মিথিলা - দেবলীনা পন্ডা

অলংকরণ - পার্থ মুখার্জী
এক

দিগন্তের শেষপ্রান্ত থেকে আলোকবর্ণালীর উজ্জ্বল ছটায় সমগ্র আকাশ ভরিয়ে দিতে দিতে এদিনের মতো বিদায় জানালেন তেজোদীপ্ত দিনমণি। লাল-কমলা-সোনালী বর্ণের অনুপম শোভায় নববধূর মতো সেজে উঠছে চরাচর, বিশ্রামকক্ষের উন্মুক্ত গবাক্ষে মুগ্ধ দুই চোখ মেলে সেদিকেই তাকিয়েছিলেন মহারাজ। ঠিক যেন রাত্রির রত্নখচিত অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকার আগে প্রকৃতি নিজেকে প্রস্তুত করছে এই সলাজ রূপটানে! সূর্যাস্তের এই রক্তিম আভা স্পর্শ করেছে তাঁর প্রশস্ত ললাট, উন্নত নাসিকাকে... উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে সোনালী বর্ণে ধৌত শ্বেতশুভ্র উপবীত। এই সময়টা বড় প্রিয় তাঁর। সারাদিনের ক্লান্তিকর রাজ্যপরিচালনা ও কূটনৈতিক আলাপচারিতার পর এই নৈসর্গিক দৃশ্যটুকু যেন শীতল বারিধারার মতো তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে, মুছিয়ে দেয় সমস্ত ক্লেদাক্ত মলিনতা। আহ্, কী শান্তি!

কিন্তু বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না মুহূর্তটুকু। অচিরেই দ্বারপ্রান্তে উদ্ভব হল এক ছায়ামূর্তির, নতমস্তকে কক্ষে প্রবেশ করে অভিবাদন জানালো সর্বক্ষণের অনুচর সদাশিব, “প্রধান অমাত্য আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী মহারাজ!”

চঞ্চল হয়ে উঠল তীক্ষ্ণ চোখদুটি। পেছনে ঘুরলেন বিশালদেহী ব্রাক্ষ্মণ। এই সংবাদের অপেক্ষাই তো করছিলেন! যে কাজে পাঠিয়েছিলেন প্রধান অমাত্য সহ মন্ত্রীবর্গকে, মহামায়ার আশীর্বাদে তা কি সফল হয়েছে? একটি সম্মতিসূচক ভ্রুকুটি ফুটে উঠল তাঁর রক্তচন্দন চর্চিত কপালে। বাধ্য ভৃত্যের মতো অভিবাদন করে সূক্ষ্ম রেশম নির্মিত বহুমূল্য ঝালর তুলে ধরল সদাশিব, ভেতরে প্রবেশ করলেন প্রধান অমাত্য বলদেব সিংহ।

প্রাসাদের বাইরের আকাশে তখন গোপন শত্রুর মতো ভীড় করে এসেছে ঘন কৃষ্ণবর্ণ মেঘের দল, বিশাল নিকষ আঁধার দলিতমথিত করছে অস্তগামী দিবাকরের উজ্জ্বল আলোকসজ্জা... সহসা গুপ্তঘাতকের তীক্ষ্ণ তরবারির মতো ঈশান কোণে ঝিকিয়ে উঠল রূপোলি বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ! সেই ঘনঘোর মেদুরতার মধ্যেও নতমস্তকে দণ্ডায়মান বলদেব সিংহের মুখমণ্ডলের ওপর ঘনিয়ে আসা ছায়া নজর এড়ালো না মহারাজের। ব্যর্থ! তবে এবারেও ব্যর্থ তাঁর সৈন্যবর্গ! প্রধান অমাত্যের শুষ্ক কণ্ঠ নিঃসৃত বাক্যগুলি তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র এক বিপুল ক্রুদ্ধ-আগ্নেয়গিরি যেন নিদ্রাভঙ্গ শেষে জেগে উঠতে লাগল! বটে! এত বড় স্পর্ধা ওই অর্বাচীন নরাধমগুলোর! খান্ডওয়ালা বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক তিনি, স্বয়ং মহামহিম সম্রাট জাহাঙ্গীরের আশীর্বাদধন্য... আর তাঁর বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনা করার দুঃসাহস করে তারা! ক্রোধে উন্মত্ত বন্য মহিষের মতো আরক্ত চোখে চাইলেন প্রধান অমাত্যের দিকে, সে দৃষ্টি যেন জ্বলন্ত অঙ্গার... ভস্ম করে দিতে চায় এই গোপন শত্রুদের! সুবিশাল প্রাসাদের অলিন্দ সমূহ মুখরিত করে যেন বিষধর কালনাগিনীর ক্রুদ্ধ গর্জন ভেসে এল বলদেব সিংহের দিকে, “এক শত দক্ষ সৈন্যের বাহিনী প্রস্তুত কর!”

দুই

দুম করে ব্যাগটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলল ভূমি! রোদে ঘুরে ঘুরে চোখমুখ লাল, চেয়ারে বসে চেপে চেপে মুখটা মুছে ঢকঢক করে বোতল থেকে জল খেল। আর কাঁহাতক সহ্য করা যায় এই হাড় জ্বালানো চাকরিটা! এইমাত্র নিউজ কভার করে ফিরল সে... কী নিউজ? ভাবতেও নিজেরই গা-টা রি রি করে উঠল ভূমির! গেছিল বড়বাজারের এঁদো বস্তিতে, কোন রিকশাচালকের ক্লাস এইটে পড়া ছেলে গলায় দড়ি দিয়েছে তার দিদি তাকে ইয়ারফোনে গান শুনতে দেয়নি বলে! ব্রিফ শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেছিল, কিন্তু উপায় নেই, যেতেই হবে... এডিটরের নির্দেশ! তারপর ফিরে এসে নাকি এখনকার প্রজন্মের ধৈর্য্যের অভাব ও তাদের ওপর প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে চাট্টি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রিপোর্ট বানাতে হবে! আবার ওবেলা কপালে কী নাচছে কে জানে!

মাথার রগদুটো টিপে ধরল ভূমি। মাঝে মাঝে এত অসহ্য লাগে, মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে চলে যায়! কোথায় তার স্বপ্ন বড় নিউজচ্যানেলের লাইভ রিপোর্টার হবে... আর কোথায় এই “জবরখবর” পত্রিকার অফিসে বসে ইয়ারফোন না পেয়ে সুইসাইডের রিপোর্ট লিখতে বসেছে! মুখের ভেতরটা যেন তিতকুটে হয়ে উঠল! উঠে বাথরুমের পাশে বেসিনটায় গিয়ে মুখে চোখে ভালো করে জলের ঝাপটা দিলো ভূমি। ভেজা মুখে তাকিয়ে আছে আয়নায়। এখনো সেই স্বপ্নটা মাঝে মাঝেই তার ঘুমের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসে... কোনো একটা বেশ মারাত্মক লড়াই চলছে, তার মধ্য দিয়ে হাতে বুম ধরে দৌড়তে দৌড়তে খবর রিপোর্ট করছে ভূমি আর তার পেছনে দৌড়াচ্ছে ক্যামেরাম্যান! কিংবা কোনো বড় পাঁচতারা হোটেলের বিলাসবহুল স্যুটে বসে সে ইন্টারভিউ নিচ্ছে কোনো বড় সেলিব্রিটির! অথবা একটা ভীষণ আলোড়ন ফেলে দেওয়া মার্ডার কেস, হিমশিম খেতে থাকা পুলিশের হাতে বড়সড় কোনো ক্লু তুলে দিচ্ছে নিজে তদন্ত করে! কত রাত এইরকম সব দৃশ্য স্বপ্নের মধ্যে দেখে উত্তেজনায় ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে! কিন্তু বাস্তবটা বড়ই কঠিন, রসকষহীন শুকনো পাঁউরুটির মতো। সেই পাঁউরুটি গত আট মাস ধরে চিবিয়ে চলেছে ভূমি। কম চেষ্টা করেনি সে! ঘুরে ঘুরে সব বড় বড় নিউজ চ্যানেল গুলোয় ইন্টারভিউ দিতে দিতে যে কতগুলো জুতো ছিঁড়ে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই, কিন্তু তার ভাগ্যের শিকেটা আর ছিঁড়ল না! বাংলার মাস্টার বাবা আর সাধারণ গৃহবধূ মায়ের বাংলা মিডিয়ামে পড়া মেয়ে ভূমি, ইন্টারভিউতে ইংলিশ বলতে গিয়ে জিভ জড়িয়েমড়িয়ে একাকার... অতএব বাতিল! বাংলা নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টারের যে ইংলিশ বলার এত কীসের প্রয়োজন বুঝে উঠতে পারে না সে। তার ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখের সামনে দিয়ে প্রতিবারেই টেক্কা মেরে বেরিয়ে গেছে কোনো স্মার্ট সুন্দরী বা হ্যান্ডসাম গড়গড়িয়ে ইংলিশ বলা মেয়ে বা ছেলে! তবে হাল ছাড়েনি ভূমি। এরপর চেষ্টা করেছে একের পর এক নামকরা বাংলা খবরের কাগজ গুলোয়। টিভিতে মুখটা না দেখাতে পারুক, বড় কাগজে ছাপার অক্ষরে তার নামটা বেরোলেও ব্যাপারটা নেহাত মন্দ হয় না! কিন্তু সেখানেও হাজারটা গেরো! মাস্টার্স ডিগ্রী চাই। বরাবরই মাঝারী ধরনের ছাত্রী ছিল, পড়াশুনোয় ফাঁকিটাও বেশ গুছিয়ে মারতো... সারাদিন ঝকঝকে ড্রেস পরে অফিস যাচ্ছে, এমন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকলে আর গল্প বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখলে পড়াশোনাটা হবে কী করে! সেই চাকরি পেতে গেলে যে আগে রেজাল্ট ভালো করতে হবে, সেটা মাথায় ঢুকলে তো! যথারীতি টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাস, মাস্টার্স ডিগ্রী তো দূর অস্ত! তাও বলেছিল ভূমি, যে সে ডিসট্যান্স কোর্স করে ডিগ্রীটা জুটিয়ে ফেলবে, কিন্তু গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার ওপর তাদের আবার কাজের অভিজ্ঞতাও চাই! বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল, “আরে আপনারা চান্স না দিলে শুরুটা করব কী করে? এক্সপেরিয়েন্স কি আকাশ থেকে পড়বে?”

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভূমি। শুধুমাত্র নিজের সিভিতে এক্সপেরিয়েন্স যোগ করার জন্যই পড়ে আছে এই এঁদো পেপারটায়। লাখ খানেকও সার্কুলেশন হবে কিনা এই "জবরখবর" এর কে জানে! সবথেকে আশ্চর্য লাগে ওর, এতগুলো লোকই বা কারা, যারা এই পেপারটা পড়ে! নিজের লেখার মান নিয়ে তার কোনো সন্দেহই নেই, কিন্তু বাকি খবর গুলো! সব মান্ধাতার আমলের লেখার স্টাইল বাকি বুড়ো রিপোর্টারগুলোর! যাই হোক, সে সব ভেবে আর সে কী করবে... তার রাস্তাটা তো আর বড় সোজা না, ধাপে ধাপে উঠতে হবে। বেশ কদিন ধরে যখন মেয়ে চাকরির খোঁজ করে করে ঘরে ফিরে শেষে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকল, তখন রিটায়ার্ড বাংলার মাস্টার অবনীবাবু শেষমেষ ফোনটা করেই ফেললেন বাল্যবন্ধু প্রাণগোপাল মিত্রকে। বহুদিন সেভাবে যোগাযোগ না থাকলেও নাম্বারটা ছিল, ফোনে চিনতে পেরেই “আরে অবু যে!” বলে বিগলিত হয়ে উঠেছিল তাঁর ছেলেবেলার সব দুষ্টুমির সাথী “পানু”! প্রাণগোপাল যে একটা খবরের কাগজ চালান সে খবরটা ছিল অবনী বাবুর কাছে, তাই প্রাথমিক জড়তাটা কেটে গেলে খুলে বললেন মেয়ের ইচ্ছের কথাটা। আর একচান্সেই সেটা লুফে নিলেন প্রাণগোপাল, ওরফে পানু বাবু! তাঁর “জবরখবর” এর যে আসলে জবরজঙ্গ অবস্থা, সেটা বাল্যবন্ধুকে ঘুণাক্ষরে টের পেতে না দিলেও নিজে মনে মনে ভেবে ফেললেন একজন অল্পবয়সী তরতাজা উদ্যমী মেয়েকে রিপোর্টার হিসেবে পেলে নিশ্চয়ই তাঁর পত্রিকার অবস্থা ফিরে যাবে!

আদ্যিকালের ঘড়িটা ঢংঢং করে বারো বার বেজে নিজের জানান দিল। ওড়নার খুঁট দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে টেবিলে এসে বসল ভূমি। তার বারোটা তো বহুদিন আগেই বেজে গেছে। চারপাশটায় চোখ বোলালো, এই আটমাস ধরে একই দৃশ্য দেখছে। সেই কালো ঝুল মাখা ঘরগুলো, পুরোনো কাঠের চলটা ওঠা টেবিল, গদি ছেঁড়া চেয়ার। সঙ্গে প্রিন্টিং প্রেস এর অনবরত ঘটাংঘট শব্দ আর পান খাওয়া ধুতি পরা সব বাবার বয়সী টেকো কলিগ! প্রথম দিনটা যেন এখনও চোখের সামনে জলছবির মতো ভেসে ওঠে...

—“দাদা ‘জবরখবর পত্রিকা’র অফিসটা কোন গলি?” লিপস্টিক বাঁচিয়ে রুমালে আলতো করে ঠোঁটের ওপরের ঘামটা মুছে পান দোকানিকে জিজ্ঞেস করল ভূমি।

—“জবরখবর!” একটা বাচ্চা ছেলেকে খুচরো ফেরত দিতে দিতে ভোম্বল চোখে দেখল লোকটা।

একটু ভারিক্কি ভাবে একদিক ওদিক তাকাল ভূমি। নামটা একটু অদ্ভুত টাইপের, তাই বলে অমন তাচ্ছিল্যের চোখে দেখার কী আছে! অবশ্য এরা আর কতটুকুই বা খবর কাগজের খোঁজ রাখে! তাও একবার শেষ চেষ্টা করে বেরিয়ে আসছিল দোকান থেকে, “খবরের কাগজের অফিস... ঠিক আছে, আমি খুঁজে নিতে পারবো...” এমনসময় “খবরের কাগজ? ও পানুবাবুর আপিস খুঁজছেন নাকি? আগে বলবেন তো! উনি তো দুবেলা আমার এখান থেকেই পান খেয়ে যান! জর্দা স্পেশাল চমনবাহার!” বলে ছোপ ছোপ দাঁতে পানের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে একগাল হাসল লোকটা। সরু গলিটা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেও কপাল থেকে ভ্রুকুটিটা যাচ্ছিল না ভূমির, যে খবরের কাগজকে স্থানীয় লোকজন নিজের নামে নয়, বরং এডিটরের পান খাওয়ার জন্য, চেনে সেটার হাল...

ভাবতে ভাবতেই পুরোনো টাইপের একটা দোতলা বাড়ির জংধরা গেট ঠেলে ঢুকেছে। একটা সাইনবোর্ড লাগানো “জবরখবর পত্রিকা”, নীচে ঠিকানা লেখা। নিজের মনের মধ্যে ফুলতে থাকা বেলুনের হাওয়াটা যে আস্তে আস্তে বেরোচ্ছে, বুঝতে পারছিল ভূমি... তারপর সবুজ রঙের কাঠের দরজাওলা ঘরটায় ঢুকতেই... ফুউউউসস! চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো পুরোপুরি চুপসে গেছিলো। আর হবে নাই বা কেন! ঝাঁ চকচকে কেতাদুরস্ত না হোক, অন্তত ভদ্রস্থ গোছের একটা অফিসের যে ছবি সে মনের মধ্যে এঁকে রেখেছিল, সেটা মুহুর্তের মধ্যে জল পড়ে ধেবড়ে গেল। একটা মাঝারি ধরনের হলঘর, দেওয়ালের রং আর বিভিন্ন জায়গায় ঝুলতে থাকা সিমেন্টের চাংড় দেখে মনে হয়না গত দশ বছরে তাদের কোনো যত্নআত্তি হয়েছে! কোণে কোণে ঝুল, লোহার শিক দেওয়া জানালাগুলোর একপাশে গুটোনো নোংরা পর্দা, ডাঁই করে রাখা মলিন ফাইল... এসবের থেকে নজর ঘুরে এসে পড়ল বিভিন্ন জায়গায় বসে থাকা লোকগুলোর ওপর। এরা কি তার সহকর্মী নাকি! মাঝবয়সী বা আধবুড়ো তিন—চারজন মানুষ... একজন একটা পাখির পালক দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, একদিকে টেবিলের সামনে বসে ঢুলছে একজন, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়িতে টান দিতে দিতে ধোঁয়া ছাড়ছে আরেকজন। তবে ভূমিকে দেখে সবাই ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসল, আর এমনভাবে ভূমিকে আপাদমস্তক জরিপ করতে লাগল যেন কোনো মানুষ নয়, অন্য গ্রহের কোনো প্রাণী এসে দাঁড়িয়েছে! সে আর তাদের দোষ কী... সেই মুহুর্তে ভূমির নিজেরই নিজেকে কেমন একটা এলিয়েন এলিয়েন মনে হচ্ছিল। এই ধ্যাদ্ধেড়ে রংচটা অফিসের ব্যাকগ্রাউন্ডে ভূমির জিনসে স্মার্টলি গুঁজে পরা স্ট্রাইপড শার্ট, পাফ করা চুলে পনিটেল, আর মুখে হালকা কাজল-লিপস্টিকের ছোঁয়া... পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম বেমানান দুটো বিষয়!

ঠক্। চায়ের গ্লাস বসিয়ে দিয়ে গেল বেয়ারা রতন। ক্যাটকেটে মিষ্টিওলা লাল চা। অন্যমনস্কভাবে গ্লাসটা টানল ভূমি। এরকম ভাঙাচোরা অফিস, পুরোনোপন্থী বাবার বয়সী কলিগেরা... এই সব কিছুই মানিয়ে নিত সে, যদি কাজটা অন্তত ইন্টারেস্টিং হত! যত বড় বড় ইম্পর্ট্যান্ট নিউজ গুলো বড় নিউজপেপার বা নেট থেকে ইনফো জোগাড় করে লিখতে হয়। কালেভদ্রে এক-আধটি জায়গায় যদি নিজে গিয়ে স্টোরি করার সুযোগও মেলে, নামীদামি পেপার আর চ্যানেলের রিপোর্টারদের ভিড়ে আসল কাজটা করাই যায় না! লোকবলই তো নেই! একটা পুরোনো ক্যামেরা ঝোলানো পঞ্চাশ বছরের বিমলবাবু আর ভূমি... এই তো তাদের টিম! কেউ পাত্তাই দেয় না!

কোঁৎ করে কিছুটা চা গিলে মুখ বিকৃত করল ভূমি! ধুত, আজকাল অফিসে আসতেই ভালো লাগে না! আর কতদিন যে এভাবে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হবে কে জানে! এখানে না আছে কোনো অ্যাড্রিনালিন ঝরানো খবর, না বুদ্ধি খাটিয়ে কোনো ক্রাইমের বিশ্লেষণ করার অবকাশ! কিন্তু কিছু করারও তো নেই! কোনোমতে দিনের বেলা চাকরির সঙ্গে সঙ্গে ডিসট্যান্স মাস্টার্স কোর্স আর সপ্তাহে দুদিন সন্ধ্যেয় স্পোকেন ইংলিশ কোর্সটাও চালিয়ে যাচ্ছে সে, যাতে একবার ডিগ্রীটা পেলে আর এখানে থেকে কিছুদিনের এক্সপেরিয়েন্স জোগাড় হয়ে গেলে বুড়োকে ঠ্যাঙা দেখিয়ে বড় নিউজপেপারে জয়েন করবে!

“দিদিমুনি!” রতনের হেঁড়ে গলায় ভাবনাটা ছিঁড়ে গেল ভূমির। কখন এসে দাঁড়িয়েছে রতন, একটু ভুরু নাচিয়ে তার বিখ্যাত উচ্চারণে বলল, “ছার ডাকতিছেন!” ঘড়িটা দেখল ভূমি। দেরি তো বিশেষ হয়নি, রিপোর্টটা লিখতে তার বড়জোর আধঘন্টা লাগবে। তাছাড়া বন্ধুর মেয়ে বলেই হোক, বা এই খেঁকুরে অলস বুড়ো রিপোর্টারদের মধ্যে সেই একমাত্র করিৎকর্মা বলে হোক, পানুবাবু একটু তুইয়েবুইয়েই রাখেন তাকে... কাজে কর্মে তাড়া দেন না মোটেই! ঠোঁটটা কামড়ালো, তবে কি আবার ওবেলা কোথাও দৌড় করাবে বুড়ো? বিরক্তি চেপে বলল, “যাচ্ছি”। তারপর চা-টা শেষ করে ওড়নাটা গুছিয়ে নিয়ে উঠল। এখানে আসার প্রথম দিনেই একটু হাত কচলে বিগলিত গলায় বলে দিয়েছেন পানুবাবু, “হেঁ হেঁ... আসলে বুইলে কিনা মা... সব তো গুরুজন এখানে... মানে, তুমি ওই চুড়িদার-টুড়িদার পরো না? হেঁ হেঁ... আসলে এরম পোশাক এখানে... দেখার ওব্বেস নেই কিনা... !” যা বোঝার বুঝে গেছিল ভূমি। সেদিনই সন্ধ্যেয় রাগে গজগজ করতে করতে গড়িয়াহাট থেকে একগাদা কুর্তি-ওড়না-সালোয়ার কিনে এনেছিল। এর মধ্যেই অনভ্যাসের ফলে বাসের ঠাসাঠাসিতে খোঁচা লেগে আবার তিনটে ওড়না ছিঁড়েও গেল! অসহ্য!

তারা বসে যে হলঘরটায় তারই এককোণে প্লাইউডের পার্টিশান দিয়ে এডিটরের চেম্বার, পাতলা শাঁস উঠে যাওয়া প্লাইয়ের দরজাটা ঠেলল ভূমি, “ডাকছিলেন কাকাবাবু?”

মোটা কাঁচের স্ল্যাব ঢাকা টেবিলটার উল্টোদিকে কাঠের চেয়ারে বসে মনযোগ দিয়ে কী একটা কাগজ পড়ছিলেন প্রাণগোপাল মিত্র, তার গলা শুনেই ক্যাঁচম্যাঁচ শব্দ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, “এসে গেচো ভূমিসুতা? বোসো বোসো, একটা জবর খবর আচে!” “আপনার তো সবটাই জবর খবর!” মনে মনে ভাবতে ভাবতে ভুরুটা কুঁচকে গেল ভূমির, কী ব্যাপার? উনি হঠাৎ ভূমিসুতা বলে ডাকলেন যে! তার ভূমিসুতা ভট্টাচার্য্য নামটাকে প্রথম দিনই আদর করে “বিবি” করে নিয়েছিলেন পানু বাবু, আজ হঠাৎ একেবারে ভূমিসুতা! বুড়ো নিশ্চয়ই কোনো কারণে বিশাল এক্সাইটেড! আলতো হেসে পানু বাবুকে জরিপ করতে করতে চেয়ারে বসল ভূমি। ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ মানুষটার পানের কালো ছোপওয়ালা দাঁতের সারি একদম দুই কান অব্দি ছড়িয়ে আছে, চোখ দুটো টেনিস বলের মতো গোল্লা গোল্লা! উত্তেজিত হয়ে টেবিলে একটা চাপড় মেরে বলে উঠলেন, “আমি জানতুম! হুঁ হুঁ বাওয়া, মুখ দেখলেই বোঝা যায়! ফার্স্ট হওয়া অত ইয়ে নাকি! হত আমাদের পচ্চিমবঙ্গ...”

উফফ্! এই এক যন্ত্রণা! এই ভদ্রলোক যে কোথা থেকে শুরু করে কোথায় চলে যান কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা ভূমি! বিরক্তিটা চেপে রেখে ঠোঁট ফাঁক করল, “ব্যাপারটা কী যদি একটু খোলসা করে বলেন... কার ফার্স্ট হওয়ার কথা বলছেন?”

—“এহে!” মস্ত করে একটা জিভ কাটলেন পানুবাবু, “দেকেচো কাণ্ড ! আসল কতাটাই বলতে ভুলে গেসলাম!” তারপর ভুরু নাচিয়ে পায়চারি করতে করতে এবং উত্তেজিত হয়ে টেবিলে কয়েকবার ঘুঁষি মেরে পরের দশ মিনিট যা যা বললেন তার সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, দিন কয়েক আগে যে বিহার বোর্ডের প্লাস টু বোর্ড রেজাল্ট বেরিয়েছে আর তাতে যে হাজিপুরের মেয়েটা টপ করেছে, সে আদতে সাবজেক্টগুলোর নামই ঠিক করে বলতে পারছে না! এতদূর শুনেই ভূমি বলে উঠল, “কিন্তু সেটা নিয়ে তো একটা আর্টিকল অলরেডি লিখেছি কাকাবাবু! এই তো আগের উইকেই!”

—“আরে খবর সেটা না! দাঁড়াও দাঁড়াও, এই দেখো...” বলতে বলতে ঘরের এক কোণে টেবিলের ওপর বসানো পেটমোটা ছোট টিভিটা চালিয়ে দিলেন পানুবাবু, চ্যানেল টপকে টপকে পৌঁছেছেন একটা বড় সর্বভারতীয় চ্যানেলে। সেখানে ব্রেকিংনিউজ হিসেবে যা চলছে তা হল, ওই মেয়েটির আবার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল এবং সেই পরীক্ষায় খুবই করুণ ভাবে ফেল করার পর সে স্বীকার করেছে একটি গ্যাং এর জড়িত থাকার ব্যাপারে। গ্যাংটি টাকার বিনিময়ে বোর্ডে ফার্স্ট করিয়ে দিয়েছে তাকে!

—“কী রকমের দুর্নীতি ভাবো! টিচারদেরও নিশ্চয়ই টাকা দিয়ে কিনে রেখেছে ওই গ্যাং! আমি চাই তুমি ওখানে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা কভার করো! শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড, তারাই যদি এমন...” গড়গড় করে দেশের দুর্দশার ব্যাপারে একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলেন পানুবাবু! এমনিতেই দেশের শিক্ষা সংস্কৃতি, যুব সমাজ নিয়ে ভীষণ রকম চিন্তিত থাকেন, তাই পছন্দ মতো টপিক পেয়ে মোটামুটি এক নিঃশ্বাসে সুচিন্তিত বক্তব্য পেশ করতে লাগলেন! অর্ধেক কথাই কানে যাচ্ছিল না ভূমির... তার চোখ তখন আটকে আছে টিভিতে বুম হাতে রিপোর্ট করতে থাকা মেয়েটার দিকে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কবে যে সেও এরকম লাইভ নিউজ কভার করতে পারবে! যাই হোক, আপাতত পাটনা যাওয়ার তোড়জোড় করতে হবে তাকে।

তিন

অমাবস্যার তমসাচ্ছন্ন রজনী আসন্ন। প্রগাঢ় মসীবর্ণের আচ্ছাদনে ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হচ্ছে সমগ্র তরাই, উন্নতশির সুবিশাল হিমালয় কেবল অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় দণ্ডায়মান। ক্লান্ত পক্ষীকুল যখন নিজেদের নীড়ে সবে নিদ্রা দেবীর আরাধনা শুরু করেছে, তখন তরাইয়ের দুর্ধর্ষ জঙ্গল ভেদ করে বন্ধুর পার্বত্য পথে দেখা গেল কিছু অগ্নিশিখা! নিশীথের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে চতুর্দিক মুখরিত হল শতাধিক অশ্বের খুর নিঃসৃত ধ্বনিতে!

শিকারি বাজের মতো শ্যেন দৃষ্টিতে সামনের পথের দিকে তাকিয়ে ছিলেন মহারাজ, রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়েই অতর্কিতে আক্রমণ হানতে হবে শত্রুর ডেরায়! তাঁর রাজত্বে বসবাস করে রাজাদেশ অমান্য করার দুঃসাহস অদ্যাবধি কারোর হয়নি, আর এই বন্য আদিবাসীগুলো তাঁর তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে শুধু করফাঁকি দিয়ে বৎসরের পর বৎসর অতিবাহিতই করেছে তা নয়... এই নিয়ে দ্বিতীয় বার তাঁর প্রেরিত ফলকনামা বাহক কর্মচারীদের হত্যা পর্যন্ত করেছে! জ্বলন্ত মশালের আলোকে মহারাজের দুই চোখ হীরকখণ্ডের মতো জ্বলতে লাগল। এত শক্তি ধরে সে নরকের কীটগুলো! নিশ্চয়ই কোনো বিদেশী শক্তি গোপনে সাহস জুগিয়েছে এই বর্বর জাতিকে... আজ তিনি সমূলে উৎপাটিত করবেন সেই দুঃসাহসের নব অঙ্কুরিত বীজ! স্বহস্তে প্রতিটি গ্রামবাসীর মুণ্ড ধড় হতে বিচ্ছিন্ন না করা অবধি শান্তি নেই তাঁর!

মাসকয়েক পূর্বের ঘটনাটি তাঁকে যথেষ্ট অবাকই করেছিল। উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল থেকে দক্ষিণের রুক্ষ সমভূমি অবধি সুবিস্তৃত তাঁর সাম্রাজ্য, দক্ষ প্রশাসক হিসেবে সাম্রাজ্যের প্রায় চার সহস্রাধিক গ্রাম সর্বদাই নখদর্পণে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিসেবে নামডাক আছে তাঁর, প্রজারা একই সঙ্গে ভয় ও ভক্তির আসনে বসালেও নিজ প্রভাব যাতে কোনো অংশে খর্ব না হয় সেই উদ্দেশ্যে বিপুল অর্থব্যয়ে গড়ে তুলেছেন এক শক্তিশালী গুপ্তচরবাহিনী। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল হতে সেই বাহিনী সংবাদ বহন করে এনেছিল, মহারাজের রাজত্বের সীমানার মধ্যে সুউচ্চ পর্বতমালার পাদদেশে গভীর অরণ্যবেষ্টিত একটি অঞ্চলে উদ্ভব হয়েছে কিছু মানুষের, সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে একটি গ্রাম গঠন করেছে তারা! বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর নজরদারি এড়িয়ে কোথা থেকে এসেছে এই গোষ্ঠীবিশেষ? একি তাঁর পিতা-পিতামহের শাসনকাল থেকে এতগুলো বৎসর ধরে আত্মগোপন করে আছে? অথবা ওইনওয়াড়া বংশের পতনের পরবর্তী মাৎসন্যায়ের সময় আগত রাজপুত সামন্তদের কোনো অংশ, যারা এখনো গোপনে বসবাস করছে? চিন্তান্বিত হয়ে তৎক্ষণাৎ নিজ আদেশপত্র সহ সৈন্যসামন্তের একটি দল প্রেরণ করেন তিনি, তাদের নেতা যেন রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে রাজার প্রতি যথাযথ আনুগত্য প্রকাশ করে। কিন্তু পক্ষ অতিবাহিত হয়, কোনোরূপ সংবাদ আসে না তাঁর প্রেরিত প্রতিনিধি দলটির! গুপ্তচরবাহিনীও কোনো আশাপ্রদ তথ্য সংগ্রহ করে উঠতে পারে না এ ব্যাপারে... একপ্রকার যেন শূন্যেই বিলীন হয়েছে তারা! দ্বিতীয় পর্বে প্রেরিত বাহিনীটিরও অনুরূপ অবস্থার সংবাদ যখন প্রধান অমাত্য বহন করে আনলেন, তখন ধৈর্য্যশক্তির শেষ সীমায় পৌঁছেছেন তিনি! প্রবল ক্রোধাগ্নি গ্রাস করে তাঁর সকল অস্তিত্ব! এক বর্বর জঙ্গলবাসী গুপ্ত ঘাতক দল দিনের পর দিন তাঁর আদেশনামা বাহক কর্মচারীদের নির্বিচারে হত্যা করে দেহ অন্তর্হিত করবে, প্রশ্ন তুলবে তাঁর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর আর তিনি একজন অযোগ্য মূঢ় প্রশাসকের মতো অসহায় দৃষ্টিতে শান্ত ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন... তা তো হতে পারে না! ওই পাপিষ্ঠ নরাধমদের তিনি নিজহস্তে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন কার বিরুদ্ধাচারণ করেছে তারা এবং তার শাস্তি কত ভয়ঙ্কর হতে পারে! তাই তাঁর নির্দেশেই প্রস্তুত হয়েছে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাপেক্ষা দক্ষ, বিশেষ শক্তিধর এই একশত সৈন্যবাহিনী, সেনাধিপতি সহ যাদের নিয়ে শত্রুনিধনে চিরনির্দেশিত পথে অগ্রসর হয়েছেন স্বয়ং মহারাজ!

হিমশীতল বিক্ষুব্ধ বায়ু জঙ্গলের প্রকাণ্ড বৃক্ষগুলিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মর্মরধ্বনি তুলছে। মশালের অগ্নিরেখায় দূরে যেন দেখা যায় একটি ক্ষুদ্র গৃহ! তবে কি গন্তব্য আসন্ন? সতর্ক দৃষ্টিতে স্বল্প দূরত্ব বজায় রেখে থামার নির্দেশ দিলেন মহারাজ, দুইজন অশ্বারোহী সৈন্য খোলা তরবারি হাতে এগিয়ে গেল। কোনোরকম বিপদের আভাস নেই, সৈন্যরা সঙ্কেত দেওয়া মাত্র ভগ্নপ্রায় গৃহটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মহারাজ। একটি পরিতক্ত্য মন্দির গৃহ! বিস্মিত ভ্রুকুটি দেখা দিল তাঁর কপালে! আপাত দৃষ্টিতে জনবসতিশূন্য এই অঞ্চলে বহু বৎসর পূর্বে মানুষজনের বাস ছিল বলে তিনি শুনেছিলেন, তারপর এক ভয়ঙ্কর মহামারীর কবলে পড়ে ধীরে ধীরে মুছে যায় সমস্ত জীবিত প্রাণীর চিহ্ন। এ কি তবে সেই অভিশপ্ত অঞ্চল, যেখানে কালের অমোঘ নিয়মকে অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে এই পরিত্যক্ত মন্দিরগৃহটি? কৌতূহলী পায়ে মন্দিরের সামনের ঘন গুল্মরাজি ভেদ করে ভগ্ন দ্বারের সামনে এসে দাঁড়ালেন মহারাজ এবং সঙ্গে সঙ্গেই অপার বিস্ময় ও ভক্তিতে আপ্লুত হল তাঁর দুই নয়ন। পুরু ধুলোর আস্তরণ জমেছে পাষাণ মূর্তির ওপর, তার মধ্যেই শুষ্ক পত্রাদির স্তুপে ভগ্ন আসনে অধিষ্ঠান করছেন স্বয়ং আদ্যাশক্তি কালীমাতা! এ কোন লীলা মায়ের! শত্রুনিধন যজ্ঞের পূর্বে মায়ের এই মৃন্ময়ী রূপ দর্শনের সৌভাগ্য... এ কি স্বয়ং বিধাতার ভাগ্যলিখন? তাঁরই বিজয়ের শুভসঙ্কেত? পূর্ণচিত্তে আভূমি প্রণিপাত করলেন মহারাজ, ভক্তিভরা সজল নয়নে কিছু মুহূর্ত মাতৃমূর্তির সামনে প্রার্থনা করে ফিরে গেলেন নিজ বাহিনীর কাছে। শতাধিক অশ্বারোহী সৈন্যদল জঙ্গল ভেদ করে তরাইয়ের বন্ধুর পার্বত্য পথে অগ্রসর হল শত্রুর উদ্দেশে।

চার

রুমে ঢুকে কাঁধের ব্যাগ আর গলায় ঝোলানো আই কার্ডটা খুলে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল ভূমি। শরীর আর চলছে না! অসম্ভব পরিশ্রম গেছে সারাদিন... আর সেই সঙ্গে... দুপুরে বিহারী পুলিশ অফিসারটার বাঁকা হাসিটা মনে পড়তেই কান দুটো আবার গরম হয়ে গেল ভূমির! তাল মিলিয়ে যেন বিদ্রূপ মেশানো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিচ্ছিল বাকি সব নামীদামি চ্যানেলের রিপোর্টার গুলোও! ইসস্, চ্যানেল না হোক, অন্তত যদি একটা বড় কাগজেরও রিপোর্টার হত সে! একে তো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রমরমা, সব তিলক কাটা আর মোটা গোঁফ ওলা বিহারী পুলিশ গুলো চ্যানেলদেরই বাইট দিতে ব্যস্ত, টিভিতে মুখ দেখানোর এমন চান্স কেউ ছাড়ে! তাও বাংলার বড় বড় পেপারের লোক গুলোরও এখানে লোকাল করেন্সপনডেন্স আছে, বেশ ভালোই কানেকশান... এদিক ওদিক দিয়ে গলে ঠিক ঢুকে গেল! আর ভূমি! এই সব ঝাঁ চকচকে ব্যাপারের মধ্যে এক পাতি বাংলা কাগজের রিপোর্টার, যার নাম কটা লোক শুনেছে সন্দেহ! ওকে তো পাত্তাই দিল না কেউ! মাইক আর ক্যামেরা নিয়ে ঠেলাঠেলি করতে থাকা এক গাদা লোকের ভিড়ে ওই পাশ থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে যতটা বুঝেছে, নোট করে নিয়েছে। অথচ কাল আসার পর থেকে কতগুলো প্রশ্ন তৈরী করল এই হোটেল রুমে বসে, অফিসার-ইন-চার্জকে ডিটেইলসে জিজ্ঞাসা করবে বলে!

বিছানার ওপর এলিয়ে পড়ল ভূমি। কিচ্ছু ভালো লাগছে না! পদে পদে এত হ্যারাসমেন্ট, এত অপমান... আর কতদিন নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে? চেষ্টার তো কোনো ত্রুটি রাখে না সে, নিজের কাজটুকুর জন্য মন প্রাণ সঁপে দেয়... তার এই পরিশ্রমের কি কোনো মূল্যই নেই? তার স্বপ্নগুলো কি স্বপ্নই থেকে যাবে? কোনোদিনই কি সে এমন কোনো খবর আমজনতার সামনে তুলে ধরতে পারবে না, যাতে চমকে যায় গোটা দেশ?

দরজায় টোকা পড়ল। চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসল ভূমি। আসার সময় নীচে রিসেপশানে একটা কফি পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল, সেটাই হবে। চোখ থেকে গড়িয়ে আসা ফোঁটাটা মুছে নিজেকে গুছিয়ে নিল, দরজা খুলেছে। দরজার বাইরে কফির ট্রে হাতে খুদে খুদে চোখের নেপালী ছেলেটা দাঁড়িয়ে, মুখে ছড়ানো একটা শিশুসুলভ হাসি! আপনা থেকেই একটা হালকা হাসি ফুটে উঠলো ভূমির ঠোঁটের কোণেও, স্নিগ্ধ গলায় বলল, “আও বাবুরাম!”

ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর ট্রেটা বসালো বাবুরাম। সহজ-সরল ছেলেটাকে গতকাল আলাপ করার পর থেকেই বেশ ভালো লেগে গেছে ভূমির, কত বড় উপকারটাই না করল! এমনিতে ছোটো খাটো সস্তার হোটেল, কর্মচারীও হাতে গোনা কজন। কাল সন্ধ্যেয় হোটেলের সামনে অটো থেকে নেমে ভয়ঙ্কর ফ্যাসাদে পড়েছিল ভূমি! ট্রলিব্যাগটার চাকাগুলো এমনিতেই নড়বড়ে ছিল, নামতে গিয়ে খুলে একদিকে কেতরে গেল! সেটা নিয়েই তখন ব্যস্ত ও, আর ইতিমধ্যে অটো ছেড়ে দিল, যার মধ্যে টাকা-পয়সা-আইকার্ড সমেত রয়ে গেছিল ওর সাইড ব্যাগটা! ভয়ে তো হাত পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড় ভূমির! এই অজানা অচেনা শহরে কীভাবে উদ্ধার করবে ব্যাগটা! একটা পয়সাও তো নেই যে ফিরে যেতে পারবে! কোনোমতে হোটেলে ঢুকেই কাতর কণ্ঠে সবে ম্যানেজারের কাছে সাহায্য চাইছে, অমনি নিজের থেকে এগিয়ে এসেছিল এই বাবুরাম! ম্যানেজারের বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে, আর আধঘন্টা মতো পরে ঘাম মুছতে মুছতে লবিতে বসে থাকা ভূমির সামনে হাসিমুখে ধরেছিল ব্যাগটা, “লিজিয়ে দিদি!” ধড়ে প্রাণ এসেছিল ভূমির! হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল, কিছু টাকা দিতে যেতে কিছুতেই নেবে না বাবুরাম! শেষে একপ্রকার জোর করেই ওর শার্টের পকেটে গুঁজে দিয়েছিল একশো টাকার নোটটা।

—“কী হল দিদি? কাজ ঠিকঠাক হয়েছে তো?” ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে উদ্বিগ্ন মুখে বলে উঠল বাবুরাম! একটু শুকনো হাসল ভূমি। কাল রাতের খাবার দিতে এসেও অনেকক্ষণ গল্প করছিল ছেলেটা। সে রিপোর্টার শুনে তার কী উত্তেজনা! হায় রে, এত সিরিয়াসলি যদি তাকে বাকিরাও নিত! আলগা হাতে কফির কাপটা টেনে নিয়ে বলল ভূমি, “ছাড়ো আমার কথা... তুমি বল... তোমাদের গ্রামের গল্প শোনাও! কে কে আছেন বাড়িতে?”

একগাল হেসে গল্প জুড়ে দিল বাবুরাম। কথা বলতে ভীষণ ভালোবাসে ছেলেটা। বয়সে ভূমির থেকে অনেকটাই বড়, তাও তাকে সে দিদি বলবেই! বারবার বলা সত্ত্বেও চেয়ারটায় না বসে মেঝেতে বসে পড়ল হাঁটু মুড়ে, আর তারপর হাত-পা নেড়ে হিন্দিতে বলা শুরু করল তার গ্রামের কথা... বিহারের সীতামারির কাছে ভারত-নেপাল সীমান্ত পেরিয়ে তাদের গ্রাম, বাড়িতে থাকা মা, ভাই, স্ত্রী আর তার ছোট্ট মেয়ের গল্প...

শুনতে শুনতে মনের ভেতরের হতাশার কালো সুতো গুলো ধীরে ধীরে ছিঁড়ে যাচ্ছিল ভূমির। বাবুরাম তখন বিভোর হয়ে বলে চলেছে তার প্রিয় গাইটার কথা, তাদের ধানের ক্ষেত... যেখানে ফসল ফলায় তার ভাই, তার একরত্তি মেয়েটা সবে হাঁটতে শিখেছে... একটা শীতল প্রশান্তি চারিয়ে যাচ্ছিল ভূমির মধ্যে, সেই সঙ্গে একটু বিষন্নতাও। কত সুন্দর সহজ-সরল জীবনযাপন এদের, কত অল্পেই খুশী! অথচ তাদের শহুরে দিন গুলো যেন রোজ শুরুই হয় টিকে থাকার লড়াই, আরো বেশী পাওয়ার চাহিদা, নাম-যশ-সম্পত্তি এই সবের হিসেবনিকেশ দিয়ে! মুগ্ধ স্বরে বিড়বিড় করল ভূমি, “কী লাকি তোমরা…!” লাজুক হাসল বাবুরাম, তারপর পকেট থেকে পার্স বের করল... একটা পাসপোর্ট সাইজ ফোটো এগিয়ে দিল উজ্জ্বল মুখে, “ইয়ে দেখিয়ে দিদি! হামারি বিটিয়ারাণী! নাম হ্যায় কুসমা!”

একটা বছর খানেকের ধপধপে ফর্সা গোলগাল বাচ্চা মেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। একমাথা তেল চুপচুপে চুল টেনে গোছা করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি বাঁধা, কপালে মস্ত বড় কাজলের টিপ, তার ওপরে বেশ খানিকটা পাউডার থাবড়ানো। ছবি তোলার আগে বোধহয় কাঁদছিল, চোখে মোটা করে পরা কাজলটা ধেবড়ে গিয়ে চোখের নীচটা কালো, নাক দিয়েও সিকনি গড়িয়ে এসেছে। “বাঃ! খুব মিষ্টি তোমার মেয়ে!” স্মিত হাসল ভূমি। “জান হ্যায় মেরি! ওর জন্যই তো বাড়ি থেকে দূরে পড়ে থেকে পরিশ্রম করছি... !” স্বপ্নমেদুর চোখে সেই অদ্ভুত টান মেশানো হিন্দিতে বলে চলল বাবুরাম, “ওকে আমি পড়াব, কলেজে পাঠাবো! তোমাদের মতো নিজের পায়ে দাঁড়াবে আমার মেয়ে, রোজগার করবে! জানো দিদি, আমাদের গ্রামের মেয়েগুলোর পন্দরা বরস হোতে না হোতেই সব বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার মেয়ের অত জলদি শাদি করাবো না আমি! শাদি হয়ে গেলে আর কী বলো... সেই তো শশুরাল গিয়ে সোয়ামি আর শাশ-শশুরের সেবা...”

অবাক হয়ে বাবুরামের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল ভূমি। ওর প্রতিটা কথা যেন হৃদয়ের গভীরতম অংশে গিয়ে ধাক্কা মারছে! বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। স্বল্পশিক্ষিত এই নেপালী যুবকের প্রতি মনে মনে শ্রদ্ধায় মাথা ঝুঁকে এল তার, মুখে শুধু অস্ফুটে বলল, “খুব ভালো!”

ওদিকে বাবুরাম দ্বিগুন উৎসাহে বলতে শুরু করেছে, “আমরা কিন্তু পড়াশোনা জানা ফ্যামিলির মানুষ, জানো দিদি! হ্যাঁ, আমরা ভাইয়েরা বেশী দূর লেখাপড়া করতে পারিনি... সেই ছোট্টোবেলায় পিতাজি মারা গেল... মা অনেক কষ্ট করে আমাদের বড় করেছে, কেলাস ফোর অব্দি পড়িয়েছে। কিন্তু পিতাজিও চাইতেন আমরা যেন অনেক লেখাপড়া করে বড় হই! আসলে আমাদের অনেক আগের সব দাদা-পরদাদা তো অনেক বড় পণ্ডিত ছিলেন...”

ওর কথা বলার ভঙ্গিটা ভারি মজার লাগছিল ভূমির, উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলল, “তাই!”

—“হ্যাঁ দিদি!” চোখ বড় বড় করে বলল বাবুরাম, “শুধু বড় পণ্ডিত না, আমরা তো আসলে রাজার বংশ! কালে কালে অবশ্য সবই গেছে... সেসব রাজত্বের নমুনা তো কিছুই দেখিনি চোখে, এত পুরুষ ধরে শরিকে শরিকে খেয়োখেয়ি করে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। এখন আমাদের ঠিকমতো খাওয়ারের জোগাড় করতে হালত খারাপ হয়ে যায়। তবে মায়ের কাছে শুনেছি, এই বিহারেরই দ্বারভাঙ্গাতে রাজধানী ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। সে কত বছর আগের কথা! মোগল সম্রাট আকবর নিজে দিল্লির রাজসভায় ডেকে রাজা ঘোষণা করেছিলেন তাঁদের! কত বড় বড় বীর ছিলেন, কত বিদ্বান ছিলেন সেই রাজারা! মৈথিলি ব্রাক্ষ্মণ তো আমরা, তাই সবাই রাজ্য চালানোর সঙ্গে সঙ্গে অনেক পড়াশোনা জানাও ছিলেন, বুঝলে দিদি! এই আমার মাকেই দেখো না, বিয়ের আগে সই অব্দি করতে পারতো না। তারপর পিতাজি শেখালেন সই করা... বাড়িতে অনেক পুরোনো কিতাব আছে, মা এখন সারাদিন পড়ে সেগুলো! মেরি বেটি ভি ওয়সে হোগি! সব লোগ বোলেগা, উও দেখো কুসমা কি পিতাজি যা রহে হ্যায়!” গর্বে যেন দুই চোখ চকচক করে উঠল বাবুরামের!

মনখারাপের কালো মেঘটা কেটে যাচ্ছে। এই অজানা শহরের এই অচেনা মানুষটা নিজের অজান্তেই কতটা সাহস জুগিয়ে গেল ভূমিকে! হোটেলের বেয়ারার এই সামান্য চাকরির আয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে বাবুরাম... মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করবে... তার লড়াইয়ের কাছে ভূমির এই স্ট্রাগল তো কিছুই নয়! নিজের ভেতরটা গুছিয়ে নিচ্ছিল ভূমি। স্নিগ্ধ মুখে ওর মেয়ের ছবিটা ফিরিয়ে দিল বাবুরামকে, একটা মমতাভরা চুমু খেয়ে সলজ্জ মুখে পার্সে ছবিটা রাখতে যাবে বাবুরাম... এমন সময়... আরেকটা কী যেন কাগজের টুকরোর মত পড়ে গেল ওর পার্স থেকে।

কুড়িয়ে নিল ভূমি। এটাও একটা ফোটো। আগেরটার চেয়ে একটু বড়, প্রায় পোস্টকার্ড সাইজের। বেশ পুরোনো সাদা কালো ছবি, মলিন হলদেটে রঙ... ন্যাতানো কোণ গুলোও ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। তার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে সম্ভবত কোনো এক স্টুডিওর বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে তিনটে বাচ্চা। একদম বামদিকের জন সবচেয়ে বড়, দশ-বারো বছরের হবে... মাঝে কুঁকড়ে বসে বোধহয় সবচেয়ে ছোটো বছর তিনেকের বাচ্চাটা... আর তার পাশে ছ-সাত বছরের আরেকজন। শীতকালে তোলা বোধহয়, সব্বার গায়ে মোটা সোয়েটার, মাঙ্কি টুপি, পায়ে হাঁটু অব্দি মোজা।

—“এরা কারা?” কৌতূহলী গলায় বলে উঠল ভূমি। উজ্জ্বল প্রাণচঞ্চল বাবুরামের মুখটা যে হঠাৎ বিষণ্ণতার চাদরে ঢেকে যেতে শুরু করেছে, নজর এড়িয়ে গেল তার। “উও,” শুকনো গলায় থেমে থেমে বলল বাবুরাম, “হাম... ভাইলোগ...”

—“হুম্... এই তো তোমাকে চেনা যাচ্ছে, ডানদিকে... মাঝে নিশ্চয়ই তোমার ভাই? আর বামদিকের জন কে?” উৎসাহিত স্বরে বলল ভূমি।

কোনো উত্তর নেই। অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল, মাথা নীচু করে বসে আছে বাবুরাম, পার্সে ফোটোটা ঢুকিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “হামারে বড়ে ভাইয়া।”

—“ও তাই? তো সবার কথা বললে, এনার কথা বললে না তো?”

—“উও আব ইস দুনিয়ামে নেহি রহে। আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের মত,” বুজে আসা গলায় কোনোমতে বলল বাবুরাম!

স্তব্ধ হয়ে গেল ভূমি। না জেনেই বাবুরামের কষ্টের জায়গায় খোঁচা দিয়ে ফেলেছে! অপ্রস্তুত বিষণ্ণ গলায় বলে উঠল, “ওহ... আই অ্যাম সরি... খুব খারাপ লাগলো...”

—“ঠিক হ্যায় দিদি,” জলভরা চোখ তুলে তাকাল বাবুরাম, চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে আসা ফোঁটাটা মুছে নিয়ে ভারী গলায় বলল, “নসিব থা উসকা। খুব ডানপিটে ছিল তো, দোস্তলোগদের সঙ্গে বাজি লাগিয়ে গেছিল ওই গুঙ্গা গাঁওতে... আর ফিরল না...”

—“গুঙ্গা গাঁও!” বলব না বলব না করেও ভূমির ভেতরের কৌতূহলী মনটা বলেই ফেলল।

একটু যেন শিউরে উঠল বাবুরাম। তারপর ভয়পাওয়া গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল, “সেটা একটা আজব গ্রাম দিদি! তোমরা তো রিপোর্টার, কত জায়গায় যাও... কখনো দেখেছ একটা গ্রামের সব লোক বোবা? একজনও কথা বলেনা ওই গ্রামে, বাচ্চা থেকে বুড়ো... সব্বাই বোবা! কখনো বেরোয়ও না ওরা গ্রাম ছেড়ে! কেমন যেন ভয় ভয় লাগে ওই গ্রামটা দেখলে...”

ভুরুটা ভীষণ ভাবে কুঁচকে গেল ভূমির। এটা কী করে হয়! একটা গ্রামের সবাই বোবা? কোনো ভয়ঙ্কর রোগের জন্য? কিন্তু তাহলে তো নতুন প্রজন্মরা যারা জন্মাবে তাদের তো বোবা হওয়ার কথা নয়! নাকি কোনো অজানা জিনবাহিত রোগ এটা?

—“আর ওদের চোখ! কেমন যেন একটা... দেখলে কেমন গা শিরশির করে...” চোখ বড় বড় করে বলে চলেছে বাবুরাম।

—“আচ্ছা, কবে থেকে আছে ওরা? মানে কবে থেকে ওদের এমন দেখছো তোমরা?” কী যেন ভাবছে ভূমি।

—“সে তো অনেক দিন থেকে... আমরা তো ছোটো থেকেই দেখছি,” মাথা দুলিয়ে বলল বাবুরাম, “শুনেছি পিতাজিদের ছোটোবেলায়ও ছিল এই গ্রাম... কে জানে কতদিন... আগেও নাকি একজন গেছিল ওদের গ্রামে, আর ফেরেনি...” বিষণ্ণ গলায় বলল।

এ কোন গ্রাম! যেখানে মানুষ গেলে আর ফেরে না? মানুষ গুলোকে কি মেরে ফেলা হয়? কিন্তু কী এমন আছে ওই গ্রামে যার জন্য এত গোপনীয়তা? কোনো অন্ধবিশ্বাসের কুপ্রথা চলে কি? ওরা নিজেরাও কেন বেরোয় না গ্রাম ছেড়ে? হুড়মুড়িয়ে ধেয়ে আসা একের পর এক প্রশ্নের জোয়ারে হাবুডুবু খাচ্ছিল ভূমির ভেতরের অনুসন্ধিৎসু মনটা! কিছু তো একটা আছেই! যদি সত্যিই তেমন কোনো রহস্য থাকে... আর যদি সেটাকে সমাধান করতে পারে... বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে টানটান হয়ে বসল ভূমি! ঠিক এইরকম একটা কিছুই তো চেয়েছিল সে! এইরকম একটা অ্যাড্রিনালিন ছোটানো খবর... একটা রোমাঞ্চকর অভিযান! মনে মনে নিজের আগামী প্ল্যানটা সাজিয়ে ফেলল... এই চান্স মিস করা যায় না! বাবুরামকে পটিয়ে পাটিয়ে যেতেই হবে ওই গ্রামে! আর নেহাতই যদি তেমন কিছু না পায়, তবে নেট ঘেঁটে বিহার বোর্ডের কেসটার রিপোর্ট লেখা আর কী এমন ব্যাপার!

পাঁচ

—“হ্যাঁ বাবা! মনে করে প্রেশারের ওষুধটা খেও, আর মাকে টেনশান না করতে বোলো! রাখছি এখন... আবার পরে ফোন করব!” ফোনটা রেখে গাড়ীর সীটের পেছনটায় মাথাটা এলিয়ে দিল ভূমি। গাড়ী সীতামারি থেকে বেরোচ্ছে। এখান থেকে প্রায় ঘন্টাচারেকের কাছাকাছি লাগবে জনকপুর, নেপালের ধানুসা ডিস্ট্রিক্টের জেলাসদর, সেখান থেকে আরো প্রায় তিরিশ কিলোমিটার মতো গেলে বাবুরামের গ্রাম। মাঝে অবশ্য বর্ডার পড়বে। কাল বাবুরামের কাছ থেকে তাদের গ্রামের কথা শুনতে শুনতে ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ভূগোল বইয়ে পড়া নেপাল দেশটার বর্ণনা! তাদের বেড়াতে যাওয়া বলতে ওই বাঙালীর দী-পু-দা, মানে দীঘা, পুরী আর দার্জিলিং এর বেশী হয়ে ওঠেনি কখনো। এই প্রথম বার তার বিদেশ যাওয়া! হেসে ফেলল ভূমি। বিদেশই বটে! যদিও প্রথম বারটা যে এভাবে সুযোগ আসবে সে ব্যাপারে একদমই তৈরী ছিল না সে! সিনেমায়-গল্পে-ইন্টারনেটে দেখা কাঠমান্ডু শহর, সেখানকার দরবার স্ক্যোয়ার, পশুপতিনাথ মন্দির... কতবার এই গুলো দেখে দেখে মনে মনেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছে! নিজের চাকরির টাকা জমিয়ে বাবা-মাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে, এমনটা ভেবে ভেবে কত প্ল্যানিংই না করেছে! পাহাড় ওকে বরাবর টানে, সমুদ্রের চেয়ে বেশী। আর নেপাল তো তার বেড়ানোর লিস্টে বেশ ওপরের দিকেই আছে! গতবছর ভূমিকম্পটার ফলে অবশ্য ভয়ানক ক্ষতি হয়েছে দেশটার... ধ্বংস হয়ে গেছে বহু প্রাচীন সব ঐতিহাসিক সৌধ, দরবার স্ক্যোয়ারটা তো আর নেই বললেই চলে! তবুও... যেটুকুনি নিজের চোখে ছুঁয়ে দেখা যায়! মনে মনে নিজেকে ধমক দিল ভূমি, কাজের জায়গায় এসে সে শুধু বেড়ানোর কথাই ভেবে চলেছে! কাঠমান্ডু তার যাওয়ার কোনো চান্সই নেই এবার! আর দুদিন পরে পাটনা থেকে তার রিটার্ন টিকিট কাটা আছে, তার মধ্যেই বাবুরামের বলা ওই গ্রামটার ব্যাপারে পুরো ডিটেইলসে খোঁজখবর করে নিতে হবে। দরকার হলে অবশ্য ওই ট্রেনে ফিরবে না ও... রহস্যটা সমাধান করে তবেই...

মোবাইলটা একবার দেখল ভূমি। জনকপুর দিয়ে একটা সার্চ মারা যাক। বাবুরামদের গ্রামটার নাম বিঙ্গাই, সেই রহস্যময় গ্রামটা অবশ্য ওখান থেকে আরো কিছুটা ওপরে, পাহাড়ের ঢালে। সকালে বাবার বলা কথাটা বাজছিল কানে... জনকপুর শুনেই বাবা বলেছিল, “তুই তাহলে তোর দেশে চললি রে মানা!” অবাক হয়ে বলেছিল সে, “আমার দেশ! মানে!” বাবার হালকা হাসি ভেসে এসেছিল, “জনকপুর মানে তো জনকরাজার দেশ! মানে যাকে পুরানে বলে মিথিলা! আর জনক রাজার মেয়ে কে ছিল সেটা তো আর বলে দিতে হবে না?”

—“সীতা!” বিড়বিড় করেছিল ভূমি। ছোটোবেলায় যখন বাবাকে নানারকম প্রশ্ন করে করে পাগল করে দিত, তখন কতবার বাবা শুনিয়েছে এই গল্পটা! ভূমিসুতা মানে ধরণীর কন্যা, ভূমি হতে জন্ম যার। সেকারণেই লাঙলের ফলায় মাটির কোল থেকে উঠে আসা সীতারও আরেক নাম! আশ্চর্য্য! কী অদ্ভুত কোইন্সিডেন্স!

ছয়

—“ওরা কখনো গ্রামের বাইরে বেরোয় না? তাহলে খাবার, জল, জামাকাপড় এইসব দরকারী জিনিস পায় কোথা থেকে?

—“সে তো জানি না দিদি! তবে ওরা চাষ করে... ঘাসের মতো কী একটা জিনিষ চাষ করে! আর গাঁয়ের মধ্যেই মাঝে মাঝে গাছ কাটে... ছোটো ছোটো গাছ...!"

—“এক মিনিট এক মিনিট!” উঠে দাঁড়ালো ভূমি। বাবুরামদের বাড়ির সামনের দাওয়াটায় বসেছে ওরা সবাই। ওরা মানে বাবুরাম আর ওর ভাই সুবাস। সামনে ধুলোর ওপর পড়ে থাকা খড়ের কুচি নিয়ে খেলা করছে বাবুরামের বছর দেড়েকের মেয়ে কুসমা। হিন্দিতেই চলছে কথোপকথন... এতক্ষণ কথা বলছিল বাবুরামের ভাই সুবাস, ভূমির কথায় জিজ্ঞাসু চোখে চাইল।

—“ওরা গ্রামের বাইরে বেরোয় না, তাহলে তোমরা জানলে কী করে যে ওরা সবাই বোবা?”

একটু হাসল সুবাস। তারপর শান্ত চোখে বলল, “ওদের গ্রামের পাশেই একটা নীচু টিলা আছে জঙ্গলের গা ঘেঁষে, ওখান থেকে গ্রামের ভেতর অব্দি পরিষ্কার দেখা যায়! কয়েক ধাপ নামলে লোক গুলোকেও দেখা যায়। আমাদের ছেলেরা চুপিচুপি অনেকবার গেছে ওদের দেখতে। সবাই চুপচাপ কাজ করে, নিজেদের মধ্যে কখনো কথাবার্তা বলে না... শুধু একে অন্যের দিকে তাকায়, আর তাতেই যেন সব বুঝে যায়... একটা আওয়াজ ও শোনা যায় না ওখানে... কোনো পশু পাখির ডাক অব্দি না...”, একটু থামল সুবাস। তারপর বিষণ্ণ গলায় বলল, "গ্রামের চত্বরে পা রাখলেই যেন কীভাবে টের পেয়ে যায় ওরা... দল বেঁধে চলে আসে। মাঝে মধ্যে কয়েকজন সাহস দেখাতে একটু নেমেছিল টিলা থেকে, ওদের দেখেই দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। আর বড়ে ভাইয়া...”

মুখটা থমথমে হয়ে গেল সকলের। বাতাস যেন সীসের মত ভারী, চারদিক অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছে। দু হাতে ধুলো মুঠি করে ছড়াচ্ছিল ছোট্ট কুসমা, হঠাৎ করে সবাই চুপ করে যাওয়ায় অবাক মুখে বু বু করে এক দুর্বোধ্য ভাষায় প্রতিবাদ জানাল। “আমরা কিছু বুঝতেই পারলাম না,” কুসমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে নীরবতা ভাঙল বাবুরাম, “তখনো শাদি হয়নি আমার। মালিকের থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছিলাম। রাতে মায়ের কাছে ঘুমিয়েছি তিন ভাই, সকালে উঠে দেখি বড়ে ভাইয়ার বিছানাটা ফাঁকা! তাড়াতাড়ি খুঁজতে বেরোলাম, ওর দোস্তদের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম ও নাকি শরত লাগিয়েছিল ওই গাঁয়ের ভেতর যে মন্দিরটা আছে, ওখান থেকে বনগুলঞ্চের ফুল ছিঁড়ে নিয়ে আসবে। সেই মতো একদম ভোর ভোর ও আর ওর দুজন বন্ধু মিলে গেছিল... ভাইয়া গ্রামে ঢুকে যেতে বাকিরা ফিরে চলে এসেছে।”

—“তারপর? তোমরা আর খোঁজোনি তোমাদের দাদাকে?” বিহ্বল চোখে বলল ভূমি।

—“তন্নতন্ন করে খুঁজেছি সব জায়গা, শুধু ওই গ্রামটা ছাড়া... কোত্থাও মেলেনি! আর ফিরল না ভাইয়া!” ফুঁপিয়ে উঠল বাবুরাম, “বডিটাও অন্তত যদি পেতাম!”

অনেকগুলো চিন্তার জাল যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। শুধু ওদের গ্রামে ঢোকার জন্য একটা মানুষ কে মেরে ফেললো? নাকি অন্য কোনো কাজে লাগানো হয়েছে বাবুরামের দাদাকে? হয়ত কোনো বেআইনি ব্যবসা চলছে ওখানে... হিউম্যান ট্রাফিকিং? কিংবা হয়ত কোনো টেররিস্ট গ্রুপ বেস বানাচ্ছে? সব কিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়েই কি লোকগুলোকে বোবা বানিয়ে রাখা হয়েছে? চোয়ালটা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠল ভূমির।

—“ওরা জিন আছে দিদি! কোনো ইনসানের অমন চোখ হয়না!", বিড়বিড় করল সুবাস, "চোখের পাতা পড়ে না ওদের... কেমন অদ্ভুত বোবা দৃষ্টি! হাতে অস্ত্র-শস্ত্র কিচ্ছু নেই, শান্ত ভাবে ধীরে ধীরে দল বেঁধে এগিয়ে আসে... দেখলেই মাথা ঝিমঝিম করে, ভয় লাগে! এখন তো আর কেউ টিলার ওখানে যায়ও না ভয়ে!"

চমকে উঠল ভূমি! হিপনোটাইজড্? মাথার ভেতরটা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে... একটা গোটা গ্রামের লোক, তা সে কম করে যদি জনা বিশেকও হয়... তাদের বরাবরের মতো হিপনোটাইজড্ করে রাখা হচ্ছে? কী ভাবে? এসব অলৌকিক ভূত-প্রেতের গল্প কখনো বিশ্বাস করে না সে, ছোটোবেলা থেকেই যুক্তিবাদী মন তার। ঠোঁটটা কামড়ে ধরল... সম্ভবত কোনো ড্রাগস ইনজেক্ট করা হয়। ইয়েস! ওটাই হবে! হয়ত এমন কোনো ড্রাগস যেটা মানুষের স্বরযন্ত্র বিকল করে দেয়, একই সঙ্গে বাস্তব বোধ বুদ্ধি চলে গিয়ে হ্যালুসিনেটও করে রাখে... তাই ওরকম চোখের দৃষ্টি! এমনিতেই তিব্বত—নেপালের বড় অংশ জুড়ে খুব গোপনে ড্রাগস আর আর্মসের চোরাচালান চলতেই থাকে... নিশ্চয়ই বিরাট বড় কোনো গ্যাং কাজ করছে এর পেছনে! উত্তেজিত হয়ে হাতের তালুতে ঘুঁষি মারলো ভূমি! এই রহস্যটা ভেদ করবেই সে! দরকার হলে পুলিশের সাহায্য নেবে! আগে একবার চুপিচুপি ঠেকটা দেখে আসা দরকার!

—“কোথায় সেই মন্দিরটা? যেখানে থেকে তোমার দাদা ফুল তুলে আনবে বলেছিল?” তীক্ষ্ণ চোখে বলে উঠল ভূমি, “পুজো-আচ্চাও করে নাকি ওই জিনেরা?" বেআইনি কাজকারবার করে যারা, তাদের ধর্মের ভণ্ডামি একটু বেশীই হয় অবশ্য... মনে মনে ভাবল...

—“গাঁয়ের একদম শেষপ্রান্তে আছে মন্দিরটা... কোন ঠাকুর সে তো জানি না দিদি,” ভয় পাওয়া গলায় বলল বাবুরাম, “তবে ওরা খুব পবিত্র মানে জায়গাটাকে... দূর থেকেও হাবেভাবে বোঝা যায়! সবাই ওটার সামনে গোল হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করে, পরিষ্কার রাখে জায়গাটা, নানা রকম আওয়াজও হয় ভেতর থেকে... মনে হয় মন্দিরের ভেতর মন্ত্র পড়ে পূজা-পাঠ হয়!"

মনে মনে নিজেকে তৈরী করে নিল ভূমি। ওই মন্দিরটাই তাহলে আসল জায়গা, যেখানে কোনো বেআইনি কারবার চলে... মোটামুটি শিওর ও। গোটা গ্রামে কেউ কথা বলে না, পশু পাখির ডাকও নেই, সেখানে মন্দিরটা থেকে কী করে আওয়াজ বেরোয় সেটা সম্ভবত কখনো ভেবে দেখেনি বাবুরামরা! দেখতেই হবে মন্দিরটা... পারলে কিছু ফোটো তুলে নিতে হবে, কপাল ভালো থাকলে যদি ভিডিও রেকর্ড করতে পারে তো কথাই নেই! তারপর পুলিশের কাছে স্ট্রেট চলে যাবে এভিডেন্স নিয়ে! উফফ্, বড় বড় পেপারে ওর ছবি সহ খবর ছাপা হচ্ছে... ন্যাশনাল চ্যানেলে ওর সাক্ষাৎকার... নেপালের আন্তর্জাতিক ড্রাগ চোরাচালান চক্রের জাল ফাঁস করলেন বাঙালী রিপোর্টার ভূমিসুতা ভট্টাচার্য্য... ভাবতেই যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ভূমির! ধারালো গলায় বলে উঠল বাবুরামের দিকে তাকিয়ে, “ওই মন্দিরের কাছাকাছি যাওয়ার কোনো শর্টকার্ট রাস্তা আছে?”

চমকে তাকালো ওরা! আতঙ্কিত মুখে হাত নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বাবুরাম, এমন সময় দরজার কাছ থেকে একটা গম্ভীর খসখসে গলা ভেসে এলো... “বাবুরাম!”

ঘুরে তাকালো সবাই। দরজার কোণা ধরে সামান্য ঝুঁকে রুগ্ন অশক্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বৃদ্ধা। পরনের ঢোলা নেপালী জোব্বা ছাপিয়ে ফুটে উঠছে তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব... আর মাথায় বাঁধা গামছার নীচে জ্বলজ্বল করছে বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখ!

সাত
চণ্ডমুণ্ডবধে দেবী রক্তবীজবিনাশিনী

নিশুম্ভশুম্ভমথিনী মধুকৈটভঘাতিনী

বিষ্ণুভক্তিপ্রদা দুর্গা সুখদা মোক্ষদা সদা

আদ্যাস্তবমিমং পুণ্যং যঃ পঠেতঃ সততং নরঃ

সর্ব্বজ্বরভয়ং ন স্যাতঃ সর্ব্বব্যাধিবিনাশনমঃ

কোটিতীর্থফলং তস্য লভতে নাত্র সংশয়ঃ

গম্ভীর নির্ঘোষ মন্ত্রোচ্চারণে মন্দ্রিত হচ্ছে কক্ষ। পাষাণ প্রতিমার সম্মুখে পদ্মাসনে উপবিষ্ট বলিষ্ঠ ঋজু দেহটি পূর্ণচিত্তে মাতৃস্তবে মগ্ন। পূজা প্রায় অন্তিম পর্বে, দক্ষিণ হস্তে মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মধ্যে উপবীতখানি ধরে কপালে ঠেকিয়ে দেবীকে আরেকবার স্মরণ করলেন মহারাজ। তারপর সাষ্টাঙ্গে আভূমি প্রণিপাত নিবেদন করলেন মাতৃমূর্তিকে। ধুলাবালিতে লুণ্ঠিত তাঁর পট্টবস্ত্র। থাক, মায়ের কাছে সন্তান অর্ঘ্য নিবেদন করেছে, তাতে কি কখনো মালিন্য স্পর্শ করতে পারে?

রাত্রির চতুর্থ প্রহর। আর কিছু পরেই উপস্হিত হবে পবিত্র ব্রাক্ষ্ম মুহুর্ত। রাত্রির কালিমা মুছিয়ে দিয়ে যখন নবীন দিনমণি পূর্বাকাশে তার রক্তিম রাগে শুভসূচনা করবে এক নতুন দিনের, তখন তাঁর বাহিনী নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথম আঘাতটা হানবেন মহারাজ। জয় তো শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র! স্বয়ং আদ্যাশক্তি যাঁর সহায়, তাঁকে পরাস্ত করবে কে?

শেষবারের মত সজল ভক্তিভরা নয়নে পরম মমতাময়ী মাতৃমূর্তিকে নিরীক্ষণ করে জোড় হাত কপালে ঠেকালেন মহারাজ, তারপর পা বাড়ালেন জঙ্গলের পথে। এই মন্দিরগৃহ থেকে গ্রামটির দূরত্ব বেশী নয়, দ্রুত চললে উষালগ্নের পূর্বেই উপস্থিত হবেন। গত রাত্রিতে গন্তব্যে পৌঁছানো মাত্র বিস্মিতই হয়েছিলেন মহারাজ! এতখানি পার্বত্য পথে আরোহণ করে শেষে শত্রুপুরীতে পৌঁছে দেখলেন সে গ্রাম জনমানবহীন! না, পথ বিভ্রান্ত হননি তিনি... চরের বর্ণনা অনুযায়ী পর্বতের কোলে সজ্জিত রয়েছে কুটির গুলি, ছোটো অগ্নিশলাকা আলোকিত করে রেখেছে দ্বারপ্রান্ত, কিন্তু ভেতরে অস্তিত্ব নেই কোনো মনুষ্যের! তাঁর নির্দেশে কুটিরগুলিতে প্রবেশ করে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করে সেনা দল, শূন্য হস্তেই ফেরে তারা! তবে কি তাঁর আসার সংবাদ কোনোভাবে পৌঁছেছে শত্রুদের কাছে? আর তাই তারা আত্মগোপন করেছে? সুদীর্ঘ বন্ধুর পার্বত্য পথে আসার ফলে অশ্বগুলি শ্রান্ত, নুয়ে পড়েছিল তাদের শরীর... ক্লান্তির ছায়া পড়েছিল সৈন্যদের মুখেও... সুতরাং রাত্রিবাসের জন্য সেখানেই শিবির স্থাপন করার নির্দেশ দেন তিনি। বিশ্রাম অন্তে প্রহরায় নিযুক্ত হবে একদল, তখন প্রহরারত সৈন্যরা ছাড়পত্র পাবে বিশ্রামের... এই ব্যবস্থাই হয়। যদি রাত্রির ঘন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করে শত্রুদল! সেনাদের ব্যবস্থা করে নিজের শিবিরে বিশ্রামের প্রয়াস করলেও নিদ্রাদেবীর আগমনের কোনো সঙ্কেত ছিল না বহুক্ষণ... অবশেষে অবসন্ন দেহে কখন যেন তন্দ্রার ঘোর লেগেছিল দুই চক্ষুতে। সেই তন্দ্রার মধ্যেই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন সেই দৈবস্বপ্ন!

ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের গভীর রাত্রি। গহীন অরণ্যের পথে তিনি চলেছেন একাকী। হঠাৎ দূর থেকে অন্ধকার ভেদ করে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে থাকল এক ভাসমান আলোকবর্তিকা! ক্ষুদ্র থেকে ধীরে ধীরে বৃহৎ আকার ধারণ করতে লাগল... উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার দীপ্তি... অবশেষে তাঁর সম্মুখে এসে সেই উদ্ভাসিত কিরণ থেকে প্রকটিত হলেন স্বয়ং মা মহামায়া! এ যে সেই ভগ্ন মন্দিরগৃহে অধিষ্ঠিত মাতৃমূর্তি! দুই হস্ত প্রসারিত করে যেন স্নেহবিজড়িত হাস্যে আহ্বান করছেন মা তাঁকে! নিমেষে কেটে গেছিল তন্দ্রার ঘোর। বিহ্বল চিত্তে উঠে বসেছিলেন মহারাজ, তবে কি মা তাঁর পূজা চান? শত্রুনিধনের পূর্বে আদ্যাশক্তির এই আশীর্বাদ যে বড় অমূল্য তাঁর কাছেও! মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, সেই ভগ্ন পরিত্যক্ত মন্দিরগৃহে মা অপেক্ষা করছেন তাঁর জন্য... তিনি এখনি যাবেন মায়ের পায়ে অর্ঘ্য নিবেদন করতে! ঘুমন্ত প্রহরীদের অজ্ঞাতসারেই যাত্রা করেন তিনি এবং অরণ্যের পথটুকু অতিক্রম করে এসে পৌঁছোন এই মন্দির প্রাঙ্গনে।

পূর্ব দিগন্তে নিশীথের তমসাময় আবরণের অন্তরাল থেকে উদ্ভাসিত হচ্ছে সদ্যোজাত রবির এক-দুটি কিরণ। গাছে গাছে পক্ষীকুল নিদ্রাশেষে নতুন দিনের কর্মচঞ্চলতায় ব্যস্ত। বনানীর পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলেন মহারাজ। ওই তো, অস্পষ্ট দৃশ্যমানতায় দেখা যাচ্ছে শিবিরগুলি... সারা রাত্রি আলোক বিকিরণের শেষে মশালগুলি প্রায় নিভু নিভু। তাঁকে শিবিরে অনুপস্থিত দেখে এতক্ষণে সৈন্যদল ও অমাত্যবর্গের মধ্যে নিশ্চয়ই আলোড়নের সঞ্চার হয়েছে! পরবর্তী কর্মপন্থা ও রণকৌশল স্থির করতে করতে গ্রাম প্রাঙ্গনে এসে প্রবল ভাবে বিস্মিত হয়ে পড়লেন মহারাজ! একি! শিবিরের একপাশে একটি বৃহৎ বৃক্ষতলে একত্রে আবদ্ধকৃত ছিল অশ্বগুলি, তার একটিও সেখানে বর্তমান নেই! মুহূর্তের মধ্যে প্রখর হয়ে উঠল তাঁর ষষ্ঠেন্দ্রিয়, তবে কি তাঁর অবর্তমানে আঘাত হেনেছে ওই বিজাতীয় শত্রুদল? কিন্তু আঘাত প্রত্যাঘাতের কোনো চিহ্নই তো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না! আর তাঁর বাহিনী? তাঁর যুদ্ধ পারদর্শী দক্ষ সৈন্যেরা কোথায়? তারা কি ব্যর্থ হয়েছে এই শত্রুর আক্রমণের যোগ্য জবাব দিতে? অসংখ্য প্রশ্নবাণে জর্জরিত তাঁর হৃদয়কে শান্ত করে শরীরের প্রতিটি পেশীকে প্রস্তুত করলেন তিনি, দুর্ধর্ষ দুর্বিনীতের সঙ্গে যুদ্ধে স্নায়ু ও মস্তিষ্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখাই একজন প্রকৃত বীরের প্রথম কর্তব্য। নিজের বিশ্রাম কক্ষ থেকে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে অতি সতর্ক পদে সৈন্য শিবিরে একে একে প্রবেশ করতে থাকলেন তিনি! কিন্তু সেখানকার দৃশ্য তাঁর সমস্ত অস্তিত্বকে আন্দোলিত করে যেন এক অতল হিমশৈলে নিমজ্জ করল তাঁকে! প্রতিটি শিবির শূন্য ! শিবিরের মধ্যে উপস্থিত সমস্ত সামগ্রী যথাযথ স্থানে রাখা, কোনোরূপ অশান্তির ঝঞ্ঝার চিহ্ন নেই কোথাও... যেন সুসজ্জিত পরিপাটি শয়নকক্ষ ত্যাগ করে প্রাতঃভ্রমণে গিয়েছে তাঁর একশত সেনার দল! এ কীরূপে সম্ভব! একে একে সমস্ত শিবির পরিদর্শন করে গ্রাম মধ্যস্থ কুটির গুলির দিকে উদ্যত হলেন তিনি, ততক্ষণে আতঙ্কের করাল ছায়া তাঁর মতো প্রবল পরাক্রমী বীরের অন্তঃস্থলও গ্রাস করতে আরম্ভ করেছে! তবে কি সেই গুপ্তচরেদের অনুমানই সঠিক? কোনো আশ্চর্য্য জাদুশক্তির অধিকারী এই জাতি? তা নাহলে শতাধিক মনুষ্য ও প্রাণীর এই বিপুল বাহিনী কীভাবে মন্ত্রবলে অদৃশ্য হতে পারে! নিমেষেই ধূলিসাৎ হল তাঁর সকল আশা, যখন প্রতিটি গৃহই গত রাত্রির মতো জনমনুষ্যহীন হয়ে দেখা দিল! ধীরে ধীরে যেন স্নায়ুর ওপর থেকে সব নিয়ন্ত্রণ সরে যেতে লাগল তাঁর, অস্থির পদে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে সমগ্র গ্রাম অনুসন্ধান চালিয়ে এসে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি! এ যেন এক মৃত্যুপুরী! আর সেই মৃত্যুপুরীর মধ্যে একমাত্র জীবন্ত সত্তা শুধুমাত্র তিনি! সারা জীবন ভয়ঙ্কর সব দস্যুদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের নিজের বশে এনেছেন তিনি, কিন্তু অদৃশ্য এই শত্রুকে কীভাবে পরাস্ত করবেন! অাদিম আতঙ্কে যেন কম্পিত হতে থাকল শরীর, পিপাসায় যেন চৌচির হয়ে যাচ্ছে তাঁর কণ্ঠনালী! শরীর মনের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে মস্তিষ্ককে সচল রাখার প্রয়াস করলেন, এখনি ত্যাগ করতে হবে এই স্থান! হয়ত তাঁর অনুমান ভুল, সৈন্যরা আত্মগোপন করে আছে কাছেই কোথাও... সন্ধান করতে হবে তাদের! নবীন সূর্য্যরশ্মিতে ঝিকিয়ে উঠল তাঁর তরবারি, দুই হস্তে সেটিকে করায়ত্ত করে উন্মাদের মতো ছুটে চললেন মহারাজ!

দিবস অতিবাহিত হল। সুউচ্চ পর্বতমালার আড়ালে শায়িত হলেন সূর্য্যদেব, সায়াহ্নকালীন ছায়াচ্ছন্নতা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে লাগল সমগ্র তরাইকে। তার মধ্যেই তরবারি হস্তে অরণ্যের পথে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে উন্মাদের ন্যায় চিৎকার করে করে প্রবল বেগে ধাবিত হচ্ছিল শতচ্ছিন্ন পোশাক পরিহিত একা এক ব্যক্তি! চেতনার শেষপ্রান্তে এসে একসময় বিকারগ্রস্ত আরক্ত নয়নে ধূলিধূসরিত দেহে বনানীর কোলে লুটিয়ে পড়লেন দোর্দন্ডপ্রতাপ পরাক্রমশালী বীর মহারাজ পুরুষোত্তম ঠাকুর!

নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিল ভূমি। বাইরে একটা গরু ডেকে উঠল হঠাৎ। বেলা গড়াচ্ছে, জানলা গলে মেঝের ওপর পড়া রোদটা সরতে সরতে চেয়ারে বসা ভূমির পায়ের পাতা ছুঁয়েছে। চোখ বন্ধ করে খাটের ওপর বসেছিলেন বৃদ্ধা, আস্তে আস্তে চোখ খুললেন। ভূমির পায়ে পড়া রোদটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভারী গলায় ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলে উঠলেন, “জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এক বণিকদল খুঁজে পায় রাজাকে। মাটি-কাদা মাখা অবস্থায় রাজাকে চেনা সম্ভব ছিল না। শেষে রাজার শরীরে আঁকা উল্কি, যা রাজ বংশের প্রতীক, তাই দেখে রাজাকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনে দ্বারভাঙার প্রাসাদে।”

আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়েছি ভূমি। কাঁপা কাঁপা গলায় ওপরের দিকে মুখ তুলে কী যেন বিড়বিড় করলেন বাবুরামের মা, তারপর জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “মা মহামায়ার কৃপায় সে যাত্রা বেঁচে গেছিলেন পুরুষোত্তম ঠাকুর। ওই সৈন্যদের কী অবস্থা হয়েছিল, কেউ জানেনা। পুজোর জন্য মন্দিরে না গেলে হয়ত তাঁরও ওরকম অবস্থাই হত! ফিরে আসার পর চিকিৎসার ফলে কিছুটা সুস্থ হয়েছিলেন, তখনি লিখে রাখেন এই সব ঘটনা। পরে অবশ্য প্রতি রাতে একই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে আবার মানসিক ব্যারাম দেখা দেয় তাঁর, পাগল হয়ে যান। বেশীদিন বাঁচেননি তারপর। এই কাহিনী আমাদের পারিবারিক সূত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে আসছে। পুরুষোত্তম ঠাকুরের কিছু পুরোনো দস্তাবেজ ছিল আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে, সেখানেও আমি এই অদ্ভুত ঘটনার বর্ণনা পেয়েছি।”

—“মা জী!” দরজার কাছ থেকে রিনরিনে স্বর ভেসে এল। কুসমাকে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বাবুরামের বৌ। মিষ্টি হেসে বলল, “খানা তৈয়ার হ্যায়! দিদি আপ ভি জলদিসে আ যাইয়ে!”

মাথা নাড়লেন বাবুরামের মা। উঠতে উঠতে বললেন, “আমার বিশ্বাস, ওটা ছিল সেই গুঙ্গা গাঁও। দস্তাবেজে লেখা ভৌগোলিক অবস্থান পড়লে তাই মনে হয়। সেই পুরোনো যুগ থেকেই আছে সেই গ্রাম! এ সেই গ্রাম যেখানে গেলে ফিরে আসে না মানুষ... ওই জিনেরা জাদু করে মেরে ফেলে জ্যান্ত মানুষদের... আর তারপর তাদের শরীরটাকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ধুলোর মতো মিশিয়ে দেয় বাতাসে... চিহ্ন থাকে না... আর কোথাও কোনো চিহ্ন থাকে না তাদের...” শেষের দিকের কথা গুলো যেন প্রলাপের মতো হাওয়ায় মিশে ধাক্কা খেতে লাগল ঘরের দেওয়াল থেকে দেওয়ালে। দরজার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে গেলেন বৃদ্ধা। নুয়ে পড়া শরীরটা ঘুরল ভূমির দিকে, তারপর কাছে এসে খসখসে চামড়ার শিরাওঠা হাতটা রাখলেন ওর মাথার ওপর। কাঁপা কাঁপা করুণ কান্নাভেজা গলার আর্তি ভেসে এল, “আমার বড় ছেলেকে হারিয়েছি মা! আমাকে পঙ্গু করে আমার কোল খালি করে দিয়ে চলে গেছে সে... মরে বেঁচে আছি এখন। ওই জিনেরা শেষ করে দিয়েছে তাকে! শেষবারের মতোও একবার চোখের দেখা দেখতে পাইনি আমার ছেলেটাকে! চাই না আমার মতো দুর্ভাগ্য আর কারো হোক, চাই না আর কোনো বাবা-মায়ের কোল খালি হয়ে যাক! তুমি যেও না মা, যেও না ওই অভিশপ্ত জায়গায়... বুড়ির কথাটা একটু শোনো...”

মাথা তুলে তাকাল ভূমি। এক নিবিড় আকুতি নিয়ে পরম মমতায় তার দিকে তখন তাকিয়ে আছে এক সন্তানহারা মায়ের ছলছলে দুই চোখ!

আট

পাইনের বন থেকে একটা ঠান্ডা বাতাস আসছে। ঘড়ি বলছে দুটো বাজে। পাহাড়ী এলাকায় দুপুরটা যেন খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায়... সন্ধ্যেটা নামে ঝপ করে। এর আগে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েও দেখেছে ভূমি। এই যে এখনও গনগনে আঁচে তেজ জ্বলছে সূর্য্যটা, ঘন্টাখানেক যেতে না যেতেই আস্তে আস্তে তেজ হারিয়ে পশ্চিম দিগন্তের দিকে ঢলতে শুরু করবে।

জানালা দিয়ে দূরের পাহাড় গুলোর দিকে তাকিয়েছিল ভূমি। সকাল থেকে বারবার নানারকম প্রশ্ন সাজিয়েছে মনে মনে, নিজেই তার উত্তর গুলো খুঁজে এনেছে... আবার বাতিল করেছে। এ যেন এক অসহ্য কাটাকুটি খেলা! বাবুরামের মায়ের মুখে রাজা পুরুষোত্তম ঠাকুরের গল্পটা যদি সত্যিও হয়, তাহলেও গল্পের সেই গ্রামটাই যে এখনকার এই গুঙ্গা গাঁও, সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় কি? আর এই হঠাৎ করে এতগুলো মানুষের একসঙ্গে জাস্ট উবে যাওয়া... এটাই বা কোন লজিকে ব্যাখ্যা করা যায়? ভূত-প্রেত দত্যি-দানো জিন-পরী এসবে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই ভূমির, ওসব ছোটোবেলায় শোনা রূপকথাতেই ভালো লাগতো। আর পুরাণে তো এইসব অভিশাপ-আশীর্বাদ এর অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনার ছড়াছড়ি আছে! সে নারায়ণের কানের ময়লা থেকে মধু-কৈটভ রাক্ষসের জন্মের কাহিনীই হোক, বা স্বামী গৌতম মুনির অভিশাপে অহল্যার পাথর হয়ে যাওয়া... এসব অলৌকিক ঘটনার গল্পকথা তো আছে হামেশাই! কিন্তু আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একটা গ্রামে গিয়ে লোক স্রেফ হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, এটা কি কোনো যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব? শুধু তাই নয়, বাইরে থেকে আসা লোকেরা অদৃশ্য হলেও বহাল তবিয়তে কিন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামবাসীরা! কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকলেও তবে ওই গ্রামবাসীদের কিছু হচ্ছে না কেন?

অধৈর্য্য ভাবে পায়চারী করতে থাকল ভূমি। ভয়! খুব নিপুণ দক্ষতায় ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এই গ্রামের লোকেদের মনে! এই স্বল্পশিক্ষিত সহজ সরল মানুষ গুলোকে ভূত-ভগবানের নাম করে ভয় দেখিয়ে দেওয়া যায় খুব সহজেই, আর এক্ষেত্রে প্রথম পদ্ধতিটাই প্রয়োগ করা হয়েছে! তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু প্রবাদ, চারশো বছর আগের এই রাজা পুরুষোত্তম ঠাকুরের গল্পের মতো কিছু গল্প... যা থেকে দুয়ে দুয়ে চার করে নিয়েছে এখানকার লোকজন। উত্তেজিত হয়ে হাতের তালুতে ঘুঁষি মারল ভূমি! খুব গোপনে কোনো বেআইনি কারবার নিশ্চিত চলছে ওই গ্রামে! হয় বাইরে থেকে গ্রামে ঢোকা লোকগুলোকে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে অন্য কোথাও, অন্য কোনো বদ মতলবে... আর নাহলে কোনো ড্রাগস বা কেমিক্যাল ইনজেক্ট করে তাদের বানানো হচ্ছে যন্ত্রমানব! জ্যান্ত রোবোটের মতো শূন্য দৃষ্টিতে তারা শুধু হুকুম তামিল করে চলেছে তাদের নির্দেশদাতার!

খুট্ করে খুলে গেল দরজাটা। একটা প্লাস্টিকের জলের জগ নিয়ে ঘরে ঢুকল বাবুরাম, এক গাল হেসে বলল, “দিদি পানি!” মনে মনে কথা সাজিয়ে নিল ভূমি। হাতে খুব বেশী সময় নেই, আরো কোনো মানুষের ক্ষতি হওয়ার আগেই ভাঙতে হবে এই চক্র! আর তার জন্য বাবুরামকে পাশে পাওয়া খুব জরুরি, এই অচেনা পাহাড়ী জায়গায় একা একা কিছুই করতে পারবে না ও! বোঝাতে হবে ওকে। সরাসরি বাবুরামের চোখের দিকে তাকিয়ে ইস্পাত কঠিন গলায় বলল, “বাবুরাম, কতদিন আগে তোমার দাদা ওই গ্রামে গিয়েছিল?”

আচমকা প্রশ্নবাণে একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বাবুরাম! তারপর একটু চিন্তা করে বলল, “উও তো করিব চার সাল হো গ্যায়া দিদি!”

—“আচ্ছা, তোমার দাদার কোনো খোঁজ তো তোমরা পাওনি... এমনকি যদি মারা গিয়েও থাকে, তবে তার লাশটা অন্তত পেতে? তাহলে কী করে ধরে নিলে যে সে মারা গেছে?” ধারালো কণ্ঠে বলল ভূমি।

এবারে দৃশ্যতই হতভম্ব হয়ে গেল বাবুরাম, আমতা আমতা করে বলল, “না... মানে... গুরুজনরা বলে ওই গ্রামে গেলে কেউ ফেরে না... যে যায় মেরে হাওয়ায় মিশিয়ে দেয় ওই জিনেরা...”

—“জিন! আচ্ছা জিনেরা কি মানুষের মতো দেখতে হয়? মানুষের মতো হাঁটাচলা, কাজকর্ম করা, গাছ কাটা... এসব করতে পারে? তাও দিনের আলোয়? তোমরা তো নিজের চোখেই ওদের দেখেছো!”

থতমত খেয়ে চুপ করে গেল বাবুরাম। তার চঞ্চল চোখ গোল গোল হয়ে ঘুরছে এদিক ওদিক, বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা তোলপাড় চলছে ভেতরে। ওকে এনে খাটের একপ্রান্তে বসালো ভূমি, তারপর চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে নীচু অথচ দৃঢ় গলায় স্থির চোখে তাকালো ওর দিকে, “দেখো বাবুরাম, তুমি তোমার দাদার বডি কিন্তু খুঁজে পাওনি। হতেও তো পারে সে বেঁচে আছে?”

চমকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল বাবুরাম! বিস্ময় আর আশা মিলে মিশে আছে সে চোখে! কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ক্যায়া বোল রহে হো আপ দিদি! অ্যায়সা... হো সকতা হ্যায় ক্যায়া...!”

—“কেন হবে না?” বাবুরামের ভেতর একটু একটু আশা জাগছে, বুঝতে পারল ভূমি।

—“তাহলে যদি সত্যিই ও বেঁচে থাকে, আমাদের কাছে ফিরে আসছে না কেন?” অভিমান স্পষ্ট বাবুরামের গলায়।

—“হয়তো তার উপায় নেই! হয়তো সে বন্দী হয়ে আছে কোনোভাবে! তুমি জানো, একটা মানুষকে ড্রাগস ইনজেক্ট করে মুহূর্তের মধ্যে নিজের হাতের পুতুল বানানো যায়? তার সমস্ত স্মৃতি মুছে যায়, চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা হারিয়ে যায়... তখন তাকে দিয়ে যেকোনো কাজ করিয়ে নেওয়া যায়! জড় পদার্থের মতো সে শুধুমাত্র আদেশ পালন করে যায়... কাউকে মারতে বললে মেরে ফেলে, কোথাও বোম ফেলতে বললে বোম ফেলে!”

মুখে কোনো কথা সরছিল না বাবুরামের! বিস্ফারিত চোখে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল ভূমির মুখের দিকে! “এখনকার মর্ডার্ন সোসাইটিতে মানুষের জীবনযাত্রা যত উন্নত হচ্ছে, পাল্লা দিয়ে কিন্তু উন্নত হচ্ছে টেররিসমের বিভিন্ন পদ্ধতিও,” বলে চলল ভূমি, “তোমাদের ভূতের গল্প দিয়ে ভয় দেখিয়ে হয়তো জঙ্গিরা নিজেদের ঘাঁটি বানিয়েছে ওই গ্রামকে! হিউম্যান বম্ব, মানে সারা শরীরে বোমা বেঁধে কোনো পাবলিক প্লেসে গিয়ো সেগুলো ব্লাস্ট করা... এইসব পদ্ধতি তো বহুযুগ ধরেই ব্যবহার করছে টেররিস্টরা, এখন মর্ডার্ন টেকনোলজিতে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র বানানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ওপর নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করে তাকে রোবোট বানিয়েও কাজ হাসিল করছে!”

এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠল বাবুরামের, দু হাতে খামচে ধরেছে মাথার চুল। ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল ভূমি, নরম গলায় বলল, “আমি জানি না তোমার দাদাকে ফিরিয়ে আনতে পারবো কিনা, জানি না সে এখন কী অবস্থায় আছে। কিন্তু এই যে দিনের পর দিন যারা কমবয়েসী ছেলেদেরকে বন্দী করে তাদের ড্রাগস দিয়ে দিয়ে জড় পদার্থ বানিয়ে রাখছে, তাদের ব্যবহার করে দেশে নাশকতা চালাচ্ছে, বা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোনো বেআইনি ব্যবসা করছে... তাদের শাস্তি হোক তুমি চাও না বাবুরাম? রোজই হয়তো তোমার দাদার মতো কত কত ছেলের সর্বনাশ করছে এরা! এদের এই ঘাঁটিটা তো ভাঙতে হবে! আর ঘাঁটির সঙ্গে সঙ্গে এত বছরের একটা গুজবের পাহাড়ও ভাঙবে। পুলিশের সাহায্য তো নেবই আমরা, কিন্তু তার আগে জায়গাটা একবার দেখা দরকার... ওই মন্দিরটায় যাওয়ার যদি কোনো শর্টকাট থাকত... গ্রামে না ঢুকেও ওই মন্দিরে একবার লুকিয়ে দেখে আসতে পারলে...”

—“রাস্তা আছে দিদি,” শান্ত স্বরে বলল বাবুরাম। তারপর চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ভূমির দিকে, “আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।”

নয়

জঙ্গলের মধ্যে শুঁড়িপথ, দু ধারে সার দিয়ে ভিড় করে আছে অজস্র শাল-সেগুন-পাইন গাছ। এক পাশে একটা শুখা নালার খাত গেছে এঁকেবেঁকে... পুরো শুখা নয়, অল্প জল টলটল করছে নীচের দিকে। নালাটার পাশ দিয়ে শুকনো পাতা, ঝোপঝাড় মাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল বাবুরাম, পেছনে ভূমি। বিকেল ঢলে আসছে, কত রকম পাখি চ্যাঁ চ্যাঁ করতে করতে ফিরে আসছে বাসায়! অন্ধকার পুরোপুরি ঘিরে ধরার আগেই কাজ সারতে হবে। ভূমির পরনে কালো জিনস্ আর টি শার্ট, তার ওপরে ডেনিমের একটা জ্যাকেট চড়ানো। পিঠের ব্যাগে ক্যামেরা, ব্যাটারি, ছোটো রেকর্ডার সব প্রয়োজনীয় জিনিসই মজুত। আর আছে বাবুরামের বাড়ি থেকে নেওয়া একটা ধারালো কুকরি, আত্মরক্ষার জন্য।

ক্ষিপ্র পায়ে বাবুরামকে ফলো করছিল ভূমি, আসন্ন মুহুর্ত গুলোর উত্তেজনায় টগবগ করছে তার শরীর! কলেজে পড়ার সময়ই বিকেলবেলাটায় পাড়ার ক্যারাটে ক্লাবে যেত ও, এছাড়া এখনো রোজ সকালে লেকের ধারে জগিং ইজ মাস্ট! তার পেশার জন্য নিজেকে ফিট রাখতে হবে তো! কিন্তু “জবরখবর” এ জয়েন করার পর থেকে তার অ্যাকশান প্যাকড লাইভ নিউজ কভার করার স্বপ্নটায় মরচেই পড়ে গেছিল, আর আজ এখন এই অচেনা পাহাড়ের কোলে একেবারে একটা জঙ্গি ঘাঁটিতে ঢুকতে যাচ্ছে সে! আজ এই মানুষ অদৃশ্য হওয়ার রহস্য সে ভেদ করে ছাড়বেই! ঝোপ গুলোকে লাফিয়ে ডিঙোতে ডিঙোতে শরীর-মনে একটা আলাদাই চনমনে ভাব অনুভব করছিল ভূমি!

প্রায় আধঘন্টা মতো চলার পর দাঁড়িয়ে পড়ল বাবুরাম। এখান থেকে নালাটা পুরো এল শেপের মতো ডানদিকে বেঁকে চলে গেছে। চঞ্চল চোখে সামনে জঙ্গলের দিকে আঙুল দিয়ে কী যেন দেখালো! একটা ধূসর রঙের পাথুরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে গাছপালার ঘন আবরণের ফাঁক দিয়ে, দেখল ভূমি। এটাই কি তবে সেই গুহা! বাবুরামের দিকে ইশারা করতেই চোখ নাচিয়ে সম্মতি দিল সে! খুব একটা দূরে নয় গুহাটা, একশো মিটার হবে... তাও শত্রুর ডেরায় ঢোকার আগে ভালো করে দেখে নেওয়া দরকার! ব্যাগ থেকে বাইনোকুলারটা বের করে ফোকাস করল ভূমি, এটা সম্ভবত পেছন দিক। লতা পাতা আগাছায় ঢেকে আছে পাথুরে দেওয়ালের নীচের দিকটা, দেখলে মনে হয় কোনো পাহাড়ের একটা অংশ উপাঙ্গের মতো বেড়ে গিয়ে তৈরী করেছে এই গুহা। একদিকের দেওয়ালে শ্যাওলা জমে কালচে সবুজ লম্বা একটা প্যাটার্ন তৈরী করেছে, বোধহয় কোনো ঝর্ণার জলের ধারা শুকিয়ে গেছে। এদিক ওদিক ঘোরালো ভূমি... নাহ্, কোনো লোক এখনো চোখে পড়ছে না! এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে! তাদের দেরী হলে লোকাল পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেওয়ার জন্য অবশ্য বলে এসেছে সুবাসকে। বাইনোকুলারটা নামিয়ে ফিসফিস করল ভূমি, “তুমি এখানে থাকো বাবুরাম। তোমার কুকরিটা রেডি রেখেছো তো? আমি এগোচ্ছি... কোনোরকম চিৎকার শুনতে পেলেই অ্যাটাক করবে, তার আগে নয়! মনে রাখবে, আমরা মাত্র দুজন, ওরা অনেক... পুলিশ আসার আগে আমাদের উপস্থিতি টের পেলে কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে!”

—“কিন্তু দিদি...” ইতস্তত করল বাবুরাম, “তুমি একা যাবে? আমিও নাহয় যাই সঙ্গে... কোনো বিপদ হলে...”

—“ওই জন্যই তো তোমাকে এখানে থাকতে বলছি!” চাপা গলায় বলল ভূমি, “দুজনে একসঙ্গে গিয়ে বাঘের মুখে পড়ে তো কোনো লাভ নেই! যদি কোনো গণ্ডগোল হয় তাহলে তো আমার চিৎকার শুনতে পাবে ডেফিনিটলি, কারণ এখানে আর কেউ কথা বলতে পারে না! আর...” একটু থামল ভূমি, কী যেন ভেবে নিয়ে আবার বলল, “যদি কোনো গণ্ডগোল নাও হয়, আধঘন্টাটাক পরে একবার গিয়ে দেখবে সব ঠিক আছে কিনা! ততক্ষণ আমি সামলে নেবো! আর পুলিশ যদি এসে পৌঁছোয়, ওদের নিয়ে স্ট্রেট ঢুকে যাবে। ওকে?”

বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়ল বাবুরাম। ওর কোমরে গোঁজা ছোরাটা চকচক করছে, হাতে একটা কাঠের হাতলওলা কুড়ুল। সেদিকে একবার দেখে নিয়ে সামনে পা বাড়ালো ভূমি। দু পা এগিয়েই আবার পেছনে ঘুরে বলল, “তবে যাই হয়ে যাক, ওদের চোখের দিকে তাকাবে না একদম!”

দশ

পাহাড়ি এলাকা, সন্ধ্যেটা নেমে গেছে ঝপ করে। কখন যে আলো মরে গিয়ে চাপ চাপ অন্ধকার ঘিরে ধরে বোঝাই যায় না! মিনিট পাঁচেক হল গুহাটার গা ঘেঁষে ঝোপের আড়ালে বসেছে ভূমি। একটা অদ্ভুত পরিবেশ এখানে। গুহার একশো মিটার আগে থেকেই পাখির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছিল, এখন একদম যাকে বলে পিনড্রপ সাইলেন্স! একটু হাওয়াও দিচ্ছে না যে পাতার সরসরটুকু শোনা যাবে! হঠাৎ করে যেন কালা হয়ে গেছে ভূমি... অসহ্য লাগছে এই নিস্তব্ধতা! বেরোনোর আগে গায়ে মশা তাড়ানো ক্রীম মেখে নিয়েছিল, মশা মারতে গিয়ে চড়চাপড়ে যেন কোনোভাবে তার উপস্থিতি টের পাওয়া না যায়... তা সে একেবারেই বেকার গেছে! মশা তো মশা, এই জংলা ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটা পোকা বা পিঁপড়ে অব্দি নেই! একই ভাবে ব্যাগের মধ্যে পড়ে আছে সাপ তাড়ানোর জন্য কার্বলিক অ্যাসিডের বোতলটা। প্রায় দমবন্ধ করে বসেছিল ভূমি, এতটাই চুপচাপ চারদিক মনে হয় যেন তার নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও শোনা যেতে পারে! কিন্তু মাথার মধ্যে হিসেব গুলো মেলানোর চেষ্টাটা করেই চলেছে সে, আর বারবার মিলছে না এই কঠিন ধাঁধা! মানুষগুলোকে কোনো ড্রাগস দিয়ে বোবা বানানো গেলেও একটাও পোকা-মাকড় কেন নেই চত্বরটায়? কোনো ওষুধ স্প্রে করা হয় নাকি? বিরক্ত লাগছিল ভূমির! নাহ্, এইভাবে অনন্তকাল তো বসে থাকা যায় না! প্রচণ্ড শব্দে যেমন কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়, তেমনি বোধহয় আবার শব্দের অভাবে কানটা কটকট করছে। উঠে পড়ল ভূমি। মিনিট পাঁচ-সাত হয়ে গেল বসে আছে, একটা লোকও এদিক দিয়ে যায়নি। এবার একটু রিস্ক নেওয়া যেতেই পারে! পা টিপেটিপে গুহাটার দেওয়াল বরাবর ঘুরে গেল... ওই তো! ডানদিকে দেখা যাচ্ছে গুহার মুখটা! ডিম্বাকৃতি, দেখে মনে হয় যেন পাথর কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে। ভালো করে চারপাশে চোখ বোলালো ভূমি, সত্যিই বেশ তকতকে পরিষ্কার সামনেটা... তবে সবথেকে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে... একটা অদ্ভুত একটানা শব্দ ভেসে আসছে গুহাটার ভেতর থেকে! পলকে শরীরের মাংস পেশী গুলো টানটান হয়ে গেল ভূমির! ওই সেই শব্দ! তার মানে কিছু একটা চলছে ভেতরে! সাবধানী পায়ে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে গুহাটার মুখে নেমে এল ভূমি। এবার চট করে ঢুকে পড়া যাক!

একটা বেশ সুন্দর মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে গুহার ভেতর থেকে। ধূপ-টুপ কিছু জ্বালিয়েছে নাকি? পাথর গুলোর আড়ালে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে এগোচ্ছিল ভূমি। গুহার ভেতরটা পুরো অন্ধকার নয়, একটা লালচে আলো ছড়িয়ে আছে। বেশ বড়সড় কাণ্ডকারখানাই চলছে এখানে! নিশ্চয়ই কোনো পাওয়ার জেনারেটর দিয়ে এই লাইট গুলো জ্বালানো হয়েছে... সোর্সটা কোথায়? এখানে এত গুলো লোক থাকে, তাদের খাবার-দাবার অস্ত্র-শস্ত্রও নিশ্চয়ই বাইরে থেকে কোনো গোপন পথে আসে? আচমকা পায়ের শব্দ হল পেছন দিক থেকে! সচকিত হয়ে উঠল ভূমি! কেউ আসছে! লুকোতে হবে... কিন্তু কোথায়? কপালে বিনবিনে ঘামটা বুঝতে পারল ও! সামনে একটা আয়তকার বড় পাথরের স্ল্যাব রাখা, কী যেন খোদাইও করা আছে! সাতপাঁচ ভাবার সময় পেলো না আর... কোনোমতে শরীরটা গলিয়ে দিল পাথরটার পেছনে!

মিনিটখানেকের অপেক্ষা। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল পায়ের শব্দটা। কে যেন চলে গেল গুহার আরো ভেতর দিকে! আরো মিনিটখানেক কাঠ হয়ে পড়ে থাকার সোজা হয়ে বসল ভূমি। সামনেই পেল্লাই পাথরটা। ওপর থেকে নীচ অব্দি পাথর কুঁদে কুঁদে কী সব লেখা আছে... ঠিক যেন খোদাই করা শিলালিপি! অক্ষর গুলো ঠিক পড়া যায় না... অনেকটা দেবনাগরীর সঙ্গে মিল আছে, কিন্তু অনেক গুলোই একদম অচেনা। খুব সাবধানে কয়েকটা ফোটো তুলে নিল ভূমি। বামদিকে একটা সুড়ঙ্গের মতো চলে গেছে... এগোবে? কিন্তু যদি আবার কেউ এসে পড়ে? আর যদি লুকোনোর সুযোগ না পায়? কিন্তু এতদূর এসে সবটা না দেখে ফিরে যাবে? একটা অসম্ভব দোলাচলের মধ্যে দুলতে দুলতে নিজেকে শক্ত করল ভূমি। এগোবেই ও! এই পাহাড়ের কোলে গুহার ভেতর এরকম ভাবে পাওয়ার সাপ্লাই টানা হয়েছে, নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে! আর সেটা খুব একটা সৎ যে নয় সেটা বোঝার জন্য গোয়েন্দার বুদ্ধি তো লাগে না! জ্যাকেটের হাতাটা ভালো করে গুটিয়ে নিয়ে পা বাড়ালো। ভেজা স্যাঁতসেঁতে ধরনের দেওয়াল, বেশ নীচু... কিছু কিছু জায়গায় হামাগুড়িও দিতে হচ্ছে। তবে সেই আলোটা ছড়িয়ে আছে এখানেও... মনে হয় পুরো গুহাটার ভেতরেই পাথরের নীচে নীচে বসানো আছে ছোটো ছোটো লাইট, যেগুলো দেখা যাচ্ছে না বাইরে থেকে। একটা বাঁক ঘুরেই থতমত খেয়ে গেল ভূমি! সুড়ঙ্গটা হঠাৎ করে চওড়া হয়ে গিয়ে একটা হলঘরের মতো হয়ে গেছে! সাঁৎ করে নিজেকে একটা চওড়া পাথরের আড়ালে ঢুকিয়ে নিয়ে শুধু চোখ দুটো মেলে ধরল সামনের দৃশ্যের দিকে!

সামনে তখন ঘটছে এক অদ্ভুত দৃশ্য! বড় হলঘরটার ভেতর গাছের পাতা-ফুল জড়ো করে বানানো একটা বিছানার ওপর শুয়ে আছে একটা লোক। সম্পূর্ণ উলঙ্গ! তাকে ঘিরে রয়েছে আরো কিছুজন। সাধারণ নেপালী লোক, পরনে ঢোলা জোব্বা জাতীয় জিনিস... তবে তাদের মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। কেউ চন্দনবাটার মতো কিছু একটা মাখিয়ে দিচ্ছে তার গায়ে, কেউ বিছানাটার চারপাশে জলের মত কিছু একটা তরল ছিটিয়ে দিচ্ছে! বিস্ফারিত চোখে দেখতে থাকল ভূমি! কী করছে এরা? ওই লোকটা অমন উলঙ্গ কেন? এতদিনেও যে সম্ভাবনাটা তার মাথায় কখনো আসেনি আজ সেটা হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো খেলে গেল! কোনো তন্ত্র সাধনা চলছে এখানে? ব্ল্যাক ম্যাজিক? শিরদাঁড়া দিয়ে কিছুটা বরফকুচি যেন ভাসতে ভাসতে নীচে চলে গেল! আবার ভালো করে দেখল ভূমি, লোকটা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আর তার ঠিক বুকের ওপরটায় যেন ঠিক এক দলা মাংসপিণ্ড ! টিউমার? কোনো চিকিৎসা করা চলছে এখানে? কিন্তু পরমুহূর্তেই ভুলটা ভাঙল। একটা লোক ওই চন্দন বাটার মতো জিনিসটা মাংসপিণ্ডের ওপর মাখিয়ে দিতেই হঠাৎ নড়ে উঠল ওটা! গলা দিয়ে ছিটকে উঠে আসা চিৎকারটাকে কোনোমতে চেপে ধরল ভূমি! মাংসপিণ্ড নয়, ওটা একটা বাচ্চা! একদম সদ্যোজাত মনে হচ্ছে... আর... সেটা জুড়ে আছে ওই লোকটার শরীরের সঙ্গে! মাথার ভেতরটা ঝমঝম করতে লাগল ভূমির... এ কী নৃশংস কার্যকলাপ চলছে এখানে! ওইটুকুনি সদ্যোজাত শিশুকে জুড়ে দিয়েছে ওই লোকটার শরীরে! এ নিশ্চয়ই কোনো কালা যাদুর পদ্ধতি! কিন্তু না! বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে দেখল ভূমি... বাচ্চাটা তো জোড়া নয় লোকটার শরীরে! বরং যেন একটু একটু করে বেরিয়ে আসছে ওই লোকটার শরীর থেকে... ! যুক্তি বুদ্ধি কাজ করছিল না ভূমির, কোনো মতে কাঁপা হাতে ক্যামেরাটা তুলল... কয়েকটা ছবি তুলেই পালাতে হবে এখান থেকে! পেট গুলিয়ে যেন বমি উঠে আসছে তার... দু হাতে কাঁপতে থাকা ক্যামেরাটাকে কোনোমতে সামলানোর চেষ্টা করল ভূমি... আর ঠিক তখনই... পেছন থেকে শক্ত লোহার মতো কয়েকটা ঠান্ডা আঙুল এসে স্পর্শ করল ওর কাঁধ! চমকে এক ঝটকায় পেছনে ঘুরলো! একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে! দাড়ি-গোঁফ-মাথা সম্পূর্ণ কামানো... ভুরুটাও সম্ভবত, খুদে খুদে দুটো শান্ত চোখ, চ্যাপ্টা নাক আর পরনে সাদা আলখাল্লা জাতীয় কিছু একটা! প্রবল আতঙ্কে এক মুহূর্তের জন্য পা দুটো জমে গেছিল ভূমির, তারপর হঠাৎ মাথার ভেতর যেন পাগলাঘন্টির মতো বেজে উঠল, “পালাতে হবে! যে করেই হোক পালাতে হবে!” শরীরের সব শক্তি জড়ো করে লোকটাকে এক ধাক্কায় ঠেলে সরানোর চেষ্টা করল ভূমি... আর সঙ্গে সঙ্গেই... পিঁইইইইই! বোবা মাইক্রোফোনের মতো একটানা আওয়াজ ভেসে আসছে কোথা থেকে! উহহ্! অসহ্য যন্ত্রণায় মাথাটা খামচে ধরল... এতক্ষণের নীরবতার পর এই ঝিমঝিমে আওয়াজ যেন কানে তালা ধরিয়ে ধাক্কা মারছে সোজা মাথায়! ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে নার্ভগুলো... হাঁটুর জোর যেন কমে আসছে... পায়ের নীচে মাটিটা কেঁপে উঠল কি? চারদিক থেকে একটা দুর্বোধ্য শব্দের জাল ঘিরে ফেলল ভূমিকে... আর চেতনার শেষ সীমায় পৌঁছে একটা অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে যেন তলিয়ে গেল ভূমি!

এগারো

একটা নরম বিছানা, বেশ গদিওলা বোধহয় ... শরীরটা পুরো ডুবে আছে। পায়ের পাতার নীচে কে যেন হাত বোলাচ্ছে... ঠান্ডা একটা স্পর্শ। আস্তে আস্তে চোখ খুলল ভূমি। মাথার ওপর একটা লালচে আভাওলা ধূসর রঙের ছাদ। ডান দিকে ঘাড় ঘোরালো... বিশাল একটা চৌকোণা বাক্স বসানো আছে, গায়ে অসংখ্য বোতাম আর নবের মতো জিনিস, সরু সরু কিছু জিনিস জড়িয়ে আছে বাক্সটাকে। তার নাকি? ঘোর লাগা চোখে বোঝার চেষ্টা করল ভূমি... কোথায় আছে সে? কোনো অপারেশন থিয়েটারে? আস্তে আস্তে বামদিকে তাকাতেই একটা কারেন্ট খেলে গেল তার গোটা শরীরে! ওর ঠিক পাশেই শুয়ে আছে একটা লোক! সম্পূর্ণ উলঙ্গ! আর লোকটার পাশে বসে আছে সেই ন্যাড়া লোকটা! মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু মনে পড়ে গেল ভূমির! এক ঝটকায় উঠে পড়তে গেল সে... আর ঠিক তখনি প্রবল বিস্ময়ে তাকালো নিজের দিকে! যেন কোনো অদৃশ্য আঠায় রবারের মতো বিছানাটার সঙ্গে চিটিয়ে আছে তার শরীর... এবং... একটা সুতোও নেই তার গায়ে! ভয়ঙ্কর বিভীষিকায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল ভূমি... আর ঠিক সেই সময়ে স্মিত মুখে একটা যান্ত্রিক স্বরে পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল সেই ন্যাড়া লোকটা, “চিৎকার করে কোনো লাভ নেই ভূমিসুতা ভট্টাচার্য্য!”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ভূমি! লোকটা বাংলায় কথা বলল! কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো সে! প্রবল আক্রোশে নিজেকে বিছানা থেকে তোলার চেষ্টা করতে করতে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কে তুমি? কী করছ এখানে? আমাকে এই ভাবে আটকে রেখেছে কেন? আমার জামা-কাপড় কোথায়? জানোয়ার! একটা মেয়েকে সবাই মিলে ভোগ করবে... কী ভেবেছো তোমরা হ্যাঁ! বাইরে আমার লোক আছে... এখুনি পুলিশ চলে আসবে! সব ফাঁস করে দেব! তন্ত্র মন্ত্র সাধনার নামে কী চলছে এখানে... সব ফাঁস করে দেব!”

স্মিত মুখেই বসে আছে লোকটা, কোনো ভাবান্তর নেই। যেন ভূমিকে প্রাণভরে চিৎকার করার সুযোগ করে দিচ্ছে! ওর কথা থামলে সেই অদ্ভুত যান্ত্রিক স্বরে কেটে কেটে বলে উঠল, “তোমাদের মানুষদের এটাই সমস্যা! তোমরা মনে কর তোমরা সব কিছু জানো, বোঝো... তার বাইরে আর কিছু হতে পারে না! তাই অধিকার ফলাতে এসে নিজেদের বিপদ নিজেই ডেকে আনো তোমরা!”

সারা শরীরে কাপড় নেই... এক অদ্ভুত বিবমিষা হচ্ছে, ধীরে ধীরে একটা জমাট বাঁধা বরফের স্রোত যেন বয়ে যাচ্ছে শরীরের ওপর দিয়ে! কোনোমতে গোঙাতে গোঙাতে বলল, “তোমরা মানুষ মানে... ? তুমি নিজে কী ?”

যেন ছেলেমানুষি কথা বলেছে ভূমি, সেই ভাবে নিঃশব্দে হেসে উঠল লোকটা, “ঠিক এটাই তো সমস্যা! তোমরা মনে কর মানুষই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিশ্বর... সবচেয়ে উন্নত প্রাণী! অথচ তোমরা জানও না তোমরা ছাড়াও এই গোটা ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে আছে কত প্রাণ! তোমাদের চেতনায় তাদের অস্তিত্ব ধরা পড়ে না... কিন্তু তারা আছে, ভীষণ ভাবে আছে!”

বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল ভূমি! কি বলতে চাইছে লোকটা! এ কোথায় এসে পড়ল সে! গলা দিয়ে আর স্বর ফুটছে না, শুধু আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইল! তার দিকে যেন একটা তাচ্ছিল্যের হাসিই ছুঁড়ে দিল লোকটা। তারপর আবার সেই রোবোটের মতো ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল, “তোমায় একটা গল্প বলি শোনো।" হাঁটু দুটো ভাঁজ করে তার ওপর হাত রেখে বেশ গল্প বলার ঢং এ শুরু করল, " ধরো আজ থেকে বেশ কয়েক হাজার বছর আগে একটা গ্রহে হঠাৎ যুদ্ধ লাগল। এই এখনো তোমাদের যেমন হয়... এক দেশ আরেক দেশের ওপর বোমা ফেলে... মানুষ মরে, ঠিক তেমনি দুই শক্তির যুদ্ধের ফলে মরতে থাকল গ্রহের সাধারণ বাসিন্দারা, একে একে কমে আসতে থাকল জীবিত প্রাণীর সংখ্যা। যখন পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার মুখে সেই গ্রহ, তখন সেখানকার কিছু বাসিন্দা ও তাদের নেতা ঠিক করলেন পালাতে হবে এ গ্রহ ছেড়ে। নিজেদের আকাশযান ভাসিয়ে দিলেন তাঁরা, আর সেটা ভাসতে ভাসতে একসময় এসে পড়ল বহু আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্রহের বুকে। সেই নেতা ও তাঁর সঙ্গীরা দেখলেন এই গ্রহেও বেশ কিছু জীবিত প্রাণী আছে... আর তাদের মধ্যে যারা সবার ওপরে, তাদের ‘মানুষ’ বলে! এই ভিনগ্রহীদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল, তাঁরা খুব সহজেই অতি দ্রুত অভিযোজন ঘটিয়ে অন্য রূপ ধারণ করতে পারতেন। এছাড়া নেতারা যেহেতু অপেক্ষাকৃত উন্নত হতেন, তাই তাঁরা মুহূর্তের মধ্যেই শিখে নিতে পারতেন যে কোনো ভাষা! নিম্নবর্গের সঙ্গীগুলির মুখে ভাষা ছিল না, তবে বোবা হলেও নিজেদের মনের কথা বোঝানোর জন্য কোনো অঙ্গভঙ্গির দরকার পড়ত না... প্রত্যেকে পড়তে পারতেন অন্যের মনের ভেতরটা... তাই তাঁরা সেই মানুষের রূপ ধারণ করে স্বভাষী হয়ে মিশে গেলেন তাদেরই ভিড়ে !” একটু বিরতি দিল লোকটা।

শরীরের সব রক্ত যেন জমে গেছে। জড়পদার্থের মতো পড়ে ছিল ভূমির শরীরটা, তাও মাথার ভেতরে একটা অদ্ভুত আতঙ্ক কয়েকগুণ শক্তিশালী হয়ে ধাক্কা দিচ্ছিল... এরকম তো কল্পবিজ্ঞানে... বাস্তবে এরকম হতে পারে?

—“হ্যাঁ, হতে পারে! তোমরা নানারকম ধারণা দিয়ে নিজেদের ভুলিয়ে রাখো, তাই জানতে পারো না!” রসকষহীন মেশিনটা যেন ভূমির মাথার ভেতরের কথা গুলোও পড়ে নিল মুহূর্তে ! চমকে তাকালো ভূমি! মাথার ভেতরটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে... উঠল ন্যাড়া লোকটা, বাক্সের মতো যন্ত্রটার সামনে গিয়ে সরু আঙুল গুলো দিয়ে ঘুরিয়ে দিল কটা নব। ফিরে এসে শুরু করল আবার, “তো সেই নেতা আর তাঁর সঙ্গীরা মানুষের মধ্যেই থাকতে শুরু করলেন বটে, কিন্তু একটা বিষয়ে তাঁরা ছিলেন মানুষদের থেকে পুরোপুরি আলাদা... এবং এই বিষয়টা কোনো ভাবেই পাল্টানো সম্ভব ছিল না! আচ্ছা, এই জায়গাটার নাম কী জানো?” দুম করে ভূমির দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল লোকটা!

ভূমির স্বরযন্ত্র বোধহয় পুরোপুরি বিকল হয়ে গেছে। ওই বাক্সটার জন্যই কি? কী আছে ওই বাক্সে? কোন তরঙ্গ বেরোচ্ছে ওটা থেকে, যেটা ফাঁসের মতো চেপে ধরছে ওর গলা... আওয়াজ করতে পারছেনা ও? কিন্তু... কিন্তু... ওর মস্তিষ্কেরও যেন দখল নিচ্ছে অন্য কেউ... না চাইতেও বাক্সের চিন্তাটা সরে গিয়ে ওর মাথার মধ্যে হঠাৎ কোন অতল গভীর থেকে ভুস্ করে ভেসে উঠল খুব ছোটোবেলার একটা স্মৃতি! তার বাংলার শিক্ষক বাবা খুব পুরাণের গল্প শোনাতেন তাকে। তার ভূমিসুতা নামটা যে সীতার আরেক নাম, সেটা বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন এই গল্পটা। বহু হাজার বছর আগে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে এক রাজা ছিলেন, যাঁর নাম ছিল নিমি। শোনা যায়, সেই রাজার শরীর থেকে জন্ম হয়েছিল তাঁর ছেলের, মিথির। নিমির পরে মিথি রাজা হলে তাঁর নামানুসারে তাঁর রাজধানীর নাম হয় মিথিলা, এবং বংশটার নাম হয় জনক বংশ। সীতার বাবা কুশধ্বজও ছিলেন এই বংশের একজন রাজা। তাই সীতার জন্মকাহিনী নিয়েও অলৌকিক ব্যাখা দেওয়া আছে, মাঠ চষতে গিয়ে লাঙলের ফলায় হয়েছিল সীতার জন্ম! এই ভাবে বাবা শুনিয়ে ছিলেন মিথিলা নামের ইতিহাস! আর সেই মিথিলাই এখনকার এই জনকপুর!

ভূমির ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই একটা অদ্ভুত ঘংঘং শব্দ করে যেন হাসিতে ফেটে পড়ল লোকটা! তারপর বিদ্রুপ মেশানো স্বরেই বলল, “এই যে! বলেছিলাম না... তোমরা সব কিছুই নিজের মতো করে ভেবে নাও! যেগুলো তোমাদের বোধবুদ্ধির বাইরে সেগুলোকে অলৌকিক, আশ্চর্য বা পুরাণের কাহিনী হিসেবে চালিয়ে দাও! খুব অহঙ্কার তোমাদের না? তোমরা নাকি সর্বশ্রেষ্ঠ জীব?”

একটু একটু করে যেন একটা পর্দা সরে যাচ্ছিল ভূমির চেতনার ওপর থেকে... মাথার ভেতরটা যেন হালকা হয়ে আসছে... বাইরের ওই লোকটা তাহলে...

—“হ্যাঁ! আমরা নিজেদের শরীর থেকেই জন্ম দিই নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের! তোমাদের মানুষদের বিজ্ঞানে অবশ্য এমন একটা জীবের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে যারা কোষ বিভাজন করে নিজেদের শরীর থেকে বাচ্চার জন্ম দেয়! যদিও তারা তোমাদের বিজ্ঞানের জগতে সবথেকে নিম্নবর্গের প্রাণী... অ্যামিবা!”

শরীর ভেতরটা পাক দিয়ে ভূমির মুখ থেকে হড়হড় করে বেরিয়ে এল কিছুটা দুর্গন্ধমিশ্রিত জল... চুম্বকের মতো গদির ওপর সেঁটে থাকা শরীরের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকল সেই বমি! আর শরীরের ওপর কোনো কন্ট্রোল নেই তার... সামনে বসে থাকা লোকটা, পাশে শুয়ে থাকা এই উলঙ্গটা... এরা... এরা সবাই অ্যামিবা? সারা পৃথিবী দুলতে শুরু করেছে..সে কি কোনো বাজে স্বপ্ন দেখছে?

—“এই ভাবে আমাদের নেতা হয়ে গেলেন তোমাদের রাজা! এ মিথিলা আমাদের রাজ্য!", লোকটার ডানদিকে পাথরের ওপর রাখা ছিল সবুজ শেওলার মতো কী একটা ঘন তরল... সেটা মুখে নিয়ে একটা লম্বা চুমুক মারল লোকটা, তারপর বেশ আয়েসী ভঙ্গিতে বলে উঠল, "গোটা পৃথিবীর আড়ালে খুব সন্তর্পণে আমরা বাঁচিয়ে রেখেছি নিজেদের! এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি নতুন প্রজন্ম! তোমাদের মতো মানুষরা যোগ্য নাকি এই পৃথিবীকে পরিচালনা করার! আমার দল ও তৈরী হচ্ছে... আস্তে আস্তে তারা ছড়িয়ে পড়বে সব জায়গায়... তাদের হাতেই লেখা হবে এই গ্রহের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ! আর তোমরা... মূর্খ মানুষেরা নিজেদের ক্ষুদ্র বুদ্ধি খাটাতে এলে, আমাদের মোকাবিলা করতে এলে... মরতেই হবে! শত্রুর শেষ রাখি না আমরা!” আপনমনে যেন ঘোষণা করার মতো করে বলল লোকটা!

থরথর করে শরীরের প্রত্যেকটা রক্তকণা যেন কাঁপছে ভূমির... সকালে শোনা পুরুষোত্তম ঠাকুরের গল্পটা কি তবে সত্যি ছিল? আরো কিছুটা ওই চন্দনবাটার মতো থকথকে মিশ্রণ গায়ে লেপে দিল একজন! সিঁটিয়ে গিয়ে চিৎকার করতে চাইল ভূমি, কিন্তু একটা বোবা গোঁ গোঁ আওয়াজ ছাড়া কিছুই বেরোলো না! "কী অবস্থা করেছ নিজেদের গ্রহটার... সেটা বোঝার ক্ষমতা আছে তোমাদের? বোকার দল যত!", ভূমিকে দেখে মুখ বিকৃত করে একদলা থুতু ফেললো যেন লোকটা, "নিজেরা নিজেদের শেষ তো করছই, এই গ্রহের বাকি প্রাণীদেরও অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছ তোমরা! কে অধিকার দিয়েছে তোমাদের? দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়েছ, পরিবেশ দূষিত করতে করতে একদম শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছ! শুধু তোমাদের কারণেই আমাদের প্রজনন বা অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার জন্য আশ্রয় নিতে হয়েছে এই পাহাড়ের গুহায়! বাইরের গরম আবহাওয়া, দূষণ প্রতি মুহূর্তে কষ্টকর করে তুলছে আমাদের বেঁচে থাকাকে! তাই সবার আগে এই মানবজাতিরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া প্রয়োজন!", প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চিৎকার করে উঠল লোকটা! ভূমির কানের মধ্যে যেন গরম গলানো লোহা ঢুকে যাচ্ছিল! "কয়েক শ বছর আগে এসেছিল এক বোকা মানুষ রাজা... একটুর জন্য বেঁচে গেছিল আমাদের হাত থেকে... এক রাতের মধ্যে খতম করে দিয়েছিলাম ওর পুরো দলকে! তখন আবহাওয়া এত গরম ছিল না, বাইরের পৃথিবীতেই স্বচ্ছন্দে থাকতে পারতাম আমরা। কিন্তু আমাদের এই বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটা নজরে চলে আসছিল সাধারণ মানুষদের... তাই আমরা যে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলাম, সব জড়ো হলাম এক জায়গায়... গড়ে তুললাম এই গ্রাম। আর তোমাদের ওই বোকা রাজা এই গ্রামের খবর পেয়ে এসেছিল আমাদের শেষ করতে!", ঘং ঘং করে গুহার দেওয়াল কাঁপিয়ে আবার সেই বিদ্রুপের হাসিটা হাসল, “তখন তো ওই মানুষগুলোকে খতম করার জন্য এইরকম গুহার কৃত্রিম পরিবেশ দরকার ছিল না... প্রত্যেকটার তাঁবুতে ঢুকে ঢুকে মেরেছিলাম!” সে উল্লাসের হাসি যেন আর থামছে না তার!

কিছুক্ষণ ধরেই কোথা থেকে যেন একটা শব্দ আসছে। বুড়বুড়ি কাটার মতো একটা আওয়াজ... ঠিক যেন আলতো ফটফট আওয়াজ করে ফেটে যাচ্ছে কিছু বুদবুদ। এবার আস্তে আস্তে বাড়ছে শব্দটা... কোনো ফুটন্ত তরলের ওপর যেন ভেসে উঠে সশব্দে ফাটছে বুদবুদ গুলো! সারা শরীর অসাড়, অতি কষ্টে শব্দের উৎস লক্ষ করে বাম দিকে তাকালো ভূমি... আর একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আতঙ্কে যেন ওর হৃদপিণ্ডটা শরীর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে মনে হল! ওর পাশে শুয়ে থাকা লোকটার সারা শরীর কেমন গলে গলে যাচ্ছে! অথচ রক্ত-মাংস-মজ্জা কিছুই বেরিয়ে আসছে না... পুরো শরীরটা যেন একটা থলথলে স্বচ্ছ জেলি হয়ে যাচ্ছে! সেই জেলির মতো জিনিসটার কোনো আকার নেই... ধীরে ধীরে ওই জায়গায় যেন এক মানুষ সমান একদলা স্বচ্ছ চটচটে সান্দ্র পদার্থ পড়ে থাকল! আর তার মধ্যে ভেসে বেড়াতে থাকল নানা আকৃতির ছোট ছোট বলের মতো জিনিস! আদিম আতঙ্কে ভূমির চোখ দুটো যেন কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল! এ কোন ভয়ঙ্কর কদর্য জীব!

—“অবাক হচ্ছ? ঘেন্না করছে? আমরা তো এরকমই! এটাই আমাদের আসল রূপ!” ন্যাড়া লোকটা যেন ভূমির আরো কাছে সরে এসে খসখসে গলায় বলল, “তোমাদের এই মানুষদের গ্রহে বহুদিন ধরে বাধ্য হয়েছি আমরা মানুষের রূপ ধরে থাকতে... জোর করেই অভিযোজন ঘটাতে হয়েছে নিজেদের... অনেক যন্ত্রণার সেটা! অনেক কষ্ট সহ্য করে থাকতে হয়েছে আমাদের! তাই আমরা ঠিক করেছি, আর না... এবার থেকে নিজেদের মতো করেই থাকব আমরা এই পৃথিবীতে, ইচ্ছে হলে নিজেদের রূপেই জন্ম দেব আমাদের আগামী প্রজন্মের! একবার নিজেদের গ্রহ হারিয়েছি আমরা, আর দ্বিতীয় বার ঘর ছাড়া হতে চাই না!"

মাথার ভেতরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে ভূমির, বুকটা যেন ফেটে যাবে এই বার! এই বুঝি শেষ! এটাই ছিল তার নিয়তি! কত স্বপ্ন দেখেছিল! শেষে খবরের সন্ধানে অজানাকে তাড়া করে এসে কোন পাহাড়ের কোলে গুহার ভেতর এই পরিণতি হল তার! কী দোষ করেছিল সে? কেউ জানবে না... কেউ না... মা-বাবা... তাদের বাড়িটা... বন্ধুরা... তার প্রিয় বই গুলো... আর দেখা হবে না কারোর সঙ্গে... এই অন্ধকূপে এই কদাকার নোংরা জীব গুলোর হাতে চিরকালের মতো শেষ হয়ে যাবে সে! একেই কি বলে মৃত্যুভয়? কীভাবে মারবে তাকে? ঠিক কী করবে তার সঙ্গে? কেন এভাবে শুইয়ে রেখেছে?

এবার একটা ক্রুর হাসি খেলে গেল লোকটার মুখে! একটু ঝুঁকে পড়ে ঠান্ডা বরফের মতো জমাট বাঁধা চোখ রাখল ভূমির চোখে, তারপর কেমন একটা জান্তব স্বরে হিসহিসিয়ে বলে উঠল, “কেন, অ্যামিবা কীভাবে তার শত্রুকে খতম করে জানো না? পড়ো নি তোমাদের বিজ্ঞানে? মিশিয়ে নেয় নিজের শরীরে, গিলে নেয়... হ্যাঁ! ঠিকই ভাবছো! আত্তীকরণ! কতবার স্কুলের পরীক্ষায় সংজ্ঞা লিখেছো! ভাবো... ভাবো... শেষবারের মতো ভেবে নাও...” বলতে বলতে গলে যেতে লাগল ন্যাড়া লোকটার শরীরটাও... ঠিক পাশে পড়ে থাকা জীবটার মতোই…

আর কিছু ভাবার সুযোগ পেল না ভূমি। একটা উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধ যেন প্রকট হয়ে উঠছে... যেন চেপে বসছে তার বুকে... দম বন্ধ হয়ে আসছে ভূমির! পাশে শুয়ে থাকা জেলিটা হঠাৎ নড়ে উঠল, প্রায় ভেসে এসে লেগে গেল ভূমির অর্ধ অচেতন শরীরে! কখন যেন তাদের ঘিরে ধরেছে এই জেলির মতো আরো কত গুলো প্রাণী! গোল হয়ে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে... সেই কনকনে ঠাণ্ডা চন্দনবাটার মতো জিনিসটার প্রলেপ লাগল ভূমির গায়ে... সেই একটানা আওয়াজ... সম্পূর্ণ ভাবে চেতনার শেষবিন্দুতে চলে যেতে যেতে হঠাৎ ভূমির মনে পড়ে গেল বাবুরামের মায়ের মুখে শোনা সেই কথা গুলো! “উন্মত্ত পদে দৌড়ে শিবিরের মধ্যে ঢুকলেন মহারাজ! এক অত্যাশ্চর্য দৃশ্য তাঁর সম্মুখে! প্রতিটি শয্যার ওপর নিপুণ ভাবে সাজানো আছে সৈন্যদের পোশাকগুলি! ঠিক যেন পোশাক পরিহিত সৈন্যদের শরীর টুকু মিলিয়ে গেছে শূন্যে , রয়ে গেছে পোশাক আশাক! বাইরে অশ্বগুলির ঝালর, পৃষ্ঠদেশের আসন, লাগাম প্রভৃতি শিবিরের বাইরে ভূমির ওপর পতিত, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি শোষণ করেছে, গলাঃধকরণ করেছে তাদের দেহটুকু!"

সহসা এক অসহ্য যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল তার বাম দিকটা! বলিতে পড়া কাটা ছাগলের মতো ছটফটিয়ে উঠতে চেয়েও পারল না..রবারের মতো গদিটা থেকেও বেরিয়ে এসেছে কিছু জেলির মতো আঙুল, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তার শরীরটা! একটা বরফের মতো কনকনে ঠান্ডা ছুরি যেন কেটে বসে যাচ্ছে চামড়া ভেদ করে! আবছা হয়ে আসা চোখে শেষবারের মতো দেখল ভূমি... একটা মোটা জেলির আবরণে যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে সে... আর তার বাম হাতটা... যেন আস্তে আস্তে গলে নরম হয়ে যাচ্ছে... নরম রবারের মতো ঢুকে যাচ্ছে পাশের লোকটার শরীরে মধ্যে!