হিটলারের চিঠি - অভিষেক মিত্র

অলংকরণ - স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

আজ অফিস পৌঁছতে একটু দেরীই হয়ে গেল। একে তো ট্রেন পায় আধ ঘণ্টা লেট তার উপরে রাজাবাজার ক্রসিঙের সামনে বিশাল জ্যাম। কন্ডাক্টারকে জিজ্ঞেস করতে বলল, “পরীক্ষায় পাশ করেনি বলে স্টুডেন্টরা অবরোধ করেছিল। এখন পুলিশ এসে ওঠাচ্ছে।” সেই জ্যাম ছাড়তে ছাড়তে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট। কোনক্রমে বাস থেকে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে অফিসে ঢুকলাম। আমি অবিনাশ দত্ত, চাকরি করি ‘বার্তা কোলকাতা’ নামক একটা পত্রিকার অফিসে। এম.এসসি করে বসেছিলাম, আমার এক মামা কাকে ধরে চাকরিটা করিয়ে দিয়েছে। মাইনে পত্র যে খুব একটা ভালো তা নয়, তবে আমি একা মানুষ, আমার দিব্য চলে যায়।

অফিসে ঢুকে নিজের চেয়ারটায় বসে ঢক ঢক করে দু গ্লাস জল খেয়ে ফেললাম। তারপর আমাদের পিওন রাধানাথকে বললাম, “একটু চা নিয়ে আয় না ভাই।” সকালের ট্রেন ধরতে হয় বলে চা-টা সোজা শিয়ালদাহ ষ্টেশনে এসে খাই, কিন্তু আজ তাড়াহুড়োয় সেটা খাওয়া হয়নি। আমার পাশের চেয়ারে বলে স্বজলবাবুকে একটা ছেড়া ডাইরি পড়তে দেখে বুঝলাম আজ সম্পাদক মহাশয় আসেননি, তাই সবার মধ্যেই একটা ঢিলেঢালা ভাব। একটু জিরিয়ে নিয়ে বললাম, “এত মন দিয়ে কী পড়ছেন?”

ভদ্রলোক ডাইরিটা দুম করে টেবিলের উপর ফেলে বললেন, “আর বলবেন না মশাই, পাগলের প্রলাপ।”

“মানে?”

“মানে আমার মাথা আর আপনার মুণ্ডু। আরে আজ সকালে আমাদের অফিসে এটি কুরিয়ারে এসেছে। তাই ভাবলাম হয়তো কোন গোপন খবর থাকবে, তাই একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছিলাম আর কী। কিন্তু এ তো মনে হয় কেউ মশকরা করেছে।”

“কই দিন তো দেখি।” বলে স্বজলবাবুর টেবিল থেকে ডাইরিটা হাতে নিলাম।

স্বজলবাবু বলে চললেন, “আরে কী সব যাতা লেখা আছে দেখুন না। হিটলার, বেল না ঘণ্টা কী একটা আর লাল মার্কারি। আচ্ছা বলুন তো পারদ আবার লাল হয় না-কি? আমি তো জানতাম পারদ ওই থার্মোমিটারে যেটা থাকে, সে তো রুপালী মত হয়। না-কি?”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। বললাম, “পড়ে দেখি একবার।”

আমার কোথা শুনে স্বজলবাবু মুচকি হেসে বললেন, “দেখো, দেখো। তুমি তো আবার লেখক। দেখো পড়ে যদি নতুন গল্পের প্লট পাও তো ঝেপে দিও।” এই বলে সশব্দে হো হো করে হেসে উঠলেন।

গল্পের প্লটের অভাব আমার নেই তবে স্বজলবাবুর একটা কথা আমার মনে খটকা লাগিয়েছে। সেটা হল রেড মার্কারি।

ডাইরিটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলাম। উপরে সবুজ রঙের মলাটটা প্রায় ধূসর হয়ে গেছে। ভিতরের পাতাগুলোও হলদেটে। কিছু পাতার কোণাগুলো পোকায় কেটেছে। ডাইরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় মুক্তোর মত হাতের লেখার লেখা ডাঃ কালিকিঙ্কর মল্লিক, পিএচডি।

ডাঃ কালিকিঙ্কর মল্লিক... নামটা যেন কোথায় শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন মনে করতে পারলাম না, তখন হাল ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম কাজ তো সেরকম কিছু নেই, এটাই বসে বসে পড়ি একটু।

আমি তো ডাইরিটা পড়ে একদম থ। এও আবার হতে পারে নাকি! ডাইরিটায় যেরকম পড়েছিলাম, তা হুবহু তুলে দিচ্ছি।

২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৩

সকালে উঠে এক কাপ চা খেয়ে একটু শহরের দিকটায় ঘুরে আসা আমার গত পঁচিশ বছরের অভ্যেস। এখন আমার এক সঙ্গীও জুটেছে। আমার পড়শি সুকুমার লাহা। তবে শুধু মর্নিং ওয়াকের সঙ্গি বললে ভুল হবে, তবে গত দশ বছরে আমি আর সুকুমারবাবু অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠেছি। উনিও আমার মত একাই থাকেন এই বাটানগর নামক ছোট্ট মফঃস্বলে। শুধু ফারাক হল আমি অবিবাহিত আর উনি বিপত্নীক। ওনার মুখেই শুনেছি যে ইংরেজ আমলে ওনার বাপ ঠাকুরদা এন্টিক জিনিষের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা কামিয়েছিলেন। ওনাদের এন্টিক শপ নাকি আজ থেকে দশ বছর আগেও ছিল। উনিও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন বছর বিশেক। তারপর অবসর নিয়ে এখানে এসে উঠেছেন। উনি থাকায় আমার একদিক দিয়ে যেমন ভালো হয়েছে তেমন একটু খারাপও হয়েছে। ভালো হয়েছে কারণ এই এলাকায় আমার বন্ধু বিশেষ কেউ নেই। আর যেহেতু আমার বাড়িটা বাটানগরের প্রায় শেষ প্রান্তে তাই এখানে খুব দরকার ছাড়া কেউ আসে না। সুকুমারবাবুর বাড়িটা ঠিক আমার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। এই এলাকায় এই দুটি মাত্র বাড়ি আছে। তাই উনি থাকায় আমার একজন কোথা বলার লোক হয়েছে। কারণ আমার চাকর ভীম মূক। যদিও এখন আমার আবিষ্কৃত ভাইব্রেটোমিটারের দৌলতে একটু একটু কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু জিনিষটার ভাইব্রেশিনটা যদি আর হাজার পাঁচেক হার্জ বাড়ানো যেত, তাহলে হয়তো ব্যাটা আর মাস দুয়েকের মধ্যেই ও গড়গড় করে আবৃত্তি করতে পারত।

হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। এই সুকুমারবাবু আসার খারাপ দিকটা হল উনি আমার কাজে খুব নাক গলান। উনি যে বোঝেন না তা নয়, তবে একজন বাংলার প্রফেসার হয়ে আমাকে যখন ফুরফুরাল এলকোহলের রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান দেন, তখন মাঝে মাঝে ব্যাপারটা অসহ্য হয়ে ওঠে।

আজ সকালে আমাকে বেরতে দেখে সুকুমারবাবু প্রায় দৌড়ে এসে বললেন, “গুড মর্নিং, স্যার। একী আজ দাড়ি কাটেননি দেখছি। এ দৃশ্য তো সচরাচর দেখা যায় না। ব্যাপারটা কী মশাই?”

ভেবেছিলাম ওনাকে ব্যাপারটা বলব না, কারণ বললেই দশটা আলতু ফালতু সাজেশন দেবেন। তবে যখন দেখেই ফেলেছেন তখন আর কী করা যায়। বললাম, “আসলে আমি কৃত্রিম উপায়ে কেশ গজানোর চেষ্টা করছি।”

উনি বেশ অবাক হয়ে বললেন, “কেন মশাই, এত সুন্দর একখানা তো ফ্রেঞ্চ কাট আছে।” তারপর এক মুহূর্ত আমার দিকে চেয়ে বললেন, “ও টাকে চুল গজাবেন বলে?”

সুকুমারবাবুর এই মন্তব্যগুলো একদম পছন্দ হয় না আমার। আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, “বিদেশে এলরেডি আবিষ্কার হয়ে গেছে, তবে সেখানে ছুঁচ ফুটিয়ে ফুটিয়ে হেয়ার ফলিকেলগুলোকে বের করে আনে, তারপর সেখান থেকে জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ারাড় চুল বসিয়ে দেয়। কিন্তু আমি যেটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি, সেটা একটা ক্রিম। লাগালেই ন্যাচারাল চুলের মত খুব সূক্ষ্ম ফাইবার বেরিয়ে আসবে।”

সুকুমারবাবু কী বুঝলেন জানি না, তবে মাথা নেড়ে বললেন, “আচ্ছা। তা আপনার এই ফলস চুল কি টানলে উঠে যাবে?”

কথা শুনেই আমার একটু কেমন যেন ঠেকল। ভদ্রলোক কি আবার আমার দাড়ি ধরে টান ফান মারবেন নাকি? বললাম, “কেন বলুন তো?”

“না, মানে ওই আগের দিন টিভিতে দেখাচ্ছিল কোন এক সাধু নাকি দাড়ি দিয়ে গাড়ি টানছেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কী।”

কথাটা একদম অপ্রাসঙ্গিক বলে এড়িয়ে গেলাম। তারপর সুকুমারবাবু বললেন, “আজ বাড়ি ফেরার পথে একবার আমার বাড়িতে চলুন। একটা দারুণ জিনিষ দেখাবো।”

কী জিনিষ সেটা জিজ্ঞেস করে কোন ফল হবে না জানি। এই ভদ্রলোকের আর একটা ব্যারাম, সব কিছুর মধ্যেই একটা রহস্যময়তা রাখেন।

বাড়ি ফেরার পথে যখন ভদ্রলোকের ঘরে ঢুকলাম, তখন ওনার চাকর দেখি চা নিয়ে রেডি। আমি সোফায় বসে বললাম, “এবার দেখান।”

সুকুমারবাবু সামনের টেবিলের তলা থেকে একটা পুরনো ছেঁড়া চিঠি বের করে আমার হাতে দিল। বললেন, “দেখুন, স্বয়ং অ্যাডলফ হিটলারের লেখা চিঠি।”

আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে বললাম, “এ জিনিষ কোথায় পেলেন?”

সুকুমারবাবু হেসে বললেন, “আসলে আমাদের এন্টিক দোকানটা উঠে যাওয়ার পর সেখানের জিনিসগুলো এই বাড়িতে দুটো ঘরে বোঝাই করে রেখেছি। আজ একটা পুরনো ট্রাঙ্ক ঘাটতে ঘাটতে এটা পেলাম।”

আমি জার্মান ভাষাটা বার্লিনে পোস্ট ডক করার সময়ই শিখে নিয়েছিলাম, চিঠিটা তাই পড়তে অসুবিধে হল না। চিঠিটা ডাঃ রথেনস্টাইন নামক একজনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু চিঠিতে তেমন কিছু লেখা নেই। যে দু লাইন লেখা আছে তাও খুব সাধারণ আর মানেটাও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। চিঠিটা বাংলায় অনুবাদ করে নীচে তুলে দিলাম।

“হে ডাঃ রথেনস্টাইন,

আলো প্রায় নিভু নিভু। ঘণ্টা-টা নিয়ে এসো। LH - ৩৪২২১১৮৩২

এ. হিটলার

১৯/০২/১৯৪৪”

চিঠিটা সুকুমারবাবুকে পড়ে শোনাতে উনি বললেন, “বলেন কী মশাই, শুনেছিলাম তো হিটলার মৃত্যুর পূর্বে নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু এ তো দেখছি, না। গণ্ডগোলটা অনেক আগে থেকেই। না হলে আলো নেই বলে কেউ কি ঘণ্টা আনতে বলে? পুরোপুরি পাগলই ছিল মনে হয়।”

আমি উঠতে উঠতে বললাম, “হিটলার যা যা করেছে, পাগল না হলে কেউ কি করতে পারে ?”

২৯ ডিসেম্বর ১৯৯৩

আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সাধারণ লোকে এটাকে কাকতালীয় বা কোয়েন্সিডেন্স বলে উড়িয়ে দিত। আমি পারলাম না। কারণ আমি গবেষণা করে দেখেছি যে কোয়েন্সিডেন্স বলে কিছু হয় না। এই পিছনেই কাজ করে একটা সূক্ষ্ম ফর্মুলা। গত বছর উগান্ডার বিখ্যাত ম্যাথামেটিসিয়ান ডাঃ উদুম্বে টাচালা আর আমি মিলে আবিষ্কার করেছিলাম সেই থিওরি। ফর্মুলাটাও বেশ জটিল। একশো সাত্তারটা ভ্যারিয়েবেল আছে। নাম দিয়েছিলাম টাচালা-মল্লিক থিওরি অফ কোয়েন্সিডেন্স। অ্যামেরিকার বিখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত হয়েছিল পেপারটা।

যাই হোক, আজ সকালে প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরে দেখি আমার বৈঠকখানার সোফায় এক সাহেব বসে আছেন। একটু অবাক হলাম, কারণ বিনা এপয়েন্টমেন্টে আমার সাথে সেরকম কেউ দেখা করতে আসে না। আমাকে ঢুকতে দেখে সাহেবটি উঠে দাঁড়িয়ে তার ডান হাতটি প্রসারিত করে বলল, “গুড মর্নিং, ডাঃ ম্যালিক। আমার নাম হ্যারি ওসবর্ণ।”

ভদ্রলোক বেশ লম্বা, ছ ফুটের একটু বেশিই হবে। মাথা ভর্তি সোনালি চুল প্রায় কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। গালে দুদিনের না কাটা দাড়ি। সেটা যদিও স্টাইলও হতে পারে। পরনে কালো জিন্স আর সাদা টিশার্ট।

করমর্দন করে আমি ওনাকে বসতে বললাম। তারপর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওসবর্ণ বলল, “আপনি হয়তো আমার বসের ইনভিটেশন লেটারটা পাননি। আপনাকে ফোনেও ধরার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ। তাই স্বশরীরে আসতে হল আমাকে।”

ভদ্রলোকের ইংরেজি স্পষ্ট হলেও সেখানে একটু টান আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার নামটার সাথে আপনার কথার এক্সেন্ট ঠিক মিলছে না তো !”

হ্যারি ওসবর্ণ প্রায় হো হো করে হেসে বললেন, “আসলে আমি অ্যামেরিকার লোক। কিন্তু সেই দশ বছর বয়স থেকে জার্মানের মিউনিখ শহরে আছি। তাই কথায় একটা জার্মান টান আছে।”

চা না কফি জিজ্ঞেস করতে বলল, “নো স্যার, আই হ্যাভ এ ফ্লাইট টু ক্যাচ। আমি শুধু আপনাকে এই ইনভিটেশনটা দিতে এসেছি।” এই বলে পকেট থেকে একটা প্রায় বারো ইঞ্চি লম্বা খাম বের করে আমার হাতে দিল।

খামের ভিতর একটা আমন্ত্রণ পত্র আর দুটো ফ্লাইটের টিকিট। যিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর নাম এডালার্ড কিমলার। চিঠির বিষয় বস্তু হল কোন এক বিশেষ কাজের জন্য ওনার আমার সাহায্যের প্রয়োজন। তাই আমি যদি হপ্তা দুয়েকের মত ওনার আতিথেয়তা গ্রহণ করি তাহলে উনি খুব খুশি হবেন। উনি এও লিখেছেন যে সাথে প্লেনের দুটো টিকিট পাঠিয়েছেন, আমার আর আমার সহকারির জন্য। কবে আসবেন সেটা ঠিক করে যেন হ্যারিকে ফোন করে জানিয়ে দিই, সেই হিসেবে উনি বাকি ব্যবস্থা করবেন।

হ্যারি ওসবর্ণ যাওয়ার আগে ওর কার্ড আমাকে দিয়ে গেছে। বলেছে এই কার্ডেই ফোন নং আছে। আমিও ওর থেকে ভাববার জন্য দুদিন সময় চেয়ে নিয়েছি।

ব্যাপারটা কাকতালীয় বললাম কারণ এই কয়েকদিন আগেই হিটলারের লেখা চিঠি পড়লাম আর আজ নাকি হিটলারের দেশ থেকেই আমন্ত্রণ!

৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৩

গতকাল হ্যারি ওসবর্ণের কথাটা সুকুমারবাবুকে বলতে উনি তো হা। বললেন, “এরকম কোয়েন্সিডেন্সও হয়!”

আমি ওনাকে ছোট্ট করে বুঝিয়ে দিলাম টিচালা-মল্লিক থিওরিটা। উনি কী বুঝলেন জানি না তবে গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “আচ্ছা।”

তারপর হঠাৎ বললেন, “তা সহকারি হিসেবে আমি ঝুলে পড়ি ? আপনার সাথে হিটলারের দেশটাও দেখে আসব।”

ওনাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার একদম ছিল না, তাই বললাম, “যেতে পারেন, তবে বোর হবেন কিন্তু খুব। আমি বিভিন্ন পত্রিকা ঘেঁটে যা দেখেছি ওই এডালার্ড কিমলার হল জার্মানের বিখ্যাত সংস্থা কিমলার ইন্ডাস্ট্রি-র মালিক। নিশ্চই কোন রিসার্চের ব্যাপারে ডেকেছেন।”

“নামটা কোথায় যেন শুনেছি মনে হচ্ছে।” তারপর একটু ভেবে সুকুমারবাবু বললেন, “জাহাজ টাহাজ বানায় না?”

সুকুমারবাবুর এই আর একটা দোষ, জানেন না তবুও জানার ভান করে যা-তা একটা কিছু বলে দেন। আমি একটু বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, “আপনি কিলমার আর কিমলার গুলিয়ে ফেলেছেন। কিলমার জাহাজ বানায় না, বাড়ি বানায়। রিয়েল এস্টেট। আর যিনি আমন্ত্রণ করেছেন তিনি হলেন কিমলার। অস্ত্র বানায়। আর্মস।”

“বন্দুক?” চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলেন সুকুমারবাবু।

“হ্যাঁ, তবে শুধু বন্দুক কেন, কামান, গুলি ইত্যাদিও বানায়।”

“তাহলে তো আর কথা নেই মশাই। এই ঝুলে পড়লুম। বন্দুকের কারখানা দেখার লোভ আমি সামলাতে পারব না, মশাই। আপনি বলে দিন যে আপনি আর আপনার সেক্রেটরি সুকুমার লাহা যাচ্ছেন জার্মানি।”

অগত্যা তাই করলাম। শহরে গিয়ে একটা আইএসডি বুথ থেকে হ্যারি ওসবর্ণকে জানিয়ে দিলাম যে আমরা দুজন যাচ্ছি আর আমরা রওনা দেব ৩ জানুয়ারি।

৪ জানুয়ারি ১৯৯৪

গত কদিন লেখার মত কোন ঘটনা ঘটেনি। তবু বলে রাখি, গত পরশু আমার ক্রিম তৈরি হয়ে গেছে। আর সুকুমারবাবুর কথা মাথায় রেখেই আমার তৈরি কার্বো-টাইটানিয়াম-আরকিওলাইটিক এসিডের সাথে ফাইব্রাস মার্কিউরিক পলিমার মিশিয়ে একটা প্রচণ্ড শক্ত কিন্তু চুলের মত সরু ফাইবার তৈরি করেছি। ক্রিমের মধ্যের সেই একই ফর্মুলা দিয়েছি। তাই ক্রিম লাগানোর ফলে যে চুলের মত জিনিষগুলো বেরোচ্ছে সেগুলো খুবই হালকা আর প্রচণ্ড শক্তিশালী। আর আশ্চর্য জিনিষ হল, এই চুলগুলো বেরনোর জন্য কোনও ত্বকের প্রয়োজন হচ্ছে না। গতকাল হাত ফসকে টেবিলের উপর এক ফোটা পড়ে গিয়েছিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যের দেখি সেই জায়গায় এক গোছা লম্বা চুল গজিয়ে গেছে।

সেই ক্রিমের একটা কৌটো সঙ্গে নিয়েছি কিমলার সাহেবকে দেখাবো বলে।

গত তিনদিন সুকুমারবাবু প্রায় পঞ্চাশবার আমার বাড়িতে এসেছেন। কী নিয়ে যাবেন, ঠাণ্ডা কেমন হবে, ওনার সুটটা ছোট হয়ে গেছে, আর একটা বানাবেন কি না? এইসব প্রশ্ন নিয়ে।

আমি বললাম, “অত চিন্তা করছেন কেন? বাড়ির বাইরে তো আর সেরকম বেরতে হবে না। রিসার্চ করতে হলে সে তো ল্যাবে বসেই করতে হবে।”

কথাটা শুনে ভদ্রলোক একটু মুষড়ে পড়েছিলেন। কিন্তু গতকাল এয়ারপোর্টে আসার পর থেকে দেখছি ওনার উৎসাহ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

আমাদের ফ্লাইট ছিল দমদম বিমানবন্দর থেকে রাত সাড়ে বারোটায়। মিউনিখ পৌঁছতে লাগল প্রায় চোদ্দ ঘণ্টা। মালপত্র নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বেরনোর মুখে দেখি আমার নাম লেখা একটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হ্যারি ওসবর্ণ। আমাদের দেখতে পেয়ে হাসি মুখে এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক।

রাস্তায় বেরিয়ে দেখি একটা পেল্লায় মার্সিডিজ গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন মিঃ ওসবর্ণ। আমরাও ওর পিছন পেছন উঠে পড়লাম। গাড়ি ছুটতে লাগল হাওয়ার গতিতে।

আমি আগেও একবার মিউনিখে এসেছিলাম। ১৯৮৭ সালে একটা বৈজ্ঞানিক সন্মেলনে। তাই শহরটা ঘুরে দেখে নিয়েছিলাম সেইবার। প্লেনে আমার এমনিই ঘুম হয় না। তাই শরীরটা সিটে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। লক্ষ করলাম সুকুমারবাবু হা করে তাকিয়ে আছেন জানলার বাইরে।

ঘুম ভাঙল সুকুমারবাবুর ডাকে, “ও মশাই, এসে গেছি মনে হচ্ছে, উঠুন।”

দেখি আমাদের গাড়িটা একটা উঁচু বিল্ডিঙের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে সোনালি ফলকে ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘হোটেল বেয়ার-আইশার হফ।’ গাড়ি থেকে নেমে হ্যারির পিছন পিছন হোটেলে ঢুকলাম। তারপর লিফটে চেপে উঠে গেলাম সপ্তম তলায়। পাশাপাশি দুটো ঘর আমাদের দেখিয়ে বলল, “আপনারা আজকে বিশ্রাম করুন। আমি কাল সকালে ঠিক আটটার সময় আসব। স্যার, তখনই দেখা করবেন।”

হ্যারি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সুকুমারবাবু আমার ঘরে এসে বললেন, “একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলেন?”

আমি সুটকেস থেকে আমার মোটা জ্যাকেটটা বের করতে করতে বললাম, “কী ?”

“কী আবার! আপনি তো গাড়িতে উঠেই টেনে ঘুম মেরে দিলেন। আপনি আর বুঝবেন কী করে? সেই এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের একটা কালো গাড়ি ফলো করছিল।”

“তাই নাকি? তারপর?” আমার বেশ মজাই লাগছিল। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমাদের চেনে কে যে ফলো করবে?

উনি আমার কথার শ্লেষটা ধরতে না পেরে বললেন, “আচ্ছা, বিশ্বাস হচ্ছে না তো। একবার উঁকি মেরে দেখুন জানলা দিয়ে।”

এই বলে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে গেলেন উত্তর দিকের জানলাটার কাছে। তারপর পর্দাটা সামান্য সরিয়ে বললেন, “ওই দেখুন।”

দেখলাম হোটেলের এন্ট্রান্সের সামনে একটা কালো ভ্যান টাইপের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনের সিটে একটা লোক বসে চোখে দুরবিন লাগিয়ে আমাদের এই দিকটায় তাকিয়ে আছে। আমি পকেট থেকে আমার স্পেয়ার চশমাটা বের করে চোখে লাগালাম। এই চশমাটাও আমার তৈরি, মানে চশমার কাঁচটা। চশমার ডাঁটিটা পাশে একটা ছোট্ট বোতাম আছে, আর সেটা টিপলে কাঁচগুলোর মধ্যে একটা রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে আর তারপর ওগুলো দূরবীনের কাজ করে।

ভালো করে লক্ষ করে বুঝলাম যে লোকটার সিটের পাশে কাত করে রাখা আছে একটা কালাশনিকভ বন্দুক। আর লোকটার মুখটাও আমার চেনা। এই ভদ্রলোক প্লেনে আমাদের পিছনের সিটে বসেছিলেন।

৫ জানুয়ারি ১৯৯৪

আজ সকালে ঠিক আটটার সময় হ্যারি এসে আমাদের নিয়ে গেল তার ‘স্যার,’ এডালার্ড কিমলারের কাছে। তেরো তলার অফিসটা যেমন সুন্দর তেমন সাজানো গোছানো। আমরা সামনের হ্যারির সাথে সোজা গিয়ে পৌঁছলাম এডালার্ড কিমলারের চ্যেম্বারে।

ভদ্রলোক আমাদের ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আর ওমনি আমার পাশে থাকা সুকুমারবাবুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “দৈত্য!” ভদ্রলোককে যদিও দেখতে একটুও দৈত্যর মত নয়, কথা বলেছেন এডালার্ড কিমলারের উচ্চতা দেখে। আমার ধারণা ওনার হাইট সাত ফুট তো হবেই। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, পেটাই চেহারা। দেখেই মনে হয় বেশ কসরত করেন। এক গাল লালচে দাড়ি আর মাথায় চুলের লেশমাত্র নেই। বয়স আন্দাজ চল্লিশ।

আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কিমলার বললেন, “টি ইয়া হুইস্কি?”

বললাম, “হুইস্কি আমাদের দুজনেরই চলে না, আপনি বরং চা-ই বলুন।”

উনি হ্যারির দিকে ইশারা করতে হ্যারি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

তারপর “প্লিজ এক্সকিউজ মে ফর এ মোমেন্ট” বলে এডালার্ড কিমলার-ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

এই ফাঁকে সুকুমারবাবু আমার জ্যাকেটের আস্তিনটায় একটা টান মেরে বললেন, “আপনার চুল গজানোর ক্রিমটার কথা জানলো কী করে বলুন তো? আপনি আর কাউকে বলেছিলেন ব্যাপারটা?”

বললাম, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন সুকুমারবাবু, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার চুল গজানোর ক্রিমের জন্য উনি আমাদের ডাকেননি। আর একটা কথা, ওই ক্রিমটার একাটা নাম আছে, কেরাটিনো পেপেরিথ।”

“পেঁপে?” চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করলেন সুকুমারবাবু।

আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় এডালার্ড কিমলার ঢুকে আমাদের সামনে এসে বসলেন। তারপর ড্রয়ার থেকে খুব যত্ন করে একটা পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ বের করে আমাদের সামনে এগিয়ে দিলেন।

কাগজটা দেখে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। সুকুমারবাবুর অবস্থা আরও খারাপ। কারণ আমাদের সামনে যে কাগজটা আছে সেটা একটা চিঠি আর হুবহু সেই একই চিঠি আমি দেখেছিলাম সুকুমারবাবুর বাড়িতে। লেখকের নাম এ. হিটলার।

মুহূর্তে নিজেকে সামলে আমি চিঠিটার উপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে মিঃ কিমলারের দিকে তাকালাম। কিমলার বললেন, “আগে আমার ঠিক করে একটা পরিচয় না দিলে আপনি পুরো ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারবেন না। আমার ঠাকুরদার নাম ছিল হান্স কিমলার।”

আমি ওনাকে থামিয়ে বললাম, “থার্ড রেশের হান্স কিমলার?”

“হ্যাঁ, এই চিঠিটা ওনার পুরনো জিনিষ ঘাটতে ঘাটতে পেয়েছি।” তারপর পকেট থেকে একটা সিগার বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি প্রত্যাখ্যান করতে উনি নিজে একটা ধরিয়ে আবার বললেন, “আপনাকে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিষ বলি। ১৯৪৪ সালে হিটলারের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর হার প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু হিটলার হার মানলেন না। সেই সময় আমাদের দেশের বিজ্ঞান অনেক উন্নতি করেছিল। আর ওনার কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন ক্যান্সারের ওষুধ। তবে উনি যে হিটলার! সেই সব বৈজ্ঞানিক আর বাঁচেননি। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে পড়তে হয়েছিল। তবে ওষুধের ফর্মুলাটা বেঁচে গিয়েছিল। আর সেটা লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং হিটলার। কিন্তু যখন নিজেরই ক্যান্সার ধরা পড়ল, তখন উনি ওনার এক বিশ্বাসী অনুচরকে বললেন সেই ফর্মুলা নিয়ে আসতে। এই চিঠিতে সেটাই বলা আছে।”

আমি বললাম, “ব্যাপারটা খুব অবিশ্বাস্য। একজন ক্যান্সার থেকে বেঁচে গিয়েও আত্মহত্যা করবেন সেটা হজম করা একটু কঠিন।”

মিঃ কিমলার বললেন, “আসলে ফর্মুলাটা উনি পাননি। শেষ জীবনে শারীরিক আর মানসিক কষ্ট সহ্য না করতে পেরেই আত্মহত্যা।”

“হু, তবে আমাকে কেন ডেকেছেন সেটা যদি বলতেন...”

মিঃ কিমলার একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “আমার একমাত্র মেয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ব্ল্যাড ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। ডাক্তার বলেছেন খুব বেশি হলে আর মাস দুয়েক। আমার এই ফর্মুলাটা চাই ডাঃ ম্যালিক। আমার এই ফর্মুলাটা চাই।” এই বলে ভদ্রলোক দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললেন।

আমি বললাম, “আই এম সরি মিঃ কিমলার, কিন্তু আমার পক্ষেও এই ওষুধ আবিষ্কার করা কঠিন। তাছাড়া আমি রাসায়নিক। এই কাজের জন্য আপনি কোন বায়ো-কেমিস্ট...”

আমার কথা শেষ করতে দিলেন না মিঃ কিমলার, বললেন, “এখন সেই সময় নেই ডাঃ ম্যালিক। আমাদের সেই ফর্মুলাটা খুঁজে বের করতে হবে।”

আমি তো অবাক। মনে মনে বললাম, ‘এ লোক পাগল নাকি?’ নাৎজি অধিকৃত জার্মানি সম্পর্কে অনেক গাল-গল্প ছড়িয়ে আছে দুনিয়ায়। যেমন সুপার সোলজার, এটোম বোমা ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলো গল্পই। উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।

বললাম, “আপনি একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন মিঃ কিমলার, আপনি যেটা বলছেন সেটা অসম্ভব।”

“অসম্ভব নয় ডাঃ ম্যালিক। আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন না?”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। এক অসহায় পিতায় আর্তি অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। বললাম, “কিন্তু কোথায় পাব সেই ফর্মুলা?”

মিঃ কিমলার বললেন, “আমি বাবার কাছে যেটুকে শুনেছি, ডাঃ রথেনস্টাইন এই চিঠি পাননি। চিঠিটা হিটলারের মৃত্যুর অনেক পরে আমার দাদুর কাছে আসে। আর যা আছে সে এই চিঠিতেই।”

আমি এডালার্ড কিমলারের থেকে একদিন সময় চেয়ে নিলাম। বললাম যে একটু ভাবতে দিন, কালকে এই সময় আপনাকে জানাবো।

হোটেলে নিজের ঘরে ফিরে একটা কাগজে চিঠিটার বিষয়বস্তু লিখে ফেললাম। এখানে বলে রাখি আমার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর। যে কোন কিছু একবার দেখলে সেটা মোটামুটি মনে থেকে যায়। ওই যাকে বলে ফটোগ্রাফিক ম্যেমারি।

সুকুমারবাবু কিন্তু চিঠিটা দেখে একদম দমে গেছেন। ফেরার পথে শুধু বললেন, “আমারটা তাহলে নকল?”

৬ জানুয়ারি ১৯৯৪

কাল সারারাত প্রায় ঘুম হয়নি। বেশির ভাগটাই কাটিয়েছি ঘরের মধ্যে পায়চারি করে। আর মাঝে মাঝে জানলার ধারে গিয়ে দেখেছি সেই সকালের কালো গাড়ি আর তার সামনের সাইট বসা লোকটাকে। আজ সকালে একবার হোটেলের রিসেপশনে গিয়েছিলাম একটা ফোন করার জন্যে। আমার পুরনো বন্ধু ও বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ডাঃ এড্রিয়ান গোতজেকে। কিন্তু বার পাঁচেক চেষ্টা করার পর বিফল মনোরথে ফিরে আসি।

প্রায় সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ হ্যারি এল। আমি আর সুকুমারবাবু রেডি হয়েই ছিলাম। তাই আবার রওনা দিলাম এডালার্ড কিমলারের অফিসের উদ্দেশে। আমার যা ভাবার ভাবা হয়ে গেছে।

আমি রাজি এটা শুনে ভদ্রলোক আমার সাথে আর একবার করমর্দন করে বললেন, “আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব ডাঃ ম্যালিক সেটা বুঝতে পারছি না। আমি তো ভেবেছিলাম আমার কথা শুনে আপনি হয়তো বললেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

বললাম, “দেখুন মিঃ কিমলার, আমি রাজি হয়েছি সেটা ঠিক, কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। আপনি যদি সেটা মেনে নেন, তাহলে আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শুরু করতে পারি।”

“কী ডাঃ ম্যালিক?”

“আমরা যদি ফর্মুলাটা পাই, তাহলে আপনি সেটা ব্যবহার করুন। কিন্তু তারপর আপনাকে সেটা তুলে দিতে হবে ইউনেসকোর হাতে। এই ওষুধে যদি সত্যিই ক্যান্সার সারে, তাহলে সেটা নিয়ে ব্যবসা আপনি করতে পারবেন না।”

ভদ্রলোক এইবার একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “আই সি, কিন্তু ডাঃ ম্যালিক, আমি যদি আপনাকেও টেন পারসেন্ট দিই, তাহলে?”

“টাকার প্রতি আমার খুব একটা লোভ নেই মিঃ কিমলার,” বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললাম।

মিঃ কিমলার মিনিট দুয়েক চুপ করে থেকে বললেন, “ওকে ডাঃ ম্যালিক। আমি রাজি।”

“ঠিক আছে, কিন্তু তার আগে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।”

“ইয়েস?”

“এই ওয়াইল্ড গুজ হান্টের জন্য আপনি হঠাৎ আমাকে ডাকলেন কেন? আমি তো সামান্য একজন বিজ্ঞানী। হঠাৎ আমার দরকার পড়ল কেন?”

মিঃ কিমলার বললেন, “দেখুন ডাঃ ম্যালিক, আমি ১৯৯০ সালে ভেঙ্কুভার বিজ্ঞান সন্মেলনে ক্যান্সারের ওষুধ নিয়ে আপনার বক্তৃতা শুনেছিলাম। তাই আমার মনে হয়েছে আপনি হয়তো আগ্রহী হবেন এই বিষয়ে। আর তা ছাড়া আমার বাবার মুখে যা শুনেছি, সেটা হল, এই ওষুধটা ভীষণ আনস্টেবেল। ওটাকে স্টেবিলাইজ করার জন্য আপনি যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন।”

“আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমরা ছাড়া এই ব্যাপারে আর কে কে জানেন?”

“কেউ না, আমি ফর্মুলাটা নিজে হাতে না পেয়ে কাউকে কিছু জানাতে চাইনি। এমন কি আমার মেয়েকেও না।” তারপর ভদ্রলোক একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, “এই জন্য বলিনি যে পড়ে যদি দেখি ব্যাপারটা মিথ্যে, তখন?”

“আর আমার শেষ প্রশ্ন, চিঠিতে যেটা লেখা আছে, তার মানে সম্পর্কে আপনার কী ধারণা ?"

মিঃ কিমলার আবার চিঠিটা বের করে আমাদের সামনে রাখলেন। তারপর একটা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস বের করে তার উপর ধরে বললেন, “দেখুন।”

আমি আর সুকুমারবাবু দুজনেই ঝুঁকে পড়লাম চিঠিটার উপর।

মিঃ কিমলার বললেন, “LH এর পরের নম্বরগুলো ভালো করে লক্ষ করুন।”

খুব মন দিয়ে নম্বরগুলো দেখতে একটা অদ্ভুত জিনিষ লক্ষ করলাম। প্রথম দুটো, তারপরের দুটো আর তারপরের তিনটে নম্বরের পর একটা করে ছোট্ট ফুটকি মানে ডট দেওয়া। আর সেটা যে ইচ্ছাকৃত সেটা বোঝা যাই এই দেখে যে সবগুলো ডটই সমান আকারের আরে একদম সংখ্যাগুলোর উপরের দিকে।

আমার ডান পাশ থেকে ঝুঁকে পড়া সুকুমারবাবু বললেন, “ফুটকি আর...”

“আর কী সুকুমারবাবু?”

ভদ্রলোকের বয়স হলেও চোখের দৃষ্টি যে এত তীক্ষ্ণ সেটা আগে জানতাম না। বললেন, “দেখুন দ্বিতীয় ফুটকিটা কিন্তু ঠিক ফুটকি নয়, একটু যেন লম্বাটে...”

চিঠিটা হাতে তুলে নিয়ে আরও কাছে চোখ নিয়ে গিয়ে দেখলাম। ঠিক তো, দ্বিতীয় ফুটকিটা একটু লম্বাটে... আমার শিরদাঁড়ার ভীতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। না চাইতেও মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে গেল, “কো-ওরডিনেটস!”

“ইয়েস ডাঃ ম্যালিক, কো-ওরডিনেটস,” কিমলারের ঠোঁটের ফাঁক দিতে তাঁর সোনার দাঁতটা ঝলমলিয়ে উঠল।

“কিন্তু এই LH মানে কী ?” এবার প্রশ্নটা করলেন সুকুমারবাবু, “L না হয় ল্যাটিটিউড কিন্তু H?”

“ওটা আমিও বুঝতে পারিনি মিঃ লাহা,” আক্ষেপের সাথে বললেন কিমলার।

“কিন্তু এই কো-ওরডিনেটসটা কোথায়?” আমি চিঠি থেকে মুখতুলে প্রশ্ন করলাম।

“রেসিডে, লস এঞ্জেলাস,” বললেন মিঃ কিমলার।

“অ্যামেরিকা?”

“হু।”

“কিন্তু, ইতিহাসে যত দূর পড়েছি হিটলার আর অ্যামেরিকা বিশ্বযুদ্ধের সময় বিপরীত দিকে ছিল। সেখানে ক্যান্সারের ওষুধের ফর্মুলা লস এঞ্জেলাসে থাকাটা প্রায় অসম্ভব।”

“আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম ডাঃ ম্যালিক, কিন্তু পরে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি যে সেই সময় অ্যামেরিকায় নাৎজিরা নাকি একটা গোপন বেস তৈরি করেছিল আর সেখানেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ফর্মুলা। কারণ অ্যামেরিকানরা যদি খোঁজ করে তাহলে জার্মানিতে করবে, নিজের দেশে নিশ্চই করবে না।”

“আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?” কথা বললেন আমার পাশে বসা সুকুমারবাবু।

“ইয়েস?”

“আলো প্রায় নিভু নিভু – মানে তো জীবন প্রদীপ নেভার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ঘন্টা কেন? লোকে কি তখনকার দিনে অসুখ হলে ঘন্টা বাজাতো?”

সুকুমারবাবুর কথা শুনে মিঃ কিমলার হো হো করে হেসে উঠলেন, তারপর বললেন, “গুড কোয়েসচেন মিঃ লাহা। আসলে আমাদের দেশের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী কারুর কঠিন অসুখ হলে পরিবারের লোক দরজার সামনে একটা বড় ঘন্টা ঝুলিয়ে দিত আর মাঝে মাঝে সেটা বাজাত কারণ তাদের ধারনা ছিল যে ওর পবিত্র ঘন্টা ধ্বনিতে যমদূতেরা আসবে না।”

ঠিক হল আমরা রেসিডে-র উদ্দেশে পরশু রওনা দেব কিমলার সাহেবের প্রাইভেট প্লেনে।

৮ জানুয়ারি ১৯৯৪

কালকে ডাইরি লেখার সময় পাইনি বললে ভুল হবে কিন্তু বরং বলা উচিৎ ডাইরি লেখার মানসিকতা ছিল না। ঘটনাটা প্রথম থেকেই একটু গুছিয়ে লিখি।

আমার কাল সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল যে মিউনিখে আসার পর থেকে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে শহরটা একটু ঘুরে দেখা হয়নি। তা চা খেতে খেতে সুকুমারবাবুও যখন বললেন, “ফর্মুলা টরমুলা খুঁজতে তো কাল যাবেন, আজ বরং চলুন একটু ঘুরে আসি। ফিরে লোকে জিজ্ঞেস করলে কী বলব যে বিদেশে গিয়ে এক সপ্তাহ হোটেলে কাটিয়ে এলাম?”

বললাম, “ঠিক হ্যাঁয়, ব্রেকফাস্ট করে চলুন একটু ঘুরে আসি। তার আগে রিসেপশনে বলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।”

“কেন? কিলমারকেই বলুন না একখান গাড়ি দেবে।”

“সে তো বললেই দেবে কিন্তু উনি যখন নিজে বলেননি, তখন ওনার গাড়ি নিতে আমার একটু আপত্তি আছে।”

“ওকে স্যার, মানে বলছিলাম কেন, আপনিও এখানের রাস্তা চেনেন না, আর আমার কথা তো ছেড়েই দিন। তা আমাদের যদি কেউ কিডন্যাপ টিডন্যাপ করে?”

হেসে বললাম, “সুকুমারবাবু, আপনার আর আমার মত দুটো বুড়োকে কারা কিডন্যাপ করবে? কী আছে আমাদের কাছে?”

গাড়িতে যেতে যেতে দেখলাম মিউনিখ শহরটা যেমন সুন্দর তেমন গোছানো। পরিস্কার দু লেনের রাস্তা, আর পাশের ফুটপাথের গা ঘেঁষে সারি সারি দোকান। কোনটা জামা কাপড়ের, কোনটা ঘর সাজানোর জিনিষের। কিন্তু প্রতি দশটা দোকানের মধ্যে একটা রেস্তরা। তাই দেখে সুকুমারবাবু বললেন, “এত রেস্তরা কেন বলুন তো? এরা কি বাড়িতে রান্না করে না?”

এখানের বাড়িগুলো আমাদের ওখানের মত না। সবই প্রায় দশ থেকে বারো তলা আর ছাদগুলো দুদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সুকুমারবাবু বললেন, “এবাবা, এরা ছাঁদে ওঠে না?”

বললাম, “ছাদগুলো ঢালু করার কারণ হচ্ছে যাতে বরফ পড়লে সেটা জমে না থাকে।”

“বরফ পড়ে? কিন্তু এটা তো প্রায় সমতল ভূমি?”

“কেন? বরফ কি শুধু পাহাড়েই পড়ে?”

আমরা ঠিক করেছি প্রথমে আমরা মিউনিখ রাজ প্রাসাদে যাব। আর ওখানে মিউজিয়াম আছে শুনে সুকুমারবাবু বললেন, “যদিও বাংলা পড়াতাম, কিন্তু ইতিহাস জিনিষটা আমার বিশেষ প্রিয়।”

তারপর সবে বলতে শুরু করছেন যে কবে স্কুলে ইতিহাসে লেটার মার্ক্স পেয়েছিলেন, আমি হাতের ইশারায় ওনাকে থামতে বললাম। গাড়ির সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখলাম সেই কালো গাড়িটা আমাদের পিছু নিয়েছে। আর আমরা যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি সেটা একদম শুনশান। শুধু আমাদের গাড়ি আর ওই কালো গাড়ি ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই। বাড়ি ঘরও নেই সেরকম। কারণ প্যালেসটা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। নিজেরা কথা বলতে বলতে লক্ষ করিনি কখন শহর থেকে বেরিয়ে গেছি।

আমি ড্রাইভারকে বললাম, “গাড়িটা একটু বাঁদিক করে দাঁড় করান তো।”

আমার কথাটা যেন ড্রাইভারের কানে গেল না। সে আস্তে আস্তে গাড়ির গতি বাড়াতে লাগল। আমি আবার বললাম, আর একটু জোরেই বললাম, “গাড়িটা থামান।”

ড্রাইভার এবার গতিটা একটু কমালো আর তারপর তার ডান হাতটা স্টিয়ারিং থেকে সরিয়ে ওটা আমাদের দিকে এগিয়ে ধরল। ওর ডান হাতে ধরা আছে একটা রিভলভার। তারপর ইংরেজিতে বলল, “যেখানে বসে আছেন চুপ করে বসে থাকুন।”

সুকুমারবাবু বন্দুকটা দেখেই খপ করে আমার জামার আস্তিনটা চেপে ধরলেন। আমার কানের কাছে মুখ এনে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “আপনি এতদিনে বন্দুক জাতীয় কিছু আবিষ্কার করেছেন নিশ্চয়ই?”

আমি উত্তর দেওয়ার আগে গাড়িটা রাস্তার পাশে একটা জায়গায় এসে থামল আর তার সাথে আমাদের পিছনের কালো গাড়িটাও। যে লোকটা দূরবীন দিয়ে আমাদের ঘরের দিকে দেখত, সে আর অন্য আর একটা লোক এসে কালো কাপড় দিয়ে আমাদের চোখ বেঁধে ফেলল। তারপর আমাদের গাড়ি আবার চলতে লাগল। গাড়িতে কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম সামনে ড্রাইভার ছাড়া আরও একজন লোক আছে।

এইভাবে আরও প্রায় এক ঘন্টা গাড়ি চলার পর আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। সেই লোকটাই আমাদের চোখের বন্ধন খুলে দিল।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটা মস্ত চার্চের সামনে। আমাদের অপহরণকারীর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ভিতরে ঢুকলাম। তারপর যীশু খ্রিষ্টের মূর্তিটার পিছন দিয়ে একটা গুপ্ত দরজা দিয়ে আর একটা ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম। ঘরটা খুব একটা বড় না, আর আলো খুব কম। ঘরের এক প্রান্তে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সুকুমারবাবু দেখি রাম নাম জপছেন। আর একটু কাছে যেতে লোকটা আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে আমার মুখ দিয়ে আপনিই বেরিয়ে গেল, “একি এড্রিয়ান, তুমি?”

সামনে যে কালো লং কোট পরে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি আমার বন্ধু বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ডাঃ এড্রিয়ান গোতজে।

“তোমাকে এইভাবে এখানে নিয়ে আসার জন্য আমায় মাফ কর মল্লিক, কিন্তু আমার কাছে তোমার কাছে পৌঁছনোর আর কোন উপায় ছিল না। তাও আজকে ভাগ্যিস বেরিয়েছিলে না হলে কী করতাম জানি না। চল, পাশের ঘরে বসে কথা বলি।”

সুকুমারবাবু বললেন, “এঁকে আপনি চেনেন?”

এড্রিয়ান আমার বন্ধু শুনে উনি চোখ কপালে তুলে বললেন, “বন্ধু বন্ধুকে কিডন্যাপ করে এটা প্রথম দেখলাম মশাই।”

পাশের ঘরে বসে এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে এড্রিয়ান বলল, “হাতে খুব বেশি সময় আছে বলে মনে হয় না। শোন মল্লিক, তোমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে যাও। তুমি বললে আমি এখান থেকে তোমাদের সোজা এয়ারপোর্টে ছেড়ে দেব। বাড়ি চলে যাও। তোমরা যার কাছে এসেছো সে খুব একটা সুবিধের লোক নয়।”

“দেখ এড্রিয়ান, কী ব্যাপার সেটা তুমি খুলে বল, না হলে আমাদের হোটেলে ছেড়ে দাও।”

“তুমি বুঝতে পারছ না মল্লিক। এডালার্ড কিমলার শুধু অস্ত্রের ব্যবসা করে না, আতঙ্কবাদীদের সাথে ওর যোগাযোগ আছে। তোমাকে যে কাজে ও ডেকেছে, আমি নিশ্চিত সেটাও ওই টেরোরিজেম সম্পর্কিত।”

“কী যা-তা বলছ, এড্রিয়ান? উনি আমাকে ডেকেছেন ওনার মেয়ে জন্য একটা...”

“মেয়ে? কিমলারের মেয়ে আজ থেকে বছর দুয়েক আগে মারা যায়, ক্যান্সারে।” এই বলে একটা পুরনো খবরের কাগজের কাটিং আমার হাতে দিল। তাতে এডালার্ড কিমলারের মেয়ে ডায়েনা কিমলারের মৃত্যু সংবাদ।

ডাঃ এড্রিয়ান গোতজে বলল, “তোমার সাথে এখনও অবধি কী কথা হয়েছে কিমলারের সেটা বল তো?”

আমি বললাম, “আগে তুমি বল, তোমার এই অবস্থা কেন?”

এড্রিয়ান যা বলল তার সারমর্ম এই যে জার্মানিতে গত এক বছর ধরে বিভিন্ন টেরোরিস্ট গ্রুপের লোকেদের আনাগোনা শুরু হয়েছে, তাই বেসরকারী ভাবে ও নিজে একটা গোপন দল বানিয়েছে এই সব ঘটনার মূলে পৌঁছনোর জন্য। আর ওদের প্রধান টার্গেট হল এডালার্ড কিমলার।

এড্রিয়ান আমার বহু পুরনো বন্ধু তাই তাঁকে অবিশ্বাস করতে পারলাম না। আমিও ওকে সংক্ষেপে বললাম আমাদের ঘটনা।

“চিঠিটা আমাকে দেখাতে পারবে মল্লিক?”

আমি একটা কাগজ চেয়ে তাতে লিখে দিলাম চিঠিটায় যা লেখা ছিল। এড্রিয়ান মিনিট পাঁচেক মন দিয়ে দেখে বলল, “অবিশ্বাস্য!”

“কী ?”

“দে গ্লোখে!”

“কী খেয়ে?” এই কথাটা অবিশ্যি সুকুমারবাবুর।

দে গ্লোখে নামটা শুনে আমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। বললাম, “দে গ্লোখে? সে তো গল্পে পড়েছি, নাৎজিদের বানানো অ্যাটোম বোমা।”

“অ্যাটম বোমা নয় মল্লিক, অ্যাটম বোমা হলে তাও ঠিক ছিল। এটা একটা বায়োলজিক্যাল ওয়েপন।”

সুকুমারবাবু আমার হাতে একটা টোকা মেরে বললেন, “বায়োলজিক্যাল ওয়েপন জিনিষটা আবার কী ?”

আমি কিছু বলার আগেই এড্রিয়ান বলতে লাগল, “এ যে সে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন নয়, একবার যদি এর বিস্ফোরণ হয়, তাহলে একশো কিলোমিটাররের মধ্যে যা আছে তা তো ধ্বংস হবেই, তাঁর সাথে ছড়িয়ে পড়বে বিষাক্ত জীবাণু। একাবার এই বোমা যদি ফাটে, তাহলে একটা মহাদেশ শেষ হয়ে যেতে মাস খানেক লাগবে।”

“কী সাংঘাতিক!!” বলে মাথা চাপড়ালেন সুকুমারবাবু।

বললাম, “কী করে বুঝলে এখানে সেই বোমার কথা বলা আছে?”

“দে গ্লোখে-র খুব কমন একটা নাম আছে, বেল।”

এবার সুকুমারবাবু বলে উঠলেন, “বেল... মানে... ঘন্টা!”

এবার চিঠিটার মানে আমার কাছেও একদম স্পষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু অ্যামেরিকায় কেন? পর মুহূর্তে নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। এই বোমা যদি হিটলার একবার ফাটাতে পারত তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফল হয়তো অন্যরকম হত।

“কিন্তু একটা কথা এখনও বুঝতে পারলাম না যে এই জিনিষ তো কিমলার নিজেই করতে পারত, আমাকে কীসের জন্য প্রয়োজন হল?”

“এটাও বুঝলে না মল্লিক? দে গ্লোখে তৈরি হয়েছে রেড মার্কারি দিয়ে। আর তুমি হয়তো জানো যে রেড মার্কারি জিনিষটা ভীষণই আনস্টেবেল। ওটা স্টেবিলাইজ করার জন্য যে জিনিষ দরকার সেটা তুমি ছাড়া আর বিশেষ কেউ অত তাড়াতাড়ি আবিষ্কার করতে পারবে বলে মনে করেনি কিমলার।”

আমি মিনিট তিনেক চুপ করে বসে থাকলাম তারপর বললাম, “আমি তো এই অবস্থায় দেশে পালাতে পারব না এড্রিয়ান।”

“কী বলছ মল্লিক, কী করবে তুমি? কিমলার জানতে পারলে তোমাকে আর তোমার বন্ধুকে এখানেই শেষ করে ফেলে দেবে।”

“সে না হয় দেখা যাবে। আজ উঠি এড্রিয়ান।”

গাড়িতে ফেয়ার পথে সুকুমারবাবুকে বললাম, “আপনি একটা কাজ করুন বরং। আমি কিমলার সাহেবের সাথে কথা বলে নিচ্ছি, আপনি দেশে ফিরে যান।”

সুকুমারবাবু জানলার বাইরে তাকিয়ে গুনগুন করে একটা পুরনো বাংলা ছবির গানের সুর ভাজতে ভাজতে বললেন, “কী যে বলেন মশাই, এই বিদেশ বিভূঁইতে আপনাকে একা রেখে চলে যাব? আর আগে ভেবেছিলাম বিদেশ যাত্রা, এখন তো দেখছি পুরো ডবল বিদেশ।”

না এখন লেখা বন্ধ করি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরতে হবে স্যান ফ্রান্সিস্কোর উদ্দেশে।

১৫ জানুয়ারি ১৯৯৪

গত কদিনে লেখার মত কোন ঘটনা ঘটেনি। লস এঞ্জেলাসে নেমে গাড়ি করে রেসিডে যেতে লাগল পাক্কা দু ঘন্টা। পৌছিয়ে বুঝলাম যে মিঃ কিমলার আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আমার জন্য একটা ল্যাবরেটরিও ভাড়া করে রেখেছেন। সেই ল্যাবরেটরির লাগোয়া দুটো ঘর, একটাতে আমি আর অন্যটাতে সুকুমারবাবু। মিঃ কিমলার বললেন উনি উঠেছেন একটা হোটেলে। আমাদের গেটের বাইরে দুজন বন্দুকধারী রক্ষি আছে, আর আমাদের বলা হয়েছে যে জায়গাটা নাকি খুব একটা ভালো না, তাই এই ব্যবস্থা। মিঃ কিমলার যাওয়ার আগে আমাকে একটা টেস্ট-টিউবে লালচে রঙের একটা কম্পমান বস্তু দিয়ে গেছেন, বলেছেন, “এই জিনিষটা আমার এক মার্কিন বন্ধুর থেকে আনিয়েছি। এটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে আনস্টেবেল লিকুইড। আপনি বরং এটাকে স্টেবেল করার চেষ্টা করুন। আশা করছি, ওষুধটা এর থেকে বেশি হবে না।”

আমি না জানার ভান করে বললাম, “কী জিনিষ এটা?”

উনি বললেন, “আমিও ঠিক জানি না, তবে একটু সাবধানে কাজ করবেন।”

আমি টেস্ট টিউবটা হাতে নিয়েই বুঝেছিলাম যে এ জিনিষ আমি আগে কখনও দেখিনি। শুরু করলাম আমার কাজ।

প্রথমেই একটা ক্যামিকাল টেস্ট করে দেখে নিলাম জিনিষটা আসলে কী? মার্কারি সাইক্লো-পাইরো-ওর্থ-এয়ান্টিমোনেট। মার্কারি আর এন্টিমোনির মধ্যে বিভিন্ন রকম বন্ডিং-এর ফলে এই রেড মার্কারির উৎপত্তি। আর একটা মজার জিনিষ লক্ষ করলাম, তরলটা প্রচন্ড ভাইব্রেট করছে। মেপে দেখলাম প্রায় ফ্রিকোয়েন্সি প্রায় ৬৩০০০ গিগাহার্জ।

আমি আমার কাজ শুরু করে দিলাম।

আজ বিকেলের দিকে মিঃ কিমলারকে জানিয়ে দিলাম যে আমার কাজ শেষ। লাল বস্তুটাকে স্টেবেল করার উপায় আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি।

সন্ধ্যে নাগাদ মিঃ কিমলার এলে ওনাকে একটা ডেমন্সট্রাশনও দেখিয়ে দিলাম। উনি লাফিয়ে উঠে বললেন, “তাহলে আর দেরি কেন, এখনই বেরিয়ে যাই। দিন?”

আমি বললাম, “আরে এটা তো শুধু স্যাম্পেল বানিয়েছিলাম। কাল বিকেলের মধ্যে আমি বেশ খানিকটা বানিয়ে দিচ্ছি।”

ভদ্রলোক একটু কিন্তু কিন্তু করে উঠে গেলেন।

মিঃ কিমলার চলে যাওয়ার পর সুকুমারবাবু বললেন, “আপনি কি বানিয়ে ফেললেন নাকি?”

বললাম, “ফেললাম।”

“সে কি মশাই, লোকটা একটা টেরোরিস্ট জেনেও আপনি বানিয়ে ফেললেন?”

“আমি এড্রিয়ানকে বলে এসেছি মার্কিন উপরমহলে খবর দিতে। কিমলারেরটা ওরা দেখবে। কিন্তু আপনার আর আমারটা তো আমকেই দেখতে হবে। না বানালে এখানেই খতম, বুঝলেন।”

১৮ জানুয়ারি ১৯৯৪

গতকাল দুদিন ডাইরি লেখা হয়নি, আর যে কোনদিন লেখা হবে সেটাও ভেবেছিলাম বলে মনে হয় না। পরশু দিন সন্ধ্যে বেলায় মিঃ কিমলার এসে হাজির। আমিও তৈরি ছিলাম। মিঃ কিমলারের হাতে ছোট্ট একটা টেস্ট টিউবে করে আমার আবিষ্কৃত তরলটা তুলে দিলাম। মিঃ কিমলার আমার সাথে করমর্দন করে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ, ডাঃ ম্যালিক। আপনি আমার মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আপনার এই উপকার আমি কোনদিন ভুলবো না। থ্যাংস এ লট।”

তারপর একটু থেমে বললেন, “হ্যারি আপনাদের এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিয়ে আসবে।”

আমি বললাম, “কিন্তু মিঃ কিমলার, আমি নিজে একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই। কারণ কত পরিমাণে তরলটা স্টেবিলাইজ করে সেটা না জেনে যাওয়াটা একটু রিস্কি।”

কিমলার একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, “ওকে, তবে ফর্মুলাটা কিন্তু আপনাকে দেখাবো না।”

আমি হেসে বললাম, “সে আমার দরকার নেই মিঃ কিমলার।”

“ওকে, তা আপনার সেক্রেটরিও যাবেন নাকি?”

আমি ‘না’ বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তাঁর আগেই সুকুমারবাবু বলে উঠলেন, “আলবাত যাবে। যেখানে স্যার, সেখানে সেক্রেটরি।”

আমাদের ল্যাব থেকে বেরিয়ে একটা কালো রঙের লম্বা গাড়িতে উঠে আমরা রওনা দিলাম। খুব অবাক হলাম এই দেখে যে আমি, সুকুমারবাবু আর মিঃ কিমলার ছাড়া আর কেউ যাচ্ছে না দেখে। মিনিট পঁয়তাল্লিশ যাওয়ার পর আমরা যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেখানে গাছপালা না থাকলে সেটাকে অনায়াসে মরুভূমি বলা যায়। এখানে পৌঁছনোর মিনিট কুড়ি আগে থেকেই দেখেছি আসে পাশে বাড়ি ঘর, দোকান পাট কিছুই নেই।

গাড়ি থেকে নেমে আমরা একটা বেশ বড় টিলার সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেই টিলার আর একটু কাছাকাছি যেতে বুঝলাম সেটা একটা পুরনো খনি।

মিঃ কিমলারের পিছন পিছন আমরা এগিয়ে চললাম সেই খনির ভিতর দিয়ে। বহুদিন বন্ধ থাকার কারণে ভিতরটায় একটা ভেপসা গন্ধ। পাশে পাথরের গায়ে অল্প অল্প শেওলা জমেছে। মিনিট পনেরো এইভাবে হাঁটার পর, সামনের পথটা আস্তে আস্তে সরু হতে লাগল। মাথার উপরের ছাঁদও এখানটায় অনেকটাই নিচু। আরও মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর যেখানে পৌঁছলাম, সেখানে আর সোজা হয়ে হাঁটা যায় না। তিনজনে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগলাম। আসে পাশের পাথরগুলো দেখলাম খসখসে কিন্তু কোণাগুলো মসৃণ। বুঝলাম, এগুলো প্রাকৃতিক নয়। এই সুড়ঙ্গটা মানুষের বানানো। গুহার এই জায়গাটায় আলো না আসার জন্য প্রাণের কোন চিহ্ন এখানে নেই। যদিও এই কিছুক্ষণ আগেও একটা বিছে জাতীয় জিনিষ দেখেছি আমাদের পায়ের পাশ দিয়ে চলে যেতে। আমার পিছনে সুকুমারবাবু প্রচণ্ড রকম হাঁপাচ্ছেন। ভদ্রলোক বেকার এলেন। এখন ওনার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তখন...

আমার সামনে দেখি মিঃ কিমলার আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বুঝলাম, গুহাটা এখান থেকে আবার চওড়া হয়েছে।

উঠে দাঁড়িয়ে সুকুমারবাবুকে বললাম, “আপনি আর এগবেন না-কি এখানেই বসবেন?”

ভদ্রলোক একটু জিরিয়ে নিয়ে বললেন, “না, চলুন।”

টর্চ হাতে আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর যে জায়গাটায় পৌঁছলাম, সেটা একটা হল ঘর। আর আমরা যেদিক দিয়ে এসেছি, তার ঠিক উল্টো দিকে একটা বিশাল দরজা। আমরা তিনজন আস্তে আস্তে দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি সেখানে একটা বহু পুরনো কাঠের লিফট করা আছে। মিঃ কিমলারের পিছন পিছন আমরাও ওঠে পড়লাম সেটায়। মিঃ কিমলার লিফটের গায়ে লাগানো কাঠের হাতলটা টেনে দিলেন আর ওমনি ঘড় ঘড় শব্দ করে লিফটটা নীচের দিকে নামতে শুরু করল। চারিদিকে পাথরের দাওয়াল আর তার মাঝখান দিয়ে আমরা নেমে যাচ্ছি। এইভাবে মিনিট দশেক নামার পর লিফটটা থেমে গেল।

আমরা লিফট থেকে নেমে সামনের দিকে টর্চ ফেলতেই একটা জিনিষ দেখতে পেলাম। সামনে দেওয়ালের পাশে যেটা রাখা রয়েছে, সেটা যে কোন ধাতু দিয়ে তৈরি তা দেখলেই বোঝা যায়। ট্রান্সপারেন্ট টাইটানিয়াম গ্লাস। জিনিষটি লম্বায় প্রায় দু মানুষ হবে আর চওড়ায় এক মানুষ। আর সেই টাইটানিয়াম গ্লাসের ভিতর আছে একটা উজ্জ্বল লাল তরল। জিনিষটাকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে একটা লাল রঙের ঘণ্টা। আমরা তিনজনেই এগিয়ে গেলাম সেই ঘণ্টাটার দিকে। আর কিছু বোঝার আগেই দেখি মিঃ কিমলার আমার দেওয়া টেস্ট টিউবের জিনিষটা ঝপ করে সেই লালচে তরলের মধ্যে ঢেলে দিলেন। আর সেই পাশে রাখা কন্ট্রোল প্যানেলের লাল বোতামটা টিপে দিলেন। আমি দেখলাম সেই জিনিষটার নীচের দিকে একটা লাল আলো দুবার দপ দপ করে নিভে গেল।

আর তারপর যেটা হল সেটার জন্য আমার প্রস্তুত থাকা উচিৎ ছিল। মিঃ কিমলার পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে আমার দিকে তাক করল। তারপর বলল, “ডাঃ ম্যালিক, তুমি এত বড় বিজ্ঞানী হয়ে অ্যামেরিকা ধ্বংস করে দিলে? আমার কোন মেয়ে নেই ডাঃ ম্যালিক।” তারপর হা হা করে এক বিকট অট্টহাসি হেসে বলল, “আমার দাদুর স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারলাম। আমার আর আমেরিকার সাথে আজ তোমরাও...”

এইবার যেটা হল সেটার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। দেখি সুকুমারবাবু ওনার হাতের বড় টর্চটা একটা অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুঁড়ে মেরেছেন মিঃ কিমলারের দিকে আর সেটা গিয়ে লেগেছে ভদ্রলোকের মাথায়। ভদ্রলোক মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করছেন দেখে দেখি সুকুমারবাবু টর্চটা তুলে আবার এক মোক্ষম ঘা বসিয়ে দিলেন। এবার ভদ্রলোকের দেহ অসাড় হয়ে গেল।

তারপর দেখলাম আমাদের চোখের সামনে লালচে তরলটা আস্তে আস্তে কালচে হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম পাথুরে মেঝেটা যেন অল্প কেঁপে উঠল। ভূমিকম্প! এই এলাকায় সেই ৭১ সাল থেকে ছোট বড় ভূমিকম্প লেগেই আছে। আমি সুকুমারবাবুর হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে দৌড় লাগালাম। যখন লিফটে করে উপরে এসে পৌঁছেছি, তখন দেখলাম কম্পন অনেকটা বেড়েছে। হাঁটা যাচ্ছে না। সুকুমারবাবু কোন রকমে টাল সামলাতে সামলাতে বললেন, “মনে হয় বোমটা ফাটছে।”

বললাম, “আপনার ভয় নেই সুকুমারবাবু, ও বোম আর ফাটবে না।”

“কেন, ওই যে দেখলুম লাল থেকে তরলটা কালো হয়ে গেল?”

“সেটা আমার কেরাটিনো পেপেরিথের কামাল। জিনিষটা এমনিতেই খুব শক্ত ফাইবের আর উপরে এই কদিন ধরে বিভিন্ন ফ্লকুল্যান্ট দিয়ে যেটা তৈরি হয়েছে, সেটা চুলের মত ফাইবের গজিয়ে মার্কারি সাইক্লো-পাইরো-ওর্থ-এন্টিমোনেট –কে মার্কারি আর এন্টিমনিতে ভেঙে ফেলেছে।”

“কাকে ভেঙে ফেলেছে? কী নেট?”

আমি ছুটতে ছুটতে বললাম, “বাড়ি ফিরে বলব, এখন ছুটুন।”

সেই সরু সুড়ঙ্গটার সামনে এসে দেখি পাথর ধসে পড়ে সেটা ভেঙে গেছে। যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। কী করব ভাবছি এমন সময় হুড়মুড় শব্দে আমাদের ডানদিকের পাথরের দেওয়ালটা ধসে পড়ল, আমি এতক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে থাকার ফলে সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আমরা দুজনে সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে সমতম ভূমি ধরে ছুটতে লাগলাম। মাটি এখন ভীষণ কাঁপছে। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে তলিয়ে যাব মাটির নীচে।

আরও মিনিট খানেক পর ভূমিকম্প বন্ধ হয়েছিল। রেসিডে শহরটা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছিল। আর তাঁর সাথে ধ্বংস হয়ে গেছিল সেই খনিতে ঢোকার রাস্তা আর টিলাটাও মিঃ কিমলারকে নিয়ে ধসে নীচে নেমে গেছিল প্রায় একশো ফুট।

না, এখন লেখা বন্ধ করি, এখুনি বিমান সেবিকা এসে সিট বেল্ট বাঁধতে বলে গেল। আর মিনিট পনেরোর মধ্যে ফ্লাইট কোলকাতা বিমানবন্দরে নামবে। আর সুকুমারবাবুকেও ডেকে তুলতে হবে, ভদ্রলোক সেই প্লেন ছাড়ার থেকে এক টানা ঘুমচ্ছেন।

আর একটা কথা, আসার সময় মিঃ কিমলারের দেওয়া রেড মার্কারি আধ টেস্ট টিউব নিয়ে এসেছি। আমার বিশ্বাস, ৬৩০০০ গিগাহার্জ ফিরকোয়েন্সি দিয়ে ভাইব্রেটোমিটার বানালে ভীম নিশ্চই এক সপ্তাহের মধ্যেই আবৃত্তি করতে পারব।