রাবণ - বিভাবসু দে

অলংকরণ - মৈনাক দাশ
(১)

রাতটা যেন আজ বড় বেশিই অন্ধকার হয়ে নেমেছে মন্দোদরীর ঘরে। একটা প্রদীপও জ্বালেনি সে। ইচ্ছেই করছে না আজ। আকাশেও কালো মেঘ। চাঁদ, তারা সব কোথায় যেন হারিয়ে গেছে এই অনন্তব্যাপী অন্ধকারে। শ্বেতপাথরের অপূর্ব কারুকার্যে সাজানো এই ঘরের আনাচে-কানাচে অন্ধকার যেন ক্রমশ আরও আরও ঘনিয়ে উঠছে। আজ শুধুই অন্ধকার, কোথাও আলো নেই।

চারপাশে একবার তাকাল মন্দোদরী। হ্যাঁ, এই সেই ঘর, ওর তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নভূমি। এখানেই, এই ঘরেই বিয়ের পর প্রথমবার আপন করে জেনেছিল সে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে, নিজের স্বামীকে। তাঁর সঙ্গে কাটানো কত সুখস্মৃতি, কত স্বপ্নের মায়াজাল জড়িয়ে আছে এই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে। প্রথম যৌবনের সেই সোনালী দিনগুলো, কত ছোট বড় আনন্দ-বিষাদের স্মৃতি, কত পাওয়া, কত না-পাওয়ার গল্প, কত নিশুতি রাতের স্বপ্নিল কলতান; সেই সব যেন আজ আবার ওর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে।

জানালা দিয়ে ভেসে আসছে ওই দূরের সমুদ্রের নোনা হাওয়া; বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে মন্দোদরীর শুকনো চোখের পাতায়। চোখে আর জল আসে না এখন। এই ক’দিনে এতসব প্রিয়জনের রক্তে ওর চোখের জল মিশেছে যে আর কান্না পায় না। থেকে থেকে যেন বুকের ভেতরটা শুধুই ভেঙে আসতে চায় এক অকারণ আর্তনাদে। ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে আলো, শত্রু শিবিরের আলো। নিজের অবসন্ন শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে সেদিকেই তাকিয়েছিল মন্দোদরী।

হঠাৎ পায়ের শব্দে চমকে উঠল সে। এই পদধ্বনি চিনতে কোনওদিন ভুল হয়নি তার, আজও হল না। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তার প্রাণের দেবতা, তার স্বামী। বিশ্ব যাঁকে জানে লঙ্কেশ্বর রাবণ নামে।

“একি প্রিয়ে, ঘর অন্ধকার করে রেখেছ কেন? দাসী, আলো...”

“থাক না স্বামী, আজ নাহয় এই অন্ধকারেই কিছু সময় থাকি।”

রাবণ আস্তে আস্তে এসে বসলেন মন্দোদরীর পাশে। নিজের হাতটা ওর হাতের ওপর রেখে বললেন, “তোমার কষ্ট আমি বুঝি।”

মন্দোদরী কোনও উত্তর দিল না। ওর চোখদুটো এখনও বহু বহু দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে, হয়তো অতীতের সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিতে।

“কাল আমি যুদ্ধে যাচ্ছি প্রিয়ে।” রাবণ বললেন।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে এল মন্দোদরীর। “তবে কি এই আমাদের শেষ রাত্রি নাথ?” ওর পাথরের মতো নিশ্চল অপলক চোখদুটো যেন রাতের এই অন্ধকারকে আরও অন্ধকার করে তুলল নিমেষে। চারপাশে বড় গুমোট নীরবতা। উত্তাল সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে।

মন্দোদরীর হাতটা নিজের কোলের কাছে টেনে নিয়ে রাবণ বললেন, “তোমার মুখে এ কেমন কথা প্রিয়ে? তুমি কি জানো না তোমার স্বামী লঙ্কেশ্বর রাবণ? যার ভয়ে ওই দেবতারা বাধ্য হয়েছে পৃথিবী ছেড়ে নিজেদের লোকে ফিরে যেতে।”

“জানি স্বামী। কিন্তু এই নারীজন্মে নিজের চোখের সামনে যত আপনজনের মৃত্যু দেখতে হয়েছে তারপর যে আর মনে জোর রাখতে পারি না। ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ, আমার এত এত বীর পুত্রেরা, রাক্ষস কুলের গৌরব মেঘনাদ ; এরা কেউই তো কম ছিলেন না প্রভু, তবু...” শেষের কথাগুলো বলতে বলতে যেন গলাটা কেঁপে উঠল মন্দোদরীর।

রাবণ উঠে দাঁড়ালেন। বুক ভেঙে আসা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস যেন বুকেই লুকিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন জানালার পাশে। তাঁর দৃষ্টি বহুদূরের সেই সমুদ্রতীরে জ্বলতে থাকা আলোর দিকে। শত্রুদলের শিবিরের আলো।

“দূরে ওই যে আলো জ্বলছে, দেখেছ?” সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই জিগ্যেস করলেন রাবণ।

মন্দোদরী কিছুই বলল না; ওর দৃষ্টি শুধু নীরবে মিশে গেল ওর স্বামীর দৃষ্টিপথে। রাবণ বললেন, “ওখানে কে আছে জানো?”

“রাম।” মন্দোদরী বলল।

“না প্রিয়ে। বিভীষণ। আমার নিজের ভাই বিভীষণ।” বুক ঠেলে আসা শ্বাসটা এবার আর বাধ মানল না। রাবণ আবার বলতে লাগলেন, “যেই কুম্ভকর্ণ চিরকাল যুদ্ধে অপরাজেয়, যেই মেঘনাদের নামে দেবতারাও ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে, একটা তুচ্ছ বনচারী মানুষের কী সাধ্য যে তাদের পরাজিত করতে পারে?”

“কিন্তু লোকমুখে যে শুনেছি সে দেবতা?”

একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ঝলসে উঠল রাবণের ঠোঁটে। সেই অন্ধকারেও যেন স্পষ্ট দেখতে পেল মন্দোদরী। “কীসের দেবতা? একটা তুচ্ছ দুর্বল স্বরাজ্যনির্বাসিত মানুষ। এর বেশি আমার কাছে আর কোনও পরিচয় নেই সেই রামের। তবে হ্যাঁ, এটা সত্য যে দেবতাদের সাহায্য রয়েছে ওর সঙ্গে। আর থাকবে না-ই বা কেন? আমি দেবতাদের শত্রু, রাম আমার শত্রু, আর শত্রুর শত্রু মিত্র। কিন্তু তাতে কী-ই বা আসে যায় রাণী? তুমি কি জানো না যে কীভাবে দেবতারা বারবার আমার হাতে পরাজয়ের মুখ দেখেছে?”

“জানি নাথ। সেই যুদ্ধের দিনগুলোতে আপনি যখন ভোরে অস্ত্র হাতে যাত্রা করতেন তখন আমিই তো সাগ্রহে আপনার কপালে বিজয়-তিলক পরিয়ে দিতাম।” একটা ম্লান হাসির রেখা যেন মন্দোদরীর ঠোঁটে একমুহূর্তের জন্যে কেঁপে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল।

“দেবতা বা মানুষের কোনওদিন ক্ষমতা নেই যে আমাদের, রাক্ষসদের হারাতে পারে। এটাই চির সত্য আর এটা ওই দেবতারাও খুব ভালোভাবেই জানে। আমার ভ্রাতা মহাবীর কুম্ভকর্ণ, আমাদের সকল বীর পুত্রগণ, রাক্ষসশ্রেষ্ঠ পুত্র মেঘনাদ, এদের কারোরই পরাজয়ের কারণ ওই রাম বা দেবতারা নয়, শুধুমাত্র সেই বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ।”

সমুদ্রে কোথাও বোধহয় ঝড় উঠেছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া যেন ঘরের অন্ধকারটা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। মন্দোদরী নীরবে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তমের মুখের দিকে। সেই বলিষ্ঠ চোয়াল, উন্নত গ্রীবা, তীক্ষ্ণ নাসা আর টানা টানা চোখদুটো। আজও সেই প্রথম যৌবনের তেজ যেন ঠিকরে পড়ছে ওই চোখে। কিছুক্ষণ দুজনেই ডুবে রইল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়।

রাবণ জানালা ছেড়ে আবার এসে বসলেন মন্দোদরীর পাশে। ওঁর চোখের তারায় সেই প্রথম রাতের প্রেম। দুজনের মাঝে আজ অসীম অন্ধকার, তবু মন্দোদরী যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রাবণের সেই গভীর অনুভূতিসিক্ত দৃষ্টি। সেই ভালোবাসা, সেই প্রেম, সেই প্রথম দেখার আবেগ আজও অমলিন ওই দু’চোখে। মন্দোদরী আস্তে আস্তে রাবণের কাঁধে মাথা রেখে এলিয়ে পড়ল। “যুদ্ধ থেকে কি সরে আসা যায় না স্বামী?” গলাটা কেঁপে উঠল ওর।

রাবণ মন্দোদরীকে নিজের আরও কাছে টেনে নিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, “উত্তরটা তুমি জানো প্রিয়ে। এই যুদ্ধ রাক্ষসকুলের সম্মানের যুদ্ধ। আমি যে শুধু তোমার স্বামী নই, রাক্ষস জাতির অধিপতিও, সেটা কেন ভুলে যাও?”

রাবণ নিজের বুকের ওপর মন্দোদরীর তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাসটা স্পষ্ট অনুভব করলেন। রাবণ আবার বলতে লাগলেন, “প্রিয়ে, কালকের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আজ কিছু কথা বলে যেতে চাই তোমাকে। হয়তো কাল আর সম্ভব হবে না।”

বুকের ভেতরটা যেন কেঁপে উঠল মন্দোদরীর। অসহায় বালিকার মতো সে তাকাল রাবণের দিকে। রাবণ বললেন, “বহুকাল আগে স্বর্গ থেকে জিতে আনা অমৃতকুম্ভ আমি নিজের মায়াশক্তি দিয়ে স্থাপন করেছিলাম নিজের নাভিতে। কেউ যদি ব্রহ্মাস্ত্র বা সমতুল্য শক্তিশালী কোনও অস্ত্র দিয়ে আমার নাভিতে আঘাত করে তবেই আমার মৃত্যু সম্ভব। অন্য কোনওভাবে কেউ আমায় মারতে পারবে না। হাজারবার আমার মাথা কাটুক বা আমার ওপর পাশুপত অস্ত্রই প্রয়োগ করুক, কিছুতেই আমি মরব না। আমার মৃত্যুর এই উপায় তো তোমার অজানা নয়। আর বিভীষণেরও নয়। রামের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র আছে আর বিভীষণের কাছে আছে আমার মৃত্যুরহস্য। অতএব প্রিয়ে, এই আমাদের শেষ রাত্রি।” আসন্ন বিচ্ছেদের ব্যথা হাসির আড়ালে ঢাকতে চাইলেন লঙ্কেশ্বর কিন্তু চোখদুটো যেন সব সত্য বলে দিল। আজ অনেকদিন পর মন্দোদরীর দু’চোখও ছলছল করে উঠল।

রাবণের মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বললেন, “এবার তোমায় কিছু গোপন কথা বলছি, মন দিয়ে শোনো। আমার নাভিতে অমৃতকুম্ভ থাক বা না থাক বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতায় কাল আমার মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু আমার নাভিতে যদি অমৃতকুম্ভ থাকে তবে আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেবতারা আবার তা পেয়ে যাবে এবং আগের মতোই অমর ও দৈবী-শক্তিধর হয়ে পৃথিবীর প্রভু হয়ে উঠবে। যেই আসন থেকে একদিন টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে পৃথিবী-ছাড়া করেছিলাম ওদের আবার সেই আসনেই চড়ে বসবে ওরা। আর ওই হীনবল মানুষগুলো আবার তাদের সামনে মাথা নুইয়ে তাদের পদলেহন শুরু করবে। রাক্ষসদের আবার প্রাণভয়ে লুকিয়ে বেড়াতে হবে বনে-জঙ্গলে। সেসব দিন আমি কিছুতেই আবার ফিরে আসতে দেব না।” শেষের কথাগুলো বলতে বলতে রাবণের গলা এক অদ্ভুত দৃঢ়তায় গর্জে উঠল।

আগামী কালকের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ মন্দোদরীর চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসছে, তবু কেন কে জানে, ওর বুকের ভেতরটা যেন ধুকপুক করছে এক অজানা আশংকায়।

একটু থেমে রাবণ আবার বলতে লাগলেন, “এসব এড়ানোর একটাই রাস্তা। যদি এই অমৃতকুম্ভ কাল আমার নাভিতেই না থাকে।”

“স্বামী...” মন্দোদরীর দৃষ্টিতে ভয়ের কালো ছায়া।

“চিন্তা কোরো না প্রিয়ে, লঙ্কেশ্বর রাবণ কোনওদিন হারেনি আর কালও হারবে না।” একটা শান্ত হাসির রেখা ভেসে উঠল রাবণের ঠোঁটের কোণে। “মৃত্যু তো শুধু এই দেহের। রাবণ কোনও দেহ নয়, রাবণ বিদ্রোহের আরেক নাম। রাবণ সেই অনমনীয় মানসিকতার নাম যার উদ্ধত খড়গের সামনে একদিন ঝুঁকতে হয়েছিল স্বর্গের শ্রেষ্ঠতম দেবতাদেরও। প্রিয়ে, আমি আবার ফিরে আসব, আর আমার সেই পুনরাগমনের জন্যই এই অমৃতকুম্ভের সুরক্ষিত থাকা প্রয়োজন।”

মন্দোদরীর চোখের জল গাল বেয়ে পড়তে লাগল। আকাশে মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঠেছে। ঘরের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে রুপোলি জ্যোৎস্নায়। আর তারই মাঝে চির প্রেমিক দুই আত্মা নীরবে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। রাবণ মন্দোদরীর চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, “একদিন এই পৃথিবীতে আমার যোগ্য উত্তরাধিকারী আসবে, তার মধ্য দিয়েই আমি ফিরে আসব আবার। ফিরে আসবে রাক্ষস আধিপত্য। ততদিন এই বিশ্বের বুকেই এক অতল অন্ধকারে লুকোনো থাকবে আমার অমৃতকুম্ভ। দেবতাদের দৃষ্টি থেকে অনেক অনেক দূরে।”

মন্দোদরীর গলাটা বুজে এল। কী একটা কথা যেন বলতে গিয়েও আর বলা হল না, শুধু রাবণের বুকের ওপর গড়িয়ে পড়ল ওর এক ফোঁটা চোখের জল।

(২)

শীতের রাত। এখনও বরফ পড়তে শুরু করেনি, কিন্তু বাতাসে বেশ কনকনে ছোঁয়া। রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান। গায়ে গায়ে লেগে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা দু-চারটে কুকুর আর বেশ খানিকটা দূরে একটা বাড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে ঢুলতে থাকা এক নৈশপ্রহরী ছাড়া আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ সামনের ওই ঘুটঘুটে অন্ধকার গলিটা দিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এল এক মাতাল। মুখে উস্কখুস্ক দাড়ি, গায়ে একটা বহুদিনের না-ধোয়া ময়লা কোট, বেশ কিছু জায়গায় ছিঁড়েও গেছে। কিন্তু এককালে যে পোশাকে বেশ আভিজাত্যের পরশ ছিল তা এখনও বোঝা যায়। মাথার এলোমেলো সোনালী চুলের ওপর এলিয়ে পড়া হ্যাটটারও একই দশা। লোকটা আগের মতোই টলতে টলতে আরও কিছুটা এগিয়ে একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ওর চোখদুটো মদের নেশায় লাল হয়ে আছে, ঠিকমত তাকাবার ক্ষমতাটুকুও নেই। ফিরে দাঁড়িয়ে সেই ঢুলুঢুলু চোখে সে একবার তাকাল ওই অন্ধকার গলিপথের দিকে। এরই শেষপ্রান্তে সেই পানশালা যেখান থেকে এখনই বেরিয়ে এসেছে এই লোকটি। সেদিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ জড়িয়ে আসা গলায় সে চিৎকার করে উঠল, “শালা ছোটলোকের বাচ্চা, আমাকে বলে মদ দেবে না! টাকা চাইছে আমার কাছে! জানিস হারামজাদা, আমি কে? আমি রাজা। মিলানের রাজবংশের রক্ত আমার গায়ে। আমি পেন্টালিও স্ফোরজা। স্ফোরজা বংশের...”

কথাগুলো আর শেষ করা হল না পেন্টালিওর, নেশার ঘোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে। ততক্ষণে ওর চিৎকারের শব্দে সেই নৈশপ্রহরীর ঘুম চটে গেছে। গজগজ করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসতে লাগল সে। এই ঘটনা নতুন কিছু না। প্রায়ই এভাবে মদ খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে থাকে বা চিৎকার চেঁচামেচি করে পেন্টালিও। আগেও কয়েকবার এই নৈশপ্রহরীই অজ্ঞান পেন্টালিওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে, আজও বোধহয় তার ব্যতিক্রম হবে না।

মদের নেশায় কথাগুলো বললেও ভুল বলেনি পেন্টালিও। পঞ্চদশ শতকের ইতালি তখন কতগুলো স্বাধীন নগর-রাজ্যের সমষ্টি। আর তারই মধ্যে একটি হল এই মিলান, যেখানে ছিল স্ফোরজা বংশের শাসন। পেন্টালিও সেই বংশেরই ছেলে। ইতালি সহ ইউরোপের আরও বহু জায়গায় তখন শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য ও বিজ্ঞানে নতুন চিন্তার স্রোত বইছে, চারিদিকে সৃষ্টিশীলতার এক নব-জাগরণ। রেনেসাঁ। এই সময়ই নিজের প্রাচীনপন্থী পিতার সঙ্গে মতের অমিলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে পেন্টালিও, শিল্প-সাহিত্যে নিজের স্বপ্নের জগৎ গড়তে। কিন্তু স্বপ্ন দেখা যতটা সহজ স্বপ্নকে সত্য করে তোলা ততটাই কঠিন। রাজবংশের ছেলে পেন্টালিও, জীবনে কোনওদিন খাওয়া-পরার চিন্তা করতে হয়নি তাকে। কিন্তু হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে বেরোবার পর এই ক্ষুন্নিবৃত্তিই হয়ে উঠল তার কাছে সবচেয়ে বড় চিন্তা। খালি-পেটে তো আর শিল্প-সাহিত্য চলে না! স্ফোরজা বংশের ছেলে হওয়ার সুবাদে প্রথমদিকে কিছু কাজ জুটে যেত কিন্তু পেন্টালিওর খামখেয়ালি স্বভাবের কারণে এক এক করে সেই সব চাকরি থেকেই বরখাস্ত হয় সে। হাতে জমানো টাকাও ফুরিয়ে আসতে থাকে একটু একটু করে। একদিকে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠা অর্থকষ্ট আরেকদিকে শিল্প-সাহিত্যেও ক্রমাগত ব্যর্থতা। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আস্তে আস্তে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকে পেন্টালিও। শুরু হয় মদ, মেয়েমানুষ। ছোটখাটো কাজ করে যা-ই হাতে আসত তাই সে উড়িয়ে দিতে লাগল এইসব নেশার পেছনে। যেই রঙিন স্বপ্ন চোখে নিয়ে একদিন নিজের সুখের জীবন জলাঞ্জলি দিয়ে ঘর ছেড়ে ছিল পেন্টালিও আজ সে বহুদূরে ছিটকে গেছে সেই স্বপ্নের দুনিয়া থেকে। এখন ওর জীবন জুড়ে শুধুই ক্ষুধা, বিষাক্ত নেশা ভরা অন্ধকার রাত আর অপূর্ণতার হা-হুতাশ।

নৈশপ্রহরী আস্তে আস্তে ধরে তুলল পেন্টালিওকে। রাস্তার ওপারেই একটা গলির ভেতর ছোট এক ঘুপচি মতন ঘরে ভাড়া থাকে পেন্টালিও। ভালো করেই চেনে সেই প্রহরী। সেদিকেই এগোতে যাবে এমন সময় হঠাৎ বেশ সুন্দর বাঁধানো একটা বই চোখে পড়ল তার। চামড়া দিয়ে বাঁধানো। পেন্টালিও যেখানে পড়েছিল ঠিক তার পাশেই পড়ে আছে বইটা। নৈশপ্রহরী হাতে নিয়ে দেখল। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ভেতরে কিছুই লেখা নেই, পাতাগুলো একেবারে সাদা। বেশ দামি পার্চমেন্ট পেপার। হয়তো পেন্টালিওর পকেট থেকেই পড়েছে, এই ভেবে সে বইটাও সঙ্গে নিয়ে নিল। পেন্টালিও তখনও প্রায় অজ্ঞান, শুধু নেশার ঘোরে মাঝে মাঝে গোঙাচ্ছে।

দুয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই নৈশপ্রহরী পেন্টালিওকে নিয়ে এল তার ঘরের সামনে। তারপর পেন্টালিওর পকেট থেকেই চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে পৌঁছে দিল তাকে। আর সেই বইটাও রেখে দিল পেন্টালিওর টেবিলেই।

এমন এর আগেও অনেকবার করেছে এই প্রহরী, কিন্তু পেন্টালিও কোনওদিনই জানতে পারেনি। হয়তো রাজরক্ত বলেই এই অযাচিত সেবাটুকু এখনও ওর ভাগ্যে জোটে। নইলে এমন কত মাতালই তো রোজ এখানে সেখানে রাস্তায় পড়েই রাত কাটায়। পেন্টালিও স্ফোরজা না হলে সেও হয়তো আজকে এই শীতের রাতে পথের ধারেই পড়ে থাকত।

***

গভীর রাতে হঠাৎ নেশার ঘোর কেটে ঘুম ভেঙে গেল পেন্টালিওর। মাথার ভেতর একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছু যেন সড়সড় করে বয়ে যাচ্ছে স্নায়ুতে স্নায়ুতে। মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাবে। উঠে বসল পেন্টালিও। অসহ্য ব্যথায় মাথাটা চেপে ধরেছে সে। হঠাৎ সে শুনতে পেল কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলছে। কোনও এক অজানা ভাষা। কিন্তু আশেপাশে তো কেউ নেই। হঠাৎ এক অকারণ ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল পেন্টালিওর। কী হচ্ছে এসব! ব্যথাটা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে কিন্তু সেই ফিসফিসানি তীব্রতর হয়ে উঠছে আরও। সেই অশরীরী কণ্ঠ যেন আরও কাছে এগিয়ে এসেছে, ঠিক যেন মাথার ভেতর থেকে কথা বলছে সে। এক অদ্ভুত ভাষা কিন্তু যেন খুব স্পষ্ট। একটু একটু করে পেন্টালিও যেন সম্মোহিত হয়ে পড়তে লাগল। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, সব হারিয়ে যাচ্ছে চারপাশে থেকে, কোথাও কোনও শব্দ নেই, অসীম নিস্তব্ধতার পটে আরও স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে সেই অচেনা কণ্ঠস্বর। আর সব শব্দ, সব দৃশ্য, চারপাশের এই ঘর, বিছানা এমনকি পেন্টালিওর নিজের অস্তিত্বটাও যেন মুছে গেছে, শুধুই সেই অপরিচিত শব্দগুচ্ছ ভেসে আসছে বহুদূরের কোনও ভূমি থেকে, হয়তো চেতন-অবচেতনের পারের কোনও লোক থেকে।

আচ্ছন্নের মতো উঠে দাঁড়াল পেন্টালিও। সে যেন এখন শুধুই এক যন্ত্রচালিত মূর্তি। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ঘরের একপাশে রাখা টেবিলটার দিকে। চেয়ার টেনে বসল। সামনেই সেই চামড়ায় বাঁধানো বই। কালির দোয়াত থেকে কলমটা তুলে নিয়ে সেই বইয়ের সাদা পাতায় লিখতে শুরু করল সে। পেন্টালিওর দু’চোখ চেয়ে আছে সামনের দেয়ালের দিকে; নিস্পন্দ, পাথরের মূর্তির মতো অপলক। ওর সারা শরীর অসাড় পুতুলের মতো স্থির হয়ে আছে। হাত শুধু লিখে চলেছে সাদা কাগজের বুকে।

***

জানালা বেয়ে আসা রোদের কড়া আলোয় বেশ বেলার দিকে ঘুম ভাঙল পেন্টালিওর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে একবার এদিক-ওদিক তাকাল সে। লেখালেখির টেবিলের সামনে মেঝেতে সে বসে আছে। তবে কি সারারাত মেঝেতে শুয়েই কাটিয়েছে পেন্টালিও? নিজের মনেই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ স্বপ্নের মতো একটা ছবি ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর মাথায়। কাল রাতে বিছানায় শুয়েছিল সে, হঠাৎ মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করতে শুরু করে। ঘুম ভেঙে যায়। কে একজন যেন কীসব বলছিল কানের কাছে ফিসফিস করে। কিন্তু তারপর অনেক চেষ্টা করেও আর কিছুই মনে করতে পারল না পেন্টালিও। কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকার পর যখন উঠে দাঁড়াল সে তখন প্রথমেই চোখ পড়ল টেবিলে রাখা বাঁধানো বইটার দিকে। খুলেই রাখা ছিল। প্রথম পাতা জুড়ে এক অদ্ভুত ভাষায় কীসব যেন লেখা। দেখতে অনেকটা ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মতো হলেও এটা যে সম্পূর্ণ অজানা এক ভাষা তা বুঝতে অসুবিধে হল না পেন্টালিওর। লেখাগুলোর পাশে আবার রঙিন কালি দিয়ে একটা ছোট গাছও আঁকা, ফুল ফুটে আছে তাতে। কিন্তু এই গাছ এবং ফুলও পেন্টালিওর কাছে পরিচিত বলে মনে হল না। বেশ কিছুক্ষণ ভেবেও কিছুই বুঝে উঠতে পারল না সে। শেষ অব্দি ঠিক করল যে বইটা কোথাও কোনও দোকানে বিক্রি করে দেবে। হাজার হোক বেশ দামী বাঁধাই আর কাগজ বইটার, কিছুটা কমে বিকোলেও আজ রাতের মদের টাকা উঠে যাবে।

বিকেল নাগাদ সেই উদ্দেশ্যেই বইটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল পেন্টালিও।

যখন ফিরল তখন বেশ রাত। মদের নেশায় টলতে টলতে কোনোমতে ঘরের দরজাটা বন্ধ করেই মেঝেতে বসে পড়ল সে। বিছানা অব্দি যাবার আর সামর্থ্য নেই।

কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ আবার প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেল পেন্টালিওর। যন্ত্রণায় মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। আর সঙ্গে সেই অচেনা অশরীরী কণ্ঠ অজানা ভাষায় যেন ফিসফিস করে চলছে মগজের খাঁজে খাঁজে। ঠিক গতরাতেরই মতো। পেন্টালিওর চোখের সামনে থেকে সব মুছে যেতে লাগল একটু একটু করে।

***

পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল, পেন্টালিও আঁতকে উঠল টেবিলের দিকে তাকিয়েই। সেই বইটা! তার স্পষ্ট মনে আছে গতকাল বিকেলে সে বাইরে বিক্রি করে এসেছে বইটাকে। তাহলে? উঠে দাঁড়িয়ে বইটার কাছে গেল সে। আজ দ্বিতীয় পাতাটাও ভরে গেছে সেই অদ্ভুত অচেনা অক্ষরগুলোতে। সঙ্গে একটা গাছের ছবি, ফুল সহ। কিন্তু প্রথম পাতার ছবিটা থেকে একেবারে আলাদা। পেন্টালিওর গা-টা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। এসব কী ঘটছে তার সঙ্গে?

না, আর দেরি করা যাবে না। সে তখনই বইটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে একটা আস্তাকুঁড়ে ফলে দিয়ে এল সে বইটাকে।

কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে আবার সেই দৃশ্য। টেবিলের ওপর বইটা রাখা। আজ তৃতীয় পাতাও ভরে গেছে লেখা আর ছবিতে। বুকের ভেতরটা এক অজানা ভয়ে ধুকপুক করতে লাগল পেন্টালিওর। সে প্রায় পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল নিজের ঘর থেকে। ভয়ে বুক কাঁপছে ওর। “পড়ে থাক ওই ভূতুড়ে বই, আমি আর এই বাড়িতেই ফিরব না।”

সেদিন সত্যিই আর ফিরল না পেন্টালিও। রাতে বাড়ি থেকে অনেক দূরে এক চার্চের ভেতরই শুয়ে পড়ল সে।

কিন্তু পরদিন যখন চোখ খুলল, বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল ওর। সে নিজের বাড়িতে টেবিলের সামনের মেঝেতে শুয়ে আছে আর টেবিলের ওপর সেই বইটা খোলা। আজ চতুর্থ পাতাটাও ভরাট হয়ে গেছে লেখায়। পেন্টালিওর বেশ মনে আছে সে কাল এখান থেকে অনেক দূরের এক চার্চের ভেতর ঘুমিয়ে ছিল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছিল প্রচণ্ড মাথাব্যথায়, কিন্তু তারপর আর কিছুই মনে নেই ওর। এখানে কে নিয়ে এল তবে? আর ওই বই! শীতের সকালেও কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগল পেন্টালিওর।

***

কতদিন যে এভাবে চলল পেন্টালিও নিজেও জানে না। সে রোজ এই বই, এই বাড়ি থেকে দূরে পালায় কিন্তু সকালে আশ্চর্যভাবে নিজের বাড়িতে এই টেবিলের সামনের মেঝেতেই ঘুম ভাঙে ওর। আর রোজ একটা করে পাতা সেই অজানা ভাষা আর অচেনা ছবিতে ভরে ওঠে। শেষদিকে কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে গেছিল পেন্টালিওর।

আজ সকালে বইয়ের শেষ পাতাটাও ভরে গেছে। টেবিলে বসে বইটার দিকেই তাকিয়েছিল সে। তবে কি গতকালই এই অলৌকিক উপদ্রবের শেষদিন ছিল? আজ থেকে শান্তিতে বাঁচতে পারবে পেন্টালিও?

হঠাৎ এমন সময় কে যেন কড়া নাড়ল ওর দরজায়। দরজা খুলে দাঁড়াল সে। বাইরে একজন অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে। ইউরোপীয়দের মতোই ফর্সা গায়ের রং কিন্তু পোশাক-আশাক একেবারে আলাদা। ইউরোপের কোনও দেশে এমন পোশাক কেউ পরে না।

“কাকে চান?” পেন্টালিও জিগ্যেস করল।

লোকটা কোনও উত্তর দিল না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পেন্টালিওর দিকে। হঠাৎ পেন্টালিও চমকে উঠল। লোকটার চোখের মণি থেকে নীলাভ আলো বেরোচ্ছে। পেন্টালিওর মনে হল যেন ওর সারা শরীর, মন অবশ হয়ে আসছে ওই নীল আলোর ছোঁয়ায়। আস্তে আস্তে চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল, মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ওর অচেতন শরীর।

(৩)

নিউইয়র্কের এক পাঁচ-তারা হোটেলে একটু আগেই শেষ হয়েছে মিটিংটা। মার্কিন সফটওয়ার কোম্পানি ওয়েসিস ও ইন্ডিয়া বেসড বিখ্যাত এম.এন.সি রাঠোর গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের মধ্যে ছিল এই মিটিং। কিছুদিনের মধ্যেই নিউইয়র্কে নিজেদের ব্রাঞ্চ খুলতে চলেছে রাঠোররা, আর তাতে ওয়েসিসকে পার্টনার হিসেবে পাওয়াটা খুবই জরুরি। আজ এই মিটিং-এ তারই ভবিষ্যৎ রূপরেখা ও কার্যপ্রণালী ঠিক হয়ে গেল। মিটিং সাকসেসফুল। ওয়েসিস ত্রিশ পার্সেন্ট পার্টনারশিপে এগ্রিমেন্ট ফাইনাল করেছে। এখন বাকি কাজটা ঠিকঠাক হলে এটাই হবে আমেরিকার মাটিতে রাঠোরদের প্রথম পদক্ষেপ। এই মিটিং-এর গুরুত্ব কোম্পানির কাছে অনেকটাই। তাই শুধু কোম্পানির তাবড় তাবড় মাথারা নন এমনকি খুদ বিশ্বরাজ সিং রাঠোর, এই কোম্পানির সি.ই.ও, তিনিও উপস্থিত ছিলেন এখানে। গতকালই কোম্পানির বেশ কিছু বড় বড় অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে দিল্লি থেকে নিউইয়র্ক এসে পৌঁছেছেন বিশ্বরাজ। বয়স খুব বেশি না, চল্লিশ পেরোয়নি এখনও। কিন্তু এই অল্প বয়সেই যেই অসাধারণ দক্ষতায় পারিবারিক ব্যবসাকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি তা সত্যিই ভাবা যায় না। যেমন তীক্ষ্ণ মেধা তেমনি বলিষ্ঠ পেটানো শরীরের অধিকারী বিশ্বরাজ, আর সেই সঙ্গে রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রমী মানসিকতা। তার টিকালো নাকের দু’পাশে টানা টানা চোখ দুটোতে এক অদ্ভুত দৃপ্ততা যেন ঠিকরে পড়ছে সবসময়।

মিটিং থেকে বেরিয়ে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার অরোরা এবং আরও কয়েকজন বড় অফিসারের সঙ্গে কিছু কথা বলছিলেন তিনি, এমন সময় হঠাৎ তার মোবাইলটা বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নম্বরটার দিকে একবার ভুরু কুঁচকে তাকালেন; নম্বরটা কন্ট্যাক্ট লিস্টে সেভ করা কোনও নম্বর নয়। কিন্তু একেবারে অচেনাও বোধহয় নয়।

“এক্সকিউজ মি জেন্টলম্যান...” মোবাইলটা নিয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন বিশ্বরাজ।

“হ্যালো।”

“কাজ হয়ে গেছে স্যার। ম্যানুস্ক্রিপ্টটা এখন আমার কাছে।” ফোনের ওপার থেকে একটা চাপা গলা ভেসে এল।

“গ্রেট! কাল নিউইয়র্ক এয়ারপোর্ট। বাকি ডিটেলস ইমেইলে পেয়ে যাবে।” ফোনটা রেখে দিলেন বিশ্বরাজ।

***

পরদিন সকাল সাতটা নাগাদ এয়ারপোর্টে পৌঁছলেন তিনি। কোম্পানির বেশ কয়েকজন অফিসারও সঙ্গে রয়েছেন। আর দু’ঘন্টা পর এখান থেকেই দিল্লির ফ্লাইট। এখনও হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে, ধীরেসুস্থেই সিকিউরিটি চেকিং-এর দিকে এগোনো যাবে। তাই এয়ারপোর্টের একটা ফুড আউটলেটে এক এক কাপ কফি নিয়ে বসলেন তারা।

মিস্টার অরোরা তখন বাকিদের সঙ্গে কিছু আলোচনায় ব্যস্ত। বিশ্বরাজ একাই বসেছিলেন পাশের টেবিলটায়। তার চোখদুটো যেন কাউকে খুঁজছে। হঠাৎ বিশ্বরাজের নজর পড়ল খয়েরি হ্যাট পরা বছর ত্রিশের এক আমেরিকান যুবকের ওপর। সেই যুবকটিও যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হাতে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ। বিশ্বরাজ নিজের মোবাইলে কাকে যেন একটা ম্যাসেজ করলেন। আর ঠিক তখনই হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল তার। মীরার ফোন।

“হ্যালো।”

“কী করছ? ফ্লাইট কখন?”

“তেমন কিছু না, বাকিদের সঙ্গে এয়ারপোর্টে বসে আছি। এই তো ন’টা নাগাদ ছাড়ার কথা। তোমার ওষুধগুলো খেয়েছ?”

“হ্যাঁ, এইমাত্র খেলাম।”

“গুঞ্জন কোথায়?”

“এইতো স্কুলের জন্যে রেডি হচ্ছে। তোমার তো অনেক রাত হবে ফিরতে, তাই না?”

“হ্যাঁ। সব ঠিকঠাক সময়ে চললেও বারোটার আগে ঘরে ঢোকার কোনও আশা নেই। আমার জন্যে শুধু শুধু জেগে বসে থেকো না, খেয়ে ঘুমিয়ে পোড়ো।”

“আচ্ছা, সে হবে’খন। দিল্লি নেমেই একটা ফোন করে দিও কিন্তু।”

“ঠিক আছে। এখন রাখছি। বোর্ডিং-এর সময় হয়ে এল।”

মীরা, বিশ্বরাজের স্ত্রী আর তাদের একমাত্র মেয়ে গুঞ্জন। এবার থার্ড স্ট্যান্ডার্ডে উঠল। দিল্লির বসন্ত বিহার এলাকায় বিশ্বরাজের বিশাল বাংলোতে নিজের লোক বলতে এখন এরাই। মা-বাবা অনেকদিন হল মারা গেছেন। তবে আরেকজন আছে যাকে বিশ্বরাজ নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তার একমাত্র ছোট ভাই বিক্রম। বিশ্বরাজ অনেক বুঝিয়ে ছিলেন তাকে, কিন্তু কোনও ফল হয়নি। ছেলেবেলা থেকেই দেশসেবার ভূত ওর মাথায়। দেশের জন্যে নাকি প্রাণ দেবে। তাই এই এতবড় এম.এন.সি ছেড়ে দিয়ে আর্মি জয়েন করেছে সে। বছরের অধিকাংশ সময়ই বাড়িতে থাকা হয় না বিক্রমের, কখনও সখনও আসে।

সামনের ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে যে ফ্লাইট সময় মতোই চলছে। ফোনটা পকেটে রেখে একবার হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলেন বিশ্বরাজ। পৌনে আটটা বাজে। এবার এগোনো দরকার।

“চলুন মিস্টার অরোরা। এবার ওঠা যাক।”

“হ্যাঁ, সময় তো হয়েই এল।”

বাকিরাও নিজেদের ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সিকিউরিটি চেকিং শেষ করে আস্তে আস্তে ফ্লাইটের দিকে এগোতে লাগলেন তারা।

“তাহলে আমাদের আবার আগামী মাসে তো নিউইয়র্ক আসতেই হচ্ছে?” বিশ্বরাজের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললেন মিস্টার অরোরা।

বিশ্বরাজ একটু হাসলেন। “হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক এগোলে আগামী মাসের মধ্যেই কাজ শুরু করতে পারব আমরা। লিগ্যাল ব্যাপারগুলো মিস্টার রবার্টসনকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তো?”

“হ্যাঁ স্যার। ওসব নিয়ে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না।”

বিশ্বরাজ নিজের পকেট থেকে টিকিটটা বের করে একবার দেখে নিলেন। ‘6A’।

“আপনার সিট নম্বর তো বেশ খানিকটা দূরে পড়েছে দেখছি। আমাদের সবার তো প্রায় একসঙ্গেই।” পাশ থেকে মিস্টার অরোরা বললেন।

“ওহ! যাক, এখন ফ্লাইটের দরজায় এসে তো আর কিছু করার নেই।” হ্যান্ডব্যাগের ফিতেটা একটু ঠিক করতে করতে বললেন বিশ্বরাজ।

***

প্লেনের ভেতর ঢুকে যে যার সিটের দিকে এগোতে লাগলেন। মিস্টার অরোরা সহ বাকিদের সিট ১৭ নম্বর সারিতেই পড়েছে, শুধু বিশ্বরাজের সিটটাই অনেকটা সামনে। নিজের সিটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই 6B তে বসে থাকা লোকটার সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল বিশ্বরাজের। মাথায় সেই খয়েরি হ্যাট। চিনতে অসুবিধে হল না তার। 6B তে যার বসার কথা সে-ই বসে আছে। লোকটি চোখের ইশারায় ওপরের হ্যান্ডব্যাগ রাখার জায়গাটার দিকে ইঙ্গিত করল। বিশ্বরাজ মাথার ওপরে ব্যাগ রাখার জায়গাটা খুললেন। বাঁদিক ঘেঁষে একটা ব্যাগ রাখা আছে সেখানে। দেখতে হবহু বিশ্বরাজের হাতের ব্যাগটার মতোই। বিশ্বরাজ নিজের ব্যাগটা সেই ব্যাগের ঠিক পাশে রাখলেন। তারপর কোম্পানির বাকিদের দিকে তাকিয়ে একবার হাত নেড়ে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়লেন। পাশে বসা লোকটা তখন খবরের কাগজ পড়তে ব্যস্ত। বিশ্বরাজ একবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আশেপাশে যতদূর চোখ যায় দেখবার চেষ্টা করলেন। সামনে প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। বোর্ডিং কমপ্লিট। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন টেক অফ করার জন্যে এগোবে।

***

নিউইয়র্ক থেকে দিল্লি প্রায় সাড়ে চোদ্দো ঘন্টা সময় লাগল। ঘড়িতে এখন রাত সাড়ে এগারোটা। ফ্লাইট থামার পর 6B তে বসা সেই লোকটাই প্রথমে উঠে দাঁড়াল। তারপর ওপর থেকে একটা হ্যান্ডব্যাগ নামিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। একটু পরে বিশ্বরাজও দ্বিতীয় হ্যান্ডব্যাগটা নামিয়ে নিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে বাকি জিনিসপত্র নিয়ে বেরোতে বেরোতে ঘড়ির কাঁটা নতুন দিনের গণ্ডিতে ঢুকে পড়েছে।

বাইরে আগে থেকেই প্রত্যেকের গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। বিশ্বরাজ নিজের কালো ওডি গাড়িটায় উঠে বসলেন। কোলের ওপর সেই হ্যান্ডব্যাগটা। এয়ারপোর্টের গেট পেরিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে উঠতে মিনিট দশেকের বেশি লাগল না। ব্যাগের চেইনটা অল্প ফাঁক করে একবার তাকালেন বিশ্বরাজ। না, কোনও ভুল হয়নি। ঠিক জিনিসটাই আছে। এর জন্যে পঞ্চাশ হাজার কেন পঞ্চাশ লাখ ডলার দিতেও কোনও আপত্তি নেই! তার ঠোঁটের কোণে একটা ধারালো হাসি ঝলসে উঠল।

(৪)

“না। আর দেরি করা ঠিক হবে না।” নিজের মনেই কথাগুলো বলতে বলতে বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন কমান্ডার ইন্দ্র। ভার্চুয়াল চেয়ারটাও অদৃশ্য হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তার চোখেমুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠছে। সকাল নাগাদই এসে পৌঁছেছে খবরটা। পৃথিবীতে থাকা গুপ্তচর ডিজিক কোডে সংকেত পাঠিয়েছে।

ইন্দ্রের বয়স প্রৌঢ়ত্বের গণ্ডিতে এসে ঠেকেছে ঠিকই কিন্তু এখনও শরীর যথেষ্ট বলিষ্ঠ এবং কর্মক্ষম। কাঁচাপাকা চুলের নিচে চওড়া কপাল, টিকালো নাক আর শিকারীর মতো ধারালো দুটো চোখ সেই কথাই বলছে।

এমন সময় হঠাৎ একটা ভার্চুয়াল স্ক্রিন ভেসে উঠল ইন্দ্রের সামনে। ঘরের বাইরে কমান্ডার ঋক দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দ্র পেছন ফিরে আঙুল দিয়ে ইশারা করলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে সামনের দেয়ালের একটা অংশ সাবানের বুদবুদের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠল। ঘরে ঢুকল ঋক।

“আপনার চিন্তাতরঙ্গীয় বার্তা পেলাম একটু আগেই।” ঋক বলল।

“হ্যাঁ। এস ঋক, তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। বোসো।” ইন্দ্রের কথা শেষ হতে না হতেই ঋকের পেছনে একটা ভার্চুয়াল চেয়ার ভেসে উঠল। তাতেই গিয়ে বসল ঋক। ইন্দ্র তখনও দাঁড়িয়েই। তার চোখদুটো যেন তাকিয়ে আছে কোনও আসন্ন বিভীষিকার দিকে।

“আপনাকে আজ কেমন যেন একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু কি হয়েছে কমান্ডার?”

“এখনও হয়নি, কিন্তু আর দেরি করলে অনেক কিছুই হতে পারে। আমাদের পৃথিবীতে যেতে হবে ঋক।”

ঋকের চোখে বেশ কিছু প্রশ্ন একসঙ্গে ভেসে উঠল। ইন্দ্র তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটাই ভাবছ তো যে দশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের পৃথিবীতে কীভাবে যাব। আর কেনই বা যাব। প্রথমে কীভাবে-টার উত্তর দিচ্ছি।”

ঋকের সামনে একটা ভার্চুয়াল স্ক্রিন ভেসে উঠল। ওদের এই সার্গ গ্রহ থেকে কিছুটা দূরের মহাকাশের একটা খণ্ডচিত্র। ইন্দ্র সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “এখানে একটা অদৃশ্য দরজা আছে। যার একটা মুখ এদিকে খোলে আরেকটা পৃথিবীর হিমালয় নামে এক পাহাড়ের একটি গুহায়। দশ লক্ষ আলোকবর্ষের পথ মাত্র একঘন্টায় পেরোনো যায়। এই গোপন দরজা খোলার চিন্তাতরঙ্গ আপাতত এই পুরো সার্গ গ্রহে শুধু আমিই জানি। আর অদূর ভবিষ্যতে তুমিও জানতে চলেছ।”

ভার্চুয়াল স্ক্রিনটা আপনা-আপনি অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু থেমে ইন্দ্র আবার বললেন, “এবার অনেক পুরোনো কিছু কথা তোমাকে বলছি ঋক। সেখানেই কেন-র উত্তরটা পেয়ে যাবে। এই কথাগুলো তোমাদের প্রজন্মের প্রায় কেউই জানে না। পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহু যুগের। পৃথিবীর সময়ের হিসেবে প্রায় সত্তর হাজার বছর আগের কথা। তখন সার্গ গ্রহের তিনজন সর্বাধিনায়ক ছিলেন কমান্ডার বিষ্ণু, কমান্ডার রুদ্র ও কমান্ডার ব্রহ্মস। পৃথিবীতে যাবার এই গুপ্ত দরজাও তাঁরাই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন।

“আমি তখন তোমারই বয়েসী। আমরা যখন প্রথমবার পৃথিবীতে যাই তখন সেখানকার ঘন জঙ্গলে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত জীবজন্তুর সঙ্গে কিছু দু’পেয়ে বন্যজন্তুরও দেখা পেয়েছিলাম। দৈহিক গঠনে আমাদের সঙ্গে বেশ খানিকটা মিল ছিল ওদের। আমাদের বিজ্ঞানীরা ওদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল যে শুধু দেহগঠনে নয় জিনেও যথেষ্ট মিল রয়েছে। ব্যস, সেখান থেকেই আইডিয়াটা এল কমান্ডার ব্রহ্মসের মাথায়। জেনেটিক রিকন্সট্রাকশন। আমরা ওদের ডি.এন.এ-তে নিজেদের কিছু জিন প্রতিস্থাপন করে দিলাম। আর তারপর বাকি কাজ সময় করে দিল। কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই সেই বন্যজীবদের ভেতর অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল। তাদের বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করল। আমরা তখনও নানান পরীক্ষা চালাচ্ছিলাম ওদের ওপর।

“কিন্তু এরই মধ্যে ঘটল একটা অঘটন। আমাদেরই একজন বিজ্ঞানী প্রফেসর শুক্র এক অন্য কূট খেলায় মেতেছিলেন ওই জীবদের নিয়ে। তিনি সবার অজান্তে পৃথিবীর সেই দু’পেয়ে জন্তুদের দেহে এমন কিছু জেনেটিক পরিবর্তন ঘটান যার ফলে এক ভয়ানক জীবগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। কমান্ডার বিষ্ণু যখন ব্যাপারটা জানতে পারেন তখনই বিজ্ঞানী শুক্রকে সার্গ থেকে চিরতরে নির্বাসিত করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

“আমরা স্বাভাবিকভাবে যেই উন্নত চিন্তাশীল জাতির সৃষ্টি করেছিলাম তারাই বর্তমানে পৃথিবীর মানুষ। কিন্তু বিজ্ঞানী শুক্রের করা জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে যারা জন্মেছিল তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পুরাণে এদেরকেই রাক্ষস বা শয়তান বলা হয়েছে।

“মানুষরা চিন্তাশীল ছিল, বুদ্ধিমান ছিল কিন্তু আমাদের সমান শক্তিশালী কখনই ছিল না। আমরা সেভাবেই ওদের তৈরী করেছিলাম। কারণ আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মানুষের আনুগত্য লাভ করে বিনা যুদ্ধে পৃথিবীকে নিজেদের এক উপনিবেশে পরিণত করা। আর সেই উদ্দেশ্য অনেকাংশে সফলও হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষরা বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে তুলতে লাগল আর সেসব প্রাচীন সভ্যতায় আমরাই আলাদা আলাদা নামে তাদের কাছে দেবতা হিসেবে গণ্য হতে লাগলাম। ঠিক যেমনটা আমরা চেয়েছিলাম। এরকমই এক বহু পুরোনো সভ্যতা হল ভারতীয় সভ্যতা। সেখানে এখনও মানুষরা আমাদের সেই পুরোনো তিন কমান্ডারকেই ভগবান হিসেবে পুজো করে। আর আমাদের এই সার্গ গ্রহই হল ওদের কাছে দেবভূমি স্বর্গ। ওরা কোনওদিনই বুঝতে পারেনি যে আমরা দেবতা নই, শুধু অন্য এক গ্রহের উন্নততর জীব মাত্র।

“কিন্তু রাক্ষসরা ছিল মানুষদের সম্পূর্ণ উল্টো। প্রফেসর শুক্র নিজের দুরভিসন্ধির বশে জেনেটিক্সের এমন কিছু জায়গায় হাত দিয়ে বসেছিলেন যা সামলানোর ক্ষমতা তার নিজেরও ছিল না। বিবর্তনের ধাপে ধাপে সেসব বিভীষিকা প্রকট হয়ে উঠতে লাগল আমাদের সামনে। রাক্ষসরা মেধা, শক্তি, বুদ্ধি এবং আর সবদিক দিয়েই আমাদের সমকক্ষ ছিল। আর তাই স্বাভাবিক কারণেই মানুষদের মতো তারা আমাদের দেবতা বা ঈশ্বর বলে মানত না। উল্টে পৃথিবীতে আমাদের আধিপত্যের পক্ষে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে লাগল দিন দিন।

“আমরা অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই ওদের পুরোপুরি শেষ করতে পারিনি পৃথিবী থেকে। শুক্র এমন এক বিষাক্ত বীজ পুঁতে দিয়ে গেছিলেন যা একটু একটু করে বিশাল এক বিষবৃক্ষ হয়ে দেখা দিতে শুরু করে আমাদের সামনে। যত সময় এগোতে থাকে রাক্ষসদের শক্তি আরও বাড়তে থাকে এবং একসময় পৃথিবীতে এমন সব রাক্ষসের জন্ম হতে শুরু করে যারা শক্তি, বুদ্ধি আর সবকিছুতেই আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে ছিল।

“তেমনই এক রাক্ষস ছিল রাবণ। তার মা ছিল রাক্ষসী আর পিতা এক অতিমেধাবী মানুষ। সেযুগের পৃথিবীতে যাদের ঋষি বলা হত। আর তাই বোধহয় রাবণ এত ভয়ঙ্কর ছিল। যেমন অদ্ভুত তার মেধা তেমনি তার বাহুবল আর মানসিক শক্তি। সে আমাদের অধিপত্য পৃথিবী থেকে প্রায় মুছেই দিয়েছিল। সে-ই একমাত্র রাক্ষস যে পৃথিবী থেকে সার্গ গ্রহে এসে পৌঁছতে পেরেছিল ওই গোপন দরজা দিয়ে।

“আমি নিজের চোখে দেখেছি সেই রাক্ষসকে। সার্গের তাবড় তাবড় যোদ্ধারাও টিকতে পারেননি সেদিন তার খড়গের সামনে। এতটাই দুর্ধর্ষ সে, যে এই সার্গে এসে একা আমাদের সবাইকে হারিয়ে অ্যামার্টের কলস ছিনিয়ে নিয়ে গেছিল।”

এতক্ষণ অবাক হয়ে ইন্দ্রের কথাগুলো শুনছিল ঋক। হঠাৎ অ্যামার্ট শব্দটা শুনে সে জিগ্যেস করল, “এটাই কি সেই রাসায়নিক যার জন্যে সার্গের পুরোনো দিনের লোকেরা বহু বহু যুগ বেঁচে থাকতে পারত?”

“হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছ।” ইন্দ্রের আঙুলের ইশারায় ঋকের সামনে একটা ভার্চুয়াল স্ক্রিনে ভেসে উঠল সেই অ্যামার্ট-কলসের ছবি। ইন্দ্র সেদিকে তাকিয়ে বললেন, “এই সেই কলস। আমি সার্গের সেই শেষ প্রজন্মের একজন যাদের এই অ্যামার্ট পান করার সৌভাগ্য হয়েছিল।”

“তাহলে রাবণ কি এখনও বেঁচে আছে?”

“না। তবে আমরা কেউ মারতে পারিনি তাকে। সরাসরি তার সঙ্গে লড়ার সামর্থ্য আমাদের ছিল না তাই আমরা একজন মানুষের সাহায্য নিয়েছিলাম। রাম। মানুষ হলেও সে ছিল অসাধারণ পরাক্রমী এক যোদ্ধা। কমান্ডার বিষ্ণু নিজে ওকে যুদ্ধের জন্যে তৈরী করেছিলেন।”

“যেই রাবণকে আপনারা হারাতে পারলেন না তাকে একজন মানুষ হারিয়ে দিল!” বেশ আশ্চর্য হয়েই জিগ্যেস করল ঋক।

একটু হেসে ইন্দ্র বললেন, “না ঋক, রাবণকে হারাবার সাধ্য রামেরও ছিল না। রাবণ হেরেছিল নিজেরই এক ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতায়। সে রামের পক্ষে যোগ দিয়েছিল এবং রাবণের মৃত্যুরহস্য বলে দিয়েছিল রামকে। নইলে রাবণকে মারা কখনই সম্ভব হত না।”

“আর সেই অ্যামার্টের কলস?”

“হুম। এটাই আসল ব্যাপার। রাবণ তার অদ্ভুত মায়াশক্তিতে সেই অ্যামার্টের কলস নিজের নাভিতে লুকিয়ে রেখেছিল। আমরা ভেবেছিলাম রাবণ মারা গেলে খুব সহজেই আবার তা ফিরে পাব। কিন্তু রাবণ মারা যাবার পর তার সারা শরীর, তার প্রাসাদ এমনকি আস্ত পৃথিবী তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও সেই কলস পাওয়ায় যায়নি। আমরা প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু বহু বছর পর হঠাৎ একদিন পৃথিবীর কাছাকাছি বসানো আমাদের এক রিসিভারে রাবণের চিন্তাতরঙ্গ ধরা পড়ে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও...”

“ক্ষমা করবেন কমান্ডার, কিন্তু আপনি এইমাত্র বললেন যে রাবণ সেই যুদ্ধে মারা গেছিল।”

এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল ইন্দ্রের ঠোঁটে। “যেদিন সেই তরঙ্গগুলো ধরা পড়েছিল, আমরাও তোমার মতোই অবাক হয়ে গেছিলাম। যার মৃতদেহকে নিজের চোখের সামনে আগুনে পুড়তে দেখেছি তার চিন্তাতরঙ্গ কীভাবে ধরা পড়তে পারে রিসিভারে! আর তাও কিনা রাবণের মৃত্যুর কয়েক হাজার বছর পরে। পৃথিবীর হিসেবে তখন সেখানে পঞ্চদশ শতক চলছে। মানে রাবণের মৃত্যুর প্রায় ৪৪০০ বছর পরের ঘটনা।

“ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছিল। রাবণকে তুমি দেখনি ঋক, তাই তুমি ঠিক বুঝতে পারবে কি-না জানি না। আসলে রাবণের শরীর সেই যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছিল ঠিকই কিন্তু তার চিন্তাতরঙ্গ এখনও পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছে।

“রাবণ যে কী অকল্পনীয় চিন্তাশক্তি ও মানসিক সামর্থ্যের অধিকারী ছিল তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আজও তাই সেই দুর্ধর্ষ রাক্ষস আমাদের কাছে এক বিরাট বিস্ময়।” একটু সময় সামনের স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে রইলেন ইন্দ্র। তারপর আবার বলতে লাগলেন, “আমরা সেই চিন্তাতরঙ্গগুলোকে ডিকোড করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু সেগুলো কার কাছে যাচ্ছে সেটা বের করতে পেরেছিলাম। পৃথিবীর ইতালি নামক এক দেশের মিলান শহরের এক ব্যক্তির মস্তিষ্কে তীব্রভাবে আঘাত করছিল সেই তরঙ্গগুলো। জানি না কেন তাকেই বেছে নিয়েছিল সেই অতিজাগতিক রাক্ষস-শক্তি। আমরা সেই মুহূর্তে রাবণের উদ্দেশ্য ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ওই ইতালীয় লোকটার ওপর নজর রাখা হবে। আমাকেই দেওয়া হয়েছিল দায়িত্বটা। অনেকদিন ধরে তাকে অনুসরণ করার পর আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম সেই চিন্তাতরঙ্গগুলির উদ্দেশ্য কী। রাবণ নিজের সব শক্তির বীজ এবং অ্যামার্ট-কলসের গোপন সংকেত লিপিবদ্ধ করতে চাইছিল একটি বইয়ের আকারে, আর সেই কাজের জন্যেই ওই লোকটিকে ব্যবহার করছিল সে।

“লোকটি নিজেও হয়তো জানত না যে সে কী করছে। অনেক বছর ধরে চলেছিল এই তরঙ্গ প্রবাহ। তারপর যেদিন সেই বইটি সম্পূর্ণ হয়ে গেল, আমি লোকটির মুখোমুখি হলাম। নেশাসক্ত এবং খুবই সাধারণ একটা মানুষ, তাকে অজ্ঞান করতে এক মুহূর্তও লাগল না আমার। আর তারপর খুব সহজেই বইটা তার টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়ে এলাম এখানে।

“কিন্তু তাতে তেমন কিছুই লাভ হল না। আমাদের এই সার্গ গ্রহের সবচেয়ে তুখোড় বিজ্ঞানীরাও সেই সাংকেতিক ভাষার কোনও অর্থ বের করতে পারলেন না। তবে শুধু এটুকু বোঝা গেল যে এই সংকেত কেবলমাত্র সে-ই বুঝতে পারবে যাকে রাবণের চিন্তাপ্রবাহ এর অর্থ বোঝাতে চাইবে। মানে রাবণের কোনও যোগ্য উত্তরাধিকারী, যার হাতে নিজের সব শক্তি আর অ্যামার্ট-কলস তুলে দিয়ে রাবণ আবার পৃথিবীতে রাক্ষস আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে চায়।” একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ইন্দ্র বললেন, “আমার ধারণা সেই উত্তরাধিকারী এসে গেছে।”

“কীভাবে বুঝলেন কমান্ডার?” ঋক জিগ্যেস করল।

“বলছি। অনেক চেষ্টা করেও যখন সেই গোপন সংকেতগুলোর কিছুই আমরা বুঝতে পারলাম না তখন কমান্ডার বিষ্ণুর নির্দেশে বইটি আবার পৃথিবীতে রেখে এলাম আমি। সেই ইতালিরই মনড্রাগন নামক একটি ভিলায়। পৃথিবীর সালের হিসেবে তখন ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ। বারো বছর সেখানেই পড়েছিল বইটা। ১৯১২ নাগাদ উইলফ্রিড ভয়নিখ নামে এক পুরোনো বইয়ের সংগ্রাহক বইটি খুঁজে পায় সেই ভিলা থেকে। আর তখন থেকেই ওই বইয়ের নাম ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্ট। তারপর অনেক হাত ঘুরে শেষে বইটা আমেরিকা বলে একটি দেশের ইয়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পৌঁছয়। সেখানেই পুরোনো পাণ্ডুলিপির বিভাগে এতদিন রাখা ছিল সেটা।”

“ছিল? তবে এখন কোথায়?” ভুরু কুঁচকে তাকাল ঋক।

“কয়েকদিন আগেই সেখান থেকে চুরি হয়ে গেছে। তবে আমাদের এক গুপ্তচর জানিয়েছে যে বইটা খুব সম্ভবত ভারতের দিল্লি শহরে আনা হয়েছে। কিন্তু সেটা ঠিক কার কাছে আছে এখনও জানা যায়নি।”

পাশের একটা ভার্চুয়াল স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল ঋক।

“কী ভাবছ?” কমান্ডার ইন্দ্র জিগ্যেস করলেন।

“আচ্ছা, এখন তো পৃথিবীতে আর রাক্ষস নেই, তবে কোনও মানুষ কি এই সংকেতগুলোর অর্থ বুঝতে পারবে?”

“তুমি এখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারনি ঋক। রাবণের অশরীরী চিন্তাপ্রবাহ মানুষের মধ্য থেকেই খুঁজে নেবে নিজের যোগ্য উত্তরাধিকারীকে। আর সেই ব্যক্তিকে কষ্ট করে সংকেতের অর্থ বুঝতে হবে না, সেই সংকেতগুলো নিজে থেকেই জলের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠবে তার কাছে। কারণ তখন তার মন একটু একটু করে রাবণের চিন্তাতরঙ্গের স্পর্শে রাবণের মতোই হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আমি নিজের এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, রাবণের মতো মানসিক গঠন না হলে রাবণকে বোঝা অসম্ভব, আর তার তৈরী সংকেতকেও।

“ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্টের প্রতিটি পাতায় লুকিয়ে আছে রাবণের এক একটি শক্তির রহস্য আর এসবের মাঝেই কোথাও রয়েছে সেই অ্যামার্ট-কলস অব্দি পৌঁছোবার পথ-নির্দেশও। তাই বলছি ঋক, আমাদের যেভাবেই হোক সেই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতেই হবে। কারণ একমাত্র তাকে অনুসরণ করেই আমরা অ্যামার্ট অব্দি পৌঁছতে পারব।”

“কিন্তু যদি সে আমাদের আগে পৌঁছে যায়?”

“তাহলে আর কিচ্ছু করার থাকবে না আমাদের। শুধু পৃথিবী নয় এই সার্গেও তখন রাক্ষস রাজত্ব কায়েম করবে সে।”

ঋকের মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল। “তবে আর দেরি কেন কমান্ডার? এখনই বেরিয়ে পড়ি।” উঠে দাঁড়াল সে।

ঋকের শিরায় শিরায় যেন আসন্ন দিনের উত্তেজনা থিরথির করে বয়ে যাচ্ছে।


(৫)

রাত বেশ হয়েছে। মীরা আর গুঞ্জন ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ হল। বেসমেন্টের দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা ঘরের ভেতর ঢুকলেন বিশ্বরাজ। আবছা অন্ধকার একটা ঘর। দরজার পাশে রাখা টেবিলটার ওপর শুধু একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, তাও বেশ পুরোনো মডেলের। বিশ্বরাজ দরজাটা বন্ধ করে টেবিলের ওপর হাতের বইটা রাখলেন। চামড়ায় বাঁধানো বেশ পুরোনো একটা বই।

আবছা অন্ধকারেও সারা ঘর জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু শেলফগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। থরে থরে বই সাজানো সেগুলোতে। সামনের একটা শেলফের দিকে এগিয়ে গেলেন বিশ্বরাজ। আলতো করে হাত বোলালেন তাতে রাখা বইগুলোর গায়ে।

বাইরে থেকে সাধারণ মনে হলেও প্রতিটা বইই আসলে এক একটা দুষ্প্রাপ্য ম্যানুস্ক্রিপ্ট। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় লেখা এই ম্যানুস্ক্রিপ্টগুলির কোনওটা পাঁচশো তো কোনওটা হাজার বছরের পুরোনো, আবার কোনওটা হাল আমলের হলেও নিজের কিছু বিশেষত্বের জন্যে পৃথিবীতে একমাত্র কপি। বিশ্বরাজের এই নেশাটা বহুদিনের। যখনই কোনও দুষ্প্রাপ্য ম্যানুস্ক্রিপ্টের খোঁজ পান, কিনে নেন। সে যত দামীই হোক না কেন। তবে এসব জিনিস সবসময় দাম দিয়েও পাওয়া যায় না। যেমন টেবিলের ওপর রাখা ওই ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্টটা। আর সেক্ষেত্রে বাঁকা পথটাই বেছে নেন বিশ্বরাজ।

ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়েই একদিন হঠাৎ চোখে পড়েছিল জিনিসটা। পৃথিবীর প্রথম দশ অমীমাংসিত রহস্যের একটি এই ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্ট। এমন এক অদ্ভুত সাংকেতিক লিপিতে এটি লেখা যে পৃথিবীর তাবড় তাবড় ক্রিপ্টোগ্রাফাররা অনেক চেষ্টা করেও এর অর্থ বুঝতে পারেনি। কে এই ম্যানুস্ক্রিপ্ট লিখেছিল তাও কেউ জানে না, তবে ১৯১২ তে ইতালির মনড্রাগন ভিলায় এটি খুঁজে পেয়েছিলেন উইলফ্রিড ভয়নিখ; আর তখন থেকে ওই নামেই পরিচিত এই রহস্যময় পাণ্ডুলিপি। কার্বন ডেটিং-এ অবশ্য জানা গেছে যে বইটি পঞ্চদশ শতকে উত্তর ইতালির কোথাও লেখা হয়েছিল।

ইন্টারনেটে এই ম্যানুস্ক্রিপ্টের ব্যাপারে পড়ার পর থেকেই জিনিসটা নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বিশ্বরাজ। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন যে এটি ইয়ালে ইউনিভার্সিটিতে রাখা আছে। যার সোজাসাপ্টা মানে এই দাঁড়ায় যে এ জিনিস কোটি টাকা খসিয়েও সিধে-রাস্তায় মিলবে না। কিন্তু বিশ্বরাজের কাছে ‘না’ শব্দটা বড় অবান্তর। আর তাই...

ফিরে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন বিশ্বরাজ। নিজের অজান্তেই একটা ছোট্ট হাসির রেখা ভেসে উঠল তার ঠোঁটে। এই সেই ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্ট। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং রহস্যময় পাণ্ডুলিপি, আজ থেকে এটাও সামিল হল বিশ্বরাজের এই গোপন সংগ্রহে।

চেয়ারটা টেনে বসলেন তিনি। বইটার মধ্যে কী যেন একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। ইন্টারনেটে যখন প্রথমবার চোখে পড়েছিল তখন থেকেই যেন তাকে নিজের দিকে টানছে এই বই। কেউ যেন বারবার তার অবচেতনে বলে চলেছে, এই বই তোমারই জন্যে! দেশের ভেতর আগেও অনেকবার পেশাদার চোর লাগিয়ে বিভিন্ন সংরক্ষিত ম্যানুস্ক্রিপ্ট জোগাড় করেছেন বিশ্বরাজ কিন্তু দেশের বাইরে, তাও একেবারে আমেরিকার মাটিতে এই কাজটা যে বেশ বড় একটা ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে তা ভালোই জানতেন তিনি। কিন্তু মন কিছুতেই মানছিল না, যত দিন যাচ্ছিল ততই যেন মরিয়া হয়ে উঠছিলেন।

খুব সাবধানে বইয়ের প্রথম পাতাটা খুললেন বিশ্বরাজ। পুরো পাতা জুড়ে এক অদ্ভুত লিপিতে কিছু লেখা রয়েছে। প্রথম দেখায় ইউরোপীয় কোনও ভাষা বলে মনে হলেও আদতে তা নয়, একদম আলাদা। পাতার একপাশে আবার রঙিন কালিতে ফুল-পাতা সহ একটা ছোট গাছের ছবি আঁকা। একেবারেই অপরিচিত একটা ফুল, কোনওদিন চোখে পড়েছে বলে তো মনে হল না বিশ্বরাজের। বইয়ের প্রতিটি পাতাই এই একইরকমভাবে বিভিন্ন ছবিতে সাজানো। অধিকাংশই অচেনা কিছু ফুলের ছবি।

বিশ্বরাজ এবার লেখাগুলোর দিকে চোখ ফেরালেন। এই ভাষা তার জ্ঞানের বাইরে হলেও ভারী অদ্ভুত একটা কিছু আছে ওই লেখাগুলোতে। যেন অপার্থিব একটা সৌন্দর্য। একদৃষ্টে সেই লেখাগুলোর দিকেই তাকিয়ে রইলেন তিনি।

সময়ের বোধটা যেন একটু একটু করে মুছে যেতে লাগল তার মন থেকে। কী একটা ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করছে ক্রমশ। বুঝতে পেরেও যেন সরে আসতে পারছেন না। সময়টা যেন থেমে গেছে। শুধু তিনি আর ওই রহস্যময় অক্ষরগুলো; আর কিছু নেই। কী এক অজানা নেশা ছড়িয়ে পড়ছে তার মনের আনাচে-কানাচে। চারপাশের নিস্তব্ধতা এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তিতে ঘিরে ধরতে লাগল বিশ্বরাজকে।

হঠাৎ ল্যাম্পের আলোটা কেঁপে উঠল। চমকে উঠলেন বিশ্বরাজ, যেন এক গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠলেন হঠাৎ। চারপাশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে, বাতাসটাও বড্ড ভারী লাগছে। চারপাশে কেমন যেন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া। এমন সময় টেবিলের ওপর রাখা ঘড়িটার দিকে চোখ পড়তেই ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল তার। কাঁটাগুলো তরতর করে উল্টোদিকে ঘুরে চলেছে।

চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়েও উঠতে পারলেন না। কে যেন অদৃশ্য ডোরে বেঁধে রেখেছে তাকে। ভয়ে সারা শরীর ঘেমে উঠছে তার। চিৎকার করেও লাভ নাই, এই ঘর মাটির এতটাই নিচে যে কোনও শব্দ বাইরে যাবে না। এমন সময় হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে লাগল বিশ্বরাজের গায়ে। ঘড়ির কাঁটাগুলোও থেমে গেল আপনা-আপনি। বিশ্বরাজ এখনও মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ারেই বসে আছেন। নড়বার শক্তি নেই। মনে হল অন্ধকারটা যেন বড্ড গাঢ় হয়ে ঘনিয়ে আসছে তার চারপাশে। সারাটা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে বিশ্বরাজের।

হঠাৎ কে যেন ফিসফিস করে কিছু বলতে লাগল তার কানের কাছে। অচেনা একটা ভাষা। আশেপাশে কেউ নেই অথচ তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন কথাগুলো, ঠিক কানের গোড়ায়। ভয়ে বুকটা কাঁপতে লাগল তার কিন্তু শরীর এতটাই অসাড় হয়ে আছে যে উঠে পালানোও অসম্ভব। মনে হচ্ছে যেন কেউ শরীরে অ্যান্যাসথেসিয়া এপ্লাই করেছে, শুধু ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ আছে।

টেবিলের ওপর খোলা ম্যানুস্ক্রিপ্টের পাতাগুলো নিজে থেকেই উল্টে যেতে লাগল। সেই অশরীরী কণ্ঠ আরও কাছে এগিয়ে আসছে বিশ্বরাজের। আস্তে আস্তে যেন মাথার ভেতর থেকে কথা বলতে শুরু করেছে সে।

চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল তার। চোখের সামনে যেন সমস্ত দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। এই ঘর, পেছনের ম্যানুস্ক্রিপ্টের শেলফগুলো, এই টেবিল, এই ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্ট সব ধূসর হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল বিশ্বরাজের চোখের সামনে থেকে। একটু একটু করে একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ ভেসে উঠল তার সামনে। পেছন থেকে উত্তাল সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। দূরে সবুজ বন। কে একজন যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল মূর্তিটা। এক দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ পুরুষ। ঘন কালো চুল কাঁধ অব্দি নেমেছে। সুগঠিত মাংসল চোয়াল আর বাজপাখির মতো টিকালো একটা নাক। তার টানা টানা চোখদুটোতে যেন ঠিকরে পড়ছে এক প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য ও অনমনীয়তা। কে যেন বিশ্বরাজের মাথার ভেতর থেকে বলে উঠল, “রাবণ!” কী অদ্ভুত তেজ সেই মূর্তির। সে আস্তে আস্তে আরও কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। যেন মিশে যেতে লাগল বিশ্বরাজের শরীরে।

হঠাৎ সব কেমন পরিষ্কার হয়ে উঠল বিশ্বরাজের কাছে। সেই কায়াহীন কণ্ঠের ভাষা আর অচেনা ঠেকছে না। মনে হচ্ছে এই কথাগুলো যেন তার নিজেরই মানসিক সংলাপ। বিশ্বরাজের মনের ভেতর থেকে কেউ যেন তার পুরো সত্তাটাকেই উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। অদ্ভুত এক শিহরণ! হঠাৎ তার চোখটা নিজে থেকেই চলে গেল সেই ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্টের খোলা পাতার দিকে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। আর অচেনা লাগছে না এই অক্ষরগুলো। এ যেন তার নিজেরই হাতে লেখা! সেই বইয়ের প্রতিটা শব্দ যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ হয়ে খেলে যাচ্ছে তার শরীর জুড়ে।

ধীরে ধীরে সেই অশরীরী কণ্ঠস্বর থেমে গেল। কেমন এক অদ্ভুত নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। কিন্তু এই অসীম নিস্তব্ধতার মাঝে আর যেন নিজেকে খুঁজে পেলেন না বিশ্বরাজ। সেখানে বসে আছে এক সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তি; বহুযুগের ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা এক মহাশক্তিমান সত্তা।

(৬)

“আমি তৈরী কমান্ডার।”

ঋক ভেতরে ঢুকতেই পেছনে মহাকাশযানের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

কমান্ডার ইন্দ্র ভেতরেই পাইলট-সিটে বসেছিলেন। ঋকের দিকে ফিরে বললেন, “এস। এখনই রওনা হব আমরা।”

ঋক ইন্দ্রের পাশের সিটে গিয়ে বসল। ইন্দ্র সামনের ভার্চুয়াল কীপ্যাডে কয়েকটা বোতাম টিপতে টিপতে বললেন, “একটা ভাল আর একটা মন্দ খবর আছে।”

ভুরু কুঁচকে তাকাল ঋক। তার মনের স্বাভাবিক প্রশ্ন বুঝে ইন্দ্র নিজে থেকেই বললেন, “ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্টটা দিল্লিতে কার কাছে আছে সেটা আমাদের গুপ্তচর খুঁজে বের করতে পেরেছে। ভারতের এক বেশ নামজাদা ব্যবসায়ী বিশ্বরাজ সিং রাঠোর।”

“সে-ই কি তবে চুরি করেছে?”

“খুব সম্ভবত না। হয়তো চুরি হওয়া সেই ম্যানুস্ক্রিপ্ট সে কারোর কাছ থেকে কিনেছে অথবা নিজেই কাউকে দিয়ে চুরি করিয়েছে। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়, মোদ্দা কথা হল বইটা এখন ওই বিশ্বরাজের কাছেই আছে।”

“আর খারাপ খবরটা কী কমান্ডার?” ঋক জিগ্যেস করল।

“তোমায় আগেই বলেছিলাম যে আমাদের কিছু মেন্টাল-ওয়েব রিসিভার কয়েক হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে অদৃশ্য ভাবে রাখা আছে। গতকাল তারই একটাতে খুব তীব্র এবং শক্তিশালী কিছু চিন্তাতরঙ্গ ধরা পড়ে। কম্পাঙ্ক পরীক্ষা করতেই বুঝতে পারি যে আমার ভয় অমূলক ছিল না। এগুলো রাবণেরই মানসিক তরঙ্গ। আর পঞ্চদশ শতাব্দীর তরঙ্গগুলোর চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি তীব্র। মনে হচ্ছিল যেন মানসিক তরঙ্গের ঝড় উঠেছে সেখানে। এর মানে বুঝতে পারছ ঋক?”

ঋক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সুযোগ না দিয়ে ইন্দ্র নিজেই বললেন, “রাবণ নিজের উত্তরাধিকারী পেয়ে গেছে।”

“কে সে?”

“তোমার কী মনে হয়?”

“বিশ্বরাজ?”

“হ্যাঁ। আমি রিসিভার থেকে জায়গাটার কোর্ডিনেটগুলো বের করে পৃথিবীতে আমাদের গুপ্তচরের কাছে পাঠিয়েছিলাম। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই জানায় যে জায়গাটা সেই বিশ্বরাজেরই বাড়ির ঠিকানা। দিল্লির বসন্ত বিহার নামে কোনও এক অঞ্চলে।”

“আচ্ছা কমান্ডার, পৃথিবীতে এত লোক থাকতে বিশ্বরাজই কেন?”

“কারণ তার মানসিক গঠন। আমাদের গুপ্তচরের পাঠানো তথ্য থেকে আমি ওর পুরো জীবনবৃত্তান্ত খুঁটিয়ে দেখেছি। ওদের এত বড় ব্যবসা ছিল না আগে। ভারতের রাজস্থানে সাধারণ একটা পারিবারিক ব্যবসা সামলাতেন ওর বাবা। সেখান থেকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের প্রথম দশজন ধনী শিল্পপতির তালিকায় উঠে এসেছে বিশ্বরাজ। এতদিন অব্দি যেই কাজেই হাত দিয়েছে তা সম্পূর্ণ না করে ছাড়েনি। সোজাভাবে না হলে বাঁকা পথে। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যে সে কাউকে খুন করতেও পিছপা হবে না। আর তাছাড়া লোকটা অত্যন্ত মেধাবী এবং শারীরিকভাবেও যথেষ্ট সমর্থ। এককথায় বিশ্বরাজের মধ্যে সেই সব গুণই রয়েছে যা রাবণের উত্তরাধিকারীর মধ্যে থাকা উচিত।

“এছাড়াও আরেকটা মিল আছে বিশ্বরাজ আর রাবণের মধ্যে। রাবণের পিতামহ ছিলেন ঋষি পুলস্ত্য আর বিশ্বরাজও পৌলস্ত্য গোত্রীয়। কিন্তু সেটা হয়তো সে নিজেও জানে না।”

“হুম। আমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না।” ঋকের গলাটা একটু চিন্তিতই শোনালো।

কমান্ডার ইন্দ্র আর কিছু বললেন না। তাদের মহাকাশযান এখন ওড়ার জন্যে তৈরী। ইন্দ্র যানের গতিবেগ আলোর বেগের ৯৫.৪ শতাংশে সেট করে দিলেন। যানটা আস্তে আস্তে মাটি থেকে প্রায় এক মিটার ওপরে উঠে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ চোখের পলকে দূরের আকাশে মিলিয়ে গেল।

এই বেগে সার্গ থেকে এখানে আসতে প্রায় আধ-ঘন্টা মতন সময় লাগে। মহাকাশের সেই অংশটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের মহাকাশযান যেখানে পৃথিবীতে যাওয়ার সেই গুপ্ত দরজা রয়েছে। ইন্দ্র চোখ বুজে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলেন। ঋক অবাক হয়ে দেখল সামনের ঘনকালো মহাশূন্যের বুকে একটু একটু করে একটা জ্যোতির্ময় সুড়ঙ্গপথ খুলে যাচ্ছে। উজ্জ্বল সাদা আলো বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে।

ইন্দ্র চোখ খুললেন। “এই সেই রাস্তা।”

তাদের মহাকাশযানটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল সেই আলোকিত সুড়ঙ্গের দিকে। ঋকের জীবনে এই অভিজ্ঞতা প্রথমবার। অবাক চোখে যানের দু’পাশে তাকাচ্ছে সে। সাদা আলোটা যেন আরও ঘন হয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে তাদের। হঠাৎ ঋকের মনে হল মহাকাশযানটা নিজে থেকেই প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। বেগটা যেন আলোর চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেড়ে গেছে।

পাশ থেকে ইন্দ্র বললেন, “তুমি ঠিকই ভাবছ। এখন আমাদের যান আলোর চেয়ে দশলক্ষ গুণ বেশি বেগে যাচ্ছে। এবং এই বেগ ক্রমশ বাড়তে থাকবে।”

ঋকের চোখে বিস্ময়ের গাঢ় রেখা ভেসে উঠল। “আলোর চেয়ে বেশি বেগ! কিন্তু এ যে অসম্ভব কমান্ডার।”

“এটা আমাদের কাছেও একটা রহস্য ঋক। এই মহাজাগতিক সুড়ঙ্গপথের বাইরে এ জিনিস কখনই সম্ভব নয়। কিন্তু এর ভেতরে পদার্থবিদ্যার কোনও নিয়ম কাজ করে না। এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের কতটুকুই দেখেছি বা জেনেছি আমরা? যেটুকু দেখতে পাই তাকেই নিয়মে বেঁধে দিয়ে ভাবি আমরা বুঝি প্রকৃতির সব গূঢ় রহস্যকে সূত্রে গেঁথে ফেলেছি কিন্তু এমন কত কত নিয়মের ব্যতিক্রম যে এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে তা কেই বা জানে। এই সুড়ঙ্গ তো তার মধ্যে অতি সামান্য একটা।”

ঋক আর কোনও কথা খুঁজে পেল না। তার মুগ্ধ চোখদুটো শুধু তাকিয়ে রইল সামনের ওই তীব্র উজ্জ্বল আলোর দিকে, যার মধ্য দিয়ে এক অকল্পনীয় বেগে ছুটে চলেছে তাদের মহাকাশযান।

কিছুক্ষণ পর সামনের দিকটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসতে লাগল। কীভাবে যে সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি ঋক। কয়েক মুহূর্তে তাদের যান সুড়ঙ্গপথের অন্য মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। ঋক তাকিয়ে দেখল তারা একটি গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। হালকা হালকা বরফ পড়ছে পুরো উপত্যকা জুড়ে। পাহাড়গুলোও ঢেকে আছে সাদা চাদরে।

ইন্দ্র বললেন, “এই হল পৃথিবীর বিখ্যাত হিমালয় পর্বত।”

এমন সময় হঠাৎ মহাকাশযানের ঠিক সামনে বাতাস ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা লোক। লোকটা সার্গ গ্রহের, দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না ঋকের। সম্ভবত এই সেই গুপ্তচর যার কথা কমান্ডার ইন্দ্র বেশ কয়েকবার বলেছেন।

যান থেকে নিচে নামতেই সামনের লোকটা এগিয়ে এল তাদের দিকে।

“ক্ষমা করবেন কমান্ডার, আমার ম্যাটার-ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেমটা ঠিকঠাক কাজ করছে না, তাই আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।” একটু লজ্জিত স্বরেই বলল লোকটা।

“সে ঠিক আছে। আগে বলো আর কিছু জানতে পারলে?” ইন্দ্র জিগ্যেস করলেন।

লোকটা একটু ইতস্তত করে বলল, “একটা খারাপ খবর আছে কমান্ডার।”

“কী?” গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করলেন ইন্দ্র।

“বিশ্বরাজকে পরশু রাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“মানে? কাল রাতেই তো তুমি বিশ্বরাজের ব্যাপারে খবর দিলে।”

“ক্ষমা করবেন, আমি পৃথিবীর হিসেবে গত পরশুর কথা বলছি। আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন যে সার্গ আর পৃথিবীর দিন সমান নয়। আমাদের গ্রহে একদিন মানে পৃথিবীতে প্রায় এক সপ্তাহ।”

“ওহ! তা এখন কোথায় সেই ব্যক্তি?”

“জানি না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি কমান্ডার কিন্তু কোনওভাবেই তার অবস্থান বের করতে পারছি না।”

ঋকের দিকে এক ঝলক তাকালেন ইন্দ্র। ঋক যেন তার চোখে এক অজানা আশংকার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেল। সেই গুপ্তচরের দিকে ফিরে ইন্দ্র আবার জিগ্যেস করলেন, “রিসিভারে কোনও সংকেত? পৃথিবীর আর কোনও জায়গায় রাবণের চিন্তাতরঙ্গ ধরা পড়েছে?”

“না কমান্ডার। সেই লোকটি নিরুদ্দেশ হবার পর থেকে আর কোনও তরঙ্গ আমাদের রিসিভারে ধরা পড়েনি।”

ইন্দ্র একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পাশের পাথরটার ওপর বসে পড়লেন। ঋক ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখেও একই চিন্তার ছায়া। কিছুক্ষণ পর ইন্দ্র আবার সেই গুপ্তচরকে জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা, তুমি নিশ্চিত যে বিশ্বরাজ নিজের বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে নেই?”

“হ্যাঁ, কমান্ডার। আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। এই দেখুন...” লোকটার আঙুলের ইশারায় ওদের সামনে একটা ভার্চুয়াল স্ক্রিন ভেসে উঠল। তাতে গতকালকের ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র প্রথম পাতার ছবি দেখা যাচ্ছে। সেখানে বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘বিখ্যাত শিল্পপতি বিশ্বরাজ সিং রাঠোর নিজের বাড়ি থেকে নিখোঁজ’।

“তাছাড়া আমি নিজেও গতকাল অদৃশ্য অবস্থায় বিশ্বরাজের বাড়ির ভেতর গিয়ে সব ঘরে খুঁজে দেখেছি। এমনকি মাটির নিচে তার যে লুকোনো ঘরটা আছে, সেখানেও। বিশ্বরাজ কোথাও নেই। আর সেই ভয়নিখ ম্যানুস্ক্রিপ্টটাও উধাও।”

“এর অর্থ বুঝতে পারছ ঋক?” থমথমে গলায় জিগ্যেস করলেন ইন্দ্র।

“কী অর্থ কমান্ডার?”

“সেই চিন্তাতরঙ্গ আর বিশ্বরাজকে বাইরে থেকে চালিত করছে না, এখন ওর নিজের ভেতর থেকেই উঠছে সেই তরঙ্গ। তাই রিসিভারে কোনও সংকেত ধরা পড়ছে না। রাবণ একটু একটু করে জেগে উঠতে শুরু করেছে বিশ্বরাজের শরীরে। আর সেই শক্তির জোরেই সে আমাদের সব ট্রেসিং-টেকনোলোজির আওতার বাইরে চলে গেছে।”

“তবে কি সে অ্যামার্ট-কলস অব্দিও পৌঁছে গেছে?” ঋক বেশ উত্তেজিত গলায় জিগ্যেস করল।

“জানি না। সবই এখন ভাগ্যের হাতে। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশ্বরাজকে খুঁজে বের করতেই হবে।”

“কিন্তু কীভাবে কমান্ডার? লোকটার তো কোনও খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ইন্দ্র। তারপর গুপ্তচরের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা এই বিশ্বরাজের বাড়িতে কে কে আছে?”

“স্ত্রী, একটা বাচ্চা মেয়ে আর ছোটভাই।”

“ভাই?”

“হ্যাঁ। বিশ্বরাজের চেয়ে বছর চারেক ছোট।”

“তার সব ডিটেলস আমার চাই। যত তাড়াতাড়ি পারো জোগাড় করো।” একটু কড়া গলায়ই বললেন ইন্দ্র।

গুপ্তচর বলল, “সব করেই রেখেছি কমান্ডার। ভাইয়ের নাম বিক্রম সিং রাঠোর। বয়স বত্রিশ বছর। ভারতীয় আর্মিতে কাজ করে। শুধুমাত্র দেশসেবার মানসিকতা নিয়ে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে আর্মিতে যোগ দিয়েছে। সাধারণত বাড়ির বাইরেই থাকে তবে তার দাদার নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে কালই দিল্লি এসে পৌঁছেছে।”

“আপনি ঠিক কী করতে চাইছেন কমান্ডার?” পাশ থেকে ঋক জিগ্যেস করল।

ইন্দ্রের চোখে শিকারী বাঘের মতো একটা দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে উঠল। “কিছুক্ষণের মধ্যেই সব বুঝতে পারবে ঋক। এই বিক্রমই আমাদের নিয়ে যাবে বিশ্বরাজের কাছে।”

(৭)

বসন্ত বিহার পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িটার দিকে এগোচ্ছিল বিক্রম। ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পুলিশ বিশ্বরাজের এখনও কোনও খোঁজ পায়নি।

“হ্যালো বিক্রম।” হঠাৎ অপরিচিত কণ্ঠে নিজের নাম শুনে পেছন ফিরে তাকাল সে। দুজন অচেনা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হল একজনের বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে, আরেকজন যুবক।

“আপনাদের তো ঠিক...”

“আমরা সি.বি.আই-এর লোক।” প্রৌঢ় ভদ্রলোক নিজের পকেট থেকে পরিচয়পত্র বের করে দেখালেন। ইন্দ্রজিৎ শ্রীবাস্তব, সি.বি.আই অফিসার। “আপনার যদি কোনও আপত্তি না থাকে তাহলে কোথাও বসে একটু কথা বলতে চাই।”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। সামনের ওই কফিশপটায় চলুন।” বিক্রম বলল।

“নাইস। চলুন।”

তিনজনেই রাস্তার ওপারের কফিশপটায় গিয়ে ঢুকলেন। দোকান মাত্র খুলেছে, খুব একটা ভিড় নেই। তবু একটু কোণ ঘেঁষে একটা নিরিবিলি টেবিল দেখেই বসলেন সি.বি.আই অফিসারের ছদ্মবেশে থাকা কমান্ডার ইন্দ্র।

“আগে পরিচয়টা দিয়ে দিই। আমি সি.বি.আই অফিসার ইন্দ্রজিৎ শ্রীবাস্তব আর ইনি আমার জুনিয়র অফিসার ঋক গাঙ্গুলি।”

ঋকের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের ভঙ্গিতে একটু মাথা নাড়ল বিক্রম। “কিন্তু ব্যাপারটা কী অফিসার? হঠাৎ আমার কাছে?”

“আপনিই তো বিখ্যাত শিল্পপতি বিশ্বরাজ সিং রাঠোরের ভাই। এবং আপনার দাদা বেশ কিছুদিন হল নিরুদ্দেশ।”

“হ্যাঁ।”

“পুলিশ কী বলছে?”

“ওই একই উত্তর। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি!” হালকা বিরক্তির সুরেই বলল বিক্রম।

“হুম।” একটু থেমে ঋকের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্র বললেন, “ল্যাপটপটা বের করো।”

“বিক্রম, আমি আপনাকে কিছু কথা বলব যেগুলো হয়তো আপনার কাছে খুবই অস্বস্তিকর লাগবে।” বিক্রমের দিকে ফিরে ইন্দ্র বললেন। “কিন্তু ব্যাপারটা দেশের সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত।”

“ব্যাপার কী অফিসার? খুলে বলুন প্লিজ।” কপাল কুঁচকে তাকাল বিক্রম। ঋক ততক্ষণে ল্যাপটপটা খুলে তাদের সামনে রেখেছে। বিক্রম আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখল, একটা ফোল্ডার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু নামটা পড়া যাচ্ছে না ঠিক।

ওয়েটার এসে তিনটে কফি রেখে গেল টেবিলে। ইন্দ্র নিজেরটায় একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বললেন, “আমি এখন যা যা বলব দয়া করে শান্তভাবে শুনবেন মিস্টার রাঠোর।”

“কিন্তু কথাটা কী সেটা তো বলুন আগে।”

“আপনার দাদার ব্যাপারে।”

ইন্দ্রের কথায় হঠাৎ একটু চমকে উঠল বিক্রম। “দাদার ব্যাপারে? কোনও খোঁজ...”

“না। কিন্তু উনার ব্যাপারে অনেকগুলো তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে।” কাপটা নামিয়ে রেখে ইন্দ্র বললেন, “আচ্ছা, আপনার কখনও মনে হয়নি যে আপনাদের একটা সামান্য পারিবারিক ব্যবসা থেকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বরাজ কীভাবে একটা এম.এন.সি খাঁড়া করে দিলেন?”

“দাদা অত্যন্ত পরিশ্রমী লোক।”

“আপনার কথা মানছি বিক্রম। কিন্তু শুধু পরিশ্রমের জোরে এত অল্প সময়ে অম্বানিদের সঙ্গে একাসনে বসা যায় না।”

“আপনি কী বলতে চাইছেন অফিসার?” গলাটা একটু উত্তেজিতই শোনালো বিক্রমের।

“কুল-ডাউন বিক্রম। অর্থহীন প্রলাপ বকবার জন্যে সি.বি.আই আমাদের চাকরি দেয়নি।” কথাটা শেষ করে ঋককে ফোল্ডারটা খুলতে ইশারা করলেন ইন্দ্র।

ল্যাপটপটা বিক্রমের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ঋক বলল, “দেখুন মিস্টার রাঠোর।” কিছু ব্যাংক-ট্রান্সেকশনের ডিটেলস সহ একটা কাগজ। কোনও এক এন.জি.ও-র একাউন্ট ডিটেলস।

“দেখছেন তো, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা রোজ এসে ঢোকে এই এন.জি.ও-তে। আর তারপর এই টাকার একটা বিরাট অংশ চলে যায় দেশের বিভিন্ন সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় গজিয়ে ওঠা কতগুলি ভুঁইফোড় স্বাবলম্বী গোষ্ঠীর কাছে, বাস্তবে যেগুলোর কোনও অস্তিত্বই নেই। আসলে সেই টাকা যায় সীমান্ত অঞ্চলের বা ওপারের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী দলের হাতে। তারপর যেই টাকা বাকি থাকে সেটা চলে যায় রাঠোর গ্রুপের চ্যারিট্যাবল ফান্ডে যা থেকে আজ অব্দি একটি পয়সাও চ্যারিটি করা হয়নি।”

বিক্রম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মাঝেই থামিয়ে দিয়ে ইন্দ্র বললেন, “দাঁড়ান মিস্টার বিক্রম, কথা আরও অনেক বাকি। যেই এন.জি.ও-র একাউন্টে এই টাকাগুলো আসে তার চেয়ারম্যান হলেন গুরমিত সিং নামে এক ব্যক্তি। সবচেয়ে বড় আশ্চর্য কী জানেন এই গুরমিত সিং-কে এন.জি.ও-র কেউ কোনওদিনই দেখেনি। আমরা তার আই.পি হ্যাক করে জানতে পারি যে সে আর কেউ নয়, আপনার দাদা বিশ্বরাজ।”

“কী বলছেন এসব? দাদার মতো মানুষ এমন কাজ করতেই পারে না।” চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল বিক্রমের।

“কেন? আপনার দাদা ব্যবসার খাতিরে সরকারি অফিসারদের ঘুষ দেওয়া বা প্রয়োজনে কাউকে গুণ্ডা দিয়ে হুমকি দেওয়ানোর মতো কাজ করেন না? না বলবেন না বিক্রম, আপনার দাদার এই বিজনেস পলিসিগুলো আপনি ভালোভাবেই জানেন।”

“হ্যাঁ, মানছি। ব্যবসার খাতিরে এসব কমবেশি অনেকেই করে।” গলাটা একটু নরম শোনালো বিক্রমের। “কিন্তু তাই বলে দাদার যোগাযোগ সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে! একথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারব না।”

“ছবিটা দেখাও ঋক।” ইন্দ্র বললেন। ঋক ল্যাপটপে একটা ছবি খুলে স্ক্রিনটা আবার বিক্রমের দিকে ঘুরিয়ে দিল। একটা পার্টির ছবি। বিশ্বরাজ কয়েকজন লোকের সঙ্গে বসে কথা বলছেন।

“আপনার দাদা যেই লোকটার সঙ্গে কথা বলছেন, মানে আপনার দাদার ডানপাশে বসা লোকটা, তার ছবিটা একটু জুম করে দেখে নিন।” বিক্রমের দিকে তাকিয়ে বললেন ইন্দ্র। “আমাদের কথায় বিশ্বাস নাই বা করলেন, গুগলের ওপর করেন তো? তাহলে এবার আপনার নিজের মোবাইলটা খুলে ‘টপ টেন লিডারস অফ লস্কর’ লিখে গুগল করুন।”

ইন্দ্রের কথামত তাই করল বিক্রম। মোবাইলের পর্দায় কিছু ছবি ভেসে উঠল। কিন্তু ষষ্ঠ ছবিটাতে চোখ যেতেই থমকে গেল সে। এই লোকটাই তো বসে আছে তার দাদার পাশে। গুগল বলছে এর নাম আশফাক আল রাশিদ। লস্কর-এ-তয়বার এক প্রথম সারির জঙ্গি নেতা।

“এমন আরও বেশ কয়েকটা ছবি রয়েছে আমাদের কাছে।”

বিক্রমের মুখে আর কথা সরল না। চুপ করে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর থমথমে গলায় জিগ্যেস করল, “আমার কাছে কী চান?”

“সাহায্য।” ইন্দ্র বললেন। “দেখুন, ব্যাপারটা খুলেই বলছি আপনাকে। ডি.আর.ডি.ও-র কয়েকজন বিজ্ঞানী কিছুদিন আগেই একটা খুব বিশেষ ধরণের ক্যামিক্যাল আবিষ্কার করেছিলেন। এই ক্যামিক্যাল উপযুক্ত রাসায়নিক বিক্রিয়া মারফত এগোলে পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু এক সপ্তাহ আগেই সেই ক্যামিক্যাল-ভর্তি প্রায় এক লিটারের একটা কন্টেইনার ল্যাব থেকে চুরি হয়ে যায়। এই এক লিটার পুরো ভারতবর্ষ ধ্বংস করবার জন্যে কাফি। আমাদের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী এর পেছনে বিশ্বরাজের হাত রয়েছে। উদ্দেশ্য অবশ্যই কোনও সন্ত্রাসবাদী দলের কাছে এই মারণাস্ত্র পৌঁছে দেওয়া।”

“কিন্তু এতে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি? আমি এসবের কিছুই জানি না।”

“আপনাকে শুধু আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে।”

“তাতে লাভ?” একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি কেঁপে উঠল বিক্রমের চোখে।

“সেটা এই মুহূর্তে আপনাকে বললেও আপনি পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। শুধু এটুকু বলতে পারি আপনি যদি স্বেচ্ছায় আমাদের সঙ্গ দেন তবে হয়তো একদিনের মধ্যেই আপনার দাদাকে খুঁজে বার করা সম্ভব হবে। সেরকম এক গোপন ট্যাকনোলোজি আমাদের হাতে রয়েছে।”

বেশ অবাক হয়েই ইন্দ্রের দিকে তাকাল বিক্রম। ইন্দ্র খানিকটা নরম গলায় বললেন, “আমাদের উপর ভরসা রাখুন। আপনার বা আপনার দাদার কোনও ক্ষতি হবে না।”

“আমার হয়তো হবে না কিন্তু দাদা যদি সত্যিই এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে তার তো জেল হবেই।” বিক্রম বলল। “তখন আমি আর কোনওদিন দাদার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব? বৌদি, গুঞ্জন ওদের কী বলব? গুঞ্জন যখন জিগ্যেস করবে ওর বাবা কোথায়, কী বলব ওই বাচ্চা মেয়েটাকে? আর বৌদি যখন জানতে পারবে যে দাদাকে আমিই ধরিয়ে দিয়েছি?”

ইন্দ্র আর কিছু বললেন না, শুধু চুপ করে কফির খালি কাপটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বিক্রম উঠে দাঁড়াল। “আমি পারব না স্যার। আপনি অন্য কাউকে খুঁজে নিন। নিজের দাদাকে ধরিয়ে দিতে পারব না।”

“হ্যাঁ ঠিকই তো। নিজের দাদার বিরুদ্ধে তো যাওয়া যায় না। কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে যাওয়া যায়! একটা কথা মনে রাখবেন বিক্রম, কাল যখন সেই রাসায়নিক-বোমার আঘাতে ভারতে বা অন্য কোনও দেশে লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ যাবে, হাজার হাজার গুঞ্জনের আধপোড়া লাশ পথেঘাটে পড়ে থাকবে, তার জন্যে আপনার দাদার চেয়ে আপনি কিছু কম দায়ী হবেন না। সেদিন নিজের ভেতরকার আর্মি অফিসারের মুখোমুখি হতে পারবেন তো? সেই বিক্রম সিং রাঠোরকে জবাব দিতে পারবেন তো যে একদিন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে শুধু দেশের জন্যে আর্মি জয়েন করেছিল?” ইন্দ্রের গলায় তীব্র ব্যঙ্গের সুর ভেসে উঠল।

যেতে গিয়েও কেমন যেন থমকে গেলেন বিক্রম। ইন্দ্র পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বললেন, “আমার কার্ডটা নিন। আপনি যেতে চাইছেন, যান। আটকাবার আমরা কেউ নই। কিন্তু যদি মত বদলায় তবে আজ রাতের মধ্যে ফোন করতে পারেন।”

ইন্দ্রের দিকে না তাকিয়েই কার্ডটা নিয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল বিক্রম। মনের ভেতর কী একটা যেন বড্ড খচখচ করতে শুরু করেছে তার।

ঋক এতক্ষণ পুরো ব্যাপারটাই চুপ করে দেখছিল। বিক্রম বেরিয়ে যেতেই সে বলল, “বিক্রম তো চলে গেল কমান্ডার। এখন বিশ্বরাজকে কীভাবে খুঁজে পাব?”

“চিন্তা কোরো না ঋক, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ও ফোন করবে। লোকটা সাচ্চা দেশভক্ত, তাই তো জেনেশুনেই বিশ্বরাজকে দেশদ্রোহী সাজিয়ে ওর দেশভক্তির গোড়ায় আঘাতটা করলাম। এই বিবেকদংশনের জ্বালা বিক্রম সইতে পারবে না। ফিরে সে আসবেই।” ইন্দ্রের মুখে একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল।

(৮)

বসন্ত বিহারের কাছাকাছি একটা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিল কালো ভ্যানটা। রাত বেশ হয়েছে কিন্তু দিল্লির রাস্তাঘাটে এখনও যথেষ্ট ভিড়। ভ্যানের ভেতর ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন ইন্দ্র, আর পাশের সিটে ঋক। বেশ উত্তেজিতভাবেই বারবার হাতঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে সে। এগারোটা প্রায় বাজতে চলল।

এমন সময় রাস্তার ওপাশে বেশ জোরে ব্রেক কষে থামল একটা গাড়ি। বিক্রমের গাড়ি। ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়ালেন ইন্দ্র। বিক্রম নিজের গাড়িটা লক করে রাস্তা পেরোনোর জন্যে একবার দু’পাশে তাকাল। ঋকও ততক্ষণে নেমে দাঁড়িয়েছে।

“আসুন। আমরা আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”

“হুম। কী করতে হবে বলুন।” খানিকটা গম্ভীর স্বরেই বলল বিক্রম।

ইন্দ্র ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনজন যতই অন্যায় করুক, তার বিরুদ্ধে যাওয়া যে কতটা কঠিন, আমি জানি। কিন্তু আপনার মতো একজন সত্যিকারের দেশভক্তের কাছে আমি এটাই আশা করেছিলাম।”

বিক্রম মুখে আর কিছু বলল না, শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওপাশের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইল।

“আপনি আমার সঙ্গে আসুন।” ভ্যানের পেছনের দরজাটা খুলে দিলেন ইন্দ্র। ঋক গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। ভ্যানের ভেতর ঢুকতেই বেশ অবাক হল বিক্রম। বাইরে থেকে সাধারণ ভ্যানের মতো মনে হলেও ভেতর থেকে একেবারেই আলাদা। জানালার কাঁচগুলো পুরোপুরি কালো, অস্বচ্ছ। এছাড়া ভেতরের গঠনেও অনেকটাই ফারাক রয়েছে সাধারণ ভ্যানের সঙ্গে। বিক্রম দেখল চারপাশে বেশ কিছু ছোট-বড় যন্ত্র লাগানো, আর কয়েকটা মনিটর। একটা প্রায় দশ ইঞ্চি ট্যাবের সাইজের মনিটর লাগানো রয়েছে ড্রাইভিং সিটের ওপরেও। পেছন থেকে আবছা আলোয় বসন্ত বিহার অঞ্চলের স্যাটেলাইট ভিউ বলেই মনে হল, তবে গুগল ম্যাপের স্যাটেলাইট ভিউর চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট।

ইন্দ্র বিক্রমকে বাঁদিকের সিটটায় বসতে ইশারা করলেন। তারপর তার মাথার ঠিক দু’পাশে ছোট দুটো সেন্সর লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “ঘাবড়াবেন না মিস্টার রাঠোর। এগুলো একধরণের বিশেষ সেন্সর যা আপনার মেন্টাল ওয়েবকে স্যাটেলাইটের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারে। আপনাকে শুধু চোখ বুজে খুব গভীরভাবে নিজের দাদার ব্যাপারে ভাবতে হবে। বিশ্বরাজের সঙ্গে আপনার যা যা স্মৃতি আছে সেইসব আপনি ভাববেন। এরফলে আপনার ব্রেইনে যে খুব সূক্ষ্ণ ইলেকট্রিক ওয়েব তৈরী হবে তাকে এই সেন্সর অ্যামপ্লিফাই করে কিছু জটিল প্রসেসের মাধ্যমে প্রথমে স্যাটেলাইটে আর তারপর সেখান থেকে আমাদের এই ছোট মনিটরের পেছনে থাকা রিসিভারে পাঠাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনিটরের ওপর আপনার দাদার বর্তমান লোকেশন ফুটে উঠবে।”

কথাগুলো শুনতে কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতো লাগছিল বিক্রমের কাছে কিন্তু সেই মুহূর্তে সে এতটাই মানসিক চাপে ছিল যে আর কিছু বলে উঠতে পারল না। ইন্দ্রের কথামত সে চোখ বুজে বিশ্বরাজের কথা ভাবতে শুরু করল।

মিনিট দশেক পর হঠাৎ সামনের সেই ছোট মনিটরটার ওপর ভাসতে থাকা ছবির যেন পট পরিবর্তন ঘটল। ভৌগোলিক অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। একটু পরেই ঋক খুব মৃদুস্বরে বলল, “পাওয়া গেছে। কণিকা আইল্যান্ড।”

ইন্দ্র মাথা নেড়ে এগোবার নির্দেশ দিলেন।

কণিকা আইল্যান্ড ওড়িশার উপকূলে বঙ্গোপসাগরের ওপর ভেসে থাকা একটা ছোট্ট জনহীন দ্বীপ। দিল্লি থেকে দূরত্ব প্রায় ১৭৩৫ কিলোমিটার। সাধারণ ভ্যানে সেখানে পৌঁছতে কমপক্ষে তেত্রিশ ঘন্টা লাগার কথা। কিন্তু এদের এই ভ্যান আসলে সেই মহাকাশযানেরই পরিবর্তিত রূপ, যাতে করে ইন্দ্র আর ঋক পৃথিবীতে এসেছিল। তাই এর গতিবেগ ইচ্ছামত অনেকটাই বাড়ানো যেতে পারে।

ঋক একটা ছোট কীপ্যাডে কিছু বোতাম টিপে গাড়ির গতি অটোম্যাটিক-মোডে সেট করে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিজেই ৪৫৬ মিটার প্রতি সেকেন্ড বেগ বেছে নিল। কারণ এটাই লিমিটিং ভ্যালু। বায়ুমণ্ডলের এতটা ভেতরে এর বেশি বেগে এগোলে গাড়ির ক্ষতি হতে পারে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মাটি থেকে কিছুটা ওপরে উঠে চোখের পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ভ্যানটা। জানালায় কালো কাঁচ আর তার ওপর চোখ বুজে গভীরভাবে বিশ্বরাজের ব্যাপারে ভাবতে থাকায় এসবের কিছুই বুঝতে পারল না বিক্রম।

ঋকের চোখ শিকারীর মতো গেঁথে আছে ওর সামনের ছোট স্ক্রিনটায়। কণিকা আইল্যান্ডের মধ্যে বারবার ইতস্ততভাবে নিজের অবস্থান বদলে চলেছে বিশ্বরাজ। তাই স্ক্রিনের ওপর লাল বিন্দুটাও বারবার সরে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে।

ঋক পেছন ফিরে ইন্দ্রের দিকে তাকাল একবার। ইন্দ্রও চোখের ইশারায় সম্মতি জানালেন। ভালো সংকেত, সম্ভবত বিশ্বরাজ এখনও সেই অ্যামার্টের কলস খুঁজে পায়নি।

ঠিক একঘন্টা পাঁচ মিনিটের মাথায় ওদের ভ্যান গিয়ে থামল ওড়িশা উপকূলের ধামরা পোর্টের সমুদ্র সৈকতে। বিক্রম এতক্ষণ একভাবেই চোখ বুজে বিশ্বরাজের কথা ভাবছিল, হঠাৎ ভ্যানের ঝাঁকুনিতে চমকে উঠল সে। ইন্দ্র বললেন, “আমরা পৌঁছে গেছি বিক্রম। এখান থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছেন আপনার দাদা।”

“এটা কোন জায়গা?” এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখার চেষ্টা করল বিক্রম, কিন্তু কালো কাঁচের জন্যে কিছুই দেখা গেল না।

“আপাতত সেটা আপনাকে বলা যাবে না। কিছু নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপার রয়েছে।” ইন্দ্র বললেন। “আমি আর অফিসার ঋক আপনার দাদার খোঁজে এগোচ্ছি। আপনি এখানেই থাকুন এবং নিজের কাজ চালিয়ে যান। ওই ছোট মনিটরটা আমাদের সঙ্গেই থাকবে।”

ড্রাইভিং সিটের ওপরে থাকা মনিটরটা নিয়ে ততক্ষণে নেমে পড়েছে ঋক। ইন্দ্রও পেছনের দরজা দিয়ে নেমে পড়লেন। দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে একটু বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল বিক্রম কিন্তু রাতের অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। ইন্দ্র চট করে দরজা ঠেলে দিলেন।

“যানটা ইচ্ছে করেই এখানে নামিয়েছি কমান্ডার। কণিকা আইল্যান্ডে নিয়ে গেলে হয়তো বিশ্বরাজ টের পেয়ে যেত।” ঋক বলল।

“হুম। ঠিকই করেছ।”

ধামরা সৈকতের সামনে একটা সংকীর্ণ সামুদ্রিক অঞ্চল আর তার ওপারেই কণিকা আইল্যান্ড। রাতের এই অন্ধকারেও বেশ আন্দাজ করা যাচ্ছে। তীরে একটা মোটর বোটও রয়েছে। সেদিকেই পা চালিয়ে এগোতে লাগল দুজনে।

ইন্দ্র সমুদ্রের দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই জিগ্যেস করলেন, “এখন অবস্থান কী?”

কিন্তু হাতের মনিটরটার দিকে তাকাতেই হঠাৎ থমকে গেল ঋক। ইন্দ্র তখনও এগিয়ে যাচ্ছেন বোটটার দিকে।

“ঋক, বিশ্বরাজের অবস্থানটা দেখলে?” ইন্দ্র যেতে যেতেই আবার জিগ্যেস করলেন। কিন্তু পেছন থেকে কোনও উত্তর এল না। হঠাৎ কেমন যেন একটা সন্দেহ হল তার। আর তখনই পেছন ফিরতেই যে দৃশ্য তার চোখে পড়ল তার জন্যে একেবারেই তৈরী ছিলেন না ইন্দ্র। এক মুহূর্তে যেন হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেল তার গায়ে।

তার থেকে প্রায় হাত বিশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঋক। অন্ধকারেও ইন্দ্র স্পষ্ট দেখতে পেলেন একটা চওড়া হাত ঋকের মুখটা চেপে ধরে আছে আর ওর পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একটা খড়গের প্রায় এক হাত মতন অংশ। দরদর করে রক্ত ঝরে পড়ছে ওর সারা শরীর বেয়ে। ইন্দ্র যতক্ষণে নিজেকে সামলে উঠলেন ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঋক আর নেই।

ঋকের পেছন থেকে হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে খড়গটা বের করে নিল ওর হত্যাকারী। ঋকের রক্তাক্ত দেহটা একপাশে লুটিয়ে পড়ল। রক্তে সমুদ্রের ভেজা বালি লাল হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে।

অন্ধকার চিরে একটু একটু ইন্দ্রের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল সেই বীভৎস ব্যক্তি। মাথার চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, সারা শরীর জুড়ে ধুলোমাটি আর সদ্য মৃত ঋকের রক্তে মাখামাখি। চোখদুটোতে যেন আগুনের হলকা বইছে। তার দেহের প্রতিটি স্পন্দনে এক ভয়ঙ্কর নৃশংসতা।

ইন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভীষণ মূর্তি আর ইন্দ্র ছবিতে যেই বিশ্বরাজ সিং রাঠোরকে দেখেছিল তার মধ্যে যেন আকাশ-পাতাল তফাৎ। শুধু মুখের আদলটা ছাড়া আর সবই যেন পাল্টে গেছে।

ইন্দ্র নিজের হাতের তালুর বায়োফোটোনিক লেজার-গানটা থেকে বিশ্বরাজের ওপর প্রচণ্ড তীব্রতার লেজার রে ছাড়তে লাগলেন। কিন্তু আশ্চর্য, কিছুই হল না বিশ্বরাজের। পৃথিবীর যেকোনও জীব এই তীব্রতার লেজারের একটা আঘাতেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবার কথা। বিশ্বরাজের শরীর যেন শুষে নিচ্ছে রে-গুলোকে। বিশ্বরাজ আরও এগিয়ে এল ইন্দ্রের দিকে।

“কাকে মারতে চাইছ ইন্দ্র?” অদ্ভুত এক কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল বিশ্বরাজের গলায়। গম্ভীর কিন্তু কী একটা যেন হাড়-হিম করা শীতলতা আছে ওই কথাগুলোতে।

ইন্দ্র চমকে উঠলেন। এই গলা ইন্দ্রের কাছে মোটেও অপরিচিত নয়। “রাবণ!”, নিজের অজান্তেই যেন নামটা বেরিয়ে এল ইন্দ্রের মুখ দিয়ে।

“হ্যাঁ। বড্ড দেরি করে ফেলেছ আসতে। সেই অমৃত এখন আমার শরীরে।”

“বিশ্বরাজ তুমি ভুল করছ। নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনছ তুমি। তোমার স্ত্রী আছে, মেয়ে আছে ওদের কথা ভাব একবার।”

“কে বিশ্বরাজ? নদী যেমন সাগরে মিশে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে তেমনি বিশ্বরাজ আমার মধ্যেই মিশে গেছে চিরতরে।” সেই ভয়ানক মূর্তির অট্টহাসি চারপাশের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে যেন বহুদূর অব্দি ছড়িয়ে পড়ল। “আমি রাবণ। লঙ্কেশ্বর রাবণ। বিশ্বরাজ আর আমি এখন একই ব্যক্তি।”

কথাগুলো বলতে বলতে ইন্দ্রের দিকে আরও এগোতে লাগল সে। ইন্দ্র আবার লেজার প্রয়োগ করলেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। তখনই হঠাৎ প্রায় ছুটে এসে ইন্দ্রের বুকে বেশ জোরে এক লাথি মারল বিশ্বরাজ। ইন্দ্র ছিটকে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়লেন।

“তোমায় খড়গ দিয়ে নয়, নিজের হাতে মারব ইন্দ্র।” কথাটা শেষ করতে না করতেই খড়গ ফেলে ইন্দ্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। টুঁটি চেপে ধরল ইন্দ্রের। ইন্দ্র অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই সরাতে পারলেন না বিশ্বরাজকে। বিশ্বরাজের চোখদুটোতে যেন তখন কোনও এক জন্মান্তরের প্রতিহিংসা আগুন হয়ে দাউদাউ করে জ্বলছে। ওর দেহে এখন আসুরিক শক্তি। ইন্দ্রের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। চোখের সামনে সব কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।

এমন সময় হঠাৎ একটা তীব্র আর্তনাদে চারপাশ কেঁপে উঠল। ইন্দ্র তখন প্রায় অজ্ঞান। আস্তে আস্তে নিজের টলতে থাকা পা দুটোকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল বিশ্বরাজ। একটা লোহার রড ওর পিঠ ফুঁড়ে ঠিক নাভি বরাবর বেরিয়ে এসেছে। কালচে-লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ছে চারদিকে। বিশ্বরাজ পেছন ফিরে তাকাল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিক্রম। ওর দু’চোখ ভেঙে কান্না নামছে। “আমি বুঝতে পারিনি দাদা। আমি মারতে চাইনি কিন্তু ওই মুহূর্তে হঠাৎ...”

বিশ্বরাজের চোখের বিস্ময় নিমেষে রাগের আগুন হয়ে ফেটে পড়ল।

“বিশ্বাসঘাতক...” কিন্তু বিক্রমকে আক্রমণ করতে গিয়েও পারল না বিশ্বরাজ। নাভি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা রক্তাক্ত রডটা ধরে তীব্র যন্ত্রণায় মাটিতে বসে পড়ল সে। রাবণের মায়াশক্তি বিশ্বরাজের নাভিতেই কেন্দ্রীভূত করে রেখেছিল পুরো অমৃতটা, ঠিক যেমনটা ছিল রাবণের নাভিতে। কারণ মানবদেহে নাভিই একমাত্র জায়গা যা পুরো অমৃতকে ধারণ করতে পারে। বিক্রম না জেনেই সেখানে আঘাত করে বসেছে।

বিশ্বরাজের ক্রমশ অবশ হয়ে আসা শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তবু ওর দুটো জ্বলন্ত চোখ এখনও এক ভীষণ প্রতিশোধের আগুন নিয়ে তাকিয়ে আছে বিক্রমের দিকে। ডান হাতটা বারবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে বিক্রমের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলবার।

বিক্রম হাঁটু গেড়ে বসে আছে বিশ্বরাজের সামনে। এক প্রচণ্ড আত্মগ্লানি ঝরে পড়ছে ওর চোখের জলে।

আস্তে আস্তে বিশ্বরাজের উদ্ধত রক্তাক্ত হাতটা সমুদ্রতীরের ভেজা বালিতে নেতিয়ে পড়ল। চোখদুটোও বুজে আসতে লাগল একটু একটু করে। ওর শেষ শ্বাসের সঙ্গে অস্ফুটস্বরে শুধু একটা কথাই বেরিয়ে এল, “বিভীষণ...”

পেছনে তখন বঙ্গোপসাগরের মত্ত গর্জন। ঢেউগুলো বারবার ফিরে ফিরে এসে আছড়ে পড়ছে বিশ্বরাজের রক্তাক্ত শরীরে। নীল জল লাল হয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার। হুঁ হুঁ করে বাতাস বইতে শুরু করেছে। দূরে কোথাও বোধহয় ঝড় উঠল। রাতের ঘোরালো অন্ধকার আরও ঘোরতর হয়ে ঘনিয়ে উঠছে বিক্রমের চারপাশে। আর সেই অন্ধকারের মাঝেই একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে তার দাদার শেষ নিঃশ্বাস। কিন্তু শুধুই কি বিশ্বরাজ, নাকি এই অন্ধকারের মহাগ্রাসে তারই সঙ্গে হারিয়ে গেল এক চিররহস্যময় কালো সাম্রাজ্যের উজ্জ্বলতম সম্রাট?

একটা দমকা হাওয়া হঠাৎ কাঁপিয়ে দিয়ে গেল এই নিশ্ছিদ্র নীরবতাকে। বহুদূর থেকে, চেতনার কোনও এক গভীরতম ভূমি থেকে যেন এক অশরীরী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “রাবণ কখনও মরে না।”