বিশ্বজয়ী এবং একটা পদ্ধতি - সোহম সেহানবীশ

২০০৬ :- বিশ্বকাপ ফাইনাল
২০০৮ :- ইউরোর গ্রুপ থেকে বিদায়
২০১০ বিশ্বকাপ যোগ্যতাঅর্জন পর্ব :- প্লে-অফ খেলে বিশ্বকাপে যাওয়া
২০১০ বিশ্বকাপ :- গ্রুপ থেকে বিদায়
২০১২ :- ইউরোতে দ্বিতীয় রাউন্ড
২০১৪ বিশ্বকাপ যোগ্যতাঅর্জন পর্ব :- প্লে-অফ খেলে বিশ্বকাপে যাওয়া
২০১৪ বিশ্বকাপ :- কোয়ার্টার ফাইনাল
২০১৬ ইউরো :- রানার্স আপ
২০১৮ বিশ্বকাপ :- চ্যাম্পিয়ন

একটা লম্বা রাস্তা। একাধিক টুর্নামেন্টে ব্যর্থতা। ২০০৩-এর কনফেডারেশনস কাপ জয়ের পর থেকে সাফল্যহীন একটা দল। ২০০৬-এর সেই অভিশপ্ত রাতের পর থেকে মনেপ্রাণে দেখে চলা একটা স্বপ্ন। কিন্তু, এই স্বপ্ন কি নিছকই এক মাসের? এই স্বপ্ন কি নিছকই একটা প্রতিযোগিতায় এসে পরপর সাতটা ম্যাচ ভালো খেলা আর বিশ্বজয়ীর তকমা নিয়ে ফিরে যাওয়া? মনে হয় না, কারণ বিশ্বফুটবলের সর্বোচ্চ মঞ্চে এসে হিসেব নিকেশ সবসময় অতটা সোজা থাকে না! স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন সফল হওয়ার মধ্যে থাকে একটা পদ্ধতি, যেটা বিভাজন করে দেয় ওই একত্রিশটা দল, এবং বিশ্বজয়ীর মধ্যে!

২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালটা খেলার পর থেকেই ফলাফলের গ্রাফ নিম্নমুখী হতে শুরু করে ফ্রান্সের। ২০০৮-এর ইউরোতে গ্রুপ থেকে ছিটকে যাওয়া এবং ২০১০ বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে আয়ারল্যান্ড এর সাথে প্লেঅফে থিয়েরি অরি’র ‘হ্যান্ডবল’ গোলে জিতে মূলপর্বে যাওয়া, দলটার খেলা নিয়ে বিতর্ক লেগেই ছিলো! যজ্ঞে ঘৃতাহুতি পড়লো যখন তৎকালীন কোচ রেমন্ড ডমেনেখ-এর সাথে টিমের সদস্যদের ঝামেলা তুঙ্গে ওঠে। কোনও দুর্বোধ্য কারণে তরুণ স্ট্রাইকার করিম বেনজিমাকে বিশ্বকাপে না নিয়ে যাওয়া এবং নিকোলাস আনেলকাকে কেন্দ্র করে কোচ এবং খেলোয়াড়দের মধ্যে অশান্তি, সবকিছু মাথায় রেখে হয়তো ২০১০-এর বিশ্বকাপে ফ্রান্সের গ্রুপ থেকে বিদায় নেওয়া কাকতালীয় কিছুই ছিলো না।

এরই মধ্যে ২০১২-এর ইউরোর ঠিক পর জাতীয় দলের দায়িত্ব দেওয়া হয় দিদিয়ের দেশঁকে। খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপজয়ী দেশঁ’র দায়িত্ব ছিলো ২০১৪-তে বিশ্বকাপে অন্তত একটু সম্মানজনক ফলাফল আদায় করা। কিন্তু যোগ্যতা অর্জন পর্বের শেষ ধাপে একটি বড়সড় ধাক্কা, প্লে-অফের প্রথম রাউন্ডে ইউক্রেনের কাছে ০-২ হেরে বসলো ফ্রান্স। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনই না করার! যদিও শেষ রক্ষা হয়েছিলো এবং চারদিন পর সেই ইউক্রেনকেই দ্বিতীয় রাউন্ডে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপে গেলো ফ্রান্স, এবং তর্কাতীত ভাবে জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডসের পর হয়তো গোটা প্রতিযোগিতার অন্যতম সেরা ফুটবল উপহার দিলো তারা। গোটা মাঠ জুড়ে আক্রমণাত্মক খেলার উদাহরণ দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে প্রবল পরাক্রান্ত জার্মানির কাছে ১-০ ব্যবধানে পরাজয় বরণ করলেও, গোটা ম্যাচে ফ্রান্সের মুহুর্মুহু আক্রমণ ও হার-না-মানা মনোভাবের মধ্য দিয়ে এইটুকু স্পষ্টই ছিলো, যে সেদিন না হোক, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতেই, ফরাসি ফুটবলের সুদিন ফিরছে! ভীষণভাবে ফিরছে!

আর ঠিক এখানেই আসল মাস্টারস্ট্রোকটা খেললো ফরাসি ফুটবল ফেডারেশন। দেশঁকে বরখাস্ত না করে কোচ রেখে দিয়ে। ফ্রান্সের ফুটবলের একটা স্বর্ণযুগ এলো। ২০১৪-এর দলটার সাথে এসেই যুক্ত হলো এনগোলো কান্তে, দিমিত্রি পায়েটের মতো কিছু উঠতি তারকার নাম, এবং ধীরে ধীরে ফ্রান্স হয়ে উঠতে লাগলো অপ্রতিরোধ্য! ২০১৬-এ ঘরের মাঠে ইউরোর গ্রুপ ও নকআউট পর্বের দুর্বার গতি দেখে যখন সবাই একপ্রকার বলেই দিলো যে কাপটা ফ্রান্স কে দিয়ে দিলেই হয়, ঠিক যে মুহূর্তে সবার মনে হলো ১৯৯৮ বিশ্বকাপের মতোই, আবারও ‘শিল্ড গ্রামের বাইরে যাবে না’, তখনই আবার অঘটন। পর্তুগাল এসে ফাইনালে কাপটা নিয়ে চলে গেলো! আবারও একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে! তাহলে কি এই দলটার সেই বহুচর্চিত ‘চ্যাম্পিয়ন্স লাক’ নেই?

তবে এরপরেও দেশঁর উপরেই আস্থা রাখলো বোর্ড। উমতিতি, এমবাপের মতো আরো কিছু তরুণ তারকা দলে এলেন। ফ্রান্স ছুটতে লাগলো নিজেদের আসল লক্ষ্যের দিকে। যে লক্ষ্য ২০০৬ এর বার্লিনের ওই রাতে অসমাপ্ত অধ্যায় হয়েই থেকে গিয়েছিলো! অবশেষে! অবশেষে! স্বপ্ন সফল হলো। এতবারের প্রচেষ্টায়! নকআউটে পরপর আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া... কেউ যদি এরপরও বলে যে ধারে-ভারে যোগ্য চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স নয়, তাহলে আর কিছুই বলার নেই। পুতিনের দেশে অন্য মহাশক্তিদের ব্যর্থতার মধ্যেই উজ্জ্বল রয়ে গেলো লেস ব্লুজ, এবং অবসান ঘটলো প্রতীক্ষার!

পদ্ধতি

প্রতিটা বড় সাফল্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একটা পদ্ধতি। এবং সেটা যদি আন্তর্জাতিক ফুটবল দলের ক্ষেত্রে বলতে হয়, তাহলে তো অবশ্যই! যদি এক মুহূর্তের জন্য ভেবেওনি, যে ২০১৬-এর ইউরো না জিততে পারার অপরাধে দিদিয়ের দেশঁর চাকরি নট হতো, তাহলে কি হতো? ইউরোপের একটি প্রথম সারির দল হিসেবে পরিচিত এই ফ্রান্সেরও খেলোয়াড় উৎপাদন বন্ধ হতো না, এবং নতুন কোচ পেতেও সমস্যা হতো না, তাহলে? কিন্তু, নতুন কোচের নতুন পরিকল্পনা-ছকে কি খেলোয়াড়রা মানিয়ে নিতে পারতেন? এমনিতেই দশ মাস ক্লাব ফুটবলে যে যার নিজের ক্লাবে, বছরে মেরেকেটে ওই চার-পাঁচটা ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকে ওই দুটো করে ম্যাচ, এতে কি হয়? আর ঠিক এই কারণেই, ইউরোপের ফুটবল খুঁজতে চায় একটা ভারসাম্য। খুঁজতে চায় একটা স্থায়িত্ব। যে স্থায়িত্বের খোঁজে ২০০৬ থেকে আজও জার্মানির কোচ থেকে যান জোয়াকিম লো। যে স্থায়িত্বের কারণে একজন ভিসেনতে দেল বস্কে স্পেনকে নিয়ে যান সাফল্যের শিখরে। এবং ঠিক সেই স্থায়িত্বের পদ্ধতি অনুসরণ করেই ফ্রান্সও আজ বিশ্ব-ফুটবলের শিখরে! একবার যদি ফ্রান্সের তেইশ জনের দলটির দিকে তাকিয়ে দেখা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে ফ্রান্সের এই স্কোয়াড থেকে খুব সহজেই একটি দ্বিতীয় দলও তৈরি করা যায়, যা হয়তো প্রথম দলের থেকে খুব একটা দুর্বল হবে না! এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে যে ফ্রান্স এবার পায়েট, কোম্যান, লাকাজেট, মার্শাল এবং কোসসিয়েলনির মতো কিছু পরিচিত নামকে নিয়েই যায়নি বিশ্বকাপে। স্থায়িত্বের পাশাপাশি এই রিজার্ভ বেঞ্চের শক্তিই বা আর কটা দলের কাছে রয়েছে?

ইউরোপীয় ফুটবলকে এই চিরাচরিত স্থায়িত্বের পদ্ধতিই পথপ্রদর্শক হয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সোনালী ভবিষ্যতের দিকে!