জল’কে চল্ - রুমেলা দাস

অলংকরণ - মৈনাক দাশ

এই ম্যাজিক আওয়ার-টা নষ্ট করতে চায়নি সৌম্যলেন্দু। সেপ্টেম্বরে এমন ফুটো আকাশ পাবে ভাবেইনি। ভেবেছিলো পুজোর ভিড় এড়িয়ে দু-দণ্ড ঘুরে যাবে! তা আর কী করা যায়! ভগো-র যা ইচ্ছে! ভাইজাকের রামকৃষ্ণ বিচের কাছাকাছি হোটেল ‘গ্রীন ভিউ’তে উঠেছে সবে একদিন হলো! বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই! আকাশের মুখ দেখতে পেলো কি না পেলো! উড়ে উড়ে কোথা থেকে চলে আসছে হতভাগা কালো মেঘের দল। আর ঢেলে দিচ্ছে! এই একটাই তো নেশা! এর টানেই ঘুরে বেরিয়েছে সেই বছর কুড়ি থেকে! এমন ছবি পাগলা ছেলে কতক্ষণ আর হাত-পা গুটিয়ে রুমে বসে থাকে! এখন ৫টা বেজে ৪০মিনিট হয়ে গেছে! সূর্য ডুবতে ডুবতে এখনো মিনিট কুড়ি মতন হাতে পেলেও পেতে পারে! ওর মত ফটোগ্রাফারের এটাই ‘ম্যাজিক আওয়ার’! ঠিক সূর্য ওঠা আর অস্ত যাবার আগে আগে! আলোর উৎস, পরিমাণ, প্রতিফলন এইসময় মোটামুটি ঠিক থাকে! আলো কম যদিও বা হয়, আই-এস-ও বাড়িয়ে ঠিক ছবি তুলে নেয়! বিচের নোনা ধরা ভিজে হাওয়াটা মুখে, চোখে লাগছে ওর! মনে হচ্ছে, খুব বেশি সময় আকাশ পরিষ্কার থাকবে না। দূরের মাথা নিচু শেওলা রঙের পাহাড়টার আড়াল থেকে গোল গোল তালের মত মেঘগুলো গুটি মেরে এগিয়ে আসছে! চটপট কাজটা সেরে নিতে হবে! এই ওয়াদারে ক্যামেরা বের করা বেশ রিস্ক। নোনতা হাওয়া মানুষের খিদে বাড়ালেও, ক্যামেরা লেন্সের চরম শত্রু! তবু জেদ। ছবি ও তুলবেই! ভিউপয়েন্ট, কম্পোজ ও এক্সপোজারের সামান্য হেরফের করে ছবি তুলে নেবে।

লেন্স হুড খুলে হাত দুটোকে উপরে সামান্য তুলে অ্যাঙ্গেল ঠিক করে। কিছুটা দূরে যেখানে একটা পাগলা মতন লোক হাত-পা ছড়িয়ে ময়লা জামা কাপড়ে বসে আছে বালির উপর! ওর ঠিক সামনেই অনেকগুলো পাথরের ঢিবি। উপুড় হয়ে রয়েছে একের পর এক! ওটাকে লক্ষ্য করেই লোকটা হাত থেকে কীসব ছুঁড়ছে। নুড়ি, পাথর-ই হবে! বৃষ্টির জন্য লোকজন বিশেষ না বেরোলেও, পাগলের শান্তি নেই! মনে মনে হাসে সৌম্যলেন্দু। একটু পরেই দলে দলে হুল্লোড় করতে এসে যাবে ট্যুরিস্ট। পা ফেলার জায়গাও থাকবেনা। মাথা নিচু দোকানগুলো থেকে আশ্চর্য, ইউনিক জিনিসের লোভে আরো ভিড় বাড়ায় মেয়ে, বউরা। গোল থালার মত সূর্যটাকে লেন্সে ধরতেই হবে! মিনিট তিনেক! চোখ ছোট করে সবেমাত্র মনোযোগ করেছে, তখনই দ্যাখে অস্পষ্ট একটা সাবজেক্ট আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ওর লেন্সপথে। উঁচু, নিচু, মাঝারি ঢেউয়ের সাথে ক্রমশ কাছে আসছে, আরো! এলোমেলো অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরি হচ্ছে মনে। এ সময় লেন্স থেকে চোখ সরানোটা ঠিক নয়! ফোকাস অ্যাডজাস্ট করে, ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার করতেই আরো একটু স্পষ্ট দেখতে পেলো ও! দিনশেষের লাল আভা মেখে এক অপূর্ব নারী শরীর! উজ্জ্বল ত্বক, নিটোল মুখশ্রী, গুরু বক্ষ, ক্ষীণ কটি মিলিয়ে ভালোলাগার দাঁড়িপাল্লা কানায় কানায় পূর্ণ! কী দুর্বার আকর্ষণ! স্তব্ধ হয়ে দেখা ছাড়া উপায় কী ! সরাতেই হলো লেন্সটা! মেয়েটা একেবারে ওর সামনে! বলতে এতটুকু বাধা নেই! ও মুগ্ধ! টুকরো ভেজা জলের কুঁচিরা সার বেঁধে মেয়েটার কপাল, চুলের সামনের অংশে! কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ ওর পাশে এসে দাঁড়ালো কেন? বুঝতে পারছে না। চেহারার গড়ন দেখে ঠিক বাঙালি বলে বোধ হচ্ছে না। লং আসমানী রঙের একটা টপ, পা পর্যন্ত ঢাকা। হাতের কিছুটা বেরিয়ে আছে! আরেকটা হাতে কিছু একটা রয়েছে! তবে যেমনি হোক! এমন পরিবেশে এমন সুন্দরীর সঙ্গে যদি কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়া যায়! মন্দ কি? কথা বলাটা ঠিক হবে কি? আশপাশটা দেখে নিয়ে কিছু বলবে ভাবতেই...

“এখানকার প্রকৃতি কী সুন্দর তাই না?” ওকে অবাক করে ঝরঝরে বাংলায় মেয়েটা বলে উঠলো।

“আপনি বাঙালি?”

“ওই দিকটা দেখুন! পাহাড়ের আড়ালে কত আড়াল!”

সৌম্যলেন্দু ভাবলো, কবি নাকি? মেয়েটা ডান হাত তুলে দেখাচ্ছে পাহাড়ের দিকে! মিষ্টি গন্ধটা মেয়েটার গা থেকেই আসছে! চয়েস আছে! পারফিয়ুমটা দারুণ লাগলো ওর। বালিমাখা চওড়া পথটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ও, মেয়েটার সঙ্গে! ওর নরম চুলগুলো অবাধ্য হয়ে এসে পড়ছে সৌম্যলেন্দুর মুখে, নাকে! মেয়েটা কি বন্ধুত্ব করতে চায়? নাকি ক্যামেরা হাতে দেখে ছবি তোলার অজুহাত খুঁজছে! মেয়েদের এই চেনাজানা ইসকিউজগুলো খানিকটা হলেও জানা আছে! মন্দ লাগে না অবশ্য! ক্যামেরাটা ব্যাগে ঢোকাতে যাবে, তখনই মেয়েটা হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দ্যাখাতে চাইলো!

“কী এটা?”

ও দেখলো, হাতে আঁকা একটা ছবি। পাতা জুড়ে নানান রং। অনেকটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ধরণের। একাডেমিতে এমন অনেক ছবি দেখেছে আগে! খানিকক্ষণ দেখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো-

“খুবই সুন্দর! তবে আপনার মত নয়!”

আর ঠিক তখনই ওর প্যান্টের পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট করতে শুরু করলো। দমকা হাওয়া আরো একবার সজোরে জড়িয়ে ধরলো সৌম্যলেন্দুকে। পতপত করে কালো প্লাস্টিকের কিছুটা ওই দোকান ঘরগুলো থেকে উড়ে এসে লাগলো মুখের উপর! ইশ! বালিগুলো চোখে ঢুকে জ্বালা করছে! হাত দিয়ে সরিয়ে কোনোমতে ফোনটা বের করার সঙ্গে সঙ্গেই, সূচের মত জলের ফোঁটাগুলো টপাটপ পড়তে শুরু করলো! সবুজ বোতামটা টিপে, এক হাত দিয়ে ফোনটাকে আড়াল করে সামনে তাকাতেই দেখলো...

***

এতগুলো দোকান ঘুরলো। একটাতেও মনের মত দুল পেলো না। পাঁচজোড়া নিলে মোটামুটি সবাইকে দিয়ে নিজের একটা রাখতে পারবে দেবলীনা। বাইরে ঘুরতে বেরোলে এগুলো তো করতেই হয়! ওর শুধু রাগ! কিছুতেই কিনতে দেবে না! খালি বলে, দেবলীনা নাকি ঘর ভর্তি জঞ্জাল জড়ো করে! তাই নিজের পছন্দসই জিনিসগুলো দেখে বেছে কেনার জন্য, রাতে খাবার পরই বেরোতে হলো! এই সময় ফাঁকা থাকে। হোটেলের জানলা দিয়ে দেখেছে। তাছাড়া আজ বিকেলের পর থেকে বৃষ্টিটাও কম আছে! রাতে বেরোনোর এখানে খুব একটা অসুবিধা নেই! বখাটে ছেলেদের উপদ্রব কম! এইতো কৈলাসগিরি দেখে ফেরার পথে দেখলো, লোকাল কয়েকজন বউ বেশ গা ভর্তি গয়না পরে আছে! বাব্বা, কলকাতায় আজকাল এতকিছু পরে বেরোনোই যায় না! তাই নিশ্চিন্তে এলো এদিকটায়! রাস্তাটা পেরোলেই তো হোটেল। একটু হাঁটাও হবে! এখানকার সমুদ্রের ঢেউগুলো পুরীর মত দুর্দান্ত দাপটের নয়! শান্ত! তবে পাহাড় আর সমুদ্রের কম্বিনেশন-টা খুব সুন্দর! বেশ লাগছে! এ-কদিন বাইরে তেমন ঘোরা না হলেও ভারতের এ জায়গাটা বড় মনের মতো!

“ক্যায়া ভাবিজি, আপ কুছ লেঙ্গে ক্যায়া?”

“হ্যাঁ! এক মানপাসন্দ ইয়ার রিং ঔর উস্কে সাথ...”

লোকটা ওর কথা শুনতে শুনতেই নিচু হয়ে আড়াল করা জায়গাটা থেকে টেনেটুনে বড় প্লাস্টিক বের করলো! দেবলীনা খুশি হলো! এবার হয়তো দুল পাবে ঠিকঠাক! আসলে খুব ছোট ট্যাপ দুল তো ও পরে না! মানায়ও না! রিমি বারবার বলে, বৌদি আমাকেও তোমার মত লম্বা দুলের সেট কিনে দিও! নয় নয় করে হয়েই ওঠে না আর!

“ম্যাডামজি হাম দুকান বান্ধ কারেঙ্গে। থোড়া জালদি কারিয়ে। দশ বাজ গ্যায়া! তুফান ভি আনে বালে হ্যায়!”

“ঠিক হ্যায়! ঠিক হ্যায়!”

দেবলীনা বেছেবুছে দু-জোড়া দুল এগিয়ে দিলো লোকটার দিকে! দুটোতেই কড়ির কাজ আছে! এমন দুলগুলোয় মিষ্টি আওয়াজ হয় পরলে ! ভালোলাগে! সমুদ্র বেড়াতে আসার এটাই মজা। আরেকটু আগে এলে ঝোলানো দড়ির দোলনাটা দর করা যেতো! আবার বৃষ্টি হওয়ার আগের হাওয়াটা দিচ্ছে! দাম মিটিয়ে হোটেলের দিকে যেতে হবে! ছাতা নেই, ভিজলে ওরই বিপদ! বেড়ানোটাই খারাপ হয়ে যাবে! দোকানগুলো ঝাঁপ বন্ধ করছে একে একে! এই অন্ধকারে ওটা কে বসে? পাগল নাকি! নোংরা খাবারের প্যাকেট থেকে কী খুঁজে বের করছে! দেবলীনা আরেকটু গতি বাড়ালো নিজের!

রাত হলে কেমন সব পাল্টে যায়! দিনের আলোয় পিলপিল করা মানুষের ভিড় তটের এপ্রান্ত থেকে অপ্রান্ত। আর এখন এতটা ফাঁকা! প্রকৃতিও বড় অদ্ভুত! ঢেউগুলো মাঝারি থেকে কিছুটা উচ্চতা বাড়িয়েছে মনে হচ্ছে! চাপা ফোঁস ফোঁস গর্জন করছে যেন প্রতিটা জলের তোড়! সারাদিনের হারিয়ে যাওয়া চটিজুতো, কখনো সামান্য অথচ দামি কিছু ফিরিয়ে দেয় সমুদ্র। ঠিক এই সময়ই। রাতের অন্ধকারে! ছোটবেলাতে দিদার কাছে শুনতো আর অবাক হয়ে বিশ্বাস করতো! জল বুলিয়ে যাওয়া পাড়গুলো দেখে হঠাৎই মনে হলো সেসব!

“এক্সকিউজ মি!”

চমকে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো দেবলীনা। এতরাতে এই মেয়েটা কে? কোনো অসৎ অভিসন্ধি নেই তো! বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো দেবলীনার। মেয়েটার দিকে তাকাতেই অল্প হাসলো সে। বছর বাইশ তেইশের হবে! এই বয়সের একটা মেয়ে একা এখানে কী করছে! পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে! ওই সব মেয়ে নয়তো...! ওকে এড়াতে দেবলীনা কয়েকবার ঘড়ি দেখার ভান করলো!

“আপনাকে খুব বিরক্ত করলাম। তাই না?”

“আপনি বাঙালি? আসলে আমি বেড়িয়েছিলাম টুকটাক একটু মার্কেটিং করবো বলে! কখন যে এতটা দেরি হয়ে গেছে! রুমে সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য! বৃষ্টিটাও...

“জাস্ট এক মিনিট!”

মেয়েটা আধো আলো অন্ধকারে কিছু একটা এগিয়ে দেয় দেবলীনার দিকে! একটা আঁকা ছবি মতন! এতরাতে ছবি দেখাচ্ছে কেন? টাকা পয়সা চাইবে নাকি! দেবলীনা ছবির কিছুই বোঝে না...

“আমি তেমন একটা এসব! আমার হাজব্যান্ড যখন আমার ছবি তোলে, সেগুলোই মাঝে মাঝে..! আমি একেবারেই বোদ্ধা নই। কত্তা বোঝেন! আমার না বেশ লেট হয়ে গেছে, কিছু মনে করবেন না!” ছবিটা মেয়েটার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে হনহন করে দেবলীনা রাস্তার ফুটপাথের উঁচু জায়গারটার দিকে যায়! উফঃ কার না কার পাল্লায় পড়েছিল রাতদুপুরে। ছবি দেখাচ্ছে ওকে! নির্ঘাৎ টাকা নেওয়ার মতলব! আবার কী ! তবুও কেমন একটা কৌতূহল হলো! রাস্তা পার হবার আগে আরেকবার বিচের দিকে তাকালো ও! দেখলো পাগলটা বসে বসে খুব আক্রোশ বশতঃ কীসব বলে বলে তেড়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের দিকে! ক্রমাগত ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছে ঢেউ লক্ষ্য করে! আর মেয়েটা...!

***

“মি সামাস্যা এমিতি?” (বাংলায় অর্থ- কী সমস্যা আপনাদের?)

এরা মিনিমাম হিন্দি ভাষাও বোঝে না! তেলেগু, টেনে টেনে ইংলিশ বলে চলেছে! ঠিকভাবে বোঝানো যাচ্ছে না কিছুই। গাজুয়াকা পুলিশ স্টেশনে এসে আরো এক বিপদে পড়লো সৌম্যলেন্দুরা! ওরা চেষ্টা করলো নিজেদের কথাগুলো হিন্দি, ইংলিশে যতটা সম্ভব বোঝাতে! দেবলীনা পাগলের মত কেঁদে চলেছে! শান্ত করতে পারছে না কিছুতেই! কী বলেই বা সান্ত্বনা দেবে? মাথার মধ্যে সমস্তটা গুলিয়ে যাচ্ছে ওর! আট বছরের কলি, ওদের একমাত্র মেয়েকে পাবে কী করে? কোথায়? যতটা সম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছে, ডিউটিতে থাকা অফিসারদের। রায় দম্পতির জীবনে এতবড় সর্বনাশও হওয়ার ছিলো? কী মজাই না পেয়েছিলো মেয়েটা বেড়াতে এসে! প্রথম থেকেই বাধ সাধলো বৃষ্টি। পরপর তিনদিন ঘরেই ছিলো। কোনোমতে কৈলাসগিরি আর ‘জু’ ঘুরেছে। আজ সকালে এক চিলতে রোদ দেখে তিনজন বেরোয়। ভেবেছিলো সাবমেরিন মিউজিয়াম, আরো কাছাকাছি সমুদ্রের বিচগুলো ঘুরে দেখবে! তা হলো কোথায়? সমুদ্রের কাছে এলেই মনে হয়, শুধু দু-চোখ ভরে দেখতে! ব্রেকফাস্ট খেয়ে ঠিক করে কিছুক্ষণ পাড়ে একটু বসে, তারপর রওনা দেবে! স্বামী-স্ত্রী দুজনে রামকৃষ্ণ বিচে পছন্দমত জায়গা বেছে বেশ বসেছিলো। কলি-ও ওদেরই আশেপাশে খেলে বেড়াচ্ছিল। হাজার হোক ও তো শিশু! বড়দের পাশে চুপটি করে বসে থাকে কীভাবে! হঠাৎ ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকতে ডাকতে ওর মাকে কিছু একটা দেখাতে আসে। সৌম্যলেন্দু সিগারেট ধরাতে উঠে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। কোথা থেকে জোলো ঝড়ো হাওয়াটা উন্মাদের মত হু হু করে উড়তে শুরু করে! আবার সেই আগের দিনের মতোই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটারা এলোমেলো বিঁধতে থাকে গায়ে! একটু অপেক্ষা করে বেরোনো যাবে, এই ভেবে পিছনের দিকে তাকাতেই দ্যাখে দেবলীনা জলের অনেকটা কাছে গিয়ে খুব চিৎকার করছে। দৌড়ে যায় সৌম্যলেন্দু! কলি নাকি ছুটতে ছুটতে আরো খানিকটা চলে গেছে! ওকে দেখতে পাচ্ছে না দেবলীনা! তখন থেকে বেলা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে, কলিকে পাওয়া যায়নি!

“কিন্তু ওই ছবিটা! কলি পেলো কীকরে?” চোখের জল মুছতে মুছতে দেবলীনা বলে চলেছে!

“কী ছবির কথা বলছেন?”- ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন মুখোমুখি বসে থাকা অফিসার!

“আসলে...”

“আমি বলছি! (সৌম্যলেন্দু-কে থামিয়ে ভেজা গলায় কথা বলতে শুরু করে দেবলীনা) গতকাল রাতে টুকটাক কিছু কেনার জন্য মার্কেটিং-এ বেরিয়ে ছিলাম। রামকৃষ্ণ বিচের ধারের দোকানগুলো থেকে ছোটখাটো মনিহারি কিনবো বলে! ফেরার পথে একটি বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে, ছবির মত কিছু একটা আমাকে দ্যাখাতে চাইছিলো। রাতের অন্ধকারে আমি ঠিক দেখতে পারিনি। ভেবেছিলাম ওর কোনো অসৎ অভিসন্ধি থাকতে পারে! তাই হয়তো! মেয়েটাকে এড়িয়ে হোটেলে চলে আসি! বাড়িতে এসে আর তেমন করে কথাটা মনে থাকে না। কিন্তু কলি যখন আঁকা মতন ছবি দ্যাখাতে এলো। কেমন লাগলো! হা ঈশ্বর..সেই ছবি! নিশ্চই! ওই হয়তো আমার মেয়েকে... ছবিটা কিনিনি বলে...”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান ছবিটা কীসের? কী ছবি?”

“হাতে আঁকা একটা ছবি! আমাকেও ওই বয়সী একটা মেয়ে, ওরকম-ই একটা ছবি দেখিয়েছিলো!” সৌম্যলেন্দু বলে!

“আপনাকেও?”

“হ্যাঁ, আমি সেদিন সূর্যাস্তের ছবি তুলবো বলে বিচে গিয়েছিলাম, সন্ধ্যে হবার মুখে তখনই!”

“মেয়েটার নাম কি জানেন?”

“না... মানে সেরকম তো!”

“ওই আমার মেয়েকে ঠিক... দেবলীনার গলা বুজে আসে!

“আপনারা কী বলে চলেছেন! একটা ছবি দেখিয়ে কেউ কেন আপনার বাচ্চাকে কিডন্যাপ করবে? আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয় ? আপনাদের কোনো রিলেটিভ। যে আপনাদের ওয়াচ করতে পারে!”

ওরা দুজনেই মাথা নিচু করে নাড়তে থাকলো!

“তাহলে? হঠাৎ করে এসে একটা মনগড়া কথা বলবেন আর আমিও বিশ্বাস করবো তা তো হয় না মিস্টার রায়!”

“প্লিজ আমাদের একমাত্র মেয়ে কলি। কোত্থাও খুঁজে পাচ্ছি না। সাহায্য করুন! কোথায় পাবো ওকে?”

হাত জোড় করে মনের মধ্যে একরাশ তেতো নিয়ে বসে থাকলো দুজনে! ভুরু দুটো সামান্য কুঁচকে অফিসার সন্দেহের চোখে তাকায় ওদের দিকে! জিজ্ঞেস করেন, “আপনাদের সঙ্গে আদৌ কোনো মেয়ে ছিল? আপনারা তো মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেটও দেখাতে পারলেন না! এমনকি একটা মোবাইলে তোলা ছবিও না!”

“মোবাইলে সব ছবি ছিলো এই দেখুন। আমি, আমার স্ত্রীর সব কটা ছবি রয়েছে। কি... কিন্তু আমাদের মেয়ে? কলি কোথায় গেলো... ওর ছবিগুলো কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছি না! কোনো ফোল্ডারেই নেই! আমার পার্স-এও ছিলো! কিন্তু… কোথায় গেলো দেবলীনা আমাদের মেয়ের ছবিগুলো? তোমার কাছে কোথাও! বেড়াতে এসেছি বলে বার্থ সার্টিফিকেট সঙ্গে আনিনি। আমার আধার কার্ডেই কাজ হয়ে যায়! ছবি তো ছিল.. তখন তো... আর... বাড়ির ফোনের নেটওয়ার্কও পাচ্ছি না। আমাদের মনের অবস্থাটা একবার বুঝুন! আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে হোটেলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। কিন্তু প্লিজ ডায়েরিটা লিখে কিছু একটা ব্যবস্থা করুন! আমরা মিথ্যা বলবো কেন?”

“না... না কোত্থাও নেই, মোবাইল হ্যান্ড ব্যাগ কোথাও খুঁজে পেলাম না!” কষ্ট, যন্ত্রণা দুঃখে অঝোরে কেঁদে উঠলো দেবলীনা। ওরা কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিলো না কলি ওদেরই মেয়ে!

“আপনারা বার্থ সার্টিফিকেট নিয়ে আসুন। কিংবা কিছু একটা প্রমাণ! তারপর...”

সৌম্যলেন্দু ভিতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে গেলেও, চোয়াল শক্ত করছিলো এ ধরণের মন্তব্যে।

“নিজেরা কী করছিলেন? মেয়ে হারিয়েই গেলো!”

শ্লেষ মাখানো মন্তব্যে দপদপ করে উঠেছিলো সৌম্যলেন্দু-র কপালের শিরা। একটার পর একটা কথা সাজিয়ে যাচ্ছিল লোকটা!

“আপনারা তাহলে কমপ্লেন নেবেন না?”

“প্রুফ আনুন মশাই। বললামই তো...!”

দেবলীনার হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়েছিলো সৌম্যলেন্দু। এক মুহূর্ত সময় আর এখানে থাকা উচিত হবে না। হয়তো ওখানেই কলি মা আছে! নিঃস্ব অসহায় হয়ে ওরা থানা থেকে বেরিয়ে এলো। কোথায় যাবে?

“সৌম্য আমাকে ওখানেই নিয়ে চলো! সমুদ্র আমাদের কলিকে ফিরিয়ে দেবে বলো? বলো?” স্বামীর কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে থাকে দেবলীনা।

***

ওরা এসেছে। আবার এসেছে ওরা। কোথায় পাবে ছোট্ট কলিকে? কর্পূরের মত উবে গেলো নাকি! দোকানগুলোয় ওর বর্ণনা দিয়ে কত জিজ্ঞেস করলো! কিন্তু নাহ, কোথাও নেই মেয়েটা! কেউ দ্যাখেনি ওকে! সেই সময় যদি শক্ত মুঠো করে ধরে রাখতো ওকে! ঝড় যে খুব একটা হয়েছে তাও নয়! কী করে হলো এসব? কলি-র একটা অস্তিত্ব-ও আজ ওদের কাছে নেই! কী করে গোটা পৃথিবীকে বোঝাবে! কলি ছিলো! আজ নেই! কয়েক ঘন্টার মধ্যে সব যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো! তবে কি সত্যি দেবলীনার কথাই ঠিক? মেয়েটা আমাদের ফলো করছিলো প্রথম দিন থেকে? উদ্দেশ্য কী ? ওই মেয়েটাই কী ! থানাতে এসব বলাতে হাসির পাত্র হয়েছে! কোথায় থাকে? কী করে? কেনই বা ছবি দিতে চাইছিলো ওদের দুজনকে, এমনকি কলিকেও!

“দেবলীনা...!”

এ কী করছে দেবলীনা! নিচু হয়ে বালির মধ্যে তন্ন তন্ন করে কী খুঁজছে? কলি-র ফেলে যাওয়া কিছু কি? ও ছুটে গেলো। সমুদ্র গত তিন-চারদিনের তুলনায় আজ শান্ত! নিশ্চুপে অপেক্ষা করছে! কীসের ইঙ্গিত? মাথা উঁচু ঢেউ আলতো আঁচড় দিয়ে যাচ্ছে পাড় ছুঁয়ে! খুব অস্থির লাগছে! দমবন্ধ হয়ে আসছে! দেবলীনাকে আস্তে আস্তে তুলে ও বললো-

“ওঠো। আমরা ঠিক পাবো ওকে। ওকে না নিয়ে আমরা কোত্থাও যাবো না।”

“পাবো সৌম্য?”

রাত প্রায় ১১টা। কখন যে এতটা রাত হয়েছে বুঝতেই পারেনি। ছ’টা মাত্র দিন! কী অসহনীয় নরক যেন! এগোতে এগোতে দেবলীনা, ওর হাতটা আচমকা খামচে ধরলো, “দ্যাখো ওই ওই যে পাগলটা বসে আছে... ও না সেই তখন থেকে তাকিয়ে আছে! ও কি দেখেছে কলিকে? চলো না প্লিজ! চলো!”

“কিন্তু... সৌম্য-র উত্তরের অপেক্ষা না করে দেবলীনা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো পাগলটার দিকে। আর পিছন পিছন ও! পাগলটাকে তো ভাইজাকে আসা থেকে দেখছে। ও কী বলবে, কী করে বোঝাবে দেবলীনাকে!

“এই দ্যাখো সৌম্য... এই দ্যাখো এই আমাদের মেয়েকে... ছবি নিয়ে বসে আছে! কোথা থেকে পেলো ও! জিজ্ঞেস করো ওকে!” চিৎকার করে উঠলো দেবলীনা! সৌম্যলেন্দু কী করবে এবার? পাগল লোকটা ওদের দেখে খুব জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছিলো। অবিরাম বিড়বিড় করে যাচ্ছিলো! লাল চোখ! খেতে না পাওয়া বীভৎস শুকনো মুখ দেখে ভিতরে ভিতরে গা গুলিয়ে উঠছিলো ওর! পাগলটা ছেঁড়া জামার ভিতর থেকে শীর্ণ চামড়ার হাত বের করে কপাল চাপড়াতে শুরু করেছিলো! তবে কি! এ কী ভাবনা আসছে! ওতো পাগল! কোনোরকমে মনকে সংযত করে ও বোঝার চেষ্টা করলো। কিছু কি বলতে চাইছে পাগলটা! নাকি প্রলাপ! নিচু হয়ে লোকটার সামনে আরেকটু এগোতে বুঝলো, ও হিন্দি বলছে! খুব জড়িয়ে! অস্পষ্ট! বেশিরভাগ বুঝতে পারছে না! যেটুকু বুঝেছে অনেক কষ্টে! তার বাংলা মানে করলে এমনটা দাঁড়ায়!

“সে এসেছে! আবার এসেছে! বেশ কয়েকমাস আগে অল্পবয়সী একটা মেয়ে এখানে ঠিক এই জায়গাতে বসে বসে শুধু ছবি আঁকতো! সুন্দরী মেয়েকে একা বসে থাকতে দেখে অনেকেই আসতো। দেখতো মেয়েটাকে! বিকেল সন্ধ্যের দিকে মাঝে মাঝে কাঁকড়া বেচতে আসতো পাগলটা! তখনই দেখতো মেয়েটাকে! বিক্রি বাটার ধান্দায় থাকায় আরো কয়েকজনের কাছেও খবরটা পৌঁছে গেছিলো। বেশ কয়েকদিন এভাবে যাবার পর আর মেয়েটাকে দেখা যায়নি! যে হোটেলে উঠেছিলো, পুলিশ নাকি এসেছিলো সেখানেও। ঘর বন্ধ দেখে হোটেলের লোক খবর দেয় পুলিশকে! তন্নতন্ন করে খুঁজে ঘরে পেয়েছিলো অনেক আঁকা ছবি! তারপর অনেকদিন হয়ে যায়! ভুলে যায় সবাই! কিন্তু এরও কিছুদিন পর, এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে! ভোররাতের দিকে মাছ ও ওই জাতীয় জীবিকায় থাকা কিছু মানুষের জালে গভীর সমুদ্র থেকে ধরা পড়ে অদ্ভুত এক প্রাণী! মুখ, হাত পা কিছুই বোঝা যায়নি প্রাণীটির! আয়তনে বিশাল। একটা দলা পাকানো মাংস পিণ্ড যেন! ওদের জালে এরকম অনেক প্রাণী মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে! কিন্তু এই প্রাণীটির বিশালতা আর চেহারার ভয়ঙ্করতা দেখে ভয়ে জাল ফেলেই পালিয়ে গেছিলো সবাই! দু-একজন ছিলো। কিন্তু কী করে জানে না পরীক্ষাগারে নিয়ে যেতে যেতেই কোথায় যেন হারিয়ে যায় বীভৎস প্রাণীটি! এমনকি প্রাণীটিকে শেষ দেখা জেলেরাও! চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের মানুষের মধ্যে! একে একে অমঙ্গল ঘটে জেলেপাড়ার সকলের ঘরে! প্রত্যেক ঘর থেকেই কেউ না কেউ নিখোঁজ হতে শুরু করে কিছুদিন অন্তর অন্তর! অনেক পুজো আচ্চা করেও কোনো ফল হয় না! শেষমেষ ওর ছোট মুনিয়াও নাকি কোথায় হারিয়ে যায়! মুনিয়ার ঘরে থেকে পায় এই ছবিটা! ডুকরে কেঁদে উঠছিলো লোকটা! আর আকাশের দিকে মুখ করে দুহাত বাড়িয়ে মুনিয়াকে ডেকে যাচ্ছিলো! রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে কোন এক অশরীরী উল্লাস ঘিরে রয়েছে ওদের চারপাশে! বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে ওঠে সৌম্যলেন্দুর। মুঠো মুঠো বরফ যেন কেউ শিরদাঁড়ায় মিশিয়ে দিচ্ছে ওর! এগুলো কি সত্যি? এগুলো কি বলতে পারবে থানায় গিয়ে? কাকে বলবে? কে বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস কি করেছিলো দেবলীনা? মুঠোটা আরো জোরে চেপে ধরেছিলো ওর। অদ্ভুতভাবে চেয়ে ছিলো ওর দিকে! সজোরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ওকে, বুদবুদের মত সাদা ফেনাগুলোর দিকে! ঠিক যেখানে গুমগুম শব্দ করে গুড়ি মেরে থাবা বাড়াচ্ছে একটা দুটো তিনটে, পরপর অনেকগুলো ঢেউ! পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবার মুহূর্তে বুঝতে পারছিল জোরে, আরো জোরে শব্দ করে করে অনেক অনেক নুড়ি ফেলছিলো জলে। পাগলটা!

এর ঠিক একমাস পরে

দেবলীনা কিংবা সৌম্যলেন্দু-র কী হয়েছিল আমরা জানি না। তবে জানতে পারি সেই বছরই ২০১৪-র অক্টোবর মাসেই ভাইজাকের উপকূলে আছড়ে পড়েছিল হুদহুদের দাপট। ভেসে গেছিলো বহু মানুষ, ঘরবাড়ি। ১২০ কিমি বেগের ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছিলো যোগাযোগের মাধ্যম। জীবিকাহীন হয়ে পড়েছিল অনেকেই। বন্ধ হয়ে গেছিলো স্থলপথ, আকাশপথ। মিডিয়ার ক্যামেরায় ঘুরে ফিরে আসছিলো মলিন কিছু ছবি! ভেঙে যাওয়া দোকান, ঘরবাড়ি। অসহায় মানুষজন! অবিরাম জলের তাণ্ডব। আর রামকৃষ্ণবিচের ধারে বসে, সর্বশান্ত চালচুলোহীন এক পাগলের ক্রমাগত ঢেউ লক্ষ্য করে ক্লান্তিহীন পাথর ছোঁড়া! কোন ঝড় তাঁকে সর্বশান্ত করেছে? নাকি অন্য কোনো অশনি সংকেত! প্রশ্ন চিহ্ন থেকেই যায়!