মাস্টার - সুস্মিতা কুণ্ডু

অলংকরণ : সুমিত রায়

মাস্টার হওয়ার শখ যে কোনওকালে হরিহরের ছিল না এমনটা বলা ঘোর অন্যায় হবে। সেই হাফপ্যান্ট পরে পাঠশালে যাওয়ার বয়স থেকে বুকপকেটে যেমন মার্বেলগুলি, চকের টুকরো জমিয়ে রাখত তেমনি বুকপকেটের একটু ভেতর দিকে মানে ওই বুকের মধ্যেই কিছু শখ আহ্লাদও রঙিন মার্বেলের ভেতর জমা বুদবুদের মত জমে ছিল আর কী। কালে কালে বুকপকেটের ছ্যাঁদা গলে মার্বেলগুলো পড়ে রাস্তায় গড়িয়ে গেছে আর স্বপ্নগুলোও না জানি কোন চুলোয় বেপাত্তা হয়ে গেছে। তবু কুড়িয়ে বাড়িয়ে যে দু’চারটে মনের আনাচে কানাচে জমিয়ে রেখেছে, সেগুলোই রাতের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়ে, শুধোয়,

—“ওহে হরিহর কী করলে জীবনে বাপু? ইস্কুলের ওই ম্যাদামারা ফোর্থ ক্লাস স্টাফ হয়েই কাটিয়ে দিলে। ক্লাস ফুরোলে ঘন্টা মারা, প্লাস্টিকের জগে জল বয়ে আনা, ক্লাসে ক্লাসে রোলকলের খাতা পৌঁছে দেওয়া, বইয়ের তাকের, দেওয়ালের ম্যাপের ধুলো ঝাড়া, হেডস্যার মাধববাবুর জন্য বটকেষ্টর দোকানের কচুরি কিনে আনা, এই তো তোমার কাজ। শখ ছিল বাপের মত মাস্টার হবে। কত কত ছাত্রছাত্রী রিটায়ার করার পরও এসে হাটেবাজারে পেন্নাম ঠুকবে। বলবে, ‘স্যার আপনি ছিলেন বলেই আজ এই জায়গায় পৌঁছতে পারলাম।’ তুমি তাদের সবাইকে না চিনতে পারলেও তারা তোমায় ঠিক চিনে নেবে। তোমার চোখে থাকবে হাই পাওয়ারের চশমা, শ্বেতশুভ্র চুল, স্মিত হাসি! কিন্তু কোথায় কী! যেমন তোমার ছিবড়েমার্কা কপাল তেমন তোমার দড়কচামারা চেহারা। মাস্টার হওয়ার, ভক্তিচ্ছেদ্ধা পাওয়ার যুগ্যিই তুমি নও।”

স্বপ্নগুলোকে আজকাল দুঃস্বপ্ন লাগে হরিহরের। স্বপ্নরা তো কথা কইবে কেমন মিঠে গলায়, আলতো সুরে। কিন্তু এরা তো রীতিমত বেত উঁচিয়ে মাস্টারের ম’তই বকে, এমনধারা অপমান তো হেডস্যারও করেন না। রাতে আজকাল ভালো ঘুম হয় না হরিহরের। স্কুলে গিয়ে তাই সারাদিন কেমন যেন একটা ঝিমোনো ঝিমোনো ভাব থাকে। একদিন তো টুলে বসে বসে ঢুলতেই শুরু করেছিল। লাস্ট পিরিয়ডের ঘন্টা বাজাতেই ভুলে গেছিল, প্রায় মিনিট পনেরো পেরিয়ে যাওয়ার পর, সেভেন-বি এর ঘর থেকে কালিপদ স্যার বেরিয়ে এসে গাঁট্টা মেরে হরিহরেরই মাথায় ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। খুব কান্না কান্না পেয়েছিল হরিহরের, কালিপদ মাস্টার এই সেদিন ঢুকল স্কুলে। হরিহর এই স্কুলে আছে সে প্রায় বছর তিরিশের কথা। সে কিনা এমন অপমান করল!

মফস্বলের এই সাদামাটা স্কুলটার শিক্ষক ছিলেন হরিহরের বাবা নিজেই। কিন্তু হরিহরের যখন মোটে বছর বারো বয়স তখন বাবা মা দু’জনেই দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে গিয়ে পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সেদিন থেকেই, হরিহর, কেয়ার অফ হরিহরই থেকে গেছে। শহরের দিকে পা বাড়ানোর সাহস আর ওর হয়নি। এই ময়নামতী গ্রামেরই এক পাড়াতুতো পিসির টুকরোটাকরা স্নেহ পেয়ে আর পিসির রান্না পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি খেয়ে বড় হয়েছে। কালেকালে সে পিসিও পরলোকের পথ ধরল, হরিহর তখন সবে আঠেরোয় পা দিয়েছে। স্কুল ফাইনালের গণ্ডি বার তিনেকের চেষ্টাতেও ডিঙোতে না পেরে, পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়েছে। ময়নামতী গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন হেড মাস্টারমশাই সমরবাবু হরিহরের বাবার বন্ধুমানুষ ছিলেন। দয়াপরবশ হয়ে স্কুলের এই ফোর্থ ক্লাস স্টাফের চাকরিটা তিনিই দিয়েছিলেন, সে আজ প্রায় বছর তিরিশ আগেকার কথা। তার পর আরও দুবার হেডমাস্টার বদল হয়েছে, কিন্তু হরিহরের চাকরি টিকে গেছে এতগুলো বছর ধরে। তার একটাই কারণ, হরিহরের সারা অস্তিত্বের সাথেই জুড়ে আছে এই স্কুলটা।

ময়নামতী উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার মাস্টারমশাই ছিলেন হরিহরের বাবা, হরিহর দে। হ্যাঁ হরিহরের বাবার নাম, হরিহর। ব্যপারটা একটু অদ্ভুত লাগছে, নয় কি? হরিহর দে তাঁর একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিলেন প্রদীপ। কিন্তু বাবা মা দুজনে একসাথে প্রদীপকে অনাথ করে চলে যাওয়ার পর সবাই বেশিরভাগ সময় ‘হরিহরের ছেলেটা’ বলে ডাকতে ডাকতে কখন যে সেটা ‘হরিহর’ই হয়ে গেছে ও নিজেও জানে না। বাবার স্কুলেই পড়াশোনা করছিল, কিন্তু বরাবরই পড়াশোনায় তেমন মাথা ছিল না ওর। লাল কালিওয়ালা রেজাল্ট দেখে মা রাগ করে বলত,

—“মাস্টারের ঘরে জন্ম হয়েও গোমুখ্য হয়েই থাকবে ছেলেটা।”

বাবা বলত,

—‘আহা! পড়াশোনা শিখলেই কি প্রকৃত শিক্ষক হওয়া যায়?’

আজ এই কালিপদদের মত শিক্ষকদের দেখলে পরে হরিহরের বড্ড বাবার কথা মনে পড়ে। লোকে যে ওর আসল নামটা ভুলে বাবার নামেই ডাকে সেটা ভেবে বেশ গর্ব গর্ব লাগে হরিহরের।

***

আর পাঁচটা দিনের মত আজও স্কুলে এসেছে হরিহর। পুঁইশাক কুমড়ো আর চুনোমাছ দিয়ে রান্না তরকারি আর আগের দিনের বাসি পান্তাভাত খেয়ে। টিফিনের আগে অব্দি সবই ঠিকঠাক চলছিল। টিফিন শেষের ঘন্টা দিয়ে টুলে বসে ঝিমোচ্ছিল, হঠাৎই একটা চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এল হেডস্যারের ঘরের দিক থেকে।

—“সত্যি করে বল কোথায় রেখেছিস! আজ হাতেনাতে ধরা পড়েছিস, কিছুতেই ছাড়ব না তোকে, ছোটোলোকের জাত...”

পড়ি কী মরি করে দৌড় লাগায় হরিহর। গিয়ে দেখে হেডস্যারের ঘর নয়, ওই ঘরের লাগোয়া ছোটো ঘরটা থেকে আওয়াজটা আসছে। জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরটায় যত রাজ্যের ফাইলপত্র, চক ডাস্টার, পরীক্ষার খাতা, আর একটা আলমারিতে গল্পের বই আছে। তার মাঝে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার। ছোটো স্কুলের ততোধিক ছোটো লাইব্রেরি। ছাত্রদের তাই ফ্রি পিরিয়ডেই বই দেওয়া হয় শুধু। ক্লাসের কেউ একজন বই নিয়ে গিয়ে ক্লাসে জোরে জোরে পড়ে শোনায়, বাকিরা শোনে। বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কোনও নিয়ম নেই।

ঘরের একটা চেয়ারের হাতল ধরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে, হরিহর চেনে ওকে। বলাই সোরেন, ক্লাস সেভেন-বি এর ছাত্র। খুব গরিব, ময়নামতী গ্রামের বাগদিপাড়ার যে ক’জন আসে স্কুলে পড়তে, ও তাদের একজন। তবে বাকিদের মত ও যে মিড-ডে মিলের লোভে আসে না সেটা হরিহর বোঝে। কোনওদিনও চেয়ে খাওয়ার নেয় না ছেলেটা। বলাইয়ের হাতের দিকে চেয়ে কেঁপে ওঠে শরীরটা হরিহরের। টেবিলের ওপর চিৎ করে পাতা কচি হাতদুটো, তার ওপর লম্বা লম্বা লাল লাল দাগ। সামনে লিকলিকে একটা বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে কালিপদ মাস্টার।

—“খুব ফাঁকতাল পেয়েছিস না? টিফিনের পর সবাই যে যার ক্লাসে, হেডস্যারও ক্লাস নিতে গেছে। সেই ফাঁকে দরজা খোলা পেয়ে, এই কাণ্ড! পড়াশোনার জন্য না ছাই, মিলের লোভে সব জুটেছে এসে যত। প্রায়ই দেখি একটা দু’টো করে বই গায়েব!

কী করিস বইগুলো চুরি করে শুনি? বেচে দিস না কি?”

বাতাস কেটে ফের বেতটা নেমে আসতে লাগল হাতদুটোর ওপর। হরিহর আর থাকতে না পেরে ঘরের ভেতর ছুটে ঢুকে এল। কালিপদ মাস্টারের হাত থেকে বেতটা এক হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে উঠল,

—“মাস্টারবাবু কী করছেন? অতটুকু বাচ্চা! ও চুরি করেনি, ও চুরি করেনি। ওকে মারবেন না ও’রকম করে।”

ফোর্থ ক্লাস স্টাফের এই আচরণে রাগে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে কালিপদ বেতটা চালাতে থাকে হরিপদর ওপর। প্রবল ধাক্কায় ও ছিটকে পড়ে দরজার পাল্লার ওপর। লোহার কড়াটায় মাথাটা ঠুকে রক্ত বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে আশেপাশের ক্লাসের আরও কয়েকজন মাষ্টারমশাই আর বেশ কিছু ছাত্র এসে জড়ো হয়েছে। কালিপদর সামনে কুঁকড়ে পড়ে থাকা হরিহরকে ক’জন ধরে সরিয়ে নিয়ে যান। হেডস্যারও এসে চিৎকার করেন,

—“কালিপদবাবু থামুন! কী করছেন কী!”

এক লহমায় যেন ঝড় বয়ে যায় শান্ত গ্রাম্য স্কুলটায়। সেইদিনের মত হাফছুটি দিয়ে হেডস্যার সবাইকে বাড়ি যেতে বলেন। আরও দু’জন মাস্টারমশাইয়ের সাথে হরিহরকে বাড়ি পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন। তাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে এগোনোর সময় হরিহর অপ্রকৃতিস্থর মত বিড়বিড় করতে থাকে, ‘পড়াশোনা শিখলেই প্রকৃত শিক্ষক হওয়া যায় না’। হেডস্যার মাধববাবু, কালিপদ আর বলাই সোরেনকে নিয়ে বসেন নিজের ঘরে।

—“হ্যাঁরে বলাই সত্যি করে বল তুই বই চুরি করেছিস কি না? সত্যি বললে কোনও শাস্তি হবে না তোর, আমি বলছি।”

বছর বারো তেরোর ছেলেটা এতক্ষণ ঘাবড়ে ভয়ে থম মেরেছিল, এবার হাঁউমাঁউ করে কেঁদে বলে ওঠে,

—“না গো না হেডস্যার আমি কিছু করিনি। সেদিন কেলাসে এই বইটা পড়ে শোনাচ্ছিলো তো। কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই ঘন্টা পড়ে গেসল, আর আমার গল্পের শেষটা জানতে বড্ড মন হচ্ছিলো। তাই আজ টিফিনের পর বাইরে থেকে দেখনু বইয়ের আলমারিটা খোলা। তখনই এসে বইটা নিয়ে পড়ছিনু, কালি মাস্টারমশাই ভাবল কি না আমি চুরি...”

লাল লাল হয়ে যাওয়া হাতদুটোয় করে বইটা এগিয়ে ধরে বলাই,

‘টোয়েন্টি থাউজাণ্ড লিগস আণ্ডার দ্য সি’-এর বাংলা অনুবাদ।

কিছুক্ষণ বইটার দিকে তাকানোর পর চোখ তুলে কালিপদর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান মাধববাবু। ছেলেটা মাথা নিচু করে বসে আছে। বি. এড পাশ করে, এস. এস. সি. পাশ করে ছেলেটা অঙ্কের মাস্টারের পদে যোগ দিয়েছে বছরখানেক হল। কলকাতার ছেলে, সরকারি চাকরির মায়ায় এতদূরে এসে রয়েছে। হপ্তাশেষে বাড়ি যায় মনে হয়। এখনকার ছেলেরা যেমন হয় তেমনই। শিক্ষকতা আর পাঁচটা পেশার মতই একটা পেশা, এমনটাই মনে হ’ত এর ব্যবহার দেখে মাধববাবুর। এই মুহূর্তে ছেলেটার নিচু মাথা আর আহত চোখের দৃষ্টিটা যদিও অন্য কথা বলছে। গলাটা ঝেড়ে মাধববাবু জিজ্ঞাসা করেন,

—“ঠিক কী হয়েছে বলবে কালিপদ? কেন তোমার মনে হ’ল বলাই বই চুরি করেছে?”

মৃদুস্বরে কালিপদ উত্তর দেয়,

—“অ্যানুয়াল পরীক্ষাগুলো সব শেষ হওয়ার পর দিন দশেক ছুটি ছিল। রেজাল্ট বেরনোর পর নতুন ক্লাস শুরু হ’ল। তার ক’দিন পর বই মেলাতে গিয়ে দেখি বেশ ক’টা বই গায়েব। টেনিদা সমগ্র, ফেলুদা সমগ্র, রবীন্দ্র রচনাবলীর দু’টো খণ্ড, শার্লক হোমস অনুবাদ, গোটা কয় পুরনো পূজাবার্ষিকী...”

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেন মাধববাবু...

—“থাক থাক আর বলতে হবে না বুঝতে পেরেছি। ইসসস দোষটা আমারই... আমার নাতি মানে মেয়ের ছেলেটা পরীক্ষা শেষ হ’তে ক’দিনের জন্য এসেছিল আমার কাছে। বই পড়তে ভালোবাসে বলে ছেলেটা আমিই স্কুল লাইব্রেরি থেকে এই বইগুলো নিয়ে গেছিলাম। তখন স্কুলে ক্লাস বন্ধ ছিল, শুধুমাত্র অফিসটাই খোলা ছিল। আমি তাই বইগুলো এমনিই নিয়ে চলে গেছিলাম। তুমি লাইব্রেরির দায়িত্বে, ভেবেছিলাম স্কুল খুললে তুমি এলে, বলে দেব। কিন্তু বইগুলোও ফেরত আনতে ভুলে গেছি আর তোমাকে জানাতেও। বড্ড ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেল, আমারই জন্য!”

বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে টেবিলের দু’প্রান্তে বসে থাকেন দু’জন শিক্ষক।

***

গত চারদিন ধরে স্কুলে আসছে না হরিহর, কালিপদ মাস্টারেরও রেজিস্টারের খাতায় নামের পাশের খোপটায় সই নেই ক’দিন। কী হ’ল কে জানে দুজনের। মাধববাবু একে তাকে জিজ্ঞাসা করে সদুত্তর না পেয়ে, এবং কালিপদর মোবাইল নাম্বারও বারবার ট্রাই করে না পেয়ে, চিন্তায় পড়লেন। শেষে শনিবার হাফছুটির পর সেভেন বি-এর বলাই সোরেনকে নিয়ে হরিহরের বাসার দিকে রওয়ানা দিলেন। একতলা বাড়ি, সামনে খানিকটা বাগান, বাঁশের বাতা চিরে বেড়া বানানো। ক’টা আম জাম গাছ আর গুচ্ছের পুঁইশাকের মাচা। নড়বড়ে দরজাটার কড়া নেড়ে হাঁকেন,

—“হরিহর আছো না কি?”

কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে যে বেরিয়ে আসে তাকে দেখে অবাক হয়ে যান মাধববাবু।

—“কালিপদ তুমি?”

চিনেমাটির তিনটে কাপে লিকার-টি ঢেলে একটা স্টিলের থালায় বসিয়ে নিয়ে আসে হরিহর, আরেকটা গ্লাসে আধ গ্লাস দুধ। চা বানানোরই গুঁড়ো দুধ গোলা মনে হয়, বলাইয়ের জন্য। মাধববাবু লক্ষ করেন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই হরিহরের মুখে শিশুর মত হাসি ঝরে পড়ছে। কালিপদর মুখখানাও উৎসাহে উজ্জ্বল।

চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন,

—“কী ব্যাপার? তোমাদের দু’জনেরই কামাই? সব ঠিক আছে তো? হরিহর তোমার শরীর...”

তড়বড়িয়ে হরিহর বলে,

—“না গো হেডস্যার, আমার শরীর ফাসটোকেলাস আছে। জ্বর এসেছিল কিন্তু এই কালিপদবাবু স্যার ওষুধ খাবারদাবার সব দিয়ে গেলেন। তারপর এই পরশু আর কাল দু’দিন আমরা কলকাতা ... দাঁড়ান দাঁড়ান আপনাকে দেখাই...”

বলে হরিহর উঠে দৌড় লাগায় পাশের ঘরে। ওর কাণ্ডকারখানা দেখে হাসি পেয়ে যায় মাধববাবুর।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হেডস্যার মাধববাবু তাকান কালিপদর দিকে। কালিপদ মৃদু স্বরে বলে ওঠে,

—“আসলে স্যার সেদিনের ঘটনার পর, হরিহর যখন প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় ‘পড়াশোনা শিখলেই প্রকৃত শিক্ষক হওয়া যায় না’ বলতে থাকে তখনই কী যেন একটা হয়ে গেছিল আমার মাথার ভেতরটায়। বলাইয়ের ফুলে ওঠা লাল হাতদুটো বারবার চোখে ভাসছিল, অপরাধবোধে ভুগছিলাম। সন্ধে বেলাতেই ছুটে আসি হরিহরের বাড়ি, এর ওর তার থেকে সন্ধান করে। জ্বরে পড়েছিল মানুষটা, শিগগিরই সেরে ওঠে যদিও। তারপরেই ...”

হরিহর দু’হাতে দুটো বড়বড় চটের ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে, মাঝপথে কথা থামায় কালিপদ। উঁকি দিয়ে মাধববাবু দেখেন ব্যাগদুটো বইয়ে ভর্তি।

—“স্যার আমি একা মানুষ, সাতকূলে কেউ নেই। থাকি এই বাপ-পিতেমো’র ভিটেয়, যাই হোক কচু-ঘেঁচু রেঁধে পেট ভরিয়ে নিই। স্কুল থেকে পাওয়া মাইনের প্রায় সবটাই জমে যায়। জানেন স্যার কলকাতা শহরে বাবা মা গাড়িচাপা পড়ে মরে যাওয়ার পর আর কোনওদিন যেতে সাহস হয়নি। খালি মনে হ’ত চারপাশ থেকে সব দত্যি এসে পিষে দেবে। এই কালিপদ মাস্টার কত যত্ন করে হাত ধরে ধরে আমায় কলকাতা নিয়ে গেছে। সে একটা রাস্তার দু’পাশে কত বইয়ের দোকান, ছোটো বড়ো মাঝারি। কত ছেলেমেয়ে বই কিনছে, পড়ছে। আমরা দু’জন মিলে এই বইগুলো কিনে এনেছি ওখান থেকে।”

হতবাক হয়ে শুনতে থাকেন মাধববাবু। বলাই সোরেন ততক্ষণে গুটিগুটি পায়ে চটের ব্যাগ থেকে একটা নতুন বই বার করে তার পাতাটা খুলে মুখ ডুবিয়ে নতুন বইয়ের গন্ধ নিচ্ছে বুক ভরে।

—“হরিদা এই এ্যাতগুনো বই সব তোমার?”

—“না রে না পাগলা! আমি অত বই যদি পড়তুম তবে আমিই তোদের মাস্টারমশাই হতুমনি? ওগুলো সব তোদের জন্য।”

বলে হাসতে থাকে হরিহর।

কালিপদ বলে,

—“স্যার হরিদা এই বাড়িতে একটা লাইব্রেরি বানাতে চায়। আমি ওকে যথাসাধ্য সাহায্য করছি। স্কুলের পুরনো যে বাতিল চেয়ার বেঞ্চ টেবিলগুলো আছে ওগুলো যদি পাওয়া যেত, তাহলে খুব ভালো হ’ত। বইয়ের আলমারি আমার কলকাতার বাড়িতে বেশ ক’টা আছে। ওগুলো আমি আনবার ব্যবস্থা করছি শিগগিরই। আপনি যদি একটু অন্য মাস্টারমশাইদেরও বলেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে।”

—“হেডস্যার আমরা আবার বই কিনতে যাব সামনের হপ্তায়। আপনি যাবেন আমাদের সাথে? এই হপ্তায় আমার শরীরটা একটু দুর্বল ছিল তো তাই কালিপদ স্যার আর যেতে দিলেন নে।”

মেঝেয় থেবড়ে বসে বলাইয়ের সাথে বইগুলো বার করতে করতে বলতে থাকে হরিহর।

—“বলাই, নিমপাতা জোগাড় করবি, শুকিয়ে বইয়ের আলমারিতে রাখব নইলে পোকায় কাটবে। তোর কেলাসের, অন্য কেলাসের সবাইকে বলবি আসতে আমার লাইব্রেরিতে।

না না আমার লাইব্রেরি নয়, এটা ‘প্রদীপের লাইব্রেরি’। বাপ-মার দেওয়া নামটা একটা কাজে লাগুক। বলেন স্যার? ভালো হবে না?

কালিপদ স্যার আমার নামের ইতিহাস শুনে বললে এই নামটি দিতে”

লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে হরিহর ওরফে প্রদীপ অথবা প্রদীপ ওরফে হরিহর।

মাধববাবু পাশে বসে থাকা কালিপদর কাঁধে হাতটা রেখে, আলতো চাপ দেন। কালিপদ তখন অপলক দৃষ্টিতে দেখছে হরিহর, বলাই আর বইগুলোকে।

জীবন যে কাকে কখন কোন শিক্ষা দিয়ে প্রকৃত শিক্ষক বানিয়ে তোলে, তা এতদিন ধরে শিক্ষকতা করার পর আজ বুঝি অনুধাবন করলেন ‘ময়নামতী উচ্চ বিদ্যালয়ের’ হেডমাস্টারমশাই।