চেলোবাদক - পিনাকী ঘোষ

অলংকরণ - অরিজিৎ ঘোষ

লাঞ্চের পর থেকে সেই নিয়ে আমরা তখন তৃতীয়বার গডফাদার-এর থীম মিউজিক বাজাচ্ছিলাম। তাই আমি একটু এদিকওদিক তাকিয়ে বাজারচত্বরের উল্টোদিকে বসা ট্যুরিস্টদের দেখছিলাম, বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে তাদের মধ্যে কতজন আছে যারা আগেরবার এটা বাজানোর সময় ছিল। পছন্দের হ’লে লোকেদের একাধিকবার শুনতে আপত্তি থাকে না, কিন্তু তেমনটা বারবার ঘটে না, আবার লোকেরা এটাও ভাবতে পারে যে আপনার ভাঁড়ারে আর কিছু ভালো নেই। বছরের এই সময়ে, একই গান বারবার বাজানোটা মোটামুটি চলে যায়। হিমেল হাওয়ার প্রথম পরশ আর কফির দামে হাস্যকর ছাড় ক্রেতাদের আনাগোনা বাড়িয়ে দেয়। যাই হোক, এই কারণেই আমি বাজারচত্বরে বসা লোকজনদের মুখ লক্ষ করছিলাম, আর এই করতে গিয়েই আমার নজরে পড়ল টাইবর।

ও হাত নাড়ছিল। প্রথমে আমি ভাবলাম ও আমাদের দিকে হাত নাড়ছে, পরে বুঝলাম ও ওয়েটারকে হাত নেড়ে ডাকার চেষ্টা করছে। ওকে একটু বয়স্ক দেখাচ্ছিল, আর একটু মোটাও হয়েছিল, কিন্তু চিনতে একেবারেই অসুবিধে হচ্ছিল না। আমার ঠিক পাশে বসেই অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছিল ফ্যাবিয়ান। আমি তাকে খুব হালকা করে একটা কনুইয়ের গুঁতো দিলাম আর মাথা নেড়ে ওর দিকে দেখালাম। দুটো হাতের একটাও স্যাক্সোফোন থেকে সরাতে পারছিলাম না ব’লে ঠিকমতো ওকে দেখাতে পারছিলাম না। এরপর যখন একটু ফুরসত পেলাম, তখন আমাদের ব্যান্ডের বাকিদের দিকে তাকিয়ে মনে হ’ল, সেইবছর গ্রীষ্মে যখন টাইবরের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছিল, আমাদের ব্যান্ডের আমি আর ফ্যাবিয়ান ছাড়া তখন এরা আর কেউ ছিল না।

হ্যাঁ, তাও সাত সাতটা বছর হয়ে গেল, কিন্তু তবুও ভাবলে যেন কেমন হয়। তখনও এরকম একসাথে রোজ বাজাতে বাজাতে ব্যান্ডটাকে একটা পরিবারের মতো মনে হ’ত, আর ব্যান্ডের সদস্যরা হয়ে গেছিল ভাইয়ের মতো। প্রতিনিয়ত ব্যান্ডে আসা-যাওয়া লেগে থাকলেও মনে হ’ত সকলেই যোগাযোগ রাখবে। ভেনিস, লন্ডন বা দুনিয়ার যে প্রান্তেই যাক না কেন, সেখান থেকে হয়তো পোস্টকার্ড লিখবে, নতুন ব্যান্ডের সদস্যদের সাথে তোলা ছবি পাঠাবে—ঠিক যেন নিজের পুরোনো গ্রামে চিঠি পাঠানোর মতো। তাই এরকম একটা মুহূর্ত হঠাৎ করেই মনে করিয়ে দেয় কতো তাড়াতাড়ি সব পালটে যায়। আজকের হরিহর আত্মা কেমন কালকে গিয়ে অচেনা মানুষ হয়ে যায়, ইউরোপের অজানা অচেনা কোনো স্কোয়্যার বা ক্যাফেতে গিয়ে গডফাদার থীম বা অটাম লীভস বাজায়।

থীমটা বাজানো শেষ হবার পর ফ্যাবিয়ান বিচ্ছিরিভাবে আমার দিকে তাকাল। ওর ‘স্পেশ্যাল প্যাসেজ’ বাজানোর সময় আমি ওকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়েছি বলে চটে আছে। ‘স্পেশ্যাল প্যাসেজ’ ঠিক সোলো নয়, কিন্তু বাজনার ক্ষেত্রে এটা বেশ একটা বিরল মুহূর্ত যেখানে বেহালা আর ক্ল্যারিনেট থেমে যায়, আমি ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা কিছু স্বর লাগাই, আর ও ওর অ্যাকর্ডিয়ানে একসাথে সুরটা ধরে রাখে। আমি যখন টাইবরকে দেখিয়ে ফ্যাবিয়ানকে আমার কৃতকর্মের ব্যাখ্যা দিচ্ছিলাম, তখন টাইবর একটা ছাতার নীচে বসে চামচ দিয়ে কফি নাড়াচ্ছিল। প্রথমে ফ্যাবিয়ানের তাকে মনে করতে অসুবিধে হলেও, পরে বলল,

‘ও হ্যাঁ, সেই চেলো বাজানো ছেলেটা। এখনও সেই মার্কিন মহিলার সাথে যোগাযোগ আছে কিনা দেখো’।

‘মোটেও না,’ আমি বললাম। ‘তোমার মনে নেই? তখনই তো সব চুকেবুকে গেছিল’।

ফ্যাবিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল। ওর মনোযোগ তখন ওর শীট মিউজিকের দিকে। এরপর আমাদের পরের বাজনা শুরু হবে।

ফ্যাবিয়ান আর কোনো উৎসাহ দেখাল না দেখে আমার হতাশ লাগল, কিন্তু আমার মনে হয়, ওই অল্পবয়স্ক চেলোবাদকের ব্যাপারে ওর কোনো কালেই কোনো আগ্রহ ছিল না। ফ্যাবিয়ান, দেখো, ও কখনও বার বা ক্যাফেতে বাজিয়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের তখনকার বেহালাবাদক জিয়ানকার্লো-র মতো নয়, আবার বাস গীটারের এরনেস্টো-র মতোও নয়। তাদের সঙ্গীতশিক্ষা ছিল প্রথাগত, তাই তাদের কাছে টাইবরের মতো কেউ একজন সবসময়ই চটকদার। হয়তো টাইবরের উচ্চমানের সঙ্গীতশিক্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে একটু ঈর্ষাও ছিল—তার ভবিষ্যত সামনে পড়ে আছে। আর সত্যি বলতে, আমার মনে হয় এইজন্যেই টাইবরদের এরা নিজেদের ছত্রছায়ায় নিতে চায়, তাদের একটু দেখাশোনা করবে, যেমনটা চাইছে তেমনটা করে দেবে, আর যখন তাদের মনের মতো সবকিছু হবে না, তখন সেটা তাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হবে না।

সাত বছর আগের সেই গ্রীষ্মে গরমটা অন্যান্যবারের থেকে একটু বেশীই ছিল। এমনকি আমাদের এই শহরেই মনে হচ্ছিল যেন আমরা অ্যাড্রিয়টিকের নীচের দিকে আছি। চারমাসেরও বেশী সময় আমরা বাইরে বাজাতাম—ক্যাফের সামনে একটা চাঁদোয়ার নীচে, সামনে বাজারচত্ত্বর, আর টেবিলগুলো পাতা—এতোই গরম যে দু’তিনিটে স্ট্যান্ড ফ্যান সবসময় বনবন করে চারপাশে ঘুরত। কিন্তু এটাই ছিল ভালো সময়। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, আরও অনেক দেশ, এমনকি এই দেশেরও প্রচুর ট্যুরিস্ট এইসময় এখানের সমুদ্রতটগুলোয় রোদ পোয়াতে আসে। আর সেই গ্রীষ্মেই আমরা প্রথম লক্ষ করলাম রাশিয়ান ট্যুরিস্ট। এখন আর রাশিয়ান ট্যুরিস্টদের দেখলে আলাদা করে চেনা যায় না, অন্যান্যদের মতোই লাগে। কিন্তু সেইসময় তাদের এতোটাই অন্যরকম লাগত যে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকিয়ে দেখতে হ’ত। তাদের পোশাকআশাক অন্যধরণের, আর চলাফেরা দেখলে মনে হ’ত স্কুলের নতুন বাচ্চা। প্রথমবার যখন আমরা টাইবরকে দেখি, তখন আমরা আমাদের জন্যে পাশে সরিয়ে রাখা ক্যাফের বড় টেবিলটায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। ও কাছেই বসেছিল, আর অনবরত ওর চেলোর কেসটা উঠিয়ে উঠিয়ে ছায়ায় সরাচ্ছিল।

‘ওকে দ্যাখো,’ জিয়ানকার্লো বলল। ‘রাশিয়ান মিউজিক স্টুডেন্ট, পেট চালানোর জন্যে কিচ্ছু নেই। তাই সে কী করছে? না মেইন স্কোয়্যারে কফির পিছনে পয়সা ওড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে’।

‘নিঃসন্দেহে একটা মূর্খ,’ এরনেস্টো বলল। ‘কিন্তু রোম্যান্টিক মূর্খ। সারা বিকেল ধ’রে যতক্ষণ আমাদের স্কোয়্যারে বসে থাকে, অনাহারে থাকতে ভালোবাসে’।

ওর চেহারা ছিল রোগাপাতলা। মাথায় সোনালী চুল। চোখে সাদামাটা চশমা। বড় চশমার ফ্রেমে ওর মুখটা একটা পাণ্ডার মতো লাগত। দিনের পর দিন ও এসে বসে থাকত। এখন আমার ঠিক মনে পড়ছে না কীভাবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই আমরা বাজানোর মাঝে গিয়ে ওর সাথে বসতাম আর গল্প করতাম। আর কখনও সখনও ও যদি ক্যাফেতে সন্ধ্যের সেশনে আসত, তাহলে আমরা সব মিটে গেলে ওর সাথে গল্প করতাম, হয়তো ওয়াইন আর ক্রস্টিনি খাওয়াতাম।

কিছুদিনের মধ্যেই আমরা জানতে পারলাম টাইবর আসলে রাশিয়ান নয়, হাঙ্গেরিয়ান; আর ওকে দেখে বয়স যতটা মনে হয়, ও তার থেকে একটু বেশীই, কারণ ও ইতিমধ্যেই লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ মিউজিক থেকে পড়াশোনা করেছে, ভিয়েনায় ওলেগ পেট্রোভিচের কাছে দু’বছর শিখেছে। সেই বৃদ্ধ পণ্ডিতের কাছে তেড়েফুঁড়ে শুরু করার পর শিখেছে কীভাবে সব আবেগ অনুভূতিকে বশ করতে হয় এবং তারপর গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভিয়েনা ছেড়ে ইউরোপের কিছু কিছু মর্যাদাপূর্ণ শহরে বাজিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু তারপর চাহিদা কম থাকার জন্যে কনসার্টগুলো এক এক করে বাতিল হতে শুরু করে। ওকেও তখন বাধ্য হয়ে অপছন্দের বাজনা বাজাতে হয়। এদিকে মাথাগোঁজার খরচও দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছিল।

আমাদের শহরে একটা বেশ সাজানো গোছানো শিল্প-সাংস্কৃতিক উৎসব হয়। তাতে যোগদানের জন্যেই সেই গ্রীষ্মে ও এখানে এসেছিল। এই উৎসবটা ওর কাছে ছিল খুব দরকারী একটা সাহায্য। তাই ওর রয়্যাল অ্যাকাডেমির পুরোনো এক বন্ধু যখন ক্যানালের পাশে তার অ্যাপার্টমেন্টে নিখরচায় থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল, ও বিনা দ্বিধায় রাজী হয়ে গেছিল। ও বলেছিল আমাদের শহরটাকে ওর বেশ ভালো লেগে গেছে, কিন্তু টাকাপয়সার সমস্যাটা একটা বড় সমস্যা। যদিও এখন ওর মাঝেমধ্যে বাজানোর ডাক আসছে, কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে ভালোই ভাবতে হচ্ছে।

ওর এই সমস্ত দুঃখ দুর্দশার কথা বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর জিয়ানকার্লো আর এরনেস্টো ঠিক করল ওর জন্যে আমাদের কিছু করার চেষ্টা করা উচিত। আর এইভাবেই টাইবরের সাথে কাউফমানের যোগাযোগ হয়। কাউফমান অ্যামস্টারডামে থাকেন, জিয়ানকার্লোর দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয়, হোটেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

সেইদিন সন্ধ্যের ঘটনা আমার খুব ভালো মনে আছে। সময়টা তখনও গ্রীষ্মের শুরুর দিকে। কাউফমান, জিয়ানকার্লো, এরনেস্টো, এবং বাকি আমরা সবাই ক্যাফের ব্যাক রুমে বসে টাইবরের চেলো বাজানো শুনছি। ও নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছিল সেদিন ও কাউফমানের জন্যে একটা অডিশন দিচ্ছিল। আর তাই সেদিন রাতে বাজানোর জন্যে ও বেশ উদ্গ্রীব ছিল। আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার তখন ওর অন্ত ছিল না। কাউফমান যখন জানালেন উনি অ্যামস্টারডামে ফিরে গিয়ে ওর জন্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন, ও তো খুশীতে গদগদ। এরপর লোকজন যখন বলে ওই গ্রীষ্মেই টাইবরের অধঃপতন শুরু হয়েছিল, ও নিজের ভালো নিজে বুঝছিল না, আর এই সবকিছুর জন্যে দায়ী ছিল সেই মার্কিন মহিলা, তাহলে বুঝতে হবে সেই কথাগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে।

***

দিনের প্রথম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই টাইবর সেই মহিলা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল। সেইসময় বাজারচত্বরটা ঠাণ্ডা থাকে। ক্যাফের দিকটা সকালের অনেকটা সময় ছায়া ঢাকা থাকে। শহরের মজদুররা এসে হোসপাইপ দিয়ে ফুটপাথগুলো ভিজিয়ে গেছে, তখনও ভিজেভিজে ভাব। তার নিজের ব্রেকফাস্ট করার সামর্থ্য নেই, কেবলমাত্র ঈর্ষান্বিত হয়ে দেখতে হচ্ছিল পাশের টেবিলের ওই মহিলা নানানরকমের বানানো ফলের রস অর্ডার করে যাচ্ছেন। তারপর আপন খেয়ালখুশীতেই, যদিও তখনও দশটা বাজেনি, একবাটি ঝিনুক সেদ্ধ অর্ডার করে বসলেন। টাইবরের কেমন যেন মনে হ’ল সেই মহিলাও তাকে মাঝেমধ্যে আড়ে আড়ে দেখছে, কিন্তু সেটা নিয়ে সে বেশী ভাবল না।

‘ভারী চমৎকার মহিলা, দেখতেও দারুণ,’ ও তখন আমাদের বলেছিল। ‘কিন্তু দেখতেই পাচ্ছো, উনি আমার থেকে প্রায় দশ পনেরো বছরের বড় হবেন। তাহলে কিছু চক্কর চলছে সেটাই বা ভাবব কী ভাবে?’

তারপর ও এই বিষয়টা ভুলে গেল। ঘরে ফিরে গিয়ে লাঞ্চের আগে ঘন্টা দু’য়েক রেওয়াজ করতে হবে। তাই ও ওঠার তোড়জোড় করছিল। এমন সময় হঠাৎ ও দেখল সেই মহিলা ওর সামনে সটান দাঁড়িয়ে।

বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। দেখে মনে হবে ওদের মধ্যে অনেকদিনের চেনাজানা। স্বভাবে লাজুক বলে ও সেই মহিলাকে কোনো অভিবাদন জানাতে পারল না। তারপর তিনি ওর কাঁধে একটা হাত এমনভাবে রাখলেন যেন মনে হবে ও কোনো পরীক্ষায় ফেল করেছে আর উনি সান্ত্বনা জানাচ্ছেন। তিনি বললেন,

‘সেদিন তোমার বাজানোর সময় আমি ছিলাম। সান লোরেঞ্জো-তে’।

‘ধন্যবাদ,’ ব’লে ও বুঝতে পারল উত্তরটা খুব বোকা বোকা শোনাল। তারপর যখন দেখল সেই মহিলা ওর দিকে তাকিয়েই আছেন, ও বলল, ‘ও হ্যাঁ, সান লোরেঞ্জো চার্চে। ঠিক। আমি ওখানে একদিন বাজিয়েছিলাম’।

মহিলাটি তখন হাসতে হাসতে হঠাৎ ওর সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লেন। ‘এমনভাবে বলছ যেন ইদানিং তোমার পরপর ঠাসা অনুষ্ঠান রয়েছে,’ ঠাট্টার সুরে তিনি বললেন।

‘যদি তেমনকিছু মনে হয়, তাহলে আমি বলছি আমার বলার ধরণটা একটু ভুল হয়ে গেছে। যে অনুষ্ঠানটায় আপনি এসেছিলেন, সেটা ছিল বিগত দু’মাসে আমার প্রথম অনুষ্ঠান’।

‘কিন্তু তুমি তো এখন সবে আরম্ভ করছ,’ তিনি বললেন। ‘ভালোই বাজাও, যেকোনো অনুষ্ঠানে ডাক পাবার মতো। আর সেদিনও তো ওখানে ভালো ভীড় ছিল’।

‘ভালো ভীড়? ওখানে মাত্র চব্বিশজন ছিল’।

‘তখন সবে বিকেল। বিকেলের অনুষ্ঠানের পক্ষে সংখ্যাটা ভালোই’।

‘আমার অভিযোগ জানানো উচিত নয়। তবুও বলব, ভীড়টা ভালো ছিল না। যে সমস্ত ট্যুরিস্টরা ছিল, তাদের কিছু করার ছিল না বলে সেখানে ছিল’।

‘ওহ! এতোটা হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? আরে, আমি তো ওখানে ছিলাম। আমি ওই ট্যুরিস্টদের মধ্যে একজন ছিলাম’। তখন ও লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, কারণ ক্ষোভ উগরাতে ও এসব বলেনি। মহিলাটি তখন ওর হাত ছুঁয়ে, মুচকি হেসে আবার বললেন, ‘তুমি সবে শুরু করছ। এখন তোমার শ্রোতাদের সংখ্যা নিয়ে ভাবতে হবে না। মনে রাখবে, সেই জন্যে তুমি বাজাচ্ছ না’।

‘ওহ, তাই নাকি? শ্রোতাদের জন্যে বাজাচ্ছি না তো কাদের জন্যে বাজাচ্ছি?’

‘আমি তা বলিনি। আমি তোমাকে যেটা বলতে চাইছি সেটা হ’ল তোমার কেরিয়ারের এই জায়গায় তোমার শ্রোতা কুড়ি হ’ল দু’শো হ’ল তাতে কিছু যায় আসে না। কেন যায় না বলব? কারণ তোমার সেটা আছে!’

‘আমার আছে?’

‘হ্যাঁ, তোমার আছে। নিশ্চয়ই আছে। তোমার সেই... সম্ভাবনা।

ওর ঠোঁটের কোণে একটা অভব্য হাসি বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাকে সংবরণ করে নিল। ওনাকে না করে নিজেকেই নিজের ভর্ৎসনা করতে ইচ্ছে হ’ল। মনে হয়েছিল, উনি হয়তো ওকে বিশাল পণ্ডিত বা প্রতিভাবান কিছু বলবেন, কিন্তু পরমুহূর্তেই ওনার কথায় ওর সে ভুল ভেঙে গেল। তিনি আরও বলতে লাগলেন,

‘এখন তুমি কী করবে, না তুমি একজনের জন্যে অপেক্ষা করবে যে এসে তোমার বাজনা শুনবে। সেই মঙ্গলবারের কুড়িজন শ্রোতার মধ্যে একজনকে তুমি অনায়াসেই একটা ঘরে পেয়ে যাবে...’

‘আয়োজক ছাড়া চব্বিশ জন...’

‘ওই হ’ল, চব্বিশ জন। আমি যেটা বলতে চাইছি, সেটা হ’ল এখন ওই সংখ্যাটা কোনো ব্যাপার নয়। ব্যাপার হ’ল সেই একজন’।

‘আপনি রেকর্ডিং কোম্পানীর লোকের কথা বলছেন?’

‘রেকর্ডিং? আরে না না। ওটা এমনি এমনিই হয়ে যাবে। না, আমি সেই লোকের কথা বলছি যে তোমাকে ফুটিয়ে তুলবে, যে তোমার বাজনা শুনবে আর বুঝবে তুমি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সাধারণ মাপের কেউ নও। তুমি এখনও গুটিপোকা হয়ে আছ, একটু সাহায্য পেলেই তুমি প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাবে’।

‘ও, বুঝলাম। তা, কোনওভাবে আপনি কি সেই লোক হতে পারেন?’

‘আরে, বাদ দাও! তুমি তো বেশ অহংকারী হে। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয় না তো, যে তোমার মেন্টর হবার জন্যে লোকেদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। অন্তত, আমার মাপের তো কেউ নয়’।

একটা বড়সড় ভুল করে ফেলে ও তখন রীতিমতো বেকায়দায়। আবার ভালো করে সেই মহিলাকে দেখল। তিনি তখন চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে ফেলেছেন। ও দেখল নম্র, দয়ালু সেই মুখে ফুটে উঠেছে হতাশার ছাপ, হয়তো কিছুটা রাগও। ও তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েই রইল, আশা করছিল চিনতে পারবে, কিন্তু শেষমেশ বলতে বাধ্য হ’ল,

‘আমি খুব দুঃখিত। আপনি বোধহয় কোনো খ্যাতনামা সুরকার?’

‘আমি এলুইজে ম্যাককরম্যাক,’ হাসিমুখে তিনি বললেন আর তারপর হাত বাড়িয়ে দিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, নামটা টাইবরের অজানা, তাই ও পড়ল আরও মুশকিলে। প্রথমেই ও অবাক হওয়ার ভান করল, আর বলল, ‘সত্যি, কী আশ্চর্য!’ কিন্তু তারপর যখন মনে হ’ল এমন মিথ্যে বলা শুধু অসাধুতাই নয়, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লজ্জাজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে, ও নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল,

‘মিস ম্যাককরম্যাক, আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ায় আমি অভিভূত। কিন্তু বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আমি বয়সে নবীন এবং আগেকার ইস্টার্ন ব্লকের লোহার ঘেরাটোপে বড় হবার কারণে হালের ফিল্ম স্টার বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও চিনি না, যদিও তাদের নাম পশ্চিমের ঘরে ঘরে জানে। তাই আপনি ঠিক কে সেটা আমি বুঝতে পারছিনা ব’লে আমাকে ক্ষমা করবেন’।

‘হুম...তোমার আন্তরিকতার প্রশংসা না করে পারছি না’। মুখে একথা বললেও তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি অপমানিত বোধ করছেন। তাঁর আগের উৎসাহও আর দেখা যাচ্ছিল না। কিছুটা অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে ও আবার বলল,

‘আপনি কোনো খ্যাতনামা সুরকার, ঠিক?’

তিনি মাথা নাড়লেন। তাঁর দৃষ্টি তখন ভেসে বেড়াচ্ছে স্কোয়্যারটার উল্টোদিকে।

‘আমি আবার ক্ষমা চাইছি,’ ও বলল। ‘আমি সত্যিই ভীষণ সন্মানিত যে আমার মতো তুচ্ছ একজনের বাজনা শুনতে আপনি এসেছিলেন। আমি কি জানতে পারি আপনি কোন যন্ত্র বাজান?’

‘তোমার মতো,’ তিনি চটপট জবাব দিলেন। ‘চেলো। এইজন্যেই তো আমি শুনতে গিয়েছিলাম। তোমার মতো সাধারণ কেউ বাজালেও আমি না গিয়ে পারি না। শুনেও আমি অন্যদিকে চলে যেতে পারি না। আমার তো একটা লক্ষ্য আছে, সেইজন্যেই মনে হয়’।

‘একটা লক্ষ্য?’

‘আমি জানি না তাছাড়া এটাকে আর কী বলব। আমি চাই সমস্ত চেলোবাদক খুব ভালো বাজাক। ভীষণ চমৎকার বাজাক। প্রায়শই দেখি তারা এমন ভুল পথে পরিচালিত হয়ে বাজাচ্ছে’।

‘কিছু মনে করবেন না, কিন্তু শুধুমাত্র কি আমরা এই চেলোবাদকরাই ভুল পথে পরিচালিত হয়ে বাজাচ্ছি? নাকি আপনি সব সুরকারদের কথাই বলছেন’।

‘হতে পারে এটা অন্য বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। কিন্তু আমি একজন চেলোবাদক, তাই আমি অন্য চেলোবাদকদের বাজনাই শুনি, আর যখন শুনি কিছু ভুল হচ্ছে... জানো, সেদিন কী হয়েছিল, মিউজিও সিভিকো-র বারান্দায় কিছু অল্পবয়সী ছেলে বাজাচ্ছিল আর লোকজন সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করেই যে যার মতো নিজের কাজে ছুটছিল। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে পড়ে শুনলাম। আর তুমি তো জানো, আমি না বলে থাকতে পারি না’।

‘ওরা কি ভুল বাজাচ্ছিল?’

‘না, ঠিক ভুল সেটাকে বলা যায় না। কিন্তু... হ্যাঁ, ওটার অভাব ছিল। ওটার ধারেকাছেও ছিল না। তুমি হয়তো ভাবছ আমি খুব বেশী আশা করছি। আমি জানি, আমি যেমনটা চাইছি তেমনটা সবাই বাজাবে সেটা আশা করা বৃথা। মনে হয় ওরা মিউজিকের স্টুডেন্ট ছিল’।

এতক্ষণে তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। স্কোয়্যারের মাঝখানে বসানো ফোয়ারাটার কাছে বাচ্চারা হইহল্লা করে একে অন্যের দিকে জল ছেটাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে টাইবর বলে উঠল,

‘মঙ্গলবার আমার ক্ষেত্রেও আপনি বোধহয় সেই তাগিদটাই অনুভব করেছিলেন। আমার কাছে এসে আমাকে আপনার পরামর্শ দেবার তাগিদ’।

তিনি হাসলেন, আর পরমুহূর্তেই তাঁর মুখটা খুব গম্ভীর হয়ে গেল। ‘হ্যাঁ, করেছিলাম,’ তিনি বলে উঠলেন। ‘আমি সত্যিই করেছিলাম। কারণ আমি যখন তোমার বাজনা শুনলাম, মনে হ’ল আমি আমারই একসময়ের বাজনা শুনছি। কিছু মনে কোরো না, হয়তো একটু খারাপ শোনাবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, তুমি এখনও সঠিক রাস্তা খুঁজে পাওনি। তাই যখন আমি তোমার বাজনা শুনলাম, তোমাকে সাহায্য করার জন্যে উঠেপড়ে লাগলাম, তা সে দেরিই হোক আর তাড়াতাড়িই হোক’।

‘আপনি হয়তো জানেন না, আমি ওলেগ পেট্রোভিচের কাছে শিখেছি’। খুব সাদামাটাভাবে কথাটা বলে টাইবর উত্তরের অপেক্ষায় রইল। কিন্তু এটা শুনে তিনি মুখ টিপে হাসছেন দেখে আরও অবাক লাগল।

‘পেট্রোভিচ, হ্যাঁ,’ তিনি বললেন। ‘পেট্রোভিচ তাঁর সময়ের একজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী ছিলেন। আর আমি জানি তাঁর ছাত্ররা আজও তাঁকে সমীহ করে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অনেকের কাছে তাঁর ধ্যানধারণা, তাঁর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী...’ কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই বাকিটা তিনি মাথা নেড়ে, হাতদু’টো প্রসারিত করে বোঝালেন। টাইবরের তখন প্রচণ্ড রাগে কথা প্রায় বন্ধ। ও তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি আবার তাঁর হাতটা ওর হাতের ওপর রেখে বললেন, ‘আমি অনেক বলে ফেলেছি। আমার বলার অধিকার নেই। আমি এখন যাচ্ছি। তুমি শান্তিতে থাকো’।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে টাইবরের রাগও কিছুটা পড়ল। টাইবরের স্বভাবটা ছিল খুব উদার। ও বেশীদিন কোনো মানুষের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে থাকতে পারত না। আর তাছাড়া, সেই মহিলা ওর পুরোনো শিক্ষক সম্বন্ধে যা ব’লে ওর মনে নাড়া দিলেন, সেটা ওর মনে হলেও কোনদিন প্রকাশ করতে সাহস হয়নি। তাই ও যখন তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকাল, ওকে দেখে বিভ্রান্ত ছাড়া আর কিছু মনে হ’ল না।

‘দ্যাখো,’ তিনি বললেন, ‘মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর এখন এতোই রেগে আছো যে এসব নিয়ে তুমি এখন ভাবতে পারবে না। কিন্তু তবু আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। যদি তোমার মনে হয় তুমি এই বিষয় নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করতে চাও, তাহলে আমার কাছে চলে এসো। আমি কাছেই, এক্সেলসিয়র-এ আছি’।

এই হোটেলটা শহরের সবচেয়ে বড় হোটেল। ক্যাফের সামনে স্কোয়্যার, আর তার উল্টোদিকে একদম শেষ প্রান্তে রয়েছে হোটেলটা। তিনি আঙুল উঠিয়ে টাইবরকে দেখালেন। তারপর একটু মুচকি হেসে সেইদিকে হাঁটা লাগালেন। ও তাকিয়েই রইল যতক্ষণ না পর্যন্ত স্কোয়্যারের মাঝখানে বসানো ফোয়ারাটার কাছে গিয়ে তিনি বাঁক নেন। সেখানে পৌঁছে একটু তাড়া দিয়ে পায়রার ঝাঁকটাকে ওড়ালেন, আর তারপর টাইবরকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে নিজের রাস্তায় এগিয়ে গেলেন।

***

পরের দু’দিন ধরে ও এই সাক্ষাতটা নিয়ে অনেকবার ভাবল। পেট্রোভিচের নাম করায় তাঁর মুখে বিদ্রুপের হাসিটা মনে পড়ে গিয়ে আবার নতুন করে রাগ হতে লাগল। ও এটাও লক্ষ করল যে ওর রাগটা কিন্তু ওর পুরোনো শিক্ষকের তরফে হচ্ছে না। রাগটা বরং হচ্ছে পেট্রোভিচের নাম নিয়েও সম্ভ্রম আদায় করতে না পারার জন্যে। ও এতোদিনে মোটামুটি এইভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল যে পেট্রোভিচের নাম উল্লেখ করলেই তার একটা প্রভাব পড়বে। এটা যেন একধরণের সার্টিফিকেট যেটা দিয়ে ও গোটা দুনিয়ায় ভাঙিয়ে খাবে। কিন্তু তখনই ওর মাথা গরম হয়ে গেল যখন দেখল সেই সার্টিফিকেট যতটা ওজনদার ওর মনে হয়েছিল, ততটা আদৌ নয়।

যাবার সময়ের তাঁর আমন্ত্রণটাও টাইবরের বারবার মনে পড়ছিল। ও যতক্ষণ স্কোয়্যারে বসেছিল, ও খেয়াল করল, ওর নজর চলে যাচ্ছিল দূরে, সেই এক্সেলসিয়র হোটেলের প্রধান প্রবেশপথের দিকে যেখানে দারোয়ানের সামনে দিয়ে ঘনঘন ট্যাক্সি, লিমুজিন ঢুকছে আর বেরোচ্ছে।

অবশেষে, এলুইজে ম্যাককরম্যাকের সাথে কথা বলার তৃতীয় দিনের মাথায়, ও বাজারচত্বরটা পেরিয়ে হোটেলের মার্বেলমোড়া বারান্দাটায় গিয়ে উঠল। তারপর ফ্রন্ট ডেস্কে এসে তাঁর এক্সটেনশনে ফোন করতে বলল। রিসেপশানিস্ট ফোনে কথা বলে ওর নাম জানতে চাইল। তারপর আরও কয়েকটা কথা বলে রিসিভারটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো।

‘আমি ভীষণ দুঃখিত,’ ওপ্রান্ত থেকে তাঁর গলা ভেসে এলো। ‘সেদিন আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছিলাম। তাই তুমি কে সেটা ভেবে বার করতে একটু সময় লাগল। আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি। সত্যি বলতে কি, আমি তোমার করুণ ভাগ্যের কথা ভাবছিলাম। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। আর সেটা এক্ষুণিই বলা দরকার। তোমার সঙ্গে চেলো এনেছো? না, আনোনি নিশ্চয়ই। তাহলে এক ঘন্টার মধ্যে নিয়ে চলে এস না। ঠিক এক ঘন্টা কিন্তু। আমি তোমার অন্যে অপেক্ষা করব’।

ও যখন এক্সেলসিয়রে ওর বাদ্যযন্ত্রটা নিয়ে আবার ফেরত এলো, রিসেপশানিস্ট তাড়াতাড়ি এলিভেটরের দিকে দেখিয়ে বলল মিস ম্যাককরম্যাক ওর জন্যে অপেক্ষা করছেন।

সেই ভরদুপুরে তাঁর ঘরে ঢুকে টাইবরের এক অদ্ভুত অন্তরঙ্গতা বোধ হ’ল। ঢুকেই একটা বড় স্যুইট। বেডরুমটা সম্পূর্ণ আড়ালে। শাটার লাগানো বড় বড় জানালা। শাটার সরাতেই হাওয়ায় জানালার পর্দা উড়তে লাগল। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেই স্কোয়্যারটা নজরে পড়বে। অমসৃণ পাথরের দেওয়াল, গাঢ় পালিশ করা কাঠের মেঝে নিয়ে ঘরটা যেন একটা মঠের মতো লাগছিল। তার সঙ্গে ছিল ফুল, কুশন আর অ্যান্টিক কিছু আসবাবপত্র। ঘরটার সঙ্গে একদম বেমানানভাবেই তাঁর পরণে টি-শার্ট আর ট্র্যাকস্যুট, যেন এক্ষুণি দৌড়ে ফিরেছেন। চা বা কফি কোনকিছুই অফার না করে খুব সাদামাটাভাবে অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি বললেন,

‘আমাকে বাজিয়ে শোনাও। সেদিন অনুষ্ঠানে যেটা বাজিয়েছিলে, সেটাই আজ আমার জন্যে বাজাও’।

ঘরের মাঝখানে রাখা পালিশকরা খাড়া চেয়ারটা দেখিয়ে ওকে বসতে বললেন। ওটার ওপরে বসেই ও চেলোটা কেস থেকে বার করতে শুরু করল। কিছুটা কুণ্ঠিতভাবে তিনি গিয়ে বসলেন একটা বড় জানালার সামনে, ওর সঙ্গে ঠিক আড়াআড়িভাবে। তারপর যতক্ষণ ও যন্ত্রটাকে সুরে বাঁধছিল, তিনি সামনের ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন। ও বাজাতে শুরু করার পরেও তিনি ঠায় একইভাবে বসে রইলেন। প্রথম টুকরোটা বাজানোর পর তিনি কিছু না বলে চুপ করে থাকলেন। তাই ও তাড়াতাড়ি আরেকটা টুকরো ধরল, তারপর আরেকটা। আধঘন্টা পার হয়ে গেল, তারপর একঘন্টা। ঘরের ছায়াময় পরিমণ্ডল, উড়তে থাকা পর্দার ফাঁক দিয়ে ফিকে হয়ে যাওয়া বিকেলের রোদ, নীচে বাজারচত্বরের শোরগোল, সর্বোপরি, ঘরের মধ্যে তাঁর উপস্থিতি ওর বাজনায় এক নতুন গভীরতা, নতুন ইঙ্গিতের সৃষ্টি করছিল। দ্বিতীয় ঘন্টার শেষদিকে ওর মনে হ’ল এবার নিশ্চয়ই তাঁর প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। কিন্তু ও যখন বাজনা শেষ করল, দুজনেই চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর দিকে মুখ করে বসে তিনি বললেন,

‘হুম, আমি বুঝতে পারছি তুমি ঠিক কোন জায়গায় আছ। ব্যাপারটা খুব একটা সহজ হবেনা, কিন্তু তুমি পারবে। তুমি নিশ্চয়ই পারবে। চলো, ব্রিটেনেরটা দিয়ে আমরা শুরু করি। ওটা আবার বাজাও, শুধু ধরতাইটা, আর তারপর আমরা ওটা নিয়ে আলোচনা করব। এমনভাবে একটু একটু করে একসাথে আমরা এগিয়ে যেতে পারব’।

এই কথা শুনেই ওর মনে হ’ল যন্ত্রটা বেঁধেছেঁদে নিয়ে এক্ষুনি চলে যাবে। কিন্তু আবার কৌতুহলবশত বা হয়তো নিজের অহংকারকে জয় করতে ও ওই টুকরোটা বাজাতে শুরু করল। বেশ অনেকগুলো মাত্রা পেরোনোর পর ওকে থেমিয়ে দিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন। এবারও ওর উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করল। তারপর মনে মনে স্থির করে নিল, ভদ্রতা দেখিয়ে খুব বেশী হলে আর মাত্র পাঁচ মিনিট এই গায়েপড়া প্রশিক্ষণ ও সহ্য করবে। কিন্তু দেখল ও তার থেকে একটু বেশী রয়ে গেল, তারপর আরও একটু বেশী। ও কিছুটা বাজাচ্ছিল, আর তারপর তিনি আবার বলছিলেন। প্রথম চোটে তাঁর কথাগুলো দাম্ভিকতাপূর্ণ এবং ভিত্তিহীন শোনাচ্ছিল, কিন্তু ও যখন সেগুলোকে ওর বাজানোর মধ্যে দিয়ে আত্মস্থ করছিল, তখন তার প্রভাব দেখে আশ্চর্য হচ্ছিল। ঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই আরও একঘন্টা কেটে গেল।

‘আমি হঠাৎ যেন কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম,’ ও আমাদের ব্যাখ্যা করে বলেছিল। ‘যেন একটা বাগান, যেখানে আমি এখনও ঢুকিনি। ওটা আগে থেকেই ছিল, কিছুটা দূরে। রাস্তায় অনেককিছু ছিল। কিন্তু সেটাই প্রথমবার, দেখলাম রয়েছে। বাগানটা আমি আগে কখনও দেখিনি’।

হোটেল থেকে ও যখন বেরোলো, সূর্য ডুবে গেছে। বাজারচত্বরটা পেরিয়ে ক্যাফের টেবিলগুলোর কাছে এসে পৌঁছল। তারপর মনের সুখে হুইপড ক্রিম দিয়ে একটা আমন্ড কেক নিয়ে বসল। মনের মধ্যে অহংকারের বিন্দুমাত্র তখন আর অবশিষ্ট ছিল না।

***

তারপর বেশ কিছুদিন বিকেলবেলায় ও নিয়মিত সেই হোটেলে যেতে লাগল, আর সববারেই ফেরার সময়, প্রথমবারের মতো আবরণ উন্মোচনের অভিজ্ঞতা না হলেও, মনটা অন্তত নতুন আশা উদ্দীপনায় ভরে থাকত। এদিকে তাঁর বলার মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। বাইরের কেউ যদি সেখানে থাকত তবে নির্ঘাৎ ভাবত এ কী বেয়াদবের মতো কথা! কিন্তু টাইবরের সেইধরণের কথায় আর তেমনকিছু মনে হ’ত না। ওর তখন একটাই ভয়, কবে তাঁর এই শহরে থাকার দিন ফুরিয়ে যাবে, আর এই চিন্তাই ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত, রাতে ঘুমোতে দিত না। কিন্তু যখনই ও এই বিষয় নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করত, স্পষ্ট কিছু উত্তর পেত না। কখনও হয়তো বলতেন, ‘ওহ, যতক্ষণ পর্যন্ত ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারব’। আবার কখনও বলতেন, ‘আমার মনে হয়, যতদিন পর্যন্ত এখানে একঘেয়ে না লাগছে, ততদিন আমি আছি’।

‘কিন্তু উনি কার মতো বাজান?’ আমরা ওকে জিজ্ঞেস করেই যেতাম। ‘মানে চেলোতে। উনি কার মতো?’

প্রথমবার যখন আমরা প্রশ্নটা তুলেছিলাম, টাইবর আমাদের ঠিকমতো জবাব দেয়নি। শুধু বলেছিল, ‘উনি আমাকে বলেছেন উনি একজন সঙ্গীতবিশারদ, একদম গোড়া থেকে’, বলে প্রসঙ্গ পালটে দিয়েছিল। কিন্তু পরে যখন বুঝল আমরা ওকে রেহাই দেব না, ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাদের ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল।

বিষয়টা হ’ল, একদম প্রথমবারেই, টাইবরের কৌতুহল জেগেছিল তাঁর বাজনা শোনার, কিন্তু ও সেদিন এতটাই ভয় পেয়ে ছিল যে তাঁকে বলতে পারেনি। ওর একটু সন্দেহ হয়েছিল যখন ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখেছিল সেখানে তাঁর নিজের চেলোর কোনো চিহ্ন নেই। তারপর আবার মনে হয়েছিল, ছুটি কাটাতে এসে সঙ্গে চেলো নিয়ে আসেনি এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আবার এটাও মনে হয়েছিল যে হয়তো চেলো আছে—ভাড়া করা চেলো—বন্ধ বেডরুমের ভেতর রাখা আছে।

কিন্তু ওই স্যুইটে পরবর্তী সেশনগুলো যখন ও যেতে শুরু করল, তখন সন্দেহ আরও বাড়ল। ও যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল মন থেকে সেসব হঠিয়ে দিতে। তিনি যে ওর বাজনা শুনছেন, এটাই ওর কাছে একটা বড় পাওনা। তাই একটা বিকেল থেকে আরেকটা বিকেলের মাঝের সময়টায় ও মনে মনে ভাবত পরেরদিন কী বাজাবে, তাতে তিনি কী মন্তব্য করবেন, তাঁর মাথা নাড়ানো, তাঁর ভ্রূকুটি, বাহবা জানানো, আর সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক, ওর সুরের আবেশে চোখ বন্ধ করে হাতের ভঙ্গিমার অনুকরণ। কিন্তু তবুও সন্দেহ যায় না, আর তারমধ্যেই একদিন ও ঘরে ঢুকে দেখল বেডরুমের দরজাটা আধখোলা। ভেতরেও পাথরের দেওয়াল, মান্ধাতার আমলের ছত্রী লাগানো খাট, কিন্তু চেলোর কোনো চিহ্ন নেই। একজন সঙ্গীতবিশারদ, যতই ছুটিতে থাকুন, এতদিন বাদ্যযন্ত্র না ছুঁয়ে থাকবেন? কিন্তু এই প্রশ্নটাও ও মনে থেকে দূর করে দিল।

***

গ্রীষ্ম চলাকালীনই ওদের আলাপ আলোচনা হোটেলের সেশন শেষ হবার পর ক্যাফের টেবিল অবধি এসে পৌঁছল। তিনি ওর জন্যে কেক, কফি, মাঝেমাঝে স্যান্ডুইচ কিনে দিতেন। তখন আর ওদের কথাবার্তা শুধু বাজনার মধ্যেই আটকে থাকত না। যেমন, তিনি হয়তো ওকে ভিয়েনায় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা সেই জার্মান মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করতেন।

‘কিন্তু বোঝার চেষ্টা করুন, ও কোনদিনই আমার গার্লফ্রেণ্ড ছিল না,’ টাইবর তাঁকে বলত। ‘আমাদের মধ্যে তেমন কিছু ছিল না’।

‘তুমি বলতে চাইছো, তোমাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক ছিল না? কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে তুমি ওকে ভালোবাসতে না’।

‘না, মিস এলুইজে, এটা ঠিক নয়। আমার ওকে ভালো লাগত ঠিকই, কিন্তু আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না’।

‘কিন্তু কাল যখন তুমি আমার ওখানে র‍্যাকমানিনভ বাজাচ্ছিলে, তোমার মধ্যে একটা আবেগ ফুটে উঠছিল। প্রেম, রোম্যান্টিক প্রেমের আবেগ’।

‘না, হতেই পারে না। ও আমার ভালো বন্ধু ছিল, কিন্তু আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল না’।

‘কিন্তু তুমি ওই অংশটা এমন বাজাও, মনে হয় যেন কোনো প্রেমের স্মৃতিতে বাজাচ্ছ। তোমার এত অল্প বয়স, তবু তুমি ত্যাগ জানো, বিচ্ছেদ জানো। এইজন্যেই থার্ড মুভমেন্টটা তুমি অমনভাবে বাজাতে পারো। বেশীরভাগ চেলোবাদকই ওই মুভমেন্টটা বাজায় আনন্দের সুরে। কিন্তু তোমার কাছে সেটা আনন্দের নয়, সেটায় থাকে আনন্দঘন মুহূর্তের স্মৃতি যা ছেড়ে গেছে চিরকালের মতো’।

ওদের মধ্যে এমন ধরণের আলোচনা হ’ত, আর তার পরিপ্রেক্ষিতে ওরও লোভ হ’ত তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করার। কিন্তু যেহেতু পেট্রোভিচের কাছে শেখাকালীন তাঁকে কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার সাহস ওর হয়নি, তাই এলুইজেকেও ও তেমন ধরণের কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। পরিবর্তে, তাঁর উত্থাপন করা ছোটখাটো বিষয়গুলোতেই—যেমন পোর্টল্যাণ্ডে, ওরিগনে তিনি কেমনভাবে থাকতেন, সেখান থেকে তিন বছর আগে তিনি কীভাবে বোস্টন চলে গেছিলেন, দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে বলে পারী-কে তিনি কেমন অপছন্দ করতেন—আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকত।

বন্ধুত্বের প্রথম দিনগুলোর তুলনায় এখন তিনি অনেক সহজেই হেসে ওঠেন, আর এক্সেলসিয়র থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে বাজারচত্বরটা পেরোলেই নিজের হাত দিয়ে ওর হাতটা জড়িয়ে নেবার অভ্যেস হয়ে গেছে। এই কারণেই আমাদের প্রথম নজর পড়েছিল ওদের দু’জনের ওপর। এক অদ্ভুত জুটি, ওকে যা ওর বয়স তার থেকে অনেক কমবয়সী দেখায়, আর সেই মহিলা কিছুটা মায়ের মতন, কিছুটা, এরনেস্টোর ভাষায়, ‘ছিনালী অভিনেত্রী’র মতো। টাইবরের সাথে আমাদের কথা শুরুর আগে, আমরা ওদের নিয়ে অনেক ফালতু আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করতাম, ব্যান্ডের সদস্যরা যেমন করে আর কি। ওরা যদি আমাদের সামনে দিয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যেত, আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলতাম, ‘কী মনে হচ্ছে? চক্কর চলছে, না?’ কিন্তু আন্দাজে এসব বলে মজা পেলেও, পরক্ষণেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলতাম এটা হতে পারে না; ওদের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকা ভাবটাই নেই। আর তারপর টাইবরের সাথে আলাপ জমে যাবার পর, বিকেলবেলাগুলো তাঁর স্যুইটে গিয়ে কী কী হ’ত, ও নিজেই সেসব আমাদের বলত। আমাদের কেউই তখন ওকে টিটকিরি দেওয়া বা ওকে নিয়ে মজা করার কথা ভাবতাম না।

তারপর একদিন বিকেলে ওরা যখন স্কোয়্যারে কফি আর কেক নিয়ে বসেছিল, তিনি একজন লোকের সম্বন্ধে বলতে শুরু করলেন যিনি তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল পিটার হেন্ডারসন। তিনি ওরিগনে জমিয়ে গলফের ইক্যুইপমেন্ট বিক্রির ব্যবসা চালাতেন। কেতাদুরস্ত, ভদ্র, সমাজে সম্ভ্রান্ত ব’লে পরিচিত। এলুইজের থেকে বয়সে ছ’বছরের বড়, কিন্তু সেটা তেমন কিছুই না। আগের পক্ষের স্ত্রীর দু’টো বাচ্চা আছে বটে, কিন্তু সেসব আপসে ফয়সালা হয়ে গেছে।

‘তুমি এখন বলো আমি এখানে কী করছি,’ বোকা বোকা একটা হাসি হেসে তিনি বললেন। তাঁর এমন হাসি টাইবর আগে কখনও দেখেনি। ‘আমি গা-ঢাকা দিয়ে আছি। পিটার জানে না আমি কোথায়। আমি জানি আমি খুব নিষ্ঠুর। গত মঙ্গলবার আমি ওকে ফোন করেছিলাম, বলেছিলাম আমি ইতালিতে আছি, কিন্তু কোন শহরে সেটা বলিনি। আমার ওপর খুব রেগেছিল, আর মনে হয় সেটা অন্যায়ও কিছু নয়’।

‘তাহলে, আপনি ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে গরমের ছুটি কাটাচ্ছেন,’ টাইবর বলল।

‘না, ঠিক তা নয়। আমি শুধু গা-ঢাকা দিয়ে আছি’।

‘এই পিটারকে আপনি ভালোবাসেন না?’

তিনি কাঁধ ঝাঁকালেন। ‘ও খুব ভালো মানুষ। আর আমার সামনে যে অনেক সুযোগ আছে, তেমনটাও নয়’।

‘আপনার এই পিটার, গানবাজনা ভালোবাসেন?’

‘ওহ... এখন যেখানে আমি থাকি, ওখানে তো ওকে বলতেই হয়। সবচেয়ে বড় কথা, ও কনসার্টে যায়। আর তারপর, রেস্তোরাঁয় বসে, কনসার্টে যা শুনেছে সেসব সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা বলে। তাই ও গানবাজনা ভালোবাসে সেটা তো স্বীকার করতেই হয়’।

‘কিন্তু তিনি... মানে, আপনার প্রশংসা করেন?’

‘ও জানে, একজন সঙ্গীতবিশারদের সঙ্গে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়’। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলেন, ‘এটাই আমার সারা জীবনের সমস্যা। তোমার পক্ষেও এটা সহজ হবে না। কিন্তু তোমার আর আমার, আমাদের সত্যি কোনো উপায় নেই। আমাদের একটা সংকল্প আছে’।

এরপর তিনি আর কখনও পিটারের কথা তোলেননি। কিন্তু সেদিনের কথাবার্তার পর ওদের সম্পর্কের একটা নতুন দিক খুলে গিয়েছিল। ওর বিকেলের বাজনা শেষ হবার পর তাঁর চুপ করে থাকার সময়, অথবা বাজারচত্বরে একসাথে বসে থাকার সময়, তিনি যখন বিভোর হয়ে যেতেন, উদাস হয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, ও বুঝতে পারত ওর উপস্থিতি তাঁর কাছে কতটা কাম্য।

***

একদিন বিকেলে ওর একটা টুকরো বাজানো শেষ হ’লে, তিনি আবার একটা ছোট টুকরো বাজাতে বললেন—শুধু আট মাত্রা—শেষের দিক থেকে। যেমন বললেন, তেমনটাই ও বাজাল। কিন্তু তবুও তাঁর কপালে একটু ভাঁজ থেকে গেল।

‘এটা আমাদের মতো শোনাল না’, মাথা নাড়াতে নাড়াতে তিনি বললেন। যথারীতি, তিনি সেই বড় জানালাটার সামনে ওর ঠিক আড়াআড়ি বসেছিলেন। ‘বাকিটা যা বাজিয়েছ সব ঠিক আছে। বাকি সবটা আমাদের মতো। কিন্তু ওই অংশটা...’ তিনি একটু নড়ে বসলেন।

ও ওটা আবার বাজাল, অন্যভাবে, যদিও ঠিক কী বাজাতে চাইছে সেটা না বুঝেই, আর ও মোটেও অবাক হ’ল না যখন ও দেখল এবারেও তিনি মাথা নাড়াচ্ছেন।

‘স্যরি,’ ও বলল। ‘ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট করুন। “আমাদের মতো না” বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি না’।

‘তুমি কি বলতে চাইছ আমি তোমাকে বাজিয়ে দেখিয়ে দেব? তাই বলতে চাইছ?’

তিনি খুব শান্তভাবেই কথাগুলো বললেন। কিন্তু তারপর তিনি যেই ওর দিকে ঘুরলেন, ও টের পেল একটা আতঙ্ক ওদের মধ্যে নেমে আসছে। তিনি ওর দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে, প্রায় মরিয়া হয়ে, অপেক্ষা করছেন ওর উত্তরের।

অবশেষে ও বলল, ‘না, আমি আবার চেষ্টা করছি’।

‘তুমি হয়তো ভাবছ, আমি নিজে কেন বাজাচ্ছি না, তাই না? কেন তোমার যন্ত্রটা ধার নিয়ে যেটা বলতে চাইছি সেটা দেখিয়ে দিচ্ছি না’।

‘না...’ উদাসভাবে ও মাথা নাড়ল। ‘না, আমার মনে হয় এটাই ঠিক আছে, সবসময় যেমনভাবে আমরা চলি। আপনি মুখে বলে দেন, তারপর আমি বাজাই। এইভাবে করলে তো নকল করা এড়ানো যায়। আপনার কথাগুলো আমার কাছে এক একটা জানালা খুলে দেয়। আপনি যদি বাজিয়ে দেখিয়ে দেন, তাহলে সেই জানালাগুলো খুলবে না। আমার শুধু নকল করাই হবে’।

ওর কথাগুলো তিনি বিবেচনা করলেন, তারপর বললেন, ‘তুমি হয়তো ঠিক বলছ। বেশ, আমি আরেকটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি’।

পরের বেশ কিছুটা সময় তিনি এপিলোগ আর ব্রিজিং প্যাসেজের ফারাক নিয়ে বললেন। তারপর যখন ও আবার ওই কটা মাত্রা বাজাল, তিনি মুচকি হাসলেন আর সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন।

কিন্তু সেদিন বিকেলের সেই বাক্যবিনিময়ের মধ্যে দিয়ে কিছুটা অন্ধকার ঢুকে পড়েছিল। হয়তো সেটা ছিলই, কিন্তু আজ যেন সেটা বন্ধ কৌটো থেকে বেরিয়ে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। আরেকবার, ওরা যখন বাজারচত্বরে বসেছিল, ও তাঁর কাছে গল্প করছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকাকালীন কীভাবে ওর অনেকগুলো আমেরিকান জিন্সের বদলে এই চেলোটার আগের মালিকের থেকে চেলোটা কিনেছিল। গল্পটা শেষ হ’লে তিনি অদ্ভুতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘যন্ত্রটা তো বেশ ভালো। চমৎকার আওয়াজ। কিন্তু আমি এই যন্ত্র কখনও তোমার মতো এত ছুঁইনি, তাই আমি ঠিক এটার ভালোমন্দ বিচার করতে পারব না’।

ও বুঝতে পারছিল, তিনি একেবারে খাদের কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছেন। তাই ও চট করে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

‘আপনার মাপের শিল্পীদের জন্যে অবশ্য এই যন্ত্র যথেষ্ট নয়। এমনকি, আমার ক্ষেত্রেও এটা এখন যথেষ্ট নয়’।

কথা ঘোরানোর পরেও ওর ভয় হচ্ছিল পাছে উনি আবার ওই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তাই ও আর স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছিল না। কথা বলার মধ্যে খুব আনন্দদায়ক পরিস্থিতিতেও ওকে সজাগ থাকতে হ’ত। ওই প্রসঙ্গ উঠলেই তাকে ধামা চাপা দিতে হ’ত। সবসময় হয়তো তাঁর কথা ঘোরানো সম্ভব হ’ত না। তিনি হয়তো বলছেন, ‘ওহ, এটা যে কী সহজ, আমি একবার বাজিয়ে দিলেই বুঝতে!’ সেক্ষেত্রে ও একদম না শোনার ভান করে থাকত।

***

সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি—বাতাসে তখন সবে হিমেল ছোঁয়া—জিয়ানকার্লো অ্যামস্টারডাম থেকে কাউফমানের ফোন পেল; শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা ফাইভস্টার হোটেলে চেম্বার মিউজিকের একটা দলে চেলোবাদকের ভ্যাকেন্সি আছে। দলটা সপ্তাহে চারটে সন্ধ্যে ডাইনিং হল লাগোয়া মিন্সট্রেল গ্যালারিতে বাজায়, আর হোটেলে টুকটাক আরও কিছু কাজ করে। থাকাখাওয়ার চুক্তি আছে। শুনেই কাউফমানের টাইবরের কথা মনে হয়েছে এবং ওর জন্যেই পোস্টটা ধরা আছে। ফোন পাবার দিনেই সন্ধ্যেবেলা ক্যাফেতে গিয়ে আমরা টাইবরকে সবকিছু জানালাম। কিন্তু টাইবরের উদাসীনতা দেখে আমরা সকলেই ঘাবড়ে গেলাম। গ্রীষ্মের শুরুর দিকেও, যখন আমরা কাউফমানের কাছে ওর অডিশনের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলাম, ওর যা মতিগতি ছিল, তার থেকে এখন সম্পূর্ণ আলাদা। ওর ওপর, বিশেষ করে, জিয়ানকার্লো ভয়ানক খাপ্পা হয়ে গেল।

‘তাহলে এসব নিয়ে এতো জলঘোলা করার কী ছিল?’ জিয়ানকার্লো ওর কাছে জানতে চাইল। ‘তুমি কী আশা করছিলে? কার্ণেগি হলে বাজাবে?’

‘আমি অকৃতজ্ঞ নই। তবু, বিষয়টা নিয়ে আমাকে আরেকটু ভাবতে হবে। লোকেরা যখন খাওয়াদাওয়া করতে করতে গল্পগুজব করবে, তখন তাদের জন্যে বাজানো। আর এই যে, হোটেলের অন্যান্য টুকটাক কাজ। এগুলো কি আমার মতো লোকের পক্ষে মানানসই হবে?’

জিয়ানকার্লো বরাবরই বদমেজাজী ছিল, চট করে মাথা গরম করে ফেলত। ও টাইবরের জ্যাকেট খামচে ধরে গালিগালাজ করতে যেতেই আমরা কোনমতে সামাল দিলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার টাইবরের পক্ষ নিয়ে কথা বলা উচিত মনে করল। তাদের মতে, যতই হোক, এটা তার জীবন, তাই যে কাজ তার পোষাবে না, সেটা করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। একসময় সব থিতিয়ে পড়ল। টাইবরও মানল যে সাময়িকভাবে হ’লে কাজটা ভালোই। এরপর ও রাখঢাক না করেই বলল যে ট্যুরিস্টদের সীজন চলে গেলে তো শহরটা ব্যাকওয়াটার হয়ে যায়। সেদিক থেকে দেখলে অ্যামস্টারডাম তো অন্তত একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল।

‘আমি এই বিষয়টা নিয়ে আরও ভালো করে ভাবব,’ শেষে ও বলল। ‘যদি দয়া ক’রে কাউফমানকে ব’লে দাও যে আমি তিনদিনের মধ্যে আমার সিদ্ধান্ত জানাব, তাহলে খুব ভালো হয়’।

জিয়ানকার্লো এতে সন্তুষ্ট না হ’লেও—ও আশা করেছিল টাইবর একটু গদগদ হয়ে কৃতজ্ঞতাস্বীকার করবে—কাউফমানকে ফোন করে টাইবরের কথাটা জানিয়ে দিল। সেদিন সন্ধ্যের এই বাগবিতণ্ডায় এলুইজে ম্যাককরম্যাকের কথা একবারও ওঠেনি। কিন্তু এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল যে ও সেদিন যা বলছিল তাতে তাঁর পুরো প্রভাব আছে।

‘ওই মহিলাই ওকে এরকম গোঁয়ারগোবিন্দ বানিয়েছেন,’ টাইবর চলে যাবার পর এরনেস্টো বলল। ‘এমন হাবভাব নিয়ে একবার অ্যামস্টারডাম যাক না, দেখবে সেখানে কেমন ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে’।

***

কাউফমানের কাছে অডিশনের কথা টাইবর এলুইজেকে কখনও বলেনি। অনেকবার বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রত্যেকবারই পিছিয়ে গেছে। বন্ধুত্ব যতই গাঢ় হয়েছে, ততই এই প্রস্তাবে রাজি হওয়াটাকে ওর প্রতারণা মনে হয়েছে। তাই এই ব্যাপারে এলুইজের সঙ্গে আলোচনা করার ইচ্ছে আর ওর হয়নি বা কোনরকম আভাস দিতেও চায়নি। কিন্তু লুকোনোর ব্যাপারে ও একেবারেই পটু ছিল না, আর এই সিদ্ধান্তটা তাঁর কাছ থেকে গোপন রাখতে যাওয়ার ফল হ’ল একদম অন্যরকম।

সেদিন বিকেলের গরমটা ছিল অসহ্য। যথারীতি ও হোটেলে হাজির হয়ে বাজাতে শুরু করল। কিছু নতুন টুকরো, বাড়ি থেকে তৈরি করে এসেছে। মিনিট তিনেক বাজিয়েছে কি বাজায়নি, তিনি ওকে থামতে বললেন,

‘কিছু একটা গোলমাল লাগছে। তুমি যখন এসেছ, তখনই মনে হয়েছে। টাইবর, আমি তোমাকে এখন খুব ভালো করে বুঝি। দরজায় তোমার টোকা দেওয়া শুনে বলে দিতে পারি। এখন তোমার বাজনা শুনে নিশ্চিত হলাম। কোনো লাভ নেই, তুমি আমার থেকে লুকোতে পারবে না’।

ওকে একটু আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল। চেলোর ছড়টা পাশে নামিয়ে রাখতে রাখতে ও ঠিক করে নিলো সমস্ত কথা মন উজাড় করে তাঁকে বলে দেবে। কিন্তু তখনই তিনি হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন,

‘এটা এমন একটা বিষয় যে এর থেকে চাইলেও আমরা পালতে পারব না। তুমি সবসময় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করো, কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই। আমি এটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। গত সপ্তাহের গোটাটা ধরে আমি চেষ্টা করছিলাম এটা নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে’।

‘সত্যি?’ অবাক হয়ে ও তাঁর মুখের দিকে তাকাল।

‘হ্যাঁ,’ তিনি বললেন। তারপর নিজের চেয়ারটাকে টেনে এনে একদম ওর মুখোমুখি বসলেন। ‘আমি তোমাকে কখনও ঠকাতে চাইনি, টাইবর। গত কয়েকটা সপ্তাহ ধরে আমার খুব খারাপ লাগছিল। তার ওপর তুমি আমার এত প্রিয় একজন বন্ধু। আমার খুব খারাপ লাগবে যদি তুমি কখনও ভাবো আমি তোমার ওপর কোনো সস্তা কায়দা ফলিয়েছি। না, প্লীজ, আমাকে এবার থামিয়ে দিও না। আমি বলতে চাই। যদি তুমি এক্ষুণি আমাকে ওই চেলোটা দিয়ে বাজাতে বলো, আমাকে না বলতে হবে, আমি বাজাতে পারব না। পারব না, কারণ যন্ত্রটা খুব ভালো নয় বলে না, তেমন কিছুই না। কিন্তু আমি যা নই, নিজেকে তাই দেখিয়েছি বলে তুমি যদি এখন আমাকে জালিয়াত ভাবো, তাহলে আমি বলব তোমার ভুল হচ্ছে। তুমি সেগুলো দেখো, যেগুলো আমরা দু’জনে মিলে অর্জন করেছি। সেটা কি আমি জালিয়াত নয় বলে প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়? হ্যাঁ, আমি তোমাকে বলেছিলাম যে আমি একজন সঙ্গীতবিশারদ। বেশ, এখন বলি কেন সেটা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম কারণ আমি জন্মেছিলাম এক বিশেষ প্রতিভা নিয়ে, ঠিক তুমি যেমন। তুমি আর আমি, আমাদের এমন কিছু আছে যেটা বেশীরভাগ চেলোবাদকেরই থাকবে না, তাতে তারা যতই কঠিন চর্চা করুক। চার্চে তোমার বাজনা যেদিন আমি প্রথম শুনেছিলাম, সেদিনই আমি তোমার মধ্যে সেটা খুঁজে পেয়েছিলাম। আর যেভাবেই হোক, তুমিও নিশ্চয়ই আমার মধ্যে সেটা খুঁজে পেয়েছ। সেইজন্যেই তুমি প্রথমবার বলাতেই এখানে চলে এসেছিলে।

‘আমাদের মতো বেশী কেউ নেই, টাইবর। আর আমরা একে অন্যকে চিনতে পেরেছি। আমি যে এখনও চেলো বাজাতে শিখিনি, তাতে কিছু উল্টেপাল্টে যায় না। তোমাকে বুঝতে হবে, আমি একজন সঙ্গীতবিশারদ। কিন্তু আমি হলাম এমন একজন যে এখনও উন্মোচিত হয়নি। তুমিও এখনও সম্পূর্ণ উন্মোচিত হওনি, আর বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি সেটাই করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি তোমার ওপরের পরতগুলো ঝরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি তোমাকে কখনও ঠকানোর চেষ্টা করিনি। শতকরা নিরানব্বই ভাগ চেলোবাদকের ক্ষেত্রে ওই পরতগুলোর নীচে কিছু নেই। তাদের উন্মোচন করারও কিছু নেই। তাই আমাদের মতো লোকেদের উচিত একে অন্যকে সাহায্য করা। আমরা ভিড়ে ঠাসা জায়গায় যখনই একে অপরকে দেখি না কেন, আমাদের একে অন্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, কারণ আমাদের মতো লোকের সংখ্যা খুবই সামান্য’।

ও দেখল তাঁর চোখ ছলছল করছে, কিন্তু গলার স্বর একদম স্থির। এরপর তিনি চুপ করে গিয়ে ওর দিক থেকে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

‘তাহলে আপনি নিজেকে একজন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন চেলোবাদক মনে করেন,’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ও বলল। ‘একজন সঙ্গীতবিশারদ। মিস এলুইজে, আপনার কথা অনুযায়ী, আমরা বাকিরা সাহস করে, নীচে কী আছে সে সম্পর্কে না নিশ্চিত হয়েই, আমাদের নিজেদের উন্মোচন করব। আর আপনি, আপনি নিজেকে উন্মোচন করার ধার ধারবেন না। আপনি কিছুই করবেন না। এদিকে আপনি নিশ্চিত যে আপনি একজন সঙ্গীতবিশারদ...’

‘প্লীজ, রাগ কোরোনা। আমি জানি এটা একটু অদ্ভুত শোনাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা এটাই, এটাই সত্যি। আমার মা, তিনিই আমার এই বিশেষ ক্ষমতাটা চিনতে পেরেছিলেন, যখন আমি এইটুকু। অন্তত এইজন্যে আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার চার, সাত আর এগারো বছর বয়সে যে যে শিক্ষক তিনি আমার জন্যে খুঁজে দিয়েছিলেন, তারা কেউ ভালো ছিলনা। মা সেটা বুঝতে পারেননি, কিন্তু আমি পেরেছিলাম। বয়সে ছোট হলেও আমার মধ্যে সেই সহজাত ব্যাপারটা ছিল। আমি বুঝে গেছিলাম আমার এই বিশেষ ক্ষমতাটাকে এইসমস্ত লোকেদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে, যাদের হাতে পড়লে এটা পুরো ধ্বংস হয়ে যাবে, তাতে তাদের উদ্দেশ্য যতই ভালো থাকুক না কেন। তাই আমি তাদের রাস্তা বন্ধ করে দিলাম। তোমাকেও তাই করতে হবে, টাইবর। তোমার এই ক্ষমতা ভীষণ মূল্যবান’।

‘মাফ করবেন,’ বাধা দিয়ে টাইবর বলে উঠল, এবার অনেক নম্রভাবে। ‘আপনি বললেন ছোটবেলায় আপনি চেলো বাজাতেন। কিন্তু আজ...’

‘এগারো বছর বয়সের পর থেকে আমি আর চেলো ছুঁইনি। মিস্টার রথের কাছে কেন আর শিখতে পারব না তার কারণ ব্যাখ্যা করে যেদিন মাকে সব বললাম সেদিন থেকে। আর তিনি সবটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনিও বলেছিলেন কিছু না করে আমার অপেক্ষা করাই ভালো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল যে আমার বিশেষ ক্ষমতাটা নষ্ট হতে না দেওয়া। এখনও হয়তো আমার দিন আসতে পারে। হ্যাঁ, কখনও কখনও মনে হয় অনেকদিন হ’ল ছেড়ে দিয়েছি। আমার বয়স এখন একচল্লিশ। কিন্তু যে বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে আমি জন্মেছি, তা অন্তত আমি নষ্ট করিনি। এত বছরে আমি অনেক শিক্ষক দেখেছি যারা বিভিন্ন সময় আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল, কিন্তু আমি তাদের স্বরূপ বুঝতে পেরে গেছিলাম। টাইবর, কখনও কখনও আমাদের পক্ষেও বলা খুব কঠিন হয়ে যায়। এইসমস্ত শিক্ষকরা, এরা এতটাই... পেশাদার, এরা এতটাই ভালো কথা বলে যে শুনেই তুমি বুদ্ধু বনে যাবে। শেষে হয়তো তুমি কাউকে পেয়ে ভাববে সে তোমাকে সাহায্য করবে, সে হয়তো আমাদেরই মতো একজন। তারপর তুমি বুঝবে সে সেরকম কিছুই নয়। আর তখনই তোমাকে শক্ত হতে হবে আর নিজেকে বন্ধ করে দিতে হবে। মনে রেখো, টাইবর, অপেক্ষা করা সবসময় ভালো। কখনও কখনও এটা ভাবলে আমার খারাপ লাগে যে আমি এখনও আমার এই বিশেষ ক্ষমতাটা মেলেই ধরতে পারলাম না। কিন্তু আমি এটাকে নষ্ট করিনি, আর সেটাই হ’ল সবচেয়ে বড় ব্যাপার’।

ও তারপর তৈরি করে আসা গোটা দুয়েক টুকরো বাজাল, কিন্তু সেদিন কারুর মধ্যেই স্বাভাবিক ছন্দটা ছিল না বলে সেদিনের সেশনটা আগেভাগেই শেষ হয়ে গেল। তারপর হোটেল থেকে নেমে বাজারচত্বরে এসে ওরা কফি খেল, কিছু কথাবার্তা বলল। তারপর ও শহর ছেড়ে কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাবার পরিকল্পনার কথা তাঁকে জানাল। ও বলল ওর সবসময় আশপাশের গ্রামাঞ্চলগুলোতে বেড়াতে ভালো লাগে, আর সেজন্যেই ও কয়েকদিনের ছুটি কাটানোর ব্যবস্থা করেছে।

‘এতে তোমার ভালো হবে,’ তিনি মৃদুস্বরে বললেন। ‘কিন্তু বেশীদিন বাইরে থেকো না। আমাদের এখনও অনেককিছু করার বাকি আছে’।

বড়জোর এক সপ্তাহ, তার মধ্যেই ফিরে আসবে ব’লে ও তাঁকে আশ্বস্ত করল। তবুও যাওয়ার সময় দেখা গেল তাঁর হাবভাবে একটা অস্বস্তির ছোঁয়া তখনও রয়ে গেছে।

ওর যাবার ব্যাপারে পুরোটা সত্যি ও বলেনি; ওর তখনও পর্যন্ত কোনো তোড়জোড়ই ছিল না। সেদিন বিকেলে এলুইজের কাছ থেকে বেরিয়ে ও বাড়ি ফিরল। তারপর অনেকগুলো ফোনকল করল। সবশেষে আমব্রিয়ান সীমান্ত প্রদেশের পাহাড়ের ইউথ হস্টেলে একটা বেড ভাড়া করল। সেইদিন রাতেই ও ক্যাফেতে এলো আমাদের সাথে দেখা করতে। ওর বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান প্রোগ্রাম সব আমাদের বলল। আমরাও সবাই যে যেমন পারলাম উপদেশ দিলাম, কোথায় যাবে, কী দেখবে এসব নিয়ে। ও সেসব দিকে পাত্তা না দিয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়ে জিয়ানকার্লোকে বলল সে যেন কাউফমানকে জানিয়ে দেয় যে ওর কাজটা নেবার ইচ্ছে আছে।

‘এছাড়া আমি আর কী করতে পারি?’ ও আমাদের জিজ্ঞেস করল। ‘আমার বেড়িয়ে ফিরে আসতে আসতে আমার হাতে আর কিছু টাকাই থাকবে না’।

***

গ্রামের দিকে বেড়াতে গিয়ে ছুটিটা ভালোই কাটল টাইবরের। যদিও কয়েকজন জার্মান হাইকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া আর খেতে গিয়ে খরচখরচা একটু বেশী হয়ে যাওয়ার কথা ছাড়া ও বেড়ানো সম্বন্ধে আর তেমন কিছু আমাদের বলেনি। এক সপ্তাহ পরে ও যখন ফিরল, ওকে বেশ তরতাজা লাগছিল। কিন্তু ওর ভয়ও ছিল পাছে এরমধ্যে এলুইজে ম্যাককরম্যাক চলে যান।

ট্যুরিস্টদের ভিড়টা তখন আসতে আসতে কমে যাচ্ছিল। ক্যাফের ওয়েটাররা হীটারগুলো নামিয়ে ঝাড়পোছ করে বাইরের টেবিলগুলোর মাঝে বসাচ্ছিল। যেদিন ফিরল, সেদিন বিকেলেই টাইবর সময় মতো চেলো হাতে নিয়ে এক্সেলসিয়রে গিয়ে হাজির হ’ল। এলুইজে ওর জন্যে শুধুমাত্র অপেক্ষাই করছিলেন তাই নয়, ওর অভাবও অনুভব করেছেন যথেষ্ট। এসব দেখেশুনে টাইবর খুব খুশি হ’ল। বাড়িতে লোকজন এলে যেমন তাদের খাবারদাবার, পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করতে বাড়ির লোকজন ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তেমনি টাইবরকে নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আসার সাথেসাথেই ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে সেই চেয়ারটায় বসালেন। তারপর নিজেই হন্তদন্ত হয়ে কেস থেকে চেলোটাকে বার করতে করতে বললেন, ‘চলো, বাজাও! এক্ষুণি আমার জন্যে বাজাও!’

বিকেলটা তাদের একসঙ্গে চমৎকার কাটল। তাঁর সেদিনের সেই স্বীকারোক্তি আর তারপর ওদের ওইভাবে বিদায় নেওয়ায় ওর আসার আগে একটু চিন্তা হচ্ছিল সব কেমন কী থাকবে না থাকবে। কিন্তু ওখানে গিয়ে পৌঁছনোর পর সব দুশ্চিন্তা উবে গিয়েছিল, আর পরিবেশটাও মনে হচ্ছিল আগের থেকে অনেক ভালো। এমনকি যখন, ওর একটা টুকরো বাজানোর পরে, তিনি চোখ বুজে ওর বাজনার লম্বাচওড়া সমালোচনা শুরু করলেন, তখনও ওর রাগ হ’ল না, বরং তাঁকে যতটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। পরের দিন এবং তার পরের দিন, একইভাবে চলল; বেশ নিশ্চিন্ত মনে, কখনও কখনও ঠাট্টাতামাশার মধ্যে দিয়ে, আর ওর মনে হতে লাগল ও জীবনে এত ভালো কখনও বাজায়নি। ওদের মধ্যে টাইবরের বেড়াতে যাবার আগের সেইসব কথাগুলো ওঠেনি, আর তিনিও ওর গ্রামে ছুটি কাটাতে যাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি। তাদের মধ্যে শুধু বাজনা নিয়েই কথা চলল।

ও ফিরে আসার চতুর্থ দিনের দিন এমন কয়েকটা গণ্ডগোল ঘটে গেল—যার মধ্যে একটা ছিল ওর ঘরের টয়লেটের সিস্টার্ন লিক করা—যাতে ওর এক্সেলসিয়রে পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেল। যাবার পথে ক্যাফের কাছাকাছি পৌঁছনর সময়েই আলো অনেক কমে গিয়েছিল, ওয়েটারগুলো কাচের পাত্রের ভেতর রাখা মোমবাতি জ্বালাচ্ছিল। আমাদের কয়েকজন ওখানে ছিলাম। ও হাত নাড়ল আমাদের দিকে, তারপর স্কোয়্যারটা আড়াআড়ি পেরিয়ে চলে গেল হোটেলের দিকে। চেলোটা সাথে নিয়ে হাঁটার জন্যে দূর থেকে ওকে দেখে মনে হচ্ছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।

ও খেয়াল করল সেদিন রিসেপশনিস্ট এলুইজেকে ফোন করতে একটু ইতস্তত করছে। তারপর ঘরের সামনে পৌঁছনর পর তিনি যখন দরজা খুলে ওকে অভ্যর্থনা জানালেন, কেমন যেন একটু খটকা লাগল। ও কিছু বলার আগেই তিনি তাড়াতাড়ি বলতে শুরু করলেন,

‘টাইবর, খুব ভালো লাগছে তুমি এসেছ। এইমাত্র আমি পিটারকে তোমার সম্বন্ধে সবকিছু বলছিলাম। ঠিক ধরেছ, অবশেষে পিটার আমাকে খুঁজে পেয়েছে’। তারপর তিনি ওকে নিয়ে ঘরে গেলেন, ‘পিটার, ও এসেছে! টাইবর এসেছে! আর সাথে চেলোটাও এনেছে!’

টাইবর ঘরে ঢুকতেই লম্বাচওড়া, একটু ঝুঁকে পড়া, পাকাচুলওয়ালা এক ভদ্রলোক হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে ফ্যাকাসে একটা পোলো শার্ট। তিনি খুব শক্ত করে টাইবরের হাতটা ধ’রে বললেন, ‘ওহ, তোমার কথা আমি সব শুনেছি। এলুইজে তো ধরেই নিয়েছে তুমি একজন বড় স্টার হবে’।

‘পিটার একদম নাছোড়বান্দা,’ এলুইজে বললেন। ‘আমি জানতাম ও আমাকে শেষমেশ খুঁজে বার করবেই’।

‘আমার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে না,’ পিটার বললেন। তারপর তিনি টাইবরের জন্য একটা চেয়ার টেনে এনে দিলেন। ক্যাবিনেটের আইস বাকেটে রাখা শ্যাম্পেনের বোতল থেকে এক গ্লাস শ্যাম্পেন ঢেলে টাইবরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এসো, টাইবর, আমার রিইউনিয়ন সেলিব্রেট করতে সাহায্য কর’।

টাইবর শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে খেয়াল করল পিটার নিতান্ত কাকতালীয়ভাবেই ওর চেলো বাজাতে বসা চেয়ারটা টেনে এগিয়ে দিয়েছেন। এলুইজে কিছুক্ষণের জন্যে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন। হাতে শ্যাম্পেনের গ্লাস ধরা অবস্থাতেই টাইবর আর পিটার কথা বলছিল। পিটার স্বভাবে বেশ নম্র, টাইবরকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করছিলেন। হাঙ্গেরির মতো একটা দেশে টাইবরের বড় হয়ে উঠতে কেমন লেগেছে? পশ্চিমের দিকে যখন প্রথম এসেছিল তখন কি খুব অবাক লেগেছিল?

‘আমি কোনো একটা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে চাই,’ পিটার বলতে লাগলেন। ‘তুমি খুব ভাগ্যবান। আমার খুব শিখতে ইচ্ছে করে। যদিও একটু দেরি হয়ে গেল মনে হয়’।

‘ওহ, আপনি কখনও বলবেন না দেরি হয়ে গেল,’ টাইবর বলল।

‘ঠিক বলেছ। দেরি হয়ে গেল বলাটা ঠিক নয়। দেরি হয়ে গেল বলাটা একটা অজুহাত। না, আসল কথা হ’ল, আমি খুব ব্যস্ত মানুষ। আমি মনে মনে বলি আমি ব্যস্ত বলে ফ্রেঞ্চ শিখতে পারছি না, কোনো বাজনা শিখতে পারছি না, ওয়র অ্যান্ড পীস পড়তে পারছি না। আর যা যা আমার করাবার ইচ্ছে ছিল। এলুইজে যখন বাচ্চা ছিল, ও বাজাত। আমার মনে হয় ও তোমাকে এই ব্যাপারে বলেছে’।

‘হ্যাঁ, বলেছেন। আমি বুঝি, তাঁর অনেক সহজাত গুণ আছে’।

‘ওহ, আছেই তো। যে ওকে জানে, সে-ই বুঝবে। ও ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ। ও এমন একজন যার উচিত এই সমস্ত কিছু শেখা। আর আমি, আমি একটা ঢ্যাঁড়স,’ ব’লে তিনি হাত তুলে হো হো ক’রে হাসতে লাগলেন। ‘আমার পিয়ানো শেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এমন হাত দিয়ে তুমি কী করবে? এই হাত দিয়ে মাটি কোপানোই ভালো হবে, যেটা আমার পূর্বপুরুষরা করতেন। কিন্তু ওই ভদ্রমহিলা’—ব’লে তিনি হাতের গ্লাসটা তুলে দরজার দিকে দেখালেন—‘ওর এই ব্যাপারে ভীষণ সংবেদনশীল’।

অবশেষ, একটা গাঢ় রঙের সান্ধ্য পোশাক আর অনেক গয়নাগাটি পরে এলুইজে বেডরুম থেকে বেরোলেন।

‘পিটার, টাইবরের মাথা খেয়ো না,’ তিনি বললেন। ‘গলফে ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই’।

পিটার হাত ছড়িয়ে দিয়ে সনির্বন্ধ দৃষ্টিতে টাইবরের দিকে তাকালেন। ‘টাইবর, তুমিই এখন বলো। আমি গলফ সম্বন্ধে একটা কথাও তোমাকে বলেছি?’

টাইবর বলল ওর এখন ফিরে যাওয়া উচিত; কারণ ও দেখতে পাচ্ছে ওর জন্যে তাদের ডিনারে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই শুনে ওঁরা দুজনেই একসাথে প্রতিবাদ করে উঠলেন। পিটার বললেন,

‘আমার দিকে তাকাও। আমাকে দেখে মনে হচ্ছে কি আমি ডিনারে যাবার পোশাক পরে আছি? তুমি কিছু না বাজিয়ে যেতে পারবে না। আমি তোমার বাজনা নিয়ে ইতিমধ্যে এত প্রশংসা শুনেছি’।

কী করবে ভেবে না পেয়ে, সবে টাইবর চেলো কেসটা খুলতে শুরু করেছে, তখন এলুইজে বেশ দৃঢ়ভাবে, একদম অন্য সুরে বলে উঠলেন,

‘টাইবর ঠিকই বলেছে। সময় হয়ে যাচ্ছে। এই শহরের রেস্তোরাঁগুলোয় সময় মতো হাজির না হ’লে ওরা তোমার জন্যে টেবিল ধরে রাখবে না কিন্তু। পিটার, তুমি জামাকাপড় বদলে নাও। দাড়িটাও কামিয়ে নেবে নাকি? আমি টাইবরকে একটু এগিয়ে দিতে যাচ্ছি। ওকে আলাদা করে কয়েকটা কথা বলার আছে’।

লিফটে নামার সময় ওরা শুধু চোখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসল, কোনো কথা বলল না। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল বাজারচত্বরের সব আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। স্থানীয় বাচ্চারা বলে লাথি মারছে, ফোয়ারাটার চারদিকে দৌড়দৌড়ি করছে। পুরোদমে সান্ধ্যভ্রমণ শুরু হয়ে গেছে আর আমার মনে হয় আমাদের গানের সুরও ভেসে ভেসে ওরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই অবধি পৌঁছচ্ছিল।

‘হ্যাঁ, তাই হ’ল,’ অবশেষে তিনি বলে উঠলেন। ‘ও আমাকে খুঁজে বার করল। তাই আমার মনে হয়, ও আমাকে পাবার যোগ্য’।

‘খুব মজার মানুষ,’ টাইবর বলল। ‘এখন কি আমেরিকা ফিরে যাবেন ভাবছেন?’

‘হ্যাঁ, মনে হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই’।

‘বিয়ে করবার ইচ্ছে আছে নাকি?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে’। খুব আন্তরিকভাবে টাইবরের দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়েই আবার অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন, আর আবার একই কথা বললেন, ‘তাই তো মনে হচ্ছে’।

‘আপনার সুখশান্তি কামনা করি। উনি খুব দয়ালু মানুষ। গানবাজনাও ভালোবাসেন। আর এটা আপনার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ’।

‘হ্যাঁ। সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ’।

‘একটু আগে যখন আপনি তৈরি হচ্ছিলেন, আমরা গলফ নয়, গানবাজনা শেখার ব্যাপারে কথা বলছিলাম’।

‘ওহ, সত্যি? মানে, কার ব্যাপারে, ওর না আমার?’

‘দু’জনেরই। যাই হোক, আমার মনে হয় না, পোর্টল্যান্ড বা ওরিগনে খুব বেশী শিক্ষক পাবেন বলে, যারা আপনাকে শেখাতে পারবে’।

তিনি এবার হেসে ফেললেন। ‘আমি যেটা বলেছিলাম, আমাদের মতো মানুষদের পক্ষে এটা কঠিন’।

‘হ্যাঁ, আপনার প্রশংসা করতে হয়। এই বিগত কয়েক সপ্তাহের পর আরও বেশী করে আপনার প্রশংসা করতে হয়’। তারপর ও আরও বলল, ‘মিস এলুইজে, যাবার আগে একটা কথা আমি আপনাকে বলতে চাই। আমি খুব তাড়াতাড়িই অ্যামস্টারডাম চলে যাচ্ছি, ওখানে একটা বড় হোটেলে কাজ পেয়েছি’।

‘দারোয়ানের কাজ করতে যাচ্ছ?’

‘না, হোটেলের ডাইনিং-এ একটা চেম্বার মিউজিক ব্যান্ডের সাথে বাজাতে হবে। হোটেলের গেস্টরা যখন খাবেন, আমরা তখন তাঁদের মনোরঞ্জন করব’।

কথাগুলো বলতে বলতে ও এলুইজের দিকে লক্ষ করছিল, দেখল তাঁর চোখের মধ্যে কিছু একটা জ্বলে উঠেই যেন নিভে গেল। তারপর তিনি নিজের হাতটা ওর হাতের ওপর রেখে মৃদু হাসলেন।

‘ভালো কথা। শুভেচ্ছা রইল’। তারপর তিনি আরও যোগ করলেন, ‘ওই হোটেলের গেস্টদের জন্যে। তাদের জন্যে অনেক মজা অপেক্ষা করে রয়েছে’।

‘আমারও তাই মনে হয়’।

হোটেলের সামনের আলোর রোশনাইটা পার করে ওরা আরও কয়েকটা মুহূর্ত একসাথে দাঁড়িয়ে রইল, ওদের মাঝে বিশালাকার চেলোটা।

‘আর আমার এও মনে হয়,’ ও বলল, ‘আপনি পিটারের সঙ্গে খুব সুখী হবেন’।

‘আমারও তাই মনে হয়,’ তিনি বললেন আর আবার হেসে উঠলেন। এরপর তিনি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে একটা চুমু খেলেন আর বললেন, ‘তুমি সাবধানে থেকো’।

টাইবর তাঁকে ধন্যবাদ জানাল, আর তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল তিনি পিছন ঘুরে এক্সেলসিয়রের দিকে হাঁটা লাগিয়েছেন।

***

এর কিছুদিন পরেই টাইবর আমাদের শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। শেষ যেদিন ওর সঙ্গে আমরা খানাপিনা করছিলাম, সেদিন খুব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল ওর কাজটার জন্যে ও জিয়ানকার্লো আর এরনেস্টোর কাছে এবং বন্ধুত্বের জন্যে আমাদের সকলের কাছে কতটা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তবুও আমি বুঝতে পারছিলাম, ও আমাদের একটু যেন এড়িয়ে চলছে। শুধু আমি নই, আমাদের মধ্যে আরও কয়েকজন এটা বুঝতে পেরেছিল, যদিও জিয়ানকার্লো তখন টাইবরের পক্ষই নিয়েছিল। তার বক্তব্য ছিল ও বেচারা জীবনের পরের ধাপে পা ফেলে ভীষণ উত্তেজিত আর ভীতও।

‘উত্তেজিত? ও উত্তেজিত হবে কী করে?’ এরনেস্টো বলেছিল। ‘গোটা গ্রীষ্মটা ও কাটিয়েছে এই জেনে যে ও একটা জিনিয়াস। সেই জায়গায় হোটেলে কাজ তো অবনতি। আমাদের সাথে বসে কথা বলাও ওর কাছে অবনতি। গ্রীষ্মের শুরুতে ও একটা দারুণ ছেলে ছিল। কিন্তু ওই মহিলা ওর যা করে গেলেন, তারপর ভালোই হ’ল আমাদের আর ওকে নিয়ে থাকতে হচ্ছে না’।

আমি এইসব যা বললাম, এগুলো সব ঘটেছিল সাত বছর আগে। সেইসময়ের ছেলেদের মধ্যে আমি আর ফ্যাবিয়ান ছাড়া জিয়ানকার্লো, এরনেস্টো, আরও অন্যান্যরা সব এদিকওদিক চলে গিয়েছিল। সেদিন ওকে ওই বাজারচত্বরে দেখার আগে অবধি আমার অনেক দিন আমাদের ওই ইয়াং হাঙ্গেরিয়ান ওস্তাদের কথা মনে ছিল না। ওকে চিনতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। একটু মোটা তো হয়েছেই, তার সাথে কাঁধের কাছটা অনেকটা চওড়া হয়েছে। আর যেভাবে আঙুলের ইশারায় ওয়েটারকে ডাকছে, তাতে—হতে পারে সেটা আমার অনুমান—ওকে অধৈর্য্য, কিছু তিক্ততার কারণে রুক্ষ বলে মনে হচ্ছিল। হতে পারে, আমার এই ভাবনাটা ঠিক নয়। যতই হোক, আমি ওকে একঝলক মাত্র দেখেছি। তাতেই আমার মনে হচ্ছিল ওর অল্পবয়সের সেই লোককে খুশী করার প্রবণতা, তখনকার সেই সাবধানী আচরণ আজ আর নেই।

আমি ওর কাছে গিয়ে কথা বলতে পারতাম, কিন্তু আমাদের বাজানো শেষ হবার পর দেখা গেল ও ওখান থেকে তার আগেই চলে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল, ও শুধুমাত্র বিকেলের জন্যেই এখানে এসেছিল। একটা স্যুট পরেছিল—খুব একটা জেল্লাদার কিছু নয়, সাধারণ একটা স্যুট—বোধহয় কোনো অফিসে ডেস্কে বসে কাজ করে। হতে পারে কাছাকাছি কোথাও কোনো কাজে এসেছিল, আর পুরোনো দিনের টানে আমাদের শহরে এসে হাজির হয়েছিল। কে জানে? যদি ও আবার এই স্কোয়্যারে ফিরে আসে, আর আমি তখন না বাজাই, তাহলে আমি ওর কাছে যাব আর ওর সঙ্গে একটু কথা বলল।