সমীকরণ - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

“আদু এই আদু কী পাগলামি করছিস তুই!”

“আমি আজ যা খুশি করব। আয়াম ম্যাড।” চিৎকার করে বলল অদ্বিতীয়া। ওর কথাগুলো সমুদ্রের গর্জনের সাথে মিশে কেটে কেটে ভেসে এল রাহুলের কানে। আপনমনে হেসে উঠলো সে। সত্যিই মেয়েটা পাগলী। একদম বাচ্চাদের মত এখনও। এই যে হঠাৎ করে মন্দারমনি আসার প্ল্যানটা এটাও তো ওরই। জলের মধ্যে ক্রমাগত লাফিয়ে চলেছে অদ্বিতীয়া। আছড়ে পড়া ঢেউগুলো যেন ওর খেলার সাথী। রাহুলের হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ থেকে ছয় বছর আগের একটা বর্ষণ মুখর দিন। ওর তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ার আর অদ্বিতীয়ার ফাস্ট ইয়ার তবে অন্য কলেজ। পারিবারিক পরিচিতির কারণে একে অপরকে ভালো ভাবেই চিনত, জানত। সেদিন ওর কলেজের গেটের সামনে অদ্বিতীয়াকে দেখে অবাক হয়েছিল সে। ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে একটা গোলাপী ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। অবাধ্য বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছাতার বাধা সরিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিল ওকে। ভিজে ঝুপ্পুস মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কোনও রকম ভনিতা না করে বলেছিল, “রাহুল, আই লাইক ইউ। আই লাভ ইউ। তোকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল তাই ভাবলাম আজকেই তোকে কথাগুলো বলে দিই। তোর কোনও চাপ নেই। ভালো করে ভেবে আনসার দিস কারণ আমি ওই টাইম পাস রিলেসনশীপে নেই বস। আমি তোকে ভালোবাসি এটা জানিয়ে দিলাম। এবার তুই ভাব এখন আমার সাথে চুটিয়ে প্রেম করতে, ইন ফিউচার বিয়ে করতে, আমার বাচ্চার বাবা হতে আর আজ থেকে পঁচিশ বছর পর যখন আমার ওয়েট সত্তর কেজি হয়ে যাবে তখন ভালোবেসে আমার মুখ ঝামটা খেতে পারবি কিনা?” রাহুল হাঁ করে ওর কথাগুলো শুনছিল। এভাবেও প্রেম নিবেদন করে কেউ! যাই হোক অদ্বিতীয়ার কথাগুলো ওর কাছে মেঘমল্লার হয়ে বাজছিল কারণ অদ্বিতীয়াকে ওরও ভালো লাগতো শুধু সাহস করে বলা হয়ে ওঠেনি কখনও। মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত একটা সারল্য আছে। “আমি তাহলে এখন আসি। তুই ভাবিস তাহলে আমার প্রপোজালটা।” ছাতাটা পেছনে হেলিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল অদ্বিতীয়া যেন এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য বলতে এসেছিল। রাহুল ওর হাতটা টেনে ধরে মুখে ছদ্ম গাম্ভীর্য এনে বলেছিল, “আমার ভাবা হয়ে গিয়েছে। আমি চাই না কোনও ছেলের জীবন নষ্ট হোক কারণ তোর মত ছিটেল মেয়েকে আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও ছেলে সামলাতে পারবে বলে মনে হয় না আমার।” ওর কথা শুনে অদ্বিতীয়া হেসে ফেলেছিল। হাসলে ওর গজ দাঁতগুলো বেরিয়ে ভারী মিষ্টি লাগে ওকে।

তারপর মাঝের বছরগুলোয় মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগে আরও দৃঢ় হয়েছে ওদের সম্পর্ক। ক্রমশ আরও কাছাকাছি এসেছে ওরা। মন্দারমনিতে এসে তো ওদের মধ্যে যেটুকু দূরত্ব, যেটুকু আড়াল ছিল তাও আবেগের স্রোতে ভেসে গেছে। পরিপূর্ণ রূপে ওরা একে অন্যের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।

“এই বসে বসে কী ভাবছিস রে? এখানে আয় না।”

অদ্বিতীয়ার ডাকে ওর কাছে ছুটে গেল রাহুল।

“এখানে এসে কি কবি হয়ে গেলি নাকি? বসে বসে শুধুই কী যেন ভেবে যাচ্ছিস।”

“প্রেমে পড়লে সবাই একটু আধটু কবি হয়ে যায়।”

“তাই নাকি! জানা ছিল না। লিখে ফেল তাহলে দু'চারটে কবিতা। বাবাকে বলে বই ছাপিয়ে দেব তোর।” হাসতে হাসতে বলল অদ্বিতীয়া। ওর বাবা বিজন মিত্র বর্তমান কালের একজন বিখ্যাত লেখক।

“আমি যদি লিখতে আরম্ভ করি তোর বাবাকে ছাড়িয়ে যাব বুঝলি।”

“এই এই একদম ফালতু বকবি না। কোথায় আমার বাবা আর কোথায় তুই! ফুহ!”

ওদের খুনসুটির মাঝেই একটা বিশাল ঢেউ এসে অদ্বিতীয়াকে বেসামাল করে দিল। ঢেউয়ের ধাক্কায় পড়ন্ত অদ্বিতীয়াকে রাহুল শক্ত হাতে ধরে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল। আকাশে অস্তগামী সূর্য, পায়ের তলায় অকূল পারাবারকে সাক্ষী রেখে দুটি প্রেমমগ্ন আঁখি পরস্পরের প্রতি নিবদ্ধ হয়ে রইল। সদা চঞ্চল ছটফটে অদ্বিতীয়ার মুখে হঠাৎই নববধূর লাজ। আবেগঘন কণ্ঠে বলল, “কথা দে এমনি করেই চিরকাল আমাকে সামলে নিবি। এমনি করেই প্রতি মুহুর্তে আমার পাশে থাকবি।”

তার হওয়ায় ওড়া অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে রাহুল বলল, “কথা দিলাম।”

 

“এই রাহুল ওঠ না। বেড়াতে এসে কেউ ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়!”

“ঘুমোয় না তবে এইটা করে।” রাহুল অদ্বিতীয়াকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে আরম্ভ করলো।

“তবে রে দুস্টু। ওঠ বলছি।” অদ্বিতীয়ার সুড়সুড়ির চোটে রাহুল উঠতে বাধ্য হলো। জামাকাপড় বদলে রিসোর্টের পেছন গেটের দিকে রওনা হলো ওরা। অদ্বিতীয়ার ইচ্ছে ওই দিকে বেরিয়ে ঝাউবনের ধার দিয়ে কিছুক্ষণ রাহুলের হাত ধরে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরবে। সবে মধ্যাহ্নের সূর্য অপরাহ্নের দিকে পা বাড়িয়েছে কিন্তু তার মধ্যেই আকাশে ইতিউতি জলভরা মেঘ উঁকি দিচ্ছে। ওরা গেটের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে এমন সময় হঠাৎ মেঘগুলো কান্নাকাটি আরম্ভ করলো। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ওরা ছুটে একটা শেডের তলায় চলে এল। পুরো রিসর্ট জুড়েই সুন্দর ডিজাইনের ছোট্ট ছোট্ট সিমেন্টের শেড বানিয়ে বসার জায়গা করা আছে। তারই একটা তে আশ্রয় নিল ওরা। ওদের কটেজটা এখান থেকে বেশখানিকটা দূরে। শেডটার পাশেই পাশাপাশি দুটো নাম না জানা লাল ফুলের গাছ। প্রায় একমানুষ উঁচু ঝাঁকড়া দুটি গাছ। তারপরেই একটা কটেজ। সব কটা কটেজেরই সামনে-পেছনে এক চিলতে ছোট্ট বারান্দা আছে। রোদের মধ্যে এই বৃষ্টির দৃশ্য ভারী মন মুগ্ধকর। এমন পরিবেশে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, নিস্তব্ধতাই শ্রেয়। ওরা চুপচাপ এই হঠাৎ বৃষ্টি উপভোগ করছিলো।

“বারান্দার মধ্যে কী দুস্টুমি শুরু করেছ ভেতরে চল । যত বয়স বাড়ছে তত অসভ্য হয়ে যাচ্ছ তুমি। ” কোনও এক মধ্যবয়সিনীর ন্যাকা ন্যাকা আদুরে গলা।

“ইটস ইওর ক্রেডিট বেবি।”

“তাই নাকি!”

“হুম তুমি এখনও এত গর্যাস, এত সেক্সি। কাছে এলেই পাগল হয়ে যাই আমি।” কামাতুর পুরুষ কণ্ঠ।

“হুহ। বৌকেও নিশ্চই একই কথা বল।”

“অ্যাবসলিউটলি নট।”

“তোমার বউ তো দারুণ সুন্দরী। তাও বলো না?”

“আমার বউ নো ডাউট সুন্দরী বাট ইউ আর ফায়ার। তোমার আগুনে পুড়ে যে কী সুখ তা তুমি বুঝবে না। এই এখন আমার বউ, তোমার বরের কথা ছাড়। এখন শুধু তুমি আর আমি। নেক্সট মান্থ গোয়া ট্রিপটা কিন্তু ফাইনাল। অনেকদিন তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও যাইনি। বরের জন্য বাহানা রেডি রেখো।”

“ডোন্ট ওরি। আমার ওই শান্তশিষ্ট, ভালোমানুষ বরকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। যাহোক বললেই হলো। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে আমাকে।”

মধ্যবয়স্ক দুই নারী পুরুষের অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বর রাহুল আর অদ্বিতীয়ার মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলো। অদ্বিতীয়া পায়ে পায়ে গাছ দুটোর আড়ালে এসে দাঁড়ালো। গাছের ফাঁক দিয়ে কটেজের বারান্দাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাহুলও এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়েছে। শরীরী খেলায় মত্ত দুই নারী-পুরুষ খেয়ালই করল না চার জোড়া বিস্ময়াবিষ্ট চোখ তাদের লক্ষ করছে।

 

বেসিনের মধ্যে হড়হড় করে বমি করে ফেলল অদ্বিতীয়া।

“আদু কন্ট্রোল ইওর সেল্ফ।” অদ্বিতীয়াকে ধরে নিয়ে বলল রাহুল। অদ্বিতীয়া কাঁপতে কাঁপতে রাহুলকে জড়িয়ে ধরল। রাহুলেরও গা টা ক্রমশ গুলিয়ে উঠছে। কটেজের সেই মধ্যবয়স্ক প্রেমিক যুগল তখন বিছানার মধ্যে গভীর শরীরী আশ্লেষে মগ্ন। কামনার আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যই তো শহর থেকে দূরে নির্জনে পাড়ি জমিয়েছে তারা।

 

হাতের বইটা আঙুলের ফাঁকে ভাঁজ করে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন বিজন। আকাশ আজ কাজলা মেঘে সেজেছে। বইটা টেবিলে নামিয়ে রেখে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমে আসছে এই তপ্ত পৃথিবীর বুকে। হাতটা বাড়িয়ে দিলেন বিজন। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাঁর হাতে চুম্বন এঁকে যাচ্ছে। রুচিরা বাড়িতে থাকলে বিরক্ত হতো নিশ্চিত। বলত, "তোমাদের কবিদের এই রোমান্টিসিজমটা না ম্যানিয়ার মত।” আর বিজনের হারিয়ে ফেলা অতীতের মত ছিল “রোমান্টিসিজম না থাকলে কবি হওয়া যায় না।” বিজনের অতীত আর বর্তমানের মধ্যে অনেকটা বৈপরীত্য তবে বিজন কোনও দিন তুলনা করার চেষ্টাও করেননি কারণ অতীতকে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় কিন্তু বর্তমানের হাত ধরে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। অতীতকে বিজন তাঁর হৃদয়ের এক গোপন কুঠুরিতে বন্ধ করে রেখেছেন। তাকে কোনও দিন প্রকাশ করেন না শুধু কোনও দিন কোনও কবিতার ফাঁকে কিংবা মেঘলা বিকেলের মন খারাপের মাঝে সে জলছবি হয়ে বিজনের মানস পটে ভেসে ওঠে। রুচিরার সাথে বিজনের মানসিকতা, জীবনযাত্রায় অনেক ফারাক হলেও তাঁরা একপ্রকার সুখী দম্পতি হিসেবেই এতগুলো বছর একসাথে পার করে দিলেন কারণ তাঁরা একে অপরের প্রতি যথেষ্ট সহনশীল। রুচিরা একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চ পদে আসীন। তাঁর ব্যস্ততা নিশ্ছিদ্র যেখানে সংসার, স্বামী, সন্তানের জন্য সময় বড়ই অল্প। বিজনও ব্যস্ত থাকেন তাঁর কলেজ, সেমিনার, লেখালেখি নিয়ে কিন্তু তার মধ্যেও কোনও দিন কবিতার খাতাখানি খোলা রেখে বাগানে মেয়েকে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন সাতরঙা প্রজাপতির পেছনে। কোনও দিন হঠাৎ করে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন লং ড্রাইভে। রুচিরার সময় বাড়ন্ত হলে পিতা-পুত্রী মিলেই হারিয়ে গেছেন অজানা, অচেনা কোনও গ্রামের ধানক্ষেতের আড়ালে কিংবা পা ডুবিয়ে বসে থেকেছেন ক্ষিণতনু কোনও স্রোতস্বিনীতে। রুচিরা কে কোনও দিন দোষ দেন না বিজন কারণ ওই রকম একটা দায়িত্বশীল পদে থেকে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত ঘরকন্যা করা সম্ভব নয়। বিজন জানেন রুচিরা তাঁর সাধ্যমত চেষ্টা করেন কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে দূরত্বটা ঘোচাতে পারেন না। মানসিকতায় তফাৎ থাকলেও বিজন রুচিরার বড় গর্বের জায়গা। বিজন লক্ষ করেছেন কেউ বিজনের কোনও কবিতা বা উপন্যাসের প্রশংসা করলে রুচিরার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যখন বয়স কম ছিল তখন তো কেউ রুচিরার সামনে বিজনের প্রশংসা করলেই তারপর বিজনের প্রাপ্তিযোগটা বড় মধুর হত।

“দাদা চা।” মালার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলেন বিজন।

“আদু এখনও ফেরেনি না?’

“আদু তো অনেকক্ষণ ফিরেছে। নিজের ঘরে আছে।”

অবাক হলেন বিজন। তিনি বাড়িতে আছেন অথচ আদু তাঁর কাছে না এসে নিজের ঘরে চলে গেছে এটা বোধহয় এই প্রথমবার ঘটল। ছোটবেলা থেকেই মায়ের সঙ্গ খুব একটা বেশি না পাওয়ার অভাবটা বাবাকে দিয়ে পুষিয়ে নেয় মেয়েটা। বাবাই ওর ফ্রেন্ড, ফিলজফার এন্ড গাইড। সবাইকে বলেও বাবা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। রুচিরা মাঝে মাঝে ছদ্ম অভিমান করে বলে, “মেয়ে তো শুধু তোমার। আমাকে তো ওর দরকার নেই।” মেয়ে তখন মাকে জড়িয়ে ধরে, আদর করে একাকার করে। যখন আদু আর রুচিরা বিজনের সাথে থাকে বুকের গহনে একটা চিনচিনে বেদনা সত্ত্বেও বিজনের নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয় কিন্তু ইদানিং আকস্মিক আদুর আচার-আচরণের পরিবর্তন বিজনকে ভাবিত করছে। প্রাণচঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ করেই একদম ধীর-স্থির শান্ত হয়ে গেছে। কথাবার্তাও বিশেষ বলে না প্রয়োজন ছাড়া। রুচিরাকে জানিয়েছেন বিজন কিন্তু সে তো হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। মেয়ে বড় হয়েছে মুড সুইং করতেই

পারে এই বলে পাত্তা দেয় নি।

 

অদ্বিতীয়া দরজা খুলে দেখল সামনে বাবা দাঁড়িয়ে। যে জলস্রোতকে ট্যাপের জলে নিশ্চিহ্ন করে এসেছে কয়েক মুহূর্ত আগে সেই স্রোতটা আবার বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোনও রকমে মৃদু স্বরে জিগ্যেস করল, “বাবা তুমি?”

“আমি কি একটু ভেতরে আসতে পারি?” বাবার গলার স্বরে চমকে উঠল আদু। বাবা তার সঙ্গে এরকম গম্ভীর গলায় এভাবে কখনও কথা বলেন না। অসহায় ভাবে বলল, “এরকম করে কেন বলছ?”

“বলছি কারণ তুমি বড় হয়ে গেছ। তোমার জীবনেও এমন কথা জন্ম নিচ্ছে যা আমার সাথে শেয়ার করা যায় না। আমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে এখন বোধহয় শুধু বাবা হয়ে গেছি।” আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলা বিজনের কথাগুলো অদ্বিতীয়ার বুকে সৃষ্টি হওয়া ক্ষতস্থান থেকে নতুন করে রক্তপাত ঘটালো। চিরকাল বাবার স্নেহের শীতল ছায়ায় বেড়ে ওঠা মেয়েটার মনে হলো বাবার সাথে কয়েক যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। বড় নিঃসঙ্গ সে। মাথার ওপর হাজার হাজার ফারেনহাইটের সূর্য যার উত্তাপে সে দগ্ধ হতে হতে এই ক্লেদাক্ত পৃথিবীর পাঁকে ডুবে যাবে।

“বাবা।” বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। এই মানুষটা যে তার রাগ, অভিমান, ভরসা, বিশ্বাস সব কিছুর আশ্রয়। “ভেতরে গিয়ে বোস। আমি আসছি এক্ষুনি।” মেয়েকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন বিজন।

 

“এই নে এটা খেতে খেতে বল কী হয়েছে।” মেয়ের পাশে বসে সহজ গলায় বললেন বিজন। অদ্বিতীয়া অবাক হয়ে দেখল তার প্রিয় চকলেট আইসক্রিমের কাপটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন বাবা। ছোটবেলায় তার কান্না থামানোর সহজ উপায় হিসেবে বাবা এটা আবিষ্কার করেছিলেন।

“সব কিছু কেন ছোট বেলার মত হয় না বাবা?” কান্না ভেজা গলায় জিগ্যেস করে অদ্বিতীয়া। বিজন স্মিত হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “ ছোট বেলাটা হলো অনেকটা রূপকথার গল্পের মত। যেখানে সব কিছু স্বপ্ন মাখা কিন্তু মা বড় হয়ে মানুষকে যেসব কঠিন বাস্তবের মুখমুখি হতে হয় সেগুলো আছে বলেই ওই স্বপ্নের দিনগুলোর দাম আছে। তোর কী হয়েছে আমাকে বল দেখবি অনেক ভালো লাগছে। তুই তো ছোটবেলায় বলতিস আমি ম্যাজিশিয়ান যে তোর সব সমস্যার সমাধান করে দেয়।”

“কিন্তু আমার কথাগুলো শুনে তুমি যদি কষ্ট পাও, সহ্য করতে না পারো?”

হেসে উঠলেন বিজন।

“পাগলী তোর এই বাবা জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছে রে। অনেক কিছু হারিয়েছে। একটা সময় সর্বহারা হয়ে গেছে তাও নিজেকে সামলে নিয়ে আজও মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে কিন্তু তোর চোখের জল, তোর কষ্ট আমি একদম সহ্য করতে পারি না রে। তুই বল।”

একটু সময় নেয় অদ্বিতীয়া। কাঁচের মহল ভেঙ্গে ফেলার আগে নিজেকে একটু প্রস্তুত করে। নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে নিজের কাছেই লুকোবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে।

“বাবা আমি কনসিভ করেছি।”

চমকে ওঠেন বিজন কিন্তু কোনও ব্যাপারেই চট করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না তিনি। মাথা ঠান্ডা রেখে মেয়েকে জিগ্যেস করেন, “হু ইজ দ ফাদার?”

“রাহুল। রাহুল সেন।”

“রাহুল সেন মানে রজত সেনের ছেলে?”

“হুম।”

বিজন মিত্রের অন্তরে একটা ঘুমন্ত ঝড় জেগে উঠে উথাল পাতাল করছে কিন্তু নিজের মনভাব দমন করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন।

“ওর সাথে তোর কি কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে মানে তোরা কি পরস্পরকে ভালোবাসিস না হঠাৎ করে শুধু শারীরিক চাহিদার কারণে …” খুব শান্ত ভাবে প্রশ্ন করে চলেছেন বিজন কারণ বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং ততোধিক স্পর্শ কাতর তাঁর কন্যাটি।

“না না বাবা আমরা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসি।” বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে অদ্বিতীয়া।

“তাহলে এখন তোদের প্ল্যান কী ?”

অদ্বিতীয়ার দু'চোখের কোল বেয়ে বৃষ্টি নামল।

“উই উইল গো ফর এবরশন।”

“বুঝলাম কিন্তু তোমাদের এরকম ডিসিশনের কারণ? তোমার মা একদিন বলছিল যে রাহুল একটা এম.এন.সি তে চাকরি পেয়েছে যদিও ওর ইচ্ছে কোনও প্রেস্টিজিয়াস গভর্নমেন্ট জব করার সে যাই হোক সে একটা চাকরি করে, তুমিও একটা পাবলিকেশন হাউসের সঙ্গে এটাচ হয়েছ তাহলে তোমরা বিয়ের কথা ভাবছ না কেন? রাহুল তার বাবা-মার একমাত্র সন্তান আর তুমিও আমাদের। ফিনান্সিয়াল কোনও প্রবলেম তোমাদের হওয়ার কথা নয় তাহলে নিজেদের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর কথা ভাবছ না কেন? মিস্টার সেন আর তোমার মা বহুদিনের কলিগ এ বিয়েতে কারুর আপত্তি থাকার কথা নয়। তাহলে?” উত্তরের প্রত্যাশায় মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন বিজন কিন্তু তাঁর আদরের আদু আজ মুখ নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।

“আদু একটা সত্যি কথা বল। তোরা কি তোদের সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াস নোস মানে আজকাল তো অনেক ছেলেমেয়ে বিয়ে-বাচ্চা এসব দায়িত্ব নিতে চায় না। ঝামেলা মনে করে অথচ একে অন্যের সঙ্গে থাকতে চায়। তোরাও কি সেরকম… আর তাহলে সাবধান হওনি কেন?”

প্রবল বর্ষণে যেমন পাহাড়ের বুকে ধস নামে তেমনি অদ্বিতীয়ার ভেতরেও ধস নামছে। সব কিছু ধ্বংস করে খাদের দিকে নেমে যাচ্ছে। শূন্য দৃষ্টিতে তার সবচেয়ে ভরসার মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

“কী রে কিছু বল?” মেয়ের পিঠে আলতো হাত রাখেন বিজন।

“বাবা আমরা ওকে মারতে চাই না। আমাদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি ওর অস্তিত্ব অনুভব করি বাবা।” চিৎকার করে কেঁদে উঠে বাবার বুকে আশ্রয় খোঁজে অদ্বিতীয়া।

“তাহলে তোরা বিয়ে করে নে না। আমি সবার সাথে কথা বলব। সমস্যাটা কী হচ্ছে তোদের আমি তো বুঝতে পারছি না।”

“আমি বলতে পারবো না বাবা। তুমি ভীষণ কষ্ট পাবে।” হাহাকার করে ওঠে পিতা অন্ত প্রাণ অদ্বিতীয়া।

ছোটবেলায় বাবাকে সুপার ম্যান মনে হত অদ্বিতীয়ার কিন্তু আজ জানে সুপার ম্যানদেরও সীমাবদ্ধতা থাকে। তার সুপার ম্যান কি পারবে আসন্ন আঘাত সামলাতে? পারবে কি অদ্বিতীয়া তার বাবাকে এক নিষ্ঠুর সত্যের মুখমুখি দাঁড় করাতে? নীড় হারা পাখির মতো কাঁপতে থাকে সে।

 

সুরেলা রিংটোনের ডাকে দীপাবলি বারান্দা থেকে ঘরে এলেন। স্ক্রিনের ওপর অচেনা নাম্বার।

“হ্যালো।”

“হ্যালো, আমি বলছি।” অপর প্রান্তের গলাটা শুনে থমকে গেলেন দীপাবলি।

“হ্যালো, মিসেস সেন শুনতে পাচ্ছেন?”

“হুম।” দীপাবলি অবাক হলেন অপর প্রান্তের মানুষটির আত্মবিশ্বাস দেখে। নিজের পরিচয় টুকু দিলেন না ধরেই নিলেন কণ্ঠস্বর শুনেই দীপাবলি তাঁকে চিনে নেবেন। সত্যিই কি দীপাবলির পক্ষে চেনা সম্ভব ছিল কিন্তু তাও তো তিনি চিনে নিলেন। কথা তো ছিল ভুলে যাওয়ার কিন্তু ভুলতে তো পারেন নি। যে স্বর কর্ণকুহরে নয় হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গুঞ্জরিত হয় তাকে বোধহয় বিস্মৃত হওয়া যায় না।

“আজ বিকেলে একবার দেখা করতে পারবেন? ভীষণ দরকার। প্লিজ।” আকুতি ঝরে পড়ে মানুষটির গলায়। একটা সময় ছিল যখন এই মানুষটার একটা ডাকের অপেক্ষায় থাকতেন তিনি। তারপর এক দীপাবলির রোশনাই নেভা সন্ধ্যায় মানুষটার সব আহ্বান উপেক্ষা করে অন্ধকার গলিপথ বেয়ে ফিরে গিয়েছিলেন পিতৃগৃহে। প্রেমিকা হেরে গিয়েছিল কন্যার কাছে।

 

কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন বিজন। খুব চেনা, খুব কাছের মানুষের উপস্থিতি মানুষ চোখ বন্ধ করেও অনুভব করতে পারে। বিজ্ঞান এর কী ব্যাখ্যা দেয় জানা নেই কিন্তু এটা ঘটে থাকে। বিজনও সহসা চোখ খুললেন। রেস্টুরেন্টের প্রবেশদ্বার দিয়ে দীপাবলি ঢুকছেন। মাঝের আঠাশটা বছর দীপাবলির চুলে এক-আধটা রুপোলি রেখা আঁকা ছাড়া আর কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। দীপাবলি এখনও ভোরের শিউলির মতই স্নিগ্ধ, শান্ত। দীপাবলির চোখ দুটো ইতিউতি বিজনকে খুঁজছে। বিজন ইচ্ছে করেই ডাকলেন না। আজ বড্ড ইচ্ছে করছে ওকে আগের মত ‘দীপ’ বলে ডাকতে কিন্তু আজ আর প্রকাশ্যে সেটা করা শোভনীয় নয়। রুচিরার অফিস পার্টিতে বিজন কখনও যান না বললেই চলে কিন্তু সেবার যখন বিজনের জাতীয়স্তরের একটা পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে রুচিরা পার্টি দিলেন তখন বিজনকে বাধ্যগত যেতেই হয়েছিল। সেখানেই অনেক বছর পর দীপাবলিকে দেখেন স্বামী-সন্তান সহ। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির সি ই ও রজত সেনকে ভালো করে দেখছিলেন বিজন। এই সেই যোগ্যব্যক্তি যার অর্থ, যশ, প্রতিপত্তির কাছে তৎকালীন হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক তথা উদীয়মান কবি বিজন মিত্র পরাজিত হয়েছিলেন। যাঁর হাতে নিজের কন্যাকে তুলে দিতে না পারলে আত্মহত্যা পর্যন্ত করার হুমকি দিতে পারেন একজন পিতা! দীপাবলি বিজনকে খুঁজে নিয়ে এগিয়ে এলেন। দীপাবলিকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন বিজন কিন্তু পরমূহুর্তেই সম্বিৎ ফেরে তাঁর শক্ত হয়ে ওঠে বিজনের মন। নিজের অতীতের আবেগের জালে জড়িয়ে পড়লে চলবে না সামনে এক ভীষণ লড়াই তাঁর।

“বসো।” দীপাবলি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বিজনের দিকে। মনের মধ্যে ঘূর্ণির মত পাক খাচ্ছে অনেকগুলো প্রশ্ন। এতবছর পর বিজন এভাবে তাঁর সাথে গোপনে একলা দেখা করতে চাইলেন কেন? বিজনের ফোনে বলা কথা গুলো কানে বাজছিল দীপাবলির, “ ইটস ভেরি আর্জেন্ট আর আজও আমি বিশ্বাস করি আমি আপনাকে অকারণে বা কোনও অসাধু উদ্যেশ্যে যে ডাকছি না সেইটুকু ভরসা আপনি আমাকে করেন তাই আমি অপেক্ষায় থাকব।”

“দীপ।” বিজনের ডাকে কেঁপে উঠলেন দীপাবলি। কতদিন পরে এই ডাকটা শুনলেন। চোখের সামনে বাষ্প জমা হচ্ছে কিন্তু আঠাশ বছর আগে যেমন নিজেকে সামলে নিয়ে ছিলেন তেমনি আজও বুকের মধ্যে ওঠা ঝড়টাকে পাঁজরের খাঁচায় বন্দী করে অস্ফুটে বললেন, “ বলুন।”

“দীপ, আমার মেয়ে অদ্বিতীয়াকে তো তুমি চেন?”

“হুম।” মুখ তুলে অবাক হয়ে বললেন দীপাবলি।

“সি ইজ প্রেগন্যান্ট এন্ড ইওর সান রাহুল ইজ রেস্পন্সিবল ফর দিস।”

দীপাবলি এতটা অবাক বোধহয় কোনও দিন হননি।

“বাবু!”

“হুম। তবে এক্ষেত্রে আমার বোধহয় রেস্পন্সিবল কথাটা ব্যবহার করা ঠিক হলো না কারণ আদু আর রাহুল দুজনেই এর জন্য দায়ী। আমাদের অজান্তে ওদের মধ্যে একটা সুন্দর সমীকরণ গড়ে উঠেছে। ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। তুমি রাহুলকে জিগ্যেস করে দেখতে পারো।”

দীপাবলি একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, “ঠিক আছে আমি বাবু আর রজতের সাথে কথা বলব।”

ম্লান হাসলেন বিজন, “ব্যাপারটা এত সহজ হলে তোমাকে এভাবে ডাকার দরকার হত না দীপ। হয়ত রাহুল নিজেই তোমাকে বলত। আমি আদুকে নিষেধ করে দিয়েছি রাহুলকে জানাতে যে আমি সব জানি।”

“মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

বিজন দীপাবলির চোখে চোখ রেখে বললেন, “তুমি কতটা কষ্ট সহ্য করতে পারবে দীপ?”

“আমার সহ্য শক্তি কতটা তার প্রমাণ আপনি বহু বছর আগেই পেয়েছেন।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন দীপাবলি। একটু সময় নিয়ে বিজন বললেন, “দীপ, রুচিরা আর রজতের মধ্যে একটা এক্সট্রা ম্যারিট্যাল এফেয়ার আছে। আদু আর রাহুল মন্দারমনিতে ওদের একসাথে একটা কটেজে আবিষ্কার করে। পরিষ্কার করে না বললেও ওর কথা থেকে আমি বুঝেছি ওরা খুবই ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ছিল।”

“প্লিজ চুপ কর তুমি।” দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন দীপাবলি। বিজন চুপ করে যান। প্রেমিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ আর স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে খুব চড়া দাগের একটা পার্থক্য আছে। বাবার আদেশ মান্য করে বিজনের সাথে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে রজতের হাত ধরে একটা নতুন জীবন শুরু করেছিলেন দীপাবলি। বিজনের স্মৃতির স্রোতকে মনের এক কোণে নুড়ি-পাথর চাপা দিয়ে রজতকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন। তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। তাকে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার মত যোগ্য করে তুলেছেন তার এই প্রতিদান দিল রজত! আচ্ছা, রাহুল আর অদ্বিতীয়ার কিছু ভুল হচ্ছে না তো?

“ওদের কোনও ভুল হচ্ছে না তো?” অনেক আশা নিয়ে প্রশ্ন করেন দীপাবলি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিজন বলেন, “আমারও প্রথমে মানতে কষ্ট হয়েছিল। নিজের সাজানো মহলটা যে আসলে তাসের ঘর ছিল এটা সহজে মেনে নিতে পারিনি। আজ তোমায় একটা সত্যি কথা বলি হয়ত তোমার খারাপ লাগতে পারে তাও বলছি তুমি আমার প্রথম প্রেম এটা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি আমার স্ত্রী হিসেবে রুচিরাকেও আমি কম ভালোবাসিনি। মুদ্রার এক পিঠে যদি আছে তোমার সাথে কাটানো প্রথম যৌবনের ভালোলাগার মুহুর্তগুলো , প্রথম হাতে হাত রেখে বৃষ্টি ভেজা পথে হাঁটার স্মৃতি তেমনি মুদ্রার উল্টো পিঠে আছে রুচিরার সাথে নতুন সংসার পাতার দিনগুলো, আদুর জন্ম, প্রথম বাবা ডাক শোনার অনুভূতি। আমি খোঁজ খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি আদুদের ধারণা একবর্ণও মিথ্যে নয়।” দীপাবলি নিশ্চুপ হয়ে শুধু শুনছেন। একটু থেমে বিজন আবার শুরু করলেন, “একদিন ভাগ্যের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিলাম। তোমাকে নিজের কাছে ধরে রাখতে পারিনি কিন্তু আজ আমার মেয়েকে সেই ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা আমি পেতে দেব না। আদুর চোখের জল আমি সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া এক নোংরা সম্পর্কের জন্য ওদের পবিত্র সম্পর্কটা পরিণতি পাবে না কেন বলতে পারো? একটা নিষ্পাপ প্রাণকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হবে কেন? আমি এসব হতে দেব না। রুচিরা আর রজত আদু আর রাহুলের সম্পর্কটা মানতে চাইবে না এটা খুব স্বাভাবিক কারণ তাতে ওদের অসুবিধা হবে তাই ওরা যেমন আমাদের আড়ালে নিজেদের সম্পর্কটা তৈরি করেছে তেমনি ওদের আড়ালে আমি আদু আর রাহুলের চারহাত এক করব কিন্তু তার জন্য আমার তোমার হেল্প চাই।”

“কীরকম হেল্প?” ঝাপসা চোখে প্রশ্ন করেন দীপাবলি।

 

 

 

 

 

“বাবু।” মায়ের ডাকে বালিশ থেকে মুখ তুলে তাকালো রাহুল। দীপাবলি দেখলেন ছেলের চোখ দুটো ফোলা।

“এই সময় শুয়ে আছিস?” স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলেন।

“এমনি শুয়েছিলাম।” নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে রাহুল। ছেলের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিলেন দীপাবলি।

“খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?”

“কষ্ট? কীসের কষ্ট?” চমকে ওঠে রাহুল।

“অদ্বিতীয়ার জন্য আর পুচকুটার জন্য?”

“মা!”

“খুব মনে হচ্ছে না রে যে পুচকুটা মেয়ে না ছেলে। জন্মালে কেমন দেখতে হতো?”

“মা তুমি এসব….।” রাহুলের চোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।

“আমার কষ্ট হবে ভেবে নিজের ভালোবাসা, নিজের সন্তান সব বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছিলি!”

“তোমাকে এসব….। আমি আদুকে তো বারণ করেছিলাম।”

“কেন বারণ করেছিলি? কেন এত বড় ভুল করতে যাচ্ছিলি বাবু?”

“মা।” ছোটবেলার মত মাকে জড়িয়ে ধরে রাহুল।

“বাবু, একটা কথা দিবি আমায়?”

“কী কথা?”

“এখন থেকে আমি যা বলব তাই করবি তুই। তোর বাবার বিশ্বাসঘাতকতার কাছে আমরা হারব না, কিছুতেই না প্রমিস কর আমাকে।” মায়ের চোখে এমন আগুন রাহুল আগে কখনো দেখনি।

 

 

স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলেন রজত। মালিনী খাবার প্লেটটা তাঁর সামনে এনে রাখতে ভারী আশ্চর্য হলেন রজত। পনের দিন পর বাড়ি ফিরছেন, সাত দিন অফিস টুর আর তারপর সাত দিন রুচিরার সাথে গোয়ায় প্রমোদ ভ্রমণ। দীপাবলিকে চিরকাল তাঁর অফিস পার্টি বা অফিসের বন্ধু বান্ধব থেকে পারত পক্ষে দূরে সরিয়ে রাখায় রজতের এই দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে কোনও অসুবিধা হয়নি। রুচিরার অনাবৃত শরীরের ঘ্রাণ নিতে নিতে দীপাবলির ফোনের উত্তরে জানিয়েছেন মিটিং য়ে ভারী ব্যস্ত তিনি। ফ্রি হলে ফোন করবেন। ফোন করতে ভুলে গেলে জানিয়েছেন কাজের চাপে নাভিশ্বাস উঠছে তাঁর। দীপাবলি সরল মনে বিশ্বাস করে গেছেন তাঁকে তাই তাঁর ফেরার দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সে। প্রেমিকার নগ্ন শরীরের উত্তাপ নেবার পর শান্ত নদীর মত স্ত্রীর প্রেমের সাগরে অবগাহনটা ভালোই লাগে রজতের কিন্তু আজ এখনো দীপাবলির দেখা নেই কেন! আজ কোথাও যাওয়ার মানুষ তো সে নয়। অস্থির হয়ে ওঠেন রজত, “মানুদি দীপা কোথায়?”

“দীপার খোঁজ নেওয়ার খুব কি প্রয়োজন আছে তোর?” ঠান্ডা গলায় বলে মালিনী। সম্পর্কে সে রজতের জ্ঞাতি সম্পর্কিত খুড়তুতো দিদি। শারীরিক কিছু ত্রুটির জন্য তার বিয়ে সম্ভব ছিল না। পারিবারিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না তাদের তাই রাহুল জন্মাবার পর রজতের মা দীপাবলির দেখাশোনার জন্য মালিনীকে গ্রাম থেকে পাঠিয়ে ছিলেন সেই থেকে এবাড়ির একজন হয়ে সে রয়ে গেছে। রক্তের সম্পর্ক থাকায় এ বাড়ির মানুষগুলো প্রতি তার ভালোবাসা, অধিকার বোধ, আনুগত্য সবই গড়পরতা কাজের লোকের চেয়ে অনেক বেশি। এহেন মালিনীর আচমকা এই প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে গেলেন রজত, “মানে? কী বলতে চাইছ তুমি? দীপা কোথায় আর তুমিও মনে হচ্ছে বাইরে যাবার জন্য তৈরী হয়েছ?”

“হুম, আমি শুধু বাড়ির চাবিটা তোকে দেওয়ার জন্য এখনও আছি আর তার সঙ্গে দীপার দিয়ে যাওয়া এই কাগজটা।” একটা খাম বাড়িয়ে ধরল মালিনী।

“কী এটা?”

“পড়ে দেখে নে।” সংক্ষিপ্ত জবাব মালিনীর।

তাড়াতাড়ি খামের ভেতর থেকে কাগজটা বের করেন রজত।

“এটা কী ? এসবের মানে কী ?” চিৎকার করে উঠলেন রজত।

“তুই কি ভেবেছিলি দিনের পর দিন মেয়েটাকে তুই ঠকিয়ে যাবি আর ও জানতেও পারবে না!” গর্জে উঠল মালিনী।

“কী বলছ কি তুমি!” স্খলিত স্বরে বলেন রজত।

“কী বলছি তুই ভালো করেই জানিস। সবচেয়ে লজ্জার কথা কী জানিস তোর আর তোর ওই রুচিরার কথা সবচেয়ে প্রথমে জেনেছে বাবু। দীপা ডিভোর্স পেপারে সই করে চলে গেছে। তোকে বাকি কাজ করে নিতে বলেছে।”

“বাবু!”

“হ্যাঁ বাবু। যদিও তোকে বলতে ইচ্ছে করছে না তবুও বলছি বাবু ফরেন সার্ভিসের চাকরিটা পেয়ে নিজের বউ আর মাকে নিয়ে কাল এদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে।”

“বউ!”

“হ্যাঁ, বাবুর বউ কে সেটাও তুই জেনে যাবি। আমি এখন আসছি।”

“তুমিও চলে যাবে? কোথায় যাবে?” অসহায় গলায় প্রশ্ন করেন রজত।

“আপাতত একটা আশ্রমে যাচ্ছি। বাবু বলেছে যদি ব্যবস্থা করতে পারে আমাকেও নিয়ে যাবে ওর কাছে আর একটা কথা ওরা বলে গেছে ওদের সাথে কোনও রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা না করতে। লাভ হবে না।” মালিনী নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ডিভোর্স পেপারে দীপাবলির সই টার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রজত। একদিন তাঁর খালি ঘরে আলো জ্বালিয়ে ছিল দীপা আজ তাঁর শূন্য ঘরে শুধুই অমাবস্যার অন্ধকার। রুচিরার সাথে দিনের পর দিন সম্পর্ক রাখার সময় একবারও মনেও আসেনি এমন দিনও আসতে পারে যেদিন বাড়ি ফিরে দরজার পেছনে দীপাবলির হাসিমুখটা দেখতে পাবেন না। আর বাবু, সে এখন তার বাবাকে ঠিক কতটা ঘেন্না করে?

 

“তুমি কোথাও যাচ্ছ?” বেডরুমে ঢুকে প্রশ্ন করেন রুচিরা। বিজনের প্রস্তুতি দেখেই বোঝা যায় তিনি বাইরে কোথাও যাচ্ছেন।

“হুম, একটা ফরেন ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করছি আমি।” নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেন বিজন।

“মানে?”

“ওরা বহুদিন থেকেই ডাকছিল। আমি ভাবলাম এটাই যাওয়ার উপযুক্ত সময়।”

“কী যা তা বলছ তুমি। আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করনি? আদু জানে?” রেগে উঠলেন রুচিরা।

“তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আগে দিই, আদু জানে। আর প্রথম প্রশ্নের উত্তরে জানাই আমি আর আদু দুজনেই ভাবলাম তোমার এনজয়মেন্টে বাধা দেওয়া উচিত নয়। অনেক দিন পর রজত সেনের সাথে লম্বা ট্রিপে গেছ।” বিজনের কেটে কেটে উচ্চারণ করা কথাগুলো রুচিরার ভেতর পর্যন্ত তিরের ফলার মত বিদ্ধ করল।

“কী বলতে চাইছ তুমি?” নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন রুচিরা।

“দেখ বেশি কিছু বলার ইচ্ছে বা সময় কোনওটাই আমার নেই। তোমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও আমার নেই। হয়ত তোমার সব চাহিদা পূরণ করতে আমি ব্যর্থ তাই তোমাকে অন্য পুরুষের কাছে সুখ খুঁজতে হয়েছে। আজ থেকে আমি তোমাকে তোমার পথে চলার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলাম। ডিভোর্স পেপার, ফিনান্সিয়াল কিছু পেপার্স সব এই ব্যাগটায় আছে। দেখে নিও।”

রুচিরার চোখে মুখে হতাশা আর বিস্ময় কাটাকুটি খেলছে। একটু থেমে বিজন আবার বললেন, “আদু বলেছিল ওর ব্যাপারে তোমাকে কিছু না জানাতে কিন্তু আমার মনে হয় মা হিসেবে তোমার এটুকু জানার অধিকার আছে যে তোমার মেয়ে এখন কোথায় কী করছে। তাই জানিয়ে যাচ্ছি আদু, রাহুল মানে মিস্টার রজত সেনের ছেলেকে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। আমি আদুর কাছেই প্রথম তোমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারি। মন্দারমনিতে অবৈধ প্রেমের নেশায় মগ্ন তোমরা খেয়ালই করনি যে আদু আর রাহুলের কাছে ধরা পড়ে গেছ তোমরা। ওরা তোমাদের কথা জানতে পেরে নিজেদের জীবনটা শেষ করার পথে চলেছিল কিন্তু আমি তা হতে দিইনি। আদু মা হতে চলেছে। ওরা যাতে তোমাদের দুজনের পরিধির বাইরে নিজেদের জীবনটা সাজাতে পারে তার সব ব্যবস্থা আমি করেছি। বাই দ ওয়ে আদু বলে দিয়েছে ওকে কোনও রকম ডিস্টার্ব না করতে।”

বিজন বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। রুচিরার মনে হচ্ছে তাঁর পায়ের তলায় মাটি আর মাথার ওপর ছাদ কিছুই নেই। একটা নিঃসীম ধু ধু প্রান্তরে একলা দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ দুটোও বুঝি অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে।

“বিজন একবার কি...”

“সরি, রুচিরা আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। আসছি।”

স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে রইলেন রুচিরা। রজতের সাথে পরকীয়া প্রেমের নেশায় ভাসলেও বিজনকে ছাড়া নিজের জীবনটা তো কোনওদিন কল্পনাও করেননি। বহুদিন পরে বিজন তাঁকে ‘রুচি’ না বলে ‘রুচিরা’ বলে ডাকলেন। স্বামী-সন্তানকে সময় না দিয়ে অফিসের বাহানায় অবসর সময়গুলো রজতের সাথে কাটিয়েছেন ভেবেছেন বিজন আর আদুর অস্তিত্ব তাঁর জীবনে চিরস্থায়ী আর আজ আদু, বিজন দুজনেই তাঁকে স্রেফ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তাদের জীবন থেকে।

 

 

অদ্বিতীয়া ঘুমচ্ছে। রাহুল অফিসে। পাহাড় ঘেরা থিম্পুতে এই অলস দুপুরে বসে দীপাবলির বড্ড মনে পড়ছে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের সমীকরণ গুলো কীভাবে বদলে গেল। একদিন তিনি আর বিজন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ পরস্পরের হাত ধরে হাঁটতে চেয়েছিল কিন্তু সুতো কাটা ঘুড়ি যেমন নীল আকাশের বুকে হারিয়ে যায় তেমনি তাঁদের সম্পর্কটাও পরিবারের চাপে সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেল। দুজনেই নতুন সঙ্গীর সাথে নীড় বেঁধে জীবনের পথে এগিয়ে গেলেন। সেখানেও তাঁদের অগোচরে তৈরি হল দুটো নতুন সমীকরণ। রজত আর রুচিরা এবং রাহুল আর অদ্বিতীয়ার মধ্যে। প্রথম সম্পর্কটা ঝড়ের মত তছনছ করে দিয়েছে সব কিছু আর দ্বিতীয় সম্পর্কটা নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দীপাবলি যখন রজতের সাথে আর থাকবেন কি-না এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচলে দোদুল্যমান ঠিক তখনই বিজন এসে দাঁড়ান তাঁর সামনে। তাঁর চোখে চোখ রেখে বলেন, “একদিন আমার ডাকে সাড়া দাওনি কিন্তু আজ আমার কথা তোমাকে রাখতেই হবে। আমার আদুর দায়িত্ব তোমার। ও মাকে কোনও দিন ভালো ভাবে পায়নি সেই অভাব পূরণ করতে হবে তোমাকে। এই অবস্থায় ওর তোমাকে প্রয়োজন। আমার একদা সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির হাতে আমার সবচেয়ে আদরের মানুষটির ভার আমি তুলে দিলাম। তোমাকে ওদের সাথে যেতেই হবে। আজ আমি না শুনব না।” দীপাবলিও বিজনকে ফেরাতে পারেননি আর। রাহুল আর অদ্বিতীয়া তো ভীষণ খুশি দীপাবলি ওদের সাথে চলে আসায়। রজত একলা কী করছে কে জানে? আর আরেকটা মানুষ যে একলা চলে গেছে এই পৃথিবীর অন্য একটা মহাদেশে।

দুটো পাখি ডানা মেলে উড়ে চলছে নীল আকাশের বুকে। সেদিকে তাকিয়ে দীপাবলির হঠাৎ মনে হলো ওরা তো সীমানা মানে না। নিজেদের ইচ্ছে মত উড়ে যায় দেশ-দেশান্তরে। যাবে কি ওরা কলকাতায় ওঁর ফেলে আসা বাড়িটার একফালি ছাদের ওপর দিয়ে?