ইচ্ছে লজ্জাহীন - প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

পাইনউড চা বাগানের ম্যানেজার অলক সেন, প্লান্টারস ক্লাবের লাউঞ্জের এককোণে বসে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থাকলেও, স্বপ্ন নিয়ে আমাদের আলোচনা তার কানে যাচ্ছিল নিশ্চয়ই।

বই থেকে এবার চোখ তুলে সে বললে, “তোমরা কি কেউ স্বপ্নকে বা তাদের দলবলকে দেখেছ?” মানে? স্বপ্নের দলবল সে আবার কি? তবে সারাদিনের কাজের পর, এই ধুমডিলাতে স্বপ্ন দেখে না এমন কে আছে?

কথা কেড়ে নিয়ে, হীরের খোঁজে পুরো ধুমডিলার সব কটা পাহাড় চষে বেড়ানো, সমর ঘোষ বললেন, “আমাদের অবচেতন মনের খাঁজে-খাঁজে লুকিয়ে থাকা অসমাপ্ত চিন্তা, ঘুমের সময় সিনেমার রিলের মত ঘুরতে থাকে। সেটাই হল স্বপ্ন।”

সমর হয়ত আর কিছু বলত, অলক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “ওই সিনেমার রিল না কি একটা বললে, আমি সেই রিলটা যারা দেখায় তাদের কথা বলছি। দেখেছো কি কেউ তাদেরকে?”

সিনেমার মত, স্বপ্নের ডিস্ট্রিবিউটর, অপারেটর সেরকম আবার কিছু হয় নাকি? সবাই নিজের-নিজের অসমাপ্ত হুইস্কির গ্লাস, ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমুক দেবার আগে, এই কথাটাই বোধহয় একযোগে ভাবলেন আর একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। কেউ-কেউ আবার মুখ টিপে মিচকি-মিচকি হাসলেন।

আর যার কথা নিয়ে সবাই এসব ভাবলেন, সেই অলক সেন ততক্ষণে প্ল্যানটারস ক্লাবের বার থেকে বাইরে কোথাও চলে গিয়েও, বাকি সবাইকে এই আলোচনাটা শুরু করিয়ে দিয়ে গেল।

মাইলের পর মাইল ধরে, চুড়োয়-চুড়োয় আটকে থাকা মেঘ আর তার ধোঁয়া দিয়ে ঘেরা, এই ধুমডিলা পাহাড়শ্রেণী আর পাহাড়তলির গভীর শাল-সেগুনের জঙ্গলকে দু-ভাগে চিরে দিয়েছে সরু ফিতের মত রুপালি পাহাড়ি নদী।

একভাগে পাহাড়ের ঢাল জুড়ে পরের-পর চা-বাগানের সারি। অন্য ভাগ হীরে, সোনা, নিকেল আর কয়লার খনিজ সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ। দু’ভাগেই উড়ে বেড়ায় রঙ-বেরঙের টাইগার মথ।

খনিজের খোঁজ আর টাইগার মথের সমীক্ষায়, ধুমডিলায় এসেছি আমরা কয়েকজন দেশ-বিদেশ থেকে। এইসব কাজের জন্য, আমরা এই এলাকার নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও, প্রতি শনিবার রাতেই, সবাই চলে আসি এই প্ল্যান্টারস ক্লাবের আড্ডাতে। গভীর রাতে, পাহাড়ি নদীর বুকের ওপর লোহার দড়ির ঝোলা ব্রিজ পেরিয়ে, যে যার টেন্টে ফিরে যাই।

কিন্তু এই শনিবার রাতে, নিম্নচাপের বৃষ্টির কল্যাণে, সেই পাহাড়ি নদী এখন বেড়াল থেকে বাঘ হয়ে গিয়েছে। তার গর্জনে, থেকে থেকে হো-হো শব্দে বয়ে যাওয়া, ঝড় হেরে গিয়েও আসর ছেড়ে যায়নি।

এই সম্মিলিত গর্জনের জোর এতটাই যে ব্রিটিশ জমানার ঝোলা ব্রিজ থেকে-থেকে ভয়ে কেঁপে উঠছে। ব্রিজ থেকে দুশো মিটারেরও বেশি উঁচুতে, পাহাড়চুড়োর এই ক্লাবের বন্ধ দরজা জানালা ভেদ করে, সেই গর্জন পুরো ক্লাব হাউসে ছড়িয়ে পড়ছে।

আজ রবিবার। ঘড়ির কাঁটার হিসেবে, সকাল গড়িয়ে দুপুর এসে গেছে কিন্তু নিম্নচাপের দাপটে, আমরা ঝোলা ব্রিজ পার করবার সাহস না করে ক্লাব হাউসেই আছি। এই দুর্যোগের তীব্রতা দেখে, সূর্যেরও ওঠবার কোনও ইচ্ছে হয়নি।

ক্লাব হাউসে খাদ্য, পানীয়ের অঢেল আয়োজন। এছাড়া বিলিয়ার্ড, লন আর টেবিল টেনিস, তাস খেলার আড্ডা ঘর, ওপর- নিচ মিলিয়ে পঞ্চাশ-ষাট জনের রাতের বিশ্রাম নেবার ব্যবস্থা, সব কিছু এত সুন্দর যে এসব ছেড়ে কারোর ইচ্ছাই করেনি ফিরে যাবার।

ঘণ্টা দুই এর ওপর হতে চলল, স্বপ্ন নিয়ে আড্ডার রেশ এখনো শেষ হয়নি। অবসর সময়ে, এই অঞ্চলের চিতাবাঘ, পাইথন, হাতি আর কে কী স্বপ্ন দেখলেন এই সব বিষয়েই আমাদের আলোচনা ঘোরাফেরা করতে থাকে। আজ তার ব্যতিক্রম হল না।

প্রতিদিন বিকেল গড়াবার আগেই, রোজকার কাজ বন্ধ করে যে যার তাঁবুতে ফিরে যাই। ডিএফও’র কড়া হুকুম, জেনারেটর তো চলবেই না এমন কি হাজ্যাক লাইটও, রাত ন’টার পর নিবিয়ে দিতে হবে। রেডিও শুনতে চাইলে, খুব আস্তে। এখানের আলো বা শব্দ পাহাড়তলির জঙ্গলের রাতচরা পশুদের ভয় পাইয়ে দিতে পারে।

প্রত্যেকেরই টেন্টের সামনের লম্বা গাছে হ্যামক টাঙ্গানো আছে। টেমি জ্বালিয়ে, সাঁঝবেলাতেই রাতের আহার সেরে প্রত্যেকেই কয়েক বোতল ছাং সাথে নিয়ে, তারার সামিয়ানার তলায় গাছের ডালে বাঁধা হ্যামকের দোলনা-বিছানায় আধশোয়া হয়ে নাইট-ভিসনে চোখ লাগাই।

জোনাকির টুনি বাল্বে সাজানো বড় গাছের তলায় হরিণের দল আসে নেচে-নেচে। গাছের ডালে, আধবোজা চোখে, ঝিমায় শিকারি পেঁচা। কখনো-কখনো, আকাশে আলো করে আসে যায় ধূমকেতু। এসব দেখতে দেখতে, কখন যে চিতার মত নিঃশব্দে তুলে নিয়ে যায় স্বপ্ন, তা টের পাই আমরা যখন রাত শেষ হয়ে প্রায় ভোর হয়ে আসে সেই সময়। ততক্ষণে যাকে যা দেখাবার সেই স্বপ্ন দেখিয়ে, সে নিঃসাড়ে বিদায় নিয়েছে।

প্রতি রাত্রে, পুরো ক্যাম্পের প্রতি তাঁবুতেই, আলাদা-আলাদা স্বপ্ন দেখি আমরা। কাজের অবসরে বা দিনের শেষে ক্যাম্পে ফেরার সময়, সেই নিয়ে আলোচনা আমাদের শ্রেষ্ঠ মনোরঞ্জন। কেন জানি না, মনের মত স্বপ্ন, যার রেশ থেকে যায় অনেক পরেও এবং যা বারবার দেখতে ইচ্ছে করে, সে রকম স্বপ্ন কমই দেখি আমরা।

স্বপ্ন নিয়ে অলক সেনের কথাটা কিন্তু আমার বেশ লাগলো। বেশ কিছুদিন ধরে আমিও ভেবেছি, শহরের কাগজওয়ালার মত কেউ কি রোজ আমাদের মনের ব্যালকনিতে স্বপ্ন ছুঁড়ে দিয়ে যায়? কিন্ত উত্তর পাইনি। অলক সেন কি উত্তরটা জানেন? কিন্তু উনি গেলেনটা কোথায়?

ক্লাবহাউসের বাইরের বারান্দায় আসলেই, কুয়াশার ঘন চাদর কিন্তু একটুও রেহাই দেবে না, অজগরের মত গিলে খাবে। কিন্তু আমি যখন এই বারান্দায় এলাম, সেই মুহূর্তে হঠাৎ ওঠা দুপুর-রোদের ধারালো রশ্মির শেষ চেষ্টা কিছুটা সফল হল।

রোদের রশ্মির নিখুঁত অসিচালনায়, কুয়াসার শরীর দু-টুকরো হয়ে, পাহাড়ি ঢালে গড়িয়ে যেতেই, ক্লাবহাউসের গাড়ি- বারান্দার বাইরে, অলক সেনকে স্পষ্ট দেখা গেল। তার ছিপছিপে লম্বা শরীরটা, ঋজু পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে, ব্রিজে যাবার পাকদণ্ডি রাস্তাটায়।

অনেক বছর আছে ও এখানে। তার ওপর পাইনউড টী-এস্টেটের ম্যানেজার হবার দরুন পুরো এলাকাটা ও হাতের তালুর মত চেনে। কিন্তু ব্রিজের রাস্তায় কেন? নেশার ঘোরে চলছে না তো? ব্যাপারটা কী একটু দেখা যাক তো।

পাকদণ্ডি রাস্তাটা যেখানে চুলের কাঁটার মত বাঁক নিয়েছে, ঠিক সেইখানে, অলক সেন যেন আমার জন্য অপেক্ষাই করছিল।

কুয়াশা ততক্ষণে আমাদের দুজনকেই লেপটে নিয়েছে, কিন্তু অমিতাভ বচ্চনের মত ওর ব্যারিটোন গলা শুনতে অসুবিধে হয় না।

ও বলে, “আমি জানতাম, তুমি এখানে শুধু সোনা আর ধোঁয়াটে কোয়ার্টজ খুঁজতেই আসোনি। তুমি এসেছ এই ধুমডিলাতে স্বপ্ন আর তার দলবলকে দেখতে।”

কথাটা গায়ে না মেখে আমি বললাম, “তুমি যাচ্ছ কোথায়? ওদিকে তো ব্রিজ”।

কুয়াশা একটু হাল্কা হয়ে এলো। অলকের কুঞ্চিত ভ্রু দেখা গেল, “তুমি কি আমার খোঁজে এসেছ? স্বপ্ন যারা দেখায়, তাদের যে আজ কিছু পরে দেখা যেতে পারে, সেটা কি তোমার এখনো অজানা?”

অলক সেনের ব্যাপারে সব জেনেও, কেন যে বোকার মত বলতে গেলাম, “স্বপ্ন সে তো ঘুমিয়ে পড়লে আপনা থেকেই...”

আমাকে থামিয়ে দিয়ে অলক সেনের ব্যারিটোন গলা পাথরে আছড়ে পড়তে গিয়েও পড়ল না।

সে তার আওয়াজের স্কেল নামিয়ে বললে, “এসেই যখন পড়েছো, তখন চল ওই কোণের দিকে। ওই ভিউ পয়েন্টে বসা যাক। এইরকম ঘন কুয়াশার চাদরের আসা যাওয়ার সময়েই তো তাদের আসার কথা”।

অলক আমার হাত ধরে নিয়ে যাবার জন্য আমার খুব কাছে এলো। কিন্তু মুখে ছাং বা হুইস্কির গন্ধ একটুও নেই। তবে ওর এ রকম মনের অবস্থায়, প্রথমেই উলটো তর্ক না করে, সায় দেবার ভান করে বললাম, “আমারও মনে হয় ওই কোণের দিকেই স্বয়ং স্বপ্নদেবকে তার দলবল সমেত দেখা যাবে। কুয়াশাও মনে হয় কেটে যাবে তখন”।

“না, না কুয়াশার রঙ তখন পালটাবে। দেখবে তখন এই ধূসর রঙ থাকবে না, সেটা হবে আসমানি আর গেরুয়া মিলিয়ে একটা অদ্ভুত রঙ। গতবছর তো তাই হয়েছিল এই সময়টায়।”

“কী হয়েছিল গত বছর? এই ভিউ পয়েন্টে তাদের আসবার সময় কুয়াশার রঙ পালটে গেছিল?।”

অলক একবার আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরে বললে, “একটু অপেক্ষা করলে, হয়তো দেখতে পাবে কুয়াশার রঙ বদলের সঙ্গে, পাহাড়ি নদীর জল থেকে ভেসে উঠবে এক বড় ঝিনুক। তার ডালা খুলে বেরিয়ে আসবে পরমাসুন্দরী রানীপরী। তার দুই হাতের বিশাল দুটি ডালাতে অসংখ্য সাদা নিটোল গোল-গোল মুক্তো। সেই সময়, নদীর ওপারে, পাহাড়ের ঢালে, এক জায়গাতে গুহামুখে চাপা দেওয়া পাথর সরে যাবে। গুহার মুখ খোলা পেয়ে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে রঙ-বেরঙের খুদে খুদে পরী। এরা রানীপরীর ডালা দুটো থেকে মুক্তোগুলো গুহাতে রেখে, তার থেকে কিছু নিয়ে উড়ে যাবে চারদিকে আর চুপি-চুপি রেখে আসবে আমাদের মনের আনাচ-কানাচে। সেই মুক্তোগুলোই কিছু পরে স্বপ্ন হয়ে জন্মাবে আর রানীপরীর কাছে ফেরত যাবে। কিছু ক্ষুদে পরী ফিরে আসবে গুহাতে আর যারা ফিরতে চাইবে না, তারা এই অঞ্চলের টাইগার মথ হয়ে উড়ে বেড়াবে।”

অলক কি জাদু বা সম্মোহন জানে? আমি নিঃশব্দে আবিষ্ট হয়ে শুনছিলাম ওর কাহিনী। অবশ্য কাহিনী বলা যাবে না, অলক এটা দেখেছে, সেটাও গত বছরেই। আর তার ওপরে, টাইগার মথের তো অভাব নেই ওখানে। তাদের ছবি আর বৃত্তান্ত নথিবদ্ধ করতেই, দেশ-বিদেশ থেকে বিজ্ঞানীরা এসেছেন এখানে। যাইহোক এখন শুনলাম, টাইগার মথেরা নাকি রূপান্তরিত পরী?

আরে! অলক সেন গেলেন কোথায়? কুয়াশা এত ঘন হয়ে এসেছে যে শুধু নিজের হাত-পা দেখা যাচ্ছে।

আমাকে আশ্বস্ত করে ওনার ব্যারিটোন গলা ভেসে এলো। মনে হল যেন উনি অনেক দূরে আছেন,“আমি কিন্তু তোমার কাছেই আছি, ঠিক যেখান থেকে নদীর বাঁক দেখা যায়। এখন যেকোনো সময় কুয়াশার রঙ বদলাতে পারে আর ঠিক সেই সময়ে নদীর বাঁকে ভেসে উঠবে রানীপরীর ঝিনুক বাহন।”

গলার স্বর শুনে মনে হল বেশ ভাল মুডে আছেন এখন, সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম,“গতবছর তুমি ঝিনুক বাহনে রানীপরী আর বাকি পরীদের দেখেছো?”

অলক নিজের নিষেধাজ্ঞা ভুলে একটু জোরে হেসেই যেন কষে ব্রেক লাগালে,“তুমি তাহলে এই বুঝলে? আরে ভাই! এটা এ অঞ্চলের আদিবাসীদের জনপ্রিয় লোককথা।”

আমি এবার পায়ের তলায় জমি পেলাম, “ওঃ তাহলে তুমি আমাকে গল্প শুনিয়েছ?”

প্রতিবাদ করে অলক বলে, “নিছক গল্প বলি কী করে? গত বছর আমি এই ভিউ পয়েন্ট থেকে এই রকম ঘোর নিম্নচাপের বৃষ্টি আর কুয়াশার সময় দেখেছিলুম হঠাৎ কুয়াশার রঙ বদলাতে শুরু করল। আসমানি আর গেরুয়া মিলে সে একটা অদ্ভুত রঙ , ঠিক যেমন বলেছিল লোহা-গাঁওয়ের গাঁওবুড়ো। এই রঙ্গিন কুয়াশাতে কিন্তু নিচের পাহাড়ি নদীটা পরিষ্কার দেখা গেল। হঠাৎ দেখি জল থেকে ভুস করে একটা বিরাট ঝিনুকের মত কিছু উঠছে।”

কুয়াশার সাথে এবার কিন্তু বেশ জোরে ঝড় উঠলো, আর বিন্দু বিন্দু ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিও শুরু হল। অলক চুপ হয়ে গেল কেন? ভিউ পয়েন্ট থেকে পাহাড়ের ঢালে গড়িয়ে গেল কি?

আমি চেঁচিয়ে ডাকতে যাব প্রায় ঠিক সেই সময়ে দেখি অলক পাহাড়ের ঢাল থেকে উঠে আসছে, কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, “সেবার চা বাগানের সাইরেন বেজে ওঠায়, এক লহমার জন্য রানীপরীর ঝিনুকবাহন ছাড়া আর কিছু দেখতে পাই নি। আজ রবিবার, ছুটির দিন, সাইরেন বাজবে না। কোনও দিকে ঘাড় না ঘুরিয়ে সোজা নদীর বাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকি। মন বলছে এবার শুধু ঝিনুক নয়, স্বপ্ন দেখানোর রানীপরী আর পাহাড়ের গুহা থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষুদে পরীদের পুরো দলটাকেই হয়ত দেখা যাবে।”

পর পর দু’দুটো রামধনু তৈরি হচ্ছে আকাশে। আনন্দ-মাখানো স্বরে অলক বলে, “এই মুক্তোগুলো হয়ত আমাদের এক-একটা অ-পুরিত ইচ্ছে। আমরা তাদের লজ্জার মোড়কে আড়ালে রাখি, ফেলে দিই হয়ত। রানীপরীর দলবল তা কুড়িয়ে জমা করে রানীর ভাঁড়ারে। রানীপরী ইচ্ছেগুলোর লজ্জার মোড়ক ছাড়ায়, পরিষ্কার করে। একদিন তার প্রাসাদ থেকে এই ঝিনুকের নৌকাতে এসে, লজ্জাহীন আমাদের ইচ্ছেগুলোকে তার দলবলের হাতে তুলে দেয়”।

কথাগুলো শুনে আনন্দে মন ভরে ওঠে। “দারুণ বললে ভাই।”

ব্যারিটোন কণ্ঠ প্রতিবাদে ঝনঝন করে, “এটা আমার নয়, এখানের মিত্তু পোঙ্গল পরবের দিনে আদিবাসীদের গানের কথা থেকে পাওয়া।”

বলতে চাই না, সেদিন শেষ অবধি, আকাশে জোড়া রামধনু আদৌ উঠেছিল কি না? বা সেই রামধনু আলোতে ঘন কুয়াশা তার দোলাই চাদরের রঙ বদলেছিল কি? তার পরে নদীর বুক থেকে কি ভুস করে উঠে এসেছিল, রানীপরীকে নিয়ে আমাদের লজ্জাহীন ইচ্ছেতে বোঝাই তার ঝিনুকের নৌকো? সে দিনের পর যখন নিশি রাতের স্তব্ধতা ভেঙ্গে গাছের পাতায় পাতায় বুনো নিশিফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে, টুপ-টাপ টুপ-টাপ হাওয়া নূপুরের আওয়াজ শুনি, গাছের ডালে বাঁধা হ্যামকের দোলনা বিছানা থেকে জানি তখন, নামছে, নামছে তারা। সেই খুদে পরীরা আমাদের যে যার গোপন অপূর্ণ লজ্জাহীন ইচ্ছেগুলো নিয়ে নামছে। চেতনাকে অবশ করে দিয়ে স্বপ্ন নামছে এবার, স্নায়ুতে স্নায়ুতে।