ভদ্রলোক - দীপ ঘোষ

অলংকরণ : সুমিত রায়

স্যমন্তক মণিটা একটা পুরোনো কাঁচের কৌটোয় অনেকগুলো রঙিন মার্বেলের গুলির সাথে মিশে ছিল।

মিসেস বন্দ্যোপাধ্যায় মাসের প্রথম মঙ্গলবার ব্যাংকে পেনসন তুলতে যান। বয়স যদিও পঁচাত্তর পার হয়ে গেছে, তবুও মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায় চলে যাবার পরে সাগরিকা দেবী নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করেন। গত অনেকগুলো বছর ধরেই ফেরার পথে একবার করে পাড়ার মোড়ের পুরোনো জিনিসের দোকানে ঢোকা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

দোকানটা এই অভিজাত পাড়ায় সেই স্বাধীনতার আগে খুলেছিল কোন এক নেটিভ সাহেব। এখন বহু হাত ফেরতা হয়ে এক অবাঙ্গালি ব্যাবসাদারের অনেক ব্যবসার মাঝে টিমটিম করে চলছে এখনো। অন্ধকার কম পাওয়ারের টিমটিমে আলোর মাঝে সাহেবি আমলের দেরাজ- আলমারি-চেয়ার-টেবিলের ফাঁকে ছোটখাটো কত অদ্ভুত জিনিসই না পাওয়া যায়। পুরোনো চামড়ার দস্তানা, অদ্ভুত পুঁতির মালা, কাঠের ভীষণদর্শন মুখোশ, জং ধরা পুরোনো বাক্স, আদ্দিকালের খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন আরো কত কি! সাগরিকা দেবী এই দোকানে ঢুকলেই যেন নিজের ছোটবেলার কলকাতায় ফিরে যান।

বিকেলে দোকানের কাউন্টারে দাড়িয়ে থাকে বৃন্দা নামের মেয়েটি। অল্পবয়সী জিনস আর শার্ট পরা মেয়েটি যেন এই দোকানে সবথেকে বেমানান। হাতের ঝা চকচকে ইংরাজি পত্রিকা ছেড়ে ক্রেতাদের দিকে মন দেবার কোন ইচ্ছাই যেন তার নেই।

সাগরিকা দেবী একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার পুরনো ম্যাগাজিনের র‍্যাক হাতড়াতে থাকলেন—আজকের মেয়েগুলো! স্টাফ করা খরগোশটা এখনো কেউ কেনেনি, প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল ওটা পড়ে আছে পোর্সেলিনের ছোট্ট পুতুলগুলোর পাশে।

প্রতি মাসের মত এবারেও সাগরিকা দেবী খরগোশটাকে হাতে নিয়ে চোখ বুজে একটু হাত বোলালেন তার শুকনো খড়খড়ে হয়ে যাওয়া ফারে।

পাশের টেবিলে ডাই করা ছিল কিছু পুরোনো ‘দেশ’ আর ‘আনন্দলোক’। সেগুলো পেরিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন একটা পুরোনো কাঁচের ফুলদানী আর টেবিল ল্যাম্পের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ দুটোই নেড়ে চেড়ে দেখার পরে আবার নামিয়ে রাখলেন বৃদ্ধা। এগুলো রাখার মতো ভালো টেবিল তার ঘরে ফাঁকা নেই। এরপর বেশ কিছু পুরোনো মিলস এন্ড বুনের হলদেটে বই নেড়েচেড়ে একটা সুন্দর ছড়ির দিকে নজর গেল তাঁর। হাঁটুটা আজকাল মাঝে মাঝেই জবাব দিচ্ছে, কিন্তু চার অংকের দামটা দেখে আবার নামিয়ে রাখলেন সেটা। ঠিক তাঁর পরেই একটা কাঁচের কৌটোর মধ্যে অনেকগুলো রঙ বেরঙের মার্বেলের মাঝে স্যমন্তক মণিটা দেখতে পেলেন তিনি। নিচে কাগজে পেন দিয়ে দাম লেখা—১৮০ টাকা মাত্র।

সাগরিকা দেবী মোটা কাঁচের চশমার ভিতর দিয়ে বয়েমটাকে আলোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। শোয়ার খাটের পাশের ছোট টেবিলটায় দিব্বি লাগবে। মার্বেলের মাঝে মণিটা যেন আরো জ্বলসে উঠছে রামধনু রঙের আলোয়।

“বাহ! বেশ লাগছে তো! তাই না বৃন্দা?”

বৃন্দা ম্যাগাজিন থেকে মাথা না তুলেই কাঁধ ঝাকালো। বলিউডি অভিনেতার নতুন সিনেমার গল্পের টান এই অন্ধকার দোকানের পুরোনো আসবাবের থেকে অনেক বেশি।

“আমার টেবিলে ভালোই লাগবে বল?”

আবার কাঁধ ঝাকালো সে।

সাগরিকা দেবী বয়েমটা তুলে বৃন্দাকে দিলেন, সাথে দুশো টাকা। সে আনমনে বয়েমটার দিকে না তাকিয়েই সেটা একটা প্লাসটিকের ব্যাগে পুরে তুলে দিল সাগরিকা দেবীর হাতে, কুড়ি টাকা চেঞ্জ শুদ্ধু। দোকান থেকে বেড়িয়ে বিকেলের বাজার থেকে কিছু সবজি কিনে বাড়ী ফিরলেন মিসেস বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাড়ী ফিরে সাগরিকা দেবী ভালো করে স্যমন্তক মণিটা আর বাকি কাঁচের মার্বেলগুলো ধুলেন, কতদিন ধরে যে ওই বয়ামের মধ্যে ওগুলো পড়ে ছিল কে জানে! তারপর ভালো করে মুছে ওগুলো টেবিলের উপরে একটা রঙ্গিন প্লেটের উপর সাজালেন, পাশে রইল মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুরিতে তোলা ছবিটা, সেই ১৯৫৩ সালে বিয়ের পরেই যখন গেছিলেন।

সত্যিই মণিটা ভীষণ সুন্দর লাগছিল কালো টেবিলের উপর ল্যাম্পের আলোয়। রাতে অনেকদিন পরে সাগরিকা দেবী বড্ড আরামে ঘুমোলেন।

পরের শুক্রবার মিসেস মুখার্জি আর মিসেস সেন এলেন বিকেলবেলায়। প্রতি শুক্রবার পালা করে একেকজনের বাড়ি সন্ধেবেলা চা পানের আড্ডা বসে। মিসেস মুখার্জি চায়ে একটা চিনির কিউব নেন। মিসেস সেনের চিনি খাওয়া বারণ, তিনি ব্যাগে সবসময় স্যাকারিন রাখেন।

শোবার ঘরের দরজা থেকে স্যমন্তক মণিটার আলো ঠিকরে বসার ঘরের দেওয়ালে রামধনু রাঙা ছায়া তৈরি করছিল। মিসেস সেন সে দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা কি সাগরিকা?’

‘ওটা স্যমন্তক মণির আলো, দাঁড়াও তোমাদের দেখাই। এটা নাকি ছিল সূর্যদেবের কন্ঠহার। দ্বারকার সত্রাজিতের উপর খুশি হয়ে সূর্যদেব উপহার দেন ওনাকে। তারপর নানা গল্প জড়িয়ে আছে এটার সাথে। বিষ্ণু পুরাণ আর মহাভারতেও এর উল্লেখ আছে।’

মিসেস মুখার্জি মুখ ব্যাঁকালেন। এইসব রামায়ন মহাভারতের কুসংস্কার একদম পছন্দ নয় তাঁর। ‘কে জানে বাবা, এর থেকে আমাদের স্বপ্নার বিয়েতে দেওয়া আংটিটার হীরেটা অনেক ভালো ছিল। আমার উনি হীরেটা দুবাই থেকে অনেক খরচা করে আনিয়েছিলেন, বুঝলে? এটা তো দেখে ঝুটো পাথরের মত লাগছে।’

‘স্বপ্নার ডিভোর্স হয়ে গেছে শুনেছিলাম?’

‘হ্যাঁ, এখন ও ব্যাঙ্গালোরে একটা বুটিক চালায়।’

‘বাহ, খুব ভালো মেয়ে।’ মিসেস সেন চায়ে আরেকটা চুমুক দিলেন।

এরপর আলোচনাটা মিসেস সেনের নাতি সুদীপ আর তাঁর কলেজ এবং মিসেস মুখার্জির স্বামীর কোমরের ব্যাথার দিকে চলে গেল।

আটটা নাগাদ বন্ধু দুজন বিদায় নিলে সাগরিকা দেবী টেবিল পরিষ্কার করলেন। তারপর সোফায় বসে রোজকার মত গুনে গুনে ওষুধগুলো খেতে লাগলেন। একটা সাদা, একটা কালো ক্যাপস্যুল আর দুটো ছোট গোলাপি ট্যাবলেট।

ঠিক তখনই দরজার ঘন্টাটা আবার বেজে উঠল।

সাগরিকা দেবী দরজাটা খুললেন। সামনে দাড়িয়ে সুগঠিত শরীরের এক অনিন্দ্যসুন্দর যুবক। ঢেউ খেলানো এক মাথা লম্বা চুল কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। শরীরে সোনালী রঙের বর্ম, নিম্নাঙ্গেও বর্মের নিচ দিয়ে ধুতির মত করে কাপড় পরা। কোমরে তরবারি, পিঠে ধনুক। আর সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার, বাইরের আলোয় মনে হচ্ছে লোকটির গায়ের রঙ অদ্ভুত নীলচে।

‘নমস্কার।’ মিষ্টি হেসে বললেন মানুষটি।

‘নমস্কার।’ প্রত্যুত্তর দিলেন সাগরিকা দেবী।

‘আমি একটি অভিযানে বের হয়েছি।’

‘তাই?’ যতটা সম্ভব নিরাসক্তি দেখালেন সাগরিকা দেবী।

‘আমি কি ভেতরে এসে বসতে পারি?’

‘দেখুন, আমি একা মানুষ, যা বলার এখান থেকেই বলুন, দুঃখিত অচেনা মানুষদের ভিতরে আসতে বলতে পারি না।’

‘ঠিক আছে, আসলে আমি স্যমন্তক মণিটা খুঁজছিলাম, ওটা কি আপনার কাছে আছে?’

‘আপনার কাছে কোন আইডেন্টিফিকেশন কার্ড আছে?’ কঠিন মুখে বললেন সাগরিকা দেবী। রাতের বেলা বয়স্ক মানুষদের সাবধানে থাকার জন্যে কলকাতা পুলিশ বার বার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়।

তরুণটি একটু অপ্রস্তুত মুখে গেটের পাশে রাস্তার উপর দাঁড় করানো রথটির দিকে ফিরে গেল। এতক্ষণে সাগরিকা দেবী রথটিকে দেখতে পেলেন। বিয়েবাড়ি বা ভাসানের রথ নয়, চোখ ধাঁধানো কারুকার্য করা সোনালী রথ একটা। সামনে বিশাল চেহারার চারটি দুধ সাদা ঘোড়া। গড়ের মাঠের না খেতে পাওয়া হাড় জিরজিরে ঘোড়াগুলোর মতই নয় এদের চেহারা। তরুণটি রথের পিছন থেকে একটি ভাঁজ করা কাপড়ের টুকরো বের করে সাগরিকা দেবীর কাছে ফিরে এলেন।

কাপড়ের উপর লাল রঙ দিয়ে বড় বড় করে বাংলায় লেখা আছে – ‘দ্বারকা অধিপতি বাসুদেবপুত্র শ্রীকৃষ্ণ, যাদব সত্রাজিতের ভাই প্রসেনের হত্যায় অভিযুক্ত। নিজেকে নিরাপরাধ প্রমাণের জন্যে যাদবাধিপতি উগ্রসেনের অনুমতিক্রমে শ্রীকৃষ্ণকে স্যমন্তক মণি উদ্ধারের অভিযানের অনুমতি প্রদান করা হল।’ লেখাটির নিচে কাপড়ে একটি পায়ের ছাপ তোলা লাল রঙ দিয়ে।

সাগরিকা দেবী ছবিওয়ালা কোন আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে পাবেন ভেবেছিলেন। একটু চিন্তা করে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি তরুণটিকে ঘরের ভিতর আসতে বললেন।

শ্রীকৃষ্ণ বসার ঘরে সোফায় বসলেন। ঘরে ঢোকার আগে ধনুক ও তলোয়ারটি তিনি দরজার বাইরে রেখে এসেছিলেন। সাগরিকাদেবী রান্নাঘরে গিয়ে ফ্লাস্ক থেকে দু কাপ চা ঢেলে ঘরে নিয়ে এলেন।

কৃষ্ণ ততক্ষণে পায়ে পায়ে উঠে বসার টেবিলে রাখা মণিটার দিকে এগিয়ে গেছেন। ঘরের আলোয় বোঝা যাচ্ছে তাঁর গায়ের রঙ সত্যিই নীল। ‘এটা সেই স্যমন্তক মণিই বটে।’ মণির চোখ ঝলসানো আলো কৃষ্ণের নীল মুখের উপর পড়ে অদ্ভুত মায়াবি আভা তৈরি করছিল। তরুণটির মুখে পরিতৃপ্তির হাসি খেলে গেল। যেন তাঁর বহুদিনের সাধনার শেষ তিনি দেখতে পেয়েছেন।

‘দেবী, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি এই মণিটি সঙ্গে করে এখনি দ্বারকায় ফিরে যেতে চাই। বহুযুগ ধরে সবাই সেখানে আমার অপেক্ষায় আছে।’

‘অ্যাঁ?’

‘নিজেকে নিরাপরাধ প্রমাণ করার একমাত্র উপায় স্যমন্তক মণি উদ্ধার করে ফিরে যাওয়া। আমার অভিযান আজ সমাপ্ত হল।’

‘আপনাকে চা দিয়েছি। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

কৃষ্ণ ফিরে গিয়ে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে সোফায় বসলেন।

‘আমি খুবই দুঃখিত, পাথরটা আমি আপনাকে দিতে পারছি না।’ সাগরিকাদেবী একটু চিন্তা করে বললেন। ‘আমার শোবার ঘরের টেবিলে আমাদের ছবির সামনে ওটা খুব সুন্দর মানিয়েছে।’

‘আপনি কি এর বিনিময়ে কিছু চাইছেন? আমি আপনাকে সোনা দিতে পারি, অথবা অন্য মণি, হিরে, জহরত...’

‘না না,’ কৃষ্ণকে থামিয়ে দিলেন সাগরিকা দেবী। ‘আমি কিছুই চাই না। আমার পাথরটা পছন্দ হয়েছে, এটা আমি কাউকে দেব না।’

সাগরিকা দেবী তরুণটিকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন, ‘আপনার সাথে আলাপ করে ভালো লাগলো।’

ঘোড়াগুলো মুখ বাড়িয়ে সাগরিকাদেবীর উঠোনে রাখা ফুলের গাছগুলো খাবার চেষ্টা করছিল। রথটার চারিদিকে এর মধ্যেই বেশ ভীড় জমে গেছে। পাশের বস্তির যত ছেলে মেয়ে এসে জুটেছে।

তরুণটি কোমরের কাপড়ের থলি থেকে কিছু শস্যদানা বার করে ঘোড়াগুলোর মুখের কাছে ধরল। কিছু সাহসী বাচ্চা ঘোড়াগুলোর গায়ে হাত বোলাতে লাগল। খাওয়ানো শেষ করে কৃষ্ণ রথে উঠে রাশ ধরে টান দিলেন। বাচ্চাগুলো চিৎকার করতে করতে সরে গেল চারিদিকে আর তারপর দৌড়তে লাগল রথের পিছন পিছন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রথটা বড়বাজারের দিকে যানজটের মধ্যে হারিয়ে গেল।

সাগরিকা দেবী কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের ভিতর ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

এরপরের কয়েক সপ্তাহ একেবারেই নিরুপদ্রব কাটল। পরের বৃহস্পতিবার মিসেস সেনের সাথে তিনি মন্দিরেও গিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার মনে হয়েছিল, তরুণটির কথা বন্ধুদের বলবেনও, কিন্তু সাত পাঁচ ভেবে আর সেসব কথা তোলেননি।

সেদিন ছিল রবিবারের সকাল। উঠোনে দাঁড়িয়ে সাগরিকাদেবী ফুলগাছগুলোতে পোকা মারার ওষুধ স্প্রে করছিলেন আর আগাছা ছাড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ গলা খাকড়ানির শব্দে ফিরে তাকালেন। কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছেন। চুলগুলো আগের দিনের থেকে একটু এলোমেলো, তবে গায়ের সোনালী বর্মটা সূর্যের আলোয় যেন চোখ ঝলসে দিচ্ছে। পিঠে কাপড়ে মোড়া বড়সড় কিছু একটা শক্ত করে বাঁধা।

‘যাক তুমি যখন এসে পড়েছ তখন বুড়ো মানুষটাকে একটু সাহায্য করো দেখি বাছা।’

কৃষ্ণের হাতে আগাছা কাটার কাঁচিটা তুলে দিলেন সাগরিকাদেবী। ‘আজকাল নিচু হতে বেশ কষ্ট হয়। আগাছাগুলো কেটে বাগানের বাইরে ফেলে দিও।’

তরুণটি হাসি মুখে আগাছাগুলি সাফ করে দিল। ঘন্টাখানেক পরে কৃষ্ণ আর সাগরিকা দেবী ভিতরের ঘরের সোফায় এসে বসলেন। বাইরের রোদের তাপে কৃষ্ণ ঘেমে উঠেছিলেন। ‘চা খাবে? নাকি ঠাণ্ডা ফলের রস?’ সাগরিকাদেবী জানতে চাইলেন।

‘ঠাণ্ডাই ভালো।’ কৃষ্ণ জবাব দিলেন।

আগের হপ্তাতেই সাগরিকাদেবী কাঁচা আমের সরবত করেছিলেন। ফ্রিজ থেকে বরফ দিয়ে তাই দুই গ্লাস নিয়ে এলেন। বাইরে আবার বাচ্চাদের গলা শোনা যাচ্ছিল।

‘আজকেও রথে করে এসেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘অনেক দূর থেকে আসছো নিশ্চয়ই?’

‘তা বলতে পারেন, সত্যিই অনেক দূর।’

সাগরিকা দেবী বাথরুম থেকে একটা বড় বালতিতে জল ভর্তি করে কৃষ্ণকে ডাকলেন। কৃষ্ণ জলের বালতিটা উঠোনে ঘোড়াগুলোর সামনে রেখে এলেন।

‘তুমি নিশ্চয়ই সেই স্যমন্তক মণির জন্যেই আবার এসেছ?’

‘ঠিক বলেছেন, ওটা ছাড়া নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আর কোন উপায় নেই যে।’ কৃষ্ণ পিঠের কাপড়ে মোড়া বস্তুটা নামিয়ে টেবিলের উপরে রাখলেন। ‘এটা নারায়ণাস্ত্র। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে একবার ব্যবহার হয়েছিল। এটি নিক্ষেপ করার পরে এর থেকে আরো দশ হাজার তীর সৃষ্টি হয়ে শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়।’ কাপড়টা খুলতে খুলতে বললেন কৃষ্ণ।

কাপড়ের মধ্যে থেকে একটি অদ্ভুতদর্শন তীর বের হল। প্রায় তিন ফুট লম্বা তীরটির মুখের দিকে খাঁজকাটা চাকার মত কিছু একটা বসানো। সারা গায়ে অদ্ভুত কোন ভাষায় জড়িয়ে জড়িয়ে অনেক কিছু লেখা, সেগুলো থেকে অপার্থিব সবুজ আলো বিচ্ছুরণ করছে। সম্পূর্ণ ধাতুর তৈরি তীরটার বেশ ভালোই ওজন হবে বোঝা যাচ্ছে।

সাগরিকাদেবী তীরটা হাতে তোলার চেষ্টা করলেন একবার। ‘বাব্বা, বেশ ওজন তো, দেখে বোঝাই যায় না! আর চাকাটাও খুব ধারালো!’

‘একটি মহাযুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করে এই অস্ত্রের উপর, আমি ছাড়া মাত্র দুজন আর এই অস্ত্রের ব্যবহার জানে সারা পৃথিবীতে!’ কৃষ্ণের গলায় কি গর্বের ছোঁয়া পেলেন সাগরিকাদেবী?

‘তাহলে এটা সরিয়ে রাখাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’

‘আপনি এটা নিতে চান না?’ কিছুটা অসহায়ের মতই জিজ্ঞাসা করলেন কৃষ্ণ।

‘নাহে, ও আমার চাই না।’ সাগরিকাদেবী মাথা নাড়লেন। যদিও তাঁর মনে হচ্ছিল মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ত এই তীরটা খুবই পছন্দ হত। বসার ঘরের দেওয়ালে যে ঢাল-তরোয়ালের রেপ্লিকাটা আছে, তাঁর উলটো দিকের দেওয়ালে তীরটা বেশ ভালোই মানাতো।

কৃষ্ণ ইতিমধ্যে আবার তীরটা কাপড়ে মুড়ে ফেলেছেন। কিছুটা আশাহত অবস্থায় তিনি সোফায় বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলেন।

ইতিমধ্যে সাগরিকা দেবী সকালে বেলে রাখা ময়দা দিয়ে কিছু লুচি আর আলুর দম রেঁধে ফেলেছেন। প্লাস্টিকের কৌটোয় ন্যাপকিনের মধ্যে পুরে তিনি কৃষ্ণকে বেশ কিছু লুচি আর আলুর দম দিলেন। আর একটা ব্যাগে ঘোড়াগুলির জন্যে কিছু সবজি। কৃষ্ণকে এতক্ষণে একটু খুশি দেখালো। সাগরিকা দেবী দরজায় দাঁড়ীয়ে হাত নাড়তে লাগলেন যতক্ষণ না রথটা কলকাতার ভীড়ে মিলিয়ে না যায়।

সোমবারে সাগরিকা দেবী মিসেস মুখার্জির বাড়ি গেলেন। বেচারি বাথরুমে পা পিছলে কোমরের হাড় ভেঙ্গেছেন। এই বয়সে ফ্র্যাকচার হওয়ার কী যন্ত্রণা তা সাগরিকা দেবী জানেন। সাগরিকা দেবী একটু কেক বানিয়ে নিয়ে গেছিলেন মিসেস মুখার্জির জন্যে।

ফেরার সময় তিনি পোস্ট অফিসটা ঘুরে গেলেন। ভাগনি সোমাকে দিল্লিতে একটা চিঠি পাঠানোর ছিল। ইচ্ছে করলেই ফোন করে নেওয়া যায়, তবু সাগরিকা দেবী এই বিলাসিতাটুকু পছন্দ করেন।

পাড়ার মোড়ে এসে কি মনে করে সাগরিকা দেবী পুরোনো দোকানটায় আবার ঢুকে পড়লেন।

‘কেমন আছেন জ্যাঠিমা?’

বৃন্দার পরনে আজ একটা সুন্দর স্কার্ট, ঠোটে লিপস্টিক কি আগে কখনো ওকে পড়তে দেখেছেন? মনে তো পরে না! মেয়েটাকে বেশ মিষ্টি লাগছে। তার উপর যেচে কথা বলছে আবার!

‘ভালো আছি গো, তুমি কেমন আছো?’

‘চলছে। শুনুন না, দু-তিন সপ্তাহ আগে একটা লোক এসেছিল। সে ওই জারের মধ্যে যে মার্বেল গুলো ছিল, সেটা খুঁজছিল। আমি ওকে আপনার বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিলাম। আপনার কোন অসুবিধা হয়নি তো?’

‘না না, ছেলেটা খুব ভদ্র। আমার সাথে কথা হয়েছে।’

‘শুধু ভদ্র? কি দারুণ দেখতে সেটা বলুন! উফ স্বপ্নেই আর সিনেমার পর্দাতেই এমন ছেলে দেখতে পাওয়া যায়!’ চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বৃন্দা। ‘এমন ছেলের সাথে আমি যেকোন দিন পালিয়ে যেতে পারি।’

বইয়ের র‍্যাকে সুনীল গাঙ্গুলীর কিছু প্রেমের গল্প নেড়ে চেড়ে দেখলেন সাগরিকা দেবী। তারপর মনে পড়ল আগের বইগুলো এখনো পড়েই আছে, বইটা র‍্যাকে নামিয়ে রাখলেন তিনি।

বাড়ির দরজার সামনে কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে ছিল। পাড়ার বাচ্চাগুলো ঘোড়া আর রথের উপর উঠে মনের আনন্দে খেলছিল। ‘যাক, তুমি এসে পড়েছ, খুব ভালো হয়েছে। শীতের জামাগুলো বাক্সে ভরে আলমারির উপরে তুলে দিতে একটু সাহায্য করবে?’

পিছনের ঘরে কয়েকটা ভারি সুটকেসের মধ্যে জামাকাপড় গাদা করা ছিল। কৃষ্ণ যত্ন করে সেগুলি ভাঁজ করে সুটকেসের মধ্যে তুলে সেগুলি আলমারির মাথায় তুলে দিলেন। এরপর তারা দুজনে এক এক করে বাকি ঘরগুলি আর রান্নাঘর পরিষ্কার করলেন। কৃষ্ণের গালে একটা শুকনো কাটা দাগ দেখা যাচ্ছিল আর হাঁটার সময় তিনি বাঁ পাটা একটু টেনে হাঁটছিলেন। সাগরিকা দেবী ভেবেছিলেন একবার জিজ্ঞাসা করবেন কি হয়েছিল, কিন্তু সেটা হয়ত ঠিক ভদ্রতা হবে না ভেবে আর কিছু বললেন না। সারা বিকেল এইভাবে দুজনে ঘরগুলি পরিষ্কার করেই কাটিয়ে দিলেন।

সাগরিকা দেবী কাজ করতে করতে মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বললেন। কিভাবে বাষট্টি সালে তাদের সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছিল, স্বামী মারা যাবার পরে লাইফ ইন্সিওরেন্সের টাকায় কিভাবে বাড়ির লোনটা শোধ হয়েছে, প্রথম কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি এসে কেমন লেগেছিল, ছুটির দিনে গড়ের মাঠে আর সিনেমা দেখে তারা সময় কাটাতেন—এইরকম আরো কত কি।

কৃষ্ণ কথায় কথায় জানালেন তার মা দেবকীর কথা। কিভাবে দেবকীর প্রায় উন্মাদ ভাইয়ের হাতে ছোটবেলায় মারা যেতে বসেছিলেন তিনি। যাদববংশের রাজপরিবারের সদস্য কৃষ্ণের বাবা বাসুদেব। ছোটবেলা থেকেই কৃষ্ণ ও তার দাদা ছিলেন যথেষ্ট সাহসী ও বীর ও তাদের নানা রকম বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

এর মধ্যে দেখতে দেখতে ছটা বেজে গেছিল। ঘরের চারিদিকে বেশ গর্বের দৃষ্টিতে তাকালেন সাগরিকা দেবী, বেশ ভালোই পরিষ্কার লাগছে। দু কাপ চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলেন কৃষ্ণের সঙ্গে। আগেই ঘরের মাঝের টেবিলে একটা চামড়ার ব্যাগ এনে রেখেছিলেন কৃষ্ণ। ব্যাগটি খুলে এবার একটি সাদা রঙের পাথর বের করলেন তিনি।

‘শুধু আপনার জন্যে, অনেক খুঁজে নিয়ে এসেছি। যদি আপনি এর বদলে মণিটা আমায় দিতে রাজি থাকেন।’

সাগরিকা দেবী পাথরটা তুলে দেখলেন, একটা ক্রিকেট বলের মত আয়তন আর ওজন। ঘোলাটে সাদা রঙের বলের ভিতরে যেন এক তাল কুয়াশা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মাঝে মাঝে তার মধ্যে রূপালি বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। পাথরটার মধ্যে কেমন যেন একটা উষ্ণতা আছে।

পাথরটা ধরে থাকতে থাকতে কেমন যেন শান্তি অনুভব করলেন তিনি। যেন জগত সংসারে আর কিছুই পাওয়ার নেই তার। সব চাওয়া পাওয়া আজ পরিপূর্ণ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাথরটা নামিয়ে রাখলেন তিনি।

‘খুব সুন্দর।’

‘এটি পরশপাথর। কত লক্ষ মানুষ দানব দেবতা এর সন্ধানে বেড়িয়ে আর ফিরতে পারেনি। যেকোন ধাতুকে সোনায় পরিণত করার ক্ষমতা এর আছে। এছাড়াও অনেক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী এই পাথর।’ কৃষ্ণের গলায় গর্বের ছোঁয়া পাওয়া গেল। ‘তবে শুধু এই নয় আরো কিছু জিনিস এনেছি আমি আপনার জন্যে।’

এবার ব্যাগটি থেকে প্রমাণ মাপের একটি কালো ডিম বের করে আনলেন কৃষ্ণ। এত বড় ডিম কোনদিন দেখেননি সাগরিকা দেবী, তাছাড়া এই ডিমটা ওই ছোট থলের মধ্যে ধরল কি করে সেটা ভেবেও অবাক হলেন তিনি। কালো চকচকে ডীমটার মাঝে মাঝে বাদামি আর সাদা ছোপ। হাত বাড়িয়ে ডিমটাকে ছুঁলেন তিনি। সাথে সাথে মনে হল সাগরিকা দেবীর ঘাড়ের কাছের চুলগুলো যেন খাড়া হয়ে গেল। চোখ বন্দ করতেই তাঁর মনে হল তিনি পৃথিবী থেকে হাজার হাজার ফুট উপরে, মুক্ত, চারিদিকে মেঘের মাঝে উড়ে যাচ্ছেন অজানার উদ্দেশ্যে।

তিনি ডিমটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন, পরশ পাথরের পাশেই।

‘গরুড়ের ডিম। বহু দূরের এক পর্বতের মধ্যে থেকে নিয়ে এসেছি। হয়ত হাজার হাজার বছর পরে এই ডিম ফুটে একদিন জটায়ুর কোন জ্ঞাতি মহাপক্ষী বেরিয়ে আসবে।’

‘হুম, সেরকমই কিছু ভাবছিলাম।’ সাগরিকা দেবী বললেন।

‘আর সবার শেষে আমি এই ফুলটা এনেছি আপনার জন্যে।’ কৃষ্ণ থলেটি থেকে একটা ফুল বের করে তুলে দিলেন সাগরিকা দেবীর হাতে। একটি লাল টুকটুকে ফুল, দেখে মনে হচ্ছে যেন আগুন দিয়ে তৈরি।

ভয়ে ভয়ে সেটি হাতে নিলেন তিনি। ভীষণ নরম ফুলটা যেন সাগরিকা দেবীর হাতের মধ্যে মিশে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এলো। কোথা থেকে যেন সমুদ্রের ঝাঁঝালো বাতাস আর রোদের উষ্ণতা এসে পড়ল তাঁর মুখে। যেন তিনি বসে আছেন সমুদ্রের ধারের কোন বালুতটে। দূর থেকে কে যেন ডাকছে তাঁর নাম ধরে।

‘এটি স্বর্গের বাগানের পারিজাত ফুল। এই ফুল যার কাছে থাকে তাকে কোন অসুখ বা জরা স্পর্শ করতে পারেনা। যেকোন আঘাত সারিয়ে তুলতে পারে এই ফুল। আর শুধু তাই নয় যে এই ফুল ধারন করে সে হয়ে ওঠে চিরযৌবনা, অমর।’ সাগরিকা দেবী ফুলটি নাকের কাছে নিয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিলেন, কেমন যেন নেশা ধরানো মাতাল করা গন্ধ।

এক মুহূর্তের মধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন কে তাকে ডাকছে। এতো তাঁর স্বামীর গলা। মনে পড়ে গেল সেই বাইশ বছর বয়সে মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে পুরী যাবার কথা। কেমন সুন্দরী তম্বী ছিলেন তিনি সেই দিনগুলিতে। পুরুষরা পাশ দিয়ে যাবার সময় অন্তত একবার আড় চোখে না তাকিয়ে পারত না। কত খুশিই না ছিলেন তিনি সেই দিনগুলিতে।

তারপরেই তাঁর নজর গেল কৃষ্ণের দিকে। সুপুরুষ, বীর কৃষ্ণ, উদ্বিগ্ন মুখে শান্ত হয়ে বসে আছেন তাঁর সামনের চেয়ারে। ‘এই কটি জিনিসই আমি আনতে পেরেছি আপনার জন্যে। এগুলি সংগ্রহ করা খুব একটা সহজ ছিল না।’ কৃষ্ণকে দেখতে ঠিক যেন মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লাগছিল সাগরিকা দেবীর।

চমকে উঠে সাগরিকা দেবী ফুলটি নামিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর, পরশপাথর আর ডিমের পাশে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তিনটি আশ্চর্য বস্তুকে দেখলেন তিনি। তারপরে উঠে গিয়ে শোয়ার ঘরের টেবিলের উপরের প্লেটের ভিতরের মণিটার দিকে তাকালেন। স্বামীর ছবির পাশে মণিটাকে মানিয়েছিল বেশ। ছবিতে পঞ্চাশ বছর আগের তরুণ মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।

এরপর তিনি রান্নাঘরে গিয়ে আরো দুকাপ চা করলেন। চা নিয়ে ঘরে ফিরে এসে দেখলেন কৃষ্ণ চুপ করে একই ভাবে বসে আছেন। তিনি কৃষ্ণের চোখে চোখ রাখলেন, ‘ফুলটা ফেরত নিয়ে যাও। আমার মত বৃদ্ধাকে যৌবনের লোভ দেখিও না, এমন কাজ শালীনতার পরিচায়ক নয়।’ দম নেবার জন্যে একটু থামলেন তিনি। ‘তবে বাকি দুটো জিনিস আমি নিতে পারি। আমার শোবার ঘরের টেবিলে এই দুটো ভালোই লাগবে। তাছাড়া তুমি একটার বদলে দুটো জিনিস দিচ্ছো, সুতরাং তুমি আমায় ঠকাচ্ছো তাও বলতে পারছি না।’ কৃষ্ণের মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি থলের মধ্যে ফুলটা পুরে ফেললেন।

বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ দেবার জন্যে তিনি সবে মুখ খুলেছিলেন, কিন্তু সাগরিকা দেবী তাকে থামিয়ে দিলেন। এরপর দুজনে চুপচাপ চা শেষ করলেন। তারপর দুজনে শোবার ঘরে এলেন। টেবিলের উপর থেকে মণিটা তুলে কৃষ্ণ তাঁর থলেতে ভরে নিলেন। সাগরিকা দেবী প্লেটটা সরিয়ে সেই জায়গায় পরশপাথর আর ডিমটা রাখলেন। ডিমটা বারবার গড়িয়ে যাচ্ছিল বলে শেষে প্লেটটার মধ্যে সেটাকে রাখতে হল।

‘ভালোই লাগছে, কি বল?’

কৃষ্ণ সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ, বেশ মানিয়েছে ছবিটার পাশে।’

‘চলো বেরোবার আগে তোমায় কিছু শুকনো খাবার দিয়ে দি। বেশ কিছু কেক এনেছিলাম কাল।’

কৃষ্ণ আবার মাথা নাড়লেন।

‘তুমি চট করে বাথরুমে মুখ চোখ ধুয়ে নাও। আবার কতদূরে যাবে কে জানে! আমি ততক্ষণে খাবারটা প্যাক করে ফেলছি।’

কৃষ্ণ বাথরুমে ঢুকে যাবার পরে সাগরিকা দেবী ফ্রিজ খুলে কিছু কলা আর আপেল বের করলেন। কয়েক টুকরো কেক প্যাকেটে করে আর ফলগুলো একটা প্লাস্টিকের থলেতে পুরে তিনি কৃষ্ণের অপেক্ষা করতে লাগলেন। কৃষ্ণ বেড়িয়ে এলে তিনি তাঁর হাতে থলেটা তুলে দিয়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। বেরোনোর আগে তিনি কৃষ্ণের গালে একবার হাত বোলালেন, ‘তুমি বড় ভালো ছেলে, সাবধানে থেকো, দিনকাল ভালো নয়।’

কৃষ্ণ নিচু হয়ে তাঁকে প্রণাম করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সাগরিকা দেবী পিছিয়ে গেলেন। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ নীরবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে সাগরিকা দেবী টেবিলে বসে তাদের রাস্তায় ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে লাগলেন। শব্দটা মিলিয়ে যেতে চোখের কোণ থেকে নেমে আসা শীর্ণ অশ্রুধারা তাঁর গাল ভিজিয়ে দিল। এরপরের বেশ কদিন তিনি বাড়ি থেকে বের হলেন না।

পরের মঙ্গলবার পেনশন তুলে আবার তিনি পাড়ার পুরোনো জিনিসের দোকানে ঢুকলেন। দোকানের মেয়েটি নতুন। ‘বৃন্দার কি শরীর খারাপ?’ জিজ্ঞাসা করলেন সাগরিকা দেবী।

মহিলাটি মধ্যবয়সী। ‘কি আর বলব, আজকাল কার ছেলে মেয়ে সব। আগের হপ্তায় পালিয়েছে একটা ছেলের সাথে। ছেলেটা নাকি আবার রথে করে এসেছিল। যত্ত সব ঢং!’ খুব বিরক্তি সহকারে বললেন মহিলা। ‘দেখুন না, তারপর থেকে আমাকেই দোকানে বসতে হচ্ছে নতুন লোক না পাওয়া পর্যন্ত! কর্তার এই পুরোনো দোকান সামলাবার সময় নেই।’

‘বাহ! মনের মত মানুষ পেয়েছে তবে বৃন্দা।’ বললেন সাগরিকা দেবী।

‘হু, ওর জন্যে খুব ভালো সন্দেহ নেই, কিন্তু এই দোকানে বসে থেকে থেকে আমার কি কম সময় নষ্ট হচ্ছে!’

সাগরিকা দেবী কোন উত্তর না দিয়ে দোকানের পিছনের দিকে চলে গেলেন। একটা অদ্ভুত দর্শন পিতলের প্রদীপ চোখে পড়েছে তাঁর। সামনের দিকটা হাতীর শুঁড়ের মত বাড়ানো, মাঝখানটা চওড়া, আর পিছনে লম্বা হাতল। দেখে মনে হচ্ছে একটা চ্যাপটা চায়ের কেটলি। গায়ে একটা স্টিকারে দাম লেখা পাঁচশ পঞ্চাশ টাকা মাত্র।

সুনীল গাঙ্গুলীর প্রেমের গল্পের বইটার সাথে প্রদীপটা তুলে নিয়ে কাউন্টারে নিয়ে গেলেন তিনি।

‘বইটা দেড়শ আর সাড়ে পাঁচশ এই পুরোনো জিনিস্টার জন্যে। কি এটা বলুন তো? আজ সকালেই এসেছে আরো কিছু জঞ্জালের সাথে। পুরোনো কোন ধরনের চায়ের কেটলি হবে! পিছনে আবার উর্দুতে কি জানি লেখা আছে!’

‘এটা কেটলি নয়, এটা একটা প্রদীপ।’ বললেন সাগরিকা দেবী। তখনই চোখে পড়ল তাঁর, প্রদীপটার হাতলের সাথে দড়ি দিয়ে একটা পেতলের আংটি বাঁধা।

‘নাহ, আমাকে বরং শুধু বইটাই দিন।’ সাগরিকা দেবী বইটার দাম দিয়ে বেরিয়ে এলেন দোকান থেকে। বাড়ি ফেরার সময় তিনি ভাবছিলেন শোবার ঘরের টেবিলের ওপর এমনিতেও আর কিছু রাখার জায়গা নেই।

(নিল গেইম্যান-এর শিভ্যালরি অনুসরণে)