উপস্থিতি - মধুমিতা সেনগুপ্ত

চারতলা বাড়িটাতে চোদ্দটা ফ্ল্যাট। চার ,তিন ও দোতলাতে চারটি করে, একতলায় দুটি ফ্ল্যাট এবং বাকিটা গ্যারেজ। গ্যারেজের সামনে বড় শাটার নামানো দরজার পাশে কিছুটা জায়গা নিয়ে একটি ছোট দোকান। মুদি থেকে ছোটখাট নকল গহনা সবই পাওয়া যায়। জমির মালিক বিভাস বাবুর ছেলে দোকানটা চালায়। একটা মলম তৈরির কারখানায় সাধারণ চাকরি করে টাকাপয়সা কিছুই জমাতে পারেননি বিভাস বাবু কিন্তু বুকের খাঁচার ভিতরে ফুসফুসে টিবির রোগজীবাণু সগোষ্ঠী বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসার খরচ না থাকলেও পথ্য জোগাড় করা তার ক্লাস এইট পাশ করা ছেলের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়ায় তড়িঘড়ি চারকাঠা জমি শুদ্ধু টালির বাড়িখানা চেনা প্রমোটারের হাতে তুলে দেয় বিভাস বাবুর ছেলে বিশাল। অর্থনৈতিক কষ্ট কমে যায় পরিবারটির।

যত পরিশ্রান্তই হোন না কেন বিপত্নীক বিভাস বাবু বাড়ি ফিরে একটা গামছা পরে অন্য একটা পুরোনো গামছা হাতে নিয়ে ঘরের সব কিছু মুছতেন। বড় বেশি ভালোবাসেন তিনি নিজের বাড়িটিকে। ঘরের চারিদিকে দারিদ্র ছিল কিন্তু যেটুকু ছিল সেটুকুই ছিল পরিষ্কার। বাড়ি মানে টালির চালা দেওয়া আড়াই খানা ঘর। যেদিন প্রমোটারের হাতের কাগজে কাঁপা হাতে সই করে দিলেন বিভাস বাবু সেদিন সবার অজান্তে তার বুকের পাঁজর খসে গিয়েছিল। এই বাড়িতেই তাঁর শৈশব বাবা মা আর স্ত্রীর স্মৃতি। কিন্তু ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। তার ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকার প্রয়োজন। তিনি নিজে কোনো শক্ত কাজ ভারী কাজ করতে পারেন না। রাতে কাশির দমকে শরীর বেঁকে চুরে যায়। অনেক ভাবলেন কিন্তু বাড়িটি তিনি বাঁচাতে পারলেন না। বুঝলেন ছেলে যা করছে সেটাই ঠিক।

প্রমোটারের তৈরি অন্য এক ফ্ল্যাটে দু'বছর কাটালেন কোনোক্রমে। বেশ মোটা টাকা রাখা আছে ব্যাংকে। দোতলায় দু'কামরার ফ্ল্যাট আর একটা দোকানঘর বেছে নিয়েছে ছেলে। বাকি ফ্ল্যাট গুলির কাজ শেষ না হলেও বিভাস বাবুদের ফ্ল্যাটটির কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে তাঁদের গৃহপ্রবেশ করিয়ে দিলেন প্রমোটার। নতুন ফ্ল্যাটে এসে সামান্য আসবাবপত্র নিয়ে গুছিয়ে বসল বিশাল। দক্ষিণ পূর্ব দিকের বড় ঘরটাতে বাবার থাকার জায়গা। দেওয়ালে মার্বেলের তাকে লক্ষী মূর্তি আর দক্ষিণাকালীর ফোটো বসালো বিশাল। সবই হল কিন্তু বিভাস বাবুর মনটা ভেঙে গেল। ছেলে তাকে ধুলো পরিস্কার করতে দেয় না। তাছাড়া নতুন ফ্ল্যাটে সব কিছুই গোছানো তকতকে। নিজের টালির বাড়ির বাইরে দুটো সন্ধ্যমালতী আর চালের উপরে লাউ গাছটার জন্য বড্ড মন কেমন করে তার। এখানে ফ্ল্যাটে একটা তুলসী গাছ পোঁতার জায়গাটুকুও নেই। শরীরের অসুখ ওষুধ দিয়ে কমলো কিন্তু মনের দুঃখে মানুষটি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। তারপর একদিন মাঝরাতে আচমকা রক্তচাপের বড়সড় ধাক্কায় হৃদযন্ত্রের কাজ চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল।

মেজ পিসি একা থাকেন তাঁর বাড়িতে। তাঁর ছেলে থাকে অনেক দূরে। সব আত্মীয়ের সাথে আলোচনা করে মেজ পিসি এসে উঠলেন বিশালের কাছে। ছেলেটা অনাথ হয়ে গেল তাই একবছর বাদে কালাশৌচ কাটলেই তাকে বিয়ে দিয়ে বৌ এনে তাকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তবে তিনি নিজের বাড়ি ফিরবেন। ছোট মামা এই বাড়ির চার তলার একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। তিনিও কিছুদিন বাদেই এসে পড়বেন।

মাস কয়েক ঠিকঠাক চললো সবকিছু। দক্ষিণ পূর্বের বড় ঘরটাতেই আরো একটা চৌকি এনে পিসি ভাইপো এক ঘরেই রাতে শুতো। ঘরের লাগোয়া ছোট বাথরুমে পিসিমা যান না। তিনি রাতে বার দুয়েক ওঠেন। বাথরুম থেকে এসে জল খান। তারপর অনেকক্ষণ পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে ঘুমিয়ে পড়েন। একদিন মাঝরাতে উঠে আলো জ্বালিয়ে খাট থেকে নামেন বিশালের মেজ পিসি। ডাইনিং স্পেসে ছোট্ট একটা লাইট জ্বালা থাকে। ভেজানো দরজা খুলে বাইরে ডাইনিং স্পেসে বের হয়েই মেজ পিসি বিকট আর্তনাদ করে উঠলেন। বিশাল উঠে বসে আগে দিক পাশ সময় বুঝতে কিছুটা সময় নেয়। তারপর দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখে মেজ পিসি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তাঁকে ঘরে এনে চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে তাঁর চোখ খোলে। তিনি দু'হাতে ভাইপো কে জড়িয়ে ধরে বলেন

―“স্পষ্ট দেখলাম দাদা দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে টেবিল মুছছে! বিশু বাবা তোর বাবা এই ফ্ল্যাট ছেড়ে যায়নি। ও মাগো বাঁচাও।”

বিশাল মনে মনে মেনে নেয়। তার মনে হয় এটা বোধহয় মেজ পিসি ঠিকই দেখেছেন কারণ বাবার আত্মা হয়ত সত্যিই ফ্ল্যাট ছেড়ে যেতে পারেনি। শেষের দিকে অসুস্থ অবস্থাতেও বাবা গামছা খুঁজতেন যাতে একটু পরিষ্কার করা যায়। এখন তাকে দুবেলা দোকানে বসতে হয়। মেজ পিসির বয়স হয়েছে তাই তিনি পেরে ওঠেন না। এদিক ওদিক একটু আধটু ধুলো তারও চোখে পড়েছে। কিন্তু পরিষ্কার করার কথা পরে আর মনে রাখতে পারেনি। তাই নোংরা থেকেছে আর আয়তনে বেড়েছে। বাবা সেটা সহ্য করতে পারছেন না বোধহয়।

পরের দিন কাজের মাসিকে দিয়ে সব জায়গা পরিষ্কার করালো বিশাল। যে কটা ওষুধের শিশি ওষুধের স্ট্রিপ ছিল ডাস্টবিনে ফেলে এলো নিজের হাতে। বাবার আত্মার উপস্থিতি যদি যুক্তির খাতিরে সে মেনেও নেয় তাহলে তাঁকে কাজ করিয়ে কষ্ট সে দিতে চায় না। একবেলা দোকান না খুলে সে ফ্ল্যাট পরিষ্কার করলো। দুপুরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল বিশাল। সারাদিন বিছানা থেকে ওঠেননি মেজ পিসি। ফোন করেছেন কাকে কাকে যেন। কাজের তাড়ায় সে এত খোঁজ নিতে পারেনি। দুপুর দুটোর সময় থেকে বেল বাজা শুরু হলো। বাকি তিন পিসি একসাথে এলেন। তারপর দুই মামা এলেন একে একে। মেজ পিসি সবাইকে ফোন করে কাল রাতে তাঁর সদ্য প্রয়াত দাদার অশরীরী কীর্তিকলাপ অনেকটা বাড়িয়ে শুনিয়ে দিয়ে এস.ও.এস পাঠিয়েছেন। সবাই ভীষণ চিন্তিত হয়ে এসেছেন। সবার বাড়িতেই ভিন্ন ভিন্ন তাড়া আছে তাই বিকেল পাঁচটার আগেই তাঁরা মানে মানে বাড়ি ফিরে যেতে চান।

ছোট মামা দিন দশেকের মধ্যেই গৃহপ্রবেশ করছেন। তাঁর মেয়েকে যে গানের দিদিমণি গান শেখাতে আসেন তার ফোটো তিনি সঙ্গে করেই এনেছেন। ভাগ্নে বৌ হিসেবে মেয়েটিকে তিনি পছন্দ করেছেন। এবার সবার সম্মতি পেলেই তিনি মেয়েটির বাবার সাথে কথা বলতে পারেন। সবার হাতে হাতে ফোটোটি ঘুরতে থাকে। সবাইকে নিজের হাতে বানানো লিকার চায়ের কাপ তুলে দিতে গিয়ে আড়চোখে যতটা সম্ভব দেখার চেষ্টা করে বিশাল। সবাই ‛ভালোই তো’ গোছের মন্তব্য করে ফেললো কিন্তু তাকে দেখানোর প্রয়োজন মনে করলো না কেউ। পরিবারের সবাই এত সেকেলে যে আজকের যুগে পুরো অচল। কোথায় মেয়েটার ফোন নম্বর তাকে দেবে তা নয় নিজেরাই পছন্দ করছে যেন বিয়েটা ওনাদের কারো সাথে হবে। নিদেন পক্ষে নামটা তো বলবে। ফেসবুকে আছে কিনা রিকোয়েস্ট পাঠানো যাবে কিনা সেগুলো তো নিজেই জেনে নেওয়া যেতে পারে।

ছোট মামীর গুরুদেব তন্ত্র সাধনা করেন। তিনি এসে যদি একবার পুজো পাঠ করে দেন তাহলে বিভাস বাবুর আত্মা পালিয়ে পথ পাবে না। কিন্তু কাল অশৌচ শুনে তিনি বলেছেন বাৎসরিক হয়ে যাওয়ার পর যা বিধান দেওয়ার দেবেন। তাই আপাতত ছোট মামার গৃহপ্রবেশের দিন তিনি এসে মেজ মাসির জন্য কিছু একটা দিয়ে যাবেন যাতে তিনি ভয় না পান। এসব কথা বিশালের কানে ঢুকছিল না। ছোট মামার মেয়ে ক্লাস নাইনের ছাত্রী লিসার গানের দিদিমণিকে দেখার জন্য তার প্রাণ আকুল হয়ে উঠলো। লিসা এত ছোট যে বিশু দাদাকে ভয় পায় তাই তার কাছ থেকে কোনো সাহায্য আশা করা বৃথা।

দিন কয়েক বাদে একেবারেই সাদা মাটা ভাবে গৃহপ্রবেশ সারলেন ছোট মামা। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং পুরোনো পাড়ার ইংরেজি মতে একেবারেপাশের দরজার প্রতিবেশীরা নিমন্ত্রিত ছিলেন। বিশালদের ফ্ল্যাট বাড়ির বাকি সব ফ্ল্যাটেই বাসিন্দারাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলেন। একেবারে শেষে যখন সব আশা ছেড়ে দিয়ে বিশাল মনে মনে গজগজ করছিল আর বিশ্লেষণ করছিল কেন ছোট মামা এত ভালো চাকরি করেও এত কৃপণ ! একটা মাত্র মেয়ের একমাত্র গানের দিদিমণিকে নিমন্ত্রণ করলে কী হয় ! ইত্যাদি ইত্যাদি ঠিক সেই সময় দরজা দিয়ে প্রায় দৌড়ে ঢুকলো একটি বেশ রোগা মেয়ে। বয়স আন্দাজ সাতাশ আঠাশ গায়ের রং মাজা মাজা। মোটা ফ্রেমের চশমার ওধারে দুটো গভীর চোখ। লিসা কলকল করে উঠলো। এটা ওর গানের মিস সংযুক্তা বলে পরিচয় করিয়ে দিল বিশু দাদার সাথে। মেয়েটি বেশ স্মার্ট কোনো ভনিতা না করেই জানিয়ে দিল এত বড় ফ্ল্যাট বাড়িতে কোনো লিফট নেই এটা একদমই ভাবা যায় না। এখুনি সবাই মিলে লিফট এর বন্দোবস্ত করা উচিত ইত্যাদি।

গলা শুকিয়ে বসে রইলো বিশাল। আলাপ করানোর সময় লিসা তার মিসকে বলেছে বিশালের নতুন বিজনেস। সেটা দিনদিন ফুলে ফেঁপে উঠছে। বিশাল লজ্জায় খানখান হয়ে যায়। নির্ঘাৎ ছোট মামীমা কিছু শিখিয়ে রেখেছেন লিসাকে।

মিস যাওয়ার সময় তাকে সামনের অটো স্ট্যান্ড অবধি নিয়ে যায়। অনেক পুরোনো সাদা কালো গল্পের প্লটের নায়কের মতো নায়িকাকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় বিশাল। বিশাল আগে নামতে থাকে পিছনে লিসার মিস।

―“আপনি দৌড়ে নামছেন কেন পড়ে যাবেন তো।” সাবধান করে লিসার মিস।

―“না না মিস পড়বো না।” বলে নিজের গতিতে লাগাম কষে বিশাল।

―“আমার নাম সুদেষ্ণা। আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন।” বলে সুদেষ্ণা।

অটোতে ওঠার আগে দুজনের ফোন নম্বর বিনিময় হয়ে যায়। দুজনের কাছেই বিশালের ছোট মামা ও মামীর ইচ্ছাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। অটো ছাড়ার দুমিনিটের মধ্যেই বিশাল ফোন করে জেনে নেয় রাস্তায় কোনো জ্যাম আছে কি-না। পাশের মোটা লোকটা অসভ্য না প্রকৃত ভদ্রলোক ইত্যাদি। এরপর এরকম উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন বিপদ কল্পনা করে প্রশ্ন এবং শুধু শুধু বিনা কারণে কেমন আছো কী করছো জাতীয় প্রশ্ন করার জন্য ফোনের যাওয়া আসা শুরু হয়। আগে দুপুরে একটা ভাত ঘুম দিয়ে আবার শেষ বিকেলে দোকান খুলতো বিশাল কিন্তু সেদিনের পর থেকে ব্যবসার কাজে প্রায়ই সে বের হতে লাগলো। নানা শপিং মলে দুজনকে দেখা যেতে লাগলো।

এদিকে ছোটমামার গৃহপ্রবেশের দিন ছোট মামীর গুরুদেব এসেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। তিনি মেজ পিসির হাতে একটা কবজ দেওয়ার পর থেকে মেজ পিসি আর কোনোদিন কিছু দেখেননি। তাই তিনি মনের আনন্দে ভাইপোর সংসার কীভাবে গোছাবেন এই নিয়ে পরিকল্পনা করে চলেছেন দিনরাত।

এরমধ্যেই একদিন একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটলো। বারবার বেলের শব্দ শুনে বিশাল গিয়ে দরজা খুলে দেয়। বৃহস্পতিবার বিকেলের এই সময়টা সে ছোটমামার ফ্ল্যাটেই থাকে। লিসা গান শেখে আর সে তবলা বাজানোর চেষ্টা করে। বড় মামার কাছে কিছুদিন সে তবলার কিছু বোল শিখেছিল।

ঝড়ের বেগে ঘরে ঢোকে সুদেষ্ণা। সে যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল উল্টো দিক থেকে আসা কোনো কিছুর সাথে তার ধাক্কা লাগে। তারপর সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কী ঘটলো। কিছু দেখতে না পেয়ে সে মন শক্ত করে উঠতে শুরু করে। এবার প্রতি পদক্ষেপে তার মনে হয় তার পাশেই কেউ উঠছে উপরে। তার পায়ের সাথে কোনো অদৃশ্য মানুষের পা বার বার লেগে যাওয়ায় সে ভীষণ ভয় পেয়েছে।

ছোট মামী বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। ঠান্ডা মেশানো জলের গ্লাসটি এগিয়ে দিয়ে বলেন, “কোনো ভয় নেই। এবার থেকে যদি পায়ে পা লেগে যায় তাহলে বলবে আমি উঠবো বা বলবে আমি নামবো আপনি দয়া করে সরে যান।”

কথাটা শুনে বিশাল চমকে ওঠে। এটা কী বলছেন ছোট মামী ! সুদেষ্ণার মুখটা সাদা হয়ে গেছে। সে নিজের ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে ঢকঢক করে খায় কিছুটা। তারপর জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছিনা। কাকে সরতে বলবো?”

ছোট মামী ভালো করে বুঝিয়ে দেন। বিশালের বাবার স্বভাব কেমন ছিল। তিনি মৃত্যুর পরেও এই বাড়ি ছেড়ে যাননি। বিশালের মেজ পিসি একবার ওদের ফ্ল্যাটে চাক্ষুষ দেখেছেন। সুদেষ্ণা যেমন তাঁর উপস্থিতি টের পেয়েছে ঠিক তেমনি তিনিও পেয়েছেন। সিঁড়িতে কেউ যেন তাঁর পাশে পাশেই উঠছিলো ইত্যাদি। বিশাল কেন টের পায়নি এটা ভেবে তিনি আশ্চর্য হচ্ছেন। বিশালের কালাশৌচ কেটে গেলেই তাঁর গুরুদেব এসে এই বাড়ি থেকে ওই প্রেতাত্মাকে তাড়াবেন। পুরোটা গড়গড় করে বলে ছোট মামী মেয়েকে হারমোনিয়াম বার করতে বলে চা করতে গেলেন।

ফ্যাকাশে মুখে চোখে বেশ রাগ নিয়ে বিশালের মুখের দিকে তাকায় সুদেষ্ণা। বিশাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বোঝাতে যায় যে তার এই তথ্যটি জানা ছিল না। সুদেষ্ণা ভীষণ রাগ নিয়ে তার দিকে তাকায় তারপর লিসার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আজ গলাটা ভালো নেই। আজ আসি। তোমার মাকে বলে দিও।” কথাটা শেষ করে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে কী মনে পড়ায় থমকে দাঁড়ায়। “আমাকে একটু এগিয়ে দাও লিসা।”

―“আমি দিচ্ছি আমি দিচ্ছি,” বলে দৌড়ে চটি পরে দরজা খুলে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখে চলে যায় বিশাল। থমথমে মুখ নিয়ে সুদেষ্ণা বেরিয়ে আসে। সিঁড়ির কাছে এসে তার গলা শুকিয়ে যায়। ঢোঁক গিলে বিশালকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে সে কাঁপা গলায় বলে, “এই শেষ আর কোনোদিন এই বাড়িতে আসবো না। কারো সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবো না। যদি কেউ থেকে থাকেন দয়া করে সরে যান। আমি নিচে নামবো।”

প্রথম কথাগুলি শুনেই বিশালের মনে ভীষণ আঘাত লাগলো। সে বলে ফেললো, “কী বলছো কী সুদেষ্ণা ! আমার বাবা ভূত হয়ে সবার পা মাড়িয়ে দেন ! এসব ভীষণ বাজে অপবাদ। একী কথা! ছোট মামী বললেন আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে! তোমার আমার সম্পর্ক একটা অবিশ্বাস্য গল্পের জন্য শেষ হয়ে যাবে ! তুমি পারবে আমাকে ভুলে যেতে?”

―“পারবো। তোমার বাবা মারা গিয়ে ভূত হয়ে তোমাদের ফ্ল্যাট আর এই পুরো বাড়িটার মধ্যেই আছেন সেটা আমাকে লুকিয়েছ। কেন? তাছাড়া আমাকে হয়ত ওনার পছন্দ হয়নি তাই পায়ে পা দিয়ে বাধা দিচ্ছেন। আমি কিছুতেই তোমার বাবার অশরীরী আত্মার সাথে থাকতে পারবো না। আমাকে নীচে নামিয়ে দিয়ে এসো। কী ভীষণ জায়গা এটা, আমার শরীর কাঁপছে।” বলে সুদেষ্ণা। উত্তেজনায় তার চোখ মুখ লাল হয়ে যায়।

বিশাল অনেক কিছু বোঝাতে চায় কিন্তু সুদেষ্ণা কিছুই শুনতে রাজি নয়। সে তাড়াতাড়ি নামতে শুরু করে। পিছনে পিছনে বিশাল ও নামতে শুরু করে। দোতলায় যখন তারা নেমে আসে সুদেষ্ণা দেখে বিশালের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। ভিতর থেকে একটা পোড়া গন্ধ বার হচ্ছে। সুদেষ্ণা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিশাল দৌড়ে ফ্ল্যাটে ঢোকে। পিছনে সুদেষ্ণাও ঢুকে পড়ে।

ডাইনিং স্পেসে ঢুকে বিশাল দেখে মেঝেতে কিছু একটা কাপড় জাতীয় জিনিষ জ্বলছে। সে টেবিলে রাখা জলের জাগ থেকে কিছুটা জল হাতে নিয়ে ছিটিয়ে দেয়। তারপর চমকে ওঠে।

―“একী! সুদেষ্ণা দেখো এটা বাবার সেই গামছা যেটা দিয়ে বাবা সারা ঘরের ধুলো ঝাড়তেন। সেটাতে আগুন ধরলো কী করে? মেজ পিসি কোথায়?”

দক্ষিণ পূর্বের বড় ঘরটিতে দুজনে ঢুকে দেখে মেজ পিসি বিছানার উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর হাতের পাশে একটা সোনার গয়নার বাক্স। বিশাল চিনতে পারে গোলাকার লাল পুরোনো বাক্সখানি । মায়ের অসুখের সময় তাঁর গলার সরু হার একজোড়া কানের দুল বাবা একে একে সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মাকে বরণ করে ঠাকুমা যে নিজের সরু লোহা বাঁধানো-খানি তাঁর হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন বাবা সেটা বিক্রি করেননি। অনেক আর্থিক অনটন গেছে তবু এটা বাবা বিক্রি করেননি। বলেছিলেন এটা বিশালের বৌ এর প্রাপ্য জিনিষ সেই পাবে।

সুদেষ্ণা মেজ পিসির মুখে জল ছিটিয়ে দেয়। মেজ পিসি জ্ঞান ফিরে জল খেয়ে সুস্থ হয়ে বলেন তিনি ফোন নিয়ে বড়দির সাথে একটু গল্প করছিলেন। দুপুরে স্নান করার সময় ছোট মামীর গুরুদেবের দেওয়া কবজটা হাত থেকে খুলে পড়ে গেছে। সেটা তিনি তুলে রেখেছেন। এই ঘটনা নিয়েই দুই বোনের আলোচনা চলছিল। হঠাৎ পিছনে আলমারি খোলার শব্দ শুনে ভয় পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখেন বিভাসবাবু এই গয়নার বাক্স হাতে দাঁড়ানো। ভারী বিষন্ন গলায় তিনি বলেন, “মেজ খুকি সুদেষ্ণাকে ঘরের বৌ করিস। ভারী পছন্দ হয়েছে আমার। এটা দিস। আর বলিস আমি চলে গেলাম আর কোনোদিন এ-বাড়িতে আসবো না।” আরো কিছু হয়ত সেই ছায়া শরীর দাদার বলার ইচ্ছা ছিল কিন্তু তিনি জ্ঞান হারান। এত দূর বলে মেজ পিসি চিৎকার করে কান্না জোড়েন, “ও দাদা কোথায় গেলে গো। তুমি সোজা স্বর্গে যাও গো দাদা তোমার আদেশ আমি পালন করবো গো...”

বিশাল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এগুলি যা ঘটেছে বা ঘটছে সেগুলি কি সত্যিই ঘটছে। বাবা কি সত্যিই এত দিন তার আশেপাশেই ছিলেন ! সত্যিই কি তাঁর উপস্থিতি অনেকেই টের পেয়েছে ? আবার যেন নতুন করে বাবাকে হারালো সে। তার দুচোখ ছলছল করে ওঠে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। রান্নাঘরে ঢুকে তিন কাপ চায়ের জল চাপায়। পিছনে পায়ের শব্দ। সুদেষ্ণা এসে ঢোকে রান্নাঘরে। বলে

―“মেজ পিসিমার কাছে যাও। ওনার এখন তোমাকে দরকার। আমি চা করে আনছি।”

―“তুমি আবার কষ্ট করবে কেন?” বলে অভিমানী বিশাল।

―“নিজের বাড়িতে নিজের পরিবারের জন্য চা করতে কারো কষ্ট হয় নাকি? শুনলে না আমি বাবার পছন্দ করা বৌ। যাও পিসিমা খুব কাঁদছেন। আমি আসছি।” চা পাতা চিনি খুঁজতে খুঁজতে বলে সুদেষ্ণা।

তার জন্য তার রান্নাঘরে সুদেষ্ণা অপটু হাতে কাজ করছে এই অচেনা সুন্দর দৃশ্যটা দু'চোখ ভরে দেখে নেয় বিশাল। তারপর শোওয়ার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে।

সুদেষ্ণা খুব মনোযোগ দিয়ে প্রথমবার বিশালের জন্য চা বানিয়ে চলে।