল। আর পায়চারি করছিল। ইন্দ্রর ঘ্যান ঘ্যান শুনে বলল, “বলব। বলব। ঠিক সময়ে বলব। আজ বিকেলে আসিস। হিউম্যান ট্রাফিকিংটা কী বুঝিয়ে দেব।”

“ওক্কে। সন্তুকে বলে দেব আজ নো ভোকাট্টা। হিহি... আচ্ছা ওটা জানলে কি আমাকেও, মানে ওই টিভিতে আর কি...!”

“না। অন্য কাজ আছে তোর। তুই আয় বিকেলে। ...ওহ, এই ম্যাপটা নিয়ে যা। এখানে যে জায়গাগুলো নীল গোল করা আছে, সেগুলো বাড়ি গিয়ে ভালো করে দেখবি। প্রশ্ন করব। এখন যা...”, বলে ইন্দ্রকে ওই পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপটা দিল ভাস্কর।

চান করেই মাকে খেতে দিতে বলল ইন্দ্র। শ্যামলীদেবী একটু অবাকই হলেন, “বাব্বা, সূর্য আজ উল্টোকাতে শুয়েছিল নাকি?”

“কেন, তুমি কি ভালো রান্না করেছ?”, বলে একগাল হেসে চুল আঁচড়াতে গেল ইন্দ্র। আজ তার অনেক কাজ। ম্যাপটা খুলে দেখতে হবে। এদিকে লাইব্রেরি থেকে যে মহাকাশবিজ্ঞানের বইটা এনেছিল আজকেই সেটা ফেরত দিয়ে আসতে হবে। এখনও দশ পনেরো পাতা পড়া বাকি। অলরেডি দেড়টা বাজছে! “মা, মা, বলছি খাইয়ে দেবে আজ? অনেকদিন খাইয়ে দাও না। খুব ইচ্ছে করছে আজ। প্লিজ মা, প্লিজ মা!”

“কী এমন রাজকার্য আছে শুনি, যে এত তাড়াহুড়ো?” শ্যামলী দেবী ঠিক জানেন খাইয়ে দিলে ছেলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। মাছও পুরোটা খেয়ে নেবে।

“ভাস্করদা ডেকেছে। গল্প বলবে বলেছে!”

“তুইও পাগল। আর ও তো পাগলের গাছ একটা! পারি না বাপু। ... দাঁড়া মাখিয়ে নিয়ে আসি—”, ভাত বাড়তে চলে গেলেন শ্যামলী দেবী।

অ্যাপোলো, স্পুটনিক এসব ইন্দ্রর আগেই জানা ছিল। কিন্তু এই যে নতুন নতুন মহাকাশযান ঘাঁটি গেড়েছে মহাকাশে সেগুলো সম্পর্কে আবছা ধারণা ছিল।

বেশ খানিকটা অবাক হল যখন জানতে পারল ওদের টিভির সিগন্যাল নাকি কোনো একটা স্যাটেলাইটের থেকে আসছে। মানে ওই দূর থেকে! ভাবা যায়!

তারপর, এই যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এ বছর বর্ষা কবে আসবে, কতটা বৃষ্টি হবে সব নাকি নানা ধরণের কৃত্রিম উপগ্রহের কাছ থেকে জানা যায়। একমনে এসব পড়ছিল ইন্দ্র। কখন যে চারটে বেজে গেছে খেয়ালই হয়নি। ঘড়িতে ঘন্টা পড়তেই তড়াক করে উঠে বসল। ম্যাপটা আর খোলার সময় নেই। বাড়ি এসেই একবার দেখেছিল। কলকাতা, হাওড়ার কিছু জায়গা লাল কালিতে গোল করা আর পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, ছত্তিশগড় বর্ডারের দিকে কিছু জায়গা নীল রঙের। ওদের গ্রামটাও নীল রঙে গোল করা। ওই যে পুরুলিয়ার সুখীনদী!

সাইকেল বাগিয়ে সোজা লাইব্রেরি গেল। বইটা জমা দিয়ে নেক্সট ভলুমটা ইস্যু করল। তারপর ধাঁ করে ভাস্করের বাড়ি।

“ভাস্করদা, ভাস্করদা! জানো ওই ইটভাঁটার মালিকটাকে পুলিশে—”

“গ্রেপ্তার করেছে। জানি। খবরটা নিউজে দেখানোর আগেই, কাল রাত্রেই গ্রেপ্তার হয়েছে।”

“তুমি সব জানতে আগে থেকে?”

“ব’স। একটা জিনিস দেখাচ্ছি। ওহ ম্যাপটা আমাকে দে।” বলে ভাস্কর ম্যাপটা দেওয়ালে টানটান করে ঝুলিয়ে দিল।

“হিউম্যান ট্রাফিকিং হল এক কথায় মানুষের বেচাকেনা। এই ধরে নে আমি তোকে কিনে নিলাম পয়সা দিয়ে, তারপর তুই আমার গোলাম হয়ে গেলি!”

“মুন্ডু! ইয়ার্কি নাকি? আমাকে বেচবে কে? আর কিনলেই বা গোলাম হব কেন? আমি তো কিসুই পাচ্ছিনা।”

“যার থেকে কিনব সে পাবে। তোর বাবা, বা কোনো এজেন্ট। আর এই পণ্য-মানুষরা হয় শিশু আর নাহলে খুব গরীব, অসহায় শ্রেণীর। কাজেই অল্প ক’টা পারিশ্রমিক বা অত্যাচারের থ্রু তে এই ব্যবসা রমরমিয়ে চলে। চলছেও!”

“যা বাব্বা। সেটা তো বেআইনি।” ইন্দ্র রীতিমত অবাক।

“আর সেই জন্যই মানসুখানি অ্যারেস্ট হল। আর তাকে মানুষ সাপ্লাই দেনেওয়ালা আরও চারজন!”

“কিন্তু, লোকে জানল কী করে? ও ও বুঝেছি, ওই নিউজ রিপোর্টিং। কিন্তু সেটাও তো বলছো গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেখিয়েছে। তাহলে? আর আর...”

“আমি আগে থেকে জানলাম কী ভাবে?”

“এক্সাক্টলি!”

ভাস্কর একটা স্টিক নিয়ে ম্যাপের দিকে তাক করল। ওই গোল গোল করা জায়গাগুলোতে।

“লাল গোলগুলো যেকোনো ম্যাপেই পাবি। অথোরাইজড ইটভাঁটা। এগুলোতে চাপ নেই। হিউম্যান ট্রাফিকিং-টা বেশি হয় এই প্রত্যন্ত এরিয়াগুলোতে। যেগুলোর খবর কেউ জানে না। এখানেই শিশু শ্রমিক, ফোর্সড লেবার সব থেকে বেশি। একে তো এগুলোর খোঁজ পাওয়া নেক্সট টু ইম্পসিবল, তারপর হাতে নাতে প্রমাণ! সেটাও—”

ইন্দ্র গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে। চোখের সামনে ভেসে উঠল সকালের ভিডিও ফুটেজটা। বাচ্চাদের মুখগুলো। অপুষ্টিতে ভোগা শরীরটাকে টেনে টেনে কাজ করছে। ওই টেম্পারেচারে।

“তার মানে? তাহলে নিউজের লোকগুলো জানল কীকরে? ওরা ভিডিও করলে তো ইটভাঁটার মালিক তাড়িয়ে দেবে।”

“গুপ্ত ক্যামেরা। পুরো ইটভাটার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়ারফুল ক্যামেরা গুঁজে এসেছিলাম আমি আর প্রফেসর সমাদ্দার।”

“কী! তুমি! আর তোমার কলেজের ওই রাগী দাদু! কী বলছ?... আর এরকম ক্যামেরা গোঁজা ব্যাপারটাই বা কী? কেমন একটা স্টিং অপারেশনের গন্ধ পাচ্ছি, ভাস্করদা!” অবাক হয়ে চোখ পাকিয়ে ইন্দ্র বলল।

“হেহেঃ... শোন সবটা। ইউনিসেফের নাম শুনেছিস তো? তো সেই সংস্থা অনেক আগে থেকেই চাইল্ড লেবারের বিরুদ্ধে এইসব জায়গার শিশুদের জন্য নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। এখনও কাজ করে চলেছে। কিন্তু, তাতেও অনেক অঞ্চল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তখন বিকল্প ব্যবস্থা বা সাপোর্টিভ কিছু খোঁজের মধ্যেই উঠে এল এই উপায়টা।”

“কী উপায়?”

“স্যাটেলাইট! কৃত্রিম উপগ্রহ...”

“কী বলছ! ওই মহাকাশ থেকে?”

“ঠিক তাই!”

ঠকঠক করতেই অভিরাজ এসে দরজা খুলল। অভিরাজ প্রফেসরের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। চিঠি টাইপ করা থেকে ডাইরির ধুলো ঝেড়ে দেওয়া সব এই বছর পঁয়ত্রিশের মাঝারি গড়নের ভদ্রলোকের কাজ। দরজা খুলে সুপরিচিত ভাস্করকে দেখে জিগ্যেস করল, “এই ছোটভাই, সক্কাল সক্কাল! এসো এসো, চা বসাই।”

“হ্যাঁ, বেশ আদা দিয়ে ভালো করে। স্যার আছেন তো?”

“সূর্য প্রণাম করছে। ছাদে আছে। এই বাবুভাইকে তো চিনলাম না।” ইন্দ্রকে দেখে প্রশ্নটা করল অভিরাজ।

“আমার নাম ইন্দ্র। ইন্দ্রজ্যোতি স্যানাল। চাঁপাডাঙা হাই স্কুলে ফাইভে পড়ি।” হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে কথাগুলো বলল ইন্দ্র।

“বাঃ বাঃ। বসো তোমরা। বিস্কুট চা নিয়ে আসি।”

টেবিলের ওপর একটা ছোট রিমোট জাতীয় কিছু রাখা ছিল। ইন্দ্র সেটা নিয়ে দেখতে গিয়ে ভুল করে একটা বোতামে টেপা পড়ে গেল আর অমনি পাশের ঘর থেকে কী একটা উড়ে চলে এল দরজা দিয়ে। এসে ইন্দ্রর মাথার উপর ঘুরতে থাকল। আর একটা শোঁ করে আওয়াজ। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটতে লাগল জাস্ট তিন সেকেন্ড। ভাস্কর কিছু করতে পারার আগেই। আর ঠিক পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় ধুতি পরে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলেন প্রফেসর সমাদ্দার।

“এই কে রে, ড্রোন চালালি!”

নাতিস্থূল ভুঁড়ি, চোখে একটা পাতলা চশমা, ডান হাতে তাবিজ আর কপালে ভাঁজ। চোখের চাউনি দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন তাঁকে ঠকিয়ে পচা মাছ গছিয়ে দিয়েছে!

“অ। তুমিই ইন্দ্র ধনুস। বাবা ইন্দ্র এক কাজ করো তো ‘এম’ লেখা বোতামটা টেপো দেখি।”

ভাস্করের দিকে একবার তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ ‘এম’ লেখা বোতামটা টিপতেই ড্রোনটা বাধ্য ছেলের মতো প্রফেসরের মাথায় শান্ত হয়ে বসে পড়ল। আর সমাদ্দারবাবু সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে কব্জা করে তার ভিতরের চিপটা খুলে পকেটে রেখে দিলেন।

“স্যার, মানসুখানির কীর্তি ফাঁস হয়েছে। ব্যাটা গ্রেপ্তারও হয়েছে। সরকার থেকে লেবারদের জন্য পুনর্বাসনের প্রকল্পও ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ—”

ভাস্করকে মাঝপথে থামিয়ে প্রফেসর বললেন, “অর্থাৎ, মিশন ওয়ান সাকসেসফুল। এবার নেক্সট। অলরেডি আমার ইংল্যান্ডের বন্ধু প্লেসেট, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া আরো শ’দুয়েক ছবি ঘেঁটে এই পুরুলিয়াতেই তিনটে ইটভাঁটা খুঁজে পেয়েছে। সেগুলোর কোনো অথেন্টিসিটি নেই। জায়গা তিনটে হল....উমম.... হ্যাঁ, এফ পি এস.... ফড়িংহাটা, পায়রাবেড়া আর শাখনাডালা। এদের মধ্যে সব থেকে ছোট ক্যাপাসিটির হল পায়রাবেড়া। জায়গাটা সুখীনদী থেকে বাসে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। একটু ভিতরের দিকে গ্রাম।”

“বাব্বা! আপনি এত রিসার্চ কখন করলেন, স্যার?”

“কাল রাত্রে তুই ফোন করার পরই। প্লেসেট আমাকে কো-অর্ডিনেট আগেই দিয়ে রেখেছিল। ইন্দ্রকে কাজে লাগানোর আইডিয়াটা কিন্তু তোফা!”

ইন্দ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। নিজের নাম শুনে আলোচনায় মন দিল। “আমাকে আবার কী করতে হবে? আমার তো ইস্কুল আছে!”

ওর কাঁধে হাত রেখে ভাস্কর বলল, “চিন্তা করিস না। ছুটির দিনেই হবে। আর তোকে ঐ ঘুড়ি ধরতেই যেতে হবে। তবে এবার আর আদিবাসি ইটভাঁটা নয়, পায়রাবেড়া!”

“তাহলে এবার আর পেটকাটি নয়, ময়ূরপঙ্খী চাই আমার!”

প্রফেসর একগাল হেসে বললেন, “ডান!”

সঙ্গে সঙ্গে অভিরাজ, চা আর চানাচুর নিয়ে ঢুকল, “বিস্কুট শেষ হয়ে গেছে স্যার!”

ইন্দ্র সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, কত দূরে থাকা কিছু স্যাটেলাইট একনাগাড়ে ছবি তুলে যাচ্ছে। ভারতের, পুরুলিয়ার। আর তাবড় বিজ্ঞানীরা বসে বসে সেই ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, কোথায় কী ঘটছে না ঘটছে জানার জন্য! কেন করছে ওরা? কেউ তো জানতেও পারছে না। পুরো ব্যাপারটাই একটা সিক্রেট মিশন। মানুষকে ভালো রাখার মিশন। ওর মতো বাচ্চাদের হাতে সুন্দর ভবিষ্যৎ তুলে দেওয়ার মিশন। সামনের রবিবার সেও এই মিশনের সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে। ভাবলেই গাঁয়ে কাঁটা দিচ্ছে!

ইংল্যান্ডের মহাকাশ সংস্থা আর ভারত সরকারের যুগলবন্দীতে শুরু হওয়া এই মিশনে দরকার ছিল কিছু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের যাদের ঐ সমস্ত ইটভাঁটার কাছাকাছি পাওয়া যাবে। ভলিন্টিয়ার হিসেবে এরাই প্রমাণ সংগ্রহ করবে; দুই দেশের মধ্যে তথ্য আদান প্রদানের খবর কেবলমাত্র এদের কাছেই থাকবে। এরকমই একজন হলেন জয়নাল সমাদ্দার, সুরেন্দ্রনাথ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ইলেক্ট্রনিক্স-এর প্রফেসর। আর তিনি বেছে নিলেন তাঁরই ছাত্র ভাস্কর অধিকারীকে।

সারা সপ্তাহ ধরে স্কুল শেষে ঘণ্টা খানেকের জন্য ভাস্করের বাড়িতে জোর রিহার্সাল, ট্রেনিং চলল ইন্দ্রর। কীভাবে সন্দেহ এড়িয়ে জায়গায় ঢুকবে, কেউ পথ আটকালে কীভাবে হ্যান্ডল করবে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবে... সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি করা হল তাকে।

ইন্দ্রও ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করছিল ধীরে ধীরে। টিভিতে দেখানো নিয়ে আর কোন আগ্রহই নেই তার। ঘুড়ি ধরার ছুতোয় সঠিক লোকেশনে গুঁজে দিতে হবে সেই গুপ্ত ক্যামেরা। এ তো আর আদিবাসি মাঠ নয়, যে গভীর রাতে গিয়ে কাজটা করা যাবে। এ হল পায়রাবেড়া। জায়গাটা এমনিতেই দূরে প্লাস মানসুখানি ধরা পড়ার পর ওরা নিশ্চয় রাতে পাহারার ব্যাবস্থা করবে। তাই, সাত পাঁচ ভেবে এই ফন্দি।

***

নির্দিষ্ট দিনে বাস থেকে নামল তিনজন। আলাদা আলাদা ভাবে। প্রফেসরের কাঁধে একটা ব্যাগ। ভাস্করের সঙ্গে একটা ঝোলা। ইন্দ্রর পরনে সাধারণ পোশাক। ধুলো মাখা, পুরনো। হালকা চুল উড়ছে শুকনো হাওয়ায়। প্রফেসর তাঁর প্ল্যান অনুযায়ী দু’দিক দেখে নিয়ে চাষের ক্ষেতের দিকে নেমে গেলেন। একটা আখের জমিতে টুক করে ঢুকে গেলেন। ইন্দ্রকে আগেই স্যাটেলাইটের তোলা থ্রি-ডি ছবি দেখিয়ে ইটভাঁটাটা সম্পর্কে অবগত করা আছে।

ইন্দ্র আর দেরি না করে সেদিকেই হাঁটা লাগাল। এবার কাজ শুরু হল ভাস্করের। পকেট থেকে বেরোল একটা ভাঁজ করা প্লাস্টিক। ভাঁজ খুলতেই সেটা মাঝারি সাইজের ময়ূরপঙ্খী ঘুড়ি হয়ে গেল। সিন্থেটিক কাঠিগুলো বেশ শক্তপোক্ত। একটু আড়ালে গিয়ে তার মাঝখান বরাবর লাগিয়ে দিল প্রফেসরের বানানো খুদে ড্রোন! তারপর সেটাকে আখের ক্ষেতটা থেকে ঠিক লম্বালম্বি দূরত্বে একটা গাছের ডালে রেখে পালিয়ে এল। নিরাপদ স্থানে এসে প্রফেসরকে মিসড কল দিতেই ঘুড়িটা ফরফর করে উড়তে লাগল। সুতো নেই, জাস্ট উড়ছে। আর ঘুড়ির আওয়াজে ড্রোনের আওয়াজটা অত বোঝা যাচ্ছে না।

ওদিকে আখের জমি থেকে ছোট্ট একটা ল্যাপটপ বের করে সেটাকে কন্ট্রোল করছে প্রফেসর সমাদ্দার। ঘুড়িটা দেখে মনে হচ্ছে সেটা যেন কেটে গেছে। ময়ূরপঙ্খীটা আস্তে আস্তে পায়রাবেড়া ইটভাঁটার দিকে উড়ে যেতে লাগল। যেখানে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে ইন্দ্র। প্যান্টের পকেটে পাঁচটা গুপ্ত ক্যামেরা। ঘুড়িটা যেখানে যেখানে গোঁত্তা খাবে ঠিক সেখানে সেখানে সেগুলো অন করে গুঁজে দিলেই কাজ শেষ। কো-অর্ডিনেট সেট করাই আছে।

বাচ্চারা মাটি সাজাচ্ছে, মাথায় করে ইট নিয়ে চলল কেউ, গনগনে তেজ চারদিকে। আকাশ পরিষ্কার। একটা লাল ময়ূরপঙ্খী মাথার উপর উড়ছে ... সেটার পেছন পেছন ঢুকে পড়ল ইন্দ্র!

ঐ তো! ঐ তো গোঁত্তা খেল ঘুড়িটা। ইন্দ্র দৌড়ে গেল। হাতের মুঠোয় গুপ্ত ক্যামেরা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। এক পা, এক পা, করে এগিয়ে গেল সেদিকে...

‘ভোকাট্টা’ বলে চিৎকার করে উঠল বাচ্চাগুলো। তাদের উড়ান সামনেই!