শূন্য খনন - বুম বোস

মেঘ তোমায় আজ বড্ড প্রয়োজন জানো,

এই পরিত্যক্ত শ্মশানপুরী, এতো আমার দেশ নয়।

এখানে সবাই যেন মৃত, একটা বিশাল কবরের নিচে সবার বাস।

এখানে প্রতিবাদের প্রতিশব্দ রক্ত,লাল থকথকে রক্ত...

অবিশ্রান্ত আঘাতেরা, সে প্রখর রৌদ্র মেঘ,

বৃষ্টি চাই আগুন নেভাতে, মুষলধারে,কিংবা টিপ টিপ।

তোমার কাছে ভিজতে যাবো ইচ্ছে খুব,

আচ্ছা, মৃত্যুকে কি পেরিয়ে যাওয়া যায়!

 

মৃত্যু সে যে ভীষণ কাঁটাতার, তোমার আমার দেশের মাঝে মৃত্যু থাকে মেঘ, সংসার পেতেছে বহুদিন।

আমাদের আর সংসার পাতা হলো না।

তবুও যখন এই শরীরে বৃষ্টি হয় মন উজাড় করে,

তখন তুমি আমার ঠিক পাশে শুয়ে থাকো, খালি গায়ে।

মাথার, বুকের চুল গুলো এলোমেলো,

ঠিক আমার মত, আমার মতই লেগে থাকে ওরা তোমার শরীরে সারাদিন।

 

তবুও হয়তো চলে যেতে হয় কখনো কখনো, নীরবে, একলা, বৃষ্টিছাড়া হয় মেঘ, সৃষ্টিছাড়া হয় বৃষ্টি।

 

কিন্তু আমি থামবো না, ভাঙবো না, মাথা নিচু করে যে বাঁচতে শিখিনি মেঘ, তার চেয়ে মাথা উঁচু করে মৃত্যু অনেক শ্রেয়।

 

শুধু মনে রেখ দূর দেশে এক অভাগী তোমায় ভালোবাসতো, পাগলের মত...

 

যদি ফিরে আসা যায় আবার, তবে সেবার ফিরবো এক নাম না জানা পাখি হয়ে,

 

তখন তোমার কাছে যাবো রোজ,

আকাশে যে কাঁটাতার থাকে না।

 

সায়ন খান সোহাগ

(১)

“ভালোবাসা... কী বলতো ভালোবাসা? একটা বিশাল বড়ো শূন্য, এই এত্তবড়।

“শূন্যের সাথে যাই গুণ করিস, তা নিজেও শূন্য হয়ে যায়। আ বিগ, রাউন্ড জিরো।

“কিন্তু আমরা হলাম গিয়ে এক একটা শুয়োরের বাচ্চা, কিংবা বলতে পারিস কুত্তার বাচ্চা... নাহ, আমরা তো শালা মানুষের বাচ্চা!! ছিঃ.. এত্তবড় গালাগালি গায়ে সেঁটে জন্মেছি… ওয়াক, থুঃ।

“মানুষ গুলো সব জেনে শুনেও শুধু শূন্য হতে চায়। পাক্কা মানুষের বাচ্চা যে সবকটা...” হাত-পা নেড়ে বকবক করতে করতে বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁদিকের মাঠের দিকে হাঁটা দিল মাস্টার পাগলা। রোজ সকাল বিকেল একবার করে বাস স্ট্যান্ডে আসে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ভালোবাসা যে আসলে কী, তা মানুষের বাচ্চাদের বোঝানোর চেষ্টা করে। ছোটবেলা থেকে দেখছে ও লোকটাকে। মায়ের হাত ধরে যখন স্কুল যেত দীপ্ত তখনও লোকটা এভাবেই বাস স্ট্যান্ডে এসে হাতপা নেড়ে বকবক করতো। তখন লোকটা কী বলতো, কেন বলতো কিছুই বুঝতো না দীপ্ত। তবে এখন একটু একটু বোঝে, বোঝে যে লোকটার বুকে কোথাও একটা প্রচণ্ড ক্ষত আছে, যেটা হয়তো শুকোয়নি আজও।

আজকাল আর মাস্টার পাগলার কথাগুলো যুক্তিহীন লাগে না ওর।

অনেকদিন আগে দীপ্ত মায়ের কাছে শুনেছিল কোন এক মেয়েকে ভালোবেসে নাকি এমন পাগল হয়ে গেছিল লোকটা।

একসময় এলাকার নাম করা টিউশন মাস্টার ছিল, আর আজ নাকি এলাকার নামকরা পাগল... হাসলো দীপ্ত।

কাউকে ভালোবেসেও মানুষের এমন অবস্থা হতে পারে?

দীপ্তর খুব ইচ্ছে হয় মাস্টার পাগলার গল্পটা জানতে, ইচ্ছে করে জানতে ঠিক কতটা ভালোবাসলে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে সব কিছু।

ভাবতে ভাবতেই আনমনে আকাশের দিকে তাকালো ও। আকাশটা হঠাৎ ভীষণ কালো করে এসেছে। ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছে মাথার চুল গুলো। ঝিরিঝিরি কিংবা মুষলধারে শহরে আসছে বৃষ্টি। ভেজার ভয়ে সবাই এদিক ওদিক ছুটছে, কেউ কেউ আগেভাগেই আশ্র‍য় নিচ্ছে রাস্তার ধারের দোকানগুলোর ছাউনির নিচে।

দূরে মাঠের ধারে এক অচেনা প্রেমিকা নিজের ওড়না দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে তার প্রেমিকের মাথা।

তবুও, সবার সব প্রতিরোধ উপেক্ষা করে মুচকি হেসে বৃষ্টি হানা দিল শহরের বুকে।

দীপ্ত বাসস্ট্যান্ডের ছাউনি ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। ও ভিজতে ভয় পায়না। ভিজতে ওর ভালোই লাগে। ও দু’হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিকে ধেয়ে আসতে দিল নিজের সারা শরীরে।

বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটায় এক অদ্ভুত ভালোলাগা মিশে থাকে, তাদের পূর্ণ আস্বাদন ওই দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে সম্ভব না।

ভিজতে ভিজতেই আবার ওর চোখ গেল মাঠের দিকে। স্কুল ফেরত কয়েকটি ছেলে একটা ফুটবল নিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে। কাদা মেখে শুরু হয়ে গেছে খেলা। লেফট উইংগে ওর দৌড়টা আরেকবার ঝালিয়ে নিতেই দীপ্ত জিন্সটা হাঁটু অবধি গুটিয়ে নিল। তারপর ছুট্টে গেল নিজের শৈশবটাকে আরো একবার ছুঁয়ে দেখতে।

(২)

“আলু পোস্তটা কেমন হয়েছে বললিনা তো বাবু!” মায়ের কথায় সম্বিৎ ফিরলো দীপ্তর। ও হেসে বলল, “দারুণ হয়েছে মা। তোমার হাতে জাদু আছে।”

“থাক থাক, জিগ্যেস না করলে তো বলিসও না...” মা মুখ ব্যাঁকালো।

“সত্যি গো মা, সত্যি খুব ভালো হয়েছে, আর পটলের ঝালটা তো যাস্ট ফাটাফাটি।” দীপ্ত খেতে খেতে বলল।

“বুঝলাম। কয়েকদিন ধরেই দেখছি তোকে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। কিছু হয়েছে নাকি?” মা জিগ্যেস করলো।

“কিছু হয়নি মা। আচ্ছা মা তোমার মাস্টার পাগলার কথা মনে আছে?” দীপ্ত পালটা প্রশ্ন করলো।

“হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন! কিন্তু হঠাৎ ওর কথা জিগ্যেস করছিস, কী ব্যাপার?”

“তুমি অনেক দিন আগে বলেছিলে যে লোকটা নাকি কোন একটা মেয়েকে ভালোবেসে এমন পাগল হয়ে গেছিল। ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল আমায় একটু ডিটেলসে বলতে পারবে?” ছেলে হঠাৎ মাস্টার পাগলার কথা জিগ্যেস করছে দেখে মা কিঞ্চিৎ অবাকই হলেন। তারপর এঁটো থালাবাসন গোছগাছ করতে করতে বললেন, “আমি তো আর সব জানি না। ওই তোর বাবার কাছেই শুনেছিলাম যে লোকটা নাকি একসময় এলাকার নামকরা টিউশন মাস্টার ছিল। কোন এক বাংলাদেশি লেখিকাকে ভালোবাসতো। তখন তো আর তোদের মতন ফেসবুক, হয়াটস্যাপ ছিল না, ওই চিঠিতেই যোগাযোগ থাকতো।

“একদিন পেপারে খবর বেরোয় যে, ওই লেখিকাকে নাকি কেউ বা কারা খুন করেছে। তারপর থেকেই লোকটা অমন হয়ে যায়।” মা একটানা বলে থামল। এদিকে দীপ্তর কৌতূহল বেড়েই চলেছে।

“আচ্ছা ওই লেখিকা কি খুব পপুলার ছিলেন? কী নাম ওনার?” ও আবার জিগ্যেস করলো।

“আমার তো অত মনে নেই বাবু, তোর বাবা ফিরলে জিগ্যেস করিস, তোর বাবা ভালো বলতে পারবে।” সত্যিই তো, এই কথাটা দীপ্তর মাথায় আগে এলোনা কেন! বাবা তো একসময় চুটিয়ে সাহিত্যচর্চা করেছে, লেখালেখিও করেছে বিস্তর। দীপ্ত ঠিক করলো আজ রাতেই বাবাকে জিগ্যেস করবে কথাটা।

(৩)

রাতে বাবা ফিরতেই নিজের প্রশ্নের লাইনআপটা আরেকবার ঝালিয়ে নিল দীপ্ত। তারপর বাবার স্নান খাওয়া শেষ হতেই বাবার ঘরে ঢুকলো ও। বাবা বিছানায় শুয়ে পেপার পড়ছিল, ওকে দেখে নড়েচড়ে বসলো।

“কী রে তোর মোবাইলটা খারাপ হয়ে গেল নাকি?” দীপ্ত অবাক হয়ে বলল, “কইতো না তো, বেশ চলছে।”

“না হঠাৎ এই সময় আমায় মনে পড়লো তোর, তাই ভাবলাম...” বাবা হাসলো।

“বাবা তুমি ইয়ার্কি করো না, আমি একটা সিরিয়াস কথা জিগ্যেস করবো বলে এসেছি।”

“আচ্ছা বল কী বলবি।”

“বলছি মাস্টার পাগলা যে বাংলাদেশি লেখিকাকে ভালোবাসত তার নামটা কী?”

ছেলের প্রশ্ন শুনে বাবার মুখটা পালটে গেল। খানিকটা বিস্ময় সূচক দৃষ্টিতেই বাবা বললেন, “তুই হঠাৎ মাস্টার পাগলার কথা জিগ্যেস করছিস কেন? কিছু হয়েছে?”

“না না, কী আবার হবে? এমনি কৌতূহল।”

“হুম। বুঝলাম।” বলেই বাবা শুরু করলো, “আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। সেই সময় বাংলাদেশে এক নতুন লেখিকা একাই সাহিত্য জগৎ দাপিয়ে বেরাচ্ছিলেন, নাম ‘সায়ন খান সোহাগ’। তৎকালীন বাংলাদেশের এক বিখ্যাত পত্রিকায় তার প্রথম উপন্যাস বেরোতেই তা একদম সুপার ডুপার হিট। যথারীতি লেখিকা দুই বাংলাতেই চর্চায় চলে এলেন। তারপর আস্তে আস্তে তার উপন্যাস সমগ্র, কবিতা সমগ্র, সিঙ্গেল বই সবই বেরোলো। এতটাই পপুলার ছিলেন যে সেই সময় এপার বাংলার বিখ্যাত সব পত্রিকাতেও তার লেখা ছেপেছিল।

একবার এক সাহিত্য সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে কোলকাতায় আসেন সোহাগ, আর সেখানেই তার আলাপ হয় মেঘনীলের সাথে।”

“মেঘনীলটা কে?”

“মাস্টার পাগলাই হলো মেঘনীল।”

“আচ্ছা। তারপর কী হলো?”

“বইয়ের পাতায় অটোগ্রাফ নেওয়া থেকে যে সম্পর্কের শুরু, তা শেষ পর্যন্ত প্রেম অবধি গড়ালো। শুনেছি দুজনেই দুজনকে পাগলের মত ভালোবাসত।”

“তারপর কী হলো?”

“তারপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু টালমাটাল হতে শুরু করলো, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাও দেখা দিল দেশে। আর সেই প্রসঙ্গেই বদলাতে শুরু করলো সোহাগের কলম। ক্রমেই সে হয়ে উঠছিল প্রতিবাদী। ভেবেছিল কলমের খোঁচায় বদলে দেবে সব...!

“কিন্তু পারেনি সে, একদিন সকালে উঠে পেপারে দেখলাম সে নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নৃশংস ভাবে রাস্তার মাঝে খুন করা হয়েছিল সায়ন খান সোহাগকে।

“শুনেছিলাম মৃত্যুর ঠিক আগে ওনার যে শেষ বইটা বেরিয়েছিল, সেটা নাকি মেঘনীলের জন্যই লিখেছিলেন।” বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“ওই বইটা আছে বাবা তোমার কাছে?”

“নারে। তবে অন্য বই গুলো ছিল, কিন্তু সেসব এখন কোথায় আছে, আদৌ আছে কি-না, জানি না।”

“তুমি এত সব কী করে জানলে বাবা?”

“এই ঘটনা নিয়ে তখন বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল রে, পেপারে, পত্রপত্রিকায়। তাছাড়া মেঘনীলকে তো নিজের চোখেই দেখেছি সবটা হারাতে।”

বাবার কাছে সবটা শোনার পর মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল দীপ্তর। একটা অদ্ভুত খারাপলাগা চেপে ধরলো ওকে। ও ছুট্টে চলে গেল ছাদে। রাতের অন্ধকার আকাশে টিপটিপ করে জ্বলছে লক্ষ লক্ষ তারা। ওই দূরে বাসস্ট্যান্ডে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে তারাদের মাঝে হয়তো মেঘনীল খুঁজছে তার সোহাগকে। আচ্ছা, সোহাগকে কি সে এখনো পায়?

বহুদিন আগে দীপ্ত কোথায় যেন একটা পড়েছিল যে,

“পাশে থাকার জন্য খুব একটা কাছাকাছি থাকার প্রয়োজন হয়না,

নয় দশমিক দুই চার আলোকবর্ষ দূরে থেকেও ভালোবাসা যায়,

শুধু দরকার অভিস্রবণের ইচ্ছেটুকু।”

(৪)

“ওনার লেখা এই দুটো বই আছে আমাদের কাছে।” বলেই দোকানদার টেবিলে সায়ন খান সোহাগের ‘উপন্যাস সমগ্র’ আর ‘কবিতা সমগ্র’ বই দুটো রাখলেন। দীপ্ত বই দুটো উলটে পালটে দেখে বলল,” ওনার শেষ বইটা কি তাহলে কোত্থাও পাবো না?”

“দেখুন প্রথমত আপনি বইয়ের নাম জানেন না, তাছাড়া বইপাড়ায় আমাদের দোকানে যে বই পেলেন না সেই বই অন্য কোথাও পাওয়ার চান্স খুব কম।” মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের ঠোঁটে বেশ চওড়া একখান গর্বের হাসি খেলে গেল। তিনি আরো বললেন, “এই সমগ্র দুটোও আপনি অন্য কোনো দোকানে পাবেন না, খুব রেয়ার কালেকশন এগুলো।”

“আচ্ছা এই দুটো দিয়ে দিন।” লোকটা বই দুটো পেপারে মুড়ে, একটা পলিথিনে করে দীপ্তর হাতে দিলেন। দীপ্ত বই দুটো নিয়ে দোকান থেকে বেরোতে যাবে ঠিক তখনি ভদ্রলোক ডাকলেন দীপ্তকে।

“বলছি একটা ছোট্ট ইনফর্মেশন আপনাকে দিতে পারি।”

“বলুন।”

“এই লেখিকার সমস্ত বই বাংলাদেশের বঙ্গবাণী বলে এক প্রকাশনী ছাপাতো। লেখিকা মারা যাওয়ার পর সেই প্রকাশনীর অনেক বই বাংলাদেশে ব্যান হয়ে যায়, আর প্রকাশনীরও লালবাতি জ্বলে যায়। তখন ওই প্রকাশনীর মালিক তাপস কিরণ দত্ত স্বপরিবারে কোলকাতায় চলে আসেন। এখানে এসেও প্রকাশনা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বেশি দিন টানতে পারেননি। উনি হয়তো এখন আর বেঁচে নেই... এই ওনার ঠিকানা। ওনার পরিবারের কেউ যদি এখনো এই ঠিকানায় থেকে থাকেন, তবে আপনি কিছুটা হলেও সাহায্য পেতে পারেন।” লোকটা একটানা বলে থামলো।

দীপ্ত হাতজোড় করে বলল, “অনেক ধন্যবাদ কাকু, এই ইনফর্মেশনটা দেওয়ার জন্য।” বলেই দীপ্ত দোকান থেকে বেরিয়ে এল। তারপর হাতের চিরকুটটা দেখলো শ্যামবাজারের ঠিকানা। ও ঠিক করলো আজ বিকেলেই এই ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ খবর করবে।

(৫)

“কাকে চাই?”

“তাপস কিরণ বাবু?”

“উনি অনেক দিন হলো মারা গেছেন।”

“না, আমি জানি। আসলে আমি ওনার পরিবারের কেউ থাকলে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই। খুব দরকার।”

“ভেতরে আসুন।” দীপ্ত বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। বাড়িটা টিপিকাল উত্তর কোলকাতার বাড়ি যেমন হয় ঠিক তেমনই। সেই বিশাল আকৃতি, বড়ো বড়ো জানলা, চুন খসানো দেওয়াল, সরু গ্রিল ঘেরা ঝুল বারান্দা। সব মিলিয়ে একদম উপন্যাসের মত। দীপ্ত ভেতরে এসে বেতের সোফায় বসল। এবার সেই মেয়েটি বলল, “আমি ওনার মেয়ে, তন্নিষ্ঠা দত্ত। যা বলার আপনি আমায় বলতে পারেন। দীপ্ত তখন প্রথম থেকে যা যা ও জানে সবটা তন্নিষ্ঠাকে বলল। তন্নিষ্ঠা সবটা শুনে হেসে বললেন, “আপনি বোধহয় নিজের এবং আমার দুজনের সময়ই নষ্ট করছেন দীপ্ত বাবু।”

“কেন, আপনার কি মনে হয় ভালোবাসা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই?”

“অবশ্যই আছে। কিন্তু আপনি যে ভালোবাসার কথা বলছেন তেমন ভালোবাসা ওই গল্প উপন্যাস, কবিতাতেই হয়, বাস্তবে না।”

দীপ্ত হেসে বলল, “তাহলে বোধহয় আপনাকে সেই ভাবে কেউ ভালোবাসেনি কখনো। তাই হয়তো আপনার এই ভাবনা।”

“আপনি পেয়েছেন অমন ভালোবাসা?”

“নাহ। তবে আমার বিশ্বাস আমাকেও কেউ একদিন এভাবেই ভালোবাসবে।” দীপ্ত উঠে পড়লো। তারপর একটা কাগজে নিজের ফোন নাম্বারটা লিখে দিয়ে বলল, “কখনো যদি মনে হয় সাহায্য করবেন, তাহলে এই নাম্বারে একটা কল করে নেবেন। ধন্যবাদ।” বলেই সেখান থেকে চলে আসে দীপ্ত। মাথাটা খুব ধরেছে। কিছুটা হেঁটেই সামনে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো ও। দোকানে একটা চা বলে দোকানের বেঞ্চিটায় বসলো। পকেট থেকে রুমালটা বার করে মুখের ঘামটুকু মুছে নিল। তারপর সামনে দাঁড়ানো দুটো ছেলেমেয়ের কথপোকথন শুনতে লাগলো আনমনে।

“কী কিপটে রে তুই!”

“কেন আবার আমি কী করলাম?”

“কোথায় একদিন একটু সিসিডি তে কফি খাওয়াবি তা না, রোজ এই মাটির ভাড়ে চা।”

“এই মাটির ভাড়ের চায়ে যে নস্টালজিয়া আছে, তা কি আর ওই সিসিডি তে পাবি?”

“থাক আর ছেলে ভোলানো কথা বলতে হবে না।”

“গাধি আমার।” ছেলেটা মেয়েটার নাকটা টিপে দিল। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠলো।

“আচ্ছা আমরা আজ কোথায় যাব?”

“যেদিকে দুচোখ যায়।”

“তাই...! তা কীভাবে যাবো?”

“কেন আমার এই স্পেসশিপটা চোখে পড়ছে না তোর?”

“স্পেসশিপ না হাতি! ঝরঝরে ভাঙা সাইকেল।” মেয়েটা মুখ ভ্যাঙালো।

“তাতে কী? ক্যারিয়ার আছে, তুই আছিস। খালি তুই পেছনে বসলেই...”

“আমি পেছনে বসলেই কী?”

“এই পথ যদি না শেষ হয়,

তবে কেমন হত তুমি বলো তো?”

(৬)

“আপনি যে এখানে আসবেন আমি এক্সপেক্ট করিনি।” দীপ্ত বলল।

তন্নিষ্ঠা হেসে বলল, “আমিও না। কিন্তু পরে মনে হল আপনার বিশ্বাসটা একবার যাচাই করে দেখা দরকার। তাই ফোন করে চলে এলাম।”

“তাহলে বিশ্বাস হলো তো এবার?”

“আপনি শিওর যে ওই লেখিকার মৃত্যুই ওনার এই অবস্থার কারণ?”

“একশ শতাংশ। আমি আরো খোঁজ খবর করেছি। মেঘনীলের নিজের বলতে কেউ ছিল না। বাবা মা, ভাই বোন কেউ না। থাকার মধ্যে ছিল ওই একজন, সোহাগ। সেও যখন আর রইলো না...” মাথাটা নিচু করে নিল দীপ্ত।

“আপনি বেশ ভালো মতই জড়িয়ে পড়েছেন দেখছি। এত আবেগপ্রবণ হবেন না দীপ্ত বাবু। পরবর্তী কালে গিয়ে নিজেই কষ্ট পাবেন।” দীপ্ত মৃদু হেসে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।

“তাহলে আপনি আমায় সাহায্য করবেন তো?”

“দেখুন আমার ভাসা ভাসা ভাবে যতদূর মনে আছে আমরা যখন বাংলাদেশ থেকে কোলকাতা চলে আসি তখন সব বই সেখান থেকে আনতে পারিনি। সেটা হয়তো সম্ভবও ছিল না, তবে বেশকিছু বই আনাও হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে পাওয়া গেলেও যেতে পারে।”

“তাহলে কবে যাবো?”

“আজই আসুন বিকেলে। বইয়ের ঘরটায় বহুদিন আমি যাইনি। দুজনে মিলে খুঁজবো।”

“আচ্ছা, আজ বিকেল পাঁচটায় আমি পৌঁছে যাব তবে।” দীপ্ত বলল।

“তাহলে আমি আসি আজ?” তন্নিষ্ঠা বললেন।

“চলুন আমি আপনাকে মেট্রো স্টেশন অবধি এগিয়ে দিই।”

পুরাতন ধূলোচাপা ভালোবাসা খুঁজছে ওরা। আবেগ, স্মৃতি, কষ্ট, মৃত্যু সব খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে হবে ওদের। যদি কোথাও পাওয়া যায় মেঘের জন্য রাখা এক চিলতে প্রেমের ক্রোড়পত্র!

(৭)

“পেলেন কিছু?”

“ধুর মশাই! এদিকে ধুলোয় হাঁচতে হাঁচতে প্রাণ যাওয়ার উপক্রম আর আপনি খালি পেয়েছেন পেয়েছেন করছেন! অদ্ভুত! পেলে কি আমি লুকিয়ে রাখবো নাকি?”

“আহা রাগছেন কেন? ভালো করে খুঁজুন, ঠিক পাবেন। আর শুনুন সোহাগ মারা গেছিলেন ১৯৯৬, সুতরাং বইটার প্রথম মুদ্রণ ১৯৯৫-৯৬ সাল হবে সম্ভবত। এটা খেয়াল রাখবেন তাহলে খোঁজা সহজ হবে।” বলেই দীপ্ত আবার খোঁজায় মন দিল। ঘরের সমস্ত তাক তন্নতন্ন করে খুঁজলো ওরা। উপন্যাস সমগ্র, কবিতা সংকলন, ছোটদের গল্প সংকলন সব পাওয়া গেল কিন্তু যে বইটা ওরা খুঁজছে সেটা পাওয়া গেল না। শেষে একটা ভাঙা আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। তন্নিষ্ঠা রুমালে নাক মুছতে বললেন, “এখানে কিছু পুরানো বই আছে। এটাই শেষ আশা, এখানে পেলে ভালো, নইলে আপনার কপাল খারাপ।”

ওরা দুজনে আলমারিটা খুঁজতে শুরু করলো। বইপত্র ঘাটতে ঘাটতে আচমকা দীপ্ত হাত ছুঁয়ে গেল তন্নিষ্ঠার হাতে। দীপ্ত চমকে সরিয়ে নিল নিজের হাত। তন্নিষ্ঠা বড় বড় চোখ করে দীপ্তর দিকে তাকালো একবার, তারপর মুচকি হেসে আবার মন দিল খোঁজায়।

দীপ্ত আলমারির ওপরের দিকটা হাতড়াতে গিয়ে একদম কোণ থেকে একটা পাতলা পেপার-ব্যাক বই পেল। ধুলো-টুলো ঝেড়ে আলোয় নিয়ে গিয়ে দেখলো,

“শূন্য”

(কবিতা সংকলন)

সায়ন খান সোহাগ

দীপ্ত বইয়ের মলাটটা ওলটালো।

প্রথম মুদ্রণ : ১৪ই নভেম্বর, ১৯৯৫।

দীপ্ত পাতা উলটে গেল পরের পাতায়। সেখানে লেখা,

মেঘ কে,

“মেঘ তোমায় আজ বড্ড প্রয়োজন জানো,

এই পরিত্যক্ত শ্মশানপুরী, এতো আমার দেশ নয়।

এখানে সবাই যেন মৃত, একটা বিশাল কবরের নিচে সবার বাস।

এখানে প্রতিবাদের প্রতিশব্দ রক্ত,লাল থকথকে রক্ত...

অবিশ্রান্ত আঘাতেরা, সে প্রখর রৌদ্র মেঘ,

বৃষ্টি চাই আগুন নেভাতে, মুষলধারে,কিংবা টিপ টিপ।

তোমার কাছে ভিজতে যাবো ইচ্ছে খুব,

আচ্ছা, মৃত্যুকে কি পেরিয়ে যাওয়া যায়!

 

মৃত্যু সে যে ভীষণ কাঁটাতার, তোমার আমার দেশের মাঝে মৃত্যু থাকে মেঘ, সংসার পেতেছে বহুদিন।

আমাদের আর সংসার পাতা হলোনা।

তবুও যখন এই শরীরে বৃষ্টি হয় মন উজাড় করে,

তখন তুমি আমার ঠিক পাশে শুয়ে থাকো, খালি গায়ে।

মাথার,বুকের চুল গুলো এলোমেলো,

ঠিক আমার মত, আমার মতই লেগে থাকে ওরা তোমার শরীরে সারাদিন।

 

তবুও হয়তো চলে যেতে হয় কখনো কখনো, নীরবে, একলা, বৃষ্টিছাড়া হয় মেঘ, সৃষ্টিছাড়া হয় বৃষ্টি।

 

কিন্তু আমি থামবো না, ভাঙবো না, মাথা নিচু করে যে বাঁচতে শিখিনি মেঘ, তার চেয়ে মাথা উঁচু করে মৃত্যু অনেক শ্রেয়।

 

শুধু মনে রেখ দূর দেশে এক অভাগী তোমায় ভালোবাসতো, পাগলের মত....

 

যদি ফিরে আসা যায় আবার, তবে সেবার ফিরবো এক নাম না জানা পাখি হয়ে,

 

আকাশে তো আর কাঁটাতার থাকে না।”

 

সায়ন খান সোহাগ

 

আনন্দে চোখের কোলে জল চলে এল দীপ্তর। ওর খোঁজ সফল হয়েছে শেষ পর্যন্ত। ও চেঁচিয়ে বলল, “তন্নিষ্ঠা, এই দেখুন পেয়েছি। বলেছিলাম না পাবো, এই দেখুন।”

তন্নিষ্ঠা বইটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখল, সাথে আরো দেখলো দীপ্তর চোখের জল।

দীপ্তর হাতে বইটা দিয়ে বলল, “তাহলে এবার আপনি খুশি তো?”

“খুব খুশি, খুব।” তন্নিষ্ঠা হাসলো।

“আচ্ছা আমি এখন যাই বুঝলেন।” দীপ্ত উঠে পড়লো।

“কোথায় চললেন?”

“বইটা মেঘনীল কে দিতে হবে তো।”

“আচ্ছা যান। আর শুনুন, আমায় ভুলে যাবেন না কিন্তু, সব ঠিক থাকলে আমাদের আবার দেখা হবে।”

“নিশ্চয়ই হবে।” দীপ্ত ছুটে বেরিয়ে এল বইয়ের গুদাম ঘরটা থেকে। তন্নিষ্ঠাও এলো পেছনে।

“দীপ্ত....”

“হ্যাঁ বলুন…”

“আমি কিন্তু তোমায় ভুলবো না কক্ষনো।”

“আমিও ভুলবো না তোমায়, কথা দিলাম।”

(৮)

দীপ্ত মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে জোর পায়ে হাঁটতে লাগল পাড়ার বাসস্ট্যান্ডটার দিকে। মিনিট দশেক লাগে মেট্রো স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু আজ যেন রাস্তাটা শেষই হতে চাইছে না।

আরো খানিকটা হনহনিয়ে হাঁটার পর ও পৌঁছে গেল বাস স্ট্যান্ডে। কিন্তু এ কী এত লোক জড় হয়েছে কেন এখানে? পুলিশের গাড়িও চোখে পড়লো ওর। ও আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে এলো। “দেখি দাদা একটু সরুন। কী ব্যাপার দাদা কী হয়েছে এখানে?” বিস্তর ঠেলাঠেলির পর দীপ্ত একদম সামনেটায় চলে এল। এসে দেখলো মেঘনীল চোখ বুজে অঘোরে ঘুমচ্ছে।

পাশের লোকটাকে জিগ্যেস করতে সে বলল, “কী আবার হবে? পাগলাটা মরেছে। সেই দুপুর থেকে একইভাবে শুয়ে ছিল। লোকজন ডাকাডাকি করতেও ওঠে না। শেষে ডাক্তার সুমন এসে দেখে দুখে বলল টেঁশে গেছে।”

লোকটার কথা শুনে থমকে গেল দীপ্তর সবটা। হাতের বইটার দিকে তাকালো ও। মেঘনীলের জন্য রাখা সোহাগের শেষ স্মৃতিটুকু আজ ও খুঁজে এনেছিল তার জন্য। আর একটু অপেক্ষা করতে পারলো না মেঘনীল, আর একটু!!! এত্ত বছর বাঁচলো, আর কয়েক মূহুর্ত বাঁচতে পারলো না মানুষটা! কান্নায় ভেঙে পড়লো দীপ্ত। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিথর মেঘনীলের দিকে। মেঘনীলের বুকের ওপর আলতো করে রাখলো বইটা।

আকাশটা আবার আজ কালো করে এসেছে। বৃষ্টি আবার আসছে শহরে। তা আসুক, শেষবারের মত ছুঁয়ে যাক তার মেঘকে।

মেঘনীলের সমস্ত কথাগুলো আজ ভীষণ সত্যি বলে মনে হলো দীপ্তর।

সত্যিই ভালোবাসা মানে এক বিশাল বড় শূন্য, আ বিগ রাউন্ড জিরো।

যার সাথে গুণ হতে হলে নিজেকেও শূন্য হয়ে যেতে হয়।