কথার দাম - চুমকি চট্টোপাধ্যায়

অলংকরণ - প্রতিম দাস

বিগত পঁচিশ বছর ধরে সাহিত্য-সেবা করে চলেছেন গয়েশবাবু। ক্লাস সেভেন এইটে পড়াকালীন স্কুল ম্যাগাজিনে লেখালেখি শুরু। মোটামুটি প্রশংসা পেয়ে পেয়ে ঘোরতর ভাবে লেখার মধ্যে ঢুকে পড়েছেন পরবর্তীকালে। একেবারে বেস্ট সেলার লেখক না হলেও, গয়েশবাবুর বইয়ের কাটতি কিছু কম নয়। বিশেষত মফসসলে। জেলা বইমেলাগুলোতে দিব্বি বিক্রি হয় ওঁর বই।

মেদিনীপুর জেলার কেশপুরে আদি বাড়ি হলেও, রেলের কর্মচারী হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হত গয়েশবাবুকে। এখন রিটায়ার করে আবার কেশপুরেই ফিরে গেছেন অকৃতদার গয়েশচন্দ্র মাইতি। রিটায়ারমেন্টের কোন দুঃখ ওনার নেই বরং স্বস্তিতে লিখতে পারার আনন্দে মশগুল থাকেন। চাকরি থাকাকালীন কিভাবে লিখেছেন ভাবলে এখনও অবাক হন। একবার তো ওনার ভুলে স্টেশনে অ্যানাউন্সমেন্টে গণ্ডগোল হয়ে ভালো রকমই বিপত্তি হয়েছিল।

আসলে মাথায় যখন লেখার প্লট কিলবিল করছে, তখন কী আর কোন ট্রেন কত নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে তা মনে থাকে? সে কী অশান্তি! চাকরি যায় যায় প্রায়। তাতে অবশ্য গয়েশবাবু খুব একট দুশ্চিন্তায় পড়েননি। চাকরি গেলে মাইনেটা পাবেন না, এই তো? সে নাহয় নাই পেলেন।

তেমন কোনো চাহিদাও নেই গয়েশবাবুর কাগজ আর কলম ছাড়া। বাকি জীবনযাত্রা নিতান্তই সাদামাটা। কেবল একটা ব্যাপারেই আতঙ্কে ছিলেন তিনি, চাকরি গেলে মান-সম্মান যাবার আতঙ্ক। সম্মানের সঙ্গে অবসর নিতে পেরেছেন অবশেষে, তাতেই তৃপ্ত গয়েশবাবু।

লেখালেখির ব্যাপারে উদারমনা শুধু নন, কথার দামও যথেষ্ট ভদ্রলোকের। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বড় পত্রিকা, নামী, অনামী—যে কাগজই হোক না কেন, সকলকেই লেখা দেন এবং একই গুরুত্ব দিয়ে লেখেন তিনি। নেহাত কোনো বাধা না এলে, ডেটও ফেল করেন না কখনও।

পিতৃদত্ত নাম নিয়ে বড় হবার পর একটু আধটু অস্বস্তি হত গয়েশবাবুর। নামটার মধ্যে কেমন একটা গয়া গঙ্গা ভাব। যেন অতীত জড়িয়ে আছে নামে। হিন্দি ‘গয়া’ শব্দের অর্থ গেছে। তাই পছন্দ হয় না নামটা। কিন্তু বাবার দেওয়া নাম বদলে ফেলতেও মন চায় না। তাই গয়েশবাবু গয়েশচন্দ্র মাইতি হয়েই রইলেন।

একটা কথা না বললেই নয়, গয়েশবাবু মূলত ছোটদের লেখাই লেখেন এবং তার বেশিরভাগই ভৌতিক এবং অলৌকিক গল্প। বড়দের লেখাও লেখেন তবে তুলনায় কম। ওনার মনে হয়, ওনার নামের সঙ্গে অতীতের সংযোগ থাকার দরুন অতীতে বসবাসকারী লোকজনদের নিয়ে লেখার দিকেই ওনার ঝোঁক।

বাড়িতে একাই থাকেন গয়েশবাবু। দিনের বেলা কাজের মাসি এসে রান্না করে দিয়ে যায়। আর একজন আসে ঘর ঝাড়পোছ আর বাসন মেজে দিতে। দুপুরের পর থেকে গয়েশবাবু একাই থাকেন। কেশপুর আগের থেকে উন্নত হয়ে গ্রাম থেকে মফসসল হলেও সন্ধের পর একটা ঝিমঝিমে ভাব ঘিরে ফেলে চারদিক। প্রচুর গাছপালা থাকায় অশরীরীর চোখের মতো জোনাকিরা জ্বলে নেভে।

গয়েশবাবুর বেশ লাগে এই পরিবেশ। এমনধারা পরিবেশ হলেই তবে না ভূতের গল্প জমে! সে লেখাই হোক কি শোনাই হোক। গয়েশ বাবুর আরো মনে হয়, সন্ধের পর কারা যেন ঘিরে থাকে ওঁকে। একটা কুয়াশার চাদর যেন। মাঝেসাঝে যে দু- এক জন বন্ধু আসেন গয়েশবাবুর সঙ্গে গল্প করতে, তারাও বলেন, ‘তোমার বাড়িটা এত খোলামেলা তাও কেমন যেন স্যাঁতসেতে। উত্তরমুখো বলেই বোধহয় এমন। রোদ পায় না কিনা। কেমন যেন অস্বস্তি হয়। তোমার অসুবিধে হয় না গয়েশ?’ গয়েশবাবুর কিন্তু অন্যরকম ধারণা।

গয়েশবাবুর ধারণা, তেনারা থাকেন এখানে ওঁকে ঘিরে। ওই কুয়াশার চাদর ওঁর অনুপ্রেরণার উৎস। এই যে দিনরাত হরেক কিসিমের ভৌতিক গল্প লিখে চলেছেন, তাতে এদের অবদান আছে বৈকি! এই যে সেদিন তিনি ফ্যান বন্ধ করে স্নানে গেলেন আর ঘরে ফিরে দেখলেন ফ্যানটা চলছে, কারণটা না বুঝলেও, কার্যটি কার বা কাদের, তা বিলক্ষণ বুঝলেন। আর তাই তো লিখে ফেললেন জনপ্রিয় হওয়া গল্প ‘অদৃশ্য হাত’।

কাল রাতে যে স্বপ্নটা দেখলেন, তিনি কারো একটা সাইকেলের পেছনে বসে কেফার মাঠের দিকে যাচ্ছেন কিন্তু সাইকেল যে চালাচ্ছে তাকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, সেই বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান গল্পটা লিখছেন। কলকাতার বেশ চালু একটা পত্রিকা লেখা চেয়েছে। সেটা একটা শ্লাঘার বিষয় তো বটেই তাছাড়া লেখাটা জমে গেছে। বেজায় ভালো লাগছে লিখতে। এ ধরনের নানা সূত্র হামেশাই তেনারা সাপ্লাই করে গয়েশবাবুকে। একদিন রাতে যেমন স্পষ্ট শুনলেন কানের পাশেই কেউ হাঁচল, কিন্তু কাউকেই দেখা গেলো না। সেটাও পরবর্তী গল্পের প্লট।

একটাই ব্যাপার, কাল বিকেলে লেখাটা নিতে ওদের দপ্তরের কেউ একজন আসবে। অতএব, লেখাটা কাল দুপুরের মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে। কথা যখন দিয়েছেন তা রাখতেই হবে। কথার দাম জীবনের থেকেও বেশি ওঁর কাছে। গয়েশবাবুর কলম রকেটের গতিতে চলছে। কোনো মানুষের পক্ষে কী এই স্পিড সম্ভব!

গয়েশবাবুর শরীরটা মাসখানেক ধরে বিশেষ ভালো যাচ্ছেনা। বুকে সর্দি জমে শ্বাস নিতে কষ্টই হচ্ছে বলা যায়। নেহাত উনি অসুখ-বিসুখকে পাত্তা দেন না তাই বন্ধু হরিহর সাঁতরা বলে যাওয়া সত্ত্বেও ডাক্তার দেখাতে যাননি। ডাক্তার দেখানো মানেই সময় নষ্ট, সঙ্গে রকমারি ওষুধ খাবার ঝামেলা। অত সময় নষ্ট করলে লেখাটা তো শেষ হবে না। অতএব, লিখে চললেন তিনি।

পরদিন চারটে নাগাদ পত্রিকা দপ্তরের ছেলেটি এল গয়েশবাবুর বাড়ি। দু-তিনবার নাম ধরে ডাকাডাকি করে সদর দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে, ‘মিঃ মাইতি আছেন নাকি?’ বলে হাঁক দিল। কোন সাড়া নেই দেখে সামনের ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি মারতেই অদ্ভুত এক দৃশ্য চোখে পড়ল তার। একদলা কুয়াশা যেন থমকে রয়েছে টেবিলের ওদিকে আর একটা ফাউন্টেন পেন ঝড়ের মতো কাগজের ওপর এদিক ওদিক করছে।

ভয়ে অসাড় হয়ে ছেলেটা চেঁচাতেও ভুলে গেছে তখন। হঠাৎই একটা কুকুরের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে পেছন ফিরে শরীরের সমস্ত শক্তি পায়ে জড়ো করে দৌড় লাগায় সে। বেশ খানিকক্ষণ দৌড়ে কুঁজো হয়ে হাঁফাতে থাকে ছেলেটা। মুখ নীচু অবস্থাতেই বুঝতে পারে কুয়াশার মতো কিছু ঘিরে ধরেছে তাকে। অজ্ঞান হবার আগে যেটুকু নজরে আসে তা হল, ওর সামনে পড়ে আছে একটা পাণ্ডুলিপি, ওপরে বড় বড় করে লেখা, ‘মরে গেলেও দেওয়া কথার খেলাপ করি না।’