গলদ - ঋজু গাঙ্গুলী

অলংকরণ - অরিজিৎ ঘোষ

গ্রেলিং ডিন থেকে মাইলটাক দূরে, একটা লম্বা ঝিলের একদম গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল বাড়িটা। ওঁরা দু’জন সেদিকেই হনহনিয়ে হেঁটে আসছিলেন।

তখন আকাশের লাল সরিয়ে সন্ধ্যা নামছে।

কালচে সবুজ টিলাগুলোর মাঝে বানানো, আদতে লাল, এখন কালচে ইটের বাড়িটা সম্বন্ধে সুপারিনটেন্ডেন্ট হ্যাডলে বা ডক্টর গিডিওন ফেল্‌ কিছুই জানতেন না। বাড়ির সামনের লনটা ছিমছাম লাগলেও একেবারে নিষ্প্রদীপ ঘরগুলো দেখে তাঁরা থমকে গেলেন।

“এই যে!” এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা তর্কটা চালু রাখার পক্ষে একটা মোক্ষম উদাহরণ হাতে পাওয়ার মতো করে বাড়িটা দেখিয়ে হ্যাডলে বললেন, “এই হচ্ছে আমার গ্রামগঞ্জে না থাকার সবচেয়ে বড়ো কারণ। এখানেও আমরা একা! সামনের বাড়িটায় আদৌ কেউ থাকে, নাকি এটা পরিত্যক্ত, তাই বোঝার উপায় নেই। এর চেয়ে শহরে...”

“আমরা এখানে কিন্তু ঠিক একা নই।” হ্যাডলেকে মাঝপথে থামিয়ে বলেন ফেল্‌।

ফেল্‌-এর হাতের বিশ্বস্ত লাঠির ইঙ্গিত দেখে লেকের দিকে তাকালেন হেডলি।

জলের একদম ধার বরাবর একজন দাঁড়িয়েছিলেন। তরল অন্ধকারেও জলে ঝিকমিকিয়ে ওঠা শেষ আভাটুকু দিয়ে তাঁর চেহারা কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল।

ছোটোখাটো উচ্চতা। গাঢ়রঙা টিপটপ পোষাক। মাথায় লিনেনের একটা সাদা হ্যাট।

ভদ্রলোক জলের দিকে ঝুঁকে কী যেন দেখছিলেন। হ্যাডলে আর ফেল্‌-এর পায়ের ঘষটানি শুনে বোধহয় তাঁর সম্বিত ফিরল। ঘুরে হ্যাডলে আর ফেল্‌-কে দেখলেন ভদ্রলোক।

“আমি কোনো রাজহাঁস দেখছি না।” খুব চিন্তিত মুখে ওঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন মানুষটি, “আপনারা দেখতে পাচ্ছেন?”

“না।” গম্ভীরভাবে বললেন ফেল্‌, “দেখতে পাওয়ার কথা আছে বুঝি?”

“একটা।” অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, “একটা রাজহাঁস দেখতে পাওয়ার কথা। মরা। গলায় রক্ত মাখা। ওই...ওখানে ভাসার কথা।”

“মেরে ফেলা হাঁস?”

“অবশ্যই।” আবার মাথা দোলালেন মানুষটি, “খুন হওয়া। মানুষের মতোই।”

“কিছু মনে করবেন না।” লম্বা আর রোগাটে হ্যাডলে-র গলাটা এবার ছুরির মতোই ধারালো শোনাল, “আমরা ভেবেছিলাম এই বাড়ির বাসিন্দারা কেউ নেই। তাই এখান দিয়ে শর্ট-কাট করছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, আমরা অনধিকার প্রবেশ করে ফেলেছি।

ফেল্‌!” বিপুলদেহী মানুষটি হ্যাডলের দিকে তাকালেন। “আমরা বরং টিলার ওই দিক দিয়েই...?”

“ক্ষমা করবেন।” মানুষটির গলায় একটা মার্জিত, ধীরস্থির ভাব ছিল যেটা একটু আগের কথাগুলোর সঙ্গে খাপ খায় না। হ্যাডলে থমকে গেলেন। “ওসব কথা আমার বলা উচিত হয়নি। আসলে... তিরিশ বছর ধরে আমি প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে চলেছি। তাই বলে ফেলেছিলাম।

অনধিকার প্রবেশ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, কারণ এই জমির মালিক আমি নই। একসময় এখানে থাকতাম অবশ্য। তখনকার কথাগুলোই মনে পড়েছিল!

এখানে একটা বেঞ্চ আছে। তাতে যদি আপনারা একটু বসেন... মানে খুব অসুবিধা যদি না হয়...!”

ঘনায়মান সন্ধ্যায়, সেই নিস্তব্ধ লেক আর লনে, সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো উড়িয়ে দিতে পারেননি হ্যাডলে আর ফেল্‌। ঝিলের ধারে একটা মর্চে ধরা বেঞ্চে বসে তাঁরা ভদ্রলোকের কথাগুলো শুনেছিলেন।

“আমি জোসেফ লেসিং।” নিভু-নিভু গলায় বলছিলেন ভদ্রলোক, “বুঝতেই পারছি, আপনারা আমার নাম শোনেননি। তাহলে আমার সৎ বাবা, ই.এন.টি বিশেষজ্ঞ ডক্টর হার্ভে লেসিং-এর নামও আপনাদের শোনার কথা নয়।

সেই সময় আমরা এই বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসতাম। আমরা মানে... দাঁড়ান, একটু গুছিয়ে বলতে হচ্ছে ব্যাপারটা।

ডক্টর লেসিং-এর প্রথম স্ত্রী যখন মারা যান, তখন তাঁদের তিনটি সন্তান ছিল। দু’বছর পর যখন তিনি আমার মা-কে বিয়ে করেন, তখন মা-র প্রথম পক্ষের সন্তান হিসেবে আমি এই পরিবারের সদস্য হই।

দুঃখের বিষয়, আমার মা-ও ওই বিয়ের বছর তিনেকের মধ্যে মারা যান। তবে ডক্টর লেসিং দয়ালু মনের মানুষ ছিলেন। এই পরিবারে আমার কোনো রকম অনাদর হয়নি তার পরেও।

আমরা চার ভাইবোন, মোটের ওপর, ভালোই ছিলাম।

আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছিল ব্রাউনরিগ। প্রচুর হাসত ও। একসময় ভালো অ্যাথলিটও ছিল। তবে ওর কথা ভাবতে গেলেই মনে হয়, লোককে ঠেস দিয়ে কথা বলা, রাশিরাশি আখরোট খাওয়া, এগুলোই ওর বৈশিষ্ট্য ছিল। ও ডেন্টিস্ট ছিল।

তারপর ছিল হার্ভে জুনিয়র। লম্বা-লম্বা পা ফেলে হাঁটত হার্ভে। “ভাইসব!” বলে, কেমন একটা বক্তৃতার স্টাইলে আমাদের সম্বোধন করত ও। একজায়গায় স্থির হয়ে থাকা ওর ধাতে ছিল না। সবসময় অস্থিরভাবে, হাত ছুঁড়ে কিছু-না-কিছু নিয়ে কথা বলতে-বলতে চলেফিরে বেড়াত ও। তবে জুনিয়রের সবচেয়ে পছন্দের জিনিস ছিল জলবিহার। গণ্যমান্য লোকজন টেমসে নৌকো করে বেড়ানোর সময় যেমন লাল-সাদা পিনস্ট্রাইপ ব্লেজার আর খড়ের টুপি পরতেন, ও-ও সেরকম সাজগোজ করে নৌকোয় চেপে ঝিলে ঘুরত। ও তখন ডাক্তারি পড়ছে।

শুধু চা-এর পরের সময়টা বাদ যেত। তখন ডক্টর লেসিং-কে বিরক্ত করার প্রশ্নই ছিল না। উনি তখন দিবানিদ্রার জন্য ওই সামারহাউসটায় আসতেন।”

এতক্ষণে খেয়াল করলেন হ্যাডলে আর ফেল্‌। অন্ধকার লেকের মাঝামাঝি জায়গায়, লতার আড়ালে ঢাকা পড়ে প্রায় অদৃশ্য হয়ে আছে একটা একতলা ছোট্ট বাড়ি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে রইল লন। তারপর জোসেফ আবার কথা শুরু করলেন।

“ডক্টর লেসিং-এর তৃতীয় সন্তান ছিল মার্থা। প্রায় আমারই বয়সী ছিল ও। ওকে আমি খুব... পছন্দ করতাম। আর্থার সমার্স, মানে যার সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়া ঠিক হয়ে গেছিল, একটা লাইন রেজিমেন্টে কমিশনড অফিসার ছিল। চমৎকার ছেলে। মার্থা বাদে এই বাড়িতে আমিই ছিলাম ওর সবচেয়ে কাছের লোক। আমরা ওর আসার অপেক্ষাতেই ছিলাম যখন... ঘটনাগুলো ঘটে।

সেবার সাংঘাতিক গরম পড়েছিল।

আমি একজন মণিকারের দোকানে কাজ করতাম। ছুটি পড়ার পর এখানে এসে চারদিকে সবুজ, শান্ত পরিবেশ পেয়ে মনে হয়েছিল, বাঁচলাম।

আর মার্থা!

সেবারের ছুটির কথা ভাবতে গেলেই দুধসাদা পোশাকে রাজকন্যার মতো গরবিনী মার্থার কথা মনে পড়ে। হাসি, খেলা, আর ছুটোছুটি। এই নিয়েই থাকত ও।

বেলা দু’টো-র পর আমরা লাঞ্চ আর চা-এর মাঝামাঝি একটা কিছু সারতাম। ১৫ই অগস্ট সেসব মেটার পর আমরা প্রত্যেকেই বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান করেছিলাম। ওই...”

জোসেফের আঙুল অনুসরণ করে অন্ধকার বাড়িটার দিকে তাকান হ্যাডলে আর ফেল্‌। বাড়ির একদম মাঝামাঝি, দেওয়াল থেকে বাইরের দিকে বাক্সের মতো এগিয়ে আসা একটা জানলা দেখালেন জোসেফ।

“ওই জানলার পাশেই টেবিলটা সাজানো হয়েছিল।

ডক্টর লেসিং সবচেয়ে আগে টেবিল থেকে ওঠেন। একে গরম, তায় হাওয়ার অভাবে দুপুরটা এমন ঝিম-ধরা হয়ে উঠেছিল যে আমারও ঘুম পাচ্ছিল।

ঝিলের ধারেই জুনিয়র ইট, কাঠ, এসব দিয়ে একটা ছোটোখাটো জেটি বানিয়েছিল। তার ধারেই রাখা ছিল একটা দাঁড়টানা নৌকো, আর একটা ‘পান্ট’, মানে পোল দিয়ে টানতে হয় এমন চ্যাপ্টা নৌকো।

ডক্টর লেসিং-কে আমরা সবাই দেখতে পেয়েছিলাম। বগলে একটা বালিশ, আর হাতে একটা বই নিয়ে উনি লন পেরিয়ে দাঁড়টানা নৌকোর কাছে যান। তারপর নৌকোটার দাঁড় বেয়ে সামারহাউসে পৌঁছন।

তারপর ওঠে মার্থা। ওর যেমন স্বভাব, তেমনই করেছিল। হেসে, চেয়ারটাকে পেছনে ঠেলে, ও দৌড়ে বেরিয়ে গেছিল।

তার একটু পরেই আমিও উঠে বেরিয়ে গেছিলাম। আমার পর টেবিল ছেড়েছিল জুনিয়র। শুধু ব্রাউনরিগ আলসেমি করে সেদিন টেবিল ছেড়েই ওঠেনি। রোদ্দুর যাতে গায়ে না লাগে সেজন্য চেয়ারটাকে এক পাশে সরিয়ে, এক কাঁড়ি আখরোট নিয়ে ও সারা দুপুরটা কাটিয়ে দিয়েছিল।

এসব কথার সাক্ষী ছিল একজন।

রবিনসন বলে এক মালী জানলার নীচেই বাগানে কাজ করছিল। সে আমাদের কথা শুনেছিল, আমাদের বেরিয়ে যেতে দেখেছিল। সামারহাউসে ডক্টর লেসিং ঢুকে যাওয়ার পর যে তার সামনের আর পেছনের দুটো দরজাই ভেজানো ছিল, এবং তারপর সারা দুপুর, বিকেল, এমনকি সন্ধে অবধি আর কেউ ওখানে যায়নি, এটাও সে দেখেছিল।

ছ’টা নাগাদ আমরা ফিরে এসেছিলাম।

যখন লনে ছায়াগুলো লম্বা হতে শুরু করল, আশপাশটা একটু বেশিই ফাঁকা লাগতে শুরু করল, তখন আমাদের ব্যাপারটা খেয়াল হল।

ডক্টর লেসিং তখনও বেরোননি!

ব্যাপারটা আমাদের সবার কাছেই অস্বাভাবিক লেগেছিল। আমরা তীর থেকে ডাকাডাকি করে কোনো সাড়াশব্দ পাইনি।

বয়সে বড়ো হওয়ার সুবাদে ব্রাউনরিগ খবরদারি করার সুযোগ পেলে ছাড়ত না। তখনও ও আমাকে, একদম ফাইফরমাশ খাটানোর মতো করে বলে দিল ডক্টর লেসিং-কে ডেকে তুলতে।

আমি ‘পান্ট’ একেবারেই সামলাতে পারতাম না। এদিকে দাঁড়টানা নৌকোটা তখনও সামারহাউসের সামনেই বাঁধা আছে দেখছিলাম। শেষ অবধি জুনিয়র আমার সঙ্গে হাত লাগাল। আমরা দু’জনে, প্রচুর কসরত করে শেষ অবধি সামারহাউসে পৌঁছে ঘরে ঢুকলাম।

এক নজরে মনে হয়েছিল, ডক্টর লেসিং ঘুমিয়েই আছেন।

এক পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন মানুষটা। বালিশে মুখটা প্রায় গুঁজে ছিল। একটা হাত নীচে ঝুলছিল। নীচে, মেঝেতে, ‘থ্রি মেন অন আ বোট’ বইটা পড়েছিল।

তারপরেই আমার মনে হল, কিছু একটা গোলমাল আছে। জুনিয়র তখনই দেখাল, মানুষটির কান থেকে কিছু একটা বেরিয়ে এসেছে। কাছে গিয়ে দেখলাম সেটা কালচে লাল, চকচকে... রক্ত!

ডাক্তার বলেছিলেন, ঘুমের মধ্যেই মারা গেছিলেন ডক্টর লেসিং। তাঁর ডান কানের মধ্য দিয়ে একটা গোল, কিন্তু মাথার দিকে সরু, শক্ত, আর ধারালো জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। টুপি ঝোলানোর পেরেকের চেয়ে চওড়া, অথচ পেন্সিলের চেয়ে সরু সেই জিনিসটা, অর্থাৎ খুনির হাতিয়ারটা, পুলিশ কোথাও খুঁজে পায়নি।”

জোসেফ লেসিং চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। গাছের মাথাগুলোকে দুলিয়ে দিয়ে গেল একটা কনকনে হাওয়ার দাপট। তারাভরা আকাশের নীচে জোসেফের মাথার সাদা টুপির ওঠানামা থেকে হ্যাডলে আর ফেল্‌ বোঝেন, মানুষটি মাথা দুলিয়ে কিছু ভাবছেন, কিছু কথা সাজিয়ে নিচ্ছেন।

“হুঁ।” বিপুল শরীরের ভার বেঞ্চে ছেড়ে দিয়ে এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন ফেল্‌, কিন্তু এবার তিনি প্রশ্ন করলেন, “পুলিশ কাকে সন্দেহ করেছিল?”

“আমাকে।” নীচু স্বরে বললেন জোসেফ। “ওখানে সেদিন যতজন ছিল, তাদের মধ্যে শুধু আমিই সাঁতার কাটতে পারতাম।”

“কিন্তু...” উত্তেজিত হয়ে ওঠেন হ্যাডলি, “আপনি যে বললেন...?”

“আমি বুঝিয়ে বলছি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন জোসেফ।

“এই খুনের মোটিভ হিসেবে পুলিশ অর্থলিপ্সাকেই চিহ্নিত করেছিল।

ডক্টর লেসিং যথেষ্ট ধনী ছিলেন, এবং তাঁর সম্পত্তি মোটামুটি সমান চার ভাগেই ভাগ করে আমাদের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছিল।

ব্রাউনরিগ যে ঘর ছেড়ে নড়েনি, সেটা রবিনসনের কথায় স্পষ্ট হয়।

মার্থা ওর এক বান্ধবীর সঙ্গে দুপুরটা কাটিয়েছিল।

জুনিয়রের কোনো অ্যালিবাই ছিল না, কারণ ও হাঁটাহাঁটি করতেই বেরিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ ওকে সন্দেহ করার মতো কোনো কারণ পায়নি।

আমিই ছিলাম একমাত্র ‘বেমানান’ সদস্য। তার ওপর লোকের মুখের ওপর চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা বলার বদভ্যাস, সন্দেহবাতিক, এসবের জন্য আমাকে দোষী ভেবে এগোনোটা বোধহয় সহজ ছিল।”

হ্যাডলে আর ফেল্‌ নীরব রইলেন। জোসেফ আবার মুখ খুললেন।

“ইন্সপেক্টর ডিয়ারিং-এর মতে, আমার প্ল্যানটা ছিল এরকম।

আমি আগে এটা নিশ্চিত করব যে বাড়ির আশেপাশে কেউ থাকবে না। তাহলে সবাই ভাবতে বাধ্য, যে খুনি বাইরে থেকে এসে, ‘পান্ট’ চালিয়ে সামারহাউসে গিয়ে খুনটা করে আবার ফিরে এসেছে। যেহেতু ‘পান্ট’ আমি একেবারেই ম্যানেজ করতে পারি না, তাই আমাকে লোকে সন্দেহ করবে না।

তারপর, ইন্সপেক্টরের মতে, আমি ঝিলের ওই পারে ওই... যেখানে বেশ কয়েকটা গাছ ঝুপসি হয়ে রয়েছে, ওখানে আসি। খাওয়ার ঘরের জানলা আর সামারহাউসের সঙ্গে একই রেখায় রয়েছে ওই জায়গাটা। আমি নাকি আগেই পোষাকের নীচে স্নানের পোষাক পরেছিলাম। তাই, জামাকাপড় খুলে আমি জলে নামি।

বিশ গজ সাঁতার কাটা সত্যিই আমার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না। ইন্সপেক্টরের মতে আমি পেছন দিক থেকে যখন সামারহাউসে পৌঁছই, তখন ব্রাউনরিগ স্বাভাবিকভাবেই এই বাড়ির দোতলার জানলা দিয়ে আমাকে দেখতে পায়নি, কারণ আমি আড়াল হয়ে গেছিলাম। তারপর আমি সামারহাউসের জানলার নীচে আসি, আর খোলা জানলা দিয়ে সেখানে ঢুকি।

স্নানের পোশাকের মধ্যেই নাকি আমি খুনের অস্ত্রটি লুকিয়েছিলাম। খুন করে আমি চুপচাপ বেরিয়ে পড়ি। রোদের তেজ ছিল মারাত্মক, তাতেই আমার গা-হাত-পা শুকিয়ে যায়।

এভাবেই নাকি আমি, দুনিয়াতে আমার প্রতি সহানুভূতি দেখানো একমাত্র মানুষটিকে মেরে ফেলেছিলাম।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন জোসেফ। ঝিলের দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়া গাছগুলোতে আওয়াজ তুলল। নড়েচড়ে উঠলেন দুই শ্রোতা।

আবার জোসেফ কথা শুরু করলেন।

“আমি বারবার বলেছিলাম, আমি এই কাজ করিনি। তাছাড়া কোনো সাক্ষী নেই, কোনো প্রমাণ নেই, শুধু গায়ের জোরে এইভাবে কিছু বলা...

তবু আমার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। লাইব্রেরিতে, কোর্ট বসানোর মতো করে, ওরা আমাকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। ওরা মানে... মূলত ব্রাউনরিগ। মার্থা শুধু কাঁদছিল। জুনিয়র কয়েকবার ‘ফেয়ার-প্লে’, ন্যায়বিচার, এসবের কথা তুলেও দম-ফুরোনো পুতুলের মতো চুপ করে গেছিল। কিন্তু ব্রাউনরিগ মসৃণভাবে, হিসহিসে সুরে, কথাগুলো বলছিল।

‘হয় আমাদের এটা মেনে নিতে হবে, যে তুমিই খুনটা করেছ।’ ব্রাউনরিগ বলছিল, “নইলে মানতে হবে যে কোনো ভূতপ্রেত এই কাণ্ডটা করেছে! দ্বিতীয়টা মানা অসম্ভব। তাই তুমিই...! কাজকম্মো না করে টাকা কামানোর সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছিলে, তাই না?’

তবে এসব কথা বললেও ওদের আমি ভয় পাইনি। আমার আশঙ্কা ছিল ইন্সপেক্টর ডিয়ারিং-কে নিয়ে।

পুলিশ আমায় গ্রেফতার করেনি, কারণ তাদের কাছে আমার বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছিল না। কিন্তু রোজই মনে হত, হয়তো আজকেই ওরা আমার বিরুদ্ধে কিছু খুঁজে পাবে। ডক্টর লেসিং-এর অন্ত্যেষ্টির পর, যখন গরম আরও বাড়ল, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল মার্থার কান্নাকাটি, তখন মনে হচ্ছিল এই সন্দেহ আর অভিযোগের নরক থেকে ফাঁসিকাঠও ভালো।

আর তারপরেই...

ওই জানলাটা দেখতে পাচ্ছেন?”

জোসেফের আঙুল অনুসরণ করে হ্যাডলে আর ফেল্‌ বাড়িটার একদম ওপরে, ছাদের ঠিক নীচেই একটা জানলার দিকে তাকালেন। অল্প আলোতেও জানলাটার একটা বিশেষত্ব ওঁদের নজর এড়ালো না।

“গরাদ লাগানো আছে দেখছি জানলাটায়।” বললেন হ্যাডলে।

“হ্যাঁ।” অন্ধকারেও টুপিটার নড়াচড়া দেখা গেল, “ঘরটার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিই আপনাদের।

ঘরটা ছোটো। চৌকো। একটা দরজা, আর একটা জানলা আছে ওতে। ঘটনাটা যখন ঘটে তখন ওই ঘরে আসবাব বলতে কিচ্ছু ছিল না। একবার ওই ঘরে একটা ট্র্যাজেডি হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ঘরটা ওইরকম ফাঁকা আর তালাবন্ধ হয়ে থাকত। ঘরের চাবিটা থাকত ডক্টর লেসিং-এর কাছেই।”

একটা দেশলাই জ্বলে উঠল। অন্ধকারের মধ্যে লাফিয়ে ওঠা আলোয় হ্যাডলে আর ফেল্‌ একটা পাইপ, খাড়া নাক, টানা চোখ, আর শনের মতো সাদা লম্বা চুল, এটুকুই দেখতে পেলেন।

“২২শে অগস্ট বিকেলবেলা। এই পরিবারের যিনি সলিসিটর ছিলেন, তিনি আগেভাগে কিছু না জানিয়েই এখানে হাজির হলেন। আমি বাকিদের ডাকতে গিয়ে দেখি, ব্রাউনরিগ এক বোতল হুইস্কি নিয়ে নিজের ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি, জুনিয়র হাঁটতে বেরিয়েছে, আর মার্থা নিজের শোয়ার ঘরে।

ক’দিন ধরেই মার্থা বলছিল, ও অসুস্থ। মুশকিল হল, অসুস্থতাটা ঠিক কী ধরনের, তা না বলে ও শুধু কান্নাকাটি করছিল। বুঝতে পারছিলাম, ও আর্থার, মানে যার সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়ার কথা হয়েছিল, তার জন্য অপেক্ষা করতে-করতে অস্থির হয়ে পড়েছে। অথচ বেচারি ছুটি না পাওয়ায় আসতে পারছিল না।

সেদিনও ওর ঘরে উঁকি মেরে দেখেছিলাম, ও একটা চেয়ারে গা এলিয়ে রয়েছে। হাতে একটা স্মেলিং সল্টের বোতল। কেঁদে-কেঁদে চোখগুলো ফোলা। একটা ধবধবে সাদা পোশাক পরে, মাথার চুলগুলো চূড়া করে, একটা ওই... ঘড়ি-লাগানো পেনড্যান্ট গলায় ঝুলিয়ে কাত হয়ে শুয়েছিল ও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কেমন আছে? উত্তরে ও আমার দিকে একটা বই ছুড়ে আবার কাঁদতে শুরু করল!

নিরুপায় হয়ে আমি একাই গেলাম সলিসিটরের সঙ্গে কথা বলতে। নীচের ঘরে বসে যখন আমরা কথা বলছি, তখনই একটা শব্দ শুনলাম।

আমি একা নই, শব্দটা সলিসিটর ভদ্রলোকও শুনেছিলেন। আমরা দু’জনেই বুঝেছিলাম, আওয়াজটা ওপর থেকে এসেছে। দোতলায় উঠে দেখি, মার্থা তার ঘরে নেই। ও কোথায় যেতে পারে সেটা আন্দাজ করলাম ছাদের ঘরে যাওয়ার সিঁড়ির মুখের দরজাটা খোলা দেখে। আমরা ওপরে উঠলাম।

ওপরে গরম আরও বেশি ছিল। ওই বন্ধ ঘরের দরজাটা আধখোলা হয়ে ছিল। তার বাইরে দাঁড়িয়ে একটি কাজের মেয়ে, কী যেন নাম... বোধহয় জেন ডসন... যাকগে, সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। কোনোক্রমে সে শুধু আঙুল তুলে ঘরের ভেতরটা দেখাতে পেরেছিল।

ঘরটা, আগেই বলেছি, ছোটো সাইজের। ফাঁকা। একটা ময়লাটে খয়েরি রঙ ছিল দেওয়ালে। সূর্য নীচে নেমে এলেও তার দাপট কমেনি। সেই চোখ-ধাঁধানো আলো জানলার গরাদের ছায়া ফেলেছিল মার্থার সাদা পোশাকে।

ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় পড়েছিল মার্থা।

আমি ওকে তুলে ধরে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। তখনই দেখেছিলাম, ওর চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তের ধারা!

ঘরে আর কেউ ছিল না।

কাজের মেয়েটি বলেছিল, ও মার্থাকে ডক্টর লেসিং-এর বেডরুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে। মার্থা তখন, ওই স্কার্ট পরেও, প্রায় দৌড়চ্ছিল। সেই অবস্থাতেও ও ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। মার্থাকে ওইভাবে ওপরের ঘরে যাওয়ার সিঁড়ি খুলে ছুটতে দেখে মেয়েটি ভয়ই পেয়ে যায়, এবং ওর পিছু-পিছু ওপরে আসে।

ওপরে উঠে মেয়েটি দেখে, মার্থা এই বন্ধ ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢোকে। তারপর... তারপর মার্থা বন্ধ না করলেও দরজাটা নাকি ওর পেছনে-পেছনে বন্ধ হয়ে যায়। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি আর আশঙ্কার বশে মেয়েটি তখনই দরজাটা খুলতে চেষ্টা করেনি। কিন্তু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ও যখন কী করবে ভাবছে, তখনই সেই অদ্ভুত শব্দটা হয়, যেটা আমরাও নীচে বসেই শুনেছিলাম।

শব্দটা কেমন ছিল তা মেয়েটি বর্ণনা করতে পারেনি। তবে সেটা যথেষ্ট জোরে হয়েছিল। দেওয়াল-জড়ানো লতানে গাছে বসা পাখিরা উড়ে গেছিল। এমনকি ঝিল যেখানে বাড়িটার একদম কাছে এসেছে, ওই যে... হ্যাঁ, ওখানে, রাজহাঁসগুলোও নাকি ওখানে জল থেকে উঠে এসেছিল।

মেয়েটি ভয়ে-ভয়ে দরজা কিছুটা ফাঁক করে ঘরের ভেতরে তাকিয়ে দেখেছিল। ওইভাবে পড়ে থাকা মার্থা ছাড়া ঘরে তখন আর কেউ ছিল না।

আমরা তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।

মেয়েটির বয়ানে কোনো ফাঁক ছিল না। এমনকি পুলিশও সেখানে অবিশ্বাস করার মতো কিছু পায়নি। মেয়েটি বারবার বলেছিল, মার্থাকে, এবং শুধু মার্থাকেই সে ওই ঘরে ঢুকতে দেখেছিল। ঘর থেকে কেউ বেরোয়নি। ঘরের মধ্যে লুকোবার কোনো জায়গা ছিল না। জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে কারও পালানোর প্রশ্নই ওঠেনি। আর ঘরের মধ্যে যে কোনো যন্ত্র-টন্ত্র লুকোনো ছিল না, সেটাও ইন্সপেক্টর ডিয়ারিং তন্নতন্ন করে খুঁজে নিশ্চিত করেছিলেন।

তবে হ্যাঁ, এটা পুলিশ খেয়াল করেছিল যে ঘরটার সিলিং বা দেওয়ালে ধুলোবালি থাকলেও মেঝেটা ছিল একদম পরিষ্কার।

ব্যাপারটা শুনতে যতটা অবিশ্বাস্য লাগছে, বিশ্বাস করুন, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি ছিল। মার্থা! কীভাবে?? কেন?

পরে আমি আর জুনিয়র হাঁটতে-হাঁটতে এই ঝিলের ধারে এসেছিলাম। জুনিয়র কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, কেন মার্থা ওপরের ওই ঘরে গেছিল। সেই প্রশ্নটাই ও বারবার আমাকে, নিজেকে, বিশ্বসংসারকে করে চলেছিল। তখনই জলের ধারে ভেসে আসা থাকা ওই নলবনের মধ্যে একটা কিছু আমাদের চোখে পড়ল।

জিনিসটা দেখে এক নজরে মনে হয়েছিল, যেন জলের মধ্য দিয়ে তীরের দিকে ভেসে আসছে একটা লম্বা নখের মতো কিছু। কাছে এলে বুঝতে পারলাম, ওটা একটা রাজহাঁসের গলা, যার মাথাটা গলা থেকে, কিছু একটার ঘায়ে, প্রায় আলাদা হয়ে গেছে!

আমরা একটা নৌকো টানার হুক দিয়ে ওটাকে জল থেকে তুলে দেখেছিলাম।”

জোসেফ লেসিং চুপ করে গেলেন। অন্ধকার ঝিলের জলে, আর গাছের পাতায় দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো আওয়াজ তুলে ঘুরপাক খেল হাওয়া। হ্যাডলে অবশ্য তার মধ্যেও ফেল্‌-এর লম্বা-লম্বা শ্বাসের শব্দ পাচ্ছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, নিজের রাগটাকে সামলানোর চেষ্টা করছেন ফেল্‌।

“হুঁহ্‌!” গলা নয়, বরং নাক দিয়ে শব্দটা বের করলেন ফেল্‌, “তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, এগুলো কীভাবে হয়েছিল, সে ব্যাপারে আপনি কিচ্ছু জানেন না?”

“মানে?” জোসেফ লেসিং যে বিলক্ষণ চমকেছেন, সেটা বোঝা গেল।

“মানে আপনি সত্যিই জানেন না, কীভাবে এই খুনগুলো করা হয়েছিল?”

“না।” স্পষ্ট গলায়, গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন ছোটোখাটো মানুষটি।

“আচ্ছা বেশ।” সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে ফেল্‌ বলেন, “তাহলে আর একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি হাওয়ায় তির ছুঁড়েছেন কখনও?”

“এক মিনিট! এক মিনিট!” সোজা হয়ে বসেন হ্যাডলে। “কী বলতে চাইছেন? কেউ হাওয়ায় তির ছুড়ে মার্থাকে মেরেছিল?”

“ধুর!” কথাটা উড়িয়ে দিলেন ফেল্‌। “আমি ছেলেমানুষি খেয়ালের কথা বলছি। যেরকম খেয়াল থেকে লোকে হাওয়ায় পাথর বা তির ছুঁড়ে দেখে, সে কতটা উঁচুতে পাঠাতে পারল জিনিসটাকে। আমার আশঙ্কা, জোসেফ লেসিং মহোদয় এসব ছেলেমানুষি জিনিসে আনন্দ পান না। আর পান না বলেই এই মামলার সবচেয়ে বড়ো গলদগুলো তাঁর চোখে পড়েনি।

যেমন ধরুন, পাখিরা কারও গলার আওয়াজ, এমনকি চিৎকার শুনেও দল বেঁধে আকাশে ওড়ে না। আপনি যেরকম বললেন তাতে বাড়ির আশেপাশে, এমনকি ঝিলের পাখিরাও জুনিয়রের হাঁটাচলা আর বকবক দেখে ওই ধরনের আওয়াজে অভ্যস্ত ছিল। তাছাড়া পাখিরা উড়লেও রাজহাঁসেরা জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে আসার মতো কাজ শুধু তখনই করে যখন তাদের গায়ে, বা তাদের মাঝখানে কিছু এসে পড়ে।

অর্থাৎ, ওই জানলা দিয়ে কেউ, বা কিছু একটা জিনিস জলে পড়েছিল।

তারপর আসুন আরেকটা সহজ কথায়। কোনো মহিলা কখনও ভয় পেয়ে ওপরের একটা তালাবন্ধ ঘরে ছুটবে না, বিশেষত সেই ঘরের সঙ্গে যখন, আপনার কথামাফিক, একটা ট্র্যাজেডি জড়িয়ে আছে। সে নীচে যাবে, যেখানে লোকজন রয়েছে।

মার্থা ওপরের ওই ঘরটায় গেছিল একটাই কারণে।

না, কোনো জিনিস খুঁজতে সে যায়নি, কারণ ওখানে কিচ্ছু ছিল না। তাহলে কেন গেছিল ও?

আমরা জানি, বেশ কিছুদিন ধরেই মার্থা নিজের বাগদত্তা ওই ছেলেটির আসার জন্য দিন গুনছিল। ওর ওই কান্নাকাটি, অসুস্থ বলে নিজেকে সরিয়ে রাখা, এসবই বুঝিয়ে দিচ্ছিল, সপ্তাহের-পর-সপ্তাহ ধরে আর্থারকে দেখতে না পাওয়া, আর ডক্টর লেসিং-এর মৃত্যু, এই দুয়ের চাপ ও আর নিতে পারছিল না।

এটাও লক্ষণীয় যে, ওই ঘরটা সবচেয়ে উঁচুতে বলে ওর জানলা দিয়েই কিন্তু গ্রাম থেকে এদিকে আসার রাস্তাটা সবচেয়ে ভালো দেখা যায়।

তাহলে, কেউ যদি মার্থাকে বলে যে তার মনে হয়েছিল, ... দূর থেকে দেখার ফলে সেটা ভুলও হতে পারে, কিন্তু তবু... আর্থারকে সে গ্রাম থেকে এদিকে আসার রাস্তায় দেখেছে, তাহলে মার্থা ওই অবস্থায় কী করত?

ফাঁদ পাতা হল।

ডক্টর লেসিং-এর ঘরে গিয়ে, বাক্স থেকে চাবিটা বের করে, স্বস্তিতে ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে মার্থা ওই ঘরে গেল। দরজা খুলে মার্থা দেখল, ওর চোখে সূর্যের আলো পড়ে একদম ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। তখন, আরও স্পষ্টভাবে রাস্তাটা দেখার জন্য ও জানলার দিকে এগোল, কারণ, কোনো সদয় ব্যক্তি ওকে সাহায্য করার জন্য জানলার ধারে একটা কিছু রেখে দিয়েছিলেন। কেউ যাতে ধুলোয় পড়া পায়ের ছাপ থেকে তাঁকে চিনতে না পারে, তাই মেঝেটা ঝাড় দিয়েও রেখেছিলেন তিনি।

কী রাখা হয়েছিল সেখানে?”

“একটা দূরবীন।” খসখসে গলায় কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালেন হ্যাডলে।

“তবু,” তর্ক করার মতো করে বললেন ফেল্‌, “যে জানলায় গরাদগুলো এতই কাছাকাছি যে সেখান দিয়ে হাতও গলানো যায় না সহজে, সেখানে একটা দূরবীন লাগিয়ে দেখা যে খুবই কঠিন, তা আমরা সবাই জানি। যেদিকেই ঘোরান, গরাদগুলো সামনে পড়বে, আর ওগুলোই ফোকাসে আসবে। তখন আপনি কী করবেন?

আপনি অধৈর্য হয়ে দূরবীনটা কাত করে জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে আগে বাইরে বের করবেন। তারপর দু’টো গরাদের মধ্য দিয়ে হাত বের করে, গরাদে নাক-মুখ ঠেকিয়ে আপনি দূরবীনটা চোখে ফিট করবেন। তাই তো?”

অদ্ভুত শান্ত, ভদ্র, কিন্তু হিংস্র রাগে থরথর করে কাঁপছিলেন ফেল্‌। তবু নিজেকে শান্ত রেখে বলে চললেন তিনি।

“কিন্তু এই দূরবীনটা তো খুব সাদামাটা জিনিস ছিল না।

মার্থা সেটাতে চোখ লাগিয়েই বুঝেছিল, ছবি ঝাপসা আসছে। তাই সে মাঝের স্ক্রুটা ঘুরিয়ে ফোকাসটা ঠিক করার চেষ্টা করল। আর তখনই আঘাত হানল মৃত্যু! বিস্ফোরিত হওয়ার মতো করে একটা ধারালো স্টিলের হুক বেরিয়ে এল দূরবীনের পেছন দিকটা দিয়ে, আর মার্থার চোখ দিয়ে একেবারে মাথার ভেতর অবধি পৌঁছে গেল।

মার্থা পেছনদিকে ঠিকরে গেছিল সেই ধাক্কায়। সেজন্যই ও ঠিক জানলার কাছে ছিল না। কিন্তু ওর হাত থেকে নীচে পড়ে গেছিল দূরবীনটা, আর তার ভারী স্টিলের হুকটাই নীচের একটা রাজহাঁসের মাথাটা গলা থেকে প্রায় আলাদা করে দিয়েছিল। তারপর, দূরবীনটা তলিয়ে গেছিল জলে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ফেল্‌। একটা চুরুট হাতে নিয়েও সেটা না ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি।

“ব্যস্ত সলিসিটররা ‘হঠাৎ করে’ কোথাও আসেন না। তাঁদের ডেকে আনা হয়। ব্রাউনরিগ মাতাল অবস্থায় ছিল। জুনিয়র বাড়িতে ছিল না। দূরবীনটার নীচে পড়া দেখার জন্য কেউ ছিল না। কিন্তু খুনির একটা জবরদস্ত অ্যালিবাই দরকার ছিল। তাই ওই সলিসিটারকে ডেকে আনা হয়েছিল। মার্থাই ছিল এই বাড়ির একমাত্র সদস্য, যাকে ফাঁদে ফেলে ওইভাবে মারা যেত, যাতে পুলিশকে বিভ্রান্ত করে, তাদের নজর ডক্টর লেসিং-এর খুনির থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।

বাড়িতে একজনই ছিল যে, নিজের জবানবন্দি অনুযায়ীই, মার্থার মৃত্যুর আগে তার সঙ্গে কথা বলেছিল।

বাড়িতে একজনই ছিল যে মণিকারের সঙ্গে কাজ করত, এবং তার ফলে একটা দূরবীনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করার মতো দক্ষতা এবং যন্ত্রপাতি, দুই-ই যার কাছে ছিল।

ফলে প্রশ্ন থাকে একটাই।”

সোজা জোসেফ লেসিং-এর দিকে ঘুরে প্রশ্নটা করলেন ফেল্‌। অন্ধকারেও তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

“পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করেনি কেন?”

“করেছিল।” শান্তভাবে বললেন জোসেফ লেসিং, “আমি মাত্র মাসখানেক হল ব্রডমুর থেকে ছাড়া পেয়েছি।”

আবার একটা দেশলাই জ্বলে উঠল অন্ধকারে। নিভে যাওয়া পাইপটা ধরিয়ে নিলেন জোসেফ।

“তাহলে আপনি...” রাগ, বিস্ময়, বিরক্তি, সবকিছু নিজের গলায় মিশিয়ে বলে উঠলেন হ্যাডলে, “এতক্ষণ ধরে আমাদের এইসব শোনাচ্ছিলেন কেন? কী জানতে চাইছিলেন আপনি?”

“আহ্‌! আপনাদের তো গোড়াতেই গলদ হয়ে গেছে।” শান্তভাবে বলেন জোসেফ লেসিং, “ডক্টর লেসিং আর মার্থা-কে কে খুন করেছিল, সেটা আমি আদৌ জানতে চাইনি। আমার প্রশ্নটা অন্য।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ব্রাউনরিগ আর জুনিয়র বলেছিল, আমার মা পাগল ছিলেন। আমিই ওদের বাধ্য করেছিলাম কথাটা বলতে। বলেছিলাম, ওরা যদি ওইরকম বলে আমার ফাঁসি যাওয়া ঠেকিয়ে ব্রডমুরের পাগলাগারদে যাওয়ার ব্যবস্থা না করে, আমি সত্যি কথাটা বলে দেব।

সত্যি এটাই, যে আমার নয়, বরং ওদের, মানে ব্রাউনরিগ-জুনিয়র-মার্থা-র মা পাগল ছিলেন। ওই ওপরের ঘরটা থেকেই তিনি নীচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, তাই জানলায় গরাদ লাগানো হয়েছিল। ব্রাউনরিগ আর জুনিয়র দু’জনেই ভেবেছিল, তাদের মা পাগল ছিলেন, এই কথাটা জানাজানি হলে তাদের পেশাগতভাবে সর্বনাশ হবে।

তাই, আমার প্রশ্ন একটাই মহোদয়গণ।”

অন্ধকারে উঠে দাঁড়ান জোসেফ লেসিং। তাঁর সাদা টুপির নড়াচড়া, আর পাইপের মধ্যে ধিকিয়ে ওঠা ফুলকি দেখতে পান হ্যাডলে আর ফেল্‌।

“আমি পাগল নই, ছিলামও না। আর আমার মা-বাবাও সুস্থই ছিলেন।

তাহলে আমার আশ্রয়দাতা, সহৃদয় মানুষটিকে, এবং তারপর একটা বাচ্চা, হাসিখুশি মেয়েকে, আমি কেন মারলাম বলতে পারেন?”

লনে ঘন হয়ে ওঠে নৈঃশব্দ্য।

হাওয়ায় মড়মড়িয়ে ওঠা গাছের নীচ দিয়ে, অন্ধকারের সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার মতো করে সাদা টুপি পরা মাথাটা দুলতে-দুলতে সরে যায়।

মূল কাহিনি: “দ্য রং প্রবলেম”
প্রথম প্রকাশ: ১৪ই অগস্ট, ১৯৩৬, লন্ডন ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায়