তৃতীয় রিপুর খেলা - কস্তুরী মুখার্জি

অলংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস

মোরাম বিছানো রাস্তাটা সর্পিল গতিতে এঁকেবেঁকে মার্বেল বাঁধানো সিঁড়ির প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তাটার দুপাশে নানা ধরণের পাতাবাহার আর রংবেরঙের ফুলের গাছ রাস্তাটাকে মনোরম করে তুলেছে। পাকা আপেলের মতো টকটকে গায়ের রং, ছ ফিটের কাছাকাছি হাইট হবে, বয়স আন্দাজ সাতান্ন কি আটান্ন এক দীর্ঘদেহী ব্যক্তি ধীর পায়ে হেঁটে আসছেন। পরনের লাল খাদির পাঞ্জাবীটাতে গায়ের রং আরো খোলতাই হয়েছে। চোখে একটা ওয়াইন শেডের সানগ্লাস-- সিনেমার হিরো বললে অত্যুক্তি হয় না। চারধাপ মার্বেল বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা ছোট্ট ওয়েটিং লাউঞ্জে এসে দাঁড়ালেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে সুইং ডোর ঠেলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস ঘরে ঢুকলেন। ঘরের ভেতর সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ও প্রান্তে যিনি বসে আছেন এক অচেনা আগন্তুককে ঢুকতে দেখে তিনি অবাক বিস্ময়ে কিছুটা বিরক্তি মিশ্রিত ভঙ্গিতে তাকালেন।

“কে আপনি?” বিখ্যাত প্রোমোটার এবং ইমনকল্যান এসোসিয়েটস এর কর্ণধার

কম্পিউটার থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন।

“আমি রাজসিংহ চৌধুরী। সুরাট থেকে আসছি। আপনি কি শীলভদ্র পালিত? ইমন কল্যাণের...”

“ইয়েস। আপনার জন্য কী করতে পারি?” শীলভদ্রবাবুর তখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি।

রাজসিংহবাবু তৎক্ষণাৎ উত্তরটা না দিয়ে ঘরটাকে ভালো করে দেখলেন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল।

“আপনি বসুন,” বলে শীলভদ্রবাবু গদি আঁটা ভিসিটর্স চেয়ার দেখালেন।

রাজসিংহবাবু বসতে বসতে বললেন, “আপনার এই বিজনেস কতদিনের?”

“এই ধরুন বছর পাঁচেক হবে। কেন বলুনতো?”

“হুঁ... আচ্ছা আপনি ডাক্তার অনুময় ঘোষকে তো চেনেন?” গমগমে স্বরে রাজসিংহবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ চিনি।” শীলভদ্রবাবু ছোট্ট করে উত্তর দিলেন।

“আমার কাছে খবর আছে যে ডাক্তারবাবুর বাড়ি, জমি আপনি নিয়ে ফ্ল্যাট বানাবেন।”

“দেখুন প্রথমেই বলি আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। আর তাছাড়া এসব ব্যাপার আপনার সাথে আলোচনাই বা করবো কেন?” এবার শীলভদ্রবাবু নড়েচড়ে বসলেন।

“চিনতে পারবেন ঠিকই। আর আলোচনা করবেন কেন সেটা তখন বুঝতে পারবেন।” মেঘমন্দ্র স্বরে সারা মুখে একটা হালকা হাসির আভাস ছড়িয়ে বললেন।

“হ্যাঁ, ডাক্তারবাবুর সাথে সেই রকম কথা হয়েছে।” কিছুটা অনিচ্ছা নিয়ে বললেন শীলভদ্রবাবু।

“আপনাদের ডিলটাটা কীরকম হলো?” রাজসিংহবাবু টেবিলের ওপর একটা কাঁচের

পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন।

“দেখুন রাজসিংহবাবু আপনার সাথে এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে আমি রাজি নই।”

“রাজি যে আপনাকে হতেই হবে!!”

“কে আপনি?” এবার শীলভদ্রের একটু ভয় করছে।

“আমি কে সেটা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ না যেটা জানতে চাইছি সেটা?”

“আমার ব্যবসার ভেতরের কথা আপনাকে কেন জানাবো বলুন যেখানে আপনার পরিচয়টাই এখনো পাইনি।” শীলভদ্র এইটুকু বুঝতে পারছিলেন যে আগন্তুক যে সে নন। তাই সাবধানেই পরবর্তী কথাটা বললেন।

“হুঁ...” সহজে পেট থেকে কথা বের করা যাবে না বুঝে রাজসিংহ মাথা নাড়লেন।

“আমি ডাক্তার ঘোষের ভাগ্নে। আমরা দীর্ঘদিনের সুরাটের বাসিন্দা। মাঝে আমি অনেকদিন ম্যানচেস্টারে ছিলাম। এখন সুরাটে থিতু হয়েছি।”

“অনুময়বাবুতো ঘোষ, আপনি চৌধুরি!” শীলভদ্রের কথার মধ্যে সন্দেহের ছোঁয়া।

“আপনার আপত্তি আছে?” রাজসিংহের কথায় বিরক্তি প্রকাশ পেল।

“না,না আমার আপত্তি কীসে? কিন্তু আমি যখন কথা বলেছি তখন ডাক্তারবাবু আপনার কথা বলেননি তো। তাই ভাবছি....”

“কী ভাবছেন? এই রাজসিংহ চৌধুরী কোথা থেকে উড়ে আসলো। তাই তো? শুনুন শীলভদ্রবাবু, ওই জমি এবং বাড়ির অর্ধেক অংশের মালিকানা আমার মায়ের। যেহেতু মা এখন বেঁচে নেই এবং মায়ের আর কোনো সন্তান নেই সুতরাং সেই অংশের মালিকানা আমার।” রাজসিংহবাবু একটু থামলেন। শীলভদ্রবাবুর মুখখানা ব এর আকার ধারণ করেছে। ভদ্রলোক কী বলছেন কিছুই মাথায় ঢুকছে না।

“কিন্তু... ডাক্তারবাবু তো এসব কিছু আমায় বলেননি।” শীলভদ্রবাবুর পেটের ভেতর থেকে কথাগুলো যেন বেরিয়ে এলো।

“বলবেন না। আমার মা মামার থেকে পনেরো বছরের বড় ছিল। বহুকাল বিয়ে হয়ে গেছে। খুব যে বেশি আসা যাওয়া ছিল তাও না। আর সম্পর্ক যদি বলেন সেরকম কিছু ছিল না। এই সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করে বলুন?”

“কিন্তু... আপনি জানলেন কী করে?”

“প্রথমত মায়ের সিন্দুকে বহু পুরোনো উইল খুঁজে পেয়েছি। আমার দাদুর উইলের একটা কপি যেখানে মাকে দাদু পুরো জমির অর্ধেক এবং বসত বাটির নিচের তলা সজ্ঞানে দিয়ে যান। আর তাছাড়া মাও আমাকে বলেছে।” কথা বলতে বলতে রাজসিংহবাবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলেন।

“হুঁ... অদ্ভুত ব্যাপার! ডাক্তারবাবু তো একটি কথাও বললেন না!” কিছুটা আত্মগত হয়ে শীলভদ্র পালিত বিড়বিড় করছেন। হঠাৎ রাজসিংহবাবুর মোবাইলটা বেজে উঠলো। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে বাইরে গেলেন। শীলভদ্রবাবু চিন্তার আরকে ডুবে গেলেন।

“কী ব্যাপার, কী ভাবছেন?” রাজসিংহবাবুর ডাকে চমকে শীলভদ্র তাকালেন।

“শুনুন শীলভদ্রবাবু, আপনি এই ডিলিংস-টার থেকে সরে যান।”

“মানে?” শীলভদ্র হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছেন।

“সোজা কথা সোজা ভাবেই তো বললাম। এখানে আপনি প্রোমোটিং করতে পারবেন না। আর একটু সোজা ভাবে বলব? আমি আপনাকে এখানে কাজ করতে দেব না। ইজ ইট ক্লিয়ার?”

“না, ক্লিয়ার না। এই যে কথাগুলো বললেন তার প্রমাণ আপনাকে দেখাতে হবে। তাছাড়া ডাক্তারবাবুর সাথে আমি কথা বলব। হঠাৎ আপনি এসে বললেন আর আমি সরে যাবো এটা তো হবে না।” শীলভদ্র এবার বেশ জোরের সুরে কথা বললেন।

“প্রমাণ চান? বেশ। আর ওই যে বললেন না ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলবেন তাতে কোনো লাভ হবে না। ওকে, আজ উঠি। মনে রাখবেন কথাটা। ভুয়ো লোকের গল্প ভেবে উড়িয়ে দেবেন না।”

“হুমকি দিচ্ছেন!”

“নো নো, নট এট অল। চলি।” একটা হাসির ঝলক দিয়ে বেরিয়ে গেলেন রাজসিংহবাবু।

 

এমিলি ভদ্র। বয়স প্রায় ৮০। সারা মুখে জটিল বলিরেখাগুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে। চোখের দৃষ্টিতে কুটিলতা ভীষণভাবে প্রকট। আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে লন্ডন থেকে ষাট মাইল দূরে পামস্টে নামে একটি গ্রাম থেকে কলকাতায় বাবার সাথে চলে এসেছিলেন। আর ফিরে যাননি। বিয়েও করেছিলেন এক বাঙালিকে। স্বামী ছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী। এখন উনি পুরোদস্তুর বাঙালি। বছর কুড়ি আগে স্বামী অজয় ভদ্র মারা যান। সেই থেকে এমিলি শিবপুর ট্রাম ডিপোর থেকে কিছুটা ভেতরে রাজীব চপের গলিতে একটা ছোট দোতলা বাড়িতে থাকেন। এক ছেলে ম্যানচেস্টারে থাকে। এমিলি কফি মাগে দুধ কফি মেশাতে মেশাতে বার বার বসার জায়গায় সোফাটা লক্ষ করছিলেন। আরশাদ নিয়ে এসেছে ভদ্রলোককে। শীলভদ্র পাঠিয়েছে। কিন্তু ডিল ঠিক না হলে ভাগিয়ে দিতে হবে। আনপর, নন টেকনিক্যাল লোকেদের নিয়ে কাজ করা অসম্ভব।

“আরশাদ.... কফিটা নিয়ে যা। টেবিলে রাখ, আমি আসছি।”

“জি ম্যাডাম।”

বয়সের ভারে হাঁটা চলাটা খুব শ্লথ হয়ে গেছে। কিন্তু নুয়ে পড়েননি। ঋজু এবং দৃপ্ত ভঙ্গিতে সোফায় এসে বসলেন।

“বলুন কী খবর নিয়ে এসেছেন?”

“আমাকে ম্যাডাম তুমি বলবেন।”

“হুঁ…” এমিলি আস্তে করে মাথা ঝুঁকিয়ে উত্তর দিলেন।

“নীলগঞ্জের যে ডাক্তার আছে না...”

“অনুময় ঘোষ?”

“হ্যাঁ, ম্যাডাম। এক ঝামেলা হয়েছে।”

“ঝামেলা? কেন? কথাবার্তা তো হয়েই গেছে।” এমিলির কুঞ্চিত ভুরু আরো কুঞ্চিত হয়ে গেছে।

“ডাক্তারের ওই জমি আর বাড়িতে ভাগীদার আছে এখন জানা গেছে।”

“মানে?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম। ডাক্তারের এক দিদি ছিল। সে ও ওই সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক। ডাক্তারের বাবার উইলে লেখা আছে। সেই মহিলা বেঁচে নেই কিন্তু তার ছেলে এখন ক্লেইম করছে। ফলে ডাক্তারের একার কথায় আমরা এগোতে পারবো না।”

“তুমি খবর পেলে কী করে?”

“গতকাল দাদার কাছে রাজসিংহ চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক এসেছিল। সে নাকি ডাক্তারের ভাগ্নে। মানে দিদির ছেলে। সোজাসুজি দাদাকে এই ডিলিংস থেকে সরে যাবার হুমকি দিয়ে গেছে।”

“হুমকি ... থ্রেটেনিং দিয়েছে? কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ সত্যি কি-না খবর নিয়েছ?”

“ম্যাডাম, একচুয়ালি খবর নেওয়া হয়নি। ওই রাজসিংহ ডাক্তারের কাছে একরকম না যেতে বলেছে। দাদা তাই আপনার কাছে পাঠিয়েছে কী করা উচিত জানার জন্য?”

“উফফ! তোমার দাদার বুদ্ধি কবে হবে? ...অ্যানি ওয়ে, তোমার নামটা জানা হয়নি।” বিরক্তি খেলে গেল এমিলির চোখে মুখে।

“ম্যাডাম, আমার নাম অশোক... অশোক সামন্ত। দাদার পার্সোনাল এসিস্টেন্ট।”

“তোমাকে বিশ্বাস করবো কীভাবে? আগে তো তুমি কোনোদিন আসোনি।” একবার আরশাদ একবার অশোকের দিকে তাকিয়ে এমিলি কথাটা বললেন।

“ম্যাডাম... অশোক শীলভদ্রের লোক। আমি জানি। নিশ্চিন্তে কথা এগোতে পারেন।” আরশাদ আশ্বাস দিলো।

“হুঁ…”

“শোনো অশোক, তুমি শীলভদ্রকে বলো ইমিডিয়েট ডাক্তারের সাথে কথা বলতে। একটা ব্যাপার আমার ডাউট হচ্ছে যে ডাক্তার উইলের ব্যাপার কিছু জানে না! কিন্তু নেগোশিয়েশনের এর সময় কিছু বলেনি কেন? যাই হোক অলরেডি লেট হয়ে গেছে। অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল কথা বলতে হবে। আর...”

“আর ম্যাডাম?”

“তুমি এত কিছু জানলে কী করে? শীলভদ্র বলেছে না ওই লোকটার সাথে কথা হচ্ছিল যখন তুমি সেই সময় ঘরে ছিলে?” এমিলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অশোকের দিকে তাকিয়ে আছেন।

“আমি সেই সময়ে ঘরে ছিলাম না। বেরিয়েছিলাম। ফিরতেই দাদা সব বলল।”

“হুঁ… যাও। যা বললাম শীলভদ্রকে বলো।” বলে এমিলি সোফা থেকে উঠে ধীর পায়ে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। আরশাদ আর অশোক চোখ চাওয়াচায়ি করে উঠে বেরিয়ে গেল।

বাড়িটা বেশ পুরোনো আমলের। আর্কিটেকচারে একটা সাবেকি ছোঁয়া আছে। দাদুর বাবা অমর্ত্য ঘোষ এই বাড়িটা চল্লিশের দশকে তৈরি করেন। তখন একান্নবর্তী পরিবার ছিল। সর্বক্ষণ বাড়ি গমগম করতো। বাড়ি সংলগ্ন বিঘে পনেরো জমি ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে অর্থাৎ অমর্ত্য ঘোষের ছেলে অপূর্ব ঘোষের আমলে পরিবারের অন্য শরিক যারা ছিলেন তারা তাদের ভাগ অর্থের হিসেবে নিয়ে এই প্রাসাদপম বাড়ি এবং জমি ছেড়ে নিজেদের মতো অন্য জায়গায় চলে যান। স্বাভাবিকভাবেই অপূর্ব ঘোষ বাড়ি ও জমির একচ্ছত্র মালিক হয়ে যান। অপূর্ব ঘোষের এক ছেলে অম্লান ঘোষ। সাহিত্যের জগতে বিশিষ্ট এক মানুষ ছিলেন অম্লান ঘোষ। নিজের প্রকাশনার ব্যবসা ছিল। তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ ডাক্তার অনুময় ঘোষের মা বিপাশা ঘোষও স্বনামখ্যাত লেখিকা এবং চিত্র সমালোচক ছিলেন। অনুময়বাবু নিজের পছন্দে মা ও বাবার একরকম বিরুদ্ধে গিয়ে চিকিৎসকের জীবিকা বেছে নিয়েছেন। তিনি অকৃতদার। তিনি নিজেও সুচিকিৎসক এবং তাঁর অর্থেরও প্রাচুর্য কম না। কিন্তু জীবনের এই প্রান্তে এসে এত অর্থ, এই বিশাল সম্পত্তি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এখনও দিনে দশজন রুগী দেখেন। অবশেষে কম্পাউন্ডার কাম এসিস্টেন্ট নৈঋত এর সাহায্যে বাড়িটা জমিসহ প্রোমোটার কে দিতে ভাবনা চিন্তা করছেন। কিন্তু... কালকে রাত্রের ফোনটা অনুময়বাবুর ঘুম প্রায় কেড়ে নিয়েছে।

“নৈঋত, আর কজন পেশেন্ট আছে?” বেল বাজিয়ে অনুময়বাবু কম্পাউন্ডার নৈঋতকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন।

“স্যার, আর একজন।”

“এরপর আর নাম নেবে না। আজ আর রুগী দেখবো না।”

“কেন স্যার, মোটে তো পাঁচজন হলো। শরীর খারাপ লাগছে?” নৈঋত চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলো।

“হুঁ... খুব ক্লান্ত লাগছে।”

“আচ্ছা। শেষের জনকে পাঠিয়ে দেব না একটু বিশ্রাম নেবেন?”

“না না। পাঠিয়ে দাও। আমি দেখে ওপরে উঠে যাব।”

“ঠিক আছে স্যার।”

“আসতে পারি?”

“হুঁ... আসুন।” আগন্তুকের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে অনুময়বাবু ক্লান্ত চোখ দুটো তুলে একটু তাকালেন। তারপর ইশারায় রুগীর চেয়ারে বসতে বললেন।

“বলুন সমস্যা কী ?”

“সমস্যা যে ডাক্তারবাবু অনেক। সমাধানটা যদিও আপনার কাছে।”

এমনভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলা হল যে ডাক্তারবাবু কিছুটা চমকে উঠলেন।

“সমস্যাটা শুনি আগে।” অনুময়বাবুর গলার স্বর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে।

“শীলভদ্র পালিতের সাথে কততে রফা করলেন ডক্টর?”

“হোয়াট! হু আর ইউ?” একটু জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন।

“আহা, চিৎকার করছেন কেন? আমি শুধু জানতে চেয়েছি।”

“কে আপনি? আর আমার রুগী দেখার সময় এসেছেন কেন?”

“কেন এই সময় এসেছি কারণটা বোধহয় আপনিও কিঞ্চিৎ জানেন।” ঠোঁটের আগায় একটা হালকা হাসি ঝুলিয়ে তেরচা চোখে তাকিয়ে রইলো।

“আপনার নাম?”

অনুময়বাবুকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে একটা অদ্ভুত স্বরে বলল,”আমার নাম বললে বুঝতে পারবেন? নাকি... আগে পুরো পরিচয়টা দেব? যাই হোক, নাম যখন জানতে চাইছেন তখন নামটাই বলি আগে। ভীষ্ম চৌধুরি। কমলা চৌধুরী...” ঈষৎ ঘাড় বেঁকিয়ে আবার বলল, “আমি তো উত্তর দিলাম। এবার আপনার পালা ডাক্তার অনুময় ঘোষ।”

“আপনাকে আমি চিনি না। আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”

“আপনি বাধ্য নাই থাকতে পারেন তাই বলে আমাকে বাধ্য করবেন না উত্তরটা জোর করে আদায় করতে।”

অনুময়বাবুর সারা শরীর ঘামছে। গলার স্বরে ঈষৎ কাঁপুনি, “আমি অসুস্থ বোধ করছি। আপনি এখন আসুন।”

“আমি না হয় আজ চলে যাবো। কিন্তু আবার যে আসবো ডাক্তার ঘোষ।” চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে ভীষ্ম চৌধুরী স্থির দৃষ্টিতে অনুময়বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

চেম্বারের ভেতর থেকে কিছু অবাঞ্ছিত কথার টুকরো ভেসে আসছিল। নৈঋত তৎক্ষণাৎ ভেতরে ঢুকে স্যার কে মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকতে দেখে ভদ্রলোকের দিকে এক ঝলক দেখে কাছে গিয়ে বলল, “স্যার, ঠিক আছেনতো?”

হাতের ইশারায় জল চাইলেন অনুময়বাবু।

নৈঋত বললো, “স্যার, অসুস্থ লাগছে যখন একটু ফ্রুট জুস খান, ভালো লাগবে।” বলে একটা গ্লাসে জুস এনে ডাক্তারবাবুর হাতে দিল। ডাক্তারবাবুর খাওয়া হয়ে গেলে সর্বক্ষণের কাজের লোক রামেশ্বরকে ডেকে বললো স্যার কে ওপরে বেড রুমে নিয়ে শুইয়ে দিতে।

 

সন্ধ্যে সাতটা হবে। মিউজিক সিস্টেমে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার চালিয়ে আরাম কেদারাতে চোখ বুজে ঘর অন্ধকার করে বসে শুনছেন অনুময় ঘোষ। সকালে চেম্বারের সেই ঘটনার পর ডাক্তারবাবু নিজের ঘরে এসে অকাতরে ঘুমাচ্ছিলেন। দুপুরের খাবার খাননি। কিন্তু এত ঘুমানোর পর ও সারা শরীরে একটা অবসন্নতা। মাথাটা যেন তুলতে পারছেন না। সেতারে বেহাগ বাজছে। সুরের মূর্ছনায় অনুময়বাবু এক অন্য জগতে বিচরণ করছেন। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।

“হ্যালো...” অসীম ক্লান্তি গলার স্বরে।

“ডাক্তারবাবু… আমি শীলভদ্র বলছি।”

“শীলভদ্র?”

“হ্যাঁ। আপনার সাথে একটু কথা ছিল। আজকে একটু সময় দিতে হবে।”

“আজ আমার শরীরটা ভালো নেই। কাল...”

“আসলে খুব জরুরি ছিল। বেশি সময় নেব না। পনেরো মিনিট সময় দিলেই হবে।”

“বেশ এস। রামেশ্বরকে বলে রাখবো। তুমি এসে ওকে বললেই দোতলায় নিয়ে আসবে।”

“থ্যাংক ইউ ডাক্তারবাবু। আমি আটটা নাগাদ যাবো।”

“আচ্ছা।”

 

ভোরবেলার মিষ্টি হাওয়ায় ঘুমটা আরো জাঁকিয়ে আসছে। কিন্তু একতলার নাটমন্দিরের পাশ থেকে অনেক কথার আওয়াজ ভেসে ভেসে উড়ে বেড়াচ্ছে। কথাবার্তার আওয়াজে আর নাটমন্দিরের জটলার ভেসে আসা শব্দের তোড়ে অনুময় জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন যে একজন বেশ বড় মেয়ে ছাপার শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। ত্রস্ত তার চাউনি। আলোচনার মধ্যমণি যে সে এবং সে আলাপ যে মোটেই সুখকর নয় তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

পাশের ঘরে থেকে চাপা গলায় কথা শোনা যাচ্ছে।

“তুমি এ কী করলে! শেষে ঘরে এনে তুললে? সমাজ আছে সেখানে কীভাবে মুখ দেখাব ভেবে দেখেছো?”

“তাই বলে মেয়েটা আশ্রয়হীন অবস্থায় পড়েছিল! এতদিন খোঁজও করিনি। আজ যখন খবর পেলাম তখন তো আমি ফেলে দিতে পারি না। আফটার অল...”

“আর অনু? অনুর কথা ভেবেছো? ওর কাছে কী উত্তর দেবে?”

“উত্তর অনুর কাছে?? ওর পরিচয় ও অনুর দিদি।”

“কী বললে? অনুর দিদি?”

হ্যাঁ, অনুময় ঘোষের দিদি। মা বাবার কথায় পাশের ঘরে থেকে সেদিন এইটুকু বুঝেছিলেন অনুময় যে নিজের না হলেও সে কোনো সম্পর্কের দিদি।

 

আজ এতদিন বাদে আবার সেই কমলা চৌধুরী! খুব আস্তে করে উঠে মিউজিক বন্ধ করতে গেলেন অনুময় ঘোষ। কমলা চৌধুরী আবার তাঁর দীর্ঘদিনের ছন্দময় জীবনে ছন্দপতন ঘটাচ্ছে।

উফফ! বাবাগো! অতবড় শরীরটা চেয়ার থেকে মেঝেতে এলিয়ে পড়ল।

 

এমিলি চোখদুটো টিপে বসে আছেন। একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত দশটা বেজে গেল না আরশাদ না অশোক কারো কোনো ফোন নেই। কী ব্যাপার হলো! এমিলির সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী মেলোডি হরলিকসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ওর এমি মায়ের কাছে এল।

“এমি মা, এত কী ভাবছেন? আরশাদ কাজটা ঠিক করবে। ওর ওপর বিশ্বাস রাখুন। কথা যখন দিয়েছে তার নড়চড় হবে না।”

“মেলোডি... আমি যে কোনো কারণেই হোক অশোকের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছি না। একদম অচেনা। যদিও শীলভদ্রের পি এ. বাট আই কান্ট ট্রাস্ট হিম।”

“ওহ নো এমি মা। আরশাদ সার্টিফিকেট দিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা ট্রাস্ট তো করতেই হবে। আদারওয়াইজ কাজ চালাবেন কী করে? অ্যানিওয়ে, রাজেন এসেছিল?” চামচ দিয়ে হরলিক্স নাড়াতে নাড়াতে জিজ্ঞেস করলো মেলোডি।

“সকালে ফোন করেছিল। আজ একবার ব্যাংকে যাবে বলেছিল। ব্যাস, ওরও কোনো খবর নেই। আমার বয়স হচ্ছে। এখন এত টেনশন নিতে পারি না। ভাবছি ব্যবসা ছেড়ে দেব।”

“হোয়াটস রং উইথ ইউ এমি মা? একটু ধৈর্য ধরুন।”

বিছানার পাশে রাখা মোবাইলে টুং টাং শব্দ ভেসে আসলো। এমিলি তাকিয়ে দেখলেন রাজেন হোয়াটস আপ করেছে, “ম্যাডাম কাজ হয়ে গেছে।”

এমিলি রিপ্লাই দিলেন, “হুঁ..”

রাজেন লিখল, “মেলোডিকে বলুন আমাকে রিং করতে। আপনার সাথে জরুরি কথা আছে। আমার ব্যালেন্স নেই।”

এমিলি রিপ্লাই দিলেন, “ওকে।”

“এমি মা, রাজেনের ফোন বাজছে। ধরুন।” মেলোডি ফোনটা ধরে এমিলিকে দিলো।

“হ্যালো... মেলোডি... শোনো ম্যাডামকে ফোনটা দাও।” রাজেন ফোনটা ধরে এমিলিকে চাইলো।

“ম্যাডাম বলছি।”

“ও ম্যাডাম... ডিনার হয়ে গেছে?”

“কাজের কথা বলো রাজেন” বিরক্ত স্বরে এমিলি কথা বললেন।

“ও হ্যাঁ ম্যাডাম। ফোর্টি এইট থাইজেন্ডের বেশি তুলতে পারিনি। আসলে...”

“কী? কী বললে? ফোর্টি এইট থাইজেন্ড ? আর ইউ জোকিং রাজেন? এরপর এক্সকিউজ দিতে চাইছ? কেন পারলে না?” এমিলি সামান্য জোরে কিন্তু চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললেন।

ও-প্রান্ত কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পর বলল, “ব্যাংকের নিয়ম একবারে ফোর্টি নাইন থাইজেন্ডের বেশি তোলা যাবে না।”

“নিয়ম আমি জানি। আর একটা ফরম ভরে তুলতে পারলে না?”

“সেইম ডে-তে সম্ভব নয় ম্যাডাম।”

“হোয়াই নট? একটা কাজে দুটো দিন দেওয়া মানে পুরো প্রসিজারটা পিছিয়ে যাওয়া।”

“ম্যাডাম, রাগ করবেন না। যদি কোনোভাবে সন্দেহ হয় বুঝতে পারছেন? একটু ভেবে পা ফেলাই উচিত মনে হয়। কাল ফার্স্ট আওয়ারে গিয়ে বাকিটা ব্যবস্থা করবো। বাট...”

“আবার কী হলো?”

“ম্যাডাম, এই ট্রান্সেকশনের ব্যাপারটা ফোনে মেসেজ এসে যাবে। তখন?”

“ওহ নো রাজেন! সিগনেচার তো আছে তবে? ক্লেইম করতে করতে... হোয়াটএভার এইসব ভাবার দরকার নেই। কাল বাকিটা সেরে এখানে এস। বাই দ্য ওয়ে আরশাদ এর খবর জানো? আজ কোনো ফোন নেই!”

“ম্যাডাম, আরশাদ এর খুব জ্বর এসেছে। ডাক্তারের কাছে থেকে ওষুধ এনেছে। তাই মনে হয় যেতে পারেনি আর আপনাকেও জানাতে পারেনি।”

“ইররেস্পন্সিবল লোকজন সব! আমাকে জানাবে তো। যাই হোক, তোমার কাজ তুমি কোরো।” ফোনটা কেটে মেলোডিকে দিয়ে দিলেন এমিলি। মেলোডি একটা চকিত দৃষ্টি হেনে এমিলিকে দেখে কাপটা নিয়ে ঘর থেকে চলে গেল।

রাজ অ্যান্ড রাজ এর সেকেলে নাইলনের ফিতে আঁটা হেলান দেওয়া চেয়ারে সামনেদিকে পা ছড়িয়ে বসে সবুজ সেন খবরের কাগজ পড়ছিলেন। পাশে ছোট্ট টিপয়ের ওপর বড় এক কাপ ধূমায়িত দুধ চিনি ছাড়া ব্ল্যাক টি। একটু একটু করে সিপ করছিলেন।

“গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে, মৃদুল মধুর বংশী বাজে...” মোবাইল বেজে উঠল। সবুজ সেন একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিলেন যেন ফোনটার জন্য তিনি ওয়েট করছিলেন। সোয়াইপ করে ফোনটা ধরলেন।

“ইয়েস বস, খবর মনে হচ্ছে গুরুতর!”

“হ্যাঁ সাহেব। আপনি তো অন্তর্যামী। ফোন ধরেই বুঝে যান।”

“আরে না, অন্তর্যামী হওয়া চাট্টিখানি কথা! সে সৌভাগ্য হলো না আমার। কাগজে দেখলাম।”

“কাগজে দেখেছেন?”

“হ্যাঁ…”

“যাক, আসতে হবে তো একবার। ঠিকানা মেসেজ করে দিচ্ছি। আমি এখন অকুস্থলে।”

“ঠিকানা হলো নীলগঞ্জ, নীলমাধব পুর, গড়িয়া। ডাক্তার অনুময় ঘোষের বাড়ি। ঠিক বললাম ?” হেসে বললেন সবুজ সেন।

“১০০ পার্সেন্ট। আপনি চলে আসুন সাহেব। সঙ্গীকেও আনতে ভুলবেন না।”

“ওকে ডিয়ার।”

এতক্ষণ কথা হচ্ছিল নীলমাধবপুর থানার ওসি প্রকাশ ছেত্রীর সাথে। বছর ছত্রিশের সুঠাম দেহের অধিকারী প্রাণবন্ত, বুদ্ধিদীপ্ত এই প্রকাশ আদতে বাঙালি না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে একাদিক্রমে নয় বছর বিভিন্ন থানায় কাজ করার ফলে বাঙালি হয়ে গেছে। কোনো জটিল কেস থাকলেই সবুজ সেনের ডাক পড়ে। সবুজ সেন এক সময় বেঙ্গল পুলিশের এক দুঁদে পুলিশ অফিসার ছিলেন। বছর ছয়েক হলো অবসর নিয়েছেন। কিন্তু এখনো যে কোনো ব্যাপারে এগিয়ে যান। সেটা যে শুধু পারদর্শিতার কারণে তা নয় মনের তাগিদেও বটে। ওনার একনিষ্ঠ ভক্ত কাম সঙ্গী মুকুট রুবির কাছে থাকে। সবুজ সেনের সব কেসের সহযোগী সে। সময় নষ্ট না করে সবুজ সেন ফোনে মুকুটকে তৈরি হয়ে থাকতে বলেন। যাবার সময় তুলে নিয়ে চলে যাবেন।

 

গাড়িটা নীলগঞ্জ বাজারের ভেতর দিয়ে ঢুকতেই চারিদিকে একটা থমথমে ভাব লক্ষ করছিলেন সবুজ সেন।

“মনে হচ্ছে ডাক্তার অনুময় ঘোষ খুব বিখ্যাত ছিলেন।” জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখতে সবুজ সাহেব মুকুটকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

“ঠিক বলেছ কাকু। আমাদের গাড়িটা টার্ন নিতে নিতেই কয়েকজন গম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে আমাদের লক্ষ করছিল।”

“হুঁ...”

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সবুজ সাহেবের গাড়ি ডাক্তারের বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে গেল।

বাড়ির সামনে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। একদিকে জিপটা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে মনে হচ্ছে, পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করছে। ইতিউতি বেশ কিছু কৌতূহলী জনতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবার মধ্যে চিন্তার ভাব সুস্পষ্ট। সবুজ সাহেবের গাড়িটা দাঁড়াতেই দুজন কনস্টেবল ছুটে এলো। স্যালুট করে সরে যেতেই সবুজ সাহেব একজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “প্রকাশ ভেতরে?”

উত্তর এলো, “জি সাহেব।”

সবুজ সাহেব আর মুকুট দৃপ্ত পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথমেই ডাক্তারবাবুর রুগীদের ওয়েটিং লাউঞ্জ। সেখানে প্রকাশ অপেক্ষা করছিল, “আসুন সাহেব।”

তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে প্রকাশ সবুজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে অভিবাদন জানাল।

 

আরামকেদারাকে প্রায় অর্ধ বেষ্টন করে ডাক্তার অনুময় ঘোষের মৃতদেহ মেঝেতে পড়ে আছে। ডান হাত মাথার পেছন দিকে আর বাঁ হাত মেঝেতে আলুলায়িত ভঙ্গিতে ছড়িয়ে আছে। সবুজ সাহেব নিবিষ্ট মনে মৃতদেহ পরীক্ষা করছিলেন। মুকুট এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ সবুজ সাহেবের দিকে ফিরে বললো, “কাকু... মিউজিক সিস্টেমটা চলছিল মনে হয়। পন্ডিত রবিশঙ্করের একটা সিডি ঢোকানো আছে। আর সিডিটা চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেছে। প্লে বাটন অন করাই দেখছি।”

“হুঁ... তার মানে বন্ধ করার সময় পাননি অথবা অন্য... কিছু...” চিন্তান্বিত লাগল সবুজ সেনকে।

বিছানার চাদর কিছুটা অসমান রয়েছে। তার মানে ব্যবহৃত হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে।

“সাহেব...” প্রকাশ সবুজ সাহেবের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলো।

“উঁ...” সবুজ সাহেবের একটু অন্যমনস্ক উত্তর।

“সাহেব, মনে হচ্ছে বিছানাতে খুন করে আরামকেদারার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”

“আমার তা মনে হচ্ছে না। একটু মন দিয়ে দেখো। বিছানা যদি স্পট হয় তবে বডিটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেইটানার কোনো চিহ্ন কিন্তু নেই প্রকাশ। আর তাছাড়া...”

“তাছাড়া?”

“তাছাড়া, আঘাতটা সম্ভবত মাথার পেছনে করা হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখো প্রকাশ, বিছানা থেকে পুব দিক ঘেঁষে জানলা এবং ঐ গ্রিল ভেদ করে কোনো মানুষের আসা সম্ভব না। আর যদি মারার পরে বডি টেনে আনা হতো তবে চাদর খাট থেকে ঝুলে থাকতো। সুতরাং...”

“ঠিক বলেছেন সাহেব। চাদরটা সামান্য কুঁচকে রয়েছে। বিছানা প্লেস অফ অকারেন্স নয়।”

“কাকু…” মুকুট সবুজ সাহেবের দিকে ফিরে বলল,”জানলা দিয়ে যতদূর দেখা যাচ্ছে, এখানে কাছাকাছি কোনো বড় গাছ নেই। তবে অনেকটা দূরে মনে হচ্ছে একটা গেট দেখতে পাচ্ছি। এদিক দিয়ে কোনো লোক আসলেও দোতলায় উঠবে কেমন করে?”

“ঠিক বলেছিস। আমিও দেখেছি।” সবুজ সাহেব উত্তর দিলেন।

“প্রকাশ...”

সবুজ সাহেবের ডাকে প্রকাশ কাছে এসে দাঁড়াল।

“বলুন সাহেব।”

“ডেডবডি দেখা হয়ে গেছে। এবার আমায় বল ডাক্তারবাবুর বাড়িতে কে কে আছেন?”

“খোঁজ নিয়ে যা জানলাম যে ডাক্তারবাবু বিয়ে করেননি। একজন সবসময়ের কাজের লোক আছে আর মালি, রাঁধুনি আছে। এছাড়া ওনার কম্পাউন্ডার কাম এসিস্টেন্ট একজন আছে।”

“প্রকাশ, আমি এদের সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

“এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি সাহেব।”

 

চেম্বার রুমটা খুব ছোট না। দরজা দিয়ে ঢুকে দশ হাত মতো গিয়ে রুগীর বসার জন্য দুটো গদি আঁটা চেয়ার। বেশ বড় গ্লাস টপ দেওয়া সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার অপরপ্রান্তে ডাক্তারবাবুর বসার রিভলভিং চেয়ার। টেবিলের কাঁচের তলায় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির নাম লেখা নানা ডিজাইনের পেপার শোভা পাচ্ছে। ডাক্তারবাবুর চেয়ারের ডানদিকে দেওয়াল জুড়ে শো কেস। তাতে ওষুধ আর কিছু গণেশ,কালীর ছোট মূর্তি দেখা যাচ্ছে। চেয়ারের পেছনে বড় একটা জানলা আর তার ঠিক ওপরে সুদৃশ্য একটা ঘড়ি। ঘড়ির বাঁ দিকে ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। এই ঘরেই সবুজ সেনের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন আধ বুড়ো মতো লোক ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল।

“কী নাম তোমার?”

“আজ্ঞে রামেশ্বর।”

“এখানে অনেকদিন আছো?”

“আজ্ঞেবাবু, বছর কুড়ি হবে আছি।”

“তুমি কি ডাক্তারবাবুর কাছে সারাক্ষণ থাকতে?”

“হ্যাঁ বাবু। শুধু ওই রুগী দেখার সময়টুকু বাদ দিয়ে।”

রামেশ্বর উত্তরগুলো খুব সাবধানে দিচ্ছে বোঝা যাচ্ছে।

“তা তুমি কী কাজ করতে?”

“আমি বাবুর খাবার দেওয়া, জামাকাপড় গোছানো ঘর বাড়ির সব দেখাশুনা করা এসব করতাম।”

“আচ্ছা, বাবুর মৃতদেহ তুমি প্রথম দেখেছো?”

“হ্যাঁ আমি প্রথম দেখি। রাত এই আটটা নাগাদ একজন ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা করতে আসে। সেই খবর দিতে গিয়ে দেখিবাবু মাটিতে পড়ে আছে।”

“ওই সময় ডাক্তারবাবু ওপরে ছিলেন? রুগী দেখছিলেন না?” সামান্য বিস্মিত হয়ে সবুজ

সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

“না,বাবু ইদানিং বেশ কিছুকাল রাতে রুগী দেখতেন না। দিনে দেখতেন। সেদিনও তাই...”

“চুপ করে গেলে কেন রামেশ্বর? সেদিনও কী?”

“না বাবু, সেদিনবাবু বলেছিলেন যে রাত্তির আটটায় একজন দেখা করতে আসবে তাকে যেন ওপরে নিয়ে যাই। তা ভদ্দরলোক আসলে একটু কথা বলে আমি ওপরে খবর দিতে গিয়ে দেখি...” বলতে বলতে রামেশ্বর কেঁদে ফেলল।

একটু চুপ করে থেকে সবুজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “রামেশ্বর, সেদিন যে এসেছিলেন তাকে তুমি চেন?”

রামেশ্বর একটু সামলে নিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এর আগে কয়েকবার বাবুর কাছে এসেছিল।”

“নাম জানো?”

“উপাধি জানি না। নাম হল শীলভদ্র।”

“শীলভদ্র! শীলভদ্র পালিত কি?” সবুজ সেন ঘুরে প্রকাশকে জিজ্ঞেস করলেন।

“সাহেব… মনে হচ্ছে। আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।”

“তারপর রামেশ্বর, তুমিবাবুকে ওরকম দেখে কী করলে?”

“আমি কেমন হয়ে গেছিলাম। তারপরেই বাবু আমায় একটা মোবাইল ফোন দিয়েছিল সেটা থেকে কম্পাউন্ডার দাদাকে ফোন করে সব বললাম।”

“আচ্ছা বললে যে শীলভদ্র দেখা করতে এসেছিল তবে নীচে এসে তাকে বলেছিলে?”

“নীচে এসে তাকে তো আর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।”

“হুঁ... তারপর?”

“তারপর দাদা এসে যা করার করে। আর আমি কিছু জানি না।বাবু, আমার ডাক্তারবাবু খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার এরকম ঘটবে ভাবতে পারছি না। দয়া করে এর একটা বিহিত করুন।” সারা ঘরে পিন পড়ার নিস্তব্ধতা।

সবুজ সাহেব এবার গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললেন, “আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো। পুলিশও করবে। তবে রামেশ্বর, আমায় তুমি পুরো সাহায্য করবে তবেই আমি এগোতে পারব।”

“হ্যাঁ বাবু, আপনি যা করতে বলবেন তাই করবো।”

“ঠিক আছে, রামেশ্বর তুমি এস এবার।”

এরপর রাঁধুনি, মালি এদের জিজ্ঞাসাবাদের পর নৈঋতকে ডেকে পাঠানো হল। কিন্তু নৈঋত বেরিয়েছে। ফলে ওই কাজ মুলতুবি রাখতে হলো।

“প্রকাশ, আমার কিছু খবর চাই। তুমি পারবে?”

“অবশ্যই সাহেব। যে খবর চান এনে দেবো।”

মাথা নেড়ে সবুজ সেন একটু মিচকি হেসে মুকুটকে বললেন, “মুকুট, চল একবার ডাক্তারবাবুর জমিদারিটা দেখে আসি। প্রকাশ তুমিও চলো।”

 

এমিলি ড্রইং রুমে বসে আছে। সামনের চেয়ারে আরশাদ আর রাজেন বসে আছে। জানালাগুলো খোলা। পর্দা হাওয়ায় উড়ছে। রাজেন সামান্য উত্তেজিত। আরশাদ চেয়ার থেকে উঠে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। ওর চোখে মুখেও একটা অস্থিরতা খেলে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে মোবাইল বেজে উঠল। আরশাদ দেখল অশোকের ফোন। একটু বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরল।

“হ্যাঁ, অশোক, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। পরে রিং ব্যাক করছি।”

“আরশাদ, একটা খবর আছে। ডাক্তার ফিনিশ। খুন হয়েছে।” অশোকের গলার স্বরে সামান্য উত্তেজনা।

“মানে? খবর পাকা?” আরশাদ এর জোরে কথা বলায় এমিলি আর রাজেন চমকে তাকালো।

“পাকা খবর না হলে দিতাম না। এখন পুলিশে বাড়ি ভর্তি। তবে কাগজে বেরিয়েছে। দেখোনি?”

“না। খেয়াল করিনি। তবে তো কাজ মনে হচ্ছে সহজ হলো। কী বলো অশোক?”

“হুঁ। ম্যাডামকে বলো। আমি বিকেলের দিকে যাবো।” বলে ফোনটা কেটে দিলো।

আরশাদ ফোন রেখে খবরটা এমিলিকে জানালো।

“অনুময় ঘোষ নেই!” এমিলির চোখে মুখে বিস্ময়।

“জি ম্যাডাম। এবার আমাদের প্ল্যানটা একটু অন্যভাবে ভাবতে হবে।” আরশাদ এমিলির দিকে তাকিয়ে বলল।

“বাট ডাক্তার খুন হয়েছে!” এমিলি অদ্ভুত একটা স্বরে বললেন।

“জি ম্যাডাম।” আরশাদ বলল।

এমিলি চুপ করে কী যেন ভাবছেন তাই আরশাদ এর কথার উত্তর দিলেন না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এমিলি মনে মনে একটা হিসেব কষে মোবাইলটা নিয়ে পাশের ঘরে যেতে যেতে রিং করলেন। আরশাদ তার ম্যাডামকে দেখছে। এরপরের নির্দেশের অপেক্ষায় বসে আছে।

ঘন্টাখানেক ধরে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। অশোক বৃষ্টির মধ্যেই তিনটে নাগাদ এসেছে। আরশাদ, রাজেন আর মেলোডি বসার ঘরে বসে আছে। ভেতরের দিকে থেকে চটির আওয়াজ আসছে। এমিলি ঘরে ঢুকে রাজেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রাজেন, আজ খবর কী?”

“ম্যাডাম, টোটাল কুড়ি লাখ তুলতে পেরেছি। ডাক্তারবাবুর মারা যাওয়াতে কিছুটা সুবিধে হল। কিন্তু...”

“আবার কীসের কিন্তু?”

“ম্যাডাম, শুনলাম পুলিশের সাথে আর এক প্রাইভেট গোয়েন্দা ময়দানে নেমেছে। এখন যদি মোবাইল সিজ করে তবে কিন্তু মেসেজ দেখতে পাবে। তখন...”

“উইথড্রয়াল ফর্মে ডাক্তারের সই আছে রাজেন। ভয় পাচ্ছ কেন?” এমিলি বললেন।

“ম্যাডাম, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা জানেন তো? আমার মতে এখন আর এগোবো না। কদিন যাক, তারপর পরিস্থিতি দেখে যা করার করা হবে। আচ্ছা ম্যাডাম, রবিনের সাথে কথা হয়েছে?”

“হয়েছে। রবিনও কটা দিন ওয়েট করতে বললো।”

অশোক সব শুনছিল। রবিন নামটা শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এমিলির দিকে তাকাল। আরশাদ উত্তর দিলো, “রবিন ম্যাডামের ছেলে। ম্যানচেস্টার থাকে।”

“তাহলে, ম্যাডাম বাকিটাকা তুলে আমি পাঠাবো।” রাজেন বললো।

“এখন কোনো রিস্ক না। ওই ব্যাপারটা পরে ভাবা যাবে।” রাজেন মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালো।

“অশোক, কাল শীলভদ্র কখন ফিরল?”

“আমি এখনো জানি না ম্যাডাম। দাদা আজ ভোরে কলকাতায় গেছে। পরে

ডিটেইল করবো আপনাকে।” অশোক এমিলির প্রশ্নের উত্তরে বললো।

“ওকে, আমাকে খবর দেবে টাইম টু টাইম।”

“অবশ্যই ম্যাডাম।”

 

ডাক্তার অনুময় ঘোষের বাড়ি থেকে সেদিন সবুজ সেন ওনার ঘরের কয়েকটা জিনিষ প্রকাশের সাথে কথা বলে নিয়ে এসেছিলেন। সকালবেলা ওনার ঘরের টেবিলের ওপর সেগুলো রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছিলেন। মুকুটও কাকুর বাড়ি সকাল বেলা চলে এসেছে।

“কাকু, মোবাইলের ইনকামিং লিস্টে শীলভদ্র পালিতের নাম দেখতে পাচ্ছি।” মুকুট সবুজ সাহেবকে বললো।

“আর কেউ? ভালো করে দ্যাখ।”

“কাকু, বেশ কয়েকটা নম্বর থেকে ফোন এসেছে কিন্তু আউটগোয়িং কম। অর্থাৎ ডাক্তারবাবু ফোন এই দুইদিনের মধ্যে করেননি। নৈঋত এর নম্বর দেখছি। আর বুঝতে পাচ্ছি না।”

“হুঁ... বুঝলি মুকুট, তিনটে ব্যাপার। এক, রামেশ্বরের সাথে আবার কথা বলতে হবে। দুই, শীলভদ্র পালিতের অফিসে যেতে হবে আর তিন নম্বর হলো নৈঋত এর সাথে মোলাকাত করা দরকার।”

গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে.....সবুজ সেনের ফোনটা বেজে উঠল। প্রকাশের নামটা স্ক্রিনে দেখে সবুজ সাহেব ফোনটা রিসিভ করলেন।

“সাহেব... এ তো বেশ জটিল কেস।”

“কী করে বুঝলে প্রকাশ?” স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার টোনে সবুজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

“অনুময় ঘোষ কিছুদিন ধরে শীলভদ্র পালিতের সাথে বাড়ি জমি বিক্রি করে ফ্ল্যাটের ব্যাপারে নেগোশিয়েশন চালাচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝে কিছু ঘটেছে যেটা এখনো জানতে পারিনি, তার জন্য ব্যাপারটা থমকে ছিল। আর...”

“আর ওইদিন রাতে শীলভদ্র ডাক্তারের বাড়ি গেছিল। সময়টা মার্ডারের কাছাকাছি। কিন্তু বাকিটা মিলছে না।”

“হুঁ... ভালো ইনফরমেশন জোগাড় করেছ। প্রকাশ.. আমি শীলভদ্রের সাথে দেখা করবো। তুমি ব্যবস্থা করো। পারলে আজই।”

“সাহেব... শীলভদ্র নেই। কোথাও গেছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি। ফিরলেই জানাবো আপনাকে।”

“তুমি কি লোক লাগিয়েছ প্রকাশ?”

“ইয়েস সাহেব। জুলকিকে লাগিয়েছি। শীলভদ্রের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে বলেছি। তাতেই খবর পেলাম শীলভদ্র গতকাল ভোরবেলা শিয়ালদাগামী ট্রেনে চেপে কোথাও গেছে। আমি খবর পেলেই জানাবো।”

“প্রকাশ, আমি তোমাকে ডাক্তারের ফোনটা দেব। তুমি কল লিস্ট দেখে জানাও নম্বরগুলো কাদের? তুমি আমার বাড়ি কবে আসছো?”

“সাহেব, আমার একটা জরুরি কাজ পড়েছে। আমি সেরে যাচ্ছি আপনার ওখানে।”

“হুঁ, ঠিক আছে। তুমি আসলে আমি কিছু জরুরি আলোচনা করবো।”

“ওকে সাহেব।”

“কাকু, আমিতো কোথাকার ফোন নম্বর বলে দিতে পারি। তুমি প্রকাশ আঙ্কেলকে বললে?” মুকুট সবুজ সাহেবকে বলল।

“নারে, পুলিশ এনকোয়ারী করলে চটপট রেসপন্স পাওয়া যাবে। শোন, আমি একটু বেরোবো। তুই এখানে থাক। দুপুরে ফিরে লাঞ্চ করব।”

“আমি যাবো না?” মুকুটের চোখে মুখে একটা কষ্টের অভিব্যক্তি।

সবুজ সেন ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, “পরে যাবি। সবে তো নাটকের শুরু। এই কাজটা আমি একা করতে চাই।”

মুকুট আর কিছু বললো না।

 

বিকেল প্রায় তিনটের সময় সবুজ সেন ফিরলেন। মুখ গম্ভীর। মুকুট লক্ষ করলো কাকু খাবার টেবিলেও বিশেষ কথা বলল না। সাড়ে তিনটে নাগাদ ডোর বেলটা বেজে উঠল।

“সরি সাহেব, আসতে দেরি হয়ে গেল।” ঘরে ঢুকেই আপোলজি চেয়ে নিলো প্রকাশ।

সবুজ সাহেব সেই যে খেয়ে উঠে নিজের চেয়ারে বসেছেন আর নড়েননি। মন একেবারে অন্য জগতে ডুবে যাচ্ছে। প্রকাশ আসার দুই মিনিট পরে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন।

“খবর কী প্রকাশ?”

“সাহেব... শীলভদ্র ফিরেছে। একটু আগে অফিসে গেছে। তবে...”

“তবে?” মুখটা গম্ভীর। সবুজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

“তবে, জুলকি খবর দিলো শীলভদ্র অফিসে ঢোকার মিনিট কুড়ি বাদে দুজন লোক বাইকে করে ওর অফিসে ঢুকেছিল। তবে লোকদুটো ভেতরে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা গ্রে রঙের আই-টেন অফিসের গেটের থেকে ১০০ মিটার দূরত্বে দাঁড়াল। গাড়ির ভেতরে কাউকে দেখা গেল না। পাঁচ মিনিট পরে চলে গেল।” প্রকাশ চুপ করতেই সবুজ সাহেব বললেন, “প্রকাশ, নৈঋতকে তোমার অফিসে আসতে খবর পাঠাও। ওর সাথে পরিচয় পর্বটা এখনো হয়ে ওঠেনি। আজ এই ধরো রাত আটটা নাগাদ শীলভদ্রের অফিসে যাবো। তুমি আর মুকুট যাবে। তবে মৌনীব্রত অবলম্বন কোরো। যা বলার আমি বলবো।”

“সাহেব, নৈঋতকে কবে আসার জন্য খবর পাঠাব?”

“কাল সকালে ধরো আটটা নাগাদ।”

“সাহেব, এই গাড়ীটা ট্রেস করতে হবে। আমি দুজন কনস্টেবলকে গাড়িটাকে ফলো করতে বলেছি। একটা বড় গ্যাং আছে মনে হচ্ছে। শীলভদ্র পালিতের এই প্রমোটিং এর পুরো ব্যাপারটা খুব ফিসি।”

“কেন এরকম মনে হচ্ছে?” ঠোঁটে একটা আলগা হাসি ঝুলিয়ে সবুজ সেন জিজ্ঞেস করলেন।

“কাকু, তুমি আজ ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছিলে না?” মুকুট হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

“বাহ ভাইপো, ঠিক ধরেছিস তো! ওই নিরিবিলি বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলাম আর রামেশ্বরের সাথে একটু কথাবার্তা বললাম। লোকটা জানে অনেক কিছু। ও বাই দ্য ওয়ে মুকুট, প্রকাশকে ফোনটা দে। প্রকাশ তুমি নম্বরের নাড়ি নক্ষত্রের খবর নিয়ে তাড়াতাড়ি জানাও।”

“ওকে সাহেব। আর আমি আপনাকে তুলে নিয়ে যাবো এই ধরুন সোয়া সাতটা নাগাদ।”

“হাইজ্যাক করবে বলছো?” বলে সবুজ সেন হো হো করে হেসে উঠলেন।

 

সাতটার সময় সবুজ সেন আর মুকুট তৈরি হবে বলে সবে উঠেছে তখন ফোনটা বেজে উঠল।

স্ক্রিনে প্রকাশের নম্বর দেখে ফোনটা ধরলেন সবুজ সেন, “হুঁ বলো প্রকাশ।”

“সাহেব, জুলকি অনেক খবর এনেছে। আমার চেম্বারে বসে আছে। আপনি সামনাসামনি কথা বলবেন? জুলকি আপনাকে মিট করতে চায়।”

“বেশ, শোনো, তবে আমার এখানে আসার দরকার নেই তোমাদের। আমি আর মুকুট পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরোচ্ছি। তোমার ওখানে গিয়ে জুলকির সাথে কথা বলে বিজনেস ম্যাগনেটের ডেরায় যাবো।”

“ওকে সাহেব।”

নীলগঞ্জ থানার মেন বিল্ডিংয়ের পাশে প্রকাশ ছেত্রীর অফিস বিল্ডিং। হালকা নীল রং করা। ঢুকতে ঢুকতে মুকুট চাপা স্বরে বলল, “কাকু, তুমি খেয়াল করেছিলে যে আমাদের গাড়িটাকে একটা সাদা রঙের লোগান ফলো করছিলো?”

“হুঁ। তুই গাড়ির ভেতরে কে ছিল দেখতে পেয়েছিস?”

“না তো।”

“একজন বয়স্ক মহিলা।”

“মহিলা?” মুকুট গোল গোল চোখ করে কাকুর দিকে তাকিয়ে আছে।

“প্রসিড ভাইপো।” মুচকি হেসে প্রকাশের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

 

“জুলকি বসো ওখানে।” সবুজ সাহেব আসাতে জুলকি টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সবুজ সাহেব বসতে বলাতে পাশের টুলে বসে পড়লো।

“বলো কী খবর?”

“খবর হেব্বি গরম স্যার।” বিড়ি খাওয়া কালো পুরু ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জুলকি বলল।

“কীরকম?”

“শীলভদ্র মাকড়াটা... সরি স্যার!” জুলকি বলেই জিভ কেটে উঠে দাঁড়াল। প্রকাশ বলে উঠলো, “জুলকি... মুখটাকে সামলে!”

“আরে ঠিক আছে। ওর ওই মধুর ভাষা না বেরোতে দিলে খবরটাও ঠিকঠাক বেরোবে না।” সবুজ সাহেব মুচকি হাসলেন।

“স্যার, তো শীলভদ্র মাকড়াটা অফিসের ভেতরে ঢোকার ধরুন কুড়ি মিনিট বাদে বাইক করে দুটো লোক ঢুকলো। একজন মনে হল শীলভদ্রের চামচা। আর একজনের হেলমেট ছিল বলে চিনতে পারলাম না। কিন্তু শীলভদ্রের অফিস বিল্ডিংয়ের পাশের রাস্তায় একটা গ্রে রঙের আই-টেন দাঁড়িয়েছিল। ওরা ঢোকার সাথে সাথে গাড়িটা সামনে এসে দাঁড়ালো। কেউ কাঁচটা নামিয়ে দেখে আবার স্টার্ট দিল।”

“সে কী ছেলে না মেয়ে?”

“ঠিক বুঝলাম না তবে মনে হলো একজন লোক।”

“আর কী খবর?”

“স্যার, শীলভদ্রের যে দারোয়ানটা আছে তার সাথে ভাব জমিয়ে,বিড়ি খাওয়ার পয়সা দিয়ে গল্প করে জানলাম যে কয়েকদিন আগে ফুলটুস দেখতে এক শুড্ডা মালিকের কাছে এসেছিল। ঘরে কী কথা হয়েছে জানে না কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে ফোনে কথা বলতে বলতে শুড্ডাটা বাইরে এসেছিল। তখন দারোয়ানটার কিছু কথা কানে এসেছিল।

“ভীষ্ম, আমি যা বলছি সেইমতো চলো। সবকিছু কি ম্যাজিক?”

.................

“না, খেলিয়ে তুলতে সময় লাগবে। বুড়োকে ফোন করেছিলে?”

......................

“আচ্ছা। এদিকটা আমি দেখছি। রাতে এস একবার…”

.................

“রবিনের সাথে কথা হল। দেখা যাক। ওই কথা রইলো তবে।”

এরপর ফোনটা কেটে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।”

“আচ্ছা জুলকি তুমি এই স্পেশাল ভাষাগুলো কোথা থেকে আমদানি করেছ বলতো?” প্রকাশ মুচকি হেসে বলল।

সাহেব ভুরু কুঁচকে হাত নেড়ে প্রকাশকে থামতে বলল।

“জুলকি তুমি খুব ইম্পরট্যান্ট খবর দিলে। আচ্ছা ওই লোকদুটো কখন বেরোলো নজর করেছিলে?” সবুজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ, স্যার। লোকদুটো বেরিয়ে হাওড়া শিবপুর ট্রামডিপোর কাছে একটা গলিতে ঢুকে যায়। আমার একটা চামচা আছে। স্যার ওকে বলেছিলাম ওই মাকড়া দুটোকে ফলো করতে। ওরাই খবরটা দেয়।”

“হুঁ… জুলকি, তোমার ঐ চামচাকে বলো ট্রাম ডিপোর কাছাকাছি থাকতে। ওই গলি দিয়ে কোথায় যাচ্ছে বা কার কাছে যাচ্ছে সেই খবর চাই।”

“প্রকাশ ডাক্তারের বাড়িতে কাউকে ফিট করো। শামসুল আছে না?”

“হ্যাঁ সাহেব। এখনই ব্যবস্থা করছি। আর জুলকি কী করবে?” প্রকাশ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলো।

“জুলকি যেমন নজর রাখছে সেরকমই রাখুক। ওকে, জুলকি এখন তুমি যাও।”

“কাকু, এ তো ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে!” মুকুট চিন্তিত হয়ে বলল।

“নাটক জমে উঠেছে ভাইপো। আমার এরকমই কিছু সন্দেহ হচ্ছিল। অ্যানি ওয়ে, চলো ওঠা যাক। ভাইপো চলো।”

 

এমিলি হাতে একটা কালো ব্যাগ নিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে। মুখটা কঠিন হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, এখনই কপালের শিরাগুলো ফেটে যাবে।

“ম্যাডাম, চলুন। শেখর এসে গেছে।” আরশাদ ভেতরে ঢুকে ভয়ে ভয়ে এমিলির দিকে তাকিয়ে বলল।

এমিলি কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ল। আরশাদ সামনে আর পেছনে এমিলি।

“কোথায় যাব আরশাদ ভাই?” শেখর জিজ্ঞেস করলো।

“যাদবপুর।”

“ম্যাডাম ফোনটা কখন এসেছে?”

“ভোর বেলা।”

“ভীষ্ম চৌধুরী খুব চেনা চেনা লাগছে। একটা ব্যাপার, আপনার নম্বর পেলো কীভাবে?”

“আমারো তাই প্রশ্ন। শোনো আমার দলের যদি কেউ গদ্দারী করে তার বুকে শুধু দুটো গুলি। ব্যস!” একটা ধূর্ত হাসি হাসল ম্যাডাম। “আরশাদ, ওই টিকটিকি আর পুলিশ ফিল্ডে নেমেছে। প্রতিটা স্টেপ হিসেব করে চলবে।”

“নামুক ম্যাডাম। চিন্তা করবেন না। কিন্তু এই ভীষ্ম দুই জায়গায় খেলছে নাতো?” আরশাদ একটু চিন্তিত হয়ে বলল।

“দুই জায়গা বলতে?”

“ম্যাডাম, ভীষ্ম একদিকে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছে আবার ডাক্তারের বাড়ির সাথেও কোনো ডিল চালাচ্ছে!”

“আরশাদ, ডাক্তার এখন আর বেঁচে নেই।”

“বেঁচে নেইতো কী হয়েছে? ডাক্তারের এক ভাগ্নে উদয় হয়েছে না!”

“ওহ ইয়েস।”এমিলিকে চিন্তিত দেখালো।

 

“নমস্কার শীলভদ্রবাবু। থানা থেকে এসেছি। উনি প্রাইভেট গোয়েন্দা সবুজ সেন আর ওনার সঙ্গী মুকুট।” প্রকাশ দারোয়ানকে দিয়ে স্লিপ পাঠিয়ে শীলভদ্রের চেম্বারে ঢুকে পরিচয় দিল।

“হুঁ, বসুন বসুন। কী নেবেন বলুন। ঠান্ডা না গরম?” শীলভদ্র অতি বিনয়ের সাথে কথাগুলো বলল।

“গরম নেবো না একটু গরম আপনাকে দিতে পারি।” সবুজ সেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শীলভদ্রকে দেখছেন।

“মানে?”

“না কিছু না। যাক, শীলভদ্রবাবু এবার বলুন, ডাক্তার অনুময় ঘোষকে কতদিন চেনেন?”

“আগে চিনতাম না। এই ফ্ল্যাটের জন্য চেনা পরিচয় হয়েছে।”

“কীভাবে যোগাযোগটা হলো?” পরের প্রশ্ন করলেন সবুজ সাহেব।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শীলভদ্র বলল, “ডাক্তারবাবুর কম্পাউন্ডার নৈঋত দাস যোগাযোগ করিয়েছে। ডাক্তারবাবু জমি বাড়ি প্রমোটারকে দিয়ে ফ্ল্যাট বানাবেন বলেছিলেন তাই নৈঋত আমার কথা বলেছিল।”

“বেশ। আচ্ছা, কলকাতা শহরে এত প্রোমোটার থাকতে হঠাৎ আপনার কাছে আসার কারণ?”

“নৈঋত আমার বন্ধু। তাই বোধহয়।”

“বোধহয়...!”

“শীলভদ্রবাবু, যেদিন ডাক্তারবাবু খুন হন সেদিন ওই সময় ডাক্তারবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন?”

শীলভদ্র এসি ঘরে বসেও ঘামতে শুরু করেছে। “হ্যাঁ মানে... ডাক্তারবাবু আটটা নাগাদ যেতে বলেছিলেন।”

“আচ্ছা... ডাক্তারবাবু যেতে বলেছিলেন না আপনি যেতে চেয়েছিলেন?”

“ওই আর কি।”

“দুটো তো এক নয় প্রোমোটার সাহেব। বলুন, আপনি কেন যেতে চেয়েছিলেন?”

“ওই, ফ্ল্যাটের ব্যাপারে কথা বলার জন্য।”

“রাতে কেন?”

“দিনের বেলা উনি রুগী দেখতেন। সময় দিতে পারতেন না। তাই...”

“ওনার সাথে কততে ডিল হয়েছিল?”

“এই জমি বাড়ি মিলিয়ে দুই কোটি আর একটা বড় ফ্লাট,নিচে চেম্বার ঘর আর গ্যারেজ।”

“বাহ বেশ। তা কাজ শুরু করেছেন?”

“না, শুরু করবো বলে কাগজপত্র রেডি করছিলাম। তখন খবর পেলাম ওই জমি বাড়ির আর একজন অংশীদার আছে। ডাক্তারবাবুর দিদি।”

“এটা কেমন হলো? ডাক্তারবাবুর দিদি একজন অংশীদার আর নেগোশিয়েশনের এর সময় এটা জানতেন না? না জেনে কীভাবে এগোলেন?

“স্যার, ডাক্তারবাবু দিদির ব্যাপার আমায় কিছু বলেননি।”

“তবে কে বলল আপনাকে?”

একটু চুপ করে থেকে শীলভদ্র বলল, “গত রবিবার সকালবেলা এক সুদর্শন ভদ্রলোক, নাম রাজসিংহ চৌধুরী এসেছিলেন। তিনি ডাক্তারবাবুর ভাগ্নে। তার কাছ থেকে সব শুনলাম।”

“শুনে ডাক্তারবাবুর কাছে যাননি? ব্যাপারটা সত্যি কি-না জানতে।”

একটু ইতস্তত করে শীলভদ্র বলল, “যাবো বলেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলাম। রাত আটটা নাগাদ ঠিক হয়েছিল। কিন্তু...” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শীলভদ্র।

“এই খুনের ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়? অর্থাৎ কেন ডাক্তার খুন হলেন বা কে খুন করতে পারে এইসব।”

“দেখুন কেন খুন হলেন আমি কী করে বলব। আমার সাথে খুব অল্প কয়েক মাসের চেনা জানা। ওনার শত্রু কেউ যদি থাকে...!”

“শত্রু বলতে?”

“না না বলছি শত্রু যদি থাকে আমার তা জানা নেই।”

“হুঁ... শীলভদ্রবাবু সঠিক জবাব দিচ্ছেন না। ওকে আমি সত্যিটা ঠিক জেনে নেব। বাই দ্য ওয়ে কলকাতায় কেন গিয়েছিলেন?”

“ম মা মানে? আপনাকে কে বলল আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম ?” একটা ভয় মিশ্রিত বিরক্তি ঝরে পড়ল গলা দিয়ে।

“আমাকে যে সব জানতে হয়! বলুন। অবশ্য সত্যিটা বলবেন না ধরে নিয়েই জিজ্ঞেস করছি।”

“আমার বিজনেসের কাজে গেছিলাম।”

“ওও বিজনেস! তা কীসের বিজনেস আপনার?”

“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই কীসের বিজনেস?” জোর গলায় বলে উঠল শীলভদ্র।

“চ্যাঁচাবেন না। প্রশ্নের উত্তর দিন।” সবুজ সেনের কঠিন স্বরে মুকুট, প্রকাশ চমকে উঠলো এবং অবশ্যই শীলভদ্র পালিতও।

“আমি প্রমোটিঙের বিজনেসের সাথে যুক্ত। আমার নাম এই তল্লাট কেন কলকাতায়ও বিখ্যাত। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।”

সবুজ সাহেব কড়া চোখে শীলভদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। শীলভদ্র চুপ হয়ে আছে।

“তাই কি শীলভদ্রবাবু? পুরোনো এন্টিক মূর্তি আপনি বিদেশে পাচার করেন না?”

শীলভদ্রের পিঠ দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে। চোখ লাল করে সাহেবের দিকে তাকিয়ে হিসহিসে গলায় বলল,”মিস্টার সেন, শুধু শুধু আমার নামে মিথ্যে কথা বলবেন না। জেনে রাখুন আমারো তিনটে চোখ আছে।”

“আমার চারটে চোখ আছে মিস্টার পালিত...” চাপা স্বরে সবুজ সাহেব বলে উঠে পড়লেন। দরজা দিয়ে প্রকাশ, সবুজ সেন আর মুকুট বেরিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে কানে এলো শীলভদ্র কাউকে বলছে, “বহুত বেড়েছে বুড়ো টিকটিকিটা। বললেই....” আর শুনতে পেলো না মুকুট। ভয়ে অবসন্ন লাগল মুকুটের।

সারা পথে সবুজ সেন চুপ হয়ে আছেন। গভীর ভাবে কী যেন ভেবে চলেছেন। প্রকাশ আর মুকুট মুখ চাওয়াচায়ি করে বাইরে দেখতে দেখতে যাচ্ছে।

“মুকুট তোকে নামিয়ে আমি নামবো। তারপর প্রকাশ তুমি চলে যেও।”

“কাকু আজ আমি মাকে বলে এসেছি তোমার ওখানে থাকবো।”

“বেশ। প্রকাশ বাকি খবরগুলোর কী হল?”

“সাহেব কাল জানাতে পারবো।”

“ওকে।”

 

প্রকাশ থানায় ওর নিজস্ব রুমে ঢুকতেই অফিসার আশীষ ঘোষ ঢুকলো।

“স্যার, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ। শিমাই খবর এনেছে। আপনাকেই বলতো কিন্তু আপনি না থাকায় আমাকে বলেছে।”

“বলুন। এক মিনিট।” বলে বেল বাজিয়ে ঘনশ্যমকে দু কাপ কফি আর স্যান্ডউইচ অর্ডার দিয়ে আশীষের দিকে তাকালো।

“আপনি আজ বাড়ি যাবেন না?”

“দেখি।” অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল প্রকাশ।

“স্যার, শিমাইয়ের কথা অনুযায়ী সাদা রঙের লোগান শিবপুর থেকে যাদবপুর সেন্ট্রাল পার্কের কাছে পার্ক করে একজন বৃদ্ধা মহিলা আর একজন চল্লিশ বিয়াল্লিশ এর লোক পাশের একটা গলিতে পাঁচতলা ফ্ল্যাটে গেল। লোকটার নাম আরশাদ কিন্তু বুড়ীটার নাম জানতে পারেনি। ঘন্টা খানেক বাদে বেরিয়ে এসেছে। বুড়ি মহিলা ফোনে কাউকে বলতে বলতে নামছিল, “রাত দুটোয় অপারেশন।” তবে সেটা শিমাইয়ের মনে হলো বৃহস্পতিবার। ও খবরটা সঠিক নেবার চেষ্টা করছে। লোগান আবার ওদের নিয়ে শিবপুর ট্রামডিপোর কাছে রাজীব চপের গলির ভেতর একটা দোতলা বাড়িতে দাঁড়াল। ওই বুড়ি আর আরশাদ নামের লোকটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো। আর একটা ইনফরমেশন দিলো এবং আমার মনে হলো এটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।” এতক্ষণ বলে আশীষ থামল।

“বলুন।”

“ওদের গাড়ির পেছনে বড় বড় অনেকগুলো প্যাকিং বাক্স দুটো অল্পবয়সী ছেলে তুলে দিল।”

“হুঁ... সাহেবকে জানাচ্ছি ওনার মত নিয়ে ফোর্স রেডি করতে বলবো।”

“ওকে স্যার, আমি এখন আসছি তবে।”

“এক মিনিট। আশীষবাবু, কাল আটটার সময় নৈঋত মানে ডাক্তার অনুময় ঘোষের কম্পাউন্ডার এখানে আসবে। সাহেব আসবে। আপনি কাছাকাছি থাকবেন।”

“ওকে স্যার।”

“আসুন এখন।”

প্রকাশ একটা অদ্ভুত দোলাচলে রয়েছে। প্রথমত, সাহেব জানলেন কী করে যে শীলভদ্র প্রমোটারির পেছনে এত বড় জঘন্য কাজের সাথে লিপ্ত আছে! দ্বিতীয়ত, এন্টিক মূর্তি বিদেশে পাচারের ব্যাপার যদি হয় তবে তো এদের বড় গ্যাং রয়েছে। তবে সাহেব যখন দায়িত্ব নিয়েছেন তখন কিছুটা শ্বাস ফেলা যায়। এদিকে ‘রাজসিংহ চৌধুরী কেস’-টা কেমন ফিসি লাগছে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। একটা বিষয় খটকা লাগছে যে দিদি আছে অথচ ডাক্তার সেটা চেপে গেল!! আর এই যে ডাক্তারকে খুন করা হল এটা শুধুই জমি বাড়ির কাজিয়ার কারণে না এর পেছনে অন্য কোনো গুহ্য রহস্য আছে!! প্রকাশ হাতটা কপালে দিয়ে পুরো ঘটনাটা কে বিশ্লেষণ করছে। একটা নিশ্চিন্তি যে মাথার ওপরে সবুজ সেন আছেন।

ভোর ছটা হবে। ডোর বেল বেজে উঠলো। সবুজ সেন ব্যায়াম সেরে স্নান করে ওনার পেটেন্ট চেয়ারে বসেছেন সবে। মুকুটও উঠেছে। সবুজ সেনের কাজের লোক নয়ন খবরের কাগজ এনে চা করছে।

“মুকুট দ্যাখ তো এই সময় কে এলো? আই হোল দিয়ে দেখে নিবি।”

মুকুট আই হোলে চোখ রেখে একজন অপরিচিত লোককে দেখতে পেল। কাকুকে বলাতে ওনার অনুমতিতে দরজা খুলল। একজন এই বছর ত্রিশের, হাইট আন্দাজ পাঁচ ফুট সাত আট হবে, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখদুটো ভাষাভাষা, সব মিলিয়ে স্মার্ট লুকিং ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।

“মিস্টার সবুজ সেন আছেন?” অত্যন্ত পরিশীলিত ভয়েসে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ আছেন। আপনি কোথা থেকে আসছেন?”

“স্যারকে বলুন আমি নৈঋত দাস। ডাক্তার অনুময় ঘোষের কম্পাউন্ডার।”

নামটা শুনে মুকুটের শরীর টানটান হয়ে গেল। এর তো প্রকাশ আঙ্কেলের রুমে আটটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। এখানে এত ভোরে...!

“আসুন আসুন নৈঋতবাবু। ভেতরে এসে বসুন।”

পেছন থেকে কাকুর গলায় চমকে উঠল মুকুট। দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। একটা ফাঁকা চেয়ারে নৈঋত বসল। মুকুট কাকুর পাশে একটা টুলে বসলো আর সবুজ সাহেব তার চেয়ারে।

“বলুন, কী এমন ঘটল যে এত ভোরে এখানে আপনার পদধূলি পড়লো?” সবুজ সাহেব তাঁর একপেশে মৃদু হাসি দিয়ে নৈঋতকে বললেন।

“দেখুন স্যার, আমি থানা ফানায়ে যাবো না। আপনার যা জিজ্ঞাস্য আছে এখানে নিরিবিলিতে করুন। যা জানি উত্তর দেব। বাট নট ইন পুলিশ কাস্টডি।”

“হুঁ... আপনি কবে থেকে ডাক্তারবাবুর কম্পাউন্ডারি করছেন?” সবুজ সাহেব মোবাইলটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলেন।

“একবছর।”

“ডাক্তারবাবু মানুষ কেমন ছিলেন?”

“এমন মালিক হয় না। খুব সিমপ্যাথেটিক। আর সবচেয়ে বড় কথা হল এমন মানুষ খুব কম দেখা যায়।”

“রিয়েলি! তবে ওনাকে খুন হতে হল কেন নৈঋতবাবু?” সবুজ সাহেব কথাটা বলেই কঠোর দৃষ্টিতে নৈঋত এর দিকে তাকালেন।

“ম ম মানে?? তার আ আমি কী জানি?” আচমকা এই প্রশ্নে নৈঋত থতমত খেয়ে গেল।

“না, শুনলাম আপনি ওনার খুব কাছের লোক ছিলেন তাই জিজ্ঞেস করলাম। অ্যানি ওয়ে এক বছরের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন যে ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার আপনার সাথে আলোচনা করতেন!”

“কার সাথে কতদিনে কে কতটা ঘনিষ্ঠ হবে সেটা কি আইন মেপে হয় স্যার?” নৈঋত কথাটা বেশ চাপা গলায় বলল।

“তা তো বটেই। আচ্ছা নৈঋতবাবু...” হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতে স্ক্রিনে প্রকাশের নাম দেখে সবুজ সেন মুকুটের হাতে চালান করে দিলেন। মুকুট ফোন নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

“হ্যাঁ, নৈঋতবাবু, ডাক্তারবাবু ওনার বাড়ি জমি প্রোমোটারকে দেবার ব্যাপারে আপনার সাথে আলোচনা করেছিলেন?”

“হ্যাঁ। একদিন আমায় ডেকে ওনার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। তখন আমি শীলভদ্র পালিতের নাম বলি। উনি সম্মত হওয়াতে আমিই যোগাযোগ করিয়ে দি। কথাবার্তা বেশ এগোলো।কিন্তু কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল।” নৈঋত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“শীলভদ্রের সাথে কতদিনের আলাপ?”

“এই একবছর হবে।”

“ও বাবা, এই এক বছরের আলাপে আপনি এত বড় নেগোশিয়েশন করিয়ে দিলেন? উনি কেমন লোক জানলেন না?”

“স্যার, এক বছর সময় একজন মানুষকে জানার জন্য যথেষ্ট নয় কি? আর আপনার মনে হল কেন যে আমি না জেনে এত বড় ঝুঁকি নিয়েছি?”

একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবুজ সাহেব বললেন,”সারাজীবনেও মানুষ চেনা যায় না আর এক বছরে!”

“যাই হোক, শুনুন একটা কথা বলি চুপিচুপি, শীলভদ্র সম্পর্কে একটু খোঁজ করুন। সুবিধের লোক বলে মনে হচ্ছে না।” একটা হালকা টোপ ফেললেন সবুজ সাহেব।

“সে কি? কী বলছেন? স্যার আমিতো খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছি। চমৎকার মানুষ।”

“ওও আচ্ছা। বেশ, বেশ। আচ্ছা এবার বলুন তো নৈঋতবাবু, ঘটনার দিন সকালে ঠিক কী কী হয়েছিল? ভেবে বলুন।”

“ওইদিন আমি আগে এসে চেম্বার খুলে গুছিয়ে রাখলাম।তারপর কাজের লোক ঘর ঝেড়ে মুছে চলে গেল। ততক্ষণে রুগী আসতে শুরু করেছে। আমি নাম লিখতে শুরু করলাম। তার কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তারবাবু ওপর থেকে নেমে রুগীদের ডাকতে বললেন। যথা নিয়মে রুগীরা গেল। হঠাৎ চারজন দেখার পর আমাকে বললেন যে আর দেখবেন না। ওনার খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি বললাম আর একজন আছেন। তখন তাকে ডাকতে বললেন। শেষ ভদ্রলোক যাওয়ার খানিক পরে ভেতর থেকে উচ্চ স্বরে বাদানুবাদ শোনা যেতে লাগল। আমি তখন দৌড়ে ভেতরে ঢুকে দেখি ডাক্তারবাবু খুব উত্তেজিত। ডাক্তারবাবু হাতের ইশারায় জল চাইলেন। আমি ওনার শরীর খারাপ লাগছে দেখে রামেশ্বরকে ডেকে ওনাকে দোতলায় নিয়ে যেতে বলি।” এই বলে নৈঋত চুপ করল।

“আর ওই পাঁচ নম্বর পেশেন্ট তখনো ঘরের ভেতর ছিল?”

“মনে হয় চলে গিয়েছিল। আমি স্যার কে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে খেয়াল করিনি।”

“হুঁ... ওই পেশেন্টের নাম কী ছিল?”

সবুজ সেনেরই প্রশ্নে নৈঋত চমকে উঠল।

“ঠিক মনে পড়ছে না।”

“বেশ। আমি বলি? ভীষ্ম চৌধুরী। ঠিক বললাম?” একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মধ্যে চাপা হাসি লুকিয়ে সেন সাহেব বললেন।

“বললাম তো স্যার, মনে পড়ছে না।”

“নৈঋতবাবু এবার বলুন তো ডাক্তার অনুময় ঘোষের দিদির ব্যাপারটা আপনি জানতেন না?”

“আমি! ডাক্তারবাবু আমাকে কিছুই বলেননি।”

“দলিলে উল্লেখ ছিল না কিছু? নেগোশিয়েশনের সময় দেখেননি?”

“আমি শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলাম।”

“তাই? তা আপনার পার্সেন্টেজ কত ছিল?” সবুজ সাহেব প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নৈঋতকে লক্ষ করতে থাকলেন।

“কী যা তা বলছেন? পার্সেন্টেজ? কীসের? আমি ডাক্তারবাবুর হিতৈষী ছিলাম। যেটুকু করেছি ভালোবাসার খাতিরে।” ভুরু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে নৈঋত বলল।

“ওকে, ছাড়ুন এসব কথা। একটা ব্যাপার আমার মিলছে না। শুধু বাড়ি জমির কারণে ডাক্তারবাবুর মৃত্যু হল কী করে? এর পেছনে আর কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”

“আপনার অঙ্ক কেন মিলছে না সে আমি বলবো কেমন করে? আর ওনার মৃত্যুর পেছনে আপনি কি আমায় দায়ী করছেন?”

“না, না, এখনই কিছু না জেনে আপনাকে দায়ী করি কী করে? আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করার আছে। আপনি রাজসিংহ চৌধুরী বলে কাউকে চেনেন?”

মুহূর্ত খানেকের নিস্তব্ধতা।

“না, চিনি না।”

সবুজ সেন মাথাটা ঝাঁকিয়ে নৈঋত এর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।

“স্যার, আপনার ইন্টারোগেশন শেষ হয়েছে? এখন আসতে পারি?”

“অবশ্যই পারেন। তবে মৃত্যু রহস্যের কিনারা না হওয়া অবধি অন্য কোথাও যাবেন না।”

নৈঋত একটা চোরা চাহনি দিয়ে সাহেবকে দেখে উঠে পড়ল।

নৈঋত চলে যাবার পর মুকুট দরজা দিয়ে কাকুর সামনে এসে বসল, “কাকু, প্রকাশ আঙ্কেল আসবে বলছিল। আমার মুখে নৈঋত দাস এসেছে শুনে বললো চলে গেলে জানাতে। আমি মেসেজ করে দিলাম তাই আঙ্কেল দশ মিনিটের মধ্যে আসছে বলল।”

“ঠিক আছে। ভেবেছিলাম থানায় যাবো। সেটার আর দরকার নেই।” সবুজ সেন বললেন।

এমন সময় সবুজ সাহেবের ফোনটা বেজে উঠল। আননোন নাম্বার দেখে মুকুটকে দিতে গিয়ে কী ভেবে নিজে ধরলেন। “ইয়েস, সবুজ সেন স্পিকিং।”

“অনেক তো হলো স্যার, অনেকদূর এগোলেন। এবার থামার সময় এসেছে। তাই অধম একটু স্মরণ করিয়ে দিল।”

“আপনি যেই হোন একটা কথা শুনে রাখুন, সবুজ সেন থামতে জানে না। সুতরাং...”

“সুতরাং, প্রস্তুত থাকুন আল্টিমেট ডেস্টিনেশনে যাবার জন্য।” ফোনটা কেটে গেল।

“মুকুট প্রকাশ এসে চলে গেলে বেরোবো। তুই বাড়িতেই থাকবি। ফোনটা রেখে যাচ্ছি। তুই সব কল রিসিভ করে লিখে রাখবি।”

“কার ফোন এসেছিল কাকু? হুমকি?” মুকুট উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

“আমার হিতৈষীর। একটু কড়কে দিলো। সে তো করতেই পারে। আফটার অল ফ্রেন্ড তো।” মুচকি হাসলেন সবুজ সাহেব।

“কাকু তুমি ফোন না নিয়ে গেলে যোগাযোগ করবো কীভাবে?”

“তোকে করতে হবে না। আমি প্রয়োজনে করব।”

মুকুট কিছুটা বিমর্ষ হয়ে ‘আচ্ছা’ বলল।

 

প্রকাশ ছেত্রীকে বসতে বলে কাকুকে খবর দিলো মুকুট। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবুজ সেন তৈরি হয়ে বাইরের ঘরে এলেন।

“প্রকাশ, বলো তোমার জরুরি খবর।”

“সাহেব, আপনার কথামতো ডাক্তারের ফোন কলগুলো সার্চ করেছি। মৃত্যুর আগের রাতে দশটা চব্বিশ নাগাদ রাজসিংহ চৌধুরীর ফোন এসেছিল। এছাড়া নৈঋত দাসের নম্বর আছে আর শীলভদ্র পালিতের নম্বরও আছে। কিন্তু সব ইন কামিং। আউট গোয়িং নেই কিছু। কিন্তু...”

“কিন্তু?” ভুরুটা ওপরে তুলে সবুজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

“উনি ব্যাংক থেকে কয়েক দফায় কুড়ি লাখটাকা তুলেছেন। ব্যাংক থেকে ফোনে মেসেজ এসেছে। কিন্তু এটা সম্ভব হলো কী করে? তবে কি উনি কাউকে তুলতে বলেছিলেন?” প্রকাশকে চিন্তিত দেখালো।

“দেখি মেসেজটা।” সবুজ সাহেব মেসেজটা পড়তে পড়তে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

“প্রকাশ, উনি উইথড্রয়াল ফর্মে সই করে এতটাকা তোলালেন? নাকি এ.টি.এম থেকে তোলানো হয়েছে? কিন্তু ওনার খুন হবার পরও টাকা তোলা হয়েছে দেখছি। উঁহু প্রকাশ পুরো ব্যাপারটা জাল মনে হচ্ছে।”

“সে কি সাহেব? হাও ইজ ইট পসিবল?”

“পসিবল যদি সই জাল করা হয়। এবং ইফ আই এম নট রং, সই জাল হয়েছে। শোনো, এস.বি.আই নীলগঞ্জ ব্রাঞ্চের ম্যানেজার কে জানো?”

“হ্যাঁ, সাহেব, প্রণব পোদ্দার।”

“ওও প্রণব? আমি চিনি। ও এখন ওখানকার ম্যানেজার? ওকে, একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। আমি যাবো।”

“ওকে সাহেব। আমি ব্যবস্থা করে আপনাকে জানাচ্ছি।”

“আমি বেরোচ্ছি প্রকাশ। তুমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে মুকুটকে জানিয়ে দিও। আমি জেনে যাবো।”

এমিলির বেডরুমের ভেতরে আর একটা বড় ঘর আছে। সেখানে আরশাদ আর রাজেন বসে মাল এক্সপোর্ট করার প্ল্যান চেক আউট করছিল। পুলিশ সন্দেহ করতে শুরু করেছে এটা ওরা টের পেয়েছে। আর শুধু পুলিশ হলে হতো পেছনে যে আরো বাঘা টিকটিকি লেগেছে সেটাই বড় সমস্যা হয়েছে। এখন ওদের আর একটা মস্ত বড় কাজ রামেশ্বরকে সরানো। ভালো কথায় দেশে পাঠাতে হবে নয়তো...

“নমস্কার ম্যাডাম আমি রাজসিংহ চৌধুরী।” এমিলির ড্রইং রুমে বসে কথা হচ্ছে।

“ও, আই সি। আপনি রাজসিংহবাবু।” এমিলি একটু হেসে বলল।

“ফোনে যা বলেছিলাম সেই মতো প্ল্যান করেছি। কিন্তু আপনার সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হচ্ছিল না। তাই আলোচনা করতে পারছিলাম না।” রাজসিংহ চৌধুরী গমগমে স্বরে বলল।

“সরাসরি কাজের কথায় আসা যাক।” এমিলি কুটিল হাসি হেসে বলল।

“হ্যাঁ, অবশ্যই, আমিও তাই চাই।”

“ডাক্তারের সিন্দুকের মালের খবর কী?”

“এখনো অবধি সেখানেই আছে। একটা ব্যাপার আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার। রবিনের সাথে আমার কাজের কমিশনের ফিক্সড রেট আছে। তার কমে কাজ করি না। আর এখানে তো রিস্ক আছে।”

“প্রথম কথা আপনি রবিন কে চেনেন?”

“হ্যাঁ, চিনি। তবে সব কাজ লোক মারফত হয়।”

“আচ্ছা। নেক্সট হলো, ডাক্তার তো ফিনিশ। সেক্ষেত্রে রিস্ক কোথায়?”

“আছে ম্যাডাম। ওই বাড়ি এখন পুলিশের নজরে আছে। আর ডাক্তারের এক কাজের লোক আছে। তাকে কব্জা করাও কষ্টকর মনে হচ্ছে।”

“হুঁ... প্রয়োজনে সেই লোক কে শেষ করে দিতে হবে।”

“প্রয়োজন হলে হবে। কিন্তু আমি কাজ করবো আমার মতো করে। আর আপনি ঠিক সময় মাল পেয়ে যাবেন।”

“ওকে। আর আপনি ডাক্তার ঘোষের কাছে যে মূর্তি আছে সেটা জানলেন কীভাবে?”

“এটা আমার প্রফেশনাল সিক্রেট। বলা যাবে না।”

ঘরের ভেতরে যখন এই কথা চলছিল তখন বাইরে দুটো ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। রাজসিংহ চোধুরী যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ছায়ামূর্তি দুটো সরে গেল।

 

গত তিনদিন ধরে সবুজ সেন সকালে বেরিয়ে ফিরেছেন রাত্তিরে। আজ বিকেলে কাকুর তলবে মুকুট এসেছে। প্রকাশও এসেছে।

“কাকু, মনে হচ্ছে অনেক দূর এগিয়েছ। একটু কিছু বলবে?”

“তিষ্ঠ বৎস, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এতদিন মনে হচ্ছিল, আলোর রশ্মিটা অনেক দূরে। ছুঁতে চাইছি কিন্তু অন্ধকারে এলোপাথাড়ি সাঁতরে যাচ্ছি,সঠিক ভাবে ছুঁতে পাচ্ছি না। এখন মনে হচ্ছে, আলোক রশ্মি ছোঁয়ার পথ আপনি এসে ধরা দিচ্ছে।” বলে মুকুটের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন। তারপর মুকুটের পিঠ চাপড়ে প্রকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,” প্রকাশ, ফোর্স রেডি?”

“ইয়েস সাহেব। এবার শুধু আপনার আদেশের অপেক্ষায়।”

“ওকে। মুকুট আজ রাতে আমাদের গ্র্যান্ড অপারেশন। বাড়িতে বলে দে, আজ ফিরছিস না।”

“ঠিক আছে কাকু। আমার একটা ব্যাপার জানার কৌতূহল হচ্ছে। উত্তর দেবে?” মুকুট জিজ্ঞেস করলো।

“বল।”

“আচ্ছা টাকা তোলার ব্যাপারটা কী হলো?”

মুচকি হেসে মুকুটের দিকে তাকিয়ে সবুজ সাহেব বললেন, “ভাইপো, বিরাট চক্র বুঝলে, গভীর জাল। যা এখন একটু রেস্ট নিয়ে নে।”

মুকুট বুঝলো এর চেয়ে একটা শব্দ বেশি বের হবে না এখন কাকুর মুখ থেকে। ও পাশের ঘরে চলে গেল।

 

রাত তিনটে। চরাচর ঘুমের আরকে ডুবে আছে। এত বড় বাড়িটা ভূতের বাড়ির মতো নিঝুম। নিঃশব্দে দুটো মানুষ সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছতে পৌঁছতে নীচে সিঁড়ির মুখে আরো দুজনকে দেখা গেল। ওপরের দুটো মানুষ সেগুন কাঠের দরজার লক খুলে ঘরে ঢুকল। অতি সন্তর্পনে হাতের সরু পয়েন্টেড টর্চটা জ্বালাল। পা টিপে টিপে ধীরে ধীরে বড় আলমারির পাল্লাটা খুলে একজন ভেতরে ঢুকে গেল। একজন বাইরে দাঁড়িয়ে। মিনিট দশ বাদে বড় ত্রিপলের কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসে আলমারির পাল্লাটা বন্ধ করতেই ঘরের মধ্যে অন্য দুজন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটল।

“বাহ, বাহ, নাটকটা তো দারুণ জমিয়েছেন শীলভদ্রবাবু!!”

“ক কে কে? কে আপনি?” চকিতে চমকে উঠে শীলভদ্র পালিত পেছন ফিরে তাকিয়ে রিভলভার তাক করে আগন্তুকের দিকে তাকাল।

“আপনার যমদূত। অনেক খেলা খেলেছেন। এবার যে বিশ্রাম নিতে হবে প্রোমোটার সাহেব।” কথা বলতে বলতে মোটা গোঁফ আর পরচুলা খুলে ফেললেন সবুজ সেন। মুকুট ঘরের আলো জ্বেলে দিল।

শীলভদ্র পালিতের সঙ্গী ধীরে ধীরে পেছন হেঁটে দরজার দিকে যেতে শুরু করতেই মুকুট কষে পা দিয়ে এমন ধাক্কা দিলো যে মান্যবর সঙ্গীটি ধরাশায়ী হয়ে গেল।

“ব্রাভো ভাইপো! ওর দিকে লক্ষ রাখ। আর প্রকাশকে ওপরে আসতে বল।”

“আচ্ছা কাকু।”

সবুজ সাহেব এবার শীলভদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কতদিন চালাচ্ছেন এই ব্যবসা?”

“কীসের ব্যবসা? আমি... আমি…” শীলভদ্র পালিত ভয়ে কুঁকড়ে গেছে।

“অনেক জারিজুরি খাটিয়েছেন। এবার থামুন। সত্যি কথাটা বলুন মিস্টার শীলভদ্র পালিত।” সবুজ সাহেব চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললেন। এর মধ্যে পেছনে প্রকাশ এসে দাঁড়িয়েছে।

“সাহেব কী করব বলুন।”

“প্রকাশ, ওদিকের খবর ঠিক আছে?”

“ইয়েস সাহেব। অপারেশন সাকসেসফুল।”

“শোনো, ওই যে মহামানবটি ধরাশায়ী হয়ে আছেন আপাতত ওর মুখোশটা টেনে খোলো। দেখো কে উনি?” একটা একপেশে হাসি হেসে সাহেব বললেন।

“এ কে সাহেব?” মুখোশটা এক ঝটকায় খুলে প্রকাশ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“ইনি হলেন এই যে প্রোমোটার সাহেব তার একান্ত সচিব শ্রীযুক্ত অশোক সামন্ত। এর সাথে আগে বোধহয় তোমার মোলাকাত হয়নি। “

“প্রকাশ, ওই বড় ব্যাগটা তোমার কনস্টেবলকে বল থানায় নিয়ে যেতে। আর মনে হচ্ছে, প্রোমোটার সাহেব আর তার এই সঙ্গীটিকেও চালান করা দরকার। তারপর করকানি দিও যাতে সঠিক কথা জানা যায়। ও... এর থার্ড ডিগ্রি দেওয়ার সময় আমাকে খবর দিও। শ্রীমুখ থেকে অনিন্দ্যবচন শোনার লোভটা সামলাতে পারছি না।”

বামাল সমেত শীলভদ্র আর অশোক সামন্তকে চালান করে সবুজ সেন ডাক্তারবাবুর ঘর থেকে বেরোতেই রামেশ্বরকে জড়সড় হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সেন সাহেবকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে দিলো।

“রামেশ্বর, ভয় পেওনা। আমি আছি। এখন চলি। তুমি ঘরে গিয়ে নির্ভয়ে ঘুমাও। বাইরে পাহারা এখনো আছে।” সবুজ সেন রামেশ্বরের পিঠে আলতো করে হাত দিয়ে বললেন।

 

গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে... মোবাইল বেজে উঠতেই সবুজ সেন তাকিয়ে দেখলেন

প্রকাশ।

“প্রকাশ ব্যবস্থা রেডি?”

“হ্যাঁ, সাহেব। আপনি যেমন বলেছেন সেরকম করেছি।”

“বসার ব্যবস্থা কোথায় করলে?”

“আমার চেম্বার লাগোয়া একটা এন্টি রুম আছে। বেশ বড় ঘরটা। এস আই নরেশ সব ব্যবস্থা করেছে। আপনারা কখন আসবেন সাহেব?”

“আমরা তিনটে নাগাদ পৌছাবো। আচ্ছা শোনো, রামেশ্বরকে আনার জন্য লোক পাঠিও।”

“সাহেব শামসুল চলে যাবে। ওই নিয়ে আসবে।”

“ওকে। বাই।”

“কাকু, তুমি অনুমান করেছিলে যে ডাক্তার ঘোষের বাড়ি শীলভদ্র যাবে?” মুকুট একরাশ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“অনুমান নয় ভাইপো ২০০ পার্সেন্ট শিওর ছিলাম।”

“কীভাবে?”

“এতদিন যখন কৌতূহল চেপে রেখেছিলে আর কয়েক ঘন্টা চেপেই রাখো মাই বয়। বিকেলেই সব রহস্যের উদঘাটন হবে।” এক অমলিন হাসি হেসে সবুজ সেন উত্তর দিলেন। মুকুট কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে লাগলো।

প্রকাশ ছেত্রীর এন্টি রুমটা আয়তনে বেশ বড়। সাত আটটা চেয়ার ছাড়া দুটো থ্রী সিটার সোফা রাখা হয়েছে ঘরে। সোফার সামনে একটা ছোট টি টেবিলে জল রাখা আছে। সবুজ সেন ঠিক তিনটের সময় মুকুটকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন। প্রকাশ ছাড়া লালবাজার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের আরো দুজন চিফ অফিসার ঘরে বসে আছেন। একজন রেবতী আচার্য এবং অন্যজন সোমনাথ চ্যাটার্জী। এছাড়া এস আই নরেশ পণ্ডা এবং আশীষ মিত্র হাইয়ার অফিসিয়াল এর পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। সবুজ সেন ঘরে ঢুকতেই সকলে দাঁড়িয়ে ওনাকে অভিবাদন জানালেন।

“বসুন সেন সাহেব। তারপর আপনিতো কেল্লামাত করে দিয়েছেন। এত বড় চক্রকে ধরে আপনি আমাদের বিরাট উপকার করেছেন। এখন আমরা উদগ্রীব হয়ে আছি আপনার থেকে পুরো ব্যাপারটা শোনার জন্য।”

“আমি একা না স্যার। আমার সাথে প্রকাশ এবং পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট না থাকলে সম্ভব হতো না।” মৃদু হেসে সবুজ সেন বললেন। এরপর প্রকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “রামেশ্বরকে এনেছ?”

“হ্যাঁ সাহেব। বাইরে বসে আছে।”

“আর...?” সবুজ সেন ভুরু তুলে প্রকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেই প্রকাশ উত্তর দিলো, “হ্যাঁ সাহেব তিনিও এসেছেন। হি ইজ ওয়েটিং ইন মাই রুম।”

কথার মাঝখানে রামেশ্বর ঘরের ভেতর ঢুকে এক কোণে জড়সড় হয়ে বসলো। এরপর যিনি ঢুকলেন তিনি ষাটোর্ধ এক সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তি। গায়ের রং গোলাপি ফর্সা। উচ্চতা আন্দাজ ছয় ফুট। পরনের পোশাক অতি সাধারণ। একটা আভিজাত্য চেহারার মধ্যে সুস্পষ্ট।

“বসুন।” সামনের চেয়ার দেখিয়ে সবুজ সেন বসতে বললেন।

সবুজ সেন একটু গলা ভিজিয়ে সোমনাথ চ্যাটার্জী আর রেবতী আচার্যের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন।

“আমার এই কেসের রহস্য উন্মোচনের আগে একটা ঘটনা বিবৃত করবো। তারপর আসল প্রসঙ্গে যাবো।। ডাক্তার অনুময় ঘোষ হত্যা রহস্যের পেছনে অতীত কালের একটা ঘটনা সম্পৃক্ত রয়েছে। অনুময় ঘোষের দাদুর একটি অবৈধ সম্পর্ক ছিল। মহিলাটি সম্ভবত বাইজি ছিল সেই সম্পর্কের একটি ছেলেও হয়েছিল। কিন্তু এই খবর পরিবারের অনেকেই জানতো না। পরবর্তীকালে কীভাবে জানিনা, ডাক্তার ঘোষের বাবা অম্লান ঘোষ জানতে পারেন। খোঁজ খবর করে সেই দাদার কাছে যান। দাদা তখন মুমূর্ষু। একটি বস্তিতে থাকে। তার আবার একটি মেয়েও ছিল। হতদরিদ্র অবস্থা। মা বাবাকে কিছু না জানিয়ে এক সকালে মেয়েটিকে নিয়ে নিজের বাড়ি আসেন। ইতিমধ্যে সেই দাদা মারা যান। আর দাদার যে মা ছিল তার মহামূল্য কিছু গয়না আর বহুমূল্যের বেশ কিছু মূর্তি ওই মেয়েটি সঙ্গে নিয়ে আসে। বহু বাকবিতণ্ডার পর মেয়েটি ডাক্তারবাবুদের পরিবারে স্থান পায়। তখন ডাক্তার ঘোষের বয়স ছিল ছয় কি সাত আর মেয়েটি বছর বাইশের। সেই আমলেও শুধু অর্থের কারণে মেয়েটির তখনো বিয়ে হচ্ছিল না। ডাক্তার ঘোষ ওকে দিদি বলেই জানতেন। কিছুদিন পরে ওর বিয়ে হয়ে যায় এবং যাওয়ার আগে সে তার ঠাকুমা অর্থাৎ অনুময় ঘোষের ঠাকুমাকে ওই মহামূল্য সম্পত্তি দিয়ে যায়। আর ঠাকুমা তাঁর স্বামীকে অর্থাৎ ডাক্তারের দাদুকে লিখিত শর্ত করিয়ে নেন যে ওই মেয়েকে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দেওয়া যাবে না। সেই মেয়ে অর্থাৎ যিনি ডাক্তার ঘোষের দিদি বলে পরিচিত তাঁর নাম কমলা চৌধুরী।”

নামটা শুনে প্রকাশ এবং মুকুট চমকে উঠল। সবুজ সাহেব একটু জল খেলেন। তারপর ঘরে বসা ওই আগন্তুককে উদ্দেশ্য করে বলেন, “উনি হলেন কমলা চৌধুরির পুত্র শ্রীযুক্ত রাজসিংহ চৌধুরী।” সারা ঘর স্তব্ধ হয়ে গেল।

মুকুট জিজ্ঞেস করল, “মানে? ইনি... রাজসিংহ চৌধুরী? সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।”

সবুজ সাহেব মুচকি হেসে জবাব দিলেন, “গোলমাল হবারই কথা। ইনি হলেন আসল রাজসিংহ চৌধুরী। আর যে রাজসিংহ চৌধুরী নাম ভাঁড়িয়ে প্রথম শীলভদ্রের কাছে যায় সে আসলে একটা ফ্রড। মূর্তি পাচারকারী একটা দুর্ধর্ষ ক্রিমিনাল গ্যাং এর মাস্টার মাইন্ডদের একজন।”

“কিন্তু সেন সাহেব, আমি একটা জিনিষ বুঝতে পারছিনা। রাজসিংহ চৌধুরী যে ডাক্তার ঘোষের দিদি কমলা চৌধুরীর ছেলের নাম এবং এনাদের নাড়ি নক্ষত্রের খবর ওই ক্রিমিনালটা জানলো কীভাবে?” সোমনাথ চ্যাটার্জী প্রশ্নটা করে সেনসাহেবের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

“ইয়েস স্যার, এটা একটা বিষয়। এই নকল রাজসিংহ চৌধুরী যার আসল নাম তুষার গোমস সে অনেকদিন ম্যানচেস্টারে থাকতো। আর ইনি অর্থাৎ আসল রাজসিংহ চৌধুরী বেশ কিছু বছর ম্যানচেস্টারে অধ্যাপনা করতেন। ওনার বিষয় ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি। সেই সময়ে এই তুষার গোমসের সাথে পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। তুষার অন্ধকার জগতের সাথে যুক্ত ছিল। যখনই রাজসিংহবাবুর থেকে জানতে পারে ওনার মায়ের বহুমূল্য কিছু মূর্তি ঠাকুমার থেকে অবশেষে ডাক্তার ঘোষের কাছে এসেছে তখন সেগুলোর প্রতি তার অসম্ভব লোভ জন্মায়। তারপর এই চাল খেলে। অবশ্য এখানেও আবার একটা ছোট্ট গল্প আছে। সেটা পরে বলব। এখানে এসে ডাক্তারের সম্পত্তিতে কমলা দেবীর ভাগের গল্প তৈরী করে। শীলভদ্রের কাছে যায় ইত্যাদি।”

“কি রাজসিংহবাবু ঠিক বলছি?” সবুজ সাহেব রাজসিংহবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন।

“একদম স্যার!” মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন রাজসিংহবাবু।

“কাকু তুমি কখন এগুলো বুঝতে পারলে?” মুকুট জিজ্ঞেস করে ওঠে।

“আমার সন্দেহ একটা হচ্ছিল। তাই আমি আবার রামেশ্বরের কাছে যাই। রামেশ্বর আলমারি হাতড়ে দলিল বের করে আমার হাতে দেয়। দলিলে কমলা চৌধুরী যে সম্পত্তির ভাগিদার তার কোনো উল্লেখই নেই। এবং শুধু তাই না, পুরো সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক যে ডাক্তার ঘোষ সেটা স্পষ্ট লেখা আছে। অনুময় ঘোষের দাদু, বাবার সইও আছে। তখন বুঝতে পারি যে এ এক গভীর জাল। তখন আমি আশীষকে সুরাটে খবর নিতে বলি। আশীষ পুরো খবর আমায় এনে দেয়।”

“ওকে সেন সাহেব এবার বাকিটা বলুন।” রেবতীবাবু বললেন।

“এবার একটু অন্য পর্বে আসি।” কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে সবুজ সাহেব আবার শুরু করলেন, “ডাক্তার ঘোষের বয়স হয়েছিল। তিনি এত সম্পত্তি নিয়ে মনে হয় সমস্যায় পড়েছিলেন। তখন সব বেচে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। রামেশ্বর ছিল ওনার অতি বিশ্বস্ত কর্মচারী। ওকে তাই বলেওছিলেন। ঠিক এই সময় ডাক্তার ঘোষের আগের কম্পাউন্ডার জগৎ বোস কাজে ইস্তফা দেয়। তখন বিজ্ঞাপন দেখে নৈঋত দাস আসে এবং নিযুক্ত হয়। এখানে একটু বলি যে এই যে জগৎ বোস, একে কায়দা করে সরানো হয়। তবে সেটা কীভাবে হয় জানি না। আর নৈঋত কিন্তু তুষার গোমসের নিযুক্ত লোক।”

“মাই গুডনেস! এ তো রীতিমত জাল বিছিয়ে এগিয়েছে।” রেবতীবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন।

“হ্যাঁ স্যার। গভীর জাল।”

“তারপর?”

“তারপর স্লো পয়জন বলে না! এ অনেকটা তাই। ডাক্তার ঘোষের ভালমানুষির সুযোগ নিয়ে নৈঋত ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে। এতটাই ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে যে ডাক্তারের মূল্যবান জিনিষ, কাগজ ইত্যাদি কোথায় থাকে তাও জেনে নিয়েছিল। এই নৈঋতই আর এক কালপ্রিট শীলভদ্র পালিতের সাথে ডাক্তারের যোগাযোগ করিয়ে দেয়।”

“শীলভদ্র পালিত! ইমন কল্যাণ এসোসিয়েটসের কর্ণধার?” সোমনাথবাবু প্রশ্ন করলেন।

“ইয়েস স্যার। তবে এই ইমন কল্যাণ এসোসিয়েটস আই ওয়াশ। শীলভদ্রও অন্ধকার জগতের মানুষ। সেও মূর্তিপাচারের সাথে জড়িত।”

“কিন্তু সাহেব, তুষার গোমস অর্থাৎ নকল রাজসিংহকে তো শীলভদ্র চিনতো না?” প্রকাশ জিজ্ঞেস করে।

“ঠিকই বলেছ প্রকাশ। তুষারকে শীলভদ্র চিনতো না। কিন্তু ওই চক্রে কাজ করতো। এই সব জগতে জানো তো প্রকাশ মাস্টার মাইন্ডদের সাথে সরাসরি যোগ থাকে না। ইভেন, একজন মাস্টারের সাথে অন্য জনেরও যোগাযোগ বিশেষ থাকে না। অন্তত এখানে তাই ঘটেছে।”

“মানে?” মুকুটের সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

“সে কথায় একটু পরে আসছি ভাইপো।” মৃদু হেসে সবুজ সাহেব বললেন।

“এবার শীলভদ্র ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে। নৈঋত ওর সাথী ছিল। শীলভদ্রের উদ্দেশ্য ছিল ফ্ল্যাট বানানোর নামে করে ডাক্তারের সম্পত্তি আত্মস্মাৎ করা। বিশেষ করে মূর্তি এবং গয়না।”

“কিন্তু শীলভদ্রের তো মূর্তির ব্যাপার জানা ছিল না!” মুকুটের প্রশ্নে সবুজ সেন বললেন,”জেনেছিল। নৈঋত বলেছিল। তুষারের লোক ছিল নৈঋত। তাই ও জানতো। আর এই ব্যাপারটা নৈঋত ফোনে শীলভদ্রের সাথে আলোচনা করছিল যা রামেশ্বর শুনতে পায়। আমাকে রামেশ্বর বলেছিল।”

“তাহলে তো রামেশ্বরের ডাক্তার ঘোষকে জানানো উচিত ছিল। রামেশ্বরও কি ওই দলের?” রেবতীবাবু বলে উঠলেন।

এই কথা শুনে রামেশ্বর ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল।

“রামেশ্বর ভয় পেও না। না স্যার, রামেশ্বর নিপাট ভালোমানুষ। ও যে শুনতে পেয়েছিল সেটা নৈঋত বুঝতে পারে। ওর দিকে একটা ঠান্ডা চাহনি দিয়ে চলে যায় এবং পরে রামেশ্বরের ফোনে চুপ করে থাকার জন্য হুমকি আসে। তবে ফোনের লোককে রামেশ্বর আইডেন্টিফাই করতে পারেনি। যাই হোক আবার আগের কথায় ফিরে আসি। শীলভদ্র প্ল্যান মাফিক এগোচ্ছিল। কিন্তু তুষার গোমস সশরীরে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে এবং কমলা চৌধুরীর গল্প ফেঁদে শীলভদ্রকে সমস্যায় ফেলে দেয়। এইসব চলাকালীন অর্থাৎ মৃত্যুর আগের রাতে অনুময় ঘোষের কাছে তুষার গোমসের ফোন আসে। এবং সম্ভবত ওনাকে ভয় দেখানো হয়। যদিও এই পার্টটুকু ডাক্তার ঘোষের ফোন কল চেক করে আমি অনুমান করি।”

“আচ্ছা কাকু শীলভদ্রের কাছে তুষার গোমস তো বলে যে সে কমলা চৌধুরীর ছেলে এবং শীলভদ্র যাতে ডাক্তার ঘোষের সাথে কাজের ব্যাপারে আর না এগোয় তার হুমকিও দেয়। তুষার গোমস এইটা করলো কেন?” মুকুট জিজ্ঞেস করল।

“এ ও সেই তৃতীয় রিপুর খেলা। অ্যাচুয়ালি ব্যাপারটা কী হয়েছিল শোনো। শীলভদ্র জানতো না এই তুষারকে। তুষার যদিও জানতো। যখনই সাক্ষাৎ করে তুষার জানতে পারল শীলভদ্র ভালোই দাঁও মারতে চলেছে তখন ওর জিঘাংসা প্রবৃত্তি চাড়া দিয়ে ওঠে এবং শীলভদ্র যাতে ডিলিংস থেকে সরে যায় তার চেষ্টা করতে থাকে। এদিকে নৈঋত আর শীলভদ্রেরও তৃতীয় রিপু লকলক করতে থাকে। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। পুলিশের চাপে তুষার সব স্বীকার করেছে এবং আমিও সেই সময় উপস্থিত ছিলাম। আসলে কী জানিস মুকুট, এই ধরণের ঘৃণ্য কাজের সাথে যারা লিপ্ত থাকে একই চক্র হলেও পরস্পর পরস্পরকে প্রতারণা করতে পিছপা হয় না। প্রয়োজনে নিজের দলের লোককে হত্যা করতেও হাত কাঁপে না।” সবুজ সেন একটু চুপ করলেন। সারা ঘরে পিন পতনের নিস্তব্ধতা।

“সেন সাহেব তারপর কী হলো?” সোমনাথবাবু মৃদু স্বরে আগের প্রসঙ্গে আসার জন্য জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ, স্যার, নৈঋত ডাক্তারবাবুকে ভালমানুষের মুখোশ পরে এমনভাবে বশ করেছিল যে, ইদানিং কালে ব্যাংকেটাকা জমা দেওয়া তোলা সব নৈঋতকে দিয়ে করাতেন। এবং সেই সুযোগ নিয়ে নৈঋত ব্যাংকের উইথড্রয়াল ফর্মে সই করিয়েটাকা তুলতো। আর এই টাকাগুলো তুলতো রাজেন বলে আরেকজন কালপ্রিট। আর একটা ব্যাপার, নৈঋত সই নকল করায় ওস্তাদ। অবশেষে অনুময় ঘোষের সই জাল করে ডাক্তার হত্যার পরেও কয়েক দফায় কুড়ি লাখ টাকা তোলে। আমি সেটা ডিটেক্ট করে ব্যাংকের ম্যানেজারকে সব জানিয়েছি।”

“রাজেন!” মুকুটের চোখে মুখে বিস্ময়বোধক চিহ্ন।

“হ্যাঁ রাজেন। মুকুট তোর মনে আছে নিশ্চই যে আমরা থানায় বা কোথাও গেলে একটা সাদা রঙের লোগান আমাদের ফলো করতো এবং তাতে এক মহিলা বসে থাকতো।”

“হ্যাঁ, কাকু।”

“সেই মহিলা হলো তুষার গোমসের মতন আর একজন মূর্তি পাচারকারী এবং ড্রাগ ব্যবসায়ীর মাস্টার মাইন্ড এমিলি ভদ্র। তার লোক হচ্ছে রাজেন, আরশাদ আর শীলভদ্র গোষ্ঠী। “

“ওরে বাবা এতো দেখছি বিরাট চেইন। শাখা প্রশাখা বিস্তার করে এগিয়ে চলেছে।” রেবতীবাবু মন্তব্য করলেন।

“তা বলতে পারেন।” সবুজ সাহেব হেসে জবাব দিলেন।

“কী সঙ্ঘাতিকভাবে এরা এই জঘন্য এবং দেশদ্রোহী কাজ দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছিল ভাবা যায় না।” প্রকাশ বললো।

“হ্যাঁ, আমাদের কাছেও খবর ছিল। কিন্তু সেন সাহেব যে দক্ষতার সাথে এই কুচক্রীদের সাথে মোকাবিলা করলেন ,এর জন্য সাহেবকে স্যালুট জানাই।” সোমনাথবাবু বললেন।

“নো মেনশন প্লিজ স্যার। আমি দেশের মঙ্গলের কথা ভেবে করেছি।” সবুজ সাহেব মাথা ঝুঁকিয়ে বিনয়ের সাথে কথাগুলো বললেন।

“কাকু এই এমিলি ভদ্র, তুষার গোমস তার মানে একসাথে কাজ করতো?” মুকুট প্রশ্ন করলো।

“না মুকুট। বললাম না, এই মাস্টার মাইন্ড রাও একে অপরকে চেনে না। তুষার গোমস অনেক পরে এমিলির সাথে যোগাযোগ করে। এখানে আর একটা ব্যাপার আছে। তুষার ভীষ্ম চৌধুরী নামের তার দলের আর একজনের মাধ্যমে এমিলির সাথে যোগাযোগ করে। তবে এই নামটাও রাজসিংহবাবুর ছেলের নামটাকে ধার করে দেওয়া হয়েছে। তাইতো রাজসিংহবাবু?” রাজসিংহবাবুর দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন সবুজ সাহেব। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন রাজসিংহবাবু।

“এর আসল নাম ব্রজেশ্বর। আমার এই দক্ষ পুলিশ অফিসার বন্ধুদের দুঃসাহসিক অভিযানের জন্যই এই সব তথ্য আমি পেয়েছি। এর ফলে রহস্য সমাধান করতে আমার খুব সুবিধা হয়েছে।” আশীষবাবু এবং নরেশ পণ্ডার দিকে তাকিয়ে হেসে সবুজ সেন বললেন।

“ওই আরশাদ, রাজেন এবং শীলভদ্রের মুখোশ টেনে খুলেছে আশীষবাবু এবং তার ফোর্স। ওরা মাদক দ্রব্য, বিভিন্ন দুর্মূল্য মূর্তি বিদেশে পাচার করার জন্য প্যাকিং করছিল। তখন পুলিশ গিয়ে হাতেনাতে ধরে। সেই সূত্র ধরে এমিলির হদিস পাওয়া যায়। অবশ্য এদের ধরার জন্য ডিপার্টমেন্টের ইনফর্মাররাও খুব সাহায্য করেছে।”

“এবার আমার একটা প্রশ্ন রয়েছে সেন সাহেব।” রাজসিংহবাবু বললেন।

“হ্যাঁ বলুন।”

“মামা অর্থাৎ ডাক্তার ঘোষের হত্যা কীভাবে হলো?”

“আসছি সে প্রসঙ্গে। তার আগে এই ব্যাপারটা একটু বলে নি। এমিলি ভদ্রর ছেলে রবিন ম্যানচেস্টারে থাকে এবং এই লোকটিও মায়ের কর্মজগতের সাথে যুক্ত। রবিন হচ্ছে এই গ্যাং এর আর এক মাস্টার মাইন্ড। সেই মূলত চক্র চালাতো। তুষার গোমসের মারফত সে অনুময় ঘোষের সব খবর পায় এবং পুরো প্ল্যান তৈরি করে। রাজসিংহ চৌধুরীর সাথে কোনো এক অনুষ্ঠানে আলাপ হয় এবং ওনার কাছ থেকেও কিছু খবর সংগ্রহ করে। যদিও এটা আমার অনুমান। কী রাজসিংহবাবু ঠিক বললাম কি?” বলে সবুজ সেন রাজসিংহ চৌধুরির দিকে তাকালেন।

“হ্যাঁ সেন সাহেব, ঠিক বলেছেন তবে তুষার গোমস ‘ওনার বিশেষ বন্ধু ‘ বলে রবিনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। এই রবিন ভদ্র আমাকে বলে যে তার ইতিহাসে ইন্টারেস্ট আছে আর বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের মূর্তির ব্যাপারেও খুব জানতে আগ্রহী। স্বভাবতই আমি যেহেতু এই বিষয়ের সাথে যুক্ত ও প্রায়ই আমার কাছে আসতো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে এত বড় ঘৃণ্য কাজ করে যাচ্ছিল বা প্ল্যান করছিল তা আমার স্বপ্নের ও অগোচর ছিল।” করুণ মুখে রাজসিংহবাবু জানালেন।

“তা তো বটেই রাজসিংহবাবু আপনি জানবেন কী করে!! আর তাছাড়া আপনি যাতে বিন্দুবিসর্গ জানতে না পারেন সেটুকু অভিনয় তো এই ধরণের কুচক্রী লোকেরা করবেই। যাই হোক, এবার শেষ পর্বে আসি। ডাক্তার অনুময় ঘোষ হত্যা রহস্য পর্ব।” সবুজ সেন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তারপর গলাটা একটু ঝেড়ে শুরু করলেন।

“ডাক্তারবাবুর ব্যাপারে একটা কথা সবার আগে আপনাদের জানাই। আর এটা জানতে আমাকে সম্পূর্ণ সাহায্য করেছে রামেশ্বর।” বলে সবুজ সাহেব এক ঝলক রামেশ্বরের দিকে তাকালেন।

“ডাক্তার অনুময় ঘোষ কিন্তু জমি, বাড়ি সব বেচে ফ্ল্যাট বানাতে চাননি। ওনাকে ফোর্স করা হয়েছিল।”

“মানে!” প্রকাশ আর মুকুট একসাথে বলে উঠলো।

“ইয়েস মাই ডিয়ার, এটাই সত্যি ঘটনা এবং এটা আমার অনুমান প্রসূত নয়।” সামান্য হাসলেন সেন সাহেব।

“ডাক্তারবাবুর ইচ্ছা ছিল বসত বাড়ি যেমন ছিল তেমন ই থাকবে শুধু জমি বেচে সেখানে ছোট একটা নার্সিং হোম করবেন যেখানে গরিব মানুষেরা সুচিকিৎসা পাবে। প্রথমে রামেশ্বরকে ওনার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা জানান। কিন্তু কীভাবে এগোবেন সেই বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে নৈঋত মঞ্চে অবতীর্ণ হয়। বলেছি না যে নৈঋত অদ্ভুত দক্ষতার সাথে অনুময়বাবুকে স্লো পয়জন করতে থাকে! তো তার ফলে ডাক্তারকে জমি বাড়ি বেচে ফ্ল্যাট বানাতে প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছিল।”

“আচ্ছা কাকু, একটু ইন্টারেপ্ট করছি। ওদের তো আসল উদ্দেশ্য ছিল ডাক্তারবাবুর মূল্যবান গয়না আর মূর্তি। তবে ফ্ল্যাট বানাতে রাজি করিয়ে লাভ কী হচ্ছিল?” মুকুট জিজ্ঞেস করল।

“মনে রাখিস মুকুট, শীলভদ্র পালিত কিন্তু প্রোমোটার আর ও ফ্ল্যাট, শপিং মল তৈরি করে। নার্সিং হোম তৈরি করার পারমিশন ওর নেই। এদিকে যেন তেন প্রকারেণ শীলভদ্রের সাথে যোগাযোগ করাতেই হবে নয়তো উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। তাই নৈঋত ডাক্তারকে জমি বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাট বানানোর সম্মতি আদায় করিয়েছিল। এদিকে তুষার গোমসও শীলভদ্র গোষ্ঠীর খেলা ধরে ফেলেছিল। তাই সে ডাক্তারকে ফোনে কমলা চৌধুরির নাম করে হুমকি দেয়। কিন্তু অনুময় ঘোষ মন থেকে এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। রামেশ্বরকে বলতেন। কেমন একটা সম্মোহনের মধ্যে দিয়ে চলছিলেন। মাঝেমধ্যেই নৈঋতকে মনের এই দোলাচলের কথা বলতেন। আসলে নৈঋতকে খুব বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। এদিকে নৈঋত অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং অবশ্যই ধূর্ত ফলে ও বুঝতে পারছিল যে আর দেরি করলে ডাক্তারবাবু মত পাল্টে ফেলবেন। সবটাই তো তৃতীয় রিপু থেকে উদ্ভূত। “

“তাই কি ভীষ্ম চৌধুরীকে রুগী হিসেবে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে এসেছিল?” প্রকাশ জিজ্ঞেস করল।

“একদম তাই। নৈঋত তুষারের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছিল আর সেটা করেছিল ফোনে। রামেশ্বর সেটা শুনেছিল। তখন রামেশ্বর ভয় পেয়ে এবং মালিকের বিপদ বুঝতে পেরে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। কারণ, নৈঋত রামেশ্বরের দিকে প্রখর নজর রেখেছিল।”

“রাতে তো নৈঋত থাকতো না। তখন তবে বলেনি কেন?” সোমনাথবাবু মন্তব্য করলেন।

“নৈঋত অনুময় ঘোষের অজান্তে বাড়িতে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিল এবং রামেশ্বরকে সেটা বলেছিল। রামেশ্বর ভয় পেয়ে চুপ করে যায়।” সবুজ সেন উত্তর দিলেন।

“এরপরের ঘটনা ক্রমান্বয়ে বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার যদিও আমি প্রমাণ জোগাড় করে তবে প্রকাশকে এবং রেবতীবাবু আপনাকে ফোর্স রেডি করতে বলি। অনুময়বাবু যখন শরীর খারাপ লাগছে বলে জল চান তখন নৈঋত কায়দা করে জলের বদলে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি যে ফ্রুট জুস দেয় তাতে হাই ডোজে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খেতে দেয়। সেটা খেয়ে ডাক্তার ঘোষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।” এই পর্যন্ত বলে সবুজ সাহেব থামলেন।

“কিন্তু কাকু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। শীলভদ্র জানতো না তো যে ডাক্তার ঘোষের দিদি আছে, সেটা কী করে সম্ভব হলো? নৈঋত তো জানতো? তুষার গোমস নিশ্চই বলেছিল?”

“শীলভদ্র প্রথমে জানতো না ঠিকই। তুষারের থেকে শুনে নৈঋতকে জিজ্ঞেস করায় নৈঋত তখন আসল ব্যাপারটা খুলে বলে। এবার শীলভদ্র, নৈঋত, আরশাদ আর অশোক সামন্ত মিলে একটা পরিকল্পনা করে। কিন্তু অনুময়বাবু শেষের দিকে কিছুতেই ফ্ল্যাট করতে রাজি হচ্ছিলেন না। নৈঋত এর সাথে বচসাও হয়। এর প্রমাণ রামেশ্বর এবং ডাক্তারবাবুর বাড়ির রাঁধুনি মঙ্গলা। তখন শীলভদ্রের সাথে পরিকল্পনা করে যে, ডাক্তারকে ধরাধাম থেকে না সরালে মূর্তি চুরির কাজ মসৃণ ভাবে হবে না। শীলভদ্র সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যার দিন রাত আটটায় ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। এদিকে সেই দিন সন্ধ্যায় নৈঋত সবার অলক্ষ্যে অনুময়বাবুর পাশের ঘরে চুপিসারে এসে অন্ধকারে বসে থাকে। শীলভদ্র যথারীতি আটটায় আসে। এবং সেটা কোনোভাবে নৈঋতকে জানায়। সেটা কীভাবে আমি জানি না। আমার অনুমান, অনুময়বাবু সেইসময় মিউজিক সিস্টেমে বাজনা শুনছিলেন এবং ঠিক আটটা নাগাদ সেটা বন্ধ করতে ওঠেন। শীলভদ্র ওদিকে রামেশ্বরকে নীচে আটকে রাখে ইত্যবসরে নৈঋত একটা ভারী নোড়া দিয়ে অনুময়বাবুর মাথায় আঘাত করে এবং ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি মারা যান। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও তাই বলছে। অনুময়বাবুর মতো একজন বিখ্যাত ডাক্তারের মৃত্যুতে পুলিশ বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে। আমাকে খবর দেওয়া হয়। আমিও মাঠে নেমে পড়ি। ফলত, এই পুরো চক্রের কাজ শ্লথ হয়ে পড়ে। মুকুট আমায় প্রশ্ন করেছিল যে শীলভদ্র ও তার সাগরেদ মূর্তি চুরির জন্য ডাক্তারের বাড়ি রাতে যাবে যে আমি জানলাম কীভাবে? তাইতো মুকুট?”

“হ্যাঁ, কাকু।”

“শামসুল এই ব্যাপারে আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য না করলে জানতেই পারতাম না। সব তো আর অনুমান করে হয় না। নৈঋত এর পেছনে ছায়ার মতো লেপ্টে ছিল শামসুল। ওই আমায় খবর দেয়। আর এর পরের ঘটনা তো সবার জানা।” সবুজ সেন চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে চুপ করে বসলেন।

“জানেন সেন সাহেব, এই গ্যাং শিলং, দিল্লি, মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল আর ওদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। আপনি অসাধ্য সাধন করলেন।” রেবতীবাবু প্রশংসাসূচক দৃষ্টিতে সবুজ সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন।

সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে সবুজ সেন খানিকটা আত্মগত হয়ে বললেন, “ষড় রিপুর বশিকরণ ক্ষমতা এতই প্রবল যে মানুষ তার বশে কখন যে বশীভূত হয়ে যায় যে তার তখন ভালো মন্দ জ্ঞান লোপ পায়। আর তৃতীয় রিপু মানুষকে তার মানবিক প্রবৃত্তি, সৌন্দর্য বোধকে শেষ করে ফেলে। না হলে এই রকম জঘন্য কাজে মানুষ লিপ্ত হতে পারে!” দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সবুজ সেনের ভেতর থেকে। ঘরের সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে। প্রবল ঝড়ে সব কিছু তছনছ হয়ে যাবার পর প্রকৃতি যেমন শান্ত, স্তব্ধ হয়ে যায় এই ঘরেও সেই স্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে।