বহুরূপীয়া - অনিমেষ গুপ্ত

অলংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস

ছুটি চাইছিল কে বি সিং। হিন্দি বাংলা মিশিয়ে। কোথা থেকে বাংলা শিখেছে কে জানে তবে হিন্দির সঙ্গে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা মিশিয়ে বেশ চালিয়ে দেয়।

অন্যমনস্ক ছিলাম। ক’দিন ধরে কাজের চাপ খুব বেশি। মুখ তুলে বললাম, ‘কী জন্য আর ক’দিনের জন্য ছুটি চাইছ?’ সামান্য অবাক হল কে বি সিং। অনেকক্ষণ ধরেই আমার কাছে বোধহয় ছুটির আর্জি করছিল সে। একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘স্যরজী আমার পিতাজীর দেহান্ত হয়েছে। গাঁও যেতে হবে। তা ধরুন দিন দশেক তো লাগবেই মিনিমাম।’

কে বি সিংয়ের বাড়ী হরিয়ানায়। দিল্লী থেকে খুব একটা দূরে নয়। বাসে গেলে বড়জোর ঘন্টা দু-আড়াই লাগবে। সদ্য বিয়ে করেছে। এখনো গাঁয়েই আছে তার বৌ বীনা। প্রত্যেক উইক এন্ডেই কে বি সিং দিল্লী থেকে তার গাঁয়ের বাড়ীতে যায়। শুক্রবার রাতে গিয়ে সোমবারে ফেরে। সে কাজের ছেলে, ছুটি নিলে কাজের ক্ষতি কিন্তু এ প্রয়োজন আলাদা। এইসব নিশ্চিত কারণ থাকলে কারুর ছুটি আটকানো যায় না।

সামনের খালি চেয়ারে তাকে বসতে বলে তার ছুটির দরখাস্ত দেখছিলাম। ওইভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবে যেতে চাইছ?’

‘আজ রাতের বাসেই বেরিয়ে যাবো স্যরজী।’

রেকমেন্ড করে সই দিতেই অ্যাপ্লিকেসন নিয়ে চলে গেল কে বি সিং। হাতে-হাতে পৌঁছে দেবে অ্যাডমিন ক্লার্কের কাছে।

শেষ আঁচড় মেরে ফিরে যাচ্ছিল দিল্লীর শীত। রোদ কম অথচ উজ্জ্বল হয়ে আছে সকালটা। জানলা খুলে দিয়েছি, ভারি মিষ্টি একটা হাওয়া এসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঘরময়। এটা দিল্লীর স্পেসালিটি, আসে তো বেশ জানান দিয়েই আসে বসন্ত। হাওয়াতে হাওয়াতে কখন যে এবারের বসন্ত ঢুকে পড়েছে দিল্লীতে।

কে বি সিংয়ের ছুটি শেষ হয়েছে। ফিরে আসার পর তাকে ডেকেছিলাম আমার কাছে। সবাই যে যার নিজের নিজের গ্রাম শহর থেকে দিল্লীতে আসে ট্রান্সফারে। আত্মীয় স্বজন নেই, কলিগরাই যা আপনজন। একটা কাস্টমারি কুশল বিনিময় তো করতেই হয়।

‘তোমার কাজ সব মিটেছে তো ভালোভাবে?’

‘হ্যাঁ, স্যরজী চৌথার কাজ ভালো ভাবেই মিটে গেছে আপকি কিরপা সে। বড়ে ভাইলোগ এসেছিলেন। যা করার ওনারাই করেছেন। আমি তো সবচেয়ে ছোট। পিতাজীর বয়েস হয়েছিল অনেক। তা প্রায় আশি হবে। দুনিয়ায় যা দেখার তা দেখে নিয়েছেন এতদিনে। বলতেন খুব বেশি দেখতে নেই দুনিয়ায়, মনের মধ্যে শুনাপন জাগে। একরকম অপেক্ষাই করছিলেন বলতে পারেন।‘

‘ফ্যামিলির অন্য সকলে ভালো তো? আমাদের ভারতীয়দের মধ্যে একটা বিশ্বাস আছে জানো তো... অন্তত একটা বছর একটু কেয়ারফুল থাকতে হয়। মহাগুরু নিপাত বলে একে।’

‘হ্যাঁ স্যরজী, আমি শুনেছি। ব্যস চিন্তা আছে তো সিরফ মা’কে নিয়ে।’

‘কেন! মাজীর শরীর খারাপ হল নাকি!’

‘না না স্যর, সেসব ঠিক আছে। মা তাগড়া আছেন। বয়সের ভারে আর দমের অসুখে পিতাজী খাটিয়া নিয়েছিলেন বেশ কিছু সাল আগে। আমাদের আঙিনায় বৃষ্টি-বাদলের সময় ছাড়া প্রায় সব সময়েই শুয়ে থাকতেন পিতাজী।’ একটু হাসল কে বি সিং। ‘আসলে সরজী, গাঁয়ের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষই সংসারের মাথা। তাঁর খেয়াল রাখতে হয় সকলকেই। তা আমার মা পিতাজীর সব দেখভাল, সব রকম সেবা নিজেই করতেন। এক লোটা জলও গড়িয়ে খেতে দিতেন না।’

‘তাহলে! মাকে নিয়ে চিন্তা কীসের!’ সত্যি সত্যি উদ্বেগ হচ্ছিল আমার। অনেক আগেই হারিয়েছি নিজের মাকে।

কে বি সিং চিন্তায় রয়েছে বলে মনে হল। অপেক্ষা করছিলাম সে কী বলে!

অফিসের চা ওয়ালা এসে চা দিয়ে গেছে দু কাপ। সদ্য গরম চায়ের বাষ্পে হালকা একটা ধোঁয়ার আস্তরণ দু'জনের সামনে।

কে বি সিং বলল, ‘স্যর, ছোট বলে আমি মায়ের একটু বেশি আদরের এখনো। ফিরে আসার দিন দুই আগে দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে একটু গড়িয়ে নেব ভাবছিলাম। ঘরের মধ্যে বীনাও আমার অপেক্ষা করছিল।’

চোখ মুচকে একটু অর্থপূর্ণ হাসলাম তার দিকে তাকিয়ে। কে বি সিং তেমন গ্রাহ্য করল না। জানাল, ‘তা স্যর, মা ডেকে পাঠালেন আমায়। খোলা চত্বরে তখন পিপলের ছায়া চারপাশে। বাবার সেই খাটিয়ার ওপরে বাবার মতোই এঁকে বেঁকে শুয়ে ছিলেন মা। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে আমায় বসতে বললেন পাশে। বললেন, বেটা একটা শলা করব বলে ডেকেছি তোকে। বললাম, হ্যাঁ মা বল। তা মা যা বললেন স্যর সেটাই আমার চিন্তার সাবজেক্ট।’

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কে বি সিংয়ের জন্য রাখা কাপের দিকে ইশারা করে তাকিয়ে রইলাম।

একটু ইতস্তত করে কে বি সিং বলল, ‘স্যর মা বললেন... আমি কী করি বলত! তোর পিতাজী চলে গিয়ে আমাকে বহোত মুস্কিল মে ফেলে গেছেন বেটা। পাশে বসে মায়ের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে অবাক হয়ে তাকালাম আমি। কেন মা, অ্যায়সা কেয়া মুস্কিল! তা মা বললেন, এই এত্ত সময় নিয়ে এখন কী করি বলত আমি! তোর বাবা বেঁচে থাকতে সময় পেতাম না। মাঝে মাঝে গুসসা হত খুব। আরে মানুষটা ভাববে তো একবার, আমারও তো বয়স হচ্ছে নাকি! একটা না একটা ফাই ফরমাস চৌপর দিনভর। আর চরকির মতো ঘুরেও যেতাম বটে। তার তো শুধু শুয়ে শুয়েই ব্যস্ততা সারাদিন!

‘ভীষণ অবাক হলাম স্যর। কীসের এত ব্যস্ততা ছিল পিতাজীর! আমার দিকে তাকিয়ে বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছিলেন মা। মৃদু হেসে বললেন, তোরা তো সব বাইরে বাইরে নিজের নিজের কামকাজ, নৌকরি নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু লোকটা সারাদিন তার বেটা-বেটি, বহুয়েঁ আর পোতা-পোতি, নাতি-নাতিনদের কথা ভেবেই অস্থির। কীসে তারা আরো একটু ভালো থাকবে! ক্ষেতির জমির জন্য কারো ট্রাক্টর চাই তো কারো ঋণ মকুবের ব্যবস্থা করাতে হবে। কারো টাকার দরকার তো কারো জমি-জিরেত। যা ছিল বিষয় আশয় সব তো তারই নামে ছিল এতদিন। সময় যত এগোচ্ছিল, তোর পিতাজী বুঝতে পারছিলেন কমি হ্যায় তো ব্যস ওয়ক্তকা। এরইমধ্যে গাঁয়ের লোকজনদের ধরে রিজিস্টারি অফিস, ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা করে বন্টনের ব্যবস্থা করিয়ে রাখা।

‘মা’র কথা শুনতে শুনতে সেই প্রথম মনে হচ্ছিল স্যরজী যে পিতাজী ছিলেন তো এক বিরাট ছাতার মতো। এখন যেন হঠাৎই সেটা কেউ সরিয়ে নিয়েছে।’

কে বি সিংয়ের কথায় মনে হচ্ছিল এ অভিজ্ঞতা তেমন নতুন কিছু নয়। কিচ্ছু না করা, বাড়ীতে সুস্থ বা অসুস্থ বসে থাকা বাবা-মা চলে গেলেও মনে হয় যেন এক বিরাট ছায়া সরে গেল মাথার ওপর থেকে।

কে বি সিং বলে উঠল, ‘মা উঠে বসেছিলেন স্যরজী। খাটিয়ার অনেকটা অংশ এখন শূন্য, ভীষণ ফাঁকা। হঠাৎ সেই শুনাপন আমার চোখের ভিতরে বসে পানি ঢেলে দিল স্যর।’

কে বি সিংয়ের চোখ ছলছল করছিল কিন্তু আমি জানি সে শুধু ওইটুকুই। কে বি শক্ত মনের মানুষ। ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বললাম, ‘পি লো।’

সারফেসের ওপরে দুধের সর জমতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আনমনা কে বি সিং বলে উঠল, ‘কিন্তু স্যর ঝঞ্ঝাট সেটা নয়। ঝঞ্ঝাট হচ্ছে তো ব্যস মাকে নিয়ে। টাইম ইঁহা এক সমন্দর বন গ্যয়া আর মাঝদরিয়ায় এনে ফেলে আমার মাকে ডুবিয়ে ফেলতে চাইছে। এটা স্যর অনুভব না করতে পারলে ঠিক বোঝা যাবেনা। মনে হবে এ আর এমন কী! লেকিন স্যর ভাবুন একবার। আমার মা তাঁর সব বহুদের বলে দিলেন যে তাদের মধ্যে কেউ যেন তাঁর কোন কাজ না করে। হরিয়ানার গ্রামে এ একটা বড় সিদ্ধান্ত। এই বয়সে মা তাঁর নিজের সব কামকাজ একদম একলা করবেন! বউরা সকলে ভাবছে মা বোধহয় কোন কারণে রেগে গেছেন তাদের ওপরে। শুধু আমি বুঝতে পেরেছি স্যরজী... যতটুকু পারা যায় মা লাগাম পরাতে চাইছেন সময়ের গলায়!’

কে বি সিং চুপ করল খানিক তারপরে বলল, ‘আসলে সময় যে কী করে সে কেবল সময়ই জানে স্যরজী। এটা সত্যি যে ওয়ক্ত এক একজনের কাছে এক এক রকম। আমি ভাবি ইশশ্, যদি দিনটা আরো দু-ঘন্টা বেশি হত তো নৌকরি ছাড়া কোন একটা কারবার নামিয়ে দিতাম ঠিক। একটু মাটি, জমি-জিরেত কিনতাম। তপদিলি নিয়ে গাঁয়ে ফিরে নৌকরি, ঘরবার সবকুছ সামলাতাম। অথচ মাকে দেখুন। ভারি একটা বস্তার মতো সময় তাঁর দুহাতে ঝুলে আছে। হাউ হেল্পলেশ স্যর!

‘স্যরজী, ভয় করছে আমার। মনে হচ্ছে মাও বোধহয় পিতাজীকে মাফিক...’

একটা উদগত কান্নার ঢেউ সামলালো কে বি সিং আর তারপর বলল, ‘আসলে কী জানেন স্যরজী, দুনিয়ায় সচ ভি এক আজীব বহুরূপীয়া। একজনের কাছে এক একরকম।’

এক চুমুকে প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা চা গিলে নিয়ে চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল কে বি সিং। তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম... কথাটা যেন কী বলে গেল সে!