বোমাতঙ্ক - অনন্যা দাশ

অলংকরণ - প্রতিম দাস

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে যদি গোটা দিনের একটা আভাস পাওয়া যেত তাহলে দূর্বা হয় তো সেদিন বিছানা ছেড়ে উঠতই না! কিন্তু আভাস সে পায়নি তাই ভোর পাঁচটায় বিছানা ছেড়ে ছিল। ঠিক সাতটায় বড় মেয়ে মিহিকার হাই স্কুলের বাস আসে। বড় মানে সে বয়সেই বড়, তাকে ঘুম থেকে তুলে, জলখাবার খাইয়ে, চুল বেঁধে স্কুলে পাঠানো সব দূর্বাকেই করতে হয়। তাই দু ঘন্টা আগে থেকে প্রস্তুতি। মিহিকার বাস চলে যেতে ছোট মেয়ে ঋষিকাকে নিয়ে শুরু হল। ওর বাস আসে সাড়ে আটটা নাগাদ। তারপর স্বামীর বেরবার পালা। রোজ সকালে চলে এই যুদ্ধ। বিশ্বজিৎ অফিসে গেলে তারপর দু দণ্ড নিশ্বাস নেওয়ার সময় পায় দূর্বা। তেরো বছর হল মার্কিন মুলুকে এসেছে সে। বিয়ের পর একটা বছর হায়দ্রাবাদে ছিল। মিহিকার জন্মের পরই এখানে চলে আসে। তারপর থেকে নর্থ ক্যারোলাইনার এই ছোট্ট শহরটাতেই রয়েছে ওরা। নিজেদের গাড়ি বাড়ি সব হয়েছে। প্রথম প্রথম দূর্বা ভাবত চাকরি করবে। দু একটা কোর্সও করেছিল কিন্তু তারপর ঋষিকার জন্মের পর আর ও পথ মাড়ায়নি। এমনিতেই এখানে কাজের লোকের অভাব, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই নিজে নিজে করতে হয়। স্বামী আর দুই মেয়ের সব বায়নাক্কা সহ্য করার পর আবার বাইরের এক গাদা লোকের ম্যাও সামলাবার মতন ইচ্ছে থাকে না মোটেই। তাই চাকরি বাই বাই। এখানকার ভাষায় হোমমেকার হয়ে গেছে দূর্বা।

সেদিনটা আর পাঁচটা দিনের মতনই শুরু হয়েছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর ওয়াশিং মেশিনটা চালিয়েছিল দূর্বা। ফোনে মার সাথে কিছুক্ষণ কলকাতার শাক সব্জির মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে কথা হল। দুপুরে একটা রুটি, একটু তরকারি আর স্যালাড খেয়ে কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিল সে। মেয়েরা ফিরলেই তো আবার শুরু হবে হোমওয়ার্ক নিয়ে ধস্তাধস্তি।

মিহিকা ফিরে এসে দুটো মুখে গুঁজেই সেল ফোন নিয়ে বন্ধুকে ফোন করতে বসল। বিরক্ত হল দূর্বা কিন্তু কিছু বলল না। ঋষিকা ফিরুক তারপর বলবে। বোনের সামনে বকুনি খেলে কাজ হয় বেশি। ঋষিকার বাস আসার জন্যে বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়াল সে। বাস থেকে নেমেই ভারি ব্যাগটা মাকে ধরিয়ে দিল ঋষিকা যেমন রোজ করে।

“আমার আজকে খিদে পাচ্ছে না।

“সেটা আর নতুন কী? কোনদিনই তো পায় না!”

ঋষিকার বরাবরি খাওয়া নিয়ে খুব ফ্যাচাং!

“না সত্যি! লেক্সির জন্মদিন ছিল। ওর মা কাপকেক এনেছিলেন।

“ও!” লেটার বক্স থেকে চিঠিগুলো বার করতে করতে দূর্বা বলল। এক গাদা জাঙ্ক মেইল। কিছু বিল আর একটা মোটা খাম।

বাড়িতে ঢুকে সব কিছু টেবিলে রেখে ঋষিকাকে নিয়ে পড়ল দূর্বা, “তুমি সত্যিই কিছু খাবে না?”

“না, না!”

“ঠিক আছে যাও তাহলে হাত মুখ ধুয়ে এসো। দিদির সঙ্গে ঝগড়া করবে না।”

“আমি কোথায় করি, ওইই তো করে!”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব আমার জানা আছে!”

ঋষিকা যেতে চিঠিগুলো নিয়ে বসল দূর্বা। মোটা খামে আবার কী রয়েছে? খামের উপরে যার কাছ থেকে এসেছে তার একটা নাম আর মন্টানার একটা ঠিকানা দেওয়া, নামটা বেশ উদ্ভট! বিশ্বজিতের নামেই এসেছে প্যাকেটটা। খুলব কি খুলব না ভেবে খুলেই ফেলল দূর্বা। ও মা! ভিতরে একটা সেল ফোন। মানে অনেক পুরনো নোকিয়ার একটা কালো ফোন। সেই রকম মডেলের ফোন আজকাল আর কেউ ব্যবহার করে না! ফোনটা যে বেশ পুরনো সেটা বোঝা যাচ্ছে, সারা গায়ে আঁচড়! চমকে উঠল দূর্বা! নির্ঘাৎ বোমা! ঋষিকা এসে দাঁড়িয়েছে কাছে, পিছনে মিহিকা।

“ওটা কী মা?”

“একদম হাত দিও না! বোমা হতে পারে!”

“ও মাই গড!”

বিশ্বজিৎকে অফিসে ফোন করল দূর্বা।

“অ্যাঁ! ফোন! এক্ষুনি ওটাকে আবার মেইল বক্সে রেখে এস! দেখো ভুলে কোন বোতাম টোতাম টিপে ফেল না তাহলেই কেলেঙ্কারি হবে!”

জিনিসটাকে কোন রকমে আলতো করে ধরে আবার বাইরের লেটার বক্সে রেখে দিয়ে এল দূর্বা।

“মা এই দেখ!”

মিহিকা ততক্ষণে ফেসবুকে যে পাঠিয়েছে তাকে খুঁজে বার করে ফেলেছে! একটা সুন্দরী মেয়ে! ফেসবুকের ছবিটাতেও সে একটা রিভিলিং জামা পরে রয়েছে!

“বন্ধ করো এখুনি ওটা!”

ফোনটা বাজছে। দূর্বা তুলল, বিশ্বজিৎ।

“আমি আমার অফিসের কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। তুমি এক্ষুনি পুলিশে খবর দাও। আমি রওনা হচ্ছি! কারণ ওই জিনিসটা লেটারবক্সে ফাটলেও তো আমাদের প্রচুর ক্ষতি হবে!”

মিহিকা-ঋষিকা বেশ ভয় পেয়েছে!

“কী হবে মা?”

“তোমরা একটু চুপ করে বসো। পুলিশে খবরটা দিই।”

নন এমারজেন্সি বলে পুলিশকে খবর দিতেও মিনিট দশেকের মধ্যে দু’জন এসে হাজির।

প্রচুর প্রশ্ন তাদের।

“এই রকম আগেও কিছু এসেছে কি?”

‘না’ বলতে গিয়েও একটা কথা মনে পড়াতে থেমে গেল দূর্বা, “কয়েক দিন আগে একটা পেন এসেছিল!”

“পেন? কী রকম পেন?”

“এমনি সাধারণ ডট পেন, তবে নতুন! আমি ভেবেছিলাম প্রোমশানাল কিছু ফ্রিতে পাঠিয়েছে তাই রেখে দিয়েছিলাম!”

“নিয়ে আসুন দেখি সেটা!”

পেনটা এনে দিল দূর্বা। উল্টে পাল্টে সেটাকে দেখল ওরা দুজনে। বিশ্বজিৎ ফিরতে তাকেও নানা রকম প্রশ্ন। কী, কেন?

নাইন ইলেভেনের পর থেকে এই সব ব্যাপারে ওরা ভীষণ সজাগ। বিশ্বজিৎ একবার ভুল করে বলে ফেলল, “নামটা মিডিল ইস্টের নাম মনে হচ্ছে!”

আর যাবে কোথায় ওমনি দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়ল, “তোমরা চেনো নাকি ওখানে কাউকে?”

অনেক কষ্টে ওদের বোঝান গেল যে না কাউকে চেনে না ওরা।

“তবে বোমা হওয়ার চান্স কম কারণ অ্যান্থ্র্যাক্স ঘটনার পর থেকে পোস্টঅফিসের সব মেল স্ক্যান হয়। বোমা হলে ওরাই আমাদের খবর দিত।"

“কিন্তু আমার নামে কেন কেউ ওই রকম একটা পুরনো সেল ফোন পাঠাবে? আর পেন? পেনই বা কেন?”

“সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি।”

ওরা ফোন নিয়ে পেন নিয়ে চলে গেল। দুশ্চিন্তায় খাওয়া ঘুম সব উধাও হল বিশ্বজিৎ আর দূর্বার।

পরদিন মেয়েদের স্কুলে পাঠালেও ভয়ে অফিস গেল না বিশ্বজিৎ। বেলা দশটা নাগাদ পুলিশের ফোন এল।

“ফেসবুকের প্রোফাইলটা ভুয়ো নয়। মেয়েটা একজন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট। ঘর বাড়ি কেনা বেচা করে। আমরা ওকে ধরার চেষ্টা করছি। যে ও কেন তোমাকে পাঠাল ভাঙ্গা ফোনটা। হ্যাঁ, ওটা বেকার ফোন, আমাদের এক্সপার্টরা পরীক্ষা করে দেখেছে। ওটা খারাপ হয়ে গেছে, খুব সম্ভব জলে ভিজে।”

বেশ ভাল করেই কথা বলল ওরা। এখানকার পুলিশকে দেখলে বা ওদের সাথে কথা বললে বেশ একটা ভরসা হয়।

ধাতস্থ হয়ে উঠছিল ওরা কিন্তু সেদিন আরেকটা এলো! ওরা দুজনে একসাথে মেইল বক্স চেক করতে গিয়েছিল পোস্টম্যান লেটার বক্সে চিঠিগুলো রেখে চলে যাওয়ার পর। এটা একটা লাল রঙের মেয়েদের ফোন। এটাও অনেক পুরনো। হয়তো বা জলেও পড়েছিল! এবার অবশ্য বাড়িতে আনেনি প্যাকেটটাকে ওরা। গ্লাভস পরা হাতে খামটা পুরোটা খুলতেও হয়নি। একটু খুলতেই দেখা যাচ্ছিল।

বিশ্বজিৎ এতক্ষণ ঘরে বসে দিব্যি টিভিতে ইন্ডিয়ান চ্যানেলের প্রোগ্রাম দেখছিল, এবার ওর মুখও শুকিয়ে গেল!

ফোনটাকে আবার লেটার বক্সে রেখে পড়ি কি মরি ঘরে ছুটে এলো ওরা দুজনে।

“আমাদের মনে হয় আর এই দেশে থাকতে দেবে না! কে বা কারা এটা করছে জানি না!” বলে কাঁপা হাতে ফোন তুলে আবার পুলিশকে ফোন করল বিশ্বজিৎ।

এবারের ফোনটা এসেছে কোন এক স্লোবোদান নোকোভিচের কাছ থেকে, নিউ মেক্সিকোতে থাকে সে। এর কোন ফেসবুক অ্যাকাউন্টও পাওয়া গেল না।

ঘর বার পায়চারি শুরু করে দিল বিশ্বজিৎ। দূর্বার মাথা ঝিমঝিম করছে।

“মেয়েদের স্কুল থেকে নিয়ে আসবো?” বিশ্বজিৎ একবার বলল।

“পাগল! ওরা ওখানে নিরাপদে আছে ওদের এখানে নিয়ে আসবে! তার চেয়ে বরং রাধিকাদি কে ফোন করে বলি। ওরা ওনার বাড়িতে আজকের রাতটা থাকুক না হয়!”

বাইরে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল। ধীরে সুস্থে দু’জন পুলিশ নেমে বাগানের পথ দিয়ে ওদের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।

বিশ্বজিৎ দরজা খুলতে খুলতে বলল, “একটু না হয় অপেক্ষা করো। পুলিশ তো এসেই গেছে। ওদের সাথে কথা বলে তারপর ফোনটা করো।"

ওরা ঘরে ঢুকতেই বিশ্বজিৎ বলল, “আজকেও একটা এসেছে! ওই মেইল বক্সেই আছে আমি আর ভিতরে আনিনি। কী যে হচ্ছে জানি না! ওরা কি আমাদের মেরে ফেলতে চায়? এটা কি গ্যাং রিলেটেড কিছু?”

ওরা দু’জনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলল, “হুঁ!”

বাইরের ঘরে বসে পকেট থেকে একটা কাগজ বার করল ওদের একজন।

“আমরা ওই রিয়েল এস্টেট এজেন্ট মহিলার সাথে কথা বলেছি। এই ইবে অ্যাকাউন্ট থেকে ওই জিনিস গুলো কেনা হয়েছে। দাম দেওয়া হয়েছে আর তোমাদের নাম আর ঠিকানা দেওয়া হয়েছে!”

“অ্যাঁ!”

“হ্যাঁ, তোমরা ডাবাল বলে কাউকে চেনো?”

“ডাবাল? কই না তো!” বিশ্বজিৎ সঙ্গে সঙ্গে বলল।

“কিন্তু শুধু এই দুটো জিনিসই নয় অনেক কিছু কেনা হয়েছে এই অ্যাকাউন্ট থেকে। সব এখানেই পাঠান হয়েছে মনে হয়। মানে বিভিন্ন সময়ে। সেই গুলোর কথা তো তোমরা কিছু বলনি!”

দূর্বার এবার কেমন একটা সন্দেহ হল। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখতে চাইল সে। কাগজটায় চোখ বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল, “আরে এ তো ধবল মুখার্জি! মানে ফুল মেসোমশাই!”

দূর্বার মেসোমশাই এক কালে এই দেশে ছিলেন। মাসি থাকতে চাননি বলে ফিরে গেছেন। রিটায়ার করার পর নিজেকে কালেক্টার বলে পরিচয় দিতে ভালবাসেন। একশো খানা পুরনো ঝরঝরে ক্যামেরা, প্রচুর পেন, চশমা ইত্যাদি জড়ো করেছেন। ইদানিং তার মানে জলে ভেজা সেল ফোন জমাচ্ছেন! মাঝে মাঝে এটা সেটা কিনে ওদের ঠিকানায় পাঠান বটে! যেমন গত বার ওরা ভারতে যাওয়ার আগে একটা ক্যামেরা আর কম্পিউটার কিনে ওদের ঠিকানায় পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলো তো নতুন জিনিস আর আগে থেকে বলে রেখেছিলেন। এবার ওদের একবার বলবার দরকার বলেও মনে করেননি!

মেসোমশাইকে ফোন করতেই উনি বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই কিনেছি! মহামূল্য জিনিস সব জলের দরে ইবেতে বিক্রি হচ্ছে দেখলাম! কিন্তু সমস্যা হল শিপিং ইউ এস এতে ফ্রি কিন্তু এখানে আনাতে গেলে পাঁচশো টাকা! কুড়ি টাকার ভাঙ্গা মোবাইল ফোন কিনে পাঁচশো টাকা ডেলিভারি খরচ দেবো তাই তোদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম! আর ওই পেনটা আমার দু হাজার নাম্বার পেন! সব কালেক্টার্স আইটেম বুঝেছিস দূর্বা! তোরা যখন আসবি তখন সঙ্গে করে নিয়ে আসিস!”