গিজার খুফু পিরামিড – এক বৈজ্ঞানিক বিস্ময় - অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

মানুষের তৈরি প্রাচীন সৌধ মানুষকেই কীভাবে বিস্মিত করেছে তার সবচাইতে বড় উদাহরণ মিশরের পিরামিড। মিশরীয় সভ্যতা যে হাজার হাজার বছর আগে উন্নতির আকাশ ছোঁয়া সিঁড়িতে পা রেখেছিল, পিরামিডের সামনে দাঁড়ানো আজকের দিনের পর্যটক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে হয়ত সেই কথাই ভাবে। পিরামিড নিয়ে বিস্ময় জন্ম দিয়েছে তাকে ঘিরে উপকথার, কল্পনার জাল বুনেছে মানুষ, গড়ে উঠেছে মিথ। কারণ, সত্যিটা কোথাও লিপিবদ্ধ করে রেখে যায়নি পিরামিড গড়ার উদ্যোগীরা। আর যদি করে গিয়েও থাকে - কালের করাল থাবা, সেই সংবাদ গ্রাস করেছে চিরতরে। তাই বিজ্ঞানী, ভূতাত্ত্বিক, স্থপতি, নৃতাত্ত্বিক, সবাই ভিড় করেছে পিরামিডের চারপাশে, তার রহস্য অনুসন্ধানে এগিয়ে এসেছে।

বালুকাস্তীর্ন প্রান্তরে একদা মিশরের সমৃদ্ধির সাক্ষী, সুউচ্চ সৌধ, পৃথিবীর অন্যতম এক আশ্চর্য হিসাবে স্বীকৃত - গিজার পিরামিড, যাকে গ্রেট পিরামিডও বলা হয়। পাশাপাশি আছে আর দুটি অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার পিরামিড। স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে, মিশরীয়রা কেন বানিয়েছিল এই পিরামিডগুলো? বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃত রাজা ও রানীদের সমাধি বানাবার উদ্দেশ্যে পিরামিড বানানো হয়। রাজারা নাকি পাতালের শয়তানকে ভয় পেত। তাই তারা মারা যাবার পর মাটি থেকে উঁচুতে, স্বর্গের কাছাকাছি থাকা বেশি পছন্দ করত। আশ্চর্যের বিষয় হল, মিশরের এই পিরামিড থেকে কোনও শবাধার বা মমি, এমনকি কোনও লিপি কিন্তু আবিষ্কার করা যায়নি। কারো মতে শস্য সংরক্ষণের জন্য এই বিশাল পিরামিড বানানো হত। কিন্তু শস্যের নামগন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি কোনও পিরামিডে। তবে পিরামিডের ভিতরের স্থাপত্য কর্ম দেখে শস্য সংরক্ষণশালা বলে আদৌ মনে হয় না।

মিশরের ঐতিহাসিকদের গবেষণা অনুযায়ী, মিশর সম্রাট খুফুর শাসনকালে গ্রেট পিরামিড বানানো হয়। তাই এই পিরামিডকে খুফু পিরামিডও বলা হয়ে থাকে। আনুমানিক ৪৫০০ বছর আগে নীল নদ উপত্যকায় গড়া ওঠে গিজার গ্রেট পিরামিড। প্রাচীনকালের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম আশ্চর্য স্মারক এই পিরামিড, আজও পৃথিবীর বুকে টিঁকে আছে - বাকি আশ্চর্যগুলি বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে।

গ্রেট পিরামিডের পাশে আরও দুটি ছোট পিরামিড আছে, যাদের নাম হল কফ্রে ও মেঙ্কাউরে। সম্ভবত খুফুর দুই সন্তান এই দুটি পিরামিড নির্মাণ করে, যারা পরবর্তীকালে মিশরের রাজা হয়। কিন্তু পিরামিড তিনটি যে এই সম্রাটদের দ্বারা নির্মিত, তার সপক্ষে খুব জোরালো যুক্তি খুঁজে পাওয়া দায়। অনেকটাই যেন অনুমান সাপেক্ষ।

প্রায় ২৩ লক্ষ পাথরের চাই দিয়ে তৈরি খুফু পিরামিড ১৩ একর জমির উপর বিস্তৃত। ১৮৮৯ সালে আইফেল টাওয়ার তৈরির আগে পর্যন্ত এটাই ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ ইমারত। এর উচ্চতা ৪৮১ ফুট। যে পাথর দিয়ে পিরামিড তৈরি হয়, বিভিন্ন মাপের সেই পাথরের ওজন ৫০ থেকে ২০০ টন পর্যন্ত। এত ভারী ওজনের পাথর কীভাবে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, তা স্থপতিবিদদের কাছে আর এক বিস্ময়। পাথরগুলো খুব সম্ভবত বয়ে নিয়ে আসা হয় নীল নদ থেকে কাটা খাল পথে। কিন্তু এত বড় মাপের পাথর আজকের দিনের অত্যাধুনিক ক্রেন ব্যবহার করেও অত উঁচুতে তোলা প্রায় দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। কীভাবে প্রাচীন পৃথিবীতে সেসব সম্ভব হল, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ এমন মতও প্রকাশ করেন, সেই সময়ে এই কাজে নাকি লক্ষাধিক মানুষের শ্রম ব্যবহার করা হয়, যারা ছিল রাজা কুফুর ক্রীতদাস। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অবশ্য অন্য তথ্য তুলে ধরেছে। পিরামিডের আসেপাশে খনন কার্জ চালিয়ে প্রত্নতাত্মিকেরা বেশ কিছু ঘরবাড়ি ও মানুষের কঙ্কাল আবিষ্কার করেছেন। তাদের মতে, এই জায়গায় পিরামিডের কারিগরেরা বাস করত এবং তাদের জীবনের মান বেশ উন্নত ছিল। উদ্ধার করা কঙ্কাল পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে, তারা যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার দাবার খেত। তাই মিশরের রাজা কুফু যে পিরামিড তৈরি করার কাজে ক্রীতদাসদের লাগিয়েছিলেন এমন ধারণা ভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

এবার পিরামিডের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখা যাক, কী কী বিস্ময় সেখানে অপেক্ষা করে আছে। প্রবেশ দ্বার পেরলে প্রথমেই একটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ দেখা যাবে। সুড়ঙ্গ পার হয়ে দুটি পথ পাওয়া যায়, একটি নিচের দিকে ও আর একটি উপরের দিকে। উপরের দিকের সুড়ঙ্গ পথ দুভাগে ভাগ হয়ে, একটি চলে গেছে ভূমির সমান্তরাল অলিন্দে - যার শেষ রানীর কক্ষে, আর একটি পথ উপরে উঠেছে, - যাকে বলা হয় গ্র্যান্ড গ্যালারি, এই গ্যালারির শেষে আছে রাজার কক্ষ। সম্ভবত রাজা ও রানীর মরদেহ সংরক্ষণের জন্য এই দুটি প্রকোষ্ঠ বানানো হয়। প্রবেশ পথ পেরিয়ে নিচের দিকের সুরঙ্গটি আর একটি কক্ষে শেষ হয়েছে, যেটি একটি অন্তভৌম কক্ষ। বাস্তুকারেদের মতে, সুড়ঙ্গ পথের এত নিখুঁত শ্রেণী বিন্যাস (alignment) আজকের আধুনিক স্থাপত্যেও বিরল।

দুই ধরণের পাথর দিয়ে গোটা পিরামিডটি তৈরি - গ্রানাইট ও চুনাপাথর বা লাইমস্টোন। পিরামিডের ভিত্তি স্থাপন হয় গ্রানাইট পাথরে, বাকি সৌধ তৈরি হয় চুনাপাথর দিয়ে। পিরামিড নির্মাণ করার পর এক ধরণের বিশেষ চুনাপাথর, যার নাম তুরা লাইম স্টোন, সেই পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয় পিরামিড। মসৃণ এই পাথরের রং সাদা হওয়ায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে দূর থেকে নয়নাভিরাম পিরামিড যে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তুরা লাইম স্টোনের এই আবরণ খসে যায় দুবার ভূমিকম্প হওয়ায়। এখনো পিরামিড চুড়ায় তুরা লাইম স্টোনের অংশবিশেষ অবশিষ্ট, অনেকটা যেন টুপির মত আজও বর্তমান।

গিজার পিরামিড যে ভূমিকম্পে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়নি, তার কারণ ছোট ও বড় আকারের পাথরের এলোমেলো ব্যবহার। স্থপতিবিদেরা জানিয়েছেন, এই ভাবে পাথর সাজানোয় যে কোনও বড় সৌধে গঠনের স্থায়িত্ব আসে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘স্ট্রেস ডিস্ট্রিবিউশন’। ফলে এক জায়গায় স্ট্রেস আহরিত হয়ে প্রবল বলের ক্রিয়ায় সৌধ ভেঙে পড়ে না। ছেনির সাহায্যে বিভিন্ন আকারের পাথর কেটে, মসৃণ করে, একের পর এক সাজিয়ে, গড়ে তোলা হয়েছিল পিরামিড। দুই পাথরের সংযোগ স্থলে কোনও সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ ব্যবাহার করা হয়নি। শুধু পাথরের ভরের সামঞ্জস্য ব্যবহার করে এই বিশাল স্থাপত্য কর্ম ভূমিকম্পের প্রকোপ থেকে বেঁচে গেছে, যদিও আশেপাশের সমস্ত বাড়ি ঘর ও অন্যান্য স্থাপত্যকর্ম ধসে গিয়ে মাটিতে মিলিয়ে গেছে চিরতরে।

ফরাসী স্থপতিবিদ জিন পিয়েরে হাউডিন, তার সুদীর্ঘ আট বছরের গবেষণার ভিত্তিতে পিরামিড বানানোর কৌশল সম্বন্ধে নতুন আলোকপাত করেছেন ২০০৭ সালে। কম্পিউটর সিমুলেশনের সাহায্যে তিনি দেখিয়েছেন, গিজার পিরামিড বানানো হয়েছিল ভিতর থেকে বাইরে - অর্থাৎ আগে ভিতরের অংশে পাথর সাজিয়ে, তারপর কাঠের লিভারের সাহায্যে ভারী

পাথর সাজানো হতো চক্রাকার প্যাঁচালো সিঁড়ি বানিয়ে। তাঁর গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গ্র্যান্ড গ্যালারি বানানোর উদ্দেশ্য ছিল চেন-পুলি ব্যবস্থা ব্যবহার করে, ৭০ থেকে ২০০ টন ওজনের ভারী পাথর টেনে তোলা। বিস্ময়কর ব্যাপার হল, গ্রীক বিজ্ঞানী হিরোডেোটস ভারী বস্তু টেনে তোলার জন্য চেন – পুলি আবিষ্কার করেছিলেন কিন্তু অনেক পরে, খৃস্ট পূর্ব প্রথম শতাব্দীতে। মিশরিয় ইতিহাসবিদদের মত অনুযায়ী, পিরামিডের গঠন শৈলী পর্যবেক্ষণ করতে হিরোডোটস নাকি মিশর ভ্রমণ করেছিলেন। পিরামিডের শীর্ষে পাথরের মসৃণ ইরেজি অক্ষর ‘ভি’ এর আকৃতি নির্দেশ করে ফরাসী স্থপতি হাউডিন জানিয়েছেন, চেন-পুলি ব্যবস্থায় শক্ত দড়ি ব্যবহার করা হয় এবং ‘ভি’ আকৃতির খাঁজ ব্যবহৃত হয় দড়ির সুগম যাতায়াতের জন্য। পাথর তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় কাঠের ট্রলি। গ্র্যান্ড গ্যালারির দুই পাশে পাথরের বেঞ্চ লক্ষ করে হাউডিন অনুমান করেছেন, এই বেঞ্চের উপর দিয়ে কাঠের ট্রলিতে ভারী পাথর চেন-পুলি ব্যাবস্থায় টেনে তোলা হয়। পিরামিডের বাইরে জমি খুঁড়ে এমন ট্রলি সদৃশ কাঠের খিলান পাওয়া গেছে - কায়রোর সংগ্রহশালায় যা যত্ন সহকারে সংগৃহীত।

গ্রেট পিরামিডের স্থাপত্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট বিশেষ ভাবে বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে। (১) ছয় হাজার হেক্টর ভিত্তি প্রস্তর কীভাবে সমান্তরাল করা হয়েছিল, (২) ৫০০ মাইল দূর থেকে গ্রানাইট পাথর কেমন করে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, (৩) রাজার কক্ষ ভূমির সাথে সমান্তরাল করতে কী ধরণের পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, (৪) লোহা আবিষ্কার না হওয়ায় শুধু মাত্র পাথর ও তামার তৈরি ছেনি দিয়ে এত কম সময়ে পাথর মসৃণ করা গিয়েছিল কী করে? এই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন মতের সম্মুখীন হয়ে ঘুরে ফিরে যেন একই প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়, এমন অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা হয়েছিল কোন প্রযুক্তিতে?

খুফু পিরামিডের প্রধান কক্ষ - যাকে রাজার কক্ষ বলা হয়, সেটি লাল গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি। এর দৈর্ঘ ৩৪ ফুট, প্রস্থ ১৭ ফুট ও উচ্চতা ১৯ ফুট। ১৫৩ ফুট লম্বা সুউচ্চ গ্র্যান্ড গ্যালারি পার হওয়ার পর জমির সমান্তরাল এক সুড়ঙ্গ নিয়ে যাবে রানীর কক্ষে। এটি রাজার কক্ষ থেকে দৈর্ঘে কিছুটা কম হলেও, প্রস্থ ও উচ্চতায় প্রায় সমান মাপের। প্রবেশ পথের ঢালু সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে ভূমির ২০ ফুট নিচে অন্তভৌম কক্ষে। এর দৈর্ঘ কিন্তু রাজার কক্ষের চাইতেও বেশি। এই কক্ষ কেন তৈরি করা হয়, এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র খুফুই দিতে পারতেন, যদি তিনি আজও বেঁচে থাকতেন। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা খুফুর মরদেহ সংরক্ষণের জন্যই এই কক্ষটি বানিয়ে, পরে মত পাল্টে, উপরের দিকে পৃথক কক্ষ বানানো হয়। কেউ এমন মতও প্রকাশ করেছেন যে, এই কক্ষ শেষ কথা নয়, আরও নিচে হয়তো অন্য গুপ্ত কক্ষ আছে - যার সন্ধান অনেক অভিযান করেও পাওয়া যায়নি।

রাজা ও রানী কক্ষ থেকে বাতাস চলাচল করবার জন্য দুটি করে অতি সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়। এই চারটি সুড়ঙ্গ এমন ভাবে তৈরি করা হয়, যাতে চারটি সুড়ঙ্গ দিয়ে কাল্পনিক রেখা টানলে আকাশের বিশেষ চারটি তারাকে সেই রেখা নির্দেশ করে। মিশরের স্থপতিরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়ে কতটা উন্নতি লাভ করেছিলেন, গিজার পিরামিডের স্থাপত্যের এই উদাহরণ দেখে সহজেই অনুমান করা যায়।

এত সুবিশাল পিরামিডে মাত্র তিনটি কক্ষ? হতেই পারে না। তাই মিশর সরকার ১৯৬৬ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ ডক্টর লুই আল্ভারেজকে (১৯৬৮ সালে নোবেল বিজয়ী হন) দায়িত্ব দেয় এক্স-রে ব্যবহার করে গিজার গ্র্যান্ড পিরামিডের ভিতরে লুকিয়ে থাকা প্রকোষ্ঠ আবিষ্কারের করবার জন্য। কিন্তু এত বড় স্থাপত্য কর্মের এক্স-রে হবে কীভাবে? তাই আল্ভারেজ স্থির করলেন, সূর্যের আলোর পথে বর্ষিত হওয়া কসমিক পার্টিক্‌ল ব্যবহার করতে হবে। ব্যস, তিনি তার দলবল নিয়ে পিরামিডের ভিতর বসিয়ে দিলেন স্পার্ক চেম্বার, কাউন্টার, ওঅসিলোস্কোপ, আরও সব যন্ত্রপাতি। কণা পদার্থবিদ আল্ভারেজ জানতেন, সূর্য থেকে ক্রমাগত বর্ষিত কসমিক পারটিক্‌ল পিরামিডের দেওয়াল ভেদ করে ঢুকে পরে। পিরামিডের ভিতর ফাঁকা জায়গা যদি থাকে তবে সেই দিক থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি কণা আসবার কথা। আর যদি নিরেট দেওয়াল হয়, তবে চারিদিক থেকে প্রতি মিনিটে একই সংখ্যার কণা আসবে। আল্ভারেজের গবেষণার জন্য হিউলেট প্যাকার্ড কোম্পানি দিল ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি, আনুষঙ্গিক খরচা খরচ যোগাল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি, আই বি এম দিল আধুনিক কম্পিউটর। কিন্তু ফলাফল শূন্য - কসমিক পারটিক্‌ল প্রায় ধরাই পড়ল না। কারণ জানতে অন্য বিজ্ঞানীরা লেগে পড়লেন। জানা গেল, চুনা পাথরে উপস্থিত জলের কারণে কসমিক পারটিক্‌ল আটকে যায়। কাজেই আল্ভারেজের ব্যবহৃত পদ্ধতি গুপ্ত কক্ষ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়।

এর আগেও পিরামিডের পাথর যে জলে সম্পৃক্ত - একথা বিজ্ঞানীদের শুধু নয়, সাধারণ দর্শনার্থীদেরও জানা ছিল। মিশরের বালুকা বেলায় দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডের বাইরেটা একেবারে শুকনো খটখটে। তাহলে পাথরে এত জল এল কোথা থেকে? কেউ বললেন, এর নিচে দিয়ে বয়ে গেছে অনেক গুপ্ত জলের খাল, আবার কেউ দোহাই দিলেন – স্বর্গীয় বন্যার। বাইবেলে লেখা আছে সেই বন্যার কথা, যার প্রভাবে সারা পৃথিবী হয়েছিল জলমগ্ন, নোয়া তার নৌকোয় তুলে নিয়েছিল সর্ব প্রকারের দুটি করে প্রাণী। কারো মতে পিরামিডের গায়ে যে আঁচড়ের দাগ দেখা যায়, সেটা দীর্ঘকাল জলের তলায় থাকার ফল। এই বিষয়ে সঠিক কোনও যুক্তিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি এখনো। তবে স্বর্গীয় বন্যা না হোক, নীল নদের বন্যার ফলে জলে দীর্ঘকাল জলে ডুবে থেকে চুনা পাথরের জলে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনেক ভূবিজ্ঞানীরও।

সাধারণত পিরামিডের চারটি পার্শ্বীয় তল (lateral faces) দেখা যায়। কিন্তু গিজার পিরামিডের আটটি পার্শ্বীয় তলের পিছনে লুকিয়ে থাকা রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞানীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী মাথার চুল ছিঁড়ে চলেছেন। তবে গিজার পিরামিডের আকৃতির সাথে জ্যামিতিক পিরামিডের তফাত এইখানে, গিজার পিরামিডের নিম্নতল বর্গাকৃতি। এর চারটি পার্শ্বীয় তল চার দিশায় সারিবদ্ধ – অর্থাৎ চারটি তল সঠিক ভাবে উত্তর দক্ষিন পুর্ব পশ্চিমকে নির্দেশ করে।

১৯৪০ সালে আকাশপথে যেতে যেতে এক পাইলট পিরামিডের আটটি পার্শ্বীয় তলের সন্ধান পান। খালি চোখে, মাটিতে দাঁড়িয়ে পিরামিডের এই অতিরিক্ত তলের হদিস পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র বিষুবন বা ইকুইনক্সের (দিন ও রাত যখন সমান সমান হয়) সময় নিচে দাঁড়িয়েও খালি চোখে পিরামিডের আটটি পার্শ্বীয় তলের হদিস পাওয়া যায়, কারণ তখন সূর্যালোক সরাসরি পিরামিডে পড়বার জন্য, ছায়া সৃষ্টি হয়ে বিভ্রম ঘটায় না। খুফু পিরামিডের সঠিক দিশা-নির্দেশ কোন কৌশলে করা হয়েছিল, সে বিষয় বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে - কারণ, কম্পাসের আবিষ্কার কিন্তু এর অনেক পরে হয়েছে। তাহলে অনুমান করা যেতেই পারে, পিরামিড স্থপতিরা গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান গণনা করেই পিরামিড গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এত সঠিক মাপজোকের পিছনে তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল, তা সঠিক ভাবে আজও জানা যায় না।

এবার দেখা যাক খুফু পিরামিডের ভিতরে অবস্থিত সুরঙ্গগুলির নির্মাণ বৈশিষ্ট কী কী। ভিত্তি বরাবর যে ঢালু সুরঙ্গটি নিচের দিকে নেমে গেছে, তার কৌণিক মাপ ২৬ ডিগ্রি - এতটুকু হেরফের নেই। আবার উপরের দিকে যে সুরঙ্গটি গ্র্যান্ড গ্যালারি বরাবর উঠে গেছে, সেটিও ২৬ ডিগ্রি কৌণিক মাপে বিন্যস্ত। এই সুরঙ্গগুলির মাপ এমনই যে দর্শনার্থীকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হবে লম্বা পথ। মিশরীয় বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, চোরেদের নাস্তানাবুদ করতেই সুরঙ্গের গঠন এমন ভাবে করা হয়।

সম্প্রতি পদার্থবিদেরা আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কারের দাবী করেছেন। এই বিজ্ঞানীরা প্রমান করবার চেষ্টা করেছেন - গিজার গ্রেট পিরামিড তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ অনুরণিত হয়ে এক জায়গায় একত্রিত করতে পারে। আশ্চর্য জনক ভাবে দেখা গেছে, বিশেষ তরঙ্গ দৈর্ঘের তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ একীভূত হয় রাজা ও রানীর কক্ষে। অন্য তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে যায়। তাহলে কী সূর্য শক্তির ব্যবহার করার বিশেষ কৌশল হস্তগত ছিল পিরামিড নির্মাতাদের? এর সপক্ষেও এখনো পর্যন্ত কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা আশাবাদী, ভবিষ্যতের অনুসন্ধান গিজার পিরামিডের অনেক রহস্যই উদ্ঘাটিত করতে সক্ষম হবে।

সাড়ে চার হাজার বছর আগে মিশরের মানুষ প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে ছিল, একথা মানতে চান না অনেক বিশেষজ্ঞই। তারা এমন কথা বলেন যে, আজকের বিজ্ঞান পিরামিডের যে বিশেষ তাৎপর্য আবিষ্কার করেছে, তা নিতান্তই কাকতালীয়। অনেকে প্রমান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, অনেক কম লোকবলে, নিম্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এমন সৌধ তৈরি করা সম্ভব। আবার বিজ্ঞানীদের একদল বলেছেন, মাত্র দুই দশকে এই বিপুল পিরামিড গড়ে তুলতে হলে এমন প্রযুক্তি প্রয়োজন ছিল, যাতে দিনে বারো ঘণ্টা কাজের হিসেব ধরলে, প্রতি আড়াই মিনিটে একটি করে পাথরের চাঁই কেটে বসানো হয় - লোকবল ও উন্নত প্রযুক্তি ছাড়া যা অসম্ভব।

কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই শুধুমাত্র নিজেদের শৌর্য বীর্য অমর করে রেখে যাবার জন্যই পিরামিড বানাতেন মিশরের রাজা ফারাওরা, একথা যারা পিরামিডকে সশরীরে চাক্ষুষ করেছেন, তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া অবশ্যই কষ্টকর। কল্পবিজ্ঞান ফ্যান্টাসিও গুজব ছড়িয়েছে পিরামিড ঘিরে। ভিন গ্রহের প্রাণী, অর্থাৎ এলিয়েনদের নাকি হাত ছিল পিরামিড তৈরির পিছনে - এমন মতও অনেকে প্রকাশ করেছে।

পিরামিড তৈরির পিছনে নির্মাতাদের কী উদ্দেশ্য ছিল সঠিক ভাবে জানা না গেলেও, কোনও এক বা একাধিক উদ্দেশ্য যে ছিল - সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনা, খুফু পিরামিডের নির্মাণ শৈলীর অনেক বিচিত্র জটিল বিষয় আবিষ্কার করায়, ‘কাকতালীয় ভাবে পিরামিড তৈরি হয়েছিল’- এমন ধারণার অস্তিত্ব আধুনিক জগতে বিলীন করে দিয়েছে। বরং হদিস দিয়েছে উন্নততর এক মানব জীবনের।

তথ্যসূত্র :

1. The message of the sphinx - Graham Hancock & Robert Bauval, Three Rivers Press New York, 1996.

2. The Egypt Code - Robert Bauval, The Disinformation Company Ltd., 2008.

3. Electromagnetic properties of the Great Pyramid: First Multipole Resonances and Energy Concentration - Mikhail Balezin, Kseniia V. Baryshnikova, Polina Kapitanova, and Andrey B. Evlyukhin, Journal of Applied Physics 124, 034903 (2018)