রূপকার - পারিজাত ব্যানার্জী

মৌটুসী জানালার গরাদে মাথা ঠেকায়। তার সুদূরপ্রান্তে নিমগ্ন দৃষ্টিখানি ভারী অদ্ভুত লাগে আমার। আজ বলে নয়—রোজই। সেই যবে চৌধুরীপাড়ায় পুরোনো লালবাড়িটা কিনে উঠে এলো ওরা, তবে থেকেই নজর করেছি, মৌ এরকমই। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা—ওর সারামুখ জুড়ে লেগে থাকে ভেজা ভেজা ঘাম; সবসময়। যেন ওর গাল আলতো করে ছুঁলেই নামবে বৃষ্টি, এতখানি ওর শরীরী আর্দ্রতা। অবশ্য একে আদৌ আর্দ্রতা বলে এড়িয়ে যাওয়া উচিত, নাকি বিষণ্ণতা বলে মেখে নেওয়া উচিত নিজের শক্ত পরিশ্রমী চামড়ায়, তা এ কবছরেও বুঝে উঠতে পারিনি। আর তাই, যে মেয়েকে আমার প্রতিটি আবেগে ‘মৌটুসী’ বলে চিনেছি, তার আসল নামটুকুও এ যাবৎ আর কিছুতেই জানার বা জানলেও, মনে রাখার চেষ্টা পর্যন্ত করিনি। বা বলা ভালো, শেক্সপিয়রের সুরেই ওসব ‘নামে কি আসে যায়’ বলে উড়িয়ে দিয়েছি বিড়ম্বনা। অন্তরাত্মা যদিও প্রতিনিয়ত সাক্ষী - এই একটি মাত্র ডাকনামই আজও কিভাবে যেন রয়ে গেছে আমার ভাবনায়।

আসলে মৌকে বা ওই মৌটুসীকে আমি অনেককাল ধরে চিনি—মাঝে মাঝে মনে হয়, ও যেন কোনো পরজন্মের গল্প। আবার কখনও এই চেনাশোনাটা এতটাই অবাস্তব লাগে, ঠিক যেন মনে হয় ও বুঝি কোনো মাঝরাতের অর্ধেক ভুলে যাওয়া স্বপ্ন। তবু আমি জানি—মৌ আছে। ঠিক বেঁচে চলেছে জীবন তার নিজের মত করে। আমার সমান্তরাল কোনো প্রেক্ষাপটে ও আজও জীবনধারণ করে চলেছে অনায়াসে। ওর নিশ্বাস পড়ছে, ওর বুকের গভীরের কালো তিলটা আজও কালোজিরের মতো লেগে রয়েছে ওর মসৃণ পেলব চামড়ায়—ঠিক সেদিনকার মতো।

আমি যখন স্কুলে পড়তাম সেই তখন থেকে ওই মৌটুসীকে আমি চিনি। মেয়েটা আমার থেকে কয়েক বছরের ছোটই হবে, তবে ওর গোলগাল নিখুঁত চেহারায় বসন্তের ঢল নেমেছিল অনেক ছোট বয়সেই। আমার সঙ্গে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কখনও কথা হয়নি ওর তখনও। তবে বিকেলবেলা দল বেঁধে ওরা কয়েকজন যখন স্কুল ছুটির পর ফিরত, আমার সদ্য ধরতে শেখা জ্বলন্ত সিগারেটটা হিসেব করে তখনই দেখেছি, অপ্রস্তুত ভাবে ঠিক পরে যেত রাস্তায়। ওর গোলাপী আভা মাখা গালদুটোয় আরও একপ্রস্ত রঙ লাগত টের পেতাম। যদিও আশ্বিন মাস বা দুর্গাপুজোর আসতে তখনও অঢেল সময় বাকি।

আমার কাকার ফটোকপির দোকানটা ঠিক ওদের স্কুল বিল্ডিংয়ের একদম লাগোয়া। প্রায়ই ওদের বন্ধুবান্ধবদের গ্রুপের অনেকেই সেখানে আসত নোটস কপি করাতে। আমিও প্রায়ই স্কুল ফেরতা দুপুর থেকে সন্ধ্যের সময়টা হাতেহাতে কাকার সঙ্গে ওই দোকান সামলাতে হাজির হয়ে যেতাম। কিছুটা নেহাতই পকেটমানির দায়ে ঠিকই। তবে আমার এই কাজকর্মের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ অবশ্যই ছিল মৌ। কোনোকিছুর ফটোকপি করাতে হলে ও দেখতাম ঠিক এগিয়ে এসে আমার হাতেই কাগজ বা খাতাটা রাখত। একে অপরের আঙুলের স্পর্শেও কি ইলেকট্রিক শকের মতো ঝটকা লাগতে পারে? কে জানে, কিভাবে ওর নরম মসৃণ হাতটা যেই ছুঁয়ে যেত আমায়, স্পষ্ট অনুভব করতাম এক অজানা শিহরণ বইতে থাকত আমার শিরায় উপশিরার পথ ধরে আমার সমস্ত শরীর জুড়ে। আর ঠিক তখনই আমি টের পেতাম—মৌ ঘামছে। ওর ঠোঁটের উপর জমা পড়েছে একমুঠো মুক্তভরা বিন্দু বিন্দু জল।

মনে আছে—শ্রাবণমাস। এক ভরদুপুরবেলা মৌ একাই চলে এসেছিল আমাদের দোকানে। বৃষ্টিতে ভিজে একসা ওর শরীরখানা দেখে কিন্তু কামনার চেয়েও বেশি সেদিন যেটা হয়েছিল, তা আসলে এক মৃন্ময়ীর চিত্র অলংকরণ। ওর যেই ঘর্মাক্ত মুখ দেখলে আমার দুর্গাঠাকুরের কথা মনে পড়ে, পবিত্র এক বিহ্বলতা আঁকড়ে ধরে শিকড়, সেদিনের ওই দুপুরে দেখলাম সেই রূপেই লেগেছে অনাবিল ঐশ্বরিক কোনো ছোঁয়া।

দোকানে একলাই ছিলাম। কাকা কি একটা কাজে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে আটকে পড়েছিল বৃষ্টিতে। তাই আমিই সব সামলাচ্ছিলাম। সামনে পরীক্ষা—তাই ফটোকপি করার ধুম পড়ে যায় ছাত্রছাত্রীদের এসময়; আগেও লক্ষ্য করেছিলাম। তাই একলা থাকলেও সত্যি কথা বলতে কাজের অভাব ছিল না। হালকা রেডিওর সুরে গা ভাসিয়ে বাইরের দরজার ভারী পর্দাটা সরিয়ে ভেজা স্কুলব্যাগটা হাতে যখন মৌটুসী অমন ভাবে এসে দাঁড়ালো সামনে, আর কোনো আবেগ নয়, চেয়ে দেখলাম শুধু, হাতে ধরা সব নোটসের খাতাগুলোই কিভাবে যেন চোখের সামনে প্রেমপত্র হয়ে গেল বিস্ময়ে।

ওদিনই প্রথম চোখে চোখ রেখেছিল কিশোরী। প্রথম জানিয়েছিল ওর নাম। কি যেন একটা ভালো নামও বলেছিল—তবে ওর ভেজা ঠোঁটদুটো প্রথম ওই দিনই ডাকনামে ডাকার স্বীকৃতিটুকু অন্তত দিয়ে দিয়েছিল আমায়। “তুমি আমায় ‘মৌটুসী’ বলেই ডেকো। বা আর একটু ছোট করে ‘মৌ’… কেমন? আমার কি মনে হয় জানোতো, এই ডাকনামটা আসলে এমনি এমনিই জুড়ে দেওয়া হয় না তোমার ভদ্র সভ্য আর একটা নামের পিছনে। এ আদুরে ডাকের মধ্যে যে কাছে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা, ভালোনামের সাথে তেমন সখ্যতা যেন কিছুতেই আর হয়ে ওঠে না।”

ও যখন এত কথা বলছে প্রথম ওই দিন, আমার তখন বৃষ্টির চোটে কানে তালা লাগার জোগাড়। কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। ‘মৌ’ নামটা যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইতে শুরু করেছিল সেই শুভ মুহূর্তেই, বোকা মনটা অবশ্য সেসবের কোনো হদিস রাখেনি তখন।

আজ যখন জানালায় বসে থাকা ওই মৌটুসীকে দেখি, ভাবি, হাত নেড়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করব। বলব, “তোমার মনে পড়ে সেই পুরোনো দিনের কথা? কত ছোট ছিলাম আমরা দুজনে তখন—রাখতাম না জমাট বাঁধা হিসেবের কোনো খাতা!”

খাতা অবশ্য আমাদেরও একটা ছিল। আকাশী নীল রঙের এক পাতলা সরু লাইনটানা খাতা। প্রথম যেদিন বেশ কিছু কাগজপত্রের মধ্যে ভরে কাকার সামনেই ও এগিয়ে দিল ওই খাতাটা, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আঙুলে আঙুল ছুঁলো, চোখে চোখ রেখে কত কথা হয়ে গেল যেন সঙ্গোপনে। সেই অপার্থিব অনুভূতি, আবেগ, জড়তা, কামনা, ইচ্ছা—সব মিলেমিশে সত্যিই যে ঠিক কি হয়েছিল আমার সেদিন, তাকে পূজা বলব না প্রেম—আজও আমি বুঝে উঠতে পারিনা। শুধুই কি শরীরীই ছিল ওই কৈশোরের নিয়মভাঙা হালচাল? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। সেদিনও ওর ওই মিষ্টি ডাকনাম, ওই খাতার লেখা দুলাইনগুলো “এই পাগল, আর যে কিছু ফটোকপি করার পাচ্ছি না, এবার বরং আমায় পাতা ভেবে ভরে দিও তোমার ওই বাবা আদমের যুগের জেরক্স মেশিনে”—অনেক বেশি দামী ছিল আমার কাছে ওর শরীরের চেয়ে। তবে বাঁশের কাঠামোকে মাটির থেকে আলাদা করার তেমন সাধ্যও কোনো বয়সেই আসলে ‘প্রেম’ নামক ওই অকালবোধনের থাকে না।

আসলে ভালোবাসার আর এক মানেই বোধহয় সমর্পণ। বা পুজো! কাশফুল, ঢাক, মন্ত্রোচ্চারণ, অঞ্জলি! নিজেকে ভুলে গিয়ে অন্যের মধ্যে অন্যের জন্যে বাঁচতে পারাই তো প্রেম। সত্যি বলছি, এ সম্পর্কের কিন্তু এযুগেও দেখতে গেলে—মন্দ ভালো হয় না।

আজও আমার ভালোবাসা কিন্তু একইরকম রয়েছে। আজও দুর্গাপুজোয় অঞ্জলির সময় যেরকম শিউলিফুল হাতে পেলে খুশিতে ভরে ওঠে মন, মৌটুসীর ঘামে ভিজে ওঠা মুখে এঁকে দেওয়া স্থির দৃষ্টিখানা দেখলে তেমনই প্রশান্তির স্পর্শে আবেগময় হয়ে উঠে করতে চাই নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ। তবু জানালার গরাদ ধরে থাকা আমার দেওয়া ডাকনাম ওয়ালা মৌটুসীকে আমি কিছুতেই ওই আকাশী খাতা থেকে চিরকুট ছিঁড়ে পাঠিয়ে বলতে পারব না, “মৌ, তোমায় ভালোবাসি। শুধু তোমার জন্যই আজও নিবেদিত এই অর্ঘ্যসম প্রাণ!”

কারণ? ওই আর কি, আমি তো সেদিনও জানতাম, আজও বুঝি, ‘মৌটুসী’ বলে কেউ নেই। কিছু হয় না। এ সবই আমার কল্পনা। আমিই সেদিনও ওকে প্রতিমার আদলে তেলরঙের বদলে ঘামে লেপে রূপ দিয়েছিলাম—আজও বিসর্জনের পরের ওই বিষণ্ণমনা মুখখানিতেও আমিই সযত্নে আঁকি প্রেমের তৃতীয় চোখ।

সবে যে মহালয়ার শুরু আজ, কিছুতেই যে আগামীর দোনামোনায় ভারাক্রান্ত হওয়া যায় না!

কি গো মৌটুসী, তৈরি তো, চক্ষুদান এর সময় হয়ে এলো যে! বোধনের যে আর খুব বেশি সময় বাকি নেই একদম!