মানুষের বন্দি - শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

এক গ্রামে বহুকাল ধরে মহানন্দে বাস করত দুই ভূত – রুকি আর বুকি।

নিশিসায়র নামে ঘুটঘুটে কালো জলের এক বিরাট দিঘি বিছিয়ে আছে গ্রামের একধারে। তার দক্ষিণে কোমর অবধি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে দুখানা তালগাছ, তার ওপর ওদের বাসা। কবে যে তালশিয়রে ঠাঁই নিয়েছে দুজনে তা নিজেদেরও স্মরণ নেই। দিনের বেলায় এধার-ওধার ঘুরে বেড়ায়, সন্ধে হওয়ার আগে ওরা উঠে পড়ে তালগাছের টঙে। চারধারে আঁধারের ঘোর নেমে এলে বড়ো ভয় করে রুকি-বুকির। তখন এ এদিক থেকে গাছের মাথা ঝাঁকায়, ওদিক থেকে ও ঝাঁকায়। এইভাবে পরস্পরকে সাহস জোগায় ওরা।

কিন্তু মানুষজন তো বুঝতে পারে না। তারা ভাবে – হাওয়া নেই বাতাস নেই থেকে থেকে গাছের মাথা দোলে কেন? তবে নিশ্চয়ই অশৈলি কাণ্ড। এই ভয়ে নিশিসায়রের দক্ষিণধারে ঘেঁষে না। সকালবেলা, যখন বেশ ভিড় জমে যায় দিঘির ঘাটে ঘাটে, তবুও ওদিকটায় যেতে চায় না কেউ, পাছে গায়ে কুবাতাস এসে লাগে। মানুষের পা না পড়ে পড়ে ঝোপঝাড়ে ভরে ওঠে দক্ষিণধার, ফনফনিয়ে ওঠে লতাপাতা। থোকা থোকা আকন্দ রোদ পড়ে চকচক করে, কালকাসুন্দার হলুদ ফুলে উড়ে বেড়ায় উদাসী ভ্রমর। তার তো আর ভূতপ্রেতের ভয় নেই!

এই দূরে-ঠেলা একেবারে ভালো লাগে না রুকি-বুকির। কী আশ্চর্য, ওরা কি কাউকে ভয় দেখিয়েছে নাকি কানে কু দিয়ে পালিয়ে গেছে ধাঁ করে? আপনমনে থাকে ওরা, একটেরে, মানুষের সঙ্গে ওদের কীসের দেওয়া-নেওয়া? নিজেদের বোকামোর জন্য শুধু শুধু সহজ সরল দুটো ভূতের ঘাড়ে দোষ চাপানো।

একেকদিন, অন্য গাঁয়ের অচিন মানুষ এসে যখন দক্ষিণের ঘাটে নামে, পা ধোয়, আঁজলা ভরে জলের ঝাপটা দেয় মুখে, ভারি আনন্দ হয় রুকি-বুকির। ওরা পাখার মতো দুলিয়ে দেয় তালপাতা যাতে বাতাস পেয়ে পথিকের সকল ক্লান্তি যায় ঝরে। ধুপধুপ করে খসিয়ে দেয় পাকা তাল, সাঁ করে হাওয়ায় সাঁতার টেনে নিয়ে আসে পাকা আতা আর তাকে ভাসিয়ে দেয় জলে। দেখতে পেয়ে কেউ কেউ ভেঙে খায়, মমতায় টলমল করে ওঠে রুকি-বুকির বুক। আহা, কবে কাউকে এমন করে আতিথ্য দিয়েছে, সেই কোনো মানুষজন্মে, আজ আর মনেই পড়ে না। পথিক চলে গেলে, ওরা তার শিয়র ঢেকে অনেক দূর অবধি ছায়া দিতে দিতে যায়। যদি এসব খবর এতটুকু রাখত মানুষ, তবে কি ওইরকম আজেবাজে দোষারোপ করতে পারত?

নিশিসায়রের জল মিশমিশে কালো। সকালবেলায় আলো পড়ে যখন অনেকখানি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে গাঁয়ের আর সব পুকুর-খাল-বিলের জল, নিশিসায়রের শ্যামরূপ এতটুকু টলে না। সে জন্ম থেকেই ঘন কালো। গভীর নিকষ কালো। এই কালো রূপেই তার শান্তি। তার অহংকার। আর ঝোপঝাড়ের নিবিড় ছায়া পড়ে জলের কৃষ্ণবর্ণ সবচেয়ে গাঢ় হয়ে ওঠে দক্ষিণকোণে। তাই সে ঘাটে নাইতে আসে সদানন্দ জেলের মেয়ে রুন্তি। এই বারো বছরেই ওর মাথায় চুলের ঢল, দেহ-মনে হাজার গুণ আর হৃদয়ে অথই দুঃখ। দুঃখ হবে না, ওর মা নেই যে। ঘরে সৎ মা। না, সে মারে-ধরে না, খাওয়ার খোঁটাও দেয় না। বরং বলতে গেলে মানুষটা ভালোই। কিন্তু সে যে সোহাগও করে না। মেয়ের পাতে কক্ষনও তুলে দেয় না নিজের ভাগের তালবড়া কিংবা আলেকালের মিঠাই-দরবেশ। কাছেই যদি না টানবে, তবে সে মা কীসের? কারো কোনো ভুলভ্রান্তি দেখলে মুখরা হয়ে ওঠে মানুষটা। রুক্ষ গলায় চেঁচামেচি করে। আর এই বকুনির মধ্যেও রুন্তি টের পায় – ওর মা নেই।

চলতে ফিরতে খুব ছেলেবেলায় দেখা অস্পষ্ট একটা মুখ মনে পড়ে রুন্তির, মনে পড়ে তার বকুনিও, রাগের কণ্ঠে বলা সেসব কথার ভেতরেও ছলাৎছল নেচে উঠত নিশিসায়রের জল। কবে যে মা চলে গেল, কবে যে নতুন মানুষটা এল বাড়িতে, ওর আর খেয়াল হয় না। ছোটো থেকেই রুন্তির মাথায় অঢেল চুল, দুহাতে তাকে সামলাতে পারত না মা। রোজ তেল-জল মাখা করতলে বেঁধে দিত যত্ন করে। নতুন মা এসব করে না। সে খাওয়ার সময় খেতে দেয়, কোনোদিন নাইবার সময় পার হয়ে গেলে খেয়াল করিয়ে দেয়। ইস্কুলে যাওয়ার আগে মুখের সামনে নামিয়ে দেয় ভাতের থালা। অসুখ-বিসুখ হলে পথ্যিও দেয়। কিন্তু সবই বড়ো দূর থেকে। কী হলে যে এই ভয়ানক দূরত্বটা ঘুচে যাবে, সে কথাই দক্ষিণের ঘাটে বসে ভাবে রুন্তি।

ওকে দেখে ভারি খুশি হয় রুকি-বুকি। এই মেয়েটার মতো যে কেন হয় না সবাই? ও তো রোজ আসে, দুপুরে স্নান সারে, সাঁঝের মুখে গা ধোয়, ছুটির দিনে কাপড় কাচতে আসে; কই, এক-চুলও ক্ষতি হয়েছে ওর? কুবাতাস-টাতাস ওসব বাজে কথা। চোখে দেখা যায় না যে হাওয়া, তার আবার সু-কু-এর কী আছে?

যেখানেই থাকুক না কেন, রুন্তির আসবার সময় হওয়ামাত্র ঠিক ফিরে আসে রুকি-বুকি। দূর থেকে ওর ছোট্ট মূর্তিটা নজরে এলেই, ওরা হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয় আমন্ত্রণ – এসো এসো এসো...। ওদের পুলকে দুলে ওঠে ফুল-ভরা ঘেঁটুঝোপ, গুটিকতক সুপুরির ফুল ঝুরঝুরিয়ে যায় ঝরে, রুন্তির পথে পড়া দু-একটা শেয়ালকাঁটা গাছের কাঁটাগুলো যায় ভোঁতা হয়ে – যাতে মেয়ের গা কেটে-ছিঁড়ে না যায়। অদৃশ্য দুই বন্ধুর আনন্দের মধ্যে, অকারণ খুশি আর নিমন্ত্রণের মধ্যে, চুলের পাখনা ছড়িয়ে জলে নামে রুন্তি। নিশিসায়রের মিশমিশে কালো জল ওর স্পর্শ পেয়ে শীতল হয়ে যায়।

একদিন সন্ধেবেলা, দুনিয়াদারি সেরে যখন যে যার গাছে গুছিয়ে বসেছে, আকাশের এধারে-ওধারে পিটপিট করে চোখ মেলেছে তারার দল, হঠাৎ বুকির চোখে পড়ল কী যেন একটা চকচক করছে দক্ষিণঘাটে।

এ্যাই রুকি, ওই দ্যাখ। কী রে ওটা?

কোথায় কী?

আরে, দেখতে পাচ্ছিস না, ঘাটের ওপর, এক্কেবারে ওপরের ধাপটায়... কী যেন ঝিকোয়...

সত্যি তো! কী বল তো?

বলতে না বলতেই রুকি টুক করে ঘুরে এসে বলল, একটা রুপোর মল রে বুকি। নিশ্চয়ই রুন্তি ফেলে গেছে। ওটার ওপর চাঁদ-তারার আলো পড়ে ঝিকমিক করে উঠছে।

ওহ, কিন্তু এখন কী হবে?

কীসের কী হবে?

ও যে ওটা ফেলে গেল?

তাতে কী হয়েছে, আর কেউ তো আসে না এ-ঘাটে, কাল আবার ঠিক নিয়ে যাবে।

কিন্তু যদি ঝোড়ো হাওয়ায় জলে পড়ে যায়? কিংবা ধর যদি কেউ কাল আসে, অচিন গাঁয়ের কেউ, সে যদি চুরি করে নেয়?

তাও তো ঠিক কথা।

ভাবতে ভাবতে গম্ভীর হয়ে আসে দুজন। ওরা যে জিনিসটা তুলে এনে রেখে দেবে, তা হওয়ারও জো নেই, কেন না না বলে পরের জিনিসে হাত দেওয়ার ক্ষমতা ভূতেদের নেই। এদিকে পায়ের মল হারিয়ে ফেললে বাড়িতে যে বকা খাবে রুন্তি। তাহলে কী উপায়?

ভাবতে ভাবতে রাত হয়ে আসে। আকাশ বেয়ে আরও খানিকটা উঠে পড়ে চাঁদ। নাম না জানা রাতফুলের গন্ধ বইতে থাকে এলোমেলো হাওয়ায়। ডুবো তালগাছের শিরে বসে দুই ভূতের আর ঘুম আসে না। গাছ-ঝাড়া দিয়ে পরস্পরকে জানান দিতে ভুলে যায় ওরা। গ্রামের অন্যধার দিয়ে ঝিকঝিক করে ছুটে যায় রাতের ট্রেন, তার বাঁশির সঙ্গে সুর মিলিয়ে ডেকে ওঠে কুকুরের দল।

এইভাবে প্রহর কাটে।

হঠাৎ বুকির মাথায় কী খেয়াল হতেই ও ঝুপ করে দিঘির পাড়ের কাছটায় নেমে, হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে, হাতজোড় করে বিড়বিড় করতে লাগল। হয়েছে কী, রুন্তির জন্য চিন্তায় ভেঙে পড়ছে মন, কাকে বলবে কাকে বলবে, হঠাৎ বুকির চোখে পড়েছে আকাশের বুকে ফুটে উঠেছে ধনুক-হাতে এক নক্ষত্রদেবতা। তিনিও এই দুই বন্ধুর মতোই নিঃসঙ্গ এক মানুষ, কেবল একটা ছোট্ট কুকুর সঙ্গে করে ওই মস্ত অন্তরিক্ষ পাহারা দেন। আর কোনো উপায় না দেখে তার কাছেই প্রার্থনা শুরু করল বুকি। বেশি কিছু নয়, ও যেন ওই মলখানা কুড়িয়ে নিয়ে রুন্তিকে দিয়ে আসতে পারে। ব্যাস।

একজন নিঃসহায় মানুষের আকুতি আর কেউ শুনতে পাক না পাক আরেকজন একাকীর কাছে পা টিপে টিপে ঠিক গিয়ে পৌঁছয়। বুকির প্রার্থনাও অনুভব করলেন আকাশের প্রহরী। ওই উঁচু থেকে ঝুঁকে ফিসফিস করে তিনি বললেন, কী মনস্কাম?

আপ্লুত বুকি বলল, একটুখানির জন্য আমাদের দুজনকে শরীর দাও যাতে রুন্তির গয়নাটা দিয়ে আসতে পারি। নিশ্চয়ই খুব কষ্টে আছে ও।

ঠিক আছে। শরীর দেব। কিন্তু তার শর্ত আছে।

শর্ত!

হ্যাঁ। এই পৃথিবীর কোনো শরীরই যে শর্ত ছাড়া জন্মায় না।

কেমন শর্ত?

প্রথম শর্ত, তোমরা দুজন নয়, শুধু তুমি শরীর পাবে। একা। তাও একদিনের জন্য। রাজি?

শুধু আমি? কেন, রুকিকেও দিন না।

না। এই যে একদিনের বিচ্ছেদ, এই কষ্টের বিনিময়ে তুমি শরীর পাবে। বলো রাজি?

ইতস্তত করে রাজি হয়ে যায় বুকি। ধরতে গেলে গোটাগুটি একদিনও তো লাগবে না। একবেলার ব্যাপার – সকাল করে যাবে, রুন্তিকে খুঁজে মলটা দেবে, চলে আসবে – মিটে গেল।

রাজি। আর?

দ্বিতীয় শর্ত, কাজ মিটে গেলে, এইখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে আমাকে জানাবে, তোমার শারীরী রূপ আমি ফিরিয়ে নেব।

তাহলে তো আবার কালকের রাত্রি হতে হবে?

হ্যাঁ। আজ রাত্রে দেহ পাবে, কাল রাত্রে হারাবে। রাজি?

রাজি।

আর শেষ শর্ত হল, এই একদিনের মধ্যে যদি কারোর স্নানজল ও সিঁদুর একসঙ্গে ছুঁয়ে ফেলে তোমায়, তবে তার অনুমতি ছাড়া আর কিছুতেই শরীর ফেরাতে পারবে না তুমি। রাজি?

কেন, এমন কেন? কী আছে সিঁদুর ও স্নানজলে?

পবিত্রতা। নারীর আশ্চর্য পবিত্রতা। আমার ঐশী ক্ষমতা তাকে অতিক্রম করতে পারে না। বলো রাজি?

আচ্ছা। রাজি।

কথা শেষ হতে না হতেই বুকি দেখল আড়বাঁশির মতো ছিপছিপে আর দীঘল একটা দেহ পেয়েছে ও! ওর পায়ে কুরকুরি দিয়ে যাচ্ছে নিশিসায়রের মাছ। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ যেন শতাব্দীকাল পার করে আবার জড়িয়ে ধরছে ওকে। এই আশ্চর্য পুলকের মধ্যে বুকির মনে পড়ল রুকির কথা। বহুক্ষণ গাছের মাথায় একা রয়ে গেছে ও। এদিকে চারধার ঝেঁপে এসেছে জুজুবুড়ির মতো অন্ধকার। রুকিটা আবার একটু বেশিই ভিতু। বন্ধুর জন্য বড্ড মনকেমন করে উঠল বুকির। ও চিৎকার করে উঠল – রুকি, রুকি।

কেউ সাড়া দিল না।

আবার ডাকল বুকি। কোনো সাড়া নেই। শুধু একটা তালগাছের মাথায় সামান্য কাঁপন উঠে মিলিয়ে গেল। সে কী ওর দেখবার ভুল, নাকি বাতাস, নাকি রুকির সাড়া – বুঝতে পারল না বুকি। বহুকাল পরে দেহপ্রাপ্তির আনন্দের মধ্যে ভয়ের একটা সরু ধারা বয়ে গেল ওর বুকে।

সকালবেলা একটা শান্ত যুবক দোরে এসে খোঁজ করল রুন্তির।

রুন্তির মা তো অবাক! এ মুখ আগে গাঁয়ে দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না। তবে কোথাকার লোক? মায়াবি জল-ছলছলে চোখ, ভুরু দুখানা কপালের ঠিক মাঝঝানে এসে মিশে গেছে পরস্পরে। কাদের এমন মনকাড়া ছেলে?

রুন্তি তখন ছিল না। ভোর হতেই হারানো মলের শোকে আর মায়ের ওপর রাগে ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নৌকোয় চড়ে বসে আছে। রুন্তিদের বাসার পিছনদিকে কয়েক পা গেলে একটা মস্ত পিপুলগাছ। তার গায়ে সেই কবে থেকে হেলানো রয়েছে একখানা নৌকো। ওটাকে বানিয়েছিল সনাতন জেলের বাবা। কিন্তু কক্ষনও জলে নামায়নি। কেন বানিয়েছিল কে জানে! তা সেই নৌকোখানা হল রুন্তির খেলাঘর। গোঁসাঘরও।

রাতে খাবার সময় মায়ের চোখে পড়েছিল – মেয়ের পায়ের আঙুল খালি। তখন থেকেই শুরু। এ-কথা সে-কথায় বেশ পেকেই উঠল ঝগড়াটা। তাই সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘর ছেড়েছে মেয়ে। সে ছেড়েছে ছেড়েছে, মায়ের কিছু যায় আসে না। এ-মেয়ে বড়ো অভিমানী। আর গোঁয়ার। অবশ্য তিনি কারোর অভিমানের ধার ধারেন না।

জিজ্ঞেস করব না করব না ভেবেও নতুন-মা শুধিয়ে ফেললেন, কোত্থেকে আসছ বাছা?

প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বুকি। কী বলবে? আমতা আমতা করে মিথ্যেই বলল, আমগ্রাম থেকে।

আচ্ছা। তা কী দরকার?

রুন্তির সঙ্গে দরকার। ওর একটা জিনিস রয়েছে আমার কাছে।

কী জিনিস?

পায়ের একখানা মল।

মল? হ্যাঁ, সে তো উনি কাল খুইয়ে এসেছিলেন। তা তুমি কোত্থেকে পেলে?

ভূতেদের রক্তে মিথ্যে বলার অভ্যেস নেই। সব বলে দিল বুকি।

নিশিসায়রের দক্ষিণঘাটে।

তা সেখানে তুমি কী করছিলে গো?

আমি... আমি... মানে... পা ধুচ্ছিলাম।

ও, তা ওখানে?

এমনিই। অনেক দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম... তাই...

দূর থেকে? আমগ্রাম তো এই ঢিল ছোঁড়া দূরে বাছা!

কথা কইতে কইতে চোখ দুটো সরু করে বুকিকে দেখছিলেন রুন্তির মা। তার মুখজোড়া সংশয় ভেদ করে কীসের যেন এক চাপা আনন্দ ফুটি ফুটি করেও ফুটছিল না।

তা বেশ। আচ্ছা, মলখানা দেখে কেমন করে বুঝলে এটা রুন্তির জিনিস? তুমি কি ওকে চেনো?

আর উত্তর দিতে পারল না বুকি। দীর্ঘকাল এমন জটিলতার সম্মুখীন না হয়ে নির্ভার হয়ে গেছে ওর মন। সে কেবলই ভেসে যায়, অকারণ হরষে সারাদিনমান ভেসে ভেসেই বেড়ায় বন্ধুর সঙ্গে। এসব প্রশ্ন-উত্তর শক্ত রশির পাকে পাকে বেঁধে ফেলতে লাগল বুকিকে।

এদিকে সদ্য স্নান সেরে আসা রুন্তির মা, খোঁপায় গামছা পেঁচিয়ে দারোগার মতো একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেন। দরদর করে ঘামতে থাকে বুকি। এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই বুকির পায়ের ওপর আছড়ে পড়লেন রুন্তির মা আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন – আমাদের ঘরে ঠাকুর এসেছে গো... অমন দুখানা চোখ, জোড়া ভুরু, মুখে মাখানো আলো দেখেই বুঝেছি এ মনিষ্যি নয়... একবার গরিবের ঠেঁয়ে যখন পা রেখেছ ঠাকুর আর তোমাকে ছাড়ছি না...

অবস্থা বেগতিক দেখে পালাতে গেল বুকি। কিন্তু পারল না। টের পেল ওর পা দুটো পাথরের মতো ভারি। কারণ ততক্ষণে ওর পায়ের পাতায় মাখামাখি হয়ে আছে রুন্তির মায়ের সিঁথি থেকে ঝরা সিঁদুর ও বিন্দু বিন্দু স্নানজল। ভয়ে অবশ হয়ে এল বুকির দেহ।

ততক্ষণে মায়ের হাউমাউ শুনে ছুটে এসেছে রুন্তি। বুকির মুঠো খুলে খসে পড়া মল নিয়েছে কুড়িয়ে। ওরও বিশ্বাস হতে লেগেছে যে এই মানুষটা নিশ্চয়ই মানুষ নয়। নইলে জনমনিষ্যিহীন ঘাটে যে রুন্তি একটা মল ফেলে এসেছে, সে কথা এ-ছেলে জানবে কেমন করে?

রুন্তিদের বাড়ি কিছু একটা ঘটছে টের পেয়ে উঠোনে এসে জুটেছে কয়েকঘর পাড়াপড়শিও। তার মধ্যে সদানন্দেরই এক জ্ঞাতি পিসি খনখনে স্বরে বলে উঠলেন, ও গো, এ যে রাখালরাজা গো... আমাদের কানু... সেই ন্যাংটোবয়স থেকে তোমাকে ডাকছি ঠাকুর, কত্ত নাড়ু দিয়েছি, দুধ থেকে মাঠা তুলে ভোগ দিয়েছি, আজকে তোমার দয়া হল? বলি আজকে তোমার পেরানটা গলল ... একবার পেয়েছি যখন আর ছাড়ছি না... তুমি থাকো...

এই বলে বুকির একখানা কবজিতে নিজের থানের আঁচলখানা বেশ করে বেঁধে, গালে পান ঠেসে, পায়ের কাছ জড়িয়ে ধরে ঠাঁই গাড়লেন পিসি। তার দুচোখ দিয়ে দরদরিয়ে জল নামতেই থাকল, নামতেই থাকল।

আর এই সমস্ত সমাদরের মধ্যে হু হু করতে লাগল বুকির বুক। রুকিকে কিচ্ছুটি না বলে একটা দেহধারণ করেছে ও – তারই বুঝি শাস্তি হল। অজান্তেই তিরতির করতে লাগল ওর ঠোঁট – ‘রুকি... রুকি... রুকি...’ আর ভক্তরা ভেবে নিল বুঝি আশীর্বাদ দিচ্ছেন ভগবান। তারা মহোৎসাহে ওর চারধার ঘিরে বসে নিজেদের হাজার আবদার করে চলল, করেই চলল...

অনেক অনুরোধ-উপরোধেও রুন্তির মায়ের মন গলল না। তিনি বুদ্ধিমতী। কেন, কী বৃত্তান্ত না জানলেও কীভাবে তিনি টের পেয়েছেন বুকি এখানে আটকা পড়েছে। অগাধ আদর-যত্নে ভুলিয়ে, নরম বিছানা আর নতুন পোশাক পরিয়ে, বুকিকে তিনি বন্দি করে রেখেছন।

বুকি কিছুতে পালাতে পারে না। উঠোনের সীমা ছাড়ালেই পাথর হয়ে ওঠে পায়ের পাতা, সেই যেখানে একদিন মায়ের সিঁদুর আর স্নানজলের ছোঁয়া লেগেছিল। রুন্তিকে ও কত বলেছে যে ঠাকুর নয়, ও ভূত। শুনে শুনে রুন্তি বিশ্বাসও করেছে। ও-ও ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছে দক্ষিণঘাটের কাছে জোড়া তালগাছে দুটো ভূতের বাস। রুন্তি এও খবর দিয়েছে ওই জায়গাটা এখন কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। ঝোপঝাড়ে সেই আগেকার তেজ নেই, সব নুয়ে পড়েছে। লতায় আর ফুল ধরে না, দু-একটা যা ফোটে, তাদের মধ্যে আর মধু নেই। শুকনো-বুক ফুলে মৌমাছিও আসে না। বুকি টের পায় রুকির বিরহ ছেয়ে ফেলেছে নিশিসায়রের দক্ষিণদিক। কিন্তু উপায় কী?

একদিন বুকির হয়ে রুন্তি সব খুলে বলল ওর মাকে। শুনে তিনি খানিক মানলেন, খানিক বিশ্বাস করলেন না। বুকি যে ভূত, তার প্রমাণ কই?

রুন্তি ওকালতি করে বলল, প্রমাণ থাক আর না থাক, ও ঠাকুর হলেও তো কোনো কাজে লাগছে না তোমার।

কে বলল লাগছে না? আমার শরীরের কত ব্যথা-বেদনা কমে গেছে... তোর বাবার জালে আজকাল কত মাছ উঠছে... আমাদের গেরস্থালি কী সুন্দর ঠান্ডা আর গন্ধ-ভুরভুরে হয়ে আছে টের পাচ্ছিস না?

আসল কথা হল, বুকি তো ভালো মানুষ, মানে ভালো ভূত, তাই ওর উপস্থিতি একরকম আশীষের মতো ছড়িয়ে পড়েছে রুন্তিদের বাসায়। শুধু ওদের বাসাতেই বা কেন, ভিকুরামের মা-মরা ছেলেটার যখন ধুম জ্বর এল, এদিকে ওর বাবাকে মাছ ধরতে বেরোতেই হবে, তখন বুকিই তো রাত জেগে সেবা করে সারিয়ে তুলল ওকে। আর সদানন্দর পিসি যে ছানি-পড়া চোখেও আবার নতুন করে ছুঁচে সুতো পরাতে পারছেন, এ বুঝি কিছু নয়?

রুন্তিরও বেশ লাগছে। বুকি আসার পর থেকে মায়ের মনটা ভারি নরম হয়েছে। মুখে-চোখে একটা মায়ার পরত। আজকাল ভারি কাছে টানে। রুন্তি ভালোবাসে বলে আনন্দনাড়ু গড়ে দেয়। আঙুলের কোণ দিয়ে কাজল পরিয়ে দেয় চোখে। বুকিকেও খুব পছন্দ হয়েছে রুন্তির। শান্ত, নম্র একটা মানুষ। জোরে কথা বলে না, ধুলোমাখা পায়ে ঘরে ঢোকে না। রাত্রিবেলা বড়ো বড়ো চোখ দুটো মেলে নিষ্পলক তারা দেখে, আর থেকে থেকে ওর কাছে এসে বলে, আমাকে ছেড়ে দাও।

পুরুষ যদি কাছে এসে কাতর হয়ে ভিক্ষা করে, নারীর বুকে গোপন পুলক জাগবেই। এত সুন্দর ভিক্ষার ভঙ্গিমা, এত মধুর তার স্বর – বুকিকে কিছুতেই ছাড়তে ইচ্ছে করে না রুন্তির।

মোদ্দা কথা হল বুকির আর নিস্তার নেই। দেবতা হও, ভূত হও, সিঁদুর আর স্নানজলে একবার যখন বাঁধা পড়েছে, তখন থাকো। অনাদর তো হচ্ছে না, বরং উল্টোই। ঘরের ছেলেটির মতো দিব্যি রসেবশে রয়েছ। মনে মনে রুন্তির মা ঠিক করেছেন, একান্তই যদি ঠাকুর না হয়, এই শ্রীমন্ত ছেলের সঙ্গে রুন্তির বিয়ে দেবেন তিনি!

ওদিকে বুকির সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে না পেরে ধুধু বুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় রুকি। ও দেখতে পায় বুকি বাঁধা পড়েছে। ও ছেড়ে আসতে চাইছে, অথচ যেন পারছে না। এত কাল পরে এই মানুষি আদর ভালোই লাগছে ওর। কিন্তু এত ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা রুকিকে দানবের মতো ছিঁড়ে খায়। রাতের অন্ধকার যখন কিলবিলে আঙুলগুলো নাচায়, কবরের মাঠ থেকে শনশনিয়ে হাওয়া দেয়, ওর খুব ভয় করে। একেকদিন আকাশের তারাগুলোকে কাঁথামুড়ি দিয়ে গহন মেঘ জমে, তখন বুকির জন্য জোরে জোরে গাছ ঝাঁকায় রুকি। কিন্তু বুকি আসে না।

আর কিচ্ছু উপায় না পেয়ে একদিন আকাশের ধনুকধারী দেবতাকই ডাকতে লাগল রুকি। তিনিই তো এ-সর্বনাশটি করেছেন। ঠিক বুকি যেমন করে ডেকেছিল, সেইভাবে, হাঁটু-ডোবা জলে দাঁড়িয়ে অর্ধেকরাত্রিব্যাপী প্রার্থনার পর দেবতা এলেন।

বলো, কী চাও?

বুকিকে মুক্তি দিন।

আমার সে ক্ষমতা নেই।

তাহলে? আপনি কেমন দেবতা?

শরীর ধরতে চেয়েছিল বুকি নিজে। আমি স্পষ্ট করে তিনটে শর্ত দিয়েছিলাম। ও মেনে নিয়েছিল। কেন তখন ভাবেনি যে শরীর বড়ো শক্ত জিনিস? চাইলেই তাকে বাগে আনা যায় না? তাছাড়া তোমার বন্ধু তো মুক্তি চায় না।

কে বলেছে চায় না? চায়। আপনি ভালো করে দেখুন।

দেখেছি। ওর অর্ধেকটা মুক্তি চায়। বাকি অর্ধেকটা চায় ভোগ। সংসারের স্বাদ পেতে চায় বুকি।

তাহলে?

অপেক্ষা করো।

কতদিন?

ওর আরও ভোগ হোক। আস্তে আস্তে কটু হয়ে আসুক মনুষ্য-সংসারের স্বাদ। ততদিনে কণায় কণায় ক্ষয়ে যাবে স্নানজল আর সিঁদুরের জোর। তারপর ও নিজেই একদিন ছাড়া পাবে। ততকাল অপেক্ষা করো।

এই বলে আবার ধনুক উদ্যত করে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন দেবতা।

বিরাট ও নিঃসঙ্গ এক রাত্রির দিকে চাইল রুকি। এতদিন যে গায়ে গা লাগিয়ে থেকেছে দুটিতে, একদিনও ঝগড়া হয়নি ওদের। একটা পলও পরস্পরের সঙ্গে কথা না বলে কাটায়নি ওরা। আজ রুকির হাজার হাজার বছরের বন্ধুকে কেড়ে নিয়ে বন্দি করে রেখেছে মানুষের দল। কিন্তু বুকি তো একজনের ভালো করতেই চেয়েছিল? তবে কি মানুষের ভালো করতে নেই? নাকি, নিজেদের অজান্তেই এমন সব অত্যাচার করে ফেলে মানুষ?

অগণিত জিজ্ঞাসা অস্থির করে তোলে রুকিকে। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ও উঠে বসে গাছের মাথায়। ঝোপেঝাড়ে তখন জোনাকি জ্বলছে। চাঁদের আলোর কাছে রুকি ভিক্ষা করে সান্ত্বনা। অল্পস্বল্প মেঘ ভেসে আসে আকাশে। জ্যোৎস্না কমে বাড়ে। দুচোখ বুজে রুকি ঘুমিয়ে পড়তে চায় – যদি এতে দুঃখটা একটু কমে। আধোঘুমে ডুবে ও ডাকে – বুকি... বুকিই... বুকিইইই...

বাতাসে ভেসে আসা শিসের মতো সে ডাক পেয়ে নরম বিছানায় উঠে বসে বুকি। টের পায় পায়ের পাতা দুটো ভারি হয়ে আছে। কুলুঙ্গিতে নিভে এসেছে প্রদীপশিখা। নিশিসায়রের দক্ষিণধারের ঝোপেঝাড়ে ঝিকমিক করা জোনাকি দেখতে বড্ড ইচ্ছে করে বুকির। সেই যে যেমন করে ঘুম-না-আসা রাতগুলোয় রুকির সঙ্গে দেখত অপলক! সেই আশ্চর্য আলোর দুঃখে বুকি কাঁদতে থাকে। নিঃশব্দে কাঁদে রাতভর।