প্রেমের নেশায় - সায়নদীপা পলমল

অলংকরণ - বিভাবসু দে

“দেখা যো তুঝে ইয়ার দিল মে বাজি গিটার…”

 

সাত সকালে কৌশিকের এই ফাটা বাঁশের মত গলার গান শুনে ঘুম ভাঙলো গবার। বিছানায় উঠে বসে জানালার ধারে ভিড় করে বাইরে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকা নিজের ছয়জন সঙ্গীকে আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখলো গবা, তারপর রোজকার মত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে কাঁথা চাপা দিয়ে আবার উল্টে গেল বিছানায়।

আশুতোষ পল্লীর এই পুরোনো ফ্ল্যাটবাড়িটায় আবাসিক জনা ছয়েক ছেলের জীবনের একটাই লক্ষ্য “মেয়ে দেখাও, মেয়ে পটাও”। সকাল থেকে এরা একনিষ্ঠ হয়ে লেগে পড়ে কাজে; তবে সাফল্যের হারের হিসেবটা না কষাই ভালো। শুধু অমলই একবার একটা মেয়েকে প্রায় পটিয়ে ফেলেছিল কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ করে মেয়েটি কাঠবেকার অমলকে ছেড়ে আমেরিকানিবাসী ইঞ্জিনিয়ার বিমলের গলায় মালা দিয়ে বসল। আর বাকি সবার প্রেমের আয়ু তো ওই গড়ে এক থেকে তিনমাস। তবে এই মেসের সবাই এরকম নয়, ব্যতিক্রমও আছে একজন, আর সে হলো আমাদের গবা অর্থাৎ শ্রীমান গৌরব বটব্যাল। শান্তশিষ্ট ছেলেটার কাছে প্রেম মানে হলো গিয়ে একটা সাধনা আর প্রেমিকা হল গিয়ে ওই লক্ষী সরস্বতীর কম্বো প্যাক। কিন্তু দুঃখের বিষয় ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তাটা দিয়ে প্রতিদিন কতো মেয়ে আসে যায় কিন্তু আজ অবধি কাউকে ঠিক মনে ধরলো না ওর। এই মেয়েগুলোর কোনোটাকে দেখলেই সেই এলিজাবেথান যুগের রোম্যান্টিক সনেটিয়ারদের মত পুজো করতে ইচ্ছে হয়না।

 

ডিংডং…

সবাই তো এখন জানালার ধারে ব্যস্ত, অগত্যা ঘুম ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলল গবা। অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে নিমেষে ঘুম উড়ে গেল ওর, গলা দিয়েও কোনো স্বর বেরোতে চাইল না। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মত ঋজুর ফোনটা টেবিলের ওপরে বসে গেয়ে উঠলো, “এক নজর মে ভি পেয়ার হোতা হ্যা ম্যায়নে শুনা হ্যা...”

 

“বলছি আপনাদের বাথরুমে জল আসছে?”

মেয়েটার দিকে ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে থাকল গবা, মেয়েটার রূপে এমনই আচ্ছন্ন হয়ে গেছে ও যে তার কথাগুলো যেন ঠিক শুনতে পেলোনা ও।

“এক্সকিউজ মি, বলছি বাথরুমে জল আসছে আপনাদের?”

“হাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ আসছে…।” অনেক কষ্টে এবার তোতলিয়ে জবাব দিল গবা।

“ওহ। আমার টায় আসছে না।” দুঃখী দুঃখী মুখে বলল মেয়েটা।

গবার বুকটা কষ্টে মোচড় দিয়ে উঠল, আহারে বেচারি! সাতসকালে বাথরুমে জল না থাকলে সে যে কী ভয়ানক ব্যাপার তা কি আর আলাদা করে কাউকে বোঝাতে হয়!

“একচুয়েলি আমি না এখানে নতুন, কাউকে চিনিনা। প্লিজ একটু এসে দেখবেন কী হয়েছে।”

গবা কিছু বলার আগেই প্রেমিকার সন্ধানে উন্মুখ তরুণদল একসাথে এসে হাজির হয়ে গেল দরজার সামনে। অত্যুৎসাহে সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায়, কিন্তু সবাইকে একঝলক দেখে নিয়ে দরজার একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা গবাকে উদ্দেশ্য করে মেয়েটি বলল, “আপনি যাবেন?”

মেয়েটির প্রস্তাবে গবা সুদ্ধ চমকে উঠলো সকলেই, এত্তগুলা হ্যান্ডসাম ছেলে থাকতে মেয়েটার কিনা শেষমেশ পছন্দ হলো গবাকে!

***

শিরিনের ফ্ল্যাটে বসে চা খেতে খেতে গবা ভাবছিল কী করে সে শিরিনকে বলবে ওর মনের কথা! মেসের সবকটা ছেলেই তো তক্কে তক্কে আছে, সবাই শুধু মনে মনে ফন্দি এঁটে চলেছে। বলা যায়না কে কবে ওর শিরিনকে চুরি করে নেয়! সেদিন বাথরুমের কল ঠিক করার সূত্র ধরে গবার সাথে আলাপ শিরিনের। এরপর কী করে কে জানে মেয়েটা এই অল্পদিনেই খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে গবার, মেয়েটা খুব ভরসা করে ওকে, যে কোনো কাজে গবার সাহায্য চায়। গবা ভাবে এই হয়তো ভগবানের ইশারা। ওর বিশ্বাস শিরিন ওর মনের কথা জানলে ওকে ফেরাবে না কখনোই, কিন্তু সমস্যা হলো আজ অবধি কখনো কাউকে প্রপোজ করেনি গবা তাই সে ভেবেই পাচ্ছে না কীভাবে বলবে শিরিনকে। গবার মেসের বন্ধুগুলো তো সব একেকটা যা হিংসুটে ওদের কাছে সাহায্য চাওয়াই যাবে না।

 

“হ্যালো”

…….

“আরে মশাই আমি তো আপনার পুরোনো কাস্টমার, আপনার কি মনে হয় আমি টাকা দেবোনা আপনাকে?”

…….

“এভাবে বলছেন কেন?”

…….

“কাল সম্ভব না, প্লিজ। পরশু শিওর।”

……

“আরে মশাই বোঝার চেষ্টা করুন, আমি খুব সমস্যায় আছি। কাল কিছুতেই পারবো না।”

……

“বলছি তো…. হ্যালো… হ্যালো…”

 

বিরক্ত মুখে ফোনটা হাতে নিয়ে এই রুমে ঢুকলো শিরিন, যদিও কলটা আসতে সে উঠে রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল কিন্তু তার উত্তেজিত হয়ে বলা কথাগুলো এই রুমে বসে গবার কানে দিব্যি পৌঁছেছে। অপর প্রান্তের কথা না শুনলেও শিরিনের কথাগুলো শুনে গবা আন্দাজ করতে পারলো কিছু একটা সমস্যায় পড়েছে মেয়েটা। সবই আসলে ভগবানের ইশারা, ভগবান চান যে গবা সাহায্য করুক শিরিনকে আর সেই সুযোগে আরও কাছাকাছি আসুক ওরা দু'জন।

 

“এনি প্রবলেম শিরিন?”

“উম?… না, ঠিক আছে সব।”

“চাইলে শেয়ার করতে পারো।”

“কী বলি বলোতো!”

“সেটাই যেটা তোমার এই মিষ্টি মুখটাতে আঁধার নামিয়েছে।”

“ধ্যাৎ তুমি না… সব সময় ফ্লার্ট করো শুধু।”

“শুনে ভালো লাগলো, আমার মেসের বন্ধুগুলো তো বলে আমার এই ট্যালেন্টটা একদমই নেই।”

“ওহ প্লিজ, ওদের কথা ছাড়ো তো। উম্যানাইজ্যার সব কটা, ওরা তোমাকে কোনোদিনও চেনার চেষ্টাই করেনি।!”

“আর তুমি?”

“যদি বলি এই ক'দিনেই এতটা চিনেছি যতটা তুমি নিজেও চেনোনি নিজেকে।”

শিরিনের বলা কথাগুলো যেন কানে নয়, সোজা এসে কিউপিডের তিরের মত বিঁধে যায় গবার বুকে। অপলক দৃষ্টি নিয়ে ও তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে, এ কি সত্যিই মানুষ নাকি স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো পরি! মানুষ কি আদৌ এতো সুন্দর হয়!

“কী হলো ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

“ক্ক… কিছু না। তোমার সমস্যাটা কী হয়েছে এবার বলো।” নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে গবা।

“একচুয়েলি আমার বোন হোস্টেলে থাকে, একটু আগেই জানলাম ওর শরীরটা বেশ খারাপ সকাল থেকে। এই সন্ধ্যেবেলায় তো ওর কাছে যাওয়া সম্ভব না, তাই কাল গিয়ে ওকে নিয়ে আসব ভাবছিলাম, কিন্তু…”

“কিন্তু কী ?”

“ক'দিন আগে একটা দোকানে খুব দরকারি কিছু জিনিস কিনে দেখি আমার পার্সটা সঙ্গে নেই, কোথাও পড়ে গেছিলো বা চুরি হয়ে গেছিলো। যাইহোক, পরিচিত দোকান তো তাই বললো নিয়ে যান জিনিসগুলো পরে টাকা দিয়ে যাবেন।”

“ওকে। দেন?”

“বিভিন্ন কাজের ঝামেলায় টাকাটা এখনো দিয়ে আসা হয়নি আমার। কিন্তু আজ ওরা ফোন করে এমন অপমানজনক সব বললো যেন টাকাটা না দিয়ে পালিয়ে গেছি কোথাও। বলছে কালই দিতে হবে...কিন্তু…”

“হুম, বুঝতে পারছি সমস্যাটা। আচ্ছা ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড দোকানটার ঠিকানা দিলে আমি গিয়ে দিয়ে আসতে পারি টাকাটা।”

“রিয়েলি! ওহ গৌরব সো কাইন্ড অফ ইউ। বাট…”

“কী হলো?”

“প্লিজ তোমার মেসের ছেলেদের এসব কিছু জানতে দিও না। ওরা কী ভাববে কে জানে! এমনিতেই ওরা যেন কেমন একটা।”

“আরেহ... রিল্যাক্স। কেউ কিছু জানবে না। তুমি ঠিকানাটা বলো।”

***

এই তো, এই দোকানটার ঠিকানাই দিয়েছিল শিরিন। গবা চেয়েছিল শিরিনের বকেয়া টাকাটা নাহয় নিজেই পেমেন্ট করে দেবে কিন্তু শিরিন রাজি হয়নি। মেয়েটার আত্মসম্মানবোধ বড়ো বেশি, কারুর থেকে কোনো সুযোগ নেয় না কখনো। এই জন্যই তো গবার এতো ভালো লাগে ওকে। মেয়েটা টাকাটা দিয়েওছে কীরকম সুন্দর ব্রাউনপেপারে প্যাক করে; উফফ যেন সাক্ষাৎ মা লক্ষী!

 

রাস্তা পেরিয়ে সবে দোকানটায় উঠতে যাবে গবা ঠিক তখনই কেউ এসে খপ করে ধরল ওর হাতটা,

“পেয়েছি চাঁদু তোকে।”

“একি! কী হলো?” চমকে উঠে গবা দেখলো একজন উর্দিধারী পুলিশ ধরেছে ওর হাতটা, তার মুখটা বেশ খুশি খুশি। আর আরেকজন এসে ওর ব্যাগটা কাড়িয়ে নিয়ে তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজছে।

“পেয়েছি স্যার”, শিরিনের দেওয়া ব্রাউন প্যাকটা হাতে নিয়ে পুলিশটা হাঁক পাড়লো ওদের জিপটা লক্ষ করে।

এরপর জীপের ভেতর থেকে যিনি নামলেন তাকে দেখে গবা কতটা অবাক হলো তা বোঝা না গেলেও তিনি যে ওকে দেখে একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন তা স্পষ্ট বোঝা গেল যখন তিনি মুখ বিকৃত করে বললেন,

“শিট, এবারেও ফসকাল!”

“আশীষ দা!” চিৎকার করে উঠলো গবা।

“এই তুই স্যারকে চিনিস!” অবাক বাকি পুলিশগুলো।

***

সরি গবা। আমি চেষ্টা তো করছি বাট তাও সেভাবে আশ্বাস দিতে পারছিনা তোকে, সরি।”

“আমার কী দোষ আশীষদা? আমি তো শুধু…” কেঁদে ফেললো গবা।

“আই নো গবা ইউ আর ইনোসেন্ট… একচুয়েলি ইউ নো হোয়াট, দিস ইজ দ্য মেন প্রবলেম। শিরিন, অপালা, রাই… কতো নাম যে ওর। ও তোর মতো ইনোসেন্ট ছেলেগুলোকেই টার্গেট করে নেশার জিনিসগুলো পাচার করার জন্য, একটা পুরো গ্যাং আছে ওদের। মেয়েটা প্রতিবার আমাদের হাত ফসকে পালায়, আর ধরা পড়ে তোদের মত বোকা ছেলেগুলো। এর আগে কোনোবার মালসুদ্ধ ধরতে পারিনি বলে আগের ছেলেগুলোকে ছেড়ে দেওয়া গেছে বাট ইউ…”

“কিন্তু…”

“আই নো গবা, আই নো… বুঝতে পারছি তোর অবস্থাটা। প্রেমের নেশায় পড়ে কী খেসারতটাই না দিতে হচ্ছে এখন। যাইহোক, বেস্ট অফ লাক ব্রো। আমি একটু বেরোলাম, তুই থাক এখানে।”

 

মনের দুঃখে চোখ বন্ধ করে ফেলল গবা; চোখের কোণ থেকে একটা জলের ফোঁটা নিঃশব্দে ঝরে পড়ল মেঝেতে আর সেই ফোঁটার মধ্য দিয়ে ওর স্বপ্নে সাজানো লক্ষী-সরস্বতীর মূর্তিটা আস্তে আস্তে কেমন তালগোল পাকাতে পাকাতে শেষমেশ ঠাকুমার ঝুলিতে দেখা শাঁখচুন্নীতে রূপান্তরিত হল...