রূপান্তর - অভিষেক সেনগুপ্ত

অলংকরণ - প্রতিম দাস

লম্বাটে, চওড়া ডাইনিং টেবলটা খুব যত্ন করে সাজানো। দু’কোণে দুটো ফ্লাওয়ার ভাসে ম-ম করছে রজনীগন্ধা। মাঝখানে সিলভার স্টোনের ক্যান্ডল স্ট্যান্ডে একটা বড় মোমবাতি জ্বলছে। সোনালি রংয়ের তরল আলো ছড়িয়ে রয়েছে টেবলটা জুড়ে। স্প্লিট এসির হাওয়ায় মৃদু কাঁপছে শিখাটা। ঘরের সমস্ত আলো নেভানো। মোমের আলোয় ক্যানভাস হয়ে উঠেছে ডাইনিংয়ের চারদেওয়াল। চলমান ছায়ার ভিড়। ঘরে পা রেখে অভিভূত হয়ে গেল শুভময়। ছোট্ট লাগেজ ট্রলিটা ল্যাপটপ ডেস্কের কোণে রাখতে রাখতে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সবকিছু। তার লংজার্নির ধকল নিমেষে মুছে গিয়েছে। ঘরে ফেরার আদর্শ সিন ক্রিয়েট করেছে শ্রাবণী। ওপেন কিচেনের কাউন্টারে ডিনার সেট রাখা। একেএকে সেগুলো তুলে ডাইনিং টেবলে এনে সাজিয়ে রাখছে। শু-র‍্যাকে জুতোটা রেখে শ্রাবণীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল শুভময়।

‘হাউ ওয়াজ ইওর ট্রিপ?’ তার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল শ্রবাণী।

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শুভময়। কুচিকুচি চুল এসে পড়েছে শ্রাবণীর কপালে। মোমবাতির অলস কম্পমান শিখা থেকে ছড়িয়ে পড়া নরম আলো খুঁটেখুঁটে খাচ্ছে ওকে। ওকে ঘিরে লুকোচুরি খেলছে আলো আঁধারি। শ্রাবণীর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। সারপ্রাইজ দেওয়ার সময় এরকম ছেলেমানুষী হাসি দেখতে পায় শুভময়। দোহায় অফিসের ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে ক’টা দিন প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে। অন্য দিকে নজর দিতে পারেনি। ওয়ার্ল্ডের লিডিং অয়েল সাপ্লাই কোম্পানিতে কাজ করে সে। সারা বিশ্ব জুড়ে তাদের ব্যবসা। এই সংস্থাগুলো কর্মীদের শেষ এনার্জিটুকুও ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নেয়। এই পনেরোটা দিন অফিস তাকে ছিবড়ে করে দিয়েছে। সকালে ফাইনাল মিটিংটার পর দুপুরে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে দুবাই হয়ে কলকাতায় পা রেখেছিল যখন, ক্লান্তি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শুভময়ের শরীর জুড়ে। ভেবেছিল, বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে জাস্ট এক বওল স্যুপ খেয়ে তলিয়ে যাবে ঘুমে। ঘরে পা দেওয়ার পর মোমবাতির নরম আলো, ফুলের মৌতাত একটু একটু করে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে তার। ফুল রিচার্জড হয়ে গেছে তার সব ক’টা ড্রাই সেল।

শ্রাবণীকে দেখে সাইলেন্ট এজ মুভির নায়িকাদের মতো লাগছে। নরম, ঢলঢলে, স্নিগ্ধ। গাঢ় চকোলেট কালারের হাউসকোট ঘিরে রেখেছে ওর সি গ্রিন নাইটিটাকে। অদ্ভুত কালার কম্বিনিশেন। ফিনফিনে সোনার হারটা যেন ওর শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। তার থেকে ঝোলা পেনডেন্টটা মুখ লুকিয়েছে ক্লিভেজের খাঁজে। শ্রাবণীর মুখের বাঁদিকে আলো পড়ে একটা বদ্বীপ তৈরি হয়েছে। চোখের কোলে ডার্ক শেড। ছানাকাটা ফ্যাকাশে অন্ধকার যেন আলোর বুক চিরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে। তীক্ষ্ণ নাক আর গোলাপি ঠোঁট, গাল, চিবুক, গলা বেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে স্তনবিভাজিকায়। আহা, ডিএসএলআরটা যদি থাকত হাতের কাছে!

‘কী দেখছো শুভ?’

‘তোমাকে।’

‘আগে কখনও দেখোনি?’ হাতের কাজ সারতে সারতে প্রশ্ন করল শ্রাবণী।

‘আজ তোমাকে অন্যরকম লাগছে বনি। প্রথম দেখার দিনগুলোর মতো। ভাসাভাসা, জ্বলজ্বলে।’

বিরতি মাঝেমাঝে খুব কাজে দেয়। বিশেষ করে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। জটিল, চটচটে আবর্তে ফেঁসে যাওয়া, দম আটকে যাওয়া মানুষগুলো নতুন করে বেঁচে ওঠে। সময় পাওয়া যায় অগোছাল ঘরটাকে নতুন করে সাজিয়ে নেওয়ার। বিশ্বাস জড়ো করে ভেসে যাওয়া মানুষগুলো আবার ফিরে আসতে চায় ফেলে যাওয়া পুরোনো ভিটেতে।

‘তোমাকে ফ্রেশ দেখাচ্ছে।’ বলল শুভময়।

বাঁহাতের চেটোয় কপালের চুল সরিয়ে ডাইনিং টেবলের দিকে এগিয়ে গেল শ্রাবণী। ‘ঠিক বলেছো, ক’টা দিনের চেঞ্জটার এফেক্ট। মাঝেমাঝে নিজের সঙ্গে কাটানো খুব দরকার।’

তারপর শুভময়ের দিকে ফিরে আদুরে গলায় বলল, ‘তুমি কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? যাও না ফ্রেস হয়ে এসো। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে যে!’

‘ডক্টর শ্রীবাস্তবের সঙ্গে আর কথা হয়েছে নাকি?’ বলল শুভময়।

‘নাহ্‌, আর কী বলব? সব তো ঠিকই আছে!’

প্লেট থেকে এক চামচ রাইস মুখে তুলে শ্রাবণী বলল, ‘অ্যাই জানো, তোমাকে বলা হয়নি। কদিনের জন্য আমি দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলাম। খুব ছেলেবেলায় একবার গিয়েছিলাম ওখানে। আবছা মনে আছে। এবার তো দেখলাম, পুরো শহরটা একদম পাল্টে গিয়েছে। খুব আনন্দ করেছি আমি।’

রান্না করতে ভালোবাসে শ্রাবণী। আজ শুভময়ের ভালোলাগার বাঙালি পদগুলো সে রান্না করেছে। সোনামুগ ডাল, ঝিরঝিরে আলুভাজা, পোস্তর বড়ার ঝাল, পমফ্রেট ভাপা, মটনকারি। সঙ্গে দেরাদুন রাইসের ভাত। শেষ পাতে বেকড রসোগোল্লা। দু’জনের প্লেটে ঝাপসা টুংটাং আওয়াজ তুলেছে ডিনার স্পুন।

শ্রাবণীর কথা শুনে একটু থমকে গেল শুভময়। পরমুহূর্তে উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল, ‘এই জন্যই তো আমি তোমাকে বলেছিলাম, ঘুরে এসো। নতুন জায়গা মনের ওপর সবসময় ভালো এফেক্ট আনে। ফ্রেস লাগে। এনার্জি পাওয়া যায়।’

‘উমম, ঠিক বলেছো। সত্যিই অন্যরকম লাগছিল। এই ক্লান্তিকর, একঘেয়ে রুটিন মেনে চলা জীবনটা থেকে মুক্তি পেয়েছি ওই ক’টা দিন। মনের সব ময়লা ফেলে এসেছি।’

শুভময় খাওয়া থামিয়ে এক মনে দেখছে শ্রাবণীকে। প্রায় কুড়ি বছর সে চেনে মেয়েটাকে। সেই কলেজ জীবন থেকে প্রেম। শ্রাবণী বরাবরই আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু ইদানীং বড্ড অচেনা লাগে। একজোড়া গাঢ় ভ্রুর নীচে ওর গভীর চোখদুটোয় এতটা চাঞ্চল্য কখনও দেখেনি। যেন এই ডিনার টেবলে বসে খেতে খেতেও হারিয়ে যাচ্ছে শ্রাবণী।

‘কী হল, খাচ্ছো না?’

‘তোমার কথা শুনছিলাম।’

‘জানো, দার্জিলিংয়ে গিয়ে আমার একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।’

‘কে?’

‘তুমি চেনো না। ম্যালটা তো জানোই, নিউ মার্কেটের মতো। লোকে লোকারণ্য। রেলিংয়ের ধারে একটা টানা লোহার চেয়ারে বসে মানুষ দেখছি, এক ভদ্রলোক পাশে এসে বসলেন। কথায় কথায় আলাপ। তোমারই বয়সী হবে। তোমার মতো লম্বা-চওড়া। নাম বললেন, বিক্রম। চমৎকার মানুষ। জানো, উনিও না আমার মতো একাএকা ঘুরতে গিয়েছিলেন। অনেক গল্প হল। ছোট্ট জায়গা তো, রোজ দেখা হয়ে যেত আমাদের। পরেরদিন কেভেন্টার্সে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে দেখা। একসঙ্গেই অর্ডার করলাম। বিক্রম একদিন গ্লেনারিজে ডিনারে নেমন্ত্রণ করল। যাব না ভাবছিলাম। চিনি না, কে জানে কী রয়েছে মনে! কিন্তু-কিন্তু করেও শেষপর্যন্ত গেলাম। বুঝতে পারলাম, মানুষটা সত্যিই ভালো।’

‘একটু রাইস দিই তোমাকে?’

শুভময় একমনে তাকিয়ে রয়েছে শ্রাবণীর দিকে। মেয়েটার চঞ্চলতা বাড়ছে। খুশি উপচে পড়ছে। শ্রাবণী এমন নয়। সে চুপচাপ। সবার সঙ্গে মিশতে পারে না। ভিড়ের মধ্য‌েও একা। ধীরে কথা বলে। উচ্ছ্বাস যেটুকু দেখেছে এতদিন, তাও ক্ষণিকের। শুভময় মেলাতে পারছে না।

‘হ্যাঁ, আমি নিচ্ছি। তারপর? আর কোথায় কোথায় ঘুরলে দার্জিলিংয়ে?’

‘তুমি তো জানো, আমি খুব বেশি ছুটে বেড়ানো পছন্দ করি না। দার্জিলিংয়েই সাতটা দিন কাটালাম। প্রথম দুটো দিন বোর্ড ফিল করছিলাম। কত আর ম্যালে বসে থাকব! বিক্রমের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর হু-হু করে দিনগুলো কেটে গেল।’

‘অ্যাই শুভ, তুমি কখনও দার্জিলিংয়ে গিয়েছো?

‘ছেলেবলায় একবার গিয়েছি, স্কুলের এসকার্সনে। চমৎকার লেগেছিল।’

‘সত্যিই দারুণ জায়গা। মনের মতো সঙ্গী পেলে ঘোরার মজাই আলাদা।’

চামচটা প্লেটে নামিয়ে রেখেছে শ্রাবণী। মোমবাতির দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। ওর মণিদুটো মোমের আলোয় ক্রমশ সোনালি হয়ে উঠছে। যেন দপ করে জ্বলে উঠবে!

‘জানো, বিক্রম একদম তোমার মতো। মজার মানুষ। কলেজে তুমি যেমন জমিয়ে রাখতে, তেমন। হইহই করতে পারে। হাসাতে পারে। তোমার মতো নীলশার্ট পরতে ভালোবাসে।’

‘হুম।’

‘বেচারা বড্ড একা। অফিস আর বাড়ি। ওর কথা শোনার, ওকে সময় দেওয়ার কেউ নেই। বিক্রম বলছিল, অনেকদিন পর ও প্রাণ খুলে হাসল। ভাবো তো।’

‘তাহলে তো ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তোমাদের।’

‘তুমি বোধহয় ভাবছো, শ্রাবণী তো এমন নয়। চাপা স্বভাবের। মিশতেই পারে না। সে কী করে বন্ধুত্ব করল? কী জানো, সময় মানুষকে পাল্টে দেয়। আমিও অনেকটা পাল্টেছি। ঘরের মতো মনেও একটা চার দেওয়াল থাকে। সেটা ভেঙে বেরোতে পারলে তবেই মানুষ এই বদলের ব‌্যাপারটা বুঝতে পারে।’

শুভময় শুকনো হাসল। সে নিজেই একসময় চাইত, শ্রাবণী যেন তাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা জীবনটা থেকে বেরোতে পারে। পৃথিবীতে তারাই একমাত্র দম্পতি নয়, যাদের বাচ্চা হয়নি। শুরুতে শ্রাবণী মরিয়া চেষ্টা করত। ডাক্তারদের কাছে ছুটে যেত। কোনও লাভ হয়নি। শুভময় চেয়েছিল, একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে। শ্রাবণী রাজি হয়নি। কথা উঠলেই বলত, ‘আমাদের ঠিক হবে, দেখে নিও।’ দাম্পত্যের পনেরোটা বছর পরেও শূন্য জায়গাটা খালিই থেকে গিয়েছে।

‘তোমাকে একটা কথা বলব? ক’দিন ধরেই ভাবছি। তুমি বাইরে ছিলে বলে বলিনি।’

‘বলো?’

‘তুমি কখনও প্রেমে পড়েছো? মানে, আমি ছাড়া অন্য কারও প্রেমে?’

ফর্ক দিয়ে পমফ্রেট ভাপার একটা টুকরো তুলতে গিয়েও থেমে গেল শুভময়ের বাঁহাত। শ্রাবণীর সঙ্গে তার জীবন অনেকটাই নিস্তরঙ্গ, উচ্ছ্বাসহীন। আজ নয়, অনেকদিন। রোঁয়ার মতো কিছু আবেগ এখনও হয়তো লেগে রয়েছে। আলাদা করে বোঝা যায় না। অপূর্ণতা থেকে শূন্যতা তৈরি হয়। আর শূন্যতার ধর্মই হল, কিছু না কিছু এসে সেটা ভরাট করে দেয়। শুভময়ের জীবনেও তেমন হয়েছে। তার জীবনেও এসেছে প্রেম। কিন্তু সবটাই ছিল তার তরফ থেকে। কখনও বলা হয়ে ওঠেনি। এই একটা জায়গায় গিয়ে বরাবর থমকে গেছে শুভময়। একটা খারাপলাগা কাজ করেছে। তার মনে হয় এই খারাপলাগাটাই শ্রাবণীর ছায়া। সেটা থেকে সে কোনওদিন বেরোতে পারেনি। তাদের ছেঁড়া-ছেঁড়া সম্পর্কটা থেকে গিয়েছে। যতদিন যাচ্ছে, শ্রাবণীর থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে সে। শুভময় জানে, শ্রাবণীকে ছেড়ে সে কোনওদিন বেরোতে পারবে না। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল শুভময়ের।

‘আমি পড়েছি।’

শ্রাবণীর কথায় চমকে গেল শুভময়। অবাক হয়ে শ্রাবণীর তুলতুলে মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকল। উত্তেজনায় ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় ইষৎ লাল হয়ে গিয়েছে গাল।

‘বিক্রমকে ভালোবেসে ফেলেছি।’ কথা ক’টা বলে মুখ তুলে শুভময়ের দিকে তাকাল শ্রাবণী। তার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই, অপরাধবোধ নেই। যেন খুব সহজ কতগুলো কথা সে বলছে শুভময়কে।

‘আমি জানি তুমি ভাবছো, এতদিনের সম্পর্ক কি ভাঙা যায়? কষ্ট হবে। সত্যিই খুব খারাপ লাগবে। সম্পর্ক একটা সময় অভ্যেস হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে দাঁতমাজার মতো। খিদে পেলে খাওয়ার মতো। কিন্তু তোমার-আমার এই সম্পর্কটা এমন ছিল না। একটা স্রোত ছিল, চড়াই-উৎরাই ছিল, মোচড় ছিল। ভাঙা-গড়া ছিল। এখন আমরা অনেকটা পরিত্যক্ত কেল্লার মতো। মাটিতে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত ধ্বংসাবশেষ আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে টিকে থাকা। বিশ্বাস করো, এভাবে আর থাকতে পারছি না। বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছি। কষ্ট হয়। প্রচন্ড কষ্ট।’

‘কী বলছো বনি? তুমি কি...?’

‘পাগল হয়ে গেছি? তা বলতে পারো। ভালো থাকার, খুশি থাকার ভান করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর প্রিটেন্ড করতে পারছি না।’

মোমবাতির আলোর মতো তিরতির করে কাঁপছে শ্রাবণীর চোখের কোল। ছলছল করছে চোখ। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। কষ্ট হচ্ছে তার।

‘শুভ, আমি অনেক ভেবে দেখলাম, এটাই একমাত্র রাস্তা। এক বাড়িতে, এক ছাদের তলায় দুটো মানুষ অচেনা হয়ে থাকার থেকে ভালো দূরে সরে যাওয়া। আমি আর নিতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।’

‘তুমি… তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও।’

শুভময়ের হাত থেকে ডিনার স্পুনটা পড়ে গেল প্লেটের ওপর। ঝনঝন শব্দ তুলে। শ্রাবণী কি সত্যিই এই কথাগুলো বলছে? নাকি ভুল শুনছে সে? শুভময়ের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। তার চোখমুখ কুঁচকে উঠেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে সামলে নিল নিজেকে। এখন রাগ করলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় ট্যাকল করতে হবে। না হলে উল্টো ফল হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে কোনও সুস্থ মানুষ হাসতে পারে না। বেমানান লাগে। তবু সে হেসে ফেলল।

‘ধুর বোকা, এরকম ভাবে না। জীবনটা এমন নয়। দেখো, কাজের চাপ তো সবার থাকে। আমরা খুব বেশি সময় কাটাতে পারি না, এটা সত্যি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের আলাদা হয়ে যেতে হবে! তুমি বরং একটা চাকরি খোঁজো। বিয়ের আগে একটা স্কুলে পড়াতে। আবার স্কুলে চাকরি করো। দেখবে, সময় কেটে যাবে।’

উঠে দাঁড়াল শ্রাবণী। নিজের ডিনার প্লেটটা তুলে নিয়ে ধীর পায়ে চলে গেল কিচেনে, সিঙ্কের দিকে। সে কি শুনতে পেল শুভময়ের ক’টা কথা? হতভম্বের মতো বসে রয়েছে শুভময়। সে বিড়বিড় করে উঠল, ‘বনি, আমাকে ছেড়ে যেও না।’

মোমবাতির ফ্যাকাসে আলোটা ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে। থকথকে অন্ধকার উঠে আসছে ক্যান্ডল স্ট্যান্ডের তলা থেকে। আবছা হয়ে যাচ্ছে তাদের থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাটের ডাইনিং রুমটা। সেই অন্ধাকারে ক্রমশ মিশে দুটো মানুষের ছায়া। শুভময় মাথা নামিয়ে বসে রয়েছে ডিনার টেবলে। সেও উঠে দাঁড়াল। ইতস্তত পায়ে হেঁটে গেল কিচেনের দিকে। সম্পর্ক অনেক সময় গতি হারায়। অবরূদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। কোনও একজন যদি চেষ্টা করে, তাহলে আবার ঠিক করে নেওয়া যায়। গতি ফিরে পায়। সে চেষ্টা করবে। আঁকড়ে ধরবে শ্রাবণীকে। আরও সময় দেবে। ইদানীং বড্ড অবুঝ হয়ে যাচ্ছে শ্রাবণী। ওকে বোঝাতে হবে। কোথাও একটা থেকে ঘুরে আসা দরকার। একটা চেঞ্জ হবে। ভালো লাগবে শ্রাবণীর। তারা কাছাকাছি থাকতে পারবে। আবার স্বাভাবিক হবে তাদের সম্পর্কটা।

কয়েক পা এগোতেই শ্রাবণীর অনুচ্চ গলা শুনতে পেল শুভময়। ফোন করেছে কাউকে! এত রাতে?

শ্রাবণীর আবছা ক’টা শব্দ ভেসে এল শুভময়ের কানে। ‘বিক্রম, আজ আমি সব সত্যি কথা বলে দিয়েছি শুভকে। কতদিন আর লুকিয়ে রাখতাম বলো? সত্যিটা একদিন বেরিয়েই পড়ত, তাই না? ও জানার আগে আমিই জানিয়ে দিলাম। ঠিক করিনি, বলো? আমি জানতাম, তুমি আমাকে সাপোর্ট করবে। শুভকে বলেছি, ডিভোর্সটা ফাইল করতে। হ্যাঁ, কাল দেখা হচ্ছে সোনা। আর ভয় কীসের?’

শুভময়ের পা দুটো কেউ যেন পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছে ফ্লোরের সঙ্গে। সে চেষ্টা করছে, তবু এগোতে পারছে না। তার গলা বুজে আসছে। একদলা বাতাস আটকে আছে তার কণ্ঠনালীতে। ওপেন কিচেনের কাউন্টারটার সামনে দাঁড়িয়ে শুভময় দেখতে পাচ্ছে শ্রাবণীকে। তার দিকে পিছন ফিরে সিঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে ও। কার সঙ্গে কথা বলছে ফোনে? নিজেকে আর সামলাতে পারল না শুভময়। ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে লাগামছাড়া উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল, ‘বনি!’

চমকে শ্রাবণী ফিরে তাকাল শুভময়ের দিকে। সে দেখতে পেল, শ্রাবণীর হাতে ফোন নেই। ডেজার্ট স্পুনটা ধরেছে কানের কাছে! শ্রাবণীর চোখে বিস্ময় আর ক্রোধ একসঙ্গে খেলা করছে।

মুহূর্তে শুভময় সামলে নিল নিজেকে। তাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। যে কোনও সময় ভায়োলেন্ট হয়ে যেতে পারে শ্রাবণী।

ভেজা পাতলা গলায় শুভময় বলল, ‘চলো আমরা ব্যালকনিতে গিয়ে বসি। মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। আমি হাতটা ধুয়েই আসছি।’

বাথরুমের দরজা বন্ধ করে বেসিন কলটা চালিয়ে মোবাইলের দ্রুত একটা নম্বর ডায়াল করল শুভময়। অনেক রাত হয়েছে। পাওয়া যাবে তো? বেজে বেজে কেটে গেল। দ্বিতীয়বার রিং করার পর গম্ভীর গলা ভেসে এল ওপার থেকে। শুভময় বলল, ‘হ্যালো ডক্টর শ্রীবাস্তব... ডক্‌ আমি... আমি শুভময় আচার্য বলছি... শ্রাবণী আবার... কিন্তু ও... কখনও এমন করেনি...

ফোনটা রেখে চোখেমুখে জল দিল শুভময়। তার টেনশন হচ্ছে। শ্রাবণীর এই ঘটনা তার কাছে নতুন। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। কী করবে বুঝতে পারছে না। শুভময় জানে, শ্রাবণী দার্জিলিং যায়নি। কাতারে তার অফিসের সেমিনারের সময় এই ফ্ল্যাটেই ছিল সে। তার জন্য সর্বক্ষণের একজন ওয়েল ট্রেন্ড নার্স আছে। যদি দার্জিলিং যেত, সে ঠিক জানতে পারত। শুভময় জানে, বিক্রম বলে কেউ নেই। বিক্রম নামটা তারই। ছেলেবেলায় দাদু তাকে ডাকতেন ওই নামে। দাদু অনেকদিন মারা গিয়েছেন। তারপর থেকে এই নামে কেউ ডাকেনি তাকে। শ্রাবণীর সঙ্গে প্রেমের প্রথমদিকে এই নামটা বলেছিল শুভময়। শ্রাবণী বলেছিল, শুভময়ের থেকে বিক্রম নামটা অনেক ভালো। পুরুষালি। বিক্রম নামটা শ্রাবণীর কাছে সত্যি, রক্তমাংসের মানুষ হয়ে গিয়েছে। বিক্রম সেই কারণে চেহারায়, স্বভাবে তারই মতো!

ডিনার টেবলে তার সঙ্গে শ্রাবণীর পুরো কথোপকথনটাই কাল্পনিক। যতদিন যাচ্ছে কল্পনার জগতে চলে যাচ্ছে। ডক্টর শ্রীবাস্তব বলেছিলেন, শ্রাবণীর মতো পেশেন্টদের কন্ডিশন অনেক সময় ডিটোরিয়েট করে। দীর্ঘদিন ওষুধ না খেলে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে এমন হয়। অতিরিক্ত স্ট্রেসের জন্য হতে পারে। এইরকম ট্রমাগুলোর সময় যেন শ্রাবণীকে না চটায় সে। তাহলে ভায়োলেন্ট হয়ে যেতে পারে। এইসময় বাড়তি কেয়ার নিতে হয় পেশেন্টের।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে শ্রাবণীকে কিচেনে দেখতে পেল না শুভময়। ব্যালকনির সুইং ডোরটা খোলা। পিচ কালারের পর্দাটা উড়ছে। তার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে শ্রাবণীর আবছায়া শরীর। ওটা আসলে ওপেন টেরেস। তার রেলিং ধরে রাতের অন্ধকারে যেন মিশে গিয়েছে শ্রাবণী। শুভময় নিঃশব্দে খুলল ওয়াড্রবের দরজাটা। বের করল একটা গাঢ় নীল শার্ট। কালার কম্বিনেশনের জন্য বেছে নিল সাদা প্যান্টটা। জামা-প্যান্ট পরে দ্রুত হাতে চিরুনি চালাল চুলে। শ্রাবণীর পছন্দের পারফিউম স্প্রে করল কবজির তলায়। আয়নার নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হল। স্মার্ট লাগছে। শু-র‍্যাক থেকে জুতোটা পরে ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল ব্যালকনিতে।

‘শ্রাবণী!’

কলকাতার নিউ আলিপুরে পনেরোতলা আবাসনের নীচটা মিটমিটে আলোয় মাখামাখি। যেন লাখোলাখো জোনাকি উড়ছে। দশতলার ফ্ল্যাটের ওপেন টেরেসে এককোণে এসে আটকেছে আধভাঙা চাঁদটা। তার পাতলা আলো ধুয়ে দিচ্ছে একফালি ছাদটাকে। টেরেসের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা শ্রাবণীকে মার্বেল পাথরের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। নিশ্চল মোহময় রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তার শরীর বেয়ে গলে গলে পড়ছে আধভাঙা চাঁদটা।

‘শ্রাবণী?’

শুভময় আবার ডাকল। উদাসী চোখে পিছনে ফিরে তাকাল শ্রাবণী। মুহূর্তে ঝিকিয়ে উঠল ওর দু’চোখ।

‘তুমি এখানে? কী করে এলে? শুভ দেখতে পেলে...!’

শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে গেল শুভময়। তার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে থামিয়ে দিল। বলল, ‘তোমার ফোনটা পাওয়ার সময়ই শুভময়ের চিৎকারটা শুনেছিলাম। তোমার কথা ভেবে খারাপ লাগছিল। টেনশন হচ্ছিল। কে জানে, হয়তো শুভময়ের সব রাগ গিয়ে পড়েছে তোমার ওপর। তাই চলে এলাম।’

‘আর শুভ?’

‘আমি যখন তোমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকছিলাম, দেখলাম ও হন্তদন্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই সোজা উঠে এসেছি। ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলাই ছিল। ও আসার আগেই চলে যাব।’

বাঁধভাঙা জোৎস্নায় যেন হেসে গলে গেল শ্রাবণী। তার চোখেমুখে উপচে পড়ছে খুশি। শ্রাবণী আরও এগিয়ে এল তার কাছে। দু’হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিল শুভময়। পরির মতো লাগছে শ্রাবণীকে। যেন শুভময়কে ক্ষণিকের এই ভালোলাগার মুহূর্তটা উপহার দেওয়ার জন্যই আকাশ থেকে নেমে এসেছে সে। তার নরম ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল শুভময়।

পরম তৃপ্তিতে দু’চোখ বুজে গিয়েছে শ্রাবণীর। সে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে অচেনা স্বপ্নের ঘোরে। শ্রাবণীর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে তাকে অপলক দেখছে শুভময়। মৃদু হাওয়ায় এলোমেলো উড়তে থাকা তার চুল, শ্বাসপ্রশ্বাস, অনন্ত ভালোবাসায় ঘিরে রেখেছে শুভময়কে। তার মনের গোপন কুঠুরির সব ক’টা বন্ধ দরজা খুলে হঠাৎই। শুভময় ক্রমশ পিছলে যেতে লাগল শ্রাবণীর চুমুতে, তার ঠোঁটের লালায়। নারী-পুরুষের চুম্বনরত এই মূর্তি ঘিরে অকস্মাৎ থমকে গিয়েছে বহমান সময়।

ডঃ শ্রীবাস্তব না আসা পর্যন্ত এছাড়া উপায় নেই শুভময়ের। সব দ্বিধা সরিয়ে রেখে সে প্রাণপণে বিক্রম হয়ে ওঠার চেষ্টা করল।