খোলস - রম্যাণী গোস্বামী

অলংকরণ : সুমিত রায়

ঘুম থেকে উঠেই বাজারে ছুটতে আমার চিরকালের আলস্যি। অফিস-কাছারির দিন তাও না হয় একরকম করে মনটাকে বুঝিয়ে মানিয়ে নেওয়া যায়। ন'টা-চল্লিশের মেট্রো ধরা থেকে শুরু। তারপর সারাটা দিনই তো ছুটে বেরতে হবে। সকালটাই বা কী দোষ করল। বরং ল্যাদ খেয়ে বিছানায় না গড়িয়ে পড়ে থেকে সকাল সকাল বাজারটা সেরে ফেললে একটা গতি আসে শরীরের জং ধরা মাংসপেশিতে। ঈষৎ হেলতে দুলতেই বাজারে যাই, দু’চার পিস বন্ধু বান্ধব - চেনা পরিচিত জুটে গেলে তো আর কথাই নেই। সোনায় সোহাগা যাকে বলে! গসিপ, পরনিন্দা-পরচর্চা, বেগুনের পোকা, কাটাপোনার দর, সব মিলে মিশে তখন এক হয়ে যায়। আলোচনা থেকে বাদ যেমন যায় না সঞ্জয় দত্তের বায়োপিকের বক্স অফিস ফাটানোর খবর, অথবা অসমের কান্ধুলিমারি গ্রামের হিমা’র অ্যাথলিটে সোনা জেতার চমক। আবার কার অফিসে কে কাকে ল্যাং মারল কিংবা কার পাড়ায় কোন উঠতি মস্তানের ইদানীং খুব র‍্যালা বেড়েছে বিশেষ পলিটিকাল লিডারটির ছত্রছায়ায় এক টুকরো জমি পেয়ে, জমিয়ে রসিয়ে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে এসবও গিলি গোগ্রাসে। তারপরই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে এক ছুটে বাড়ি ফেরা। থলিটা নামিয়ে রেখেই স্নানে ঢোকা। যাক, দিনটা পুরোপুরি শুরু হয়ে গেল তবে।

রবিবারটা এসবের চাইতে একদম আলাদা। আবছা ভোরে পাখির ডাকে ঘুম চোখে তাকাই জানলার দিকে। টক করে মনে পড়ে যায়, আরে! আজ তো সানডে, মানে হলিডে। আজ আমি বাড়ি থেকে কোনওমতেই বেরব না। কাভি নেহি। ওমনি খুশিতে বুকের ভিতরটা ছলকে ওঠে। সারা সপ্তাহের খিঁচিয়ে থাকা আপামর মধ্যবিত্ত মনের কানায় কানায় রোমান্সে ভরে যায়। আরও একদফা গভীর নিদ্রার প্রস্তুতি নিতে নিতে পাশে শুয়ে থাকা স্বাতীর দিকে চোখ পড়ে। ওকে ধরে খুবসে চটকাতে ইচ্ছে করে। দরকার হলে আমি শনিবার অফিস ফেরতাও বাজার সেরে ফিরব। কিন্তু রবিবার বেলা এগারোটার আগে আমাকে বিছানা ছেড়ে ওঠায় শালা কার বাপের সাধ্য শুনি? কিন্তু আজ দিনটা খারাপ। মা-মেয়ের প্যানপ্যানানির চোটে উঠতেই হল আর ধড়াচুড়ো পরে বাজারের ব্যাগ হাতে ব্যাজার মুখে বেরতেও হল। মুডটা আরও বিগড়ে গেল বাজারে গিয়েই বিজনবাবুর দর্শন পেয়ে। উনি সাধারণত বিকেলের দিকটায় আসেন। কিন্তু আজ কেমন করে যেন সাতসকালে মাছের দোকানে দাঁড়িয়ে পাকা রুইয়ের দর করছেন। আমাকে স্বাতী একটু ইলিশ নিয়ে যেতে বলেছে। নতুন মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ইলিশ-ভাপে বানানো নিয়ে মা ও মেয়ের উৎসাহের সীমা নেই আজ। ওই মাছওয়ালাটা চেনা লোক। ভালো মাল দেবে। অগত্যা বিজনবাবুর পাশেই দাঁড়াতে হয় ঠিক ওঁর গা ঘেঁষে। গম্ভীর গলায় হাঁকতেও হয়, “ইলিশ কত করে যাচ্ছে এখন? হ্যাঁরে ঘনা?”

আমাকে দেখেই কোঁচকানো ভুরু আরও কুঁচকে গেল বিজনবাবুর। না দেখার ভান করে বাঁদিকে মাথাটা ঘুরিয়ে নিলেন সঙ্গে সঙ্গে। না, না, আমার সঙ্গে কিছুমাত্র ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই তাঁর। বসন্ত কমপ্লেক্সের দোতলায় ঠিক মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাটে থাকি আমরা। মানে, যাকে বলে নেক্সট ডোর নেবার। প্রতিদিন সকালে-বিকেলে-সন্ধে-রাতে প্রায় বত্রিশ বার মানুষটার সঙ্গে দেখা হয় আমার বা স্বাতীর। সবসময় উনি এইরকম আচরণই করেন! যেন দেখেও দেখতে পেলেন না! চিনেও চিনতে চাইলেন না! ইত্যাদি। একদিন শালাবাবুর সামনে এমন ফলস পজিশনে পড়েছিলাম ভদ্রলোকটির জন্য! শালাবাবুর ডিনারে নিমন্ত্রণ ছিল আমাদের ফ্ল্যাটে। জবরদস্ত খাওয়া দাওয়ার পর আমাদের ফ্ল্যাটের নীচেই বসন্ত কমপ্লেক্সের ভিতরের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছি দুজনে। হঠাত কোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে হাজির হলেন লোকটি। তা মুখোমুখি পড়ে গিয়ে সৌজন্যসূচক একগাল হাসি উপহার দিলাম লোকটিকে। হাজার হোক, প্রতিবেশী বলে কথা। কিন্তু উনি অভদ্রের মত মুখ ঘুরিয়ে গটগটিয়ে আমাকে প্রায় ধাক্কা মেরেই এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।

—“কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছ নাকি প্রতীকদা?” দেখলাম স্বাতীর ভাই কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ছি ছি, কী দরকার ছিল আমার ওই বোকাবোকা হাসিটার? কোনও মানে হয়? ধ্যাত!

আরও একদিনের কথা। হঠাৎই রান্নার গ্যাস ফুরিয়েছে। দুটো ওভেনেই আধসেদ্ধ রান্নাসমেত কড়াই চাপানো। ফ্ল্যাটের সমস্ত দরজায় দরজায় খোঁজ করে এসেছি আমি আর স্বাতী। কারোর কাছেই এক্সট্রা সিলিন্ডার নেই। ওদিকে ঘড়ির কাটায় সাড়ে ন’টা ছুঁই ছুঁই। আমার সরকারি চাকরি, দু-দশ মিনিট লেট হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু স্বাতীর প্রাইভেট সেক্টর। বসটিও রাম খ্যাঁচা! উপায় না দেখে স্বাতীই বলে ফেলল, “পাশের ফ্ল্যাটে গিয়েই খোঁজ করো না একবার। একা বয়স্ক মানুষ। কতই বা রান্না হয়? হয়তো ওঁর কাছেই এক্সট্রা সিলিন্ডার আছে। রিকোয়েস্ট করলে দিয়েও দেবেন।”

অভ্যর্থনা যা জুটল তা না বলাই ভালো। বেল বাজিয়ে বাজিয়ে হাত ব্যথা হয়ে গেল। উনি হয়তো দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আই-হোল এ চোখ রেখে ভাবছিলেন যে দরজাটা খুলবেন কি খুলবেন না! ইতিমধ্যেই স্বাতী রেডি হয়ে এসে বলল, “আর লেট করা যাবে না। চলো, হোটেলেই চলো।”

সেদিন কাকী’র হোটেলে পানসে ডাল আর কাঁচা কাঁচা লাউয়ের সবজি দিয়ে অ্যায়সা গোদা গোদা চালের ভাত মেখে কোনওরকমে গলাদ্ধকরণ করতে করতে আমি আর স্বাতী কতবার যে মনে মনে গালাগালি করেছিলাম বিজনবাবুকে তার কোনও হিসেব নেই।

প্রথম প্রথম ভারি অদ্ভুত লাগত। তারপর দেখলাম লোকটার ধাঁচটাই এমন। কমপ্লেক্সের কারোর সঙ্গেই ভাব বিনিময় তো দূরের কথা, সামান্য হাই-হ্যালো’টুকুও নেই। অসহ্য!

এরপরও বহুবার আমাদের দেখা হয়েছে এখানে ওখানে। ওঁর মতো আমিও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি। বেশ করেছি।

ইলিশ-ভাপে’টা জব্বর বানিয়েছে আজ স্বাতী। গন্ধে ঘর ম-ম করছে। মেয়ে ঊর্মি সবে ক্লাস এইট। কিন্তু ওরা এযুগের ছেলেমেয়ে। ইন্টারনেটের দৌলতে সমস্ত ব্যাপারেই আপডেটেড। ও খাওয়ার টেবিলেই এতক্ষণ ধরে হড়বড় করে আমাকে মাইক্রো ওভেনে রান্নার বিস্তর গুণাগুণ ব্যাখ্যা করছিল। আমি বললাম, “একটু শান্তিতে খেতে দেতো মা। পরে শুনব তোর বকবকম।”

ও খাওয়া সেরে হাত মুখ ধুয়ে চলে যেতে গিয়েও ফিরে এলো আবার। স্বাতীকে বলল, “মা, তোমাকে পাশের ফ্ল্যাটের বিজনজেঠু ডাকছেন।”

“আমাকে?” স্বাতী তো অবাক, “তোকে কে বলল?”

ঊর্মি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, “জেঠু নিজেই এসেছেন। দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন চুপচাপ। বেলটা পর্যন্ত বাজাননি। আমি নীচে টুকটুকিদিদের ফ্ল্যাটে কম্পিউটারে গেমস খেলতে যাব বলে দরজা খুলে বেরিয়েছি, তখন ওঁকে দেখলাম।”

স্বাতী বেশ ঘাবড়ে গেছে। আমাদের দুজনের খাওয়াই থেমে গেছে। অবাক হয়ে তাকালাম স্বাতীর দিকে। তারপর চেয়ার ঠেলে উঠে বললাম, “দাঁড়াও, আমি দেখছি।”

ভীষণ কুণ্ঠিত ও লাজুক ভঙ্গিতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের আড়াই বছরের পুরনো প্রতিবেশী বিজনবিহারী পাল। আমাদের দুজনকে দেখে একটু ইতস্তত করলেন। তারপর বলে উঠলেন, “অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম... ইয়ে... একটু রুইমাছের কালিয়া বানিয়ে জম্পেশ করে খাব ভাতের সঙ্গে। রোজ প্রেশার কুকারের ডাল-ডিম সেদ্ধ খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গেছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, মাছগুলো তেলে দিতেই কেমন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। আসলে রান্না-টান্নার তো অভ্যস নেই তেমন। তা বউমা, একটু দেখিয়ে দেবে গিয়ে? খুব অসুবিধে হবে? বিরক্ত করলাম অসময়ে... বাহ, খুব সুন্দর ঘরদোর সাজিয়েছ তো...”

অন্তরঙ্গভাবে এলোমেলো কথা বলে চলেছেন বিজনবিহারী বাবু। কথার মাঝে মাঝে জোরে শ্বাস টেনে উদরে ভরছেন ভাপা ইলিশের আঘ্রাণ। আড়চোখে দেখছেন ফ্ল্যাটের ভিতরটা।

এই ঘটনার ঠিক আধঘণ্টা পরে বিজনবিহারীবাবু যখন আমাদের খাওয়ার ঘরে বসে স্বাতীর যত্ন করে বেড়ে দেওয়া ইলিশের পিস দিয়ে ভাত মেখে তৃপ্তি করে মুখে পুরছিলেন এবং হাসিমুখে তাঁর ছোটবেলার দেশের বাড়ির পদ্মার ইলিশের গল্প করছিলেন অনর্গল, তখনও অবধি আমি আর স্বাতী ভালভাবে কথাই বলতে পারছিলাম না। শুধু অবাক হয়ে দুজনে অপলকে তাকিয়ে ছিলাম এতদিন পর খোলস ছেড়ে বেরনো মানুষটার দিকে।