পিশাচী - দেবব্রত চ্যাটার্জী

এক

“আপনি কখনো খুন করেছেন?”

প্রশ্ন শুনে ঘুরে তাকালাম। বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে সবেমাত্র আলাপ হয়েছে। ফাস্ট ক্লাশ কুপেতে আমরা দু’জন যাত্রী। রাতের অন্ধকারের ভেতর ট্রেণটা হু হু করে ছুটে চলেছে।

মনে হ’ল ভদ্রলোক ঠাট্টা করছেন। তাই হেসে জবাব দিলাম, “না, সে সৌভাগ্য এখনও হয় নি।”

“ভুল করছেন মশাই। সেটা কখনই সৌভাগ্য নয়, আমি কিন্তু খুন করেছি, তিন তিনটে।”

বুকটা ধড়াস করে উঠলো। জীবনে কখনও খুনী দেখি নি। মনে হ’ল এই নির্জন কুপেতে একজন খুনীর সঙ্গে ভ্রমণ করছি। বলা যায় না যদি

ভদ্রলোক আমার মনের কথাটা আঁচ করে বল্লেন, “ভয় নেই, আপনাকে খুন করব না। মানুষ মারা আমার ব্যবসা নয়। খুনগুলো ঠিক আমার ইচ্ছাকৃত নয়, হয়ে গেছে। সিগ্রেট খাবেন?”

তিনি সিগরেট কেসটা আগিয়ে দিলেন। নিলাম একটা। সিগরেট ধরিয়ে তিনি বলেন, “আমি কাদের খুন করেছি শুনলে আপনি আরও, আশ্চর্য হবেন। প্রথমতঃ একটি মেয়েকে, দ্বিতীয়তঃ একটা বুড়ো সহিসকে আর শেষকালে আমার স্ত্রীকে।”

“স্ত্রীকে!”

“হ্যাঁ। শুনে আশ্চর্য হচ্ছেন মনে হচ্ছে। ভাবছেন এ যুগে স্ত্রীর অপরাধে কোনো স্বামী কি তাকে খুন করতে পারে? আসলে আমার স্ত্রীর কোনো অপরাধ ছিল না। তবু আমি তাকে খুন করেছি। সে অবশ্য ১৫ বছর আগে।”

“কেন?”

“কারণটা সহজে বিশ্বাস করতে পারবেন না। কারণ হল আধুনিক বিজ্ঞান।”

“বিজ্ঞান?”

“হ্যাঁ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা একটা মানুষকে কি ভাবে অমানুষ করে তুলতে পারে তার উদাহরণ হলাম আমি। সেটা বলতে গেলে সব কথা আপনাকে শুনতে হবে। আপনি কতদূর যাবেন?”

“দিল্লী।”

“তাহলে হাতে অনেক সময় আছে। আপনি শুনবেন?”

“হ্যাঁ শুনব।”

আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি তার কাহিনী শুরু করলেন। তাঁর জীবনীতেই গল্পটা শুনুন।

দুই

ছেলেবেলাতেই আমার মা আর বাবা মারা যান। মামার কাছে মানুষ হই। বাবা যে টাকা রেখে গেছলেন, আমার মামার কাছ থেকে তার কিছুই আমি পাই নি। বাবা একটা এজুকেশন ইন্সিওরেন্স করে গেছলেন, তাই কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। কলেজ থেকে গেলাম ইউনিভার্সিটিতে।

কিন্তু গোল বাধল এম. এসসি. পাশ করার পর। আমি রিসার্চ করার জন্য ডাঃ মুখার্জীর কাছে কাজ শুরু করলাম। সেটাই হ’ল ভুল। ডাঃ মুখার্জী ছাড়া আর কারুর অধীনে কাজ করলে আমার জীবনটা অন্য রকম হত।

সে যা হোক। আমি ওয়্যারলসে-এর ওপর রিসার্চ করছিলাম। সে সময়ে হঠাৎ নতুন একটা আইডিয়া আমার মাথায় এল।

আপনি জানেন যে, বেতারের সাহায্যে আজকাল অনেক অটোমেটিক যন্ত্রপাতি চালান হয়। তার ওপরে পড়াশুনা করতে করতে একদিন হঠাৎ মনে হল যে চেষ্টা করলে যে কোনো জীবজন্তুকেও ত’ এই উপায়ে চালনা করা যেতে পারে। সেটা করতে পারলে আমি ফিজিক্‌সের নোবেল পুরস্কারটা অনায়াসে পেয়ে যাব। এই আবিষ্কার পৃথিবীর একটি বেশ বড় আবিষ্কার বলে গণ্য হবেই।

এখন আপনাকে বলতে বাধা নেই, আমি ঐ আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য—সেটা প্রকাশ করতে পারি নি। প্রথমতঃ একটা বাঁদরের ওপরে পরীক্ষা চালিয়ে সফলতা পেলাম। তারপর সে যাকগে, সেটা যথা সময়ে বলব। প্রথমের কথা প্রথমে শুনুন।

ডাঃ মুখার্জী আমার বিশার্চ গাইড, তাঁর বাড়ীতে প্রায়ই যেতাম। মেয়ে রত্না, স্ত্রী আর এক ভাই—এই নিয়ে ডাঃ মুখার্জীর সংসার। আমি আমার কাজে যেতাম কাজ সেরে সোজা চলে আসতাম। পরিবারের কারুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করিনি বা তার আবশ্যকতা হয় নি। একদিন ডাঃ মুখার্জী আমাকে বল্লেন, “তুমি রত্নাকে একটু অঙ্কটা দেখিয়ে দেবে?”

রাজী হতে হল। তিনি আমার রিসার্চ গাইড, তার কথা। অমান্য করা চলে না। কাজেই পরের দিন থেকে আমি রত্নাকে পড়াতে লাগলাম। রত্না বি. এসসি. পড়ে।

আমি তখন রিসার্চ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছি। অন্য কোন দিকে নজর দেবার আমার সময় নেই। আমি রত্নার কাছে বসে যন্ত্রের মত অঙ্ক কষে যাই, থিওরেম আর প্রবলেম বোঝাই । চোখ শুধু ক্যালকুলাস আর এ্যালজেব্রার দিকে। রত্নার দিকে ছিল না মোটেই। একটু রত্নার দিকে তখন মন দিলে হয়ত ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াত।

রত্না কিন্তু আমার দিকে মন দিতে শুরু করেছিল। আমি অতটা বুঝতে পারিনি। মেয়েদের মনের খবর নেবার অবসর আমার তখনও হয় নি। কিন্তু রত্না বিংশ শতাব্দীর মেয়ে, আমি বুঝতে পারি নি তা বিশ্বাস করবে কেন? ভাবল পি. এচডির জন্য লেখাপড়া করছি—একটা বি. এসসি. পড়ছে মেয়েকে আমার চোখে লাগছে না। অহংকারে আমি অন্ধ, তাই তাকে অবহেলা করছি।

সুতরাং রত্নাই বা ছাড়বে কেন? প্রেমে বাধা পড়লেই সেটা হিংসার রূপ নেয়। সুতরাং কদিন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার ব্যর্থ চেষ্টার পর রত্নাও প্রতিশোধ নিতে শুরু করল। কোনো মেয়েকে কোনো দিন প্রাইভেটে পড়িয়েছেন? পড়ান নি? তাহলে বুঝবেন না। মাষ্টারকে ডাউন করার কত রকমের ফন্দী ওরা জানে। প্রথমতঃ একটা অঙ্কের মাথার সঙ্গে আর একটার লেজ লাগিয়ে একটা অঙ্ক বানিয়ে করতে দেবে। নির্ঘাৎ উত্তর মিলবে না—তখন বাঁকা হাসি হাসৰে। মশাই, আমি ব্ৰহ্মা ত’ আর নই যে সব সময় সমস্ত অঙ্ক করতে পারব। প্রায়ই সলিড জিওমেট্রির অঙ্ক আটকাতে লাগল। আর রত্নার বাঁকা হাসির মাত্রা বাড়তে লাগল। আচ্ছা, রত্নাকে পড়িয়ে আমার কি লাভ? ডাঃ মুখার্জীকে একটু তেল দেওয়া ছাড়া এর আর কোনো সার্থকতা নেই। কিন্তু এ ভাবে রত্নার ব্যবহার বেশীদিন সহ্য করা সম্ভব হল না। একদিন এই রকম একটা ব্যাপার হবার পরে আমি বল্লাম, ‘আমি এসব পারব না।’

ব্যস্‌। রত্না অমনি ডাঃ মুখার্জীকে রিপোর্ট করে দিলে যে আমি বলেছি পারব না। তিনিও সেটা শুনে রাখলেন—আমাকে কিছু বললেন না।

তারপর মশাই যখনই আমি ডাঃ মুখার্জীর কাছে যাই—তিনি আমাকে ভাগিয়ে দেন। বলেন ‘পরে এসো, এখন নয়’ ‘এখন ব্যস্ত আছি, ‘নিজেই চেষ্টা কর, সবই যদি আমি করি তাহলে ডিগ্রিটা আমারই পাওয়া উচিত’—ইত্যাদি। এদিকে আমার রিসার্চ এগুচ্ছে না—তখন প্রায় সবই শেষ করে এনেছি—সামান্য একটু বাকী, গাইড্যান্স খুবই দরকার। কি করব কিছু বুঝতে পারছি না।

একদিন সন্ধ্যেবেলা ডাঃ মুখার্জীর বাড়ী গেলাম। রত্না দরজা খুলে বল্লে, ‘বাবা বাড়ী নেই।’

বল্লাম, “বেশ ত’। আমি অপেক্ষা করব।”

সেদিন খুবই জরুরী দরকার। রিসার্চের দরকার ত’ বটেই— তাছাড়া আমার স্কলারশিপ ফরমে তাঁর সই চাই। নইলে টাকা পাব না। তখন কিছু টাকার দরকার।

“বেশ, বসুন তাহলে।” বলে রত্না ওপরে চলে গেল।

চুপচাপ মিনিট দশেক বসে থাকলাম। খবরের কাগজটা তুলেছি, হঠাৎ রত্নার চীৎকার শুনলাম, “রঞ্জনদা, রঞ্জনদা—শীগ্‌গীর আসুন।

মনে হ’ল রত্না কোনো বিপদে পড়ে ডাকছে। দৌড়ে ওপরে গেলাম। রত্নার ঘরে কোনো আলো নেই—বারান্দার আলোতে দেখলাম রত্না মেজেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত দিলাম। বল্লাম, “কি হয়েছে?”

আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না—তখন আমার চব্বিশ বছর বয়স। কিন্তু কখনও কোনো মেয়ের গায়ে হাত দিই নি। ওর গায়ে হাত দেবা মাত্র সারা শরীরে আমার বৈদ্যুতিক শক্‌-এর মত অনুভূতি হ’ল। হঠাৎ ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। রত্না তড়া করে উঠে দাড়াল। ফিরে দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে ডাঃ মুখার্জী।

আশা করি, আর না বল্লেও চলবে যে, সেদিন রত্নার বাবা আর কাকার হাতে আমার ভাগ্যে উত্তম মধ্যম জুটেছিল। তবে খুব বেশী কাহিল হইনি। মাত্র দিন চারেক জ্বর হয়েছিল।

ভাল হয়ে আবার গেলাম নিজের ল্যাবরেটরীতে। সেখানে দেখি ডাঃ মুখার্জী বসে। তিনি জানালেন যে, আমাকে গাইড করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আমি যেন ডিপারটমেনট ত্যাগ করি।

আমি বল্লাম, “তা সম্ভব নয়। আপনি আমাকে আর কারও কাছে না হয় ট্রান্সফার করে দিন। আমার থিসিস, প্রায় শেষ, এখন রিসার্চ ছাড়া সম্ভবপর নয়।”

“আমি তোমাকে আর গাইড করতে পারব না। তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার—যদি অন্য কেউ তোমাকে নিতে চান আমার আপত্তি নেই। তুমি যার অধীনে ইচ্ছে কাজ করতে পার।”

“বেশ। আমি কিন্তু নিজের কাজ করে চলবে। আপনি আমাকে গাইড করুন বা না করুন।”

দু’দিন পরে বুঝতে পারলাম তিনি আমার জন্যে কি করেছেন। প্রথমতঃ আমার স্কলারশিপ্‌টা বন্ধ করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি তার সহকর্মী প্রফেসারদের বলে দিয়েছেন যে কেউ যেন আমার রিসার্চে গাইড না করেন। ফলে, আমি বুঝে গেলাম যে, আমি পি. এচ ডি কোনো দিনই পাব না। কিন্তু আমি ল্যাবরেটরী ছেড়ে গেলাম না। তার অন্য কারণ ছিল।

তিন

আপনাকে বলেছিলাম যে, একটা বাঁদরের ওপরে আমি একটা পরীক্ষা চালাচ্ছিলাম। সেটা আমার থিসিসের অঙ্গ নয়—নিজের খেয়াল খুশীমত পরীক্ষা চালাচ্ছিলাম। যেদিন বুঝলাম আমার থিসিস কোনোদিনই পি. এচডির জন্য আর দাখিল করতে পারব না, সেদিন থেকে আমি পুরোপুরিভাবে বাঁদরটার পেছনে পড়লাম। বাঁদরটার নাম ছিল ঘণ্টু। আমার ওপরে খবরদারি করার কেউ না থাকায় কাজ করার আরও সুবিধে হল।

ডাঃ মুখার্জী আমাকে গাইড করা বন্ধ করলেও আমাকে ল্যাবোরেটরী থেকে তাড়াতে পারেন নি।

শেষকালে একদিন সফলতা পেলাম। কি সফলতা পেলাম সেটা আপনাকে জানানো দরকার।

কোনো টেকনিক্যাল শব্দ ব্যবহার না করে আপনাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। যে কোনো জীবের মস্তিষ্কের দু’টো অংশ আছে। একটা অংশ ঐচ্ছিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, অন্য অংশ অনৈচ্ছিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যে অংশ ঐচ্ছিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে যে ধমনী রক্ত নিয়ে যায়, তাতে একটা বিশেষ ইনজেকশান দিয়ে বাঁদরটার স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দিলাম। তার আগে অবশ্য অন্য কয়েকটা আরও ইনজেকশান দিতে হয়েছে যাতে ওর রক্তে কয়েকটা কেমিক্যাল্‌সের আধিক্য হয়।

তারপর ওর মাথার একটা ছোট টুপী পরাতাম। টুপীটা একটা সাধারণ রেডিও রিসিভারের মত। ওতে একটা বিশেষ ট্রান্সফর্মার লাগান থাকত—বেতারের সাহায্যে যখন যে আদেশ পেত সেটা ওর মস্তিষ্কে একটা বৈদ্যুতিক শক্ দিয়ে জানাত। ভিন্ন ভিন্ন আদেশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রকমের বৈদ্যুতিক শক্‌-এর দরকার হত। সেজন্য বাঁদরটাকে অনেকদিন ট্রেনিং দিতে হয়েছে।

আমি আমার রেডিও ট্রান্সমিটার থেকে আদেশ দিতাম—যে আদেশ দিতাম বাঁদরটা তাই-ই করত।

কিন্তু প্রত্যেকবারই দেখতাম, ঘণ্টুকে দিয়ে কোনো কাজ করানর পরে ঘণ্টু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ত। আর ওর তখন ভীষণ খাই খাই স্বভাব হয়ে গেল। কিন্তু এর সঙ্গে আমার রিসার্চ-এর কোনো সম্বন্ধ আছে বলে জানতাম না। অনেক পরে জানলাম।

এই সময়ে আমার ভীষণ অর্থাভাব দেখা দিল। কারণ সেই স্কলারশিপ বন্ধ। নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে ডাঃ মুখার্জী আমাকে শাস্তি দেবার জন্য ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেন নি। নিজেই আমাকে ভাতে মারার ব্যবস্থা করে দিলেন।

কিন্তু টাকা আমি কোথায় পাই? ব্যাঙ্কের টাকা সব শেষ। মামার কাছে চাওয়া যায় না—নিশ্চয়ই দেবে না। কি করি?

এ সময়ে আমি হোস্টেল ছেড়ে বস্তীতে থাকতে শুরু করেছিলাম। রোজ দেখতাম, সন্ধ্যেবেলা এক মাড়োয়ারীর দোকানে ক্যাশ, গোনা হয়। সাধারণতঃ মাড়োয়ারী আর ওর এক সাকরেদ দোকানে থাকে। দোকানটা রেশম আর জরীর। তাঁতীরা কেনে সিল্কের শাড়ী বোনার জন্য। বস্তীটা তাঁতীতেই ভর্তি প্রায়। দোকানটা গলির মোড়ে। সন্ধ্যের পরে প্রায় নির্জন হয়ে যায় গলিটা।

রোজ দেখতাম গাদা গাদা টাকা গোনা হচ্ছে। এ দিকে আমার পকেটে কয়েকটা মাত্র পয়সা পড়ে আছে। সুতরাং একটা প্ল্যান করলাম।

আমার সেই রেডিও ওয়েভ কন্টোল যন্ত্রটাকে একদিন নিজের বস্তীর ঘরে নিয়ে এলাম। এটা একটা ছোট ট্রান্‌জিষ্টার রেডিওর মত। সহজেই বয়ে আনা যায়। পরের দিন বাঁদরটাকে নিয়ে এলাম ঘরে। অবশ্য লুকিয়ে আনলাম, যাতে কেউ সন্দেহ না করতে পারে।

সন্ধ্যের পরে মাড়োয়ারীটা যখন টাকার থলিটা বেঁধে সবে গদী থেকে উঠছে, তখন হঠাৎ ঘণ্টু দোকানে ঢুকে থলিটা নিয়ে চম্পট দিলে। ঘণ্টুকে সোজা সামনের বটগাছে তুলে দিলাম সিগন্যাল দিয়ে। তারপর ঘণ্টু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ীর ছাদ থেকে ওবাড়ীর ছাদ দিয়ে সোজা কলেজ ল্যাবরেটরীর ছাদে হাজির হল। সবই অবশ্য আমার সিগন্যালেই হল।

মাড়োয়ারী কিন্তু চীৎকার করে লোক জড়ো করে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। টর্চ আর লাঠি নিয়ে খোঁজাখুজি শুরু হল বাঁদরটার। টুপী পরা বাঁদর—কাজেই এটা কারুর চালাকী তা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ঘণ্টুকে ওরা খুঁজে পেলো না।

আমার আস্তানা থেকে কলেজ ল্যাবরেটরী প্রায় মাইল দু’য়েক।

কলেজের ল্যাবরেটরীর ছাদে যখন পৌছালাম, তখন প্রায় রাত দশটা। কিন্তু ছাদের ওপরে ঘণ্টুকে দেখতে পেলাম না।

এবারে ব্যাপারটা চিন্তার হল। আমার সিগন্যালে কোনো ভুল চুক হবার সম্ভাবনা নেই। ঘণ্টু কোন্ রাস্তা দিয়ে এই ছাদে আসবে তার চার্ট আমি আগেই করে রেখেছি। নিয়ম মত ঘণ্টু ছাদের ঠিক মাঝখানে শুয়ে থাকবে। আর তার হাতে থাকবে টাকার থলি। এদিক ওদিক খোঁজাখুজি করে হয়রান হয়ে গেলাম কিন্তু ঘণ্টু কোথাও নেই।

শেষকালে ভাবলাম, চলেই যাই। ল্যাবরেটরীতে কেউ নেই। শুধু নিজের কাজের জায়গাটা খুলে রেখে ওপরে উঠেছি। কোনো দারোয়ান বা চাপরাশি যদি আমাকে এভাবে রাত-দুপুরে ছাদে ঘুরতে দেখে তাহলে সন্দেহ করতে পারে। তার ওপরে ভীষণ শীত।

নীচে যাব বলে ফিরে আসছি, হঠাৎ নজর পড়ল সিড়ির কাছে কি একটা পড়ে আছে। তুলে দেখি সেই টাকার থলি।

ল্যাবরেটরীতে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম। থলি খুলে টাকা গুণলাম। খুব বেশী নয়। মাত্র বারশ’ টাকা। অবশ্য আমার পক্ষে এই-ই অনেক। টাকাগুলো পকেট ভরলাম। থলিটা পুড়িয়ে ফেললাম।

তা না হয় হল, কিন্তু ঘণ্টু কোথায় গেল? ওকে খোঁজা দরকার। কেননা ঘণ্টু ধরা পড়লে আমার ধরা পড়তে খুব বেশী দেরী হবে না।

সুতরাং আর একবার ছাদে উঠে খুঁজতে হ’ল। কোনো ফল হ’ল না। হঠাৎ মনে হ’ল ঘণ্টু তার আস্তানায় ফিরে গিয়ে থাকতে পারে। গেলাম জানোয়ার রাখার জায়গায়। কিন্তু ঘণ্টুকে সেখানেও খুঁজে পেলাম না।

চার

অগত্যা বাড়ী ফিরতে হল। রেডিও ওয়েভ কনট্রোল যন্ত্র দিয়ে এখন ঘণ্টুকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। কেন না ঘণ্টুকে যে ইনজেকশান দিয়েছিলাম তার প্রভাব শেষ হয়ে গেছে। চার ঘণ্টার বেশী প্রভাব থাকে না। সুতরাং কলকাতা থেকে পালানই ভাল। কেন না ঘণ্টু ধরাপড়া মাত্র পুলিশ আমাকেও ধরে হাজতে পুরবে। ভোরের ট্রেণে বম্বে পালাব ঠিক করলাম।

ভোর বেলা হাওড়া স্টেশনে পৌছলাম। নাগপুর এক্সপ্রেস ছাড়বে ৭-১৫ মিনিটে। একটা বম্বের টিকিট কিনে গাড়ীতে বসলাম। সারারাত ঘুমুই নি। দুশ্চিন্তার চোটে আরও কিছুদিন ঘুম হবে না।

একটা বিষয়ে অবশ্য আমি নিশ্চিন্ত। ঘণ্টু ধরা পড়লেও ওটা যে আমার বাঁদর তা কেউ বলতে পারবে না। ওটার ওপরে আমি একসপেরিমেন্ট চালিয়েছি তা অনেকেই অবশ্য জানে। তাছাড়া এখন কলকাতায় থাকলেই আমাকে ল্যাবোরেটরীতে যেতে হবে। পুলিশ যদি ঘণ্টুকে নিয়ে একবার কলেজে যায় তাহলে ঘণ্টুই আমাকে সনাক্ত করে ফেলবে। তখন আমার আস্তানায় হানা দিলেই পুলিশ বামাল সমেত আমাকে ধরে ফেলবে। সুতরাং আপাতত পালানই ভাল।

একটা থার্ডক্লাশ গাড়ীর বাঙ্কে বিছানা পেয়ে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ শুনলাম প্লাটফর্মে খবরের কাগজওয়ালা চীৎকার করছে—“রহস্যময় চুরি, চোর-বাঁদরের কীর্তি পড়ুন।” “তাজা খবর ! খুনী বাঁদরের কাহিনী।”

শুনে চমকে উঠলাম। ভাবলাম, ঘণ্টুই খুন করল নাকি?

কাগজওয়ালাকে ডাকলাম। কাগজটা হাতে নিয়েই চমকে উঠলাম—প্রথম পৃষ্ঠায় ঘণ্টুর একটা ছবি।

ঘণ্টুর মাথায় আমার তৈরী যান্ত্রিক টুপীটা ছিল না। অর্থাৎ ধরা পড়ার আগে হয় ও টুপিটাকে খুলে রেখেছিল না হয় পুলিশ খুলে ফেলেছে। পুলিশ যদি টুপিটাকে পেয়ে থাকে তাহলে মুস্কিল । ওর যন্ত্রপাতি প্রায় সবই কলেজের হবি ওয়ার্কশপে তৈরী। যারা তৈরী করেছে তারা ঠিকই চিনতে পারবে । সুতরাং আমি ধরা পড়ে যাব।

খবরের কাগজের কাটিংটা আমার কাছে আছে। পড়ছি শুনুন—

“বিশ্বাস করুন বা না করুন।

খবর পাওয়া গিয়াছে যে, কলিকাতার একটি বস্তী এলাকায় গতরাত্রি প্রায় ৭টার সময় একজন জরী ও রেশম ব্যবসায়ীর দোকান হইতে প্রায় বারশত টাকা চুরি যায়। চোর একটি বাঁদর। বাঁদরের মাথায় একটি কাল রং-এর টুপী পরান ছিল । সেজন্য সকলে সন্দেহ করিতেছে যে, ইহা কোনও দুষ্ট লোকের কারসাজী। অনেক খোঁজাখুজি করিয়াও বাঁদরটির কোনও সন্ধান পাওয়া যায় নাই। পুলিশ তদন্ত করিতেছে।

কলেজ ষ্ট্ৰীট হইতে আরও একটি অদ্ভুত সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। সেখানে একটি গৃহস্থ বাড়ীতে একটা বাঁদর রান্না ঘরে ঢুকিয়া পড়ে এবং সমস্ত খাবার গোগ্রাসে খাইতে শুরু করে। তখন প্রায় নয়টা। ঐ বাড়ীর একটি মেয়ে (২২ বৎসর) বাঁদরটিকে দেখিতে পায়। সে একটা লাঠি লইয়া বাঁদরটিকে তাড়া করিলে বাঁদরটি হঠাৎ তাহাকে আক্রমণ করে এবং তাহার গলার কাছে কামড়াইয়া পরে। মেয়েটির চীৎকারে অনেকে আসিয়া পড়ে। তখন বাঁদরটি মেয়েটিকে ছাড়িয়া পালাইয়া যায়।

মেয়েটিকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। রাত্রি প্রায় বারটার সময় মেয়েটির মৃত্যু হয়।

পাড়ার লোকেরা বাঁদরটির গতিবিধির উপরে দৃষ্টি রাখে। রাত্রি প্রায় ছয়টার সময় দমকল বাহিনী বাঁদরটিকে গ্রেফতার করিতে সমর্থ হয়।”

তার মানে ঘণ্টু এখন দুটি অপরাধে অপরাধী। প্রথমটি চুরি আর দ্বিতীয়টি খুন। ঘণ্টুকে যদি কেউ সনাক্ত করতে পারে তাহলেই পুলিশ আমার খোঁজে বেরুবে।

সুতরাং আমি বম্বে পালালাম। এই আমার প্রথম খুন।

পাঁচ

সিটিতে না থেকে আমি শহরতলীর দিকে বাসা নিলাম। বাসা মানে একটা শুধু ঘর। একটা কুয়ো আছে, সেখান থেকে জল এনে স্নান করা আর পান করা। আর একটা চাকরিও পেলাম। এতদিন রেডিও নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে এসেছি, আমার কাজ দেখে আমাকে একটা রেডিও কারখানায় নিয়ে নিল। মাইনে প্রায় আড়াইশো সব মিলিয়ে। নাম আর ডিগ্রি সব চেপে দিলাম। নাম বল্লাম রাকেশ লাহিড়ী।

দিব্যি কাটতে লাগল। সেই সময়ে আমার সঙ্গে আলাপ হ’ল হামিদুল্লা শা’র সঙ্গে।

হামিদুল্লা শা’ নিজেকে লক্ষৌ-এর নবার বংশের লোক বলে পরিচয় দিল। সে থাকে আমার বাড়ীর কাছেই। ওর রাজকীয় পরিচয়ের সাক্ষী ওর প্রিভি পার্শ অর্থাৎ বার্ষিক সাড়ে ছ’শ টাকা। এ ছাড়া অন্য কোনো আয়ও নেই। সারা বছর ধার করে আর ওর টাকা এলেই দিয়ে দেবে বলে। ওর সম্পত্তি শুধু একটা কুকুর আর একটা ঘোড়া। আর একটা সহিস চাকর আছে।

পাড়ার লোকের কাছে শুনলাম যে, হামিদুল্লার সব সম্পত্তি ঘোড়ার রেসের পেছনে গেছে। সে কয়েকবার অষ্ট্রেলিয়া থেকে ঘোড়া আনিয়েছিল, কিন্তু ওর ঘোড়া কখনই জেতে নি। ওর বাড়ীতে যে ঘোড়াটা আছে, সেটাও রেসের ঘোড়া।

আলাপ হওয়া মাত্র হামিদুল্লা আমার কাছ থেকে টাকা ধার করতে শুরু করল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ওর জানা শোনা কেউ ওকে আর ধার দেয় না। তবে কখনই দশ-পাঁচ টাকার বেশী চাইত না। হিসেব করে দেখেছিলাম কোনো মাসে টাকা পঁচিশের বেশী নিত না। সুতরাং নবাব বন্ধু রাখার পক্ষে খরচটা খুব বেশী নয়। দিয়ে দিতাম। টাকা শুধু শনিবারে চাইত রেস খেলার জন্য। অবশ্য পাঁচ টাকায় কী যে রেস খেলত, বুঝতে পারতাম না।

পরে শুনেছিলাম যে, হামিদুল্লা আন্ অফিসিয়াল বাজী ধরে । যে কোনো রেসের মাঠেই এটা হয়। মাঠের বাইরে অনেক এজেন্ট থাকে। তারা ঘোড়ার নামে টাকা জমা নেয়। ঘোড়া জিতলে সেই অনুপাতে টাকা দিয়ে দেয়। ঘোড়া হারলে টাকা গেল। হামিদুল্লা যখন জিতত তখন গান গাইতে গাইতে ফিরত। বুঝতে পারতাম ওর পেটে খানেকটা ধান্যেশ্বরী ঢুকেছে। যখন হারত, তখন চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে যেত।

বেশী জিতলে আবার ধারের টাকা ফেরৎ দিয়েও যেত । “বাঙালীবাবু, রূপিয়া লিজিয়ে” বলে দু’ একটা নোট আমার হাতে দিয়ে যেত।

একদিন সকালে হামিদুল্লা এসে বল্লে, “বাঙালীবাবু, তুমি আমার ঘোড়াটা রেখে আমাকে দু’শো টাকা ধার দেবে?”

বল্লাম, “তুমি টাকা নিয়ে যাও! কিন্তু ঘোড়া নিয়ে আমি কি করব?”

“বেশ দাও।” হামিদুল্লা টাকা নিয়ে চলে গেল। দু দিন পরে এসে বল্লে, “আমি লক্ষৌ যাচ্ছি। তুমি আমার ঘোড়াটাকে রাখ। তোমাকে আর টাকা ফেরৎ দিতে পারব না।”

আমি বল্লাম, “আমি ঘোড়া নিয়ে কি করব? তোমার রেসের ঘোড়ার তোয়াজ করা আমার কর্ম নয়। অত টাকা নেই।”

কিন্তু হামিদুল্লা নাছোড়বান্দা। সে আমাকে ঘোড়াটা গছাবেই। অগত্যা রাজী হলাম। তখন হামিদুল্লা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বলে, “ঐ ঘোড়াটার দাম কম করে হলেও ১০ হাজার টাকা। সুতরাং আমি তোমার কাছে আরও ন’ হাজার টাকা পাই।”

“তার মানে?”

“আজ পর্যন্ত যত ধার তুমি দিয়েছ সব মিলিয়ে এক হাজারের বেশী নয়। সুদ-সমেত এক হাজারই ধরলাম। সুতরাং আরও ন’ হাজার টাকা আমার পাওনা থাকল।”

“আমার অত টাকা নেই। তুমি তোমার ঘোড়া নিয়ে কেটে পড়।”

“তা হয় না বাঙালীবাবু। একবার যখন কথা দিয়েছ তখন বাকী টাকা দিতেই হবে।”

“আমার অত টাকা নেই। কোথা থেকে দেবে?”

“এখন নেই, পরে হবে। তখন দিও। এই কাগজে আমার যাদের কাছে ধার আছে তাদের নাম ঠিকানা আছে। আস্তে আস্তে দিয়ে দিও। ওটা হাজার চারেক। বাকী পাঁচ হাজার পরে দিয়ে দিও।”

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হামিদুল্লা চলে গেল।

কাগজগুলো খুলে দেখি পাওনাদারদের একটা লিষ্ট। একটা রেস ক্লাবের মেম্বারশিপের কার্ড, আর একটা সেই ঘোড়ার বংশপরিচয়। ঘোড়াটার বাপ, মা, ভাই, ঠাকুর্দা, দিদিমা, কাকা ইত্যাদিদের নাম ধাম আর কে কবে কোন রেস জিতেছে তার ইতিহাস।

পরের দিন ভোরবেলা হামিদুল্লার সহিস রসিদ ঘোড়া সমেত হাজির। বল্লে, তাকে নাকি মালিক সাহেব হুকুম করেছেন ঘোড়াটা আমার কাছে পৌঁছে দিয়ে যেখানে খুশী চলে যেতে।

“হুজুর, আমি গরীর মানুষ। আট বছর বয়স থেকে মালিক ছাড়া কাউকে চিনি না। ওঁর বড় বড় রইসী ঘোড়ার সেবা করেই জীবন কেটেছে। কিন্তু এখন কোথায় যাব?”

বল্লাম, “আমি ঘোড়াটা কোথায় রাখব এখনও ঠিক করতে পারি নি। আপাতত যেখানে ঘোড়াটা ছিল সেখানেই থাক। তুমিই দেখাশোনা কর।”

বলেই বাড়ী থেকে চলে গেলাম। মহা দুশ্চিন্তা। কাজে গেলাম। মন বসছে না। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।

একটু দেরী করেই বাড়ী ফিরলাম। ফিরে দেখি অনেক লোক আমার ঘরের সামনে জটলা করছে। আমি কাছে আসতে একজন নমস্কার করল। জিগ্যেস করলাম, “কি ব্যাপার?”

তারা যা বল্লে, তার মানে এই দাড়াল যে হামিদুল্লা কাল সবাইকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে আমি হামিদুল্লার সমস্ত সম্পত্তির বিনিময়ে তার সমস্ত ধার শোধ করবার দায়িত্ব নিয়েছি। তাদের অনেক টাকা আটকে আছে। সুতরাং আমি যেন মেহেরবানী করে তাদের টাকা দিয়ে দিই।

শুনে আপাদমস্তক রাগে জ্বলে উঠলো। হামিদুল্লাকে সামনে পেলে হয়ত খুনই করে ফেলতাম। বললাম, “হামিদুল্লা আমার কাছে টাকা ধার করেছিল। সে জন্য তার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে গেছে। তোমাদের টাকা শোধ করার দায়িত্ব আমার নয়। সেটা হামিদুল্লার—তার কাছে যাও।”

সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। আমি সোজা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাইরের গোল মাল তাতে বেড়ে গেল।

একটু বাদে মনে হ’ল বাইরের গোলমাল যেন কমে এল। কেউ যেন ওদেরকে কি বোঝাচ্ছে মনে হ’ল। জানলা দিয়ে উকি মেরে দেখি সেই সহিসটা লেক্‌চার দিচ্ছে। সরে গেলাম সেখান থেকে।

খানিক পরে দরজায় খুটখুট, আওয়াজ হ’ল। খুলে দেখি সেই সহিস। বললাম, “কি ব্যাপার?”

সে বললে, “ওরা চলে গেছে হুজুর । আজকে ‘বম্বই কুইন’ সারাদিন খায়নি। সেজন্য যে হুকুম করবেন তা করব।”

অর্থাৎ এখন টাকা দাও। “বম্বই কুইনকে” (অর্থাৎ সেই ঘোড়াটাকে) খাওয়াতে হবে। কি আর করি, দু’টো টাকা দিয়ে দিলাম।

রাত্রে ভেবে ঠিক করলাম ঘোড়াটাকে বিক্রী করে দেবো।

পরের দিন রসিদ আসতে বলাম সে কথা। জিগ্যেস করলাম, ওটাকে বেচার কোনো ব্যবস্থা সে করতে পারবে কি না?

রসিদ অবাক হয়ে গেল। বলেল, “হুজুর, রেসের ঘোড়া কেনার মত লোক কংগ্রেসী রাজ্যে কোথায় পাবেন? তবে যদি আপনি বম্বই কুইনকে দিয়ে ছ্যাকড়া গাড়ী চালাতে চান, তাহলে বিক্রী হবে।”

‘রেসের ঘোড়া’ কথাটা শোনা মাত্র একটা নতুন আইডিয়া মাথায় এল। সঙ্গে সঙ্গে মন ঠিক করে ফেললাম। আর সেই আইডিয়ার জোরে মাস তিনেকের মধ্যে কয়েক লাখ টাকা রোজগার করে ফেললাম।

বোধ হয় অনুমান করতে পারছেন। ঘোড়ার লাগাম আর জীনে মিলে আসলে সেই রেডিও ওয়েভ রিসিভারটা লাগান থাকত। হাজার পরীক্ষা করেও বোঝা সম্ভব নয় কারুর পক্ষে। আমি রেস কোর্সে দর্শকদের আসনে বসেই যন্ত্রে নির্দেশ দিতাম। প্রত্যেক বারেই “বম্বই কুইন” ফাস্ট হ’ত। ব্যস!

ছয়

আমার জীবন বদলে গেল। রেস খেলার টাকা দিয়ে একটা বাড়ী কিনলাম। কিছু কোম্পানীর কাগজও কিনলাম। আর টাকা ওড়াতে শুরু করলাম।

উড়ো টাকা কখনও থাকে না। সেটা ঠিক নষ্ট হয়ে যায়। আমার বেলাও তাই হল। হামিদুল্লা ফিরে এল। এসে ঘোড়ার বাবদ আমার থেকে বেশ কিছু আদায় করে নিল।

এমন অবস্থায় যা হয়, আমারও তাই হ’ল । খুব বেশী মদ খেতে শুরু করলাম। বম্বেতে অবশ্য সবই কালোবাজারে কিনতে হত।

সে যা হোক। আমার ব্যবসা কিন্তু বেশী দিন চললো না। হঠাৎ যেমন অনেক টাকা আসতে শুরু করেছিল, তেমনি হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে গেল।

সেদিন রাত্রে একটু বেশী খেয়ে ফেলেছিলাম। বাড়ী ফিরে শুয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল অনেক লোকের হৈ হট্টগোলে। ভাল করে ঘুম ভাঙার পর বুঝতে পারলাম যে কে বা কারা আমার দরজায় খুব জোরে জোরে ধাক্কা মারছে। দরজা খুলে দেখি আমার চাকর আর বেশ কয়েকজন পাড়ার লোক।

যা শুনলাম তাতে আমার নেশা কেটে গেল। আমার সহিস (এবং জকি) রসিদকে কে খুন করেছে। তার মৃতদেহ আস্তাবলে পড়ে আছে। গলার কাছে বিরাট ক্ষত।

পুলিশ এল। বাড়ীর সব চাকর-বাকরদের জবানবন্দী নিয়ে চলে গেল। রসিদের মৃতদেহও নিয়ে গেল।

পুলিশ অবশ্য অনেক রকম জল্পনা করতে শুরু করল। আমাকে অনেক প্রশ্ন করার পরে বিকেল বেলা রেহাই দিল ।

বাড়ী ফিরে এলাম। হঠাৎ আস্তাবলে গিয়ে একটা জিনিষ দেখে চমকে উঠলাম। একটা সন্দেহ মনে উকি মারল। ভাল করে পরীক্ষা করার পর আর সন্দেহ রইল না। রসিদের হত্যাকারীকে চিনতে পারলাম।

অনুমান করতে পারছেন? পারছেন না? সহিসকে খুন করেছে ঘোড়াটা। ওর গলার লোমে, কষে জমাট বাঁধা রক্ত দেখেই বুঝতে পারলাম।

পরের দিন পুলিশ পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট নিয়ে এল। ঘোড়াটাই সহিসের গলা কামড়ে ধরে খুন করেছে, পুলিশও বললে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে আমাকে মুচলেখা দিতে হ’ল যে আমি ঘোড়াটাকে কখনও বাড়ীর বাইরে নিয়ে যাব না। ভবিষ্যতে যদি এ রকম ঘটনা আবার হয় তাহলে আমাকেই পুলিশ দায়ী করবে। কেন না, পুলিশের মতে ঘোড়াটা পাগল।

আমার রেস খেলার বারোটা বেজে গেল। তার পরে যার আমার বাড়ীতে আসতে শুরু করলেন তারা প্রেস-রিপোর্টার।

পরের দিন সমস্ত খবরের কাগজে আমার আর আমার ঘোড়ার ছবি বেরুল। আর রেসের ঘোড়ার সহিস খুন করার রসাল কাহিনী তার সঙ্গে।

এই ঘোড়াটাকে নিয়ে আমি এবারে কি করব? সুতরাং নিজের রিভলভারটা থেকে দু’টো গুলী খরচ করে ওটাকে শেষ করে ফেললাম।

তার পরে পেটের চিন্তা দেখা দিল। আবার সেই পুরোনো কারখানায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হ’ল না, কি করব ভাবছিলাম। তার ওপরে আর একটা চিন্তা নতুন করে আমার মনে দেখা দিল। ভাগ্য-চক্রের ফেরে আমার অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে গেল, সমস্ত কাগজে আমার ছবি ছাপা হবার পর। যদি ঘণ্টুর কেসে পুলিশ আমাকে সন্দেহ করে থাকে তাহলে দু’ একদিনের মধ্যেই ক্যালকাটা পুলিশ আমাকে পাকড়াও করবে।

কিন্তু কলকাতা থেকে পালান যত সোজা ছিল, বম্বে থেকে পালান তত সোজা নয়। বম্বেতে আমার নামে একটা বাড়ী আছে, বেশ কিছু শেয়ার আছে। এগুলো অবশ্য আমার আসল নামেই কেনা, অর্থাৎ রঞ্জন লাহিড়ীর নামে। ছদ্মনামে নয়। সব ফেলে কোথায় যাব? পুলিশ ধরে ত’ ধরুক।

কিন্তু চারদিন হয়ে গেল, পুলিশ এল না। তার জায়গায় এল একটা চিঠি। যে চিঠি পাবার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি কখনও। চিঠিটা কার কাছ থেকে এসেছিল অনুমান করতে পারেন? এসেছিল রত্নার কাছ থেকে।

চিঠিটা এতবার পড়েছি যে একেবারে মুখস্থ হ’য়ে গেছে। শুনুন—

রঞ্জনদা,

তোমাকে অনেকদিন আগে থেকেই চিঠি লিখবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কোনো সুযোগ ছিল না। তুমি আমার অমানুষিক ব্যবহারের জন্য দেশত্যাগী হয়েছ তা আমি জানি, কিন্তু তুমি পেছনে একটাও চিহ্ন রেখে গেলে না কেন? এমন কি নামও বদলে ফেললে? তুমি রঞ্জন থেকে যে রাকেশ হয়ে উঠবে তা আমি কল্পনাও করতে পারি নি।

সে যা হক। আমি তোমার কাছে অনেক অপরাধ করেছি। নিজের অপরাধ স্থালন করার চেষ্টা আমি করব না, কিন্তু সত্য কথা তোমার জানা উচিত, তাই এ চিঠি লিখছি।

তোমাকে আমি সত্যই ভাল বেসেছিলাম। আমি আশা করেছিলাম তুমিও আমাকে ভালবাসবে। কিন্তু তা তোমার কাছ থেকে আমি পেলাম না। পেলাম শুধু মাস্টারীর উপদেশ আর অবহেলা। কাজেই আমি আঘাত দিয়ে তোমাকে জাগাতে চাইলাম।

কিন্তু আমার ভাগ্য মন্দ, আমার প্ল্যান ফেল করল। হঠাৎ বাবা এসে গেলেন, আমাকে ঐ অবস্থায় দেখার পর ওঁর ধারণা হ’ল অন্য রকম। বাবা তোমাকে এত শাস্তি দেবেন, তা আমি কল্পনাও করতে পারি নি। আরও একটা কথা তোমাকে জানাচ্ছি, তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না—তুমি কলকাতা ত্যাগ করার পর আমি সব কথা জানতে পেরেছিলাম। তোমার। স্কলারশিপ বন্ধ হবার খবর আমি জানতাম না, জানলে হয়ত কিছু করতে পারতাম।

মা আমার সব কথাই জানতেন। আমি বি. এস. সি. পাশ করার পর আর পড়ি নি, চাকরি নিয়ে এসেছি একটা ফার্মে। আমি বাড়ী ছাড়ার আগে আমার সঙ্গে বাবার একটু মনোমালিন্য হয়ে গেছে তোমাকে নিয়ে।

খবরের কাগজে তোমার যে ছবি আর কাহিনী বেরিয়েছে তার সঙ্গে আমার জানা রিসার্চ-স্কলারের কোনো সাদৃশ্য নেই। তুমি আমাকে কোনোদিন ভাল বাসনি—এখন হয়ত ঘৃণা কর। আমি কিন্তু ঐ রেসুড়ে রাকেশকে ভালবাসি নি। ভালবেসেছিলাম রঞ্জনকে। তুমি যদি আবার সেই রঞ্জন হ’য়ে কখন ফিরে আসতে পার তাহলে আমার সঙ্গে একবার দেখা করে। শুধু তোমার সঙ্গে একবার দেখা করার জন্যই আমি এখনও কলকাতায় আছি। তারপরে অন্য কোথাও চলে যাব।

অনেক আবোল-তাবোল লিখলাম। চিঠিটা তুমি আদৌ পড়বে কি না জানি না। আমার সব কথা লিখলাম। ভালোবাসা রইল। ইতি—

তোমার—রত্না।

সাত

চিঠির উত্তর আমি দিয়েছিলাম। রত্নাকে আমি বুঝতে পারলাম। রত্না চেয়েছিল শুধু একটু ভালবাসা, আর কিছু নয়। রত্নাকে লিখলাম যে, আমার রেসুড়ে জীবন শেষ হয়ে গেছে। আমাকে নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে হবে।

সত্যই আর রেস খেলা সম্ভবপর ছিল না কেননা আবার একটা রেসের ঘোড়া কোথায় পাব? যদিও বেশ কয়েকজন ঘোড়া বিক্রী করতে চেয়েছিল, কিন্তু যে দাম তারা হাঁকল তা দিতে হলে আমাকে বাড়ী বিক্রী করতে হয়। ইতিমধ্যে হামিদুল্লাও পটল তুলেছে। অবশ্য বেঁচে থাকলেও আর একটা রেসের ঘোড়া কোথায় পেত?

রত্নার সঙ্গে তিন চারটে চিঠি বিনিময়ের পর কলকাতায় এলাম। একটা কলেজে চাকরি পেলাম। আর রত্নাকে বিয়েও করলাম কয়েক দিনের মধ্যেই।

ডাঃ মুখার্জী এবার আমার থিসিসটা ফরওয়ার্ড করে দিলেন। যথাসময়ে পি. এচ. ডিও পেলাম।

আমার জীবন সুখেই কাটতে লাগল। রত্নার রূপ আর গুণ দুটোই ছিল। যথেষ্ট সেবা আর ভালবাসা দিয়ে রত্না আমার জীবনটাকে ভরে তুললো।

হঠাৎ একদিন কাগজে পড়লাম রাশিয়া আর আমেরিকার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে আমার থিসিসের বিষয়টা নিয়ে। ওরা চেষ্টা করছে কি ভাবে মানুষের সম্পূর্ণ স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দিয়ে তাকে যান্ত্রিক উপায়ে চালনা করা সম্ভব?

যে রিসার্চটাকে আমি ছেড়ে রেখেছিলাম, সেটা যে এমন ভাবে আবার উঠে পড়বে তা আমি ভাবি নি। এর আমি সবই জানি। এখুনি কোনো জার্নালে ওটা প্রকাশ করলেই আমি অমর হয়ে যাই। কিন্তু হাতেনাতে করে দেখানোর প্রমাণ কি করে দিই? তা ছাড়া কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যই প্রমাণিত করা যাবে না। যে বাঁদর আর ঘোড়াকে দিয়ে পরীক্ষা করেছিলাম, দু’জনকেই বেআইনী কাজে ব্যবহার করেছি। প্রকাশ করলেই জেলে নিয়ে যাবে। বাঁদরটা ত’ সোজা চুরির জন্য ব্যবহার করেছি। আর রেস কোর্সে আমার ঘোড়াটা তো বে-আইনী ভাবে জিতেছে। আমার ঘোড়াটা তো আর নিজের শক্তিতে ছোটে নি, ছুটেছে বৈদ্যুতিক শকে। সেসব তথ্য প্রকাশ করলেই সোজা হাজতবাস করতে হবে।

কিন্তু এখন আমি কি করি? আমার আবিষ্কৃত জিনিষ অন্যে আবার বের করে ফেল্লেই আমার কোনো মর্যাদা থাকবে না। কাজেই কোনো একটা ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। আমার রিসার্চটাকে কোথাও প্রকাশ করতেই হবে।

কিন্তু এখন কার ওপরে আমি পরীক্ষা চালাব? কে রাজী হবে এই মারাত্মক পরীক্ষায় যোগ দিতে?

আমার চিন্তিত মুখ রত্নার চোখ এড়াল না। জিগ্যেস করল, “তোমাকে কদিন থেকে খুব চিন্তা করতে দেখছি। কি হয়েছে?”

“কিছু হয় নি।”

“এত তবে কি ভাবে?”

“ও কিছু নয়।”

তখন ত’ এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু স্ত্রীর কাছে কি করে লুকিয়ে রাখা সম্ভব? সব কথা একদিন বল্লাম। নিজের বাঁদর আর ঘোড়ার কাহিনীও বল্লাম। শেষে জানালাম যে, রাশিয়া আর আমেরিকার অনেক বৈজ্ঞানিক একযোগে কাজ করছে। কোনদিন ওরা আবিকার করে ফেলবে ব্যাপারটা। আমার রিসার্চটা মাঠে মারা যাবে।

শুনে রত্না হাসল। বললে, “এর জন্য এত ভাবনা কি? আমি ত’ আছি।”

“তুমি আছ মানে?”

“আমাকে তোমার প্রমাণের উপকরণ বানাও। আমার ওপরে তুমি একসপেরিমেনট কর।”

শুনে আমি থ’ হয়ে গেলাম। বললম, “রত্না, তুমি পাগল হয়ে গেছ। অসম্ভব। আমার পক্ষে তোমার ওপরে পরীক্ষা চালান সম্ভব নয়।”

কিন্তু রত্না নাছোড়। সে আমার পরীক্ষায় যোগ দেবেই। অনেক বোঝালাম। কিন্তু কিছুতেই রত্নাকে নিরস্ত করতে পারলাম না। তার কাছে শেষে হার মানলাম। শেষকালে রাজী হতে হ’ল।

আট

ফেল্‌। ফেল্‌ করলাম আমি।

প্রথম দিন রত্নাকে ইন্‌জেকশন দেবামাত্র ওর শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হ’ল।

এটা আমি জানতাম না। এর আগে ইনজেকশন দিতাম পশুদের। তারা ত’ আর বলতে পারত না যে, কি হচ্ছে। যে কোনো ইনজেকশনের প্রতিক্রিয়ার মতই এর প্রতিক্রিয়া হবে, এটাই জানতাম। কোনো পশুর বেলাই ইনজেকশনের ফল চার ঘণ্টার বেশী থাক না, এটাই জানতাম। কিন্তু রত্নার বেলা তা হ’ল না। প্রথমে রত্নার মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হল। যন্ত্রণায় রত্না কঁদতে লাগল। কিন্তু আমার করার কিছুই ছিল না। কিন্তু এ দৃশ্য সহ্য করাও যায় না। তাড়াতাড়ি ইথার দিলাম। রত্না অজ্ঞান হয়ে গেল। তথাপি একটা যন্ত্রণা কাতর স্বর ওর মুখ থেকে বেরুতে লাগল। বুঝলাম, অজ্ঞান অবস্থাতেও ওকে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। আমি ধরে নিলাম যে, প্রথম দিন রত্নার ও যন্ত্রণা হবে, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু তা হ’ল না। ইথারের প্রভাব কাটতে লেগে গেল প্রায় সাত ঘণ্টা। তারপরেও কিন্তু সে সুস্থ হয়ে উঠতে পারল না।

রত্না বল্লে, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, সারা গায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে।

এ সব জানা ছিল না। এর প্রতিকারও জানি না। সুতরাং ভাবলাম বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ভাল করে খাইয়ে শুইয়ে দিলাম। ১২ ঘণ্টা ঘুমোবার পরে রত্না স্বাভাবিক হয়ে উঠলো।

ভাবলাম, যাক্, প্রথম ধাক্কা কাটলো। কিন্তু তখনও জানতাম যে, আমি কি করে ফেলেছি।

জানলাম দু’দিন পরে। ভেবেছিলাম, সেদিন রাত্রে রত্নাকে নিয়ে আবার পরীক্ষা করব। সেজন্য রেডিও ওয়েভ কনট্রোল যন্ত্রটা নিয়ে পরীক্ষা করে ঠিক করে রেখে বাড়ী গেলাম।

আমাদের বাড়ীর ঝি (রাণীর মা)-এর মুখে একটা কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সে জানাল যে, রত্না আজকে অনেকটা কাঁচা মাংস খেয়ে ফেলেছে।

“কি ব্যাপার?” জিগ্যেস করলাম। সে জানাল যে, আজকে মাংসওয়ালা দেরী করে মাংস দিয়ে গেছল। সেজন্য রত্না মাংস ফ্রিজে রেখে দিতে বলে। বাড়ীর অন্যান্য কাজ সেরে, কি একটা জিনিস আনতে সে খাওয়ার ঘরে যায়। সেখানে দেখে রত্না ফ্রিজ খুলে কাঁচা মাংস খাচ্ছে।

ব্যাপার দেখে রাণীর মা একটু ভয় পায়। রত্না কিছু টের পাবার আগেই সে চলে এসেছিল। কিন্তু পরে সে মাংসটা বের করে দেখে যে রত্ন প্রায় একপোয়া মাংস খেয়ে ফেলেছে।

শুনে একটু আশ্চর্য লাগলেও, খুব অস্বাভাবিক মনে হল না। ঐ ইনজেকশনের জন্য খুব খিদে পায় এবং যা সামনে পাবে তাই সে খাবে, সেটা ত’ স্বাভাবিক। কিন্তু রত্নার পক্ষে কাঁচা মাংস খাওয়াটা আশ্চর্যের, কেননা সে মাংস প্রায় খায়ই না।

ব্যাপারটা চাপা দেওয়া দরকার। তাই বল্লাম, “তোমার বৌদির বাচ্চা হবে রানীর মা, ওর ওপরে একটু নজর রেখো। কদিন থেকে যা তা খেতে শুরু করেছে।”

“তাই বল, দাদাবাবু। নইলে বৌদি অমন কাণ্ডটা করবে কেন? মিষ্টি খাওয়াও দাদাবাবু, এমন একটা সুখবর শোনালে।”

ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন তখন মনে হয় নি। কাজেই রত্নাকে নিয়ে সিনেমা গেলাম। ফিরে এসে একসপেরিমেনট শুরু করলাম।

এবার ইনজেকশন দেবার পর রত্না, কোনো অসুবিধের কথা বলল না। রত্নার মাথায় সেই রেডিও ওয়েভ রিসিভারটা পরালাম। এটার যান্ত্রিক জটিলতা আগেকারগুলোর তুলনায় অনেক বেশী।

কিন্তু আমার রেডিও সিগন্যালসের কোনো ফল হল না। আমি অনেক রকমভাবে চেষ্টা করলাম, কিন্তু রত্নার দেহে সামান্যতম স্পন্দনও জাগাতে সক্ষম হলাম না। আমি ফেল্‌ করলাম।

নয়

রত্না যাতে আবার কোনো গণ্ডগোল না করে, সেজন্য একটা মর্ফিয়া ইনজেকশন দিয়ে দিলাম। তার পরে আবার নিজের ল্যাবোরেটরীতে ফিরে গেলাম।

পুরো চারদিন কাজ করার পর ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। জন্তু-জানোয়ারকে চালাবার জন্য যে রেডিও ওয়েভ দরকার, মানুষকে চালাবার জন্য তার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী ওয়েভ চাই।

এই সামান্য ব্যাপারটা আমার মাথায় এতদিন আসে নি। যখন ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হল, আমিও আর্কিমিডিসের মত “ইউরেকা” বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।

রাত তখন দু’টো। এ চারদিন বাড়ী যাই নি, ল্যাবরেটরীতেই ছিলাম। সুতরাং বাড়ী চলে এলাম।

দরজার কলিং বেল টিপলাম। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে দরজা খুললো রত্না।

বল্লাম, “এত দেরী হল কেন? ঘুমুচ্ছিলে?”

—“হ্যাঁ।”

—“ঝি, চাকর সব কোথায়?”

—“দু’জনেই ছুটিতে গেছে।”

—“ওঃ।”

গিয়ে শুয়ে পড়লাম। এত রাত্রে আর স্ত্রীর সঙ্গে আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে হ’ল না। ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঠিক কেন জানি না, ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। দেখলাম, রত্না ঘরে নেই। আমাদের শোবার ঘর একটাই, কিন্তু দু’টো আলাদা বিছানা। একা না শুলে রত্নার ঘুম আসে না। সেজন্য এই ব্যবস্থা বরাবর।

প্রথমে ভাবলাম রত্না বাথরুমে, কিন্তু সেখানে ত’ আলো নেই। সুতরাং রত্না নিশ্চয়ই বাইরে গেছে। আমিও উঠলাম। দরজার পর্দা সরিয়ে যা দেখলাম তাতে আমি পাথর হয়ে গেলাম।

শোবার ঘরটা দোতলায়। সামনে একটা বারন্দা আছে। বারন্দা থেকে নীচের উঠোনটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উঠোনের একপাশে হাঁস মুরগীর খাচা। আমার প্রায় ৩০টা হাঁস মুরগী আছে । রত্না হাত বাড়িয়ে একটা মুরগী ধরল। অন্যান্য হাঁস মুরগীরা তারস্বরে চীৎকার করে উঠলো। বুঝলাম, তারা বিপদের আশঙ্কায় চীৎকার করছে। সুতরাং ব্যাপার নতুন নয়।

রত্না মুরগীটার গলাটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। মুরগীটার পাখা ঝট্‌ পট্‌ করাটা একটু বাদেই থেমে গেল। তখন রত্না তার পাখাগুলো ছিঁড়ে ফেললো। তার পরে কাঁচা মুরগীটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো। মুরগীর হাড় চিবুনোর শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম।

চুপচাপ চলে এলাম। ব্যাপার দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার দেওয়া ইনজেকশনের প্রভাবে প্রচণ্ড ক্ষুধা পায় তা জানি, কিন্তু এভাবে কাঁচা মুরগী খাওয়াটা আমি কল্পনা করতে পারি নি।

মনকে সান্ত্বনা দিলাম হয়ত খাবার জিনিষ কিছু না থাকায় রত্না মুরগী খেয়েছে। কিন্তু সকালে ভুল ভাঙল।

আইসক্রীম খাব বলে খানিকটা দুধ ফ্রিজে রাখতে গেলাম। ফ্রিজে অনেক খাবার জিনিষ থরে থরে সাজান আছে, সুতরাং সমস্ত খাবার জিনিষ ছেড়ে রত্না ইচ্ছে করে জ্যান্ত মুরগী খেয়েছে।

হঠাৎ আর একটা সন্দেহ হল। পোল্টীতে গেলাম। যেখানে দাঁড়িয়ে রত্না মুরগীর গলাটা কামড়ে ধরেছিল, তার আশেপাশে রক্ত থাকা উচিত। কিন্তু কোথাও একবিন্দু রক্ত দেখতে পেলাম না। অর্থাৎ মুরগীর রক্তটা রত্নার তেষ্টা মিটিয়েছে। হঠাৎ ঝি, চাকর কেন ছুটিতে গেছে তা বুঝতে পারলাম।

মনে পড়ল, বাঁদর আর ঘোড়া—দুটোই শেষকালে খুনী হয়ে উঠেছিল। আজ রত্নাও তাইই হয়ে উঠেছে ধরতে হবে। মনটা দমে গেল। বুঝলাম, আমার এতদিনের সাধনা সম্পূর্ণ অসফল হয়ে গেছে। যদি রত্নার ওপরে আমার একসপেরিমেন্ট সফলও হয়—তাহলেও ত’ আমি হেরে গেছি, কেননা রত্না আর রত্না নেই। আমার একসপেরিমেন্ট তাকে কাঁচা-মাংস-খেকো রাক্ষসীতে পরিণত করেছে।

কে জানে কেন আমার মনে হল, রত্না দু’ একদিনের মধ্যেই কাউকে খুন করবে। ঘোড়াটা তার সহিসের গলা কামড়ে ধরে ছিল—রত্না কার গলাটা কামড়ে ধরবে? আমার নয়ত?

দশ

কথাটা মনে আসা মাত্র একটা দারুণ আতঙ্কে আমার মনটা ছেয়ে গেল। রত্না তখনও তার সেই শেষরাত্রের খাওয়া খেয়ে অগাধে ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, এক বিছানায় থাকলে হয়ত আগেই রত্না আমার গলাটা কামড়ে ধরত। এক ঘরে অবশ্য থাকি—বলা যায় না হয়ত আজ রাত্রেই রত্না আমার ওপরে আক্রমণ চালাতে পারে।

মনের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করল। দারুণ একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। এটা আমারই হাতের সৃষ্টি রাক্ষসী—এ আমার রক্ত পান করবেই—এ বিষয়ে আমার মনে কেমন একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল। গিলোটিন যে আবিষ্কার করেছিল তার মৃত্যু গিলোটিনেই হয়েছিল। আমার বেলা তার ব্যতিক্রম হবে না। আমার মন বল্লে এ তোমাকে খাবেই।

আর আইসক্রীম খাবার ইচ্ছে রইল না। ঠিকে ঝি এল, নতুন—এর আগে কোন দিন দেখি নি। চা করতে বললাম।

ফ্রিজ থেকে জলখাবারের জন্য খাবার বের করতে লাগলাম। একদিকে কয়েকটা আপেল চোখে পড়ল। দু’টো খাবার টেবিলে রাখলাম।

—“এ কি। তুমি এসব নিজে কেন করছ?”— রত্নার গলা। ফিরে দেখি রত্না কাপড় বদলে মুখ ধুয়ে এসেছে—চোখে ঘুমের আমেজ। বল্লাম, “একটু তাড়া আছে।”

—“একটু বোসো। আমার সঙ্গে চা খেয়ে গেলে কি খুব দেরী হবে?”

—“বেশ, তা খাচ্ছি। তুমি এসো।”

রত্না চলে গেল। ভাবলাম আপেলগুলো কেটে রাখি। প্রথম আপেলটাকে চার টুকরো করলাম। দ্বিতীয় আপেলটা কাটতে যাচ্ছি হঠাৎ রত্নার পায়ের শব্দ পেলাম।

শব্দটা শোনামাত্র আমি হঠাৎ নার্ভাস হয়ে গেলাম। ছুরিটার ওপর বেশী চাপ পড়ে গেল—আমার বাঁ হাতের তর্জনীটা কেটে গেল। রক্ত বেরিয়ে এল—ডান হাত দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরলাম।

রত্না চায়ের ট্রে টেবিলে রাখল। আমার দিকে চোখ পড়তেই জিগ্যেস করলে, “কি হয়েছে?”

—“কিছু নয়। সামান্য একটু কেটে গেছে।”

—“একটু টিঞ্চার আয়োডিন লাগিয়ে নাও। পার্বতী, একটু টিঞ্চার নিয়ে এসো। দেখি কেমন কাটল।”

রত্না আমার হাতটা ধরল। আমি ডান হাতটা সরাবামাত্র কাটা আঙুলটা থেকে তীর বেগে রক্ত বেরিয়ে এল। রক্ত দেখামাত্র রত্নার চোখ জ্বলে উঠলো। ওর চোখের ভাষা আমি পড়তে পারলাম— বুঝতে পারলাম, ওর মধ্যেও ঘুমন্ত রাক্ষসীটা জেগে উঠেছে— আমারই সৃষ্টি রাক্ষসী—এর হাতে এবার আমার মৃত্যু অবধারিত—বুঝলাম, আমার আর কিছু করার নেই—

রত্না নীচু হয়ে আমার আঙুলটা হঠাৎ নিজের মুখে পুরে নিল। বাচ্চারা যেভাবে মায়ের দুধ খায় সেভাবে চুষতে লাগল।

তারপর অনুভব করলাম, রত্নার আঙুল চোষা শেষ হ’ল—বোধ হয় তখন আর রক্ত বেরুচ্ছিল না—নোনা স্বাদ শেষ হওয়া মাত্র —অনুভব করলাম রত্নার দাঁত আমার আঙুলের মাংস হাড় থেকে আলাদা করে ফেললো—আর আঙুলের ধমনী থেকে ও রক্ত শোষণ করতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম, আমার শরীরের সমস্ত রক্ত ঐ আঙুলটা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সারা শরীরে একটা অবসাদ—আমার বাঁ হাতের তর্জনীতে তীব্র বেদনা যেন শেষ বারের মত নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে বিদায় নিচ্ছে। মনে হল এভাবে আমার শরীরের রক্ত শেষ হওয়া মাত্র রত্না আমাকে ঐ মুরগীটার মত চিবুবে। আমি চীৎকার করে উঠলাম।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানটা কি তা আমি বুঝতে পারলাম। সমস্ত চেতনা আমার সজাগ হয়ে উঠলো। আমি ডান হাতে আপেল কাটা ছুরিটা নিলাম। রত্না পাগলের মত আমার আঙুল চুষে চলেছে, কোন দিকে তার দৃষ্টি নেই। ওর জামা খুলে গেছে, ব্রেসারিটা দেখা যাচ্ছে। আপেলের ছুরিটা আমি ওর বাঁদিকের স্তনের পাশে ঢুকিয়ে দিলাম। বুঝতে পারলাম সেটা দু’টো পাঁজরের হাড়ের মধ্যে দিয়ে ঢুকে গেল। গরম একটা তরল পদার্থ আমার সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ল।

এগারো

ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি সোজা সামনের দিকে, তিনি বর্তমানের কিছুই দেখছেন না, তা বুঝতে পারছিলাম—তাঁর দৃষ্টি অতীতের ছবি দেখছে। কিন্তু ভাল করে তাকিয়ে দেখি তার দু’চোখের কোণে জল।

এ অবস্থায় তাকে বিরক্ত করা উচিত নয়। চুপ করে বসে থাকলাম। গল্পের নায়িকার এই শোচনীয় পরিণামে মনটা ভারি হয়ে উঠলো। কথা বলার মত অবস্থা আমারও ছিল না।

তিনি রুমাল দিয়ে জল মুছে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন । সেটার চেয়ে কান্না বোধ হয় ভাল। বলেলন, “আর কি, দিল্লী ত এসে গেল।”

বল্লাম, “হ্যাঁ। এবারে রেডী হতে হবে।”

তিনি বললেন, “আমার গল্পও শেষ হয়ে গেল। রত্নার হৃদপিণ্ড ভেদ করে ছুরিটা চলে গেছল। হাসপাতালে ওর জ্ঞান হয়ে ছিল। মৃত্যুকালীন কয়েকটি কথা বলে মারা যায় । আমার আঙুলটা ডাক্তার বাদ দিয়ে দেয়।”

একটু ইতস্তত করে জিগ্যেস করলাম, “আচ্ছা, কোর্টে মামলা ওঠে নি?”

“হ্যাঁ, উঠেছিল। আমি ভেবেছিলাম ফাঁসী হবে। কিন্তু যে সত্যই পাপী তার সাজা ফাঁসীতে হয় না। ভগবান তাকে সাজা দেন। আমি আমার দোষ স্বীকার করেছিলাম। কিন্তু কোর্ট আমার কথা মানল না। কোটে প্রমাণিত হ’ল যে, আমার স্ত্রী পাগল হয়ে গেছলেন। আর আমার কাজটা আত্মরক্ষার্থে, কাজেই বেকসুর খালাস পেলাম।”

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তার পর বললেন, “আপনাকে আমি যেসব কথা বললাম, সে কথা প্রকাশ করবেন না। আমার অনুরোধ। আজ পনের বছর ধরে এ সব কথা চেপে আছি। কাউকে বলি নি। আপনাকে কেন শোনালাম জানি না। আচ্ছা, নমস্কার।”

ফিরে দেখি গাড়ী নিউ দিল্লী ষ্টেশনে দাড়িয়ে আছে। আমার মোটঘাট নিয়ে নামবার আগেই ভদ্রলোক নেমে পড়লেন। হন্‌ হন্ করে ওভার ব্রীজের ওপরে হাঁটছেন দেখতে পেলাম।

আমি আমার কুলী নিয়ে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে টেম্পো নিলাম। কাছেই যাব, কনাট প্লেসে। আমার গাড়ীটা কনাট সার্কাসে ঢোকা মাত্র দেখলাম রাস্তায় ভীষণ ভীড়। একজন শিখকে অন্য কয়েকজন মিলে মারছে। ব্যাপার কি? পকেটমার নাকি?

আমার ড্রাইভার নেমে গেল। ফিরে এসে বললে, “একজন বুড়ো লোক ট্রাকে চাপা পড়েছে। পাব্লিক ক্ষেপে গিয়ে তাই ড্রাইভারকে মারছে।”

বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। বললাম, “কেমন বুড়ো?

—“বোধহয় বাঙালী। দেখুন না।” যা সন্দেহ করেছিলাম তাইই। দেখলাম রঞ্জন লাহিড়ী চীৎ হয়ে শুয়ে আছে, তার পেটের ওপর দিয়ে ট্রাকের চাকা চলে গেছে। প্রাণ বোধ হয় সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য, মুখে যেন হাসি লেগে আছে।

ড্রাইভারটা অন্যদিকে চীৎকার করছে। বলছে যে, তার দোষ নেই, হঠাৎ বাবুজী তার গাড়ীর সামনে এসে যায়।

চুপচাপ ফিরে এলাম। টেম্পোতে বসে হঠাৎ মনে হল বোধহয় ড্রাইভারের কথাই ঠিক। নিজের জীবন কাহিনী কাউকে বলা বাকী ছিল—সেটা শেষ হওয়া মাত্র রঞ্জন লাহিড়ীর বেঁচে থাকার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছল।

‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার ‘মার্চ এপ্রিল ১৯৬৬’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই উপন্যাসটি। ‘ধুলোখেলা’র সৌজন্যে লেখাটি এবারের সংখ্যায় পাঠকের সামনে আবার নিয়ে এল ‘পরবাসিয়া পাঁচালী’।